উনিশে ডিসেম্বর মরশুমের শীতলতম রাত – ২

এর পরে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। চক্রবর্তী পরিবারে অনেক জল গড়িয়ে গেছে এই কবছরে। বলাই বড় হয়েছে। এখন তার নাম সুকল্প। সে এখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। অঙ্কন শিল্পে তার দক্ষতা বয়েসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সমান তালে। তবে কোনো বাঁধাধরা পথে নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে। কখনও কোনো আঁকার ইস্কুলে ভর্তি করা হয়নি সুকল্পকে। কারণ সুবলবাবুর তাতে মত ছিল না। সুরজিৎ-বন্দনাও তাঁর মতের বিরুদ্ধাচারণ করেনি কোনোকালে। তবে এতে বালক সুকল্পের শিল্প প্রতিভা নষ্ট হয়নি একফোঁটাও, বরং কোনো ধরাবাধা শিক্ষার পথে না হাঁটায়, এই প্রতিভার কুঁড়ি সাবলীলভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

একবার সুরজিৎ তার বাবাকে বলেছিল, “ভাবছি বলাইকে কোনো আর্ট স্কুলে ভর্তি করে দেব।”

সুবলবাবু ছেলের প্রস্তাবে জোরালো প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, “কোনো দরকার নেই সুরো! এমন কোনো আর্ট স্কুল নেই, যেখানে তোমার ছেলেকে আঁকা শেখাবে। ওকে আপাতত ওর নিজের খেয়াল খুশির মতো আঁকতে দাও। ধরাবাঁধা পথে শেখার দিন এখনও অনেক পড়ে আছে।

সুরজিৎ তার বাবার কথার প্রতিবাদ করেনি। করেও কিছু লাভ হতো না। এ-বাড়িতে এখনও সুবলবাবুই শেষ কথা বলেন। আর তাছাড়া সুরজিৎ জানে, তার বাবার বিচার বুদ্ধি, এখনও তাদের চেয়ে অনেক উঁচুতে। তিনি যখন এ-কথা বলছেন, নিশ্চয় তার কোনো কারণ আছে। এতে হয়তো তার ছেলের ক্ষতি না বরং ভালোই হবে।

সুরজিৎ এখন আর আগের মতো কলকাতায় আসতে পারে না। কাজের চাপ অনেক বেড়ে গেছে। মাসে একবার কী দুবার আসে শুধু, তাও দু-একদিনের বেশি নয়। ছেলে বলতে গেলে মা আর দাদুর কাছেই মানুষ হয়। কলকাতার নামী স্কুলে পড়ে। রেজাল্টও খারাপ করে না। তবে আসল শিক্ষা অবশ্য পায় দাদুর কাছ থেকে। আদর্শর শিক্ষা, জীবন মূল্যায়নের শিক্ষা। ইস্কুল থেকে ফিরেই আঁকার খাতা নিয়ে বসে পড়ে সে। তখন আর কোনো দিকে খেয়াল নেই তার, কারোর ডাকে সাড়া নেই।

 সে ছেলের কল্পনার দৌড় ছিল বিস্তর। হঠাৎ হঠাৎ এমন এমন বিষয়ের ছবি একে ফেলত, যা সে কখনও কোথাও দেখেনি। এই যেমন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রার ছবি, মিশরের পিরামিড বা মমির ছবি, পলাশীর আমবাগানে ইংরেজ সৈন্যের সঙ্গে নবাবী ফৌজের লড়াইয়ের ছবি বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে হিটলারের বৈঠক খানায় গোপন বৈঠকের ছবি। আর প্রতিটা ছবি এতই নিখুঁত আর জীবন্ত, যে সেগুলোর দিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। কে বলবে এই সব অসামান্য ছবির শিল্পী এক দ্বাদশবর্ষীয় বালক, যে কিনা জন্মাবধি কলকাতা শহরের বাইরে পা রাখেনি। পরে আবিষ্কার হয়েছিল, তার আঁকা সবকটা ছবিই কোনো না কোনো গল্প বলে। হাড় হিম করা রুদ্ধশ্বাস অজানা সেসব কাহিনি। পরে  শহরের অনেক উর্বর মস্তিস্ক ঘর্মাক্ত হয়েছিল এসব ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে নিয়ে। গবেষণা চলেছিল বিস্তর। কিছু উত্তর মিলেছিল, কিছু মেলেনি।তবে সে সব পরের কথা। এখন থাক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *