১২
গুঞ্জন ধ্বনি উঠল চারিদিক থেকে।
বোধন বসে গেছে, মহাপূজার সব আয়োজন সম্পূর্ণ, আর এই রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন। অপূজিতা মাকে ঠাকুর দালানে বসিয়ে রেখে চলে যাওয়া! এ কী একটা কথা হল?
মীরা মুখার্জি সংকল্পে অটুট। বলছেন—
আমারই অন্যায় হয়েছিল, পুজোর সাধ করা। শ্বশুর শাশুড়ী যখন তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে ঠাকুর আর এ বাড়িতে পুজো নেবেন না। খরচ অপচয় হলো অনেক। তা সেটা ভুলের খেসারৎ বলে ধরতে হবে।…. গাড়ির ব্যবস্থা করা হোক, আমি এখুনি খোকাকে বৌমাকে নিয়ে চলে যাব। …. আপনাদের ছেলের ইচ্ছে হয়, শান্তি—স্বস্তেন করে নিয়ে করুন পুজো।
ছেলে দাঁড়িয়ে উঠলেন একটা অ্যাবসার্ড কথা, বলার কোনো মানে হয় না।
আমার থাকাটাও অর্থহীন।
তা’হলে প্রতিমা?
ঠাকুর মশাই তো রইলেন। যা করবার করবেন। খরচার টাকা রেখে যাচ্ছি। এই সব সাজ গোজ?
ডেকরেটাররা খুলে নিয়ে যাবে। তাদের পাওনা তো পেয়েই গেছে।
আর কেটারাররা?
যা এনেছে উঠিয়ে নিয়ে যাক। লোকসান পুষিয়ে দেওয়া হবে।
সকলেরই সব লোকসান পুষিয়ে দেওয়া হবে।
কিন্তু আশাহত নিমন্ত্রিত গ্রামবাসীদের?
তাদের কথা কেউ ভাবছে না।
‘লৌকিকতার’ ভারবিহীন তিনদিন ব্যাপী একটা নিষ্কণ্টক নিমন্ত্রণের আশায় যারা দিন গুনছিল।
কি আর করা। তাদের কপাল।
তারা অতঃপর কিছুদিন ধরে এঁদের এই আচরণের পক্ষে এবং বিপক্ষে ডিবেট চালাবেন। আর নতুন রং করা বুড়ি বাড়িটা আবার ধীরে ধীরে রং হারিয়ে বার্দ্ধক্যের চেহারায় ফিরে যাবে। আর যে কখনো আসবে এরা এমন মনে হয় না। তবে বাড়িটাকে একটা শান্তি স্বস্তয়ন করে শোধন করে যাওয়া দরকার।
কে বলতে পারে, ওই মৃত কালো বেড়ালের আত্মা ওঁদের পিছু পিছু ধাওয়া করবে কিনা।… অলক্ষ্যে ওঁদের মোটরেও উঠে বসতে পারে।
‘কালো বেড়ালের আত্মা’ একটা পৃথিবী জানিত ভীতির বস্তু।
তা’ করতেই যদি হয় তার ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি হোক।
এ বাড়িতে যখন রান্নাবান্না হবে না। বেলা হলে অসুবিধে।
কিন্তু সেই বুড়িকে এখনো এনে ফেলছে না কেন?
ধরে হোক বেঁধে হোক।
মারতে মারতে, তাকে তার ‘তুকতাক’ তুলিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করতে হবে। অতঃপর জায়টাকে গোবর গঙ্গাজল এবং অগ্নিশুদ্ধ করে নিয়ে শান্তি স্বস্তয়ন যাহোক একটা কিছু করে ছেড়ে দেওয়া মুখুয্যে পরিবারকে।
কিন্তু কোথায় সে ভয়ঙ্কর অপরাধের নায়িকা?
তাকে নিয়ে এসে হাজির করছে কই?
না তাকে আর হাজির করে উঠতে পারেনি ওরা। যাদের ধরে আনতে পাঠানো হয়েছিল। মহেআহে গিয়েছিল যারা, স্বভাবতঃই তারা ধরে আনতে বললে বেঁধে আনার দল।… বেঁধে আনার হুকুম পেলে আর একটা বাড়াবে—
এটাই স্বাভাবিক।
তারা অতএব ‘পিটিয়ে লাশ’, করে ‘মেরে তক্তা বানিয়ে’ নিয়ে এসেছে।
অবশ্য ঠিক ‘নিয়ে’ আসা বলা চলে না।
পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে রেখে এসেছে। চিরকালের শয়তান একটা সর্বনাশিনী ডাইনিকে যখন হাতে পাওয়া গেছে, হাতের সুখ করে নেবে না?
অতঃপর রেখে এসেছে সেই ভাঙা ঝরঝরে দাওয়াটায়। যেখানে একটা চটা ওঠা কলাই করা বাটি ছাতু না কি যেন গায়ে মেখে গড়াগড়ি যাচ্ছিল।
রেখে এসে হাতের ধুলো ঝেড়ে বলল, চোখরাঙিয়ে—ডাকাডাকি করতে ভয়েই মরে গেল বুড়ি। ঘরে ঢুকে দেখি মরে রয়েছে।
কিন্তু তা বললে তো হবে না। পড়ে থাকলে তো চলবে না।
দেশে আইন নেই? পুলিশ নেই? তারা এলো, এবং ‘নিয়ে’ তারাই গেল বেঁধে ছেঁধে।
মর্গের রিপোর্ট অবশ্য ‘ভয়ে’র কথা তোলেনি।
বলেছে। ‘অপুষ্টি জনিত মৃত্যু।’
একদা এদেশে দোহাত্তা লোকে পীলে ফেটে মরতো এখন দোহাত্তা ‘অপুষ্টি জনিত’য় মরে। অতএব এটাকে স্বাভাবিক মৃত্যুই বলতে হয়। দোহাত্তাই যখন ঘটছে। আর বুড়ির চেহারাও তো রিপোর্টের পক্ষেই সাক্ষ্য দিচ্ছে। দেখে কি কেউ বলতে যাবে, ঘুষ খেয়ে রিপোর্ট দিয়েছে।
তবু জগতে মন্দ লোকের তো অভাব নেই?
তাদের কাজই অকারণ বিষোদগার।
দু’একটা দুষ্টমতি খবরের কাগজ, এমনি বিষোদগার করে বসলো। অক্টোবরের কোন একটা তারিখে ফলাও করে বেরোলো।
‘এমনও হয়। এই ঊনিশশো ঊনআশীতে’ও হয়। কলিকাতার অতি নিকটবর্তী একটি গ্রামে, ‘ডাইনি’ সন্দেহে এক বুড়িকে পিটাইয়া মারা হইয়াছে। ….. বুড়ির আত্মীয় স্বজন কেহ নাই, অতএব পুলিশী তদন্তেরও প্রয়োজন হয় নাই। পোষ্ট মর্টেমের রিপোর্ট ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বলিয়া ঘোষিত হইয়াছিল।
এই আমাদেশ দেশ।
অগ্রসর দেশের মানুষরা যখন গ্রহে গ্রহান্তরে পাড়ি দিবার সাধনা করিতেছে, তখন আমাদের দেশে এক গরীব অসহায় বুড়িকে ‘ডাইনি’ বলিয়া পিটাইয়া মারিয়া কেহ লজ্জিত হইতেছে না। ….. অথচ এই গ্রামে শিক্ষিত এবং উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির অভাব নাই।….
অপর একটা কাগজ আবার আরো সরস করে বলেছে, যদিও এই গ্রাম বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তাল রাখিয়া বিজ্ঞানের সুখ সুবিধাগুলি দ্রুত করায়ত্ত করিতেছে, এবং ক্লাবে লাইব্রেরীতে জনসভায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বন্যা বহাইয়া, নিজেদেরকে রুচিবান ও সংস্কৃতিবান বলিয়া স্বীকৃত হইতেছে, তথাপি—যাক খবরের কাগজের কথা কে ধরে।
ওদের কাজই তো তিলকে তাল করা।
হ্যাঁ তিল থেকে তাল করা, ভদ্র ব্যক্তিদের বৃথা অপদস্থ করা, পুলিশকে হ্যানস্থা করা, এবং কথায় কথায়! ‘হায়! এই আমাদের দেশ’ বলে আক্ষেপ করা। এই তো পেশা ওদের?
খবরের কাগজের কথায় কান দিলে চলে না।
তবে হ্যাঁ তিল থেকে যে তাল হয় না তা নয়। এই সাগরপুকুর গ্রামেই তো দেখা গেল তার দৃষ্টান্ত।
একটা নিহত বিড়াল শিশুর মৃতদেহ সারা গ্রামখানাকে তোলপাড় করে তুলতে সক্ষম হলো, কলকাতা থেকে আনা বহুমূল্য দেবী প্রতিমার মানতি পূজোর বহুমূল্য আয়োজন খতম করে দিলো, এবং একটি রাজসূয় যজ্ঞ পণ্ড করে ছাড়ল। এই শেষেরটায় গ্রামসুদ্ধ লোক তো কম আহত আশাহত হয় নি।….. এমন কি, যে লোকেরা ষাঁড়ের শত্রু বাঘে মারলো ভেবে উৎফুল্ল হচ্ছিল, তারাও ক্ষুণ্ণ হয়ে ভাবল, এতোটা হবে কে জানতো।
তবে হলোতো? ঐ তিল থেকেই হলো।
এই উনিশশো ঊনআশীতেও হলো।
আর ভয়ের কারণ নির্মূল হলেও এখনো লোকে স্টেশন যাবার ওই সহজ পথটা পরিত্যাগ করেই রেখেছে, সাইকেল আরোহী আরোহিনীরাও পর্যন্ত। …. ঘুরপথেই যাতায়াত করছে তারা।
কে না জানে, ওই ঢিবি জমিটার ওপর ফণী মনসার বেড়া ঘেরা চালা খসে পড়া ভাঙা দাওয়াটায় নিরবয়ব একখানা ছায়ার গায়ে আগুনের ঢেলার মত দুটো চোখ পথ চলতিদের রক্ত চুষতে রাতদিন জেগে বসে থাকে। … ‘গ্রাম’ তো নামেই, প্রগতির কমতি নেই। তবু—
মার্কসবাদ কোনো কাজে লাগেনা, কাজে লাগে না ইংলিশ মিডিয়াম।