৪
শুনেছিল জগা তার কথা।
তবে বৃন্দে সঙ্গে গিয়েছিল।
ম্যানেজ করেছিল, মায়ের ‘স্বপ্নাদেশের’ গল্প বানিয়ে। তারা হকচকিয়ে গিয়েছিল। কারণ তারা তখনও বিপদ টের পায়নি। ছেলে ঘুমোচ্ছে না ঘুমোচ্ছে। আট দশ বছরের ছেলে, কাঁথায় শোওয়া তো নয় যে, মা রাতে উঠে দেখবে।
ছেলের চেহারা দেখে মনে মনে হেসে ফেলেছিল বৃন্দে। অঘোর ঘুম ঘুমোচ্ছে ছেলে, যেমন কে তেমন। তার মানে কিছুই শেখেনি জগা।
বৃন্দে দরজার শেকল নেড়ে দোর খুলিয়েছিল, জগা বাইরে দাঁড়িয়েছিল ডাব হাতে। বৃন্দে বেরিয়ে এসে চুপিচুপি বলল, ডাবে দরকার নাই, তুই পালা, আমি পরে যাচ্চি।
হরিকুমোর দেবতুল্য ভক্তি করে বৃন্দেকে, কাতর হয়ে বলল, স্বপন দেকে ছুটে এয়েচে মা। তোমার দয়ার শেষ নাই। তো কী স্বপন দেকলে মা?
কিচু না বাবা। যেন কানে শুননু ‘হরির ঘরে যা দিকিন অ্যাকবার। মন নিচ্চে কেউ অনেষ্টর তালে আচে। তাই ছুটে এনু।’
এই মাজ রাত্তিরে। মাগো তোমার গরীব ছেলে, কী শোদ দেবে?
শোদ?
বৃন্দে হেসেছিল, তোদের ভক্তি ভালবাসাই আমার শোদ বাবা। বসে থেকেছিল আরো খানিকক্ষণ। হরির বৌকে বলেছিল পান খাবো বৌমা।
বাইরে আসার পর জগা ধরল, এডা কী হল বিন্দেদি?
হলো?
গল্পবানাতে ওস্তাদ বৃন্দে বলল, দেকনু ছেলের গতিক তো সুবিদের না। অ্যাখোন যদি টেঁশে যায়। তো তোর আমার দুজনার হাতে হাতকড়া পড়বে। বলবে মাজ আত্তিরে দুয়োর ঠেঙিয়ে ছেলেকে তুক করে মেরে ফেললো। তো মায়ের শরোন নিনু। হাতচালা, ঝাড় ফুঁক, মন্তোর তন্তোর—ছেলে চোখ মেলল দেকে, তবে এনু।…..
জগা মলিনমুখে বলল, ওদের কী জবাব দিবো?
কেট্টে পড় গা। দু’চাদ্দিন গা ঢাকা দে থাকগে যা। নবীনবাবুর শালা তো আর চেরকাল বোনাই বাড়ি থাকবেনি?
ট্যাকা খেয়েচি—
খেয়েচিস, ফেরত দেগা যা। বলবি—ওষুদ খুঁজতে ওস্তাদের কাচে গেচনু—
ট্যাকা ফেরৎ দিবো?
দিবি!
নিবে না।
বৃন্দে চোখ টিপে বলে, বড় মানুষ তো। অ্যাকোন শুনবে তুই ওষুদ খুঁজতে গেচলি, আর মেয়ে নিকেশ হয়ে গ্যাচে শুনি ট্যাকা ফেরৎ দিতি এইচিস, ত্যাখন বলবে ওতে দরকার নাই।
তাই বলতেচো।
বলতেচি। তোর আসার অনেক আগে পিথিবিতে এইচি—
তদবধি জগা বাউরি বিন্দের প্রতিপক্ষ না হয়ে মান্যভক্তিই করতো। আসল কথা তো ফাঁস করেনি বৃন্দে। ‘নিশিরডাকে’ মরা ছেলেকে বাঁচিয়ে এলো, এই কথাই জেনেছে জগা।
কিন্তু সে বৃন্দে কোন বৃন্দে?
সে কি এই নখদন্তহীন বিন্দে বুড়ি?
বিধবা ব্যাটার বৌয়ের সংসারে পরের দাবড়ানি খেয়ে যে বুড়ি নিজের উঠোন থেকে পালিয়ে আসতে পথ পায় না? আর লোকে যাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়।
সকল শক্তি হারিয়ে ফেলল বৃন্দে কোন ফাঁকে?
সকল শিক্ষেদীক্ষে ভুলে গেল কী করে?
আঃ, ওই বজ্জাতটাকে যদি বিন্দি একখান বাণ ঝেড়ে বোবা কানা করে দিতে পারতো। দূরে থেকে বাণ মারার ইতিহাসও তো আছে।
বড় দত্তর হাজারে নারকেল গাছ, বুদো গয়লার ক্ষেপে যাওয়া মোষটা, লরিগাড়ি, কামারনীর লকলকে বেগুন ক্ষেতটা, হাড়পাজী দুগগা তেলিনীর দুধেলা ছাগলটা, এরা সব বৃন্দের বয়েসকালের শক্তির সাক্ষী।
‘মা উদ্দানী চোনডি, তোর নামডা পর্য্যন্ত বিস্মরোণ হয়ে যাই মাজে মাজে। কিন্তুক লোকে আমারে ছাড়ালো ক্যানে মা? কী অপোরাদ কন্নু তোর কাচে। লোকে যে কেন ছেড়েছে, সেই তথ্যটিই জানে না বৃন্দে। বৃন্দেকে তো কেউ বলতে আসেনি—তোরই বৌ টগর বলে গেছে বিন্দে আগে নিজে ‘মন্দটি করে, তবে তারিনীমূর্তিটি ধরে ভাল করতে বসে। নিজে ‘নজর’ দিয়ে পরে নজর ছাড়ায়। নিজে ভূতে ধরিয়ে পরে ভূত তাড়ায়। নিজে ডান চুষে’ পরে ঝাড়ান কাটান করে। এতদিনে তোর স্বরূপ জানা গেছে।’
না, বলে কেউ যায়নি।
অনঙ্গ ডাক্তার একদিন বলেছিল রাগ করে সব ফাঁস করে দেব। কোথায় ফাঁস করেছে কে জানে। বৃন্দের কাছে নয়।
ভিতরে ভিতরে ভাঁওতা আছে।
এখনো আছে। জানে, ভাল করতে না পারুক, মন্দ করতে পারে এখনো।
বসে থাকতে থাকতে বৃন্দের পেটের ভিতরটা জ্বালা করে উঠে। খিদের চোঁয়ান নাড়িতে ছাতু আর কাঁচালঙ্কা বিষ হয়ে ওঠে। বৃন্দে এই সময় ভাত ফোটার গন্ধ পায়।
টগরের রান্না ঘর থেকে বাতাসে ভেসে আসে।
ভাত ফোটার, খেঁসারি ডাল ফোটার আর কাছিমের মাংস সেদ্দর।
কিন্তু ওই রান্নাঘরটা কি টগরের?
বড় সাধ করে হাঁড়ি মাচান বসিয়ে বসিয়ে ধাপি গেঁথে গেঁথে বানিয়ে দেয়নি দুলোর বাপ বৃন্দের জন্যে?
বলেছিল—অ্যামন রান্নাশাল বানিয়ে দিনু তোকে, যে রানতে রানতে আর উটতে হবেনি। হাতের মাতায় সব পাবি। চুলোর গোড়ায় কাট খসি রাকতে এই এট্টু মাচান পয্যোন্তো বানিয়ে দিচি। নে কতো রাঁদবি রাঁদ।
খেতে ভালবাসতো, এনেও দিত তেমনি।
তখন তো ওই পাপিস্টি এসে ঘরে ঢোকেনি, দুলো মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরত। দুলো জল এনে দিত, মশালা পিষে দিত মাছ কুটে দিত। আর আহ্লাদে ডগমগ বাপবেটায় ভাত বেড়ে ডাক দিত আয়। খাবি আয়। পেট জ্বলে না?