উড়াল – ৬

ছয় – বিমল

সেদিন আমরা তিনজন, কেতকীর কেবিনে।

—”তুমি আমার মধ্যে কী দেখেছিলে, বিম?”

—’তোমাকেই। আবার কী দেখবো!”

—”আমি তো একটা খারাপ মেয়ে।”

—”এই খবরটা তোমাকে কে দিল?”

—”আই নো ইট।”

—”তুমি কিচ্ছু জানো না।”

—”ইন ফ্যাক্ট তুমিই কিচ্ছু জানো না, না মালু? হি নোজ নাথিং অ্যাবাউট মি।”

—”বেশ বাবা, বেশ। আমি কিচ্ছু জানি না। আমি বোকা। হলো তো? নাউ ট্রাই টু রেস্ট আ বিট।”

—”তুমি সত্যিই খুব বোকা, বিম—বোকা না হলে এত বদ একটা মেয়ের পিছনে সো মাচ টাইম, সো মাচ লেবার, সো মাচ মানি কেউ ওয়েস্ট করে?”

—”ব্যাস? এইটুকু? আর এত আবেগ? সেটা তো বললে না? এত ভালোবাসা? সেটার অপচয় হচ্ছে না বুঝি? শুধুই দাদার সময়, শ্রম আর অর্থ যাচ্ছে?” মালবিকা বকে দেয়।

—”ইয়েস—অ্যান্ড সো মাচ হোপ—হোপিং ফর হোয়াট? বোকা বলেই তো ভুল লোককে ভালোবেসে ফেলেছো ডার্লিং। আমি খুব খারাপ, তাই তোমার এই বোকামির সুযোগ নিয়ে দিব্যি জীবনটাকে উপভোগ করে নিচ্ছি। আশা করি, টুবলুর গায়ে এই পাপের ছোঁয়া লাগবে না।”

—”কী যা তা বলছো? সত্যি সত্যি প্রলাপ বকছো তুমি আজকে! কেয়াফুল, তুমি এখন একটু ঘুমোতে চেষ্টা করো, প্লিজ।”

—”আচ্ছা বিম, কেন এমন হলো, বলো তো? আমি কেন এত খারাপ হলাম? আমি কত খারাপ তা জানতে পারলে তুমি আর আমাকে কেয়াফুল বলে আদর করতে না।”

—”করতাম। করবো। আমি সব জানি।”

—”কচু জানো। আমার কত কত সিক্রেটস আছে। আই হ্যাভন্ট ডাইভালজড দেম—হ্যাভন্ট টোলড ইউ আ থিং। কিছুই বলিনি তোমাকে। ওনলি মালু নোজ। মালু নোজ ইট অল! বাট, স—ব টুবলুকে বলে যাব।”

—”কেতকী, ক্যান উই ডিসকাস সামথিং এলস? প্লীজ, তুমি কি জানো, আজ তোমার কন্যাটি হামাগুড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আরেকটু হলেই ঐ বারান্দার সিঁড়ি ক’টা দিয়ে গড়িয়ে বাগানে পড়ে যেত? ভীষণ দুষ্টু হয়ে যাচ্ছে টুবলু। একদম মায়েরই মতন।” মালবিকা যোগ দিল।

—”হোপ নট? আই ওয়ান্ট হার টু বি লাইক ইউ। বাট আমার কপাল তো? হু নোজ?”…

—”এ ঘরে এনে ছেড়ে দেব কাল সকালে। দেখবে কী কাণ্ড করে বেড়াবে। তাণ্ডব নৃত্য—এটা টানবে, ওটা ফেলবে। যা দুরন্ত হয়েছে—”

মালবিকাকে থামিয়ে আমি বললাম—”শুধু দুরন্ত? ও মেয়ে বড় হলে মাকে হার মানিয়ে দেবে। যা ককেটিশ অলরেডি!”

—”সে সব তো আমার দেখা হবে না, তোমরা দেখো। অতদিন আমি টিকবই না। মাই টাইম ইজ আপ।”

—”ও কীরকম কথা হচ্ছে? বকুনি দেবো এবার।”

—”আমরা সবাই মিলে তোমাকে আটকে দেবো।”

—”আহা! সত্যিই যদি পারতে।” শূন্যতায় চোখ ভরে, হালকা করে হেসেছিল কেতকী। তারপরেই সামলে নিল—”বাট নো! থ্যাংক ইউ মালু, থ্যাংক ইউ। হোয়াট ইউ’ড ডান ইজ ইনাফ। মাচ মোর দ্যান ইনাফ—”

”অনেক দিয়েছ নাথ! মোর আশা তবু মিটিল না, দীনদশা ঘুচিল না—” হঠাৎ গলা খুলে গেয়ে উঠেছিল কেতকী। তখনও গলায় সুর ছিল, বুকে দম ছিল।

.

কেন এমন হয়, কেন এমন হলো, শেষদিকে মাঝে মাঝেই এই প্রশ্নটা করে আমাকে প্রচণ্ড বিব্রত করেছে কেয়া। কেন এমন হলো! কেনই বা এমন হয়।

তাও তো টুবলুর অসুখের সংবাদ সে জানত না। আমার জীবনে এই প্রশ্নটি ঘুরে ঘুরেই আসে। সকল মানুষের জীবনেই এই একটি নিরুত্তর প্রশ্ন এসেছে কখনও না কখনও। আজকের আকাশ—বাতাস মুখরিত এই একটাই প্রশ্নে। কেয়ার প্রশ্নটি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আমার কানে।

কেয়া তুমি কি জানতে পারছ আমার এইসব ভাবনা? চোদ্দমাসের গোলগাল মেয়েটাকে ছেড়ে যেতে মনে খুব কষ্ট হচ্ছিল তোমার। বারবার আমাকে বলছিলে—”মা—হারা বাচ্চা, মনে রেখো, ওর যেন অযত্ন না হয়।”—বলছিলে, ”আমার কিন্তু দোষ নেই রে টুবলু, আমি কি আর ইচ্ছে করে তোকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি? আমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে—”

হাসপাতালে গান প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কেয়ার। এত দুর্বল, এত ক্ষীণতনু হয়ে পড়েছিল মেয়েটা, গলায় জোর ছিল না, বুকে দম ছিল না। কিন্তু গান ওর মধ্যে আছড়ে পড়তো। গুনগুন করতো দিনরাত। না পারলে অস্থির হয়ে আমাকেই বলতো সে—গানটা গাইতে। আমি কি গান গাইতে পারি? ওকে সি ডি প্লেয়ারে গান শোনাতাম সর্বক্ষণ। তবু মালবিকা একটু—আধটু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে। মালবিকা ওকে ওর পছন্দসই গান শোনাত। এই সাগরপারের দেশে বিদেশী ডাক্তারদের মাঝখানে হঠাৎ আমাদের বাংলা দেশের স্নিগ্ধ সুশ্রী মালবিকা গ্রীষ্মের দুপুরবেলায় রোদ্দুরে এক—গ্লাস ঠাণ্ডা জলের মতো। ওর সঙ্গে খুব ভাব জমে গিয়েছিল কেয়ার। টুবলুর অসুস্থতার খবর কেয়ার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম আমরা সবাই মিলে। ও জানত, ও চলে যাবে কিন্তু ওর মেয়ে রইলো। মালবিকাকে বলত, ”আমি যখন থাকব না, তখনও কিন্তু তুমি ওদের একটু খোঁজখবর নিও।”

কথা রেখেছে মালবিকা। জন্ম এস্তক, এই ছ’বছর ধরে কেতকীর রুগণ মেয়েকে জগদ্ধাত্রীর মতো বুকে করে সামলে রেখেছে, আগলে রেখেছে। ঈশ্বরের দয়া হয়ে মালবিকা এসে পড়েছিল আমাদের জীবনে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি কেতকীর ডাক্তারের অ্যাসিস্ট্যান্ট একটি বাঙালি মেয়ে। ইন্টারনাল মেডিসিনেই তার কাজ। HIV, AIDS নিয়ে রিসার্চ করছে। কেতকীর ভার তার ওপরেই দিয়েছিলেন ওর ডাক্তার। চিকিৎসার যাবতীয় সংবাদ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিত মালবিকা আমাদের দুজনকেই। রোগিণীকে এবং তার অভিভাবকদের সব সত্যিকথা যথাযথ জানিয়ে দেওয়াই এখানকার নিয়ম। কিন্তু মালবিকার হাসিখুশি, মিশুক স্বভাবের গুণে সে আমাদের ভেঙে পড়তে দিত না। ডিপ্রেসড হতে দিত না কেতকীকেও। ঠিক ভাসিয়ে রাখত।

তার রোগীরা কেউ আর এখন নেই—না কেতকী, না টুবলু। তবু মালবিকা আসে। রুণার কাছে, আমার কাছে। মালবিকা এখন আমার পরিবারেরই একজন।

অদ্ভুত জীবন মেয়েটার। বারবার আছাড় খেয়েছে, বারবার উঠে দাঁড়িয়েছে। ওকে হার মানাতে পারে এমন শক্তি নেই জীবনের। অন্যদের শক্তি দেবার ক্ষমতা রাখে মেয়েটা। মস্ত ভরসা হয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সে কেতকীর। আমারও। সেই সাতটা দীর্ঘ বছরে আমার বয়েস বেড়ে গিয়েছে বিশ বছর। মালবিকা সান্ত্বনার শান্ত ছায়া হয়ে ঘিরে থেকেছে আমাদের। আজও রয়েছে।

.

কেতকীর সঙ্গে মালবিকার যে সখীত্ব হয়েছিল সেটার মূলে থাকতে পারে বেদনার অভিজ্ঞতা। মালবিকা কলকাতার মেয়ে। এখানে ডাক্তারি গবেষণার জন্য এসে হঠাৎ এক আরব ছাত্রের প্রেমে পড়ে গেল। সে এসেছিল এম.বি.এ. পড়তে, তেল—কুবেরের সন্তান। মালবিকার বাবা নেই, জ্যাঠামশাই আছেন, তিনি মুসলমান বিয়েতে মত দিলেন না। তাঁরই আশ্রয়ে—থাকা মা—ও অনুমতি দিতে সাহস পেলেন না। মালবিকা জেদ করে বাড়ির অমতেই ছেলেটিকে বিয়ে করলো। জ্যাঠামশাই ওঁর বাড়িতে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিলেন। মালবিকার প্রেমিক আগে তাকে ধর্মান্তরিত করে ফরিদা খাতুন করলো, তারপর বিয়ে। বিয়ের পরে চাকরি ছাড়িয়ে তাকে জেড্ডায় নিয়ে চলে গেল, তার গ্রীক দেবতার মতো সুপুরুষ তৈল—কুবের স্বামী। সেখানে গিয়ে মালবিকা ভর্তি হলো এক বিলাসবহুল হারেমে। সেখানে তার স্বামীর বিরাট সংসার। আরও দুটি স্ত্রী, তাদের পুত্রকন্যা, দাসদাসী—আধুনিক যান্ত্রিক যাবতীয় আরামের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা বোরখা পরতে হবে, পাঁচবেলা নামাজ পড়তে হবে, ডাক্তারিবিদ্যে প্র্যাকটিসের প্রশ্ন উঠছে না। তবে হ্যাঁ, বাড়িতে অসুখবিসুখ হলে তো নিশ্চয় দেখতে পারো, কেউ বারণ করবে না। অর্থের অভাব নেই যখন, তখন ঘরের বউ উপার্জনের প্রসঙ্গ যেন চিন্তাতেও আনে না। তার চেয়ে বাড়ির মেয়েদের ইংরিজি পড়াক।

অত্যন্ত চটপট মনস্থির করে ফেলেছিল মালবিকা। কিন্তু বাধা ছিল পর্বতপ্রমাণ। অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টায়, দু’বছর বন্দিদশার পরে, শেষ পর্যন্ত ভারত সরকারের সাহায্য নিয়ে মালবিকা পালিয়ে এসেছে। আনতে পারেনি ছেলেটাকে। ছোট্ট। মাত্র কয়েক মাসের শিশু, তাকে ওরা ছাড়েনি। স্বামীটিও কিছুতেই ছাড়তে চায়নি মালবিকাকে। মারধোর, চাবিবন্ধ করে রাখা, সবই করেছিল—শেষ পর্যন্ত তার সন্তানকে ধরে রাখলো। মালবিকা এদেশেই ফিরলো, দেশে তো যাবার জায়গা নেই—আর এখানে রিসার্চের কাজটা আবার পেয়ে গেল। সেই স্বামীটি ওকে তাড়া করে এখানে পর্যন্ত ধাওয়া করে এসেছিল—প্রেমিক বটে। কিন্তু ওকে আইনের সাহায্যে এদেশছাড়া করতে বাধ্য হয়েছে মালবিকা। প্রচণ্ড চাপ গেছে মেয়েটার ওপর দিয়ে। দেখলে সেসব কিছুই বোঝা যায় না—সুশ্রী মিষ্টি শ্যামলা, বাঙালি মেয়ে। চোখ জুড়িয়ে যায়। ওকে দেখলে বোঝা যায় না ওর বুকের মধ্যে কতবড় ক্ষত রয়ে গেছে—যা থেকে রক্তক্ষরণ কোনোদিন থামবার নয়। নিজের শিশুপুত্রকে জেড্ডায় রেখে আসতে বাধ্য হয়েছে মালবিকা। ফরিদা খাতুন মারা গেছে—এখন যে রয়েছে, তার নাম আবার ডাঃ মালবিকা সেনগুপ্ত। তার কোনো পুত্রকন্যা নেই। স্বামী—সংসার নেই। শুধু কাজ আছে। নিজের মুক্তির জন্য এই মূল্য ধরে দিতে হয়েছে মালবিকাকে—আয়ান। আয়ান তার মাকে কোনোদিন জানবে না।

অথচ আয়ানের কথাই সে কেতকীকে কোনোদিন বলেনি। ওর ধারণা কেতকী ওকে ক্ষমা করতে পারত না, অথচ কেতকীর সঙ্গে আশ্চর্য গভীর এক বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল মালবিকার। মালবিকাকে কেতকী অনেক কিছুই জানিয়েছিল, যা সে আমাকে জানায়নি কোনোদিন। মালবিকাই বোধহয় ওর জীবনের প্রথম বন্ধু, যাকে কেতকী পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পেরেছিল।

—”নো, আই ডোন্ট ট্রাস্ট এনিবডি!”—এই ছিল ওর মুখের কথা। সবার সঙ্গেই ভাব, কিন্তু সবার সঙ্গেই দূরত্ব, এই ছিল ওর জীবনযাপনের মন্ত্র। আমার সঙ্গে সেই মন্ত্র খাটেনি, আর খাটেনি মালবিকার বেলাতেও।

শেষশয্যায়, শেষ পৃষ্ঠায় এসে ওর জীবনে বিশ্বাস এল, বন্ধুতা এল। এ নিয়ে আমি দুঃখ করছিলাম মালবিকার কাছে।

মালবিকা ঠিক উলটো কথাটি বললো।

মালবিকা বললো—”কী সৌভাগ্য ওর, যে শেষমুহূর্তে ও শেষ নিশ্বাসটি ফেললো বুকভরা বিশ্বাস নিয়ে, বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে। ও একলাটি নয়, ওকে ঘিরে আছে ওরই আপনজনেরা, এটা জেনে চোখ বুজেছে।”

মালবিকা মেয়েটার এই এক আশ্চর্য গুণ, ওর পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ওকে নড়ানো যাবে না। সব সময়ে যে কোনও পরিস্থিতির মধ্যে শাদা রংটা ও ঠিক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, যতই কালোর আধিপত্য থাকুক! অথচ নিজের জীবনটা তো সংগ্রামে, বিচ্ছেদে, যন্ত্রণায় ভরা। কিন্তু সেসব মালবিকার আত্মাকে স্পর্শ করেনি, অসাধারণ স্পিরিট মেয়েটার। কেতকীর পাশে এমন একটি মানুষ যে তার সঙ্গী হয়ে, তার চিকিৎসক হয়ে শেষদিন পর্যন্ত ছিল, এ আমাদের মহা সৌভাগ্য। তারপর টুবলুকেও তো বুকে ধরে আগলে রেখেছে এতগুলো বছর। টুবলুকে দেখলে কি সেই জেড্ডায় হারিয়ে—ফেলা ছেলের কথা মনে পড়ে যায় মালবিকার? জীবনে কখনও নাম করে না যে—সন্তানের।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *