উনিশশো ঊনআশিতেও – ১১

১১

শুক্লাপঞ্চমীর রাত। মৃদু জ্যোৎস্না ঠাহর হয় না কত রাত। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে বৃন্দে?

মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে কথাটা তুলল টগর।

বলল, পদ্মোটা কেঁদে মরবে।

লোকটা বসে বসে একটা জবা ফুলের মালা গাঁথছিল।

বলল, চুপ! একদম চুপ! টু শব্দোটি না।

পেরাণ তুল্যি তো? তাই বলতেছি, আর কোতাও পেলি নাই?

পেলে তোরে বলিনা?

আকাশে তো চাঁদের আলো ফুটফুটি। ভয় লাগছে।

—তুই থামবি?

ওর দাবড়ানিতে টগরও থেমে যায়।

দুলোকে সত্যকার বিয়ে করা স্বামীকে ফুঁ দিয়ে ওড়াতো টগর। কিন্তু একে ভয় করে। একে বোঝা ভার। কখনো মাথায় তোলে, কখনো পায়ে ছ্যাঁচে। মেয়েগুলোও তাই ওকে কখনো বাপটা বলে আদর কাড়ায় কখনো যমের মত ভয় করে।

মালাটা সরিয়ে রেখে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে লোকটা বলল, শয়তান বুড়ি রাত দুপুর অবদি দাওয়ায় বোস করে ছেলো ক্যানো বল দিকি?

টগর জানবে কেমনে? বাজনা বাদ্যির আওয়াজ আসতেছে তো, তাই শুনতে যে হবে।

বাজনা বাদ্যি। হুঁ কানের কত জোর!

শোয়াপল্লি যে? ঘুইমে পড়বি না তো?

লোকটা উঠে বসে বলল, ফের কথা? বলছি না চুপ!

টগর ভয়ে ভয়ে চোখ বুজে। ভান দেখায় ঘুমিয়ে পড়ছে।

কিন্তু ঘুম কি আসবে? আসতে চায় না।

আচ্ছা টগরের তো ভরপেট তবে ঘুম না আসার কারণ কি?

ঘুম না আসতে পারে বৃন্দের। পেট খালি।

দাওয়া থেকে উঠে এসে বৃন্দে সত্যর দেওয়া সেই জালি কাঁকুড়টা বঁটিতে ফেঁড়ে নুন ঠেকিয়ে খেতে গিয়েছিল। খেতে পারা গেল না। তেতো হাকুত।

কাঁচা চালই দুটো নিয়ে চিবিয়ে খেতে গেল, তাও হল না। শুধু মাড়ির জোরে জব্দ করতে পারল না তাদের। নিজের বুদ্ধিকে ধিক্কার দিতে দিতে, তলানি গুড়টুকু মুখে দিয়ে ঢকঢকিয়ে খানিকটা জল খেয়ে শুয়ে পড়েছে।

ভাবনা, রাতে তেষ্টা পেলে খাবে কি।

আর তো জল নেই।

মরুকগে। রাততো পোহাবে এক সময়?

মনে হচ্ছে সত্যর বন্ধু কথাটা তেনাদের বলতেই ভুলে গেছে। সত্য ঠিকই বলেছে, গিন্নীমার কানে উঠলে নির্ঘাত লোক পাঠাতো….. হ্যাঁ লোকই পাঠাবে। বৃন্দের যেমন মরণ, তাই ভেবে মরেছে তিনি নিজে আসবে। তাই কখনো হয়। একি যে সে লোক।

মরতে ভাত কটা রাঁধল না বৃন্দে। ন্যাও অ্যাখোন মরো পেটে কিল মেরে জ্বলে মরো।

আচ্ছা বুড়ো হলে এতো ক্ষিদে পায় কেন?

বয়সকালে মায়ের নামে কত উপোস করেছে বৃন্দে, কই এমন তো হয়নি, টেরও পায়নি। সারাদিন উপোস করে মাঝরাত্তিরে উঠে শেকড় তুলতে গেছে। হঠাৎ বিড়বিড় করে নিজে নিজেই বলতে থাকে বিন্দে…

‘বশ করার’ ওষুধের কত খিরকেল!

আমাবস্যের দিনে নেজ্জলা উপোসে থেকে মাজ আত্তিরে গে পুকুরে ডুব দে, ভিজে কাপড়ে এলো চুলে শেকড় তুলে নে এসে। আতের মদ্যেই তারে বেটে পানের পাতে মাইকে থোও…. সেই পানটি চুন সুপূরি কপ্পুর দে সাজ করে নোকটারে খাওয়াও। ব্যস। সে তোমার পায়ে পায়ে ঘুরবে। করিচি তো এসব। কতো করিচি।

আচ্ছা।

নির্বুদ্ধির ঢেকি বিন্দে ছেলের বিয়ে হতে হতেই বৌটাকে কেন বশ করার পান খাওয়ায়নি? পেরথম পেরথম তো বৃন্দের পানের বাটা থেকে পান খেতে খুব তৎপর ছেলো বৌ।

দ্যাক তোর, না দ্যাক মোর।

বাটা খুলে পান নে দৌড়। আহা সেই মহালগ্ন হারিয়েছে বৃন্দে। আর উপায় নেই। আর শক্তিও নেই। একদিন তো বৃন্দে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ওই লোকটাকে ‘বাণ’ মারতে পারলো না, ঘাম ছুটে গেল, হাত পা কাঁপতে লাগল। বুক ‘উৎলোতে’ লাগল।

জেগে থাকতে থাকতেই কখন যেন স্বপ্নের শিকার হয়ে গেল বৃন্দে।

এই স্বপ্নের মধ্যে কত লোক, কত মুখ। চেনা অচেনা।

যেন—সেই উঠোনটায় আবার গিয়ে বসেছে বৃন্দে। পরনে পাটের শাড়ি। গলায় জবার মালা। ঝলমলে ঝকমকে গিন্নীমা বলছে আপনার হতেই তো সব মা। আপনি যদি সেদিনকে ওর জীবেনটা ফেরৎ না দিতেন কিছু হতো? ওরা সভ্য। ওরা ‘আপনি’ করেই কথা বলে।

কর্তা বলবে, জানতুম না আপনি বেঁচে আছো। জানলে আপনারে সকলের আগে নে আসতুম।

আর সেই খোকাডা? সেও এসে—

কিন্তু কোথায় সে? এরা কারা? এরা তো সেই বুড়ো কর্তা গিন্নী?

আর ওই বৃন্দে?

কালো চুলের ঢাল। মাজা মাজা রং। মাজা গড়ন। চকচকে তেলতেল মুখ। খাড়া হয়ে বসে আছে। ও কোন বৃন্দে?

সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে বৃন্দের। স্বপ্নের মধ্যে বর্তমান তাকে কিছুতেই বাগিয়ে ধরতে পারছে না। অতীতের মধ্যে গলে গলে মিলে যাচ্ছে সেটা।

সারারাত বাজনার আওয়াজ আসছে।

কিন্তু এ বাজনা কি পূজোর বাজনা? ফিনফিনে গান, ঝিনঝিনে সুর।…

একে তো বলে মাইকের গান।…

হঠাৎ একসময় বেজে উঠল পূজোর বাজনা।

ঢাকে কাঠি পড়ল।….

ভোর হলো নাকি? তাইতো। কলাবৌ নাওয়াতে যাবে তবে এখন। টাকীঢুলি ঘুম ভেঙে উঠেই দিয়েছে দুটো ঘা। যাতে সবাই জেগে ওঠে।

বৃন্দেও উঠে পড়বে নাকি?

এই পথ দিয়েই তো বড় দীঘিতে যাবে ঢাক ঢোল বাজিয়ে সমারোহ করে, কলাবৌ নিয়ে।

আর বৃন্দেকে দেখতে পেয়ে বলে উঠবে। ইস তাইতো—বড্ড ভুল হয়ে গেছে মা, আপনাকে বলতে আসি নাই।

কিন্তু উঠবে কি হাত পা উঠছে না।

মাথাটা লটকে পড়ছে। কালকের উপোসটা বড্ড লেগেছে।

আচ্ছা! বাজনাটা বেজেই থেমে গেল কেন? গোলমাল কিসের?

কোথা থেকে এমন রে রে, শব্দ আসছে?

শব্দটা বৃন্দের কুঁড়ের দিকেই আসছে যে। কাছে, আরো কাছে। আরো।—একেবারে দরজায়—

কী বলছে ওরা?

অতোগুলো লোক।

কোথায় সেই হারামজাদি বুড়ি।

টেনে বার কর। পিটিয়ে লাশ করে ছাড়।

মেরে তক্তা বানিয়ে দে!

এই শয়তানী বুড়ি, বেরিয়ে আয় বলছি। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, এখনো বজ্জাতি! এই বিন্দে! বিন্দে! বেরিয়ে আয় শীগগির!

তারমানে বিন্দেকেই খুঁজতে এসেছে।

কিন্তু এই কি নেমন্তন্ন করতে আসার ভাষা।

বৃন্দের দরজায় এতো গোলমাল, কিন্তু যাদের বাড়ি সমারোহ হবার কথা, সেখানে এক নিথর স্তব্ধতা। যেন এই আড়ম্বর আয়োজনে উদ্দাম উত্তাল হয়ে ওঠা প্রাসাদটায় হঠাৎ কোন দৈত্য এসে মরণ কাঠি ছুঁইয়ে দিয়ে গেছে।

এই ভয়াবহতায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন বর্তমানের গৃহকর্তা প্রসূন মুখার্জি, সেই পঁচিশ বছর আগের এক দুর্গাষষ্ঠির ভোরের মত, ঠাকুর দালানে ওঠবার সিঁড়ির শেষ ধাপটায়। আজ আর দুহাতে মুখ ঢাকা নয় বটে, কিন্তু মুখের উপর যেন অদৃশ্য এক কঠিন আবরণ। বোঝা যাচ্ছে না মনোভাবটা কি।

দালানের উপর ধারের দিকে বসে আছেন বর্তমান গৃহিণী মীরা মুখার্জি। পাঁচিশ বছর আগের সেই দুর্গাষষ্ঠির দিনটায় যে মেয়ে কোথায় যেন পড়েছিল অচৈতন্য হয়ে। এখন তার মুখে একটা স্থির সংকল্পের আভাষ।

বাড়িতে একটি নবদম্পতি আছে, তারা কোথায় আছে দেখা যাচ্ছে না।

তবে সাহস করে এগিয়ে এসে স্তব্ধতা ভাঙছে না। মরণকাঠির প্রভাবটা অবহেলায় মুছে দিয়ে ‘জীয়নকাঠির’ সন্ধান এনে দিচ্ছে না।

উঠোন ভর্তি ডেকরেটারদের চেয়ার পাতা আছে, উঠোনের চারদিক বিচিত্র আর বর্ণাঢ্য সাজে সজ্জিত। চেয়ারগুলির মধ্যে অনেকগুলি দখল করে আছেন কিছু বয়স্ক ভদ্রলোক। পাড়ার এবং জ্ঞাতিবাড়ির। তার সঙ্গে পুরোহিতও।

কিছুক্ষণ পরে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে এগিয়ে এলেন প্রসূনের খুড়তুতো কাকা প্রভাস মুখুয্যে। গলা ঝাড়া দিয়ে বললেন, বৌমাকে বল বাপু মনটা স্থির করতে। ঠাকুর মশাই বলছেন, দেউড়ি যখন আটক রয়েছে, খিড়কি দিয়েই নবপত্রিকা স্নান করিয়ে আনা হোক। উনি যখন বলছেন—

প্রসূন মুখার্জি একবার চোখ তুলে উঁচু দিকে তাকালেন।

চওড়া লালপাড় গরদ পরিহিতা নীটোল যৌবনা মীরা মুখার্জি স্থির স্বরে ঘোষণা করলেন, আমি তো বলে দিয়েছি ঠাকুর মশাই, পূজো হবে না। পূজোর ইচ্ছে আমারে চলে গেছে।

মীরা মুখার্জিকে দেখে কেউ বলবে না ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে ওর। যেন পঁচিশ বছর আগে যে বাইশ বছরের বৌটি এখানে ঘুরে গেছে, সেই বৌ—ই সাজবদলে গিন্নী সেজে মঞ্চে উঠে এসেছে। …. যেমন স্থির যৌবনা, তেমনি স্থির ঘোষণা।

ঠাকুর মশাই কুণ্ঠিত গলায় বললেন, বুঝছি মা। আপনার মনের অবস্থা বুঝছি। মহাষষ্ঠির দিন এই অশুভ ঘটনা। স্বয়ং ষষ্ঠিরবাহন। কিন্তু এই বিপুল আয়োজনের দিকে তাকিয়ে, আর জনসাধারণের মুখ চেয়েই এ বিধান দিচ্ছি। পূজো তো আগামীকাল। আজ কলাবৌ স্নানটা করিয়ে আনা হোক তারপর দেউড়ি সাফ করিয়ে, এখানে একটা শান্তি স্বস্তয়ণের ব্যবস্থা করে—

গৃহিণীর আগেই কর্তা বলে ওঠেন, দেউড়িই বা সাফ হচ্ছে কি করে? পঞ্চাশ টাকা থেকে একশো টাকায় উঠেছি, কেউতো ছুঁতেই রাজি হচ্ছে না। দুলে পাড়া, বাগদি পাড়া সর্বত্রই নাকি লোক ঘুরে এসেছে।

এখন আবার প্রসূনের কাকা এগিয়ে আসেন।

বলেন, কি জানো বাবা, তুকতাকের ব্যাপারতো কেউ সাহস করছে না। দুলে বাগদি হোক আর যাই হোক, সবাই ছেলে পুলে নিয়ে ঘর করে। তায় আবার দিনটা মোক্ষমতো মহাষষ্ঠির দিন, মাষষ্ঠির বাহন।

তারপর আবার গলাঝেড়ে বলেন, সেদিনই তোমায় আমি বলিনি বাবা? তুমি আবার বলছিলে ওকে নেমন্তন্ন করে পাঠাবে। এখন বুঝছো, আমাদের কথা সত্যি কিনা। মহা সাংঘাতিক মেয়েমানুষ!

প্রসূন মলিন গলায় বলেন, কিন্তু গুণীনমাতো চলতে ফিরতে পারে না।

সাধারণ কার্যক্ষেত্রে পারে না—

কাকা উদ্দীপ্ত হন, কিন্তু এসব কর্মে ঘাড়ে পিশাচের ভর হয় তো। তার জোরেই।

প্রসূন আলগা গলায় বলেন, অথচ সেদিন এই এখানেই—

তার রহস্যতো তোমার কাকিমা বলে গেলেন কাল। নিজে মেরে নিজে বাঁচালো। এই যে বিতিকিচ্ছি কাণ্ডটি করে রেখে গেছে এর পেছনে কী মতলব আছে কে জানে।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

কর্তা স্খলিত স্বরে বলেন, আগে তো দেখেছি, আপনারা সকলেই খুব ভক্তিটক্তি—

ঠাকুরমশাই এবং তস্য বয়স্য কাকা মশাই দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠেন, ওই তো! ওইখানেই তো বাহাদুরী। ভাবতে পারো বাবা একটা মুখ্যু নিরক্ষর ছোটজাতের মেয়েছেলে কতকাল ধরে এই অ্যাতো রাশি রাশি লোককে ঠকিয়ে খেয়ে এসেছে। শুধু এ গাঁ কেন দেশ দেশান্তর থেকে লোক এসেছে। এখন? এখন ধরা পড়ে গেছে স্বরূপটি। … স্রেফ একটা ডাইনী। নইলে এই অ্যাতো বড় পূজোর দিন কিনা এই কর্ম করে।

কর্তা কি বলতেন কে জানে, গিন্নীর ক্লান্ত অথচ দৃঢ় স্বর ভেসে আসে, ওসব কথা থাক। এখনই একটা গাড়ির ব্যবস্থা হোক আমি খোকাকে বৌমাকে নিয়ে চলে যাবো।

চলে যাবেন? এখনই চলে যাবেন?

দু’দুটো আর্তস্বর যেন আছড়ে পড়ে আপনি এখনই চলে যাবেন? দালালে প্রতিমা বসে—

বসেই থাকুন। নয়তো বিসর্জন দিয়ে দিন—

এখন চেয়ার—আসীন জনগণ বলে ওঠেন, বিসর্জন। সে কী? সেটা যে মহা অশাস্ত্রীয় হবে। দিকে দিকে সর্বত্র মা দালানে উপবিষ্টা—এখন বিসর্জন! ইস! তাহলে এই দালানেই পড়ে থাকুক মা!

মীরার স্বর উত্তপ্ত, এই যখন তাঁর ইচ্ছে—

দুর্গাষষ্ঠির দিন সকালবেলা দেউড়ির সামনে মা ষষ্ঠির আসল বাহন মিশকালো এক কালো বেড়ালের ছানাকে মরে পড়ে থাকতে দেখে এঁরাই শিউরে উঠেছিলেন বেশী, এঁরাই বিভীষিকা দেখিয়ে স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন সবাইকে। ঢাকী—ঢুলীরা এঁদের নির্দেশেই বাজনা থামিয়ে ফেলেছিল, আর এঁরাই বলেছিলেন, যা সবাই, সেই শয়তানী ডাইনী বুড়িকে মারতে মারতে ধরে আন, তুলে নিয়ে যাক, ওই ভয়ঙ্কর বিভীষিকাকে। এখন তাঁরাই আবার পুজো হবে না শুনে বিচলিত হচ্ছেন।

অশাস্ত্রীয় কাজ তো করা চলে না।

সেই যে কবে একদিন বাজারের পথে তিনমাথার মোড়ে, কে একটুকরো কলাপাতার ওপর পাঁচটা জবাফুল বসিয়ে রেখে গিয়েছিল, ছুঁয়েছিল কেউ? টান মেরে ফেলে দিয়েছিল? আর ভুলে ভুলে কি ডিঙিয়েই ছিল? ঘুরে অন্যপথে বাজার গেছে।

কে না জানে, ডিঙোলেই অন্য কারও দুরোরোগ্য ব্যাধি তার শরীর থেকে তোমার শরীরে এসে ঢুকে পড়বে।

কে জানে সে কাজই বা কার?

ওই ডাইনী লোক দেখিয়ে চলৎশক্তিহীনের ভান দেখায় কিনা কে বলতে পারে? পিশাচে ভর করে হয়তো রাতচরা হয়ে বেড়ায়।

তা কতক্ষণ পরে যেন দুটো ছাগলে সেই জবা কলাপাতা সব সাফ করে ফেলেছিল তাই রক্ষে। তবু দু’পাঁচদিন লোকে সেই জায়গাটা এড়িয়ে পা ফেলেছে।

ভগবান জানেন ছাগল দুটো কোন দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হয়ে গেল কিনা। ‘অ্যাজমা’ কি ‘ব্লাড ডিসেন্ট্রি’, ‘টি.বি.’ কি ‘ক্যানসার।’…..

কিন্তু ফুল পাতা নির্মূলের তো তবু দৈব প্রেরিত প্রাণীর ভরসা। কালো বেড়ালের উপায় কি?

ওকে তো আর ছাগলে খেয়ে যাবে না।

প্রথম দর্শক কেয়ারটেকার বৈকুণ্ঠ ঘোষ।

ভোরে গেটের চাবি খুলতে এসে আঁৎকে উঠে এমন ডাক হাঁক শুরু করেছিল যে সেই ভোর রাত্রির শান্ত শান্তি যেন ক্লেদাক্ত হয়ে উঠেছিল। তবে তখন গোলমাল শুনে নবদম্পতি সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে এসে বলে উঠেছিল, কী আ—শ্চর্য! এই নিয়ে এতো হৈ চৈ? রাস্তায় মরা কুকুর বেড়ালের ছানা পড়ে থাকতে দেখেনি কেউ?

বিজ্ঞরা সে কথা শুনে তাদের ব্যাপারটা সম্পর্কে অবহিত করিয়ে দিয়েছিলেন।

দেখবে না কেন! দেখেছে। গাড়ি চাপা পড়ে মরে থাকে, দু’দলে ঝগড়া খেয়োখেয়ি করে মরে পড়ে থাকে। কিন্তু দুর্গাষষ্ঠির ভোরে পূজোবাড়ির ঠিক গেট—এর সামনে মিশকালো এক বেড়ালছানাকে গলায় জবার মালা, আর কপালে সিঁদুরে ফোঁটা পরে মরতে আসতে দেখেছে কেউ কখনো?

নাঃ। একথা স্বীকার করতেই হলো, এমন দৃশ্য কেউ কখনো দেখেনি। সুইসাইড করবার জায়গাটা আবিষ্কার করেছে বটে ছানাটা।

আমেরিকা ফেরৎ ছেলে বলল, দূর! ‘তুকতাক’ আবার একটা কথা নাকি? আমি ও সব বিশ্বাস করি না। কেউ না ছোঁয়, আমি টান মেরে ফেলে দিয়ে আসছি। বল তো চানও করে ফেলতে পারি।

লরেটো পড়া বৌ তার হাত চেপে ধরে বললো, কী দরকার তোমার এতো বাহাদুরীতে? কিসে কি হয় কে জানে। মরা বেড়াল ফেড়ালে জার্ম থাকতে পরে। মানলাম। কিন্তু এই সব তুকতাক তুমি বিশ্বাস করো?

মোটেই না। তবে চিরকাল এসব চলেও তো আসছে। ও নিয়ে তাল ঠোকার দরকার কি? কখনো ওদিকে যাবে না তুমি।

দৃশ্যটার বীভৎসতায় তার গা গোলাচ্ছিল।

দু’জনেই তাই আবার শয়নকক্ষেই ফিরে গেছে। সেখানে হয়তো দেশের এই সব কুসংস্কার নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *