১
দেশ রাজ্য জুড়ে দেওয়ালে দেওয়ালে এখন উনিশশো ঊনআশীর ক্যালেণ্ডার ঝুলছে, আর শুধু শহর বাজারে নয়, গ্রামে গঞ্জেও মায়ের কোলের শিশুটাও জানে মানুষ চাঁদে ঘুরে পুরনো হয়ে এসেছে সেই কবে, এখন মঙ্গল গ্রহে ঢুঁ মারতে যাচ্ছে। এবং তাবৎ জনেই জানে মানুষ ক্রমশঃ বুধ, বেস্পতি, শুক্কুর, শনি হয়তো শেষতক রবির বাড়িও সঙ্কেত পাঠাবার তাল করতে, শূন্যে ‘স্টেশন’ বসাচ্ছে।
এই সাগরপুকুর গ্রামেও কারো জানতে বাকি নেই বিজ্ঞানের বলে এখন মানুষের শরীর যন্ত্রগুলোর কোনটা অকেজো—টকেজো হয়ে গেলে তাদের বাদ বাতিল করে কৃত্রিম অকৃত্রিম নতুন সব যন্ত্র বসিয়ে নিয়ে দিব্যি কাজ চালানো যায়। চোখের সামনেই ক’জনা তাদের হাওয়া ফুরিয়ে আসা হার্টের গায়ে ‘হার্ট—মেসিন’ বসিয়ে পুরোদমেই বেঁচেবর্তে রয়েছে। মেসিনের আয়ু ফুরিয়ে এলে, কলকাতায় গিয়ে আবার নতুন ‘আয়ু’ ভরে নিয়ে আসছে। তবু—তবু এখনো বিন্দে বুড়িকে হঠাৎ ঘাটে পথে দেখতে পেলেই, ছেলে বুড়ো সবাই উল্টোপাক খেয়ে চোঁ চাঁ সটকান দেবে। তার কারণ? কারণ ‘দৃষ্টি’।
বুড়ির ‘দৃষ্টি’কে সকলের দারুণ ভয়।
ওই দিষ্টিতেই তো বুড়ি কী না কি অনিষ্ট ঘটাতে পারে কে জানে! মানুষ গ্রহান্তরে ঘুরে আসতে শিখেছে বলেই তো আর ‘নজর লাগা’ ‘বান মারা’ ‘তুকতাক’ ‘জুড়ি—বুটি’ এগুলো মিথ্যে হয়ে যায়নি? আর শক্তিও ফুরিয়ে যায়নি জল—পড়া, তেল—পড়া, ফুল—পাতা, শেকড়—বাকড়, হোমের ছাই, হাড়িকাঠের মাটির।
বিপদে পড়লে, এরাই বিপদতারণ।
এদের নিয়ে যাদের কারবার, তারা ‘ভরে’র ঘোরে স্বর্গ মর্ত পাতাল ঘুরে এসে তোমার ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সব কিছুর ফটো তুলে তোমার সামনে ধরে দেবে। বিজ্ঞান পারবে এ সব? সে বড় জোর তোমার রক্ত মাংস চামড়া শিরা ভেদ করে হাড়ের ফটোটা তুলে ধরতে পারে। কাজেই বিজ্ঞান হার মানলেই অ—জ্ঞানের কাছে আশ্রয়। আশ্রয় তো নিতেই হবে কোথাও।
একদা বৃন্দেও এ তল্লাটের পরম ‘আশ্রয়’ ছিল। বৃন্দের নাম তখন একডাকের মাথায়। বৃন্দে তখন ‘গুনীন মা’। বিপদে পড়লেই ডাক ডাক বিপদতারিণী গুনীন মা—কে। কিন্তু এখন পালা বদলে গেছে। এখন বিন্দেবুড়িই যেন গ্রামের একটা বিপদ—কেন্দ্র।
ওর দৃষ্টি পড়ার ভয়ে ওর বাড়ির সামনে দিয়ে সাধ্যপক্ষে কেউ হাঁটে না।…. অথচ ঝোপ জঙ্গল আর ফণীমনসার বেড়ায় ঘেরা বুড়ির ওই বাড়িটার সামনে দিয়েই স্টেশনে যাবার শর্টকাট রাস্তা। গ্রাম সুদ্ধ লোকেরই তো ডেলি প্যাসেঞ্জারীর ব্যাপার। পুরুষ ছেলেরা তো নিশ্চয়ই যাবে, গ্রাম ঝেঁটিয়েই যাবে। কলকাতা না ছুটে গতি কি? এখানে ‘পাত’ সেখানে ‘ভাত’।
গ্রামের বৌ—ঝিও তো কম যায় না পড়তে, পড়াতে, চাকরি করতে, গান শিখতে, এমন কি সেলাই—বোনা শিখতেও।
সুবোধ কুমোরের মেয়েটা নাকি মাটির মূর্তি গড়া শিখতে নিত্যদিন রেলগাড়ি চড়ে কলকাতায় যাচ্ছে আসছে।
এত প্রগতির হাওয়া সাগরপুকুর গ্রামে, তথাপি সব স্টেশন যাত্রীরাই বিন্দের দিষ্টির ভয়ে দুশো পাঁচশো গজ বেশী হাঁটা স্বীকার করে নিয়েও ভাঙা শিবমন্দিরের পিছন দিয়ে ইস্কুলবাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরে স্টেশনে যায়। শুধু সাইকেল আরোহীরাই যা চোঁ চাঁ মারে সামনে দিয়ে।
মুশকিল এই, বুড়ির বর্তমানের বাসস্থান ওই খড়ের চালার ঘরটা, আর ফাটা বাঁশের খুঁটির ঠেকনোয় ঠেকানো থুত্থুড়ে দাওয়াটা, একটা ঢিপি জমির ওপর। সেই দাওয়ায় বসে থাকা বুড়িটাকে দেখলে ঠিক অশোকবনের চেড়ির মতো দেখতে লাগে! আর মরা আগুনের ঢেলার মতো চোখটাও চোখে পড়ে।
অথচ জমজমাট জ্বলজ্বলট যে ঘরবাড়ি আর সাজানো সংসারখানা ছিল বৃন্দের, সেখানে এখন আর তার পা ফেলবার হুকুম নেই! ও মুখো হতে গেলেই টগর ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেবে। বলবে—এখেনে ক্যানো? এখেনে উঁকিঝুঁকি ক্যানো? আমার বাচ্চাকাচ্চাকে নজর দিতি এইচিস বুড়ি?
‘নজর’। হায় সে ক্ষমতা যদি এখন থাকত বৃন্দের।
তাহলে এতদিনে কবে টগরের ‘সপুরী একগাড়ে’ হয়ে যেত। কিন্তু বৃন্দে এখন বিষ হারানো ঢোঁড়া। বৃন্দের এখন মন্তর—টন্তর বিস্মরণ হয়ে গেছে, শেকড়—বাকড় চিনতে পারে না। বাণ মেরে অন্যকে শুকিয়ে দেবে কি, নিজেই তো শুকিয়ে শুকিয়ে আখের ছিবড়ে হয়ে গেছে। শুকিয়েছে বয়েসে, শুকিয়েছে মনের জ্বালায়, আর শুকিয়েছে পেটের আগুনে।
সর্বনাশিনী সর্বগ্রাসিনী টগর বৃন্দেকে শুধু দূরদূর করে তাড়িয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তার রুজি রোজগারের পথটুকুও বন্ধ করে দিয়েছে শয়তানীর জাল ফেলে ফেলে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শক্তি যাচ্ছিল, রোজগারও কমে এসেছিল, বৃন্দের ‘দুলোর বাপ’ মরতে সাহায্যকারী হারিয়ে, আরোই ক্ষীণধারা হয়ে এসেছিল, তবু কিছু তো ছিল?
এখনকার বাচ্চাদের পেঁচোয় না পাক, হঠাৎ জ্বরের তাড়সে ‘তড়কা’—টা তো হয়? আমাশা, ঘুংড়ি কাসি এ সবও হয়ে পড়ে রাংতামোড়া বড়ি—ফড়ি ছাপিয়েও। আর বুড়োদের ঘাড়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা এগুলোও হয়। বৃন্দের জল—পড়া তেল—পড়াগুলো তো এ সবে ম্যাজিকের মত কাজ করত। এইটুকুর পেন্নামী থেকেই পেটটা চলে যেত একা বৃন্দের। টগর সে গুড়েও বালি দিয়েছে।
টগরের বিষ মন্তরে চাকা ঘুরে গেছে। এখন বৃন্দে সাগরপুকুরের বিভীষিকা স্থল। বিপদতারিণী থেকে বিপদকারিণীর ভূমিকায় দাঁড় করিয়েছে এখন তাকে দেশের লোক।
ইচ্ছে করে তো কেউ ওর ছায়া মাড়াতে যায়ই না, দৈবাৎ পথে ঘাটে দেখতে পেলেও ছুট মারে।
তা পথে দেখাটাও ক্রমশঃই বিলোপ পাচ্ছে। শুধু ঘাটেই বলা যায়। লাঠি ঠুকে ঠুকে খুট খুট করে যায় বৃন্দে শুধু ঘাটে। পেট বড় কড়া মনিব। মায়া মমতার বালাই নেই, উঠতে না পারলেও ঠেলে তুলে খাটতে পাঠায়।
পুকুরে তো যেতেই হবে।
বৌ হারামজাদি তো ‘টিপকল’ সমেত উঠোনটাই দখল করে নিয়েছে।
এতটুকুন একটা মেটে কলসীর গলায় গামছা বেঁধে দুলিয়ে দুলিয়ে একটু রান্না খাওয়ার জল নিয়ে আসে বিন্দে পুকুর থেকে। আর পুকুর পাড় থেকে খুঁটে খুঁটে নিয়ে আসে কিছু শুষনি কলমি শাক, দুটো শামুক গুগলি। কি দুটো ‘ঘেনি কাঁকড়া’।
ধনুকের মত গোল হয়ে যাওয়া শরীরটাকে আরো গোল করে হেঁট হয়ে বৃন্দে যখন ওই সব সংগ্রহ করে, তখন ওর ঘাড়টা অসম্ভব নড়ে। আর ঘাড় নড়ে বলে মাথার ওপরকার ঘোলাটে সাদা ঝাঁকড়া চুলগুলো মুখের দু’ধারে সাপের ফণার মত দুলতে থাকে। দৃশ্যটা দূরে থেকে ছোট ছেলেমেয়েদের পিলে চমকে দেবারই মত। বড়দেরও ভীতিকর।
ঘাড় আরো বেশী নড়ে, বিন্দের বিড়বিড়িনি বকুনির ঠ্যালায়।
বকুনি আর কি!
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে গাল পাড়া। স্বর্গের ভগবানকেও ছেড়ে কথা কয় না। তবে প্রধান টার্গেট হচ্ছে দুলোর বৌ টগর। যে বৌটার স্বামী হঠাৎ হাট থেকে ফিরে ‘বুক কেমন করতেছে’ বলে ধড়ফড়িয়ে মরে যাওয়ায় রটিয়ে বেড়িয়েছিল, বেটার বৌয়ের প্রতি আক্রোশে তাকে জব্দ করতে নিজের বেটাকেই বাণ মেরে খতম করেছে বুড়ি। ….. তদবধিই বিন্দে গ্রামের বিভীষিকা।
বিন্দের তাই এখন গালমন্দই একমাত্র অস্ত্র।
ইহ পৃথিবীতে যত গাল থাকতে পারে তার সবগুলো বৃন্দে ছেলের বৌয়ের প্রতি প্রয়োগ করে। আর ইহ সংসারে মেয়েমানুষের জীবনে যত রকম দুর্দশা ঘটা সম্ভব, সেই ‘দশা’গুলো বৌয়ের ভাগ্যে ঘটাবার জন্যে তার জানা জগতের যাবতীয় দেবদেবীর কাছে প্রার্থনা করে।
কিন্তু সবই ওই বিড়বিড়িয়ে। গলা তুলে গাল পাড়বার সাহস ঘুচে গেছে। গেছে বৌয়ের বন মেয়েটা লায়েক হয়ে ওঠা পর্যন্ত। বছর দশেকের মেয়েটা একদিন একখানা খেঁটে বাঁশ উঁচিয়ে তেড়ে এসে বলেছিল, ‘ফের যদি মায়ের নামে গাল পাড়বি, তো এই বাঁশ মেরে মাথা ফাইটে দেবো, তা বুলে আকচি অ্যাঁ।’
তদবধি ‘গলা’ বন্ধ বৃন্দের ওই বিড়বিড়। ওটাই এখন রোগে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় নড়ে, আর গলার নলি নড়ে।
ফণীমনসার বেড়ায় ঘেরা থুত্থুড়ে চালাঘরটার দাওয়ায় বসে মাৎগুড়মাখা চালভাজার গুঁড়োর দলা গিলতে গিলতে বিড়বিড় করে, আচ্চয্যি! এখনকার কাঁচা কচিগুলান কি সব্বাই আকুলি—সুকুলির বর পাওয়া? মা চণ্ডির বরপুত্তুর? তাই সাজজন্মে অ্যাকটাকে ডাইনেও চোষে না?
টগর যে গাঁয়ে তার দফারফা করে রেখেছে, সেটা বুড়ির জ্ঞান গোচরে ধরা পড়েনি, অগোচরেই রয়ে গেছে। কেউ তো আর কাছে এসে বলে যায় না। তাই ভাবে রোগ—বালাই উপে গেছে গ্রাম থেকে। তাই বলে, মা ওলাইচণ্ডীও কি গাঁ থেকে বিদেয় নেচে গা? মা শেতলা তার বেটাদের আঁচলে গিঁট বেঁদে থুয়ে একেচে?……আর ভূতপেরেৎও ভেবোন ছাড়া হয়ে গ্যাচে? তাই ঝি বৌর গায়ে এট্টু হাওয়া বাতাসও নাগে না?…. তবে আর গিরোস্তো বাড়ি থেকে বিন্দে কাওরাণীর ডাক পড়বে কোন কাজে?
কত ঝি বৌর দাঁত কবাটি ছাইড়েচে এই বিন্দে। কত বেয়াড়া মেয়ের ভূত ছাইড়েছে। চোক উল্টে যাওয়া ছেলেপুলেরে সোজা করে দাঁড় কইরে দেচে। …. ডাগদার বোদ্যি কি আর ছেল না গাঁয়ে? ছেল, তবু বিন্দেকে নৈলে চলতনি কাউর।…
এখন যেন সব সায়েব ম্যাম হয়ে গ্যাচে। আহা,মা ওলাইচণ্ডি, মা শেতলা, ভূত পেরেৎ হাওয়া বাতাস, সবাই মিলে একবার ঝাঁইপে পড় না এই সাগোরপুকুর গাঁয়ে।
আর বিন্দেকে শোক্তি দাও। নোতুন যৈবনের মতন শক্তি।
মনের প্রাণের কথা শোনবার লোক চলে গ্যাছে। অন্য আর কে এমন ভয়াবহ কথা কান পেতে শুনবে? তাই এই আক্ষেপের বাণী, প্রার্থনার বাণী ওই চালভাজার গুঁড়োর মধ্যেই গুঁড়ো হয়ে যায়।
কিন্তু শুধু বৃন্দে বুড়ি কেন? আধবুড়ো অনঙ্গ ডাক্তারই যখন তার ফাঁকা ডিসপেনসারি ঘরের মধ্যে হাতল ভাঙা চেয়ারটায় বসে কাঁচা পাকা গোঁফের ঝুড়িতে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বলে, দেশটা কি বিলেত হয়ে গেল, অ্যাঁ! চিরপরিচিত রোগগুলো সব উবে গেল তল্লাট থেকে? এখন রোগের মধ্যে রোগ, যত সব দুরারোগ্য ব্যাধি? নে, রুগী নিয়ে কলকেতায় ছোট। কলকেতায় যেন ধন্বন্তরী বসে আছে! কলকেতায় লোক মরে না!
বলি অনঙ্গ ডাক্তারের হাতে এ—যাবৎ ক’টা রুগী ফেঁসেছে? গুণে বলতে পারি।….. খাতায় লেখাও আছে। ডাক্তার মরলে দেখিস খাতা খুলে। … আর তোদের ওই কলকেতার পেশালিস্টদের হাতে? হুঁ! … বলি নাড়িজ্ঞান আছে কারুর? রুগী নিয়ে গিয়ে সামনে ধরে দিলেও তো টাচটি করে না। হুকুম হবে রুগীর রক্ত আন—ইউরিন আন—হ্যান আন—ত্যান আন—মাথা থেকে পা অবধি এক্সরে ফটো আন, তবে রুগী ছোঁব। … তখন বাবুদের হাজারে হাজারে টাকা ঢালতে পেছপা নেই। মাসের পর মাস ঘোরাচ্ছে। রুগী বয়ে বয়ে কলকেতায় যাও আর আসো, তারপর আর বোয়ো না। তাকে হাসপাতালে রেখে এসো, আর শেষ অবধি কলকেতার শ্মশানে পুড়িয়ে খালাশ হও।… অথচ অনঙ্গ ডাক্তারকে দুটোর ওপর তিনটে ভিজিট দিতে হলেই বুক ফেটে যায়। তখন শাসানি—কই ডাক্তার? কিছু তো উন্নতি দেখছি না। …. তা দেশটা বিলেত হয়ে গেল বৈ আর কী বলব? দুরারোগ্য ব্যাধি ভিন্ন কলেরা নেই, বসন্ত নেই, ম্যালেরিয়া নেই, পেটের অসুখ রক্ত আমাশা পর্যন্ত নেই। ছিঃ? থাকবে কোত্থেকে? এখন যে সব স্বয়ং কর্তা বাবুদের পকেটে পকেটে ওষুধের মোড়ক। বিশ্বসুদ্ধ সবাই ডাক্তার হয়ে বসে আছে। রোগকে কি আর মাথা তুলতে দেয়?
তখন কি আর দেয়াল ছাড়া অন্য কাউকে বলে অনঙ্গ দাস? এ—সব কথা মনেরও অগোচরে থাকে।
শুধু মড়িপোড়া ঘাটের ‘গুনো ডোম’? সে রাতের বেলা হাই তুলতে তুলতে তার সাকরেদকে ডেকে ডেকে হেঁকেই বলে, হ্যাঁ রে বেচু, সাগরপুকুরের লোকগুলো কি অমর হবার পিতিজ্ঞে নিয়েচে? রাতভোর বাসর জাইগে বোস করে রইচি, একখান মড়া নাই?
গুনো ডোমের ঘাটটাকে এখন ‘সাগরপুকুরের’ লোকেরা সভ্য করে বলে ‘বার্ণিংঘাট’ তা ‘বার্ণিং’ হতেই বা আসচে কে? আসবে না। বড়জোর দিনান্তে দুটো কি একটা। অথচ আগে?
গুনো উদ্দীপ্ত হয়ে উঠে বসে বলে, ত্যাখনকার কতা মনে কর বেচা! গাঁয়ে এ্যাক অ্যাকটা মড়োক নাগচে, আর তোতে আমাতে চিলু সাজাতে দিশে—পিশে পাচ্চিনে। … এই আসচে, এই আসচে তার ওপোর তার ওপোর। দিন রাতের ভেদ নাই।
বেচু হয়তো বলে, আজকাল আর লোক রাত—ভিতে বেরোয়—না মামা, মড়া কোলে নে বোস করে থাকে ফর্সা হবার ওপিক্ষেয়। অথচ অ্যাখোন মা মনসার বংশোধরেরাও তো নোপাট্টি। আর জনে জনে হাতে টচবাতি। ভয়ের কী আচে?
গুনো নিঃশ্বাস ফেলে বলে, রাতে বেরোয় না—তো দিনোমানেই বা বাসিমড়ার ভিড় কই? সাদে বলচি এ তল্লাটের লোকেরা অমর হবার পিতিজ্ঞে নেচে।
তা গুনোর এ আক্ষেপও তার প্রাণের প্রাণ পাতানো ভাগনা বেচু ভিন্ন কি আর কারো কানে ঢোকে? কাজেই গ্রামবাসীর টের পাবার উপায় নেই তাদের সেই অতি অকিঞ্চিৎকর বেঁচে থাকাটার উপর কোথায় কি বিষদৃষ্টি পড়ছে।
তবে এমনিতেই বৃন্দের ‘দৃষ্টি’ সম্পর্কে সবাই অবহিত।
বৃন্দের ওপর দিকের তিন পুরুষ, না, ঠিক পুরুষ বলা চলে না, তিন নারী’ই বরং বলতে হয়, মা দিদিমা আর তস্য মা সবাই ছিল নাড়িকাটা দাই। গেরস্ত বাড়ির আঁতুড় ঘরই তাদের কর্মক্ষেত্র। বৃন্দে যে কেমন করে ‘গুনীন মা’ হয়ে উঠেছিল সেটাই রহস্য।
অবশ্য রহস্য আবিষ্কার করতে গেলে, উৎস—মুখের সন্ধান যে না মেলে তা নয়। বৃন্দের যখন প্রথম বয়সে মানে বাল্যবয়েসেই, সত্যকার বিয়ে হয়েছিল, এবং বেশ ক’বছর শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়েও ছিল, তখনই এই বিদ্যাটি শিক্ষার সূত্রপাত।
বৃন্দের দিদিশাশুড়ি ছিল ওদের হলুদ গাঁয়ের নাম—করা মেয়ে। যত রকম জড়ি—বুটি শেকড়—বাকড়ের সঞ্চয় থাকা সম্ভব, তা তার ছিল। দিদিশাশড়ির এই সব জড়ি—বুটির সাপ্লায়ার ছিল একটা যোয়ান বয়সের বেদেনী। তার সঙ্গে ভাব—ভালবাসার সূত্রেই বিন্দের এই বিদ্যে শেখার সূত্রপাত। উৎসাহ দেখে দিদিশাশুড়িও শিখিয়েছিল অনেক। নিজের সব বিদ্যেই মরণকালে নাতবৌকে দিয়ে যাবে এ অঙ্গীকারও করে রেখেছিল, কিন্তু তার মরণকালের আগেই বিন্দের মরণ হল।
‘অমনিষ্যি’ যে বরটা ছিল বিন্দের সেটা একদিন বলা কওয়া নেই দুম করে মরে গেল, আর বিন্দেও পত্রপাঠ তার পিসতুতো দ্যাওরের সঙ্গে পলায়ন দিল।
ওদের সমাজেও দ্যাওরের সঙ্গে বিয়ে হয় না। কিছুদিন ঘুরল একসঙ্গে, কারণ লোকটার ছিল ওই ঘুরুনীর নেশা। আর যুবতী বিন্দের কাছে তখন পৃথিবীটা দারুণ আকর্ষণের। বলতে কি—ওই দেশ বিদেশ ঘোরার প্রলোভনেই দেশ ছেড়েছিল বিন্দে। কিন্তু লোকটার নেশা লোকটাকে আরও দূরে নিয়ে গেল।
একদিন মুঙ্গেরের গঙ্গার ঘাটে ‘তুই এট্টু বোস, আমি আসতেছি—’ বলে বিন্দেকে বসিয়ে রেখে সেই যে হাওয়া হয়ে গেল, তো গেলই।
বিন্দে কি তা বলে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে এই বিশ্বাসঘাতকতার জ্বালা জুড়োবে? না, তেমন পলকা ধাতুর মেয়ে বিন্দে নয়। বিন্দে সেই মুঙ্গেরের ঘাট থেকে অনেক ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে আর একটা পুরুষের ঘাড় জোগাড় করে, তার সঙ্গে তারই গাঁ এই সাগরপুকুর এসে ঘর বাঁধল। দুলো তার এই তৃতীয় সংসার জীবনের ছেলে।
এই সাগরপুকুরেই বিন্দের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কেটেছে, বিন্দে সংসার করেছে, জমি—জিরেত করেছে আবার দোহাতা কর্মজীবনের পশার জমিয়েছে। এত ঘোরা ঘুরতির মধ্যেও বিন্দের অতীত বিদ্যাটি নষ্ট হয়ে তো যাইইনি, বরং বেড়েছে। নানা সংস্পর্শে এসে নানা সাহায্যে বেড়েছেই সত্যি।
বিন্দে মানুষের ভাল করতেও শিখেছে, মন্দ করতেও শিখেছে।
তবে গেরস্ত ঘরের ঘর সংসারী মানুষরা তো মন্দ করতে বলতে তেমন সাহসী নয়, ভাল চাইতেই আসত ছুটে ছুটে, আর সে ভালটাই করত বিন্দে। জল পড়া তেল পড়া মাদুলী শেকড় বাকড় ঝাড় ফুঁক, যা চাও, বিন্দের কাছে আছে।
কোলের ছেলেকে মায়ের কোল থেকে ‘ডান চুষলো’—ছেলে বমি করে করে নেতিয়ে পড়ে যায় যায়—তখনই ডাক ডাক গুনীনমাকে ডাক।
তখনকার বিন্দের চেহারা, যদ ক্যামেরায় ধরা থাকত, এখন দেখলে কি কেউ বিশ্বাস করত, সেই মানুষটা এই মানুষ?
মাজামাজা গড়ন, পিঠ ছড়ানো কালো চুলের ‘ঢাল’। মুখ চোখ কুঁদে কাটা। সুন্দরী ছিল বৃন্দে কালো রঙেও।
কিন্তু রূপ—যৌবন জিনিসটার তো চিরস্থায়িত্বের গ্যারান্টি নেই। তুকতাকেও থাকে না। রূপ তো গিয়েইছিল—
বিন্দে ক্রমশ গেঁয়ো যোগীও হয়ে পড়েছিল। লোকের হঠাৎ ঘাড়ে কোমরে ব্যথা আটকে ধরলে অভ্যেসের বশে বিন্দের কাছে ‘ঝাড়াতে’ যাচ্ছিল বটে, কিন্তু হাতে হাতে ফল পেলেও, বলছিল—’দূর! ওই অ্যানাসিনের বড়ি দুটোই কাজ করল।’
বিন্দের কালো চুল শাদা হচ্ছে, ভরাট গালে ভাঙন ধরছে। খাড়া ধনুক শরীরটাকে অলক্ষ্যে কে কোথায় বসে যেন ছিলে পরাবার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর ওদিকে সাগরপুকুরের মাটি থেকে ম্যালেরিয়া কমছে, ওলাবিবি বিদায় নিচ্ছে, মা শীতলা, যদিবা তাঁর তিন ছেলের মধ্যে দুটোকে মাঝে মাঝে ছাড়ছে, কিন্তু আসল জোরাল ছেলেটাকে সহজে আঁচল ছাড়া করছে না।
অনঙ্গ ডাক্তারের মতন তো বিন্দের হাতে পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। তাই রাতের অন্ধকারে পুকুরের জলে ছড়িয়ে রেখে এসে মড়কের পদধ্বনির আশায় ঘণ্টা গুনবে।
দুলোর বাপ থাকলেও হয়তো বা করত একটা ব্যবস্থা।
সাপও মরে লাঠিও ভাঙে না এমন সব ওষুধ তারও জানা হয়ে গিয়েছিল। সংগ্রহ করে আনতে পিছপা হত না। আর এমন অলক্ষ্যে কাজ সারত যে শিবের বাবাও টের পেত না। মন্দটি করে রাখত সে আর বিন্দে ভাল করত। ধরা পড়ত না।
অনঙ্গ ডাক্তার ধরা পড়েছিল।
আর পড়েছিল বিন্দের হাতেই।
রাতের অন্ধকারে দু’জনে মুখোমুখি। পুকুরের জলে ‘ওষুধ’ ঢালবার মুখে।
বিন্দে শেকড়ের চেষ্টায় গিয়েছিল।
গেরস্থদের বৌ ঝি বিশেষ একটা ‘ওষুধের’ জন্যে তখনো বিন্দের দ্বারস্থ হত। দশটা কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ল্যানজারি হওয়ায় যে সুখ নেই, সেটা বুঝেছিল তারা গরমেণ্টের প্ররোচনার অনেক আগে থেকেই। তাদের সেই বোধ বুদ্ধির সহায়ক ছিল বিন্দে। তাই অমাবস্যার রাত্তিরে পুকুর ধারে শেকড় তুলতে এসেছিল সে।
ডাক্তারের ক্রিয়াকলাপটা দেখে ফেলে বিন্দে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় প্রশ্ন করল, ডাক্তার মশাই এটা কি হল?
অ্যাঁ! কে? কে তুই? কোনটা কি?
শুদোচ্ছো ক্যানো? নিজেই জানো নাই?
অনঙ্গ দাবাড়ি দিয়ে অস্বীকার করতে পারত কিন্তু সেইমাত্র অকর্মটা করে ফেলে বুকটা ধড়ফড় করছিল—তাই বলে উঠল, চুপ বাবা চুপ! তোর মা চণ্ডীর দোহাই! কাজটার ফল ফললে তো তোরও লাভ, আমারও লাভ!
বিন্দে তীব্র গলায় বলল, আর গুনো ডোমেরও লাভ।
আহা না না, অত কিছু না। তেমন জোরালো কিছু না। শুধু একটু রোগ—বালাই হতে পারে।
আচ্চা দেকব। ত্যামন হলে তোমায় ধরে নে গে মা চণ্ডীর তলায় বলিদান দেওয়া করাবো, তা কয়ে রাকচি।
অনঙ্গ মুসড়ে গিয়ে খানিকটা তুতিয়ে পাতিয়ে শেষে রেগে গিয়ে বলেছিল, আচ্ছা, তোরও হাটে ভাঙবার হাঁড়ি আছে।
কী আচে আমার, অ্যাঁ? কী আচে শুনি?
আছে। তোর বেটার বৌই বলেছে। বলে হন হন করে চলে গিয়েছিল অনঙ্গ ডাক্তার।
কিন্তু দুজনারই কপাল। তেমন কিছু ছেড়ে কিছুই হল না। নির্ঘাৎ ভেজাল ওষুধ।
আর সাগরপুকুরের লোক তো সহজে পুকুরের জল ব্যাভার করছে না অনেক দিন থেকেই। রাস্তায় রাস্তায় টিপকল বসিয়ে দিচ্ছে গরমেণ্ট। পয়সাওলারা নিজেরাই নিজ নিজ উঠোনে বসিয়ে নিচ্ছে।
বিন্দের উঠোনেই তো টিপকল বসেছে তখন।
প্রথম যখন জিনিসটা গাঁয়ে চালু হয়েছে। দুলোর বাক উয্যুগ আয়োজন করে নিজের উঠোনে ওই ‘পাতালগঙ্গা’ বসিয়েছিল।
সেই জিনিস এখন দুলোর বৌয়ের অধিকারে।
সর্বস্বই তার অধিকারে। পেটের বেটাই বিন্দেকে দূর দূর করে খেদিয়েছে।
বুড়ি আমার মেয়ে ক’ডাকে নজর দে নজর দে ওগা করে দেচে—।
এই ঢেউ তুলে টগর দুলোকে লেলিয়ে দিয়ে বিন্দেকে ভিটে ছাড়া করে রান্নাঘরের ধারে ওই চালাখানা তুলিয়ে বসতি করিয়ে দিয়েছে। তার মানে দূর করেই দিয়েছে।
তাড়িখোর দুলো, বোঝ না সোঝা। ঠ্যাঙা নিয়ে বোঝ। বৌয়ের কথা শুনে বলেছে, তাই তো, মেয়েগুলানতো রোগা হয়ে গেছে।
দুলো মাকে চোখছাড়া করে এসে মায়ের ঘরের বড় চৌকিখানায় হাত পা বিছিয়ে শুয়ে বলেছে, ভালই হল। আমার একখানা নেজস্বো ঘর হল। তোর ওই নরিষ্টি, গরিষ্টি মেয়ে তিনডেরে নে। তুই ও ঘরে রাজত্বি করগে যা টগরি।
কিন্তু সে আর ক’দিন? দুলোকেও তো সে চৌকি ছাড়তে হল। কে জানে এখন কোথায় কোন চৌকি জুটেছে তার। এখন তো সবটাতেই টগরের রাজত্বি। বিন্দে বুড়ি ও অঞ্চলে পা দিতেই পায় না।
মাঝে মাঝে গলা তুলে চেঁচায় বটে, টিপকলের জলডা আমারে নিতে দিবেনি ক্যানরে লক্ষ্মীছাড়ি? নান্নাখাওয়ার জলডা নিতে দিবিনে ক্যান? ওডা তোর শোউরের তৌউরি না। সে মালিক না?
টগর বিদ্রূপের হাসি হেসে বলে, তো যমের বাড়ি থে ডেকে নে আয় মালিককে। তা—পর দখল নিতে আসিস।
নিরুপায়ের শেষ অস্ত্র শাপ—শাপান্ত।
টগর যে তার ওই সোয়াগের মেয়ে তিনটেকে নিয়ে রাতারাতি বিছানায় মরে থাকবে, এমন ভবিষ্যৎ বাণীও করে বিন্দে।
টগরও চেঁচাতে ছাড়ে না, আর দু’পক্ষ যখন সপ্তমে ওঠে, তখন ঘরের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে সেই দস্যি লোকটা, দুলোর জায়গায় যে ওই সংসারটাকে বাগিয়ে নিয়েছে। ওখানেই খায় শোয় বসে দাঁড়ায়, আর সংসারটার শ্রীবৃদ্ধিকল্পে দৈত্যের মত খাটে।
তাড়িখোর দুলো উঠোনের একমুঠো ঘাস কখনো ছেঁড়েনি। আর এ লোক ওইটুকুতেই সোনা ফলাচ্ছে।
সে এসে টিপকলটার ধারে দাঁড়ায়, আর হুঙ্কার দিয়ে বলে, হয়েচেটা কী? অ্যাতো চেল্লাচিল্লি কিসের?
ব্যস। সব চুপ হয়ে যায়।
দুলোর মেয়েগুলো হি হি করে হাসে, আর বলে বাপটারে, বুড়ি য্যানো ঢিল খাওয়া নেড়ি কুত্তার মতন পাইলে গ্যাল। তাই লয়?
আশ্চর্য!
লক্ষ্মীছাড়ি ছুঁড়িগুলো কিনা আপন ঠাকুমাকে বাঁশ নিয়ে মারতে আসে, আর নিজের বাপের থেকে সৎবাপকে ভালবাসে। ‘বাপটা’ বলতে গড়িয়ে পড়ে একেবারে।
দেখে আর রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে যায় বিন্দের। মাথার চুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে শাপ দেয়, মরবি মরবি। মা ওলাবিবি তিনডেরে অ্যাক সাতে ধরবে। আত পোয়াতে না পোয়াতে, দোকখিন দোরে যাবি।
ওরা আর ভয় পায় না।
একই কথা শুনে শুনে কানে ঘাঁটা পড়ে গেছে।
নতুন কথা আর পাবে কোথায় বিন্দে? শুনতে পেলে মেয়েগুলো জিভ ভ্যাংচায়, পা দেখায়, আর হি হি করে হাসে। বুড়ি তখন যদি বলে, পা দ্যাকাচ্চিস? বাপের মায়েরে পা দ্যাকাচ্চিস? ওই পায়ে কুট হবে, জিব খোসে যাবে—। সেটাই কি নতুন বলে?
কিন্তু আর কোন সম্বল আছে এখন বিন্দের?
সন্ধেবেলা ভাতের পাট নেই। কোথায় ভাত যে পাট থাকবে? ক্ষমতাই বা কোথায় ভাত সেদ্ধ করতে? সন্ধ্যেবেলা চালের খড় খসে পড়া থুত্থুড়ে দাওয়ার নীচে বসে তেল নুন আর জল মাখা ছাতুর গুলি চিবোতে চিবোতে বৃন্দে উদাস দৃষ্টিতে আকাশ পানে তাকিয়ে তাকিয়ে তার সেই উজ্জ্বল সমারোহময় দিনগুলোর কথা ভাবে।