উনিশে ডিসেম্বর মরশুমের শীতলতম রাত – ৩

তার পর কয়েক বছর কেটে গেল। এই শেষ ক বছরে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের চক্রবর্তী বাড়িতে ঘটে যাওয়া সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল— দাপুটে, নীরোগ সুবলবাবুর অকস্মাৎ মৃত্যু।

ডাক্তার সার্টিফিকেট দিলেন ‘কার্ডিও-রেসপিরেটরি ফেলিওর’। সুস্থ-সবল মানুষটার হৃদযন্ত্র আকস্মিকভাবেই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল এক হাঁড় কাঁপানো শীতের সন্ধ্যায়। দিনটা ছিল উনিশে ডিসেম্বর! সে বছরের কলকাতা শহরের শীতলতম দিন। সেদিনই চক্রবর্তী পরিবারের বুকে নেমে এসেছিল মৃত্যুর কালো ছায়া— ‘কার্ডিও-রেসপিরেটরি ফেলিওর’।

পরবর্তীকালে এই মৃত্যু নিয়ে অনেক জল ঘোলা হয়েছিল চক্রবর্তী পরিবারে। সুরজিৎ, বন্দনা অনেক বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছিল চরম উৎকণ্ঠার সঙ্গে।

স্থানীয় থানা, লালবাজারের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ অফিসাররা দিনের পর দিন এসেছে, গেছে। কিন্তু কারুর কপালের ভাঁজ দূর হয়নি।

সুবল চক্রবর্তীর মতো একজন নীরোগ, মানুষ, যিনি কিনা মৃত্যুর ঘণ্টাখানেক আগেও স্বাভাবিক ছিলেন। কোথাও কোনো গোলযোগ ছিল না, হঠাৎই নাতির আঁকা তিনটে ছবি দেখে বুকে হাত দিয়ে চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন? এই অবিশ্বাস্য ঘটনা কি এত সহজে হজম হয়? তাঁর আদরের নাতিই শেষে কিনা হল তাঁর মৃত্যুর কারণ?

এই হিসেব আজও পুরোপুরি মেলানো যায়নি। সব হিসেব হয়তো পুরোপুরি মেলানো যায় না।

ঠিক কী হয়েছিল সেই সন্ধ্যেয়? পুলিশের বয়ানে উঠে এসেছিল এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

পুলিশ ইন্সপেক্টর অভিজিৎ ঘোষাল একটু ভিন্ন ধাচের মানুষ। প্রথম থেকেই এই মৃত্যু তার কাছে ঘোর রহস্যম্য বলে মনে হয়েছিল। মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের চক্রবর্তী পরিবারের এক বিশেষ সুনাম আছে শহরের বুকে। তাই এই মৃত্যু নিয়ে অহেতুক বিশেষ জলঘোলা হয়নি। আর সত্যি বলতে কী জল ঘোলা করার মতো তদন্তের সূত্র কিছু হাতেও ছিল না। সকলেই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল সুবলবাবুর এই মৃত্যু অকস্মাৎ হলেও স্বাভাবিক। থানা পুলিশের কচকচানি একসময় বন্ধ হল বটে, কিন্তু ইন্সপেক্টর ঘোষাল নিজের উদ্যমেই মাঝে মাঝে ও বাড়িতে আসতে যেতে লাগলেন। এটা ওটা প্রশ্ন করে মনের অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

এই যেমন, সেদিন সন্ধ্যায় বাইরের বৈঠখানায় বসে কথা হচ্ছিল সবার সঙ্গে। ইন্সপেক্টর ঘোষাল, সুরজিৎ, বন্দনা দেবী সবাই উপস্থিত ছিল। ডাকা হয়েছিল বাড়ির চাকর রামকৃষ্ণ মুন্সীকে। যাকে এ-বাড়ির সবাই রামুদা বলে ডাকে। অনেক পুরোনো লোক, স্বর্গত সুবল বাবুর বয়সের কাছাকাছিই বয়েস হবে তার। সে জড়সড়ো হয়ে সোফার একপাশে বসে ছিল। আর এই ঠান্ডাতেও ঘামছিল।

— কর্তাবাবু যখন মারা যান সেই সময় তুমি তো ওই ঘরেই ছিলে? তাই না? ইন্সপেক্টর ঘোষাল জানতে চায়।

এই প্রশ্ন শুনে রামুর জড়সড়ো ভাবটা কাটে না বরং বেড়েই যায় খানিকটা। সে মাথা নেড়ে সায় দেয়।

— ঘটনাটা ঠিক কী হয়েছিল মনে করে বলো তো?

রামু খানিকটা সময় নেয়। মনেমনে হয়তো ঝালিয়ে নেয় সেই সন্ধ্যের দুর্ঘটনার চিত্র। তারপর মিনমিনে গলায় বলতে শুরু করে—

তখন সন্ধ্যে ছটা হবে। কর্তাবাবু নিজের ঘরে বসে বই পড়ছিলেন।

— কোথায় বসে ছিলেন?

— আজ্ঞে?

— তোমার কর্তাবাবু কোথায় বসে ছিলেন? খাটে না চেয়ারে?

— আজ্ঞে ইজি চেয়ারে। সন্ধ্যাবেলা উনি খাটে উঠতেন না। সেকেলে মানুষ তো। খানিক আগেই হেঁটে ফিরলেন, আমায় চা করতে বললেন। আমি চা নিয়ে এসে দেখলাম উনি চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছু একটা বই পড়ছেন।

— বেশ তারপর? ইন্সপেক্টর ঘোষাল জানতে চাইল।

— আজ্ঞে তারপর আমি ধুনুচি নিয়ে ও-ঘরে এলুম। এ-বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা ধুনো দেওয়ার রেওয়াজ। গিন্নি মা চালু করেছিলেন। এখনও চলছে। আমি সারা ঘরে ধুনো দিচ্ছি, আশেপাশের বাড়ি থেকে শাঁখ বাজার শব্দ আসতেছে। এমন সময় দেখলাম বলাই ঘরের দোরে দাঁড়িয়ে, হাতে আঁকার খাতা।

কর্তাবাবু তাকে ভিতরে ডাকলেন। তারপরই হঠাৎ সব গোলমাল হয়ে গেল।

এই পর্যন্ত বলে রামু চোখের জল মুছল।

বন্দনা আর সুরজিৎ চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কোথায় যেন মারাত্মক কিছু একটা অশুভ ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। সুরজিৎ কাজেকম্মে বাইরে থাকে, কিন্তু বন্দনার মন কূ ডেকেছিল সেই প্রথম দিন থেকেই। এক অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপেছিল সেই হাতে খড়ির দিন থেকেই। বুকের ভিতর সেই অজানা অশুভ ইঙ্গিতের বোঝা সে বয়ে বেরিয়েছে এতগুলো বছর।

রামুকে চুপ করে যেতে দেখে, ইন্সপেক্টর ঘোষাল আবার খোঁচা মারল— তারপর কী হল?

এরপর রামু তার কাঁপা কাঁপা গলায় যা বলল, তা যেমন আশ্চর্য তেমনই অবিশ্বাস্য।

রামুর বয়ান অনুসারে—

বলাই দাদাবাবু ঘরে ঢুকেই তার দাদুর চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়াল। এমনিতেই সে শান্ত প্রকৃতির ছেলে। বয়সোচিত স্বাভাবিক উচ্ছলতা তার মধ্যে দেখা যায় না। আর সেদিন যেন তার চোখ-মুখ ছিল আরও শান্ত, আরও গম্ভীর।

নাতিকে জড়িয়ে ধরে সুবলবাবু বললেন— দুদিন আসোনি কেন দাদুভাই? আমার বুঝি তোমায় দেখতে ইচ্ছা হয় না?

— ছবি আঁকছিলাম যে। বলাইয়ের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

— দুদিন টানা ছবি এঁকেছ তুমি?

মাথা নেড়ে সায় দিল বলাই।

  নাতির চিবুকে চুমু খেয়ে, হাতের বইটাকে ভাঁজ করে সামনের টেবিলে রেখে হাত বাড়িয়ে ড্রয়িং খাতাটা হাতে নিলেন সুবলবাবু— কই দেখি! এত মন দিয়ে কী আঁকছিলে দাদুভাই? রামু বলেছিল, সুকল্পের আঁকা শেষ তিনটি ছবির দিকে তাকিয়েই কর্তাবাবুর চোখ-মুখের চেহারা পালটে যায়। এক অদ্ভুত আতঙ্কে বড় বড় চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন ড্রয়িং খাতাটার দিকে। তারপরেই বুকে হাত রেখে চেয়ারে এলিয়ে পড়েন। মারা যাওয়ার আগে দুবার ‘হিমু’ নামটা উচ্চারণ করেন। ব্যস তারপরেই সব শেষ। চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে বলাই কাঁদতে কাঁদতে পালিয়ে যায়। এ-ঘটনা তার বালক মনে এমন ছাপ ফেলেছিল, যে তার পর থেকে একটা ছবিও আর আঁকেনি সে।

রামুর চিৎকারে বন্দনা দেবী আর বাড়ির অন্য চাকর বাকরেরা এসে হাজির হয় সুবলবাবুর ঘরে। কিন্তু যা হওয়ার তখনই হয়ে গেছে। সুবলবাবুর দেহে প্রাণশক্তি তখন আর অবশিষ্ট নেই। তাঁর দেহ চেয়ারের উপর এলিয়ে আছে। দু’চোখ খোলা, দৃষ্টিতে স্পষ্টত আতঙ্কের ছাপ। নীচের চোয়াল খানিকটা ঝুলে গিয়ে মুখটা খানিকটা হাঁ হয়ে আছে। ও-মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে বুক কেঁপে ওঠে যেন। পাশে তিন পায়া টেবিলটার উপর একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। বইটার নাম ‘দ্য হাফ ম্যান’।

সুরজিৎকে খবর পাঠানো হলে, সে পরের দিন দুপুরের মধ্যে এসে হাজির হয়। ততক্ষণে বাড়িতে পুলিশি ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। যদিও ডাক্তার পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দিয়েছে নরমাল হার্ট ফেইল। ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেষ্ট। পুলিশের ডাক্তারেরও একই মত। তাই দেহ সৎকার নিয়ে কোনো গোল বাঁধেনি।

কিন্তু সুবল চক্কোত্তির এই হঠাৎ চলে যাওয়া, আর এই চলে যাওয়ার ধরন কেমন যেন গোলমেলে মনে হতে লাগল। ছেলেবেলা থেকে দৌড় ঝাঁপ, শরীরচর্চা করা পেটানো চেহারা সুবলবাবুর। নির্মেদ, নীরোগ। জীবনে ওষুধ খেতে দেখা যায়নি। এককালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের নির্দেশিত পুলিশের তাড়া খেয়ে কলকাতা ছেড়ে নানা জায়গায় বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাঁকে। নিজে হাতে বোমা বেঁধেছেন, গুলি ছুঁড়েছেন। চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরীর আদর্শে অনুপ্রাণিত সসস্ত্র রাজনীতি করেছেন বছরখানেক। দৌড় ঝাঁপ করতে পারতেন হরিণের মতো ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। তাঁর কিনা এমন মৃত্যু!

এদিকে বলাই, দাদা মশাইয়ের এভাবে চলে যাওয়া হয়তো মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। সে বেশিরভাগ সময় নিজের ঘরে বসে থাকে। এমনিতেই সে চুপচাপ। এখন যেন আরও মিইয়ে গেছে সে। কারুর সঙ্গে কথা বলে না, ছবি আঁকে না। চুপ করে বসে থাকে। তার আঁকা সেই শেষ তিনটে ছবি নিয়ে পুলিশ বেশ কিছুদিন ঘাঁটাঘাঁটি করেছে। কিন্তু কিছু উদ্ধার করতে পারেনি।

ছবিগুলো কোনোটাই খুব নিপুণ হাতের কাজ বলে মনে হয় না। তবে খুব জীবন্ত। তিনটি ছবিই পুরোনো কোনো বড় বাড়ির ছবি। পুরোনো আমলের দরজা জানলা, দালান, কড়িবরগা, কারুকার্য করা বড় বড় খিলান। খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যায় তিনটে ছবি হয়তো একই বাড়ির তিনটি আলাদা অংশের ছবি। প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা বড় লোহার গেট, গেটের মাথায় সিংহ, গেটের আশপাশের অংশ আগাছার জঙ্গলে অর্ধেক ঢেকে গেছে। গেটের ভিতরে আগাছা ভরা বাগানের মাঝখান দিয়ে একটা সরু রাস্তা মতো চলে গেছে। তার ভিতরে বাড়ির মূল অংশ।

পরের দুটো ছবি ওই বাড়িরই দুটো অংশ বলে মনে হচ্ছে। একটাতে দেখা যাচ্ছে একটা ভাঙাচোরা সিঁড়ি আর দোতলার বারান্দার খানিকটা অংশ। আর-একটা ছবিতে একটা বিশাল ঘর। তার মেঝেতে ছেঁড়া কার্পেট। একটা তক্তাপোশ, দুটো জলের কলসি, মেঝেতে রাখা কিছু বই। এছাড়া অত বড় ঘরে আর কিছুই প্রায় নেই। সিলিংয়ে কড়ি বরগা দেখা যাচ্ছে, আর দেখা যাচ্ছে খোলা জানলার বাইরে জঙ্গলের মতো অংশ। সেখানে একটা বড় ইঁদারা।

এই হল তিনটি ছবির বর্ননা। এই তিনটি ছবির মধ্যে বিশেষ কিছু লুকিয়ে আছে কি? থাকলে কী লুকিয়ে আছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক তিনটে ছবি। বালক শিল্পীর মনের কল্পনা বই তো অন্য কিছুই না। তাহলে ছবিগুলো দেখে সুবলবাবুর এমন ভাবান্তর ঘটল কেন। বুকে হাত দিয়ে এলিয়ে পড়লেন কেন? হার্ট ফেইলই বা কেন হল। কী এমন আছে এই ছবিতে? প্রশ্ন অনেক। কিন্তু উত্তর পাওয়া গেল না কিছুরই। তন্নতন্ন করে খুঁজেও সুবলবাবুর ঘরে এমন কিছুই পাওয়া গেল না, যাতে করে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। সুবল বাবুর পুরোনো বই কাগজপত্র যা অবশিষ্ট ছিল সব ঘেঁটে দেখা হল। কোনো মিসিং লিংকের হদিশ মিলল না।

বলাইকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল— এ ছবি কি সে মন থেকে এঁকেছে না কিছু দেখে এঁকেছে। দেখে আঁকলে কী দেখে এঁকেছে। হঠাৎ করে এই তিনটে ছবিই বা সে কেন এঁকেছে?

ছোট্ট জবাবে বলাই বুঝিয়ে দিয়েছে সে মন থেকেই এঁকেছে। মন থেকে সে আরও অনেক ছবি এঁকে ফেলে। কাজেই এ নিয়ে নতুন করে ভাববার বিশেষ কিছুই নেই।

এই নিয়ে তাকে আরও কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে, বলাই আর উত্তর দেয় না। চুপ করে ঘাড় গুঁজে বসে থাকে।

অবশেষে পুলিশ হাল ছাড়ে। হিসেব মেলাতে পারে না কিছুই। ওই যে বললাম সবসময় সব হিসেব মেলানো যায় না। সেই হাতেখড়ির দিন যেমন হিসেব মেলানো যায়নি, উনিশে ডিসেম্বরের সন্ধ্যায়ও তেমনই হিসেব মেলেনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *