২
উকিলবাবুর মেয়ের ঘরের পেরথম নাতি, চাঁদপারা রূপ ঝিয়ের কোলে চেপে পাড়ায় বেড়াতে গিয়েছিল। হঠাৎ ছেলে চিৎকার করে কেঁদে উঠেই ভয়ে নীল হয়ে সেই যে ঘাড় নটকে ঝিয়ের কাঁদে মুখ গুঁজল, সে মুখ আর তুলছে না। শুধু বু বু করতে করতে মুখে ফেনা কাটছে!
নজর লাগাই। কিন্তু মোক্ষম কিছু।
কিন্তু ও রোগের ওষুধ কি আর ডাক্তার বদ্যির কাছে মেলে। এর চিকিৎসা গুণীনমা। ডাক তাকে, এখুনি ছুটে যা।
রান্না চড়াচ্ছিল বৃন্দে, জ্বলন্ত কাঠে জল ঢেলে দিয়ে ছুটে এলো। দেখে কপাল টিপে বসে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ছেলের মাকে জিগ্যেস করল। ঝির সাতে ছাড়া করার বেলা ছেলের কপালে কাজলের টিপ দ্যাও নাই?
হ্যাঁ। দিয়েছি গো।
হাতের ত্যালোয় গোবরের ফোঁটা?
তাও দিয়েছি।
কোড়ে আঙ্গুল কামড়ে নেচলে?
হ্যাঁ মা, সব করেছি।
মুখে ‘থুক’ দেচলে?
ছেলের মা মাথা নাড়ল।
দাও নাই। উইতো, উইটিই তোমাদের দোষ। শুদোই মা তোমার সাত দুয়োরি ঘরের ছটা দুয়োরে খিল হুড়কো নাগিয়ে তালাচাবি দে বন্দ করে, যদি অ্যাকটা দুয়োর হাট রেকে থোও, সেই ফাঁক দে দিয়ে চোর মাতা গলাতি পারে, কি নারে’? বল আমারে?
মা নীরব।
দিদিমাকে বলে, আপনি তো মান্যিমান গিন্নী মনিষ্যি। তো আপুনিও তো দ্যাবে? আপুনি জানো না কি থেকে কী হয়?
দিদিমা ইতস্তত করে জানালেন তিনি তো বলেছিলেন, কিন্তু মেয়ে বলে ঘেন্না লাগে।
ঘিন্না নাগে? তো অ্যাকোন বোজো? বলে মায়ের থু অমতো। ওই ফাঁকা দুয়োরটি দিয়েই চোর সেঁদিয়েচে।
মা দিদিমা দুজনেই হাপাসায়।
ডাক্তার গিন্নী আর উকিল গিন্নী।
আর কখনো এমন ভুল হবে না মা। এখন তুমি বাঁচাও।
তা বাঁচাল বৈকি বৃন্দে, মায়ের খোঁপার লোহার কাঁটা পুড়িয়ে এক ঝিনুক দুধে তিনবার ছ্যাঁক ছাঁক করে ডুবিয়ে, সেই দুধ জোর করে গিলিয়ে দিল মুখ গোজা নেতিয়ে পড়া ছেলেকে। দণ্ড দুই পরেই হেঁটে বেড়ালো।
তা তো বেড়ালো। কিন্তু এমন কাজটা করলে কে?
আর কেউ নয়। সেই দাসী।
কেন এত দিনের বিশ্বাসী লোক। লোভ! লোভে পড়ে মানুষ কি না করে।
তার পেট কেঁচড়ের আঁচল থেকে বেরোল ছেলের গলার সোনার হার।
এতক্ষণ ছেলে নিয়েই ব্যস্ত ছিল সবাই, দেখেনি গলার হার গলায় আছে কি নেই। বিন্দের জেরায় স্বীকার করতে বাধ্য হল যে নিয়েছে লোভে পড়ে। এখন ধরা পড়ল। দেখা গেল ছেলের ঘাড়ে গলায় হার হিঁচড়ে টানার দাগ…..।
কলকাতার স্যাকরার গড়া, আধুনিক ‘টিপকল’ খুলতে পারেনি, ছিঁড়ে নিয়েছে। তদবধিই ছেলে মুখ গুঁজেছে। ঘাড় তোলেনি।
স্বীকার না করে উপায় ছিল?
বৃন্দে একগোছ পান মন্তর—পড়া জলে ডুবিয়ে ধরে শাসাচ্ছিল, বল মাগী, বল কেমন করে নেছিলি? … মিচে কতা বলবি তো এই পানজলের আচড়া মারব। জন্মের শোদ বাক্যি বন্ধ হয়ে যাবে। তোর ঝাড়ে বংশে শ্যাষ হবে।
উকিল গিন্নী হাতের আংটি খুলে দিয়ে দিয়েছিলেন বৃন্দেকে। আর তাঁর মেয়ে দিয়েছিল চওড়া লাল পাড় পাটের শাড়ি। সেই শাড়ি—পরা রূপ দেখে দুলোর বাপ বলেছিল, পতে ঘাটে এই রূপ নে ঘুরিসনে দুলোর মা। গোরায় ধরে নে যাবে।
বৃন্দে বলেছিল, মরণ! বুড়ো—কালে অ্যাকনো কতায় কত অস।
কথা। একদা ওই কথাতেই মজে বৃন্দে ওর সঙ্গে জাকিয়ে বসে ওর দেশ গাঁ এই সাগরপুকুরে এসে বসবাস করতে লেগেছিল। চওড়া বুক, চওড়া পিঠ, বাবরি চুল, হাত পা যেন লোহায় গড়া। অথচ প্রাণটা মায়ার সমুদ্দুর। আর মুখের কথা? যেন মিছরির পানা।
কতকাল হয়ে গেছে, তবু এখনো মনে করলে, মনটা হুহু করে ওঠে।
ভাল করতেও পারত বৃন্দে, মন্দ করতেও পারত। দত্তবাড়ি, জ্ঞাতির লড়াই। গলাবাজি থেকে হাতাহাতি।
দুই জ্ঞাতি ভাই, জ্যাঠতুতো খুড়তুতো, লেখাপড়া জানা। তথাপি পরস্পরে বাপ তুলে গালিগালাজ। অতঃপর কোর্টে ছোটে আর কি!
কিন্তু ঝগড়ার কারণ? কারণ হাস্যকর।
বড় দত্তর হাজারে নারকেল গাছের আগাটা ঝুঁকে এসে পড়েছে, ছোট দত্তর ভাগের পাঁচিলের এধারে।
ছোট দত্ত শাসায়, উঠোনে ঘুঁটে শুকোয়, কাঠ শুকোয়—ছায়া পড়ে। গাছের মাথা সরিয়ে নেবে তো নাও, নচেৎ বাগদী লাগিয়ে গাছ ঝাড়ে মূলে শেষ করে দেব।
আর বড় দত্ত শাসায়, ডেকে আন উকিল ব্যারিস্টার। বলুক কে বলবে, গাছের ছায়া অন্যের জমিতে পড়তে পারে না। পড়াটা বে—আইন। দেখি কেমন বাগদী লাগাস। গাছ দু’ফাঁক হবে তো তোর মাথাও দু’ফাঁক হবে।
ছোট দত্ত রাতের অন্ধকারে এসে ধরল বৃন্দেকে।
দুলোর বাপ হেসে বলল, তা আপনারই তো ছোটকত্তা গাজুরি লড়াই? গাছের ছাওয়া নে নড়াই চলে?
ছোটকত্তা একগোছা দশটাকার নোট ‘মায়ে’র পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বলল, তা জানিনে। বিহিত একটা করতেই হবে। এ হচ্ছে ইজ্জতের লড়াই। বলে কিনা কোর্টে যাবে। মাকে দেখতেই হবে। মুখ রাখলে শাড়িজোড়া। নতুন গামছা, আরো টাকা।
অগত্যই দেখতে হল মাকে।
ব্যস! রাতারাতিই বড় দত্তর হাজারে নারকেল গাছ, কাঁদি কাঁদি ডাব সুদ্ধু বাণ খেয়ে কাঠ। একটা ডাবের মধ্যেও ছিটে বিন্দু জল নেই।
পরদিন বড় দত্ত আপসে এসে পড়ল, তুই আমার এই করলি বাছা? বলি ছোট হারামজাদা কত টাকা দিয়ে গেছল তোকে? আমায় একবার তুই জানালি না কেন? আমি তার ডবল দিতাম। অন্যায় তো ওরই।
বৃন্দে অকুতোভয়ে বলল, ন্যায় অন্যায়ের বিচার করার মালিক বিন্দে না। ট্যাকা তার ছপ্পর ফুঁড়ে পড়ে। উনি অগরে শরোণ নেচে, উনির সাতে বেইমানী করব?
বড় দত্ত আগুন হয়ে বলে গেল এক মাঘে শীত পালায় না বিন্দে! দেখব। তা সেই তেনাকেই আবার দাঁতে কুটো নে আসতে হল বৃন্দের দোরে।
ছেলের বৌয়ের গহণার বাক্স চুরি হয়ে গেছে। ছিল কোথায়? ঘরের মধ্যে লেপের চালির ওপর তোলা ছিল। বিছানা বালিশের মধ্যে তাকিয়ার তুলো বার করে তার ভিতর পুরে রাখা থাকত। সে জিনিস চোরে নেয় কেমন করে? মই ভিন্ন তো নাগাল পাবে না।
থানা পুলিশ করতে গেলে জিনিস মিলবে না, হয়রাণি সার হবে। এ কথা গ্রামের বাসিন্দাদের জানতে বাকি নেই। অতএব? অতএব ‘গুণীনমা’।
কড়ি চেলে বল মা, কে এমন কাজ করেছে। কোন ঘরশত্তুর বিভীষণ? গিন্নীর একটা অগাবগা ভাইপো থাকত সংসারে, দু’বেলা দুটি খাওয়ার বিনিময়ে মজুরে খাটুনী খাটত, তবু কর্তার দু’চোখের বিষ সে। ‘সন্দ’ তার ওপর।
কড়িটি চাললেই খ্যাঁক করে তার কণ্ঠনালিতে চেপে বসবে। কাঁকড়া বিছের কামড়ের মত। হাতে ধরে ছাড়ানো যাবে না। স্বীকার করলে আপনি ছেড়ে খসে পড়বে।
আর অস্বীকার করলে? সে কথা বৃন্দেই জানান দিল। নিয়ে অস্বীকার কল্লে মুখে অক্ত উটবে।
কত্তা বললেন, যা হয় হোক।
গিন্নী বললেন, ওই মুখে রক্ত ওঠাউঠি বাদ দিয়ে হয় না?
বৃন্দে মাথা নাড়ে।
মন্তরের কাজ মন্তর করবে। কড়ির কাজ কড়ি। চলার পর আর বৃন্দের হাতে নেই। সে নিজের পথে ছুটবে। তবে হ্যাঁ, চোরের চেহারা চরিত্তির বলে দিতে পারে বৃন্দে চোখ বুজে। তারপর তোমরা থানা পুলিশ কর, আর মারধোর কর। তবে কড়ি হচ্ছে মোক্ষম। নির্ভুল।
চোখ বুজে বিড়বিড় করে বৃন্দে, লম্বাপারা গড়োন, গোরাপারা অং।
গিন্নী নিশ্বাস ফেলে। স্বস্তির নিশ্বাস। আর যাই হোক তাঁর ভাইপোকে কেউ ‘গোরাপারা রং’ বলে অপবাদ দেবে না। আর লম্বাপারাও নয়। দেখা যাক কে?
বৃন্দে বলে চলে, মাতার সুমুকের চুল পাতলা, বাঁ পায়ে একটা জড়ুল। আর ডান কানের পিঠে তিল। … ঘরেই বসবাস, ঘরেই শোওয়া বসা—
ছেলের বৌ ডুকরে ওঠে।
কত্তা গিন্নী বৃন্দের পায়ের সামনে উপুড় হয়ে বলেন, মা, কড়িচালায় ক্ষ্যামা দাও। এই তোমার পেননামী, এ—কথা যেন আর কারো কাছে প্রকাশ না হয়।
কিন্তু করেছে কি সে গহণা? বেচেছে? গালিয়েছে? না কি—
হ্যাঁ তাই। বেচেওনি গালায়ওনি। ভাবের মেয়েছেলেকে দেচে। কলকেতায় থাকে সে মাগী, এ অঞ্চলেই নয়।
তবে আর কী করা যায়!
করার কিছু নাই।
বৌ বাপের কাছে গিয়ে আবদার করে আবার গহণা বাগাক। বলুক, চোরে নেচে বলে তোমার বেটি ন্যাড়া গায়ে লোক—সমাজে বেরোবে?
তা বিশ্বাসের মূল্য রাখে বৃন্দে। আজ পর্যন্ত বলেনি কাউকে।