৫
পেট ‘জ্বলা’ কি জানিস, তা’ কী জানতো বৃন্দে? জানত না তবু বলতো। আর এখন?
জ্বলা পেটটা গামছার বিঁড়েয় চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বৃন্দে। নাকে আঁচল চাপা দিয়ে। ওই ভাত ফোটার ডাল ফোটার মাংস সেদ্ধর গন্ধ সহ্য করতে পারে না।
কবে একদিন, ওই শয়তানের বেটাটা কোথায় গিয়েছিল, বৃন্দে তাই সাহসে ভর করে এই দাওয়া থেকে নেমে, ফণীমনসার বেড়া ডিঙিয়ে ওই টিপকল বসান উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, অ জবা! জবা! শোন একবার।
সেজ নাতনীটার নাম জবা।
বড়টার মতন অত হারামজাদা নয়। সেটির নাম পদ্ম। বৃন্দে বলে, ‘শুদু পদ্যো না। পদ্যো কাঁটা।’ তা জবা এসে দাঁড়িয়েছিল, কী?
বলতেচি, তোর মা কী আঁদবে র্যা বড় খাশা খোশবো বেইরেচে। কাচিমের মাংসো বুজি?
জবা বলেছিল, হুঁ।
তো আমায় এট্টুখানি দিতে বল না। এট্টু মালাখোলা যাতি হোক।
বেরিয়ে এসেছিল পদ্ম।
হেঁকে বলেছিল, বুড়ি কি বলতেছে র্যা জবা?
জবা ঢোক গেলে বলেছিল, মা মানসো রাঁদতেছে তাই এট্ট চাইতেচে।
অ্যাঁ কী বললি? মানসো চাইতে এসেচে। বুড়ির যে দেকি বড়ো নোলা। বলে দে মানসো অ্যাতো সসতা না।
তবু মান খুইয়ে বলেছিল বৃন্দে, এট্টু দিলি কী তোদের অ্যাতো কমতি হবে। এ্যাতো খাবনা ভাতের উপুর অ্যাক হাতা ঢেলে দে’ দে নক্ষীসোনা।
নক্ষীসোনা। জবা হেসে পালিয়ে গিয়েছিল।
আর ঘরের মধ্যে থেকে সমবেত হাসির আওয়াজ ভেসে এসেছিল, নোলাদাগীবুড়ি। অ্যাখোন নক্ষীসোনা বলতে এয়েচে। পাঁশ কেটে কেটে থুচ্চে আতদিন। যা বেরো। খৈরান নিয়ে নিয়ে নজোর দিতি আসবেনি বলছি। পদ্ম, জবা, ঘেঁটু, তিন ফুলের মুখেই তখন হাসির ধূম।
টগরের গলা শোনা গেছল, নজোর নাগা দব্যি পেটে সইবেনি পদ্যো, নোক চিমটে এট্টু তুলে নে পাঁদাড়ে ফেলে দে আয়। ফের এখোন মাতা গলাতে এইচিস বুড়ি? হায়া নাই? নাজ নাই? যাঃ। যাঃ।
যেন বেড়াল কুকুর তাড়াচ্ছে।
তা মরে মরে পুরানো চেনা পরিচিত বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেও তো এমনি। যাঃ যাঃ করে অবিশ্যি বাড়িগুলোই পরিচিত, মানুষগুলো সবই অচেনা অপরিচিত হয়ে গেছে। একদিন সামন্তবাড়ির দরজায় লাঠি ঠুকে ঠুকে গিয়ে জিগ্যেস করেছিল একটা ছোটমেয়েকে, তুমার নাম কী গো? তুমার বাপের নাম কী গো?
তো মেয়েটা চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল, মা, মা, একটা ডাইনী বুড়ি আমায় নজর দিতে এসে কী বলচে সব।
টগরের রান্নাঘর থেকে—
ভাত মাংস চাইতে যাওয়ার দিনকে ঘরে ফিরে এসে বৃন্দে তার ‘চণ্ডীর কুলুঙ্গীর’ নীচে ঠাঁই ঠাঁই করে মাথা ঠুকে বলেছিল, মা তুই যোদি সতোর হোস আর বিন্দে যোদি তোর কন্যে হয়, তো এই আতের মদ্যেই ওই হারামজাদির য—পূরী একগাড়ে হয়ে মরে কাট হয়ে থাক। না যোদি হয় তো তোকে টান মেরে ওই পানা পুকুরে বেসজ্জন দে দেব।
মাথা ঠুকে ঠুকে কপাল ফুলিয়ে ফেলেছিল।
কিন্তু দুঃসময়ে ইষ্টও বিমুখ হয়।
একদা যে দেবী বৃন্দের একডাকে সাড়া দেচে ‘থানে’ থেকে কত কানে নেচে, সেই দেবী বৃন্দের কালশিটে পড়ে যাওয়া ঢিপি কপালের দিকেও নীরবে তাকিয়ে বসে থাকে। ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে আঁকা চোখ দুটো তো আবছা অন্ধকারে বিভীষিকার মত জ্বলে। চোখ তো জ্যান্ত।….
তবু—
পরদিন সক্কালেই টগরের ঘর থেকে হাঁসের ডিম ভাজার সুগন্ধ ভেসে আসে। তার মানে এখন সব কটায় মিলে চা খেতে বসবে। লক্ষ্মীছাড়াটা রাতে ফিরেছে মনে হচ্ছে। লোকটা হাঁস চাষ করে, ঝুড়িঝুড়ি ডিম বাজারে বেচে আসে। আবার বাড়িতেও ঝুড়ি ভর্তি। যার যখন ইচ্ছে হচ্ছে ভেজে খাচ্ছে, সেদ্ধ করে খাচ্ছে।
পদ্মতো কাঁচাই মেরে দেয় কত সময়। পদ্মর প্রাণের পুতুল বেড়ালছাড়া ‘মিশকালী’ই বোধহয় দিন দুটো চারটে খেয়ে পার।
এতবড় নিষ্ঠুর বেইমান হতে পারে মানুষ?
মাঝে মাঝে যে অবাক হতে হতে পাথর হয়ে যায় বৃন্দে।
বৃন্দেরই সর্বস্ব গ্রাস করে বসে আছে, অথচ বৃন্দেকে কুকুর বেড়ালের মত দূর দূর করা। কুকুর বেড়ালকেও মাছ ভাত মেখে মেখে, ‘আয় আয়’ তুতু করে ডেকে খাওয়ায়। হাঁস মুরগীকেও খেতে দেয় আর বৃন্দেকে খিদের জ্বালায় পেটে গামছা বেঁধে ঘুমোতে হয়।
দিনে দুটো ভাত ফুটিয়ে খায় বটে,—দুটো পান্তা রেখে দিলে চলে। কিন্তু বুড়ো হয়ে এক মরণ হয়েছে, পান্তা খেলেই পেট ভাঙবে, বমির উপর বমি।
কিন্তু সন্ধ্যেবেলা কি আবার কাঠ কুটো জ্বেলে ভাত ফোটাতে বসতে পারে? জল আনতে হবে সেই পুকুর থেকে। ছোট্ট কলসীটাকে গামছায় বেঁধে ঝুলিয়ে বড় জোর দু’বার আনতে পারে, সে আর কতটুকু? ভাত রাঁধতে জল লাগে। ছাতু খেতে লাগে না।
দুলো মাকে ‘ডাইনী’ আখ্যা দিয়ে আলাদা করে দিয়েছিল বটে, তবু যতদিন বেঁচেছিল, বড় মেটে কলসী করে দু’এক কলসী জল এনে দিতো। তা’ বৃন্দের কপালে তাও ঘুচল।
জগতে একটা ভাল লোক আছে এখনো, তাই ওই একবেলার ভাতটুকুও জোটে, সন্ধ্যেয় মাৎগুড় চালভাজার গুঁড়ো, ছাতু তেল নুন। লোকটা হচ্ছে সত্য মুদি।
মুদিখানাটা তার বড় নয়, তবে মনটা বড়।
আর ওই একটাই লোক যে বৃন্দেকে ভয় পায় না, ডেকে কথা কয়। অবিশ্যি ভয় পাবেই বা কেন? তিনকুলে আছেটা কে তার? যার জন্যে ভয় তরাশ? একদা সত্যর একটু উপকার করেছিল বৃন্দে।
সত্যর বাপের দোকানটা উঠে যাব যাব হয়েছিল, সেই সময় দোকানটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল বৃন্দে।
তখন দুলোর বাপ মারা গেছে সবে, মন প্রাণ উদাস, সেই সময় বৃন্দে মুখুয্যে বাড়ি থেকে পাওয়া সেই দশ ভরির সোনার হার ছড়াটা দিয়ে দিয়েছিল সত্যকে। বলেছিল, এটা থেকে তুমি দোকানটা ফের তোলো।
সত্য ভয়ে ভয়ে বলেছিল, তোমার ছেলে জানতে পারলে, আমায় পুলিশে দেবে যে গো—
ক্যান? মাগনা?
বৃন্দের যুক্তি এ তার নিজের পাওনা জিনিস। দুলোর বাপের দেওয়া তো নয়।
তা ছাড়া—জিনিষটা যে আছে, সেটা টের পেলেই তো হতভাগা মুখপোড়া ছলে বলে কৌশলে যে করেই হোক ওটা বাগিয়ে নিয়ে ওই সোহাগের বৌকে পরাবে। নচেৎ বৌ সর্বনাশীই কোন ফাঁকে চুরি করে নেবে। তার থেকে সত্যের দোকানটা জাঁকুক।
সত্য না হয় অসময়ে বুড়িকে দুটো ভাতের ব্যবস্থা করবে। মনে জানবে দোকানের আয়ে বিন্দেরও কিছু ভাগ আছে।
কিন্তু বলেছিল বলেই কি, সে কথা রাখবে সত্য, এমন ভরসা থাকার কথা নয়। দুনিয়াটাকে তো দেখছে বৃন্দে। না দিলেই পারতো। খেদিয়ে দিলেই পারত। বলতে পারত তুই যে সাহায্য করেছিলি, কে তার সাক্ষী আছে?
কিন্তু তা করে না সত্য।
দৈনিকের খাদ্যটা জোগান দিয়ে যায়।
একসঙ্গে দেবে কি? কে সামলাবে ইঁদুর আরশোলা? কখন হাত পা লেগে পড়ে যাবে। রোজের রোজ চারটি চাল একটু নুন, নারকেল মালায় একটু সরষের তেল, আর কাগজের ঠোঙায় একটু ছাতু আর মাটির ভাঁড়ে একটু মাৎ গুড়।
ওই সত্যর সঙ্গেই যা দুটো কথা।
বৃন্দে বলে, আরজন্মে তুমি আমার বেটা ছিলে বাপ।
সত্য বলে, ও কিছু না। ও কিছু না।
লাজুক আছে লোকটা।
আসলে লোকটা ভালই।
প্রশংসায় লজ্জা পায় এমন লোক তো এযুগে বিরল। আত্মপ্রশংসায় পঞ্চমুখ হবে, নিজেই নিজের ঢাক পেটাবে এযুগে এটাই তো স্বাভাবিক। সত্যচরণ তা হলে এ যুগের মত নয়। সত্যচরণের আত্মপ্রশংসায় লজ্জা, সত্যচরণের একদা উপকার পাওয়ার বদলে চিরকালের কৃতজ্ঞতা। এটি না থাকলে বৃন্দেকে তো নির্ঘাৎ এতদিনের দুর্ভিক্ষের মড়ার মত চিমড়ে চিমসে মরতে হতনা!
তা’ছাড়া ওই দশভরি সোনার হারটার জন্যে কৃতজ্ঞতার সমীহ সম্ভ্রম যা ছিল তা তো ছিলই আর ছিল বিস্ময়ের সম্ভ্রম।
বৃন্দের হারান প্রাপ্তির মূল উৎসের ইতিহাসই সত্যকে বিস্ময়ে সম্ভ্রমে নম্র করে রেখেছিল। সত্যচরণ যে পেয়েছিল, তার মূলে বৃন্দের শুধু যে বদান্যতাই ছিল তা’ তো নয়, স্বার্থও ছিল। পষ্টাপষ্টিই তো বলেছিল বুড়ি, ঘরে থাকলি তো ওই বৌ হারামজাদি চুরি বাটপাড়ি যে করে হোক হাতিয়ে নেবে। এ তবু জ্ঞেয়ান হবে সত্যর দুকানে বিন্দের কেচু অংশো রইলো বিন্দের অসময়ের জন্যি। অতএব এটা এমন কিছু মহত্বের নয়। আশ্চর্যেরও নয়।
আশ্চর্যের হচ্ছে বিন্দের হারটা পাওয়ার কারণ।
দেখে রোমাঞ্চ হয়েছিল সত্যর বিন্দেমাসি মুখুয্যেকর্তার মরে যাওয়া নাতিটাকে মন্তরের জোরে বাঁচিয়ে তুলল।
সত্য তো দেখেছিল নিজের চোখে।