উনিশশো ঊনআশিতেও – ৬

দুর্গাপূজোর ষষ্ঠির সকালে মা দশভুজা যখন দালান আলো করে বিরাজমান, তখন কিনা রোল উঠল, রাতের মধ্যে কখন কর্তার তিন বছরের নাতিটা মরে তক্তা হয়ে আছে। মা ওঠাতে এসেছে নতুন জামা পরিয়ে কলা—বৌ নাওয়ানের সঙ্গে পাঠাবে বলে। বার উঠোনে ঢাকী—ঢুলিরা সেইমত ড্যাডাং ড্যাং করে ঢাকে কাঠি দিয়েছে, ঠাকুর দালানে নবপত্রিকার তোড়জোড়, হঠাৎ এই নিদারুণ সংবাদ।

থেমে গেল বাজনা বাদ্যি, উঠলো কান্নার রোল।

কর্তা উন্মাদের মত ছুটে গিয়ে দালানে উঠে প্রতিমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে করতে চীৎকার শুরু করে দিলেন, বল সর্বনাশী। বল কেন এমন কাজ করলি?

ইতিমধ্যে অন্যান্য জ্ঞাতির পাঁচ বছরের ছেলের মৃত্যু অশৌচ, ক’পুরুষ পর্যন্ত লাগে। পূজোর দিনগুলো তো তা হলে গেল। আর বলাবলি করছিল, ভয়ঙ্কর একটা কোনো অপরাধ ঘটেছে।

কিন্তু মা কি এমনই প্রতিহিংসা পরায়ণ হবেন?

শাস্ত্রে পুরাণে অবশ্য দেখা যায়, দেবদেবীরা মানুষের থেকে অনেক বেশী প্রতিহিংসা পরায়ণ, তাই বলে মা দুর্গা?

এই মুখুয্যে বাড়ির ঠাকুর দালানে যিনি তিনপুরুষ ধরে পূজিত হয়ে আসছেন ত্রুটিহীন আয়োজনে, চ্যুতিহীন নিষ্ঠায়।

ডাক্তার এসে তো রায় দিয়ে গেল।

কিন্তু ইত্যবসরে যে কে বা কারা, হয়তো বাড়ির ভৃত্যকুল, ডেকে নিয়ে এসেছে ‘গুনীনমাকে।

গুনীনমার তখন ভাগ্যরবি মধ্যগগনে। এই মানুষই তো এই ক’বছর আগে বাদুলে মেয়ে দিদিমনির বিয়েতে শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি বন্ধন করেছিল। এ বাড়িতে বৃন্দের বরাবরই আসা যাওয়া।

বাসিমুখে ছুটে এসেছিল বৃন্দে।

কিন্তু নিজেই জানে না বৃন্দে কী হয়েছিল।

আজ পর্যন্তই জানে না।

সেদিনের ঘটনা তার কাছে চির রহস্যাবৃত।

বৃন্দে জানে না সে কী করেছিল, তবে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা দেখেছিল, ঠাকুরদালানের নীচের বিরাট উঠোনের মাঝখানে খড়ির গণ্ডিকাটা খানিকটা জায়গায় মাঝখানে বড় বড় ক’খানা আঙ্গুট কলাপাতার উপর শোওয়ানো সেই মৃতদেহটার ধারে মাথা খুঁড়ে রক্ত গঙ্গা হয়েছিল বৃন্দে, আর সেই খড়ির গণ্ডি ঘুরে ঘুরে একটা মেটে কলসী ভরা মন্তরপড়া জল থেকে আঁজলা ভরে ভরে ছেলের মুখে গায়ে আছড়ে আছড়ে মারছিল।

গুনীনমা যে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করে একাজ করছে, দর্শকরা অনুভব করছিল। সেই অনেক দর্শকের মধ্যে সত্যচরণও একজন ছিল। যুবক সত্যচরণ।

অবিশ্বাস আর উত্তেজনা, এই ছিল দর্শকদের মধ্যে।

ছেলের তরুণী মা কোথায় কোনখানে জ্ঞান হারিয়ে পড়েছিল কে জানে, যুবক বাবা ঠাকুর দালানের নীচের সিঁড়িটায় দু’হাতের মধ্যে মাথাটা চেপে বসেছিল, আর ঠাকুরদা প্রতিমাকে ঠেলে নড়াতে না পেরে ক্লান্ত হয়ে এসে উঠোনে এই দৃশ্যের ধারে এসে বসে পড়েছিলেন। শুধু ঠাকুরদা, মুখুয্যে গিন্নী স্থির হয়ে চোখবুজে বসে জপ করে যাচ্ছিলেন। এতোলোক জমা হয়েছিল, এবং বিশেষ কারো মধ্যেই বিশ্বাসের ভাব ছিল না তবু জায়গাটা নিঃশব্দ নীরব ছিল। কেউ একটি শব্দ উচ্চারণ করছিল না।

শুধু মাঝে মাঝে গুনীনমার তীব্র তীক্ষ্ন চীৎকার মা! মা!…. ক্রমশঃ গলাটা ভেঙ্গে আসছিল।

বাড়ির বাইরে অনঙ্গ ডাক্তার কিছু লোকের কাছে বলছিল আর কতক্ষণ এ ফার্স চলবে? এবং যে বড় ডাক্তার ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করেছিলেন, তিনি বৈঠকখানায় বসে ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ লিখে বিরক্ত চিত্তে বসেছিলেন কর্তাদের কাউকে দেখতে না পাওয়ায়।

হঠাৎ কী একটা ঘটল কে জানে।

তুমুল একটা কলরোল যেন আকাশ ছাপিয়ে অসীম শূন্যলোককে বিদ্ধ করল। ওটা সমবেত কণ্ঠের একটা জয়ধ্বনি।

হয়ত তার ভাষাটা ছিল, ‘জয় মা’।

তবে সেটা বোঝা গেল না, শুধু ধ্বনিটাই পরিব্যাপ্ত হল।

কী হল?

চমকে উঠল ডাক্তার, আর অনঙ্গ ডাক্তার।

চমকে উঠল জনতা।

কী ঘটলো? আরো কোন অভাবনীয় মর্মান্তিক?

যিনি দশভুজা প্রতিমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবার চেষ্টা করছিলেন আর দেবীর উদ্দেশ্যে কটূক্তি করছিলেন, তিনি কি তাঁর সেই মহাপাপের শাস্তি স্বরূপ প্রাণ হারালেন?

অথবা—তরুণী মা ভাগ্যের এই অন্যায় আঘাতের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে—এগিয়ে এলেন তাঁরা। এগিয়ে এসেছে তারাও, যারা এতক্ষণ যাকে বলে চিত্রার্পিত পুত্তলিকাবৎ দাঁড়িয়েছিল, আর এখন ‘জয় মা’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছে।

এখন চীৎকার ধ্বনিটা হচ্ছে—চোখ চেয়েছে। চোখ চেয়েছে।

এই অবিশ্বাস্য শব্দে চকিত হয়ে সিঁড়ি থেকে নেমে এল ছেলের দিশেহারা বাপ। আর ঘর থেকে উন্মাদিনীর মত এলোকেশ হয়ে বেরিয়ে এল মা।

কিন্তু এখন বিপদ।

ছেলেটাকে চোখ চাইয়ে, ‘গুনীনমা’ কি নিজে চিরদিনের মত চোখ বুজল? খড়ির গণ্ডির ধারে ঠিক মৃতের মতই তো পড়ে আছে নিস্পন্দ হয়ে।

ততক্ষণে ছেলে শুধু চোখই চায়নি, উঠে বসতেও চেষ্টা করেছে।

কোন অপদেবতাকে মড়ার দেহের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল না তো? বলেছিল কেউ কেউ, যার মধ্যে অনঙ্গ ডাক্তার প্রধান। মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চারের ঘটনা যারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে রাজী নয়, তারা কিন্তু এ কথাটা বিশ্বাস করছে। মৃতদেহে বিদেহী আত্মার আবির্ভাব।

এমন কি এও মনে মনে ভেবে নিল কেউ, ‘আচ্ছা পরে ছেলের ভাবভঙ্গী দেখেই বোঝা যাবে।’

আর বড় ডাক্তার এখন বললেন, চিকিৎসা শাস্ত্রে এরকম রোগের আছে, যাতে রোগীর দেহে কিছুক্ষণের জন্য সম্পূর্ণ মৃত্যুর লক্ষণ ফুটে ওঠে।

ডাক্তার সেটা চিন্তা করছিলেন এতক্ষণ।

যাক এখন ছেলেকে ভাল করে ঢাকাঢুকি দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হক। যে ভাবে ঠাণ্ডা জল আছড়া দেওয়া হয়েছে, নিউমোনিয়া হতে কতক্ষণ?

অনেকক্ষণ পরে বৃন্দেও উঠে বসেছিল।

ছেলেটাকেও বসিয়ে রাখা হয়েছে ঠাকুরমার কোলে। ভিতরে নিয়ে চলে যাওয়া হয়নি বৃন্দের মূর্চ্ছাভঙ্গের আগে।

মূর্চ্ছাভঙ্গের পর বৃন্দে না কি ছেলেটাকে বসে থাকতে দেখে, হাউ হাউ করে কেঁদেছিল।

কে জানে কিসের এই কান্না।

বৃন্দেকে পাটের শাড়ি পরিয়ে গালচের আসনে বসিয়ে গলায় জবার মালা দিয়ে, কর্তা—গিন্নী দুজনে রীতিমত পূজোই করেছিলেন বলা যায়। অথবা এ যুগের ভাষায় সম্বর্ধনাজ্ঞাপন করেছিলেন। অতঃপর মুখুয্যে গিন্নী তাঁর নিজের গলার দশভরির গোট হারখানা খুলে বৃন্দের গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন। কর্তা একখানা ফুলগিনি দিয়ে প্রণাম করেছিলেন। আর বৌ বাক্স খুলে পুজোর কেনা নতুন বেনারসী একখানা নামিয়ে দিয়েছিল বৃন্দের পায়ের কাছে, ছেলে দিয়েছিল একগোছা নোটের তাড়া।

যে যেখানে ছিল নাটকের শেষ অবধি দেখেছিল।

যারা ‘অপদেবতা’ চালানের সন্দেহ পোষণ করছিল, তারাও ছেলেকে স্বাভাবিক কথা কইতে দেখে হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিল।

সত্যচরণ ছিল সেখানে, কিন্তু সেই দলে নয়।

অভিভূতর দলে।

তা’ তাও ছিল বৈকি কিছু। এমন দৃশ্যে অভিভূত হবে না। আর ব্যাপারটা তো প্রায় পঁচিশ বছর আগের ঘটনা। সাগর পুকুরের লোক তখন একেবারে অবিশ্বাসী হয়ে যায়নি।

তখন এই—

ঘটনার পর থেকে বৃন্দের বোলবোলাও যাকে বলে টপে উঠেছিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *