উনিশশো ঊনআশিতেও – ৮

কিন্তু তখন গ্রামে গ্রামে সেই বার্ত্তা রটি গেল ক্রমে।

সেই ঘটনার পর থেকে একেবারে টপে উঠে গিয়েছিল বৃন্দে। শুধু এ গ্রামই নয়, নানাদিক থেকে লোক ছুটে আসতে শুরু করেছিল, দিকে দিকে সাগরপুকুরের ‘গুণীনমার’ নাম ডাক। ”সাগরপুকুর” বিখ্যাত হয়ে গেল বৃন্দের মহিমায়। … ষ্টেশনে ভিড় বাড়ে। আর রিকশাগুলোকে বললেই, সে বলে, ‘ঠিক আছে বুঝেছি।’

সেই সময় দুলোর বাপ ঘরবাড়ি বাগান পুকুর করল, উঠোনে টিউবওয়েল বসাল, মনের মত করে রান্নাঘর বানিয়ে দিল বৃন্দেকে।

পেশার জন্যে বার ব্রত উপোস তিরেস অনেক করত বৃন্দে কৃচ্ছ্বসাধনের অনেক নিয়ম নীতিও মানত কিন্তু সংসারটি পুরো বজায় রেখেছিল।

ভরের সময় ছাড়া সে ঠিকই আছে।

‘ভর’ হওয়ার বাড়বৃদ্ধির পর থেকে, বৃন্দেকে আর লোকের বাড়ি ছুটতে হত না, লোকই ছুটে আসত।…. এমন কি স্কুলের ছেলেমেয়েগুলো পরীক্ষার আগে! চণ্ডীর ফুল নিয়ে যেত, নিয়ে যেত চণ্ডীর সেবিকার ‘আশীর্বাদ।’

তা’ এ একটা খুব বিরল দৃশ্য নয়।

আমাদের এই পুণ্যভূমি ভারতবর্ষে প্রদেশে প্রদেশে, গ্রামে গ্রামে, যেখানে সেখানে, গাছ তলায়, বাঁশবনে এই সমারোহময় ভক্তির দৃশ্য দেখা যায়। একটা কিছু অলৌকিক শক্তির বার্তা পেলে হয়।…. আর আমাদের এই বঙ্গভূমিতে? সে তো বলে কাজ নেই। … আজ দেখলে কেউ কোথাও পেতলের থালায় দুটো চারটে পয়সা রেখে চোখ বুজে বসে আছে, কাল দেখলে তার সেই বোজা চোখের ক্যাপাসিটিতেই থালায় পয়সা ধরছে না। …অতঃপর মন্দির উঠল, দিনে দিনে সে মন্দিরের শ্রীবৃদ্ধি হতে থাকল, তারপর লোকের ভিড়ে অন্যলোকের রাস্তা চলা দায় হল।…. হয়ত ফলাও করে খবরের কাগজেও বেরোলো সেই বার্তা।

অহরহই এ দৃশ্য দেখা যায়।

মানুষ বিজ্ঞানের উন্নতি চরম সীমায় লক্ষ্যমাত্রা রেখে ছুটছে বলেই কি অলৌকিকের পিছনে ছুটবে না?

বৃন্দের ভাগ্যে তখন সেই মহালগ্ন এসেছিল।

দুলোর বাপ বলত দিনে দিনে তোর যা বোল বোলাও হতেচে বিন্দে, মন নিচ্চে তোকে নে কলকেতায় গিয়ে অ্যাকটা ঠাট বাট পেতে বসিগে।…তা’লে দালানকোটা বানিয়ে ফেলতি পারব।….

বৃন্দে উড়িয়ে দিত। বলতো শহরে বাজারের লোক এসবে বিশ্বে করে না কি? করেনি? বলতেতিস কি তুই? হুদো হুদো লোক আসতেচে না কলকেতা থেকে? ‘ডেলি প্যাসেঞ্জার’ বাবুদের আপিসের লোকই কত আসতেচে। তুই তো ভরে’ থাকিস কে আসতেচে যেতেচে খ্যাল করিস নাই।… তাই বলতেচি অ্যাকবার কলকেতায় নে গেলে—

বৃন্দের এতে তেমন সায় নেই। বৃন্দের বক্তব্য, এখেনডা হলো গে মায়ের থান। ঘটের পিতিষ্টে, এখেনছেড়ে ওন্যেত্তর গেলে কি আর মা উদ্দানী কেরপা করবে?

লোকটা বলত, আহা তোরে কি আর চাটি বাটি উঠিয়ে নে যেতে বলতেচি? কালীঘাটে মায়ের মন্দিরের চাতালে কি কোনো মোহাশ্মশানের ধারে কাচে, হপ্তায় দু’দিন গে বসলি। তাতেই দেকচি—

হপ্তায় দু’দিন কোরে আমি কলকেতায় ছুটবো? এডা—অ্যাকটা কতা হোলো। আর এই বাবুরা যে রোজ দিন ছুটতেচে। মেয়ে লোকও ছুটতেচে আজকাল। শয়োরের লোক বিশ্বাস নে আসে না। মজা দেখতে আসে পরীক্ষা করতে আসে।

তো পরীক্ষেয় তো পাশ হবি তুই। ফাষ্টো হয়েই পাশ দিবি।

বৃন্দে কেমন বিমনা হয়ে যেত।

বৃন্দের মনে হত এই তার বাঁশবন আর ফণী মনসার ঝাড়ের আড়ালে মনের মত ভিটেটুকু এই জোড়া নিমগাছ তলার কুঁড়েয় মায়ের ঘট পিতিষ্টে, এই শত শত ভক্তের পায়ের ধুলোয় পবিত্র হয়ে ওঠা উঠোন বাগান, এ সবের নড়চড় করলেই বুঝি বৃন্দে শক্তি হারিয়ে ফেলবে।…. আসলে যা কিছু করে বৃন্দে, আমি করছি, ঠিক এ বোধে করে না। যা করবে মা করবে মায়ের কি ইচ্ছে মা জানে এই সব বলে বলে অভ্যাস হয়ে গিয়ে মজ্জাগত হয়ে গেছে। তা ভয় হয় বুঝি ঠাঁই নাড়া হলেই বুঝি সব অন্যরকম হয়ে যাবে।

হায় তখন যদি বৃন্দে সেই মানুষটার হিত কথা শুনতো! তা হলে হয়ত আজ এমন দুর্দশায় পড়তে হত না তাকে। …. সেই ‘অন্যরকমই’ তো হয়ে গেল।

কে জানে কোন মহাভাগ্যের বলে বৃন্দের হাত দিয়ে মরা পর্যন্ত বাঁচালো মা, বৃন্দের অবস্থা ফিরিয়ে দিল, আবার কোন কুটিল ভাগ্যের ফেরে বৃন্দে সর্বস্ব হারিয়ে কাঙালিনী হয়ে গেল।….

ওই মানুষডাই ছেলো আমার সৌবাগ্যো।

মনে মনে ভাবে বৃন্দে।

ও হতেই আমার অ্যাতো বাড়বাড়ন্তি, অ্যাতো বোলবোলা।… ওরপরেই মা উদ্দানী এতো সদয় ছেলো ও মরার পর অবদি আমি সরবোস্বান্তো হলাম গো। হয়তো বৃন্দের কথাই ঠিক।

‘ভুজুদা’ নামের লোকটা বৃন্দের জীবনে খুব পয়া ছিল। তাই বৃন্দে ধূলো মুঠি ধরেছে সোনা মুঠি হয়েছে।

তবে—

ভুজঙ্গই ওই কালসাপিনীকে ঘরে আনার গোড়া।

বৃন্দে বলেছিল মেয়ে সোদ্দল বলে কি দুলো তোরে ধুয়ে জল খাবা?…. হেরোর আবস্তার ওই ছিরি। কিচু দেবেক থোবেক নাই।

ভুজঙ্গ হেসে বলেছিল, বেটার বোয়ের বাপের দ্যায়ায় থোওয়ায় পিত্যিসী তুই? তোর মা তোরে চেনে মেপে দেচ্চে না?

অস্বীকার করা যায় না কথাটা। অতএব—

অতএব যৌবন না আসতেই যুবতীর ধাক্কা ধরা রূপসী টগর, বৃন্দের বুকে জাঁতা বসাতে, এ সংসারে এসে প্রবেশ করলো।

ছেলের বৌকে প্রথম প্রথম ভুজঙ্গ খুব আদর যত্ন করেছিল, ‘ছেলেমানুষ’ ভেবে মায়াও করেছিল, এবং তাকে তার ‘শাশুড়ীর মহিমা’ সম্পর্কে অবহিত করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝলো, এটি কি বস্তু।

শ্বশুরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, পরিবারের লোকঠকালে ব্যবসা হতে সৌউর আমার বড়লোক বোলে প্যায়ে তো, তাই অ্যাতে ভোক্তি।….

তা কী আর করা?

একদিনে তো আর টগর বিষবড়ি খাইয়ে মারেনি শাশুড়ীকে? বড় হয়েছে, তিন তিনটে মেয়ের মা হয়েছে, এবং কেমন করে যেন বৃন্দের পাতানো সংসারখানাকে নিজের মুঠোয় ভরে ফেলতে শুরু করেছে। সেই সময় ভুজঙ্গ মারা গেল। দুম করেই গেল। চোখেকানে দেখতে দিল না বৃন্দেকে।

আর সেই শুরু হল টগরের পাড়া বেড়ানো।

অর্থাৎ বিষ ছড়ানো।

‘নিজের সোয়ামীকেই যে আকতে পাল্লোনি, সে জেবন বাঁচাবে ওন্যের? ক্যানো তোর জড়িবুটি গ্যালো কোতা? তোর উদ্দানী মা? হুঁঃ। সব ভুজুং।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *