উনিশশো ঊনআশিতেও – ৭

দুলোর বাপ দূর থেকে দৃশ্যটা দেখেছিল।

সে তো অচ্ছ্যুৎ। সে তো আর পাঁচটা ভদ্রলোকের গায়ে গা দিয়ে দাঁড়াবে না। দূর থেকে দেখছে বৃন্দেকে মালা গলায় দিয়ে পাটের শাড়ি পরিয়ে কর্তা গিন্নী ছেলে বৌ সবাই প্রণাম করছে।

কী রোমাঞ্চ!

কী অদ্ভুত আবেগ উল্লাস!

বৃন্দে ঘরে ফেরার পর বোকাবোকা গলায় বলেছিল লোকটা, এখন তোর গায়ে হাত দিতি আমার ভয় নাগচে। মন নিচ্চে তোতে বুজি মা ‘রুদ্দানী চোণ্ডীর’ ভর হইচে। তো কেমন করি কী কল্লি বল দিকি?

বৃন্দে বলেছিল, আমার বোদ নাই।

আজ পর্যন্তও বোদ নাই।

তা’ বোধ নেই বোধহয় সত্যচরণেরও।

নইলে বৃন্দের ছেলের বৌ যখন বৃন্দের নামে যথেচ্ছ অপবাদ দিয়ে দিয়ে তার ‘গুণ ফাঁস’ করে দিয়ে দিয়ে গ্রামের লোকের মন ঘুরিয়ে উল্টোমুখো বহাতে সক্ষম হয়েছে, তখনও সত্য নিজ বিশ্বাসের মত অবিচল আছে।

সে বোঝে বয়েস হয়েছে, এখন ক্ষমতা গেছে তা’বলে চিরদিনই বৃন্দে লোক ঠকিয়ে রেখেছে, একথা বিশ্বাস করতে নারাজ সে।

মুখুয্যে বাড়ির এই ঘটনার সময় হারু বাগদির মেয়ে টগর বালিকা মাত্র, দুলোর সঙ্গে মোলাকাতও ছিল না, তবু পরে দুলোর বৌ হয়ে এসে বলে বেড়ালো, উতো ওর নিজের কুকীর্তি! নিজে ‘বাণ’ মেরে বাচ্চাডারে খতম করে একে তৎপরে নোক সমাজে ঘটাপটা দেইকে বাঁচা করাল।

বাবুদের বাড়ি থে নিজেরা কেউ উকে ডাকতে এয়েছেলো? কোন্নোটা না। উয়ারই যড়করা লোক লোক গে খবোর দেচনো। বাণডা মোকখোম ছেলো, তাই সিটারে তোলা করাতে অত ঝালপিটাপিটি।

বালিকা ছিল টগর তখন।

তা’ পদ্মও তো এখন বালিকা! সাপের চেয়ে সলুইয়ের বিষ বেশী।

বাপের সঙ্গে এসেছিল টগর।

হারু ফিরে যেতে যেতে বলেছিল, তাজ্জবডা দ্যাকালো বটে গুনীনমা।

মেয়ে ঠোঁট উল্টে বলেছিল, ছেলেডা মরে নাই। শুধু ভিমরি গেছল। মলে আর বাঁচাতি হতনি।

ডাগদারে তো ঝেড়ে জবাব দে গেচলোরে।

দেককা যাক না ক্যানে। ঠিক দ্যাকে নাই। মানুষ জেয়ন্তোরে মাত্তি পারে, মড়ারে জেয়ন্তো কত্তি পারে।

বালিকা টগরের মুখে কথাটা হয়তো বেশী দার্শনিক শুনিয়েছিল। কিন্তু পদ্মও তো বালিকা। সাপের চেয়ে সলুইয়ের বিষ বেশী।

সত্যভাষিনী টগর পরবর্তী জীবনে, তার কথার সত্যতা প্রমাণ করেছে। জেয়ন্তোরে মারতে সক্ষম হয়েছে সে নিজেই। বৃন্দের জ্বলজ্বলাট গৌরিবমূর্তিটিকে সে ক্রমেই মৃদু বিষ প্রয়োগে জীর্ণ করে ধ্বংস করে ছেড়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *