উনিশশো ঊনআশিতেও – ১০

১০

বৃন্দে পঁচিশবছর আগে ফিরে যায়।

মুখুয্যেদের নব আবির্ভাবের উদ্যোগে গ্রামে রীতিমত সাড়া পড়ে গেছে। যদিও আজকালকার ছেলে মেয়েরা কোনো ফালতু ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করাকে খেলোমি মনে করে, এবং এতোদিনের অবহেলিত জীর্ণ দশাগ্রস্ত প্রাসাদটায় মিস্ত্রীর হাত পড়েছে দেখেও, তাকিয়ে দেখে না। তবু এই মেরামতীতে আর রং করণে কত খরচা হতে পারে, তার একটা সম্ভাব্য হিসেব মনে মনে কষতে থাকে অনেকেই।

খরচা যে রীতিমতই হবে তাতে সন্দেহ কি?

এখন বয়স্ক মহলে জল্পনা—কল্পনা—এতো খরচের কারণটা কি? তবে কি ছেলে বৌকে কলকাতার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত করে রেখে কর্তা গিন্নী নিজেরা এখানে এসে বসবাস করতে চান?

বিলেত আমেরিকা ফেরৎ ছেলে আর আধুনিক বৌ—এর সঙ্গে হয়তো বনছে না। আরে রেখে দাও তোমার বিলেত আমেরিকা ফেরৎ। কলকাতার রাস্তায় মুঠো মুঠো গড়াগড়ি যাচ্ছে।’ না বনলে এমনিই বনছে না।

কিন্তু এখানে এসে বাস করবে কি করে, প্রসূন মুখুজ্যে তো এখনও সার্ভিসে। তা’ছাড়া অতো সব ব্যবসা।

তাতে কি? পয়সার তো অভাব নেই। ওদের জন্যেই তো পেট্রল। রোজ গাড়িতে যাওয়া আসা করবে। ক’মাইলই বা রাস্তা। বড়লোকেরা এমন করে আজকাল।

নাকের সামনে হঠাৎ এক বড়লোক এসে বাস করতে বসলে, ব্যাপারটা খুব সুবিধের হবে না।

তাতে তোর আমার কি?

তা অবিশ্যি। আমরা তো আর ‘বাবু’ এসেছেন বলে প্রজার মত জোড়হাতে গিয়ে দাঁড়াতে যাচ্ছি না।

কেউ কেউ যাবে দেখিস। বুড়োরা তো নির্ঘাৎ। সেই পুরোনো প্রেম ঝালাতে যাবে।

কে যেন বলছিল, শুধু ধূমধাম সহকারে পূজো করে চলে যাবে।

গেলেই ভালো।

আচ্ছা শুধু চারিদিনের জন্যে এতো খরচা?

বড়লোকি দেখানো। আর কিছু নয়।

মুখে ঔদাসীন্য দেখালেও, তলে তলে উত্তেজনা আছে।

কথাটা সত্যিও।

যদি বাসই না করে, চারদিনের জন্যে এতো খরচা? বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকে তো।

হয়তো বাড়াবাড়িটা বেশিই হয়ে গেছে।

কণ্টাক্টর লাগিলে কাজ তো।

তবু—

বাড়ি সম্পর্কে একটা অপরাধবোধ পীড়িত করছিল বোধ হয় বর্তমান মালিককে। টাকার অভাব তো নেই সত্যি, অবহেলায় পিতৃপুরুষের ভিটেটা পড়ে যাবে? তাছাড়া নতুন বৌকে দেখাবার বাসনাটাও পেয়ে বসেছিল নতুন বৌয়ের শাশুড়ীর। এ পুরনো গড়নের বাড়িরও কত বাহার বুঝুক। পুরনো নামেই তো নাক তোলে সব।

বাড়ি সারানো নিয়ে জল্পনা—কল্পনা চলছিল—আসল ঘটায়, মুহূর্তে মুহূর্তে চমকাচ্ছে সবাই।…. লরী চেপে কুমোরটুলীর ঠাকুর এলেন, সেটা এমনত কিছু না। ‘সাগরপুকুর বান্ধব লাইব্রেরীর’ সর্বজনীন দুর্গোৎসবেও কলকাতা থেকে ঠাকুর আসেন। কিন্তু প্যাণ্ডেল? ডেকরেটিং? আলোকসজ্জা? কেটারিঙের ব্যবস্থা?

পূজোর ভোজে চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা। এটা এখনো হয়নি এখানে।

গ্রামসুদ্ধ নিমন্ত্রণ হয়ে গেছে।

মাঝখানে একদিন গাড়ি করে এসে প্রসূন মুখুয্যে বাড়ি বাড়ি নেমন্তন্ন করে গেছেন। এ সেকাল নয় যে, নায়েব গোমস্তা দিয়ে নেমন্তন্ন হবে।

মা দুর্গার ছবি আঁকা নিমন্ত্রণ কার্ডটা বাঁধিয়ে রাখার মত।

পঞ্চমীর দিন সাত আটখানা গাড়ি করে কলকাতা থেকে এসে গেল, নতুন বৌ ও আত্মীয় স্বজন। সেই সব গাড়ির সারি আসতে লাগল বৃন্দের বাড়ির সামনে দিয়েই।

শুধু আজ নয়, ক’দিন ধরেই আসছে গাড়ি, ট্রাক। যেন রাজসূয় যজ্ঞ। আসল কথা সকল জিনিস কলকাতা থেকে আনানোর ব্যবস্থায় সমারোহের ব্যবস্থাটা এত প্রকট দেখাচ্ছে।

টগরের বাড়ির লোকটার প্রকৃতপক্ষে ঘরামির কাজ।… পুজোটুজো বা বিয়ে থাওয়ায় সে রীতিমত ‘ব্যস্তমানুষ।’ আর এই উপলক্ষে তো বিরাট বায়না পেয়েছে সে। সবকিছু কলকাতা থেকে এলেও, বাঁশ দড়িগুলো এখানেরই। এবং দুচারটে ঘরামিও নেওয়া হয়েছে ডেকরেটারের নির্দেশে।

জবা, পদ্ম, ঘেঁটু ওদের মধ্যেও তাই উৎসাহ উত্তেজনা।

ওদের নাকি নবমীর দিনে খেতে যাবার কথাও আছে।

বৃন্দের কানে মাঝে মাঝেই ওদের কথার টুকরো ভেসে আসে … কী খাওয়াবে রে বাপটা?

আমারে বুজি বলে থুয়েরে?

বেস্তর ঘটা? তাই না রে। তুই কটা মাচ খাবি জবা?

অ্যাক কুড়ি, দুকুড়ি। তুই?

দশকুড়ি।

দূর, পেট ফাট্যা অক্কা পাবি।

মা, তুই যাবিনে?

যাবো না ক্যানে?

শুদু বুড়ি পড়ে থাকবা। হি হি।

তো তুই কোলে ধরে নে যাস।

হি হি হি।

ওদের ওই হাসির আওয়াজটা বড় অসহ্য লাগে বৃন্দের। কান চেপে শুয়ে থাকে। পঞ্চমীর দিন একেবারে সিধে দিতে এসে উৎফুল্ল সত্যচরণ বললো, আজ সবাই এসে গেছে মাসি, আমার বন্ধুকে বলে রেখেছি ওনাদের জানাতে।

বৃন্দে আজ ক’দিন ধরে আয়োজনের বহর দেখছে। আর কখনো কম্পিত, কখনো স্তিমিত, কখনো উত্তাল, কখনো স্মৃতি মর্মরিত।

মনে পড়ছে—মুখুয্যে কর্তার মেয়ের বিয়ের সেই ‘বিষ্টিবন্ধন।’

চওড়া লালপাড় তাঁতের শাড়ি প্রণামী দিল গিন্নীমা, কত মান্য, কত আদর। ছেলের বিয়েতেও সাতদিন ধরে চলেছে খাওয়া মাখা।

আর সেই ভয়ানক দিনে?

সেই ছবিটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে বারবার। গাড়ি করে কারা যেন সব এলো। ওর মধ্যে কি সেই ছেলেটা ছিল?

এখন বৃন্দে কিঞ্চিৎ স্তিমিত।

কারণ দুলোর মেয়েদের হি হি টা যেন এখনো বাতাসে ভাসছে।

বলল, কী জানান করবো?

এই—সত্য, একটু ঢোক গেলে বলে, তুমি এখনো বেঁচে বর্তে আছো, সেইটাই আর কি। বন্ধুকে বলে এসেছি—সে যা বলবার বলবে। চারটে রিকশাগাড়িকে ওরা রাতদিনের ভাড়া করে রেখেছে দরকার লাগতে—এক সময় তোমায় তারই একটায় চড়িয়ে—

বৃন্দে মলিন হাসি হেসে বলে, ‘তোর যে বাবা গাচে কাঁটাল গোঁপে ত্যাল।’

আহা কাঁঠাল পাতে নাবছে দ্যাখোনা। জানতো না গিন্নীমা—যখন জানবে তুমি এখনো আছো, দেকো কী আহ্লাদ করবে।

তেনার কি অ্যাখনো সে কথা স্মরোণে আচে?

স্মরণে নেই? কী বল মাসি?

বলে যায়। তার কেয়ারটেকার বন্ধু তাকে অনুরোধ জানিয়েছে তিন চার দিনের মত দোকান বন্ধ করে ওখানে থাকতে। কাজের লোক, অনেষ্ট লোক। সত্য ভেবেছে, ভালই হয়েছে।

সত্য সেখানে থাকলে মাসির স্থায়ী একটু ভালমত ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে বলে বলে।

দিন কেটে যায় পাথরের ভার নিয়ে।

কোথায় কে?

‘কী আহ্লাদের পসরা নিয়ে কি তবে, সেই ছেলের মা নিজেই আসবে? আজ যিনি গিন্নীমা! হয়তো তাই। তা সময় তো নেই, তাই এতো দেরী। রাত হয়ে যায় দাওয়া থেকে নড়ে না বৃন্দে।

ভাবে কতবড় বিরোদ কাজ মাতায়, তিনির কি সয়োজে অবকাশ হবে? আত করেই আসা করবে।

রাত করে?

কিন্তু কত রাত?

সন্ধেবেলা ভাত রেঁধে খাবার কথা।

দুপুরে তো ছাতুগোলায় কেটেছে। কিন্তু কাঠকুটো ধরাতে সাহস হয় না। যদি তখনি এসে পড়ে? ধুঁয়ো লাগবে।

আর—আরও একটি ক্ষীণ আসা।

ঘটার বাড়ি থেকে আসবে, শুদু হাতে কি আর আসবে? ‘ভালমন্দ’ কিছু আনবে হয়তো। মিচিমিচি ভাত ক’টা খেয়ে খিদে নষ্ট করে বসে থাকবে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *