১
মাতৃ-জঠর থেকে বেরোনোর মাস কয়েকের মধ্যেই শিশুটির শিল্প প্রতিভা প্রকাশ পেয়েছিল আশ্চর্য রকমভাবে। সবাই বলত এ-ছেলে নির্ঘাত আগের জন্মে নামকরা কোনো আঁকিয়ে ছিল। জন্মান্তরের কালক্রমেও সে ক্ষমতা বিস্মৃত হয়নি। যে সব জিনিস জন্মে অবধি সে কখনও চোখে দেখেনি, সেসবই ড্রইং খাতায় ফুঁটিয়ে তুলত অবলীলাক্রমে। সকলে ধন্য ধন্য করত।
আর বাপ-মা গর্ব করে বলত, তাদের আদরের বলাই, মা সরস্বতীর আশীর্বাদ সঙ্গে নিয়েই ভূমিষ্ঠ হয়েছে। হাতেখড়ির দিন বলাইয়ের দাদামশাই সুবল চক্রবর্তী যখন তাকে কোলে নিয়ে মা সরস্বতীর বিগ্রহের সামনে বসে, তার হাতে চক-পেন্সিল ধরিয়ে নতুন কেনা শ্লেটের উপর দাগ কাটাতে উদ্যত হলেন, তখন ঘটে গেল এক তাজ্জব ব্যাপার। সে ছেলে তৎক্ষণাৎ সকলকে অবাক করে দিয়ে, তার কম্পিত শিশু হাতে নিপুণভাবে সেই শ্লেটের উপর ফুটিয়ে তুলল মা সরস্বতীর বাহনটির অবয়ব। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ ধরেই সে সামনে রাখা বিগ্রহের হংস বাহনের দিকে চেয়ে ছিল। তারই প্রতিফলন ঘটে গেছে শ্লেটের উপর।
এমন ঘটনা এর আগে কেউ কখনও দেখেওনি, শোনেওনি। সুবলবাবু হতভম্ব হয়ে তার নাতির মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। উপস্থিত সকলের চোখ ছানা বড়া। বলাইয়ের মা বন্দনা দেবী এই অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে কেঁদেই ফেললেন। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে পাথর হয়ে বসে রইলেন সোফার উপর।
পুরুত মশাই হঠাৎই ঘণ্টা ধ্বনি সহ সজোরে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। শাঁখ বেজে উঠল তাল দিয়ে। তাঁর ভাব দেখলে মনে হল, উত্তর কলকাতার মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের, চক্রবর্তী পরিবারের এই বৈঠকখানায় আজ দেবী স্বয়ং এই ক্ষুদ্র শিশুটির ভিতরে প্রকট হয়েছেন। শঙ্খ, কাঁসর ঘণ্টা, উলুধ্বনি আর উচ্চ গ্রামে মন্ত্রোচ্চারণ, এই চতুর্মুখী আক্রমণের ঠেলায় দেবশিশু বলাই কেঁদে উঠল ভ্যাঁ করে। পুজো শেষে সুবলবাবু ঠাকুরমশাইকে যথাযত দক্ষিণা দিয়ে খুশি করলেন। প্রসাদ বিতরণ শেষ হল। কিন্তু পরিবারের সকলের মনের অস্থিরতা কাটল না। কেউ বলল সাক্ষাৎ বাগ্দেবীর আশীর্বাদ পড়েছে এই শিশুর উপর। কেউ বা আবার চোখ গোল করে এই ঘটনাটিকে অলৌকিক ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করল। কেউ বা বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল ‘এ-ছেলে বড় হয়ে মোনালিসা-টোনালিসার মতো কিছু একটা একে জগৎ জোড়া নাম করবে’।
সুবলবাবু দৃঢ়চেতা মানুষ। এককালে শহরের বুকে দাপটের সঙ্গে ব্যাবসা করেছেন। বয়েসের ভারে দাপট খানিকটা কমলেও, চেহারায় খুব একটা ছাপ পড়েনি এখনও। আজও মেরুদণ্ড শক্ত। বাড়ির ঝিঁ চাকর থেকে শুরু করে, মায় ছেলে, ছেলের বউ পর্যন্ত সুবলবাবুর সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস পায় না। এই সুবলবাবু একসময় নকশাল আন্দোলনের একজন স্বক্রিয় সদস্য ছিলেন বলে শোনা যায়। যাদবপুর বিজয়গড় এলাকায় একচেটিয়া কাজ করতেন। পুলিশের এনকাউন্টার থেকে কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। তারপর বহু বছর আর তাঁর টিকি দেখা যায়নি। বেশ কয়েক বছর পরে, বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন অনেকটা সামলে উঠেছে, সুবলবাবু আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। ব্যাবসা শুরু করেন, সংসারী হন, এর পর থেকে আর কখনও রাজনীতির ছায়া মাড়াননি।
কাজেই সুবলবাবু যথেষ্ট দৃঢ়চেতা মানুষ। নাতির এই অস্বাভাবিক আচরণ তাঁর মনে বিশেষ কোনো রেখাপাত করতে পারে না। শুধু এটাই না, কোনো অপার্থিব বিষয়ই তাঁর মনে এখনও রেখাপাত করতে পারে না। তবে এ-কথা অস্বীকার করার উপায় নেই আজকের এই ঘটনা, তাঁর মতো মানুষকেও বাকরুদ্ধ করে ফেলেছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য।
কিন্তু বলাইয়ের বাপ-মা, ছেলের আচরণে শঙ্কিত। বন্দনার মন সেই সকাল থেকেই ভারাক্রান্ত। আঁচল দিয়ে বারবার চোখের জল মুছছে সে। এই অশ্রু বোধহয় আনন্দের নয়, আতঙ্কের। মায়ের মন, তার শিশু সন্তানের মধ্যে হয়তো ঐশ্বরিক প্রতিভা চায় না। চায়, স্বাভাবিক শিশুসুলভ আচরণ।
বন্দনার স্বামী সুরজিৎ কলকাতায় থাকে না। সে সরকারি জরিপ বিভাগের উচ্চপদস্থ অফিসার। চাকরির তাগিদে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে। বন্দনা তার এই শিশু পুত্রটিকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এই বাড়িতেই থাকে। মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের এই চক্রবর্তী পরিবারের তখন শহর জোড়া খ্যাতি। সুবল চক্কোত্তিকে এখন সবাই খাতির করে।
— তুমি শুধু শুধু এত চিন্তা করছ বউমা? আমাদের বলাই আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার মতোই স্বাভাবিক।
বন্দনা শ্বশুর মশাইকে রাতের খাবার দিতে ঘরে এসেছিল। সকাল থেকেই তার মুখ থমথমে। খাবারের থালাটা ঢাকা দিয়ে টেবিলের উপর রেখে সে বলল, “জানি না বাবা! এরকমটা তো চাইনি।”
সুবলবাবু উঠে জানলার গ্রিলটা ধরে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, “সবাই সব কিছু পায় না, আবার অনেকে এমন কিছু পেয়ে যায় যা সে চায় না।
বন্দনা খুব নরম মনের মেয়ে। খুব সাধারণ পরিবার থেকে লক্ষ্মীমন্ত বউমা পছন্দ করে ঘরে এনেছিলেন সুবলবাবু। তার বছর কয়েক আগে, তিনি নিজে বিপত্নীক হয়েছিলেন। ছেলে কাজেকর্মে বাইরে বাইরে ঘুরত। তখন কেমন যেন এক অসহ্য অস্থিরতা গ্রাস করেছিল তাঁকে। এত বড় বাড়িটা যেন হা করে গিলতে আসত। তারপরই ঠিক করে ফেলেন ছেলের বিয়ে দেবেন। বাড়িতে লোকসংখ্যা না বাড়ালেই নয়।
মাস কয়েকের মধ্যেই সুরজিতের বিয়ের সানাই বাজল। বন্দনা আসায় বাড়ির শ্রী ফিরে এল আবার। দেখতে দেখতে ঘর আলো করে ফুটফুটে নাতি এল।
এসবের মধ্যে এই অহেতুক অশান্তি। এমন এক অশান্তি, অনেক মাথা ঘামিয়েও যার ব্যাখ্যা মেলে না।
বন্দনা খাটের একপাশে দাঁড়িয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও চোখের জল ধরে রাখতে পারল না সে। সুবলবাবু এসে বউমার মাথায় হাত রাখলেন, “ভেঙে পড়ার মতো কিছু হয়নি মা। দাদুভাইয়ের এ ব্যাপারটা খুব একটা স্বাভাবিক না হলেও, এমন ঘটনা এর আগেও অনেকের ঘরে ঘটেছে। বিজ্ঞান আজও এর ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।”
বন্দনা শূন্য দৃষ্টিতে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুবলবাবু, তাকে আশ্বস্ত করতে বলে চলেন, “খবরের কাগজে এরকম খবর অনেক ছাপা হয়েছে। এক বছরের বাচ্চা বাঁশি বাজাচ্ছে, সঠিক তালে তবলা বাজাচ্ছে। কথা বলতে না শিখেই অজানা ভাষার শব্দ আওড়াচ্ছে… এরকম আরও অনেক। বড় বড় পণ্ডিতরাও এর কারণ বলে উঠতে পারেনি। কোন্ অদৃশ্য শিক্ষক, কোন সে জাদুবলে, কখন যে তাদের এই প্রতিভার দীক্ষা দেয় কে জানে।”
বন্দনা কোনো উত্তর দেয় না, নিঃশব্দে ঘর থেকে চলে যায়। সুবলবাবু অতটা দুর্বল হৃদয়ের মানুষ না, তিনি দীর্ঘ নিঃশাস ছেড়ে, খেতে বসে গেলেন। তখন কি আর তিনি জানতেন তাঁর আদরের নাতির এই অস্বাভাবিক ছবি আঁকার বিষয় একদিন তাঁর মতো মানুষের সুকঠিন হৃদয়েও নিদারুণ ধাক্কা দিয়ে যাবে। যদি জানতেন সে রাতে এমন নির্লিপ্ত থাকতে পারতেন কি?
বলাই তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। সুরজিৎ আর বন্দনা এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে তাদের ছেলের দিকে।
সুরজিৎ অনেকক্ষণ থেকে বন্দনাকে বলেছে অহেতুক চিন্তা না করতে, বড় হলেই এসব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলে যদি এখনই এমন আঁকতে পারে, এ তো আনন্দের কথা, বড় হয়ে নিশ্চয় নাম করা আর্টিস্ট হবে সে।
খাট থেকে নেমে জানলার কাছে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বলল, “ও আমার ঠাকুরদার বাবার জিন পেয়েছে। শুনেছি তিনি নাকি মুর্শিদাবাদের নবাবদের ছবি আঁকতেন। খুব নাম ছিল। আমাদের বংশের গোড়াপত্তন তো উনিই করেন। তুমি দেখো, আমাদের বলাইও একদিন ছবি এঁকে খুব নাম করবে। তুমি শুধু শুধু এত চিন্তা করো না বন্দনা।
বন্দনার মনের ভিতরের খচখচানি এতেও যায় না পুরোপুরি। দুই হাঁটুর উপর মুখ গুঁজে একমনে ছেলের দিকে চেয়ে থাকে সে। ফ্ল্যাশ লাইটের আলোর ঝলকানির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে সকালে পুজোর সময়ে ঘটা সেই অলৌকিক দৃশ্যগুলো, কানে বাজতে থাকে, সেই শঙ্খ ঘণ্টা কাঁসরের শব্দ।