পাঁচ – মালবিকার ডায়েরি
কেতকীর মধ্যে আশ্চর্য গভীর একটা ঔদাসীন্য ছিল। এদিকে এত তীব্রভাবে জীবনকে ভালোবাসতেও তার মতো আর কাউকেই আমি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সবচেয়ে ভালো জিনিসটা কেনা চাই, দাম কত সেটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামায় না—এটাই একটা কারণ ছিল কেতকীর আর্থিক সমস্যার। রোজগার কম করত না সে। বিমলদারও বেশ মুশকিলই হয়েছিল কেতকীর ঋণ শোধ করতে করতে। অথচ এই যে মহার্ঘ সব বস্তু কেতকী কিনত, সেগুলোর সঙ্গে তার কোনো মায়ার বন্ধন ছিল না। যে—কোনো জিনিস, যে—কোনো মানুষের ভালো লাগলেই হলো।
—”তোমার এটা ভালো লেগেছে? তুমি এটা নিয়ে যাও।”—ওর মুখে অনবরত শুনেছি—”ইউ লাইক ইট? গুড! ইউ মে হ্যাভ ইট।” ভয়ে ওর কোনো কিছুর প্রশংসা করা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। আশ্চর্য একটা মুক্তি ছিল ভিতরে ভিতরে, কোনো কিছুতেই আঁটোসাঁটো লোভের বাঁধন ছিল না মেয়েটার। সব কিছুই প্রিয়, আবার সব প্রিয় বস্তুই বর্জনযোগ্য। কোনো কিছুই কি ছিল কেতকীর জীবনে, যা অনিবার্যভাবে জরুরি? এক টুবলু ছাড়া?
টুবলু হয়ে উঠেছিল কেতকীর জিয়নকাঠি, ওর প্রাণভোমরা। ”মাই লাইফলাইন।” বিমলদার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা দেখতে দেখতে গাঢ়তর হয়ে উঠলো রোগশয্যায়। স্নেহের জন্য কাঙালপনা ছিল কেতকীর। ছোট্ট থেকে বাইরে বাইরে। বাবা দ্বিতীয় সংসার করে ব্যস্ত। ছোটোমাসিই মিটিয়ে ছিলেন মায়ের অভাব। তা এমনি কপাল মেয়েটার—তিনিও চলে গেলেন বিনা নোটিশে। একটা মোটর অ্যাকসিডেন্টে মাসি—মেসো দুজনেরই মৃত্যু হলো, কেতকী তখন নিউ ইয়র্কে। মাসির মৃত্যুতে দ্বিতীয়বারের মতো মাতৃবিয়োগ হয়েছিল। এবারে একেবারেই লাগামছাড়া বেয়াড়া জীবনে ঝাঁপ দিল সে। বাবার দ্বিতীয়া স্ত্রী তাকে সংসারে গ্রহণ করেননি কোনোদিনই। নিজের পুত্রকন্যা নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকেন, স্বামীকেও আঙুলে জড়িয়ে রাখেন। কেবল টাকার যোগান দিয়েই ওর বাবা কন্যাদায় সেরে দেন। মাঝে মাঝে দু’একটা ফোন। বাবাকে ”মাই ব্যাংক ম্যানেজার” বলত কেতকী। নিজের বিয়ের কথা, টুবলুর খবর, কিছুই সে জানায়নি বাবাকে। অসুখের খবরও দিতে চায়নি, কিন্তু বিমলদা জানিয়েছিলেন। দেশে নিয়ে যাবার সময়েও খবর দিয়েছিলেন, কেতকীর অজ্ঞাতে। ও জানলে বাধা দিত।
ও বলেছিল, জামশেদপুরের বাড়িটা ওর নয়। ওর বাবার দ্বিতীয়া স্ত্রীর, আর তাঁর সন্তানদের। কেতকী কয়েকবার গিয়েছে, আগে আগে, গেলেই প্রবল অস্বস্তি ভোগ করেছে। সেখানে কেতকী একজন আগন্তুক। বহিরাগত। পরিবারের বড় মেয়ে নয়। পরিবার—বহির্ভূত কেউ। অনধিকারী কেউ। আজন্মের অবহেলার জন্য কেতকীর বাবার ওপরে যত না অভিমান, ওর বুকভাঙা একরাশ অভিমান ছিল অসময়ে মরে—যাওয়া মায়ের প্রতি। কেন তাকে এই স্বজনবন্ধুহীন সংসারে একলাটি ফেলে রেখে তিনি পরলোকে পালালেন? পালিয়েই তো গিয়েছেন। ছোট্ট তিন বছরের মেয়েটার মুখ তাঁর মনে পড়েনি।
সারা জীবনভোর কেতকীর বুকের মধ্যে গুমরে গুমরে উঠেছে এই একটা কথা, পৃথিবী ছেড়ে ইচ্ছে করে চলে যাবার সময়ে, কেতকীর মুখখানা তাঁকে পৃথিবীতে আটকাতে পারেনি।
.
—”টুবলু, তোকে ফেলে আমি কক্ষনো পালিয়ে যাব না। তোকে বড়ো করবো, জীবনে তোকে এসট্যাবলিশড দেখে, তবে মরবো। আমার মায়ের মতন ট্রেচারি করবো না তোর সঙ্গে। কক্ষনো না—’ এই ছিল কেতকীর বাচ্চাকে আদর করবার ভাষা। এত কথাবার্তা বলেও সেই তো তার মায়ের মতোই পালিয়ে গিয়েছে সে। কোথায় দেখলো সে টুবলুর বড়ো হওয়া?
এইসব কথা যখন বলতো, তখনই ভালোই জানতো সে নিজে HIV positive। জানতো না Full blown AIDS—এর কথাটা। কেতকী ভেবেছিল, সে বেঁচে যাবে। কতজনেরই তো রক্তে HIV positive virus আছে, তারা রোগটা বহন করে বেড়ায় বটে, কিন্তু AIDS—এর জীবাণু তাদের আক্রমণ করে না। কেতকী ভেবেছিল বেঁচে থাকা বুঝি সম্ভব হবে। ভাগ্যদেবতা ওকে সাহায্য করবেন। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে ইলাইজা টেস্টে জানা গেল ওর রক্ত HIV positive হয়ে গেছে। কে জানে কবে কোন প্রেমিকের সঙ্গে মুহূর্তের অসতর্ক প্রণয়ে ঘটে গেছে এই চরম সর্বনাশ। কিংবা হেরোয়িনের সূচিকাভরণের মুহূর্তে? কিন্তু ভাগ্যদেবতা সহায় হননি। শরীরে এইডসের সংক্রমণ ব্যাহত করা গেল না ওর। প্রসবের দু’মাস পর থেকেই এইডই—ভাইরাসের প্রবল প্রতাপ দেখা দিল কেতকীর দেহে। টুবলু তখন মাত্র দু’মাসের। তবুও কেতকী ওর সদ্যোজাত মেয়েকে অভয় দিয়ে বলতো,—”তোকে বড়ো করে দিয়ে তবে আমার ছুটি! আমি কেমন করে স্বর্গে যাবো? তোকে ফেলে? তোকে এতটুকুনি অবস্থায় এতবড় পৃথিবীতে একা ছেড়ে রেখে আমি যেতে পারবোই না। তোর বাবা যতোই ভালোমানুষ হোক না কেন, যতই যত্নশীল হোক, সে তো পুরুষমানুষই। ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্য তাদের মোটেই সময় থাকে না। আমি থাকবো, আমি সবসময়ে তোর সঙ্গে সঙ্গে থাকবো। আই শ্যাল অলওয়েজ, অলওয়েজ বি উইথ ইউ! আই স্যোয়্যার!”
.
খুব সতর্ক ছিল। খুব আদর করত মেয়েকে, কিন্তু সাবধানে। সর্বদা খেয়াল রাখতো কেউ যেন টুবলুর পাতলা গোলাপী ঠোঁটে চুমু না খায়। এই সাহেবদের দেশে বড়ই বিদঘুটে কিছু অভ্যেস আছে, আমাদের দেশে কেউ যা কক্ষনো করে না! শিশুদের ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চুমু খেয়ে আদর করা তার মধ্যে একটা। বাচ্চাদের মুখে কালিঝুলি লাগলে মা নিজের মুখের থুতুতে রুমাল ভিজিয়ে বাচ্চার মুখের কালি মুছে দেন—সেটা আরেকটা বদভ্যাস। দুটোর একটাও পছন্দ করত না কেতকী। সে জানতো তার বডি—ফ্লুইডের সঙ্গে কারুর রক্ত মিশে গেলেই সমূহ বিপদ। সে অশ্রুই হোক, থুতুই হোক আর রক্তই হোক। এবং অন্য কারুকেও বিশ্বাস করতো না। তারা নিরাপদ কিনা কে জানে? সে তো নিজের খবর নিজেই জানতো না। টুবলুকে বাঘিনীর মতো সামলাতো তার মা।
অথচ টুবলুর জন্যে এত সাবধানতা, এত সুরক্ষা, সে যে অভিশপ্ত হয়েই ভূমিষ্ঠ হয়েছে—এই ভয়ানক সত্যটি আমরা সকলে মিলেই অত্যন্ত যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিলাম কেতকীর কাছ থেকে। বিমলদার একান্ত ইচ্ছেয়। ক’টা দিনই বা বাকি আছে কেতকীর? কেতকী ভাবছে সে চলে যাচ্ছে, কিন্তু টুবলু রইল। টুবলু বড় হবে—এই স্বপ্ন নিয়ে যদি তার শেষ দিনগুলো খুশিতে কাটে কাটুক না? সারা হাসপাতালে আমরা সবাই স্বেচ্ছায় এই ষড়যন্ত্রে শরিক হয়েছি, কেতকী জানতে পারেনি তার টুবলু এই নিষ্ঠুর গ্রহে আরও অল্পদিনের অতিথি।
শরীরে AIDS—এর লক্ষণ ফুটে ওঠার পর থেকেই হু হু করে বৃদ্ধি পেতে লাগলো রোগ—মেয়ের বয়েস বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কেতকীকে চলে যেতে হলো। বুকভরা যন্ত্রণা নিয়ে বড় হয়েছিল মেয়েটা। একবুক ভালোবাসা নিয়ে চলে গেল।
মায়ের ওপরে তার ছিল গভীর গোপন ক্রোধ। মা আত্মহত্যা করেছিলেন, শিশু কেতকীর কথা ভাবেননি। স্বামীর প্রেমে প্রতারণাই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। আমি তর্ক তুলতাম। ও মানত না। ”আর তুমি? তুমি যেভাবে জীবনটা কাটিয়েছ, এই যে আজ তোমার অসুখ, এ কি আত্মহত্যারই নামান্তর নয়?”
”মোটেই না। আমি তো মরতে চাইনি? আমি তো জীবনটাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম মালু। উইথ অল ইটস ডার্ট অ্যান্ড মাক। উল্টোপাল্টা, এলোমেলো। যেমনই হোক সেই জীবন, আই ওয়ান্টেড টু এমব্রেস ইট—বাঁচার সময়ে কি মরার কথা কারুর মনে আসে? ইয়েস—আই মেড মিসটেকস। মোর দ্যান ওয়ান। ওকে, ইউ পে ফর ইওর মিসটেকস। অ্যায়াম পেয়িং উইথ মাই লাইফ। দ্য প্রাইস অফ লিভিং আ ফুল লাইফ। বাট আ রং ওয়ান। আমি ভুল করেছিলাম, তার দাম আমি জীবন দিয়ে শোধ করছি। আমার মায়েরটা ভুল নয়। অপরাধ। ইটস আ ক্রিমিনাল অফেন্স। শি নিউ হোয়াট শি ওয়াজ ডুইং। আই ডিডন্ট।”
কেতকী অস্থির হয়ে পড়ত মায়ের প্রসঙ্গ উঠলে, তুলতো নিজেই। এবং তাকে ভোলানো কঠিন হতো। আকুল হয়ে বলতো—”বলো তো মালু, এতে কী লাভ হয়েছিল তার? যে—প্রেমিকার কারণে স্বামীর ওপর রাগ করে মা আত্মহত্যা করলো, সেই মেয়ের হাতেই তো নিজের স্বামী সংসার তুলে দিয়ে গেলো। সো, দিস ওয়াজ হার গ্রেট অ্যাচিভমেন্ট! অ্যান্ড শি মেড মি আ পপার।”
সেই কালরাত্রি শিশু কেতকীর চেতনার গভীরে বিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।—”তুমি একবার দৃশ্যটা ভেবে দ্যাখো, মালু, ট্রাই টু ভিসুয়ালাইজ দ্য সীন—আমার মা গলায় দড়ি দিয়ে পাখা থেকে ঝুলছেন, খাটের ওপরে চেয়ার উলটে আছে, আমি, তিন বছরের আমি, সেই খাটের ওপরে গ্যাঁট হয়ে বসে বসে হাপুস নয়নে ‘মা! মা!’ বলে আকুল কান্না কাঁদছি। আর মা’র ঝুলন্ত পা দুটো ধরে টানছি। আমি ভাবছি, ঐ তো মা কেমন দুলছেন, তবে মা উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আর খুব অভিমান হচ্ছে, মার পা ধরে আরো টানছি। আমার কান্না শুনে চাকর—বাকরেরা অন্যদিক দিয়ে ঘুরে এসে জানলা দিয়ে ওই দৃশ্য দেখে, পুলিশে খবর দিয়েছিল। পুলিশ দরজা ভেঙে ঢুকেছিল। বাবাকে খবর দেওয়া গেল না, বাবার খোঁজ মিলল না—বাবা বাড়ি ফেরেননি সে—রাতে। ছোটমাসি এসে আমাকে নিয়ে গেল। আমি তখন খিদেতে ঘুমেতে ভয়েতে ক্লান্তিতে অবসন্ন, কাঁদতেও পারছি না।
তারপরে বছরের পর বছর, আমি চোখ বুজলেই দেখতে পেতাম মা’র শরীর দুলছে, আমি পা ধরে টানাটানি করছি। জানলার বাইরে মস্ত আগুনের গোলার মতন রাগী—রাগী লাল চাঁদ। সেদিন পূর্ণিমারাত্রি ছিল। বাবা বাড়ি ফেরেনি। এখনও পূর্ণিমারাত্রে চাঁদ দেখলেই আমার ভয় করে। আমি মাকে দেখতে পাই। মা’র ঝুলন্ত শরীরের পিছনে, ব্যাকগ্রাউন্ডে ছিল মস্তবড় পূর্ণিমার চাঁদ। আই হেট ফুলমুন নাইটস।”
কতবার যে কেতকী এই গল্প আমাকে বলেছে।
কেতকীর মুখ থেকে ঘটনাটা শোনার পর পরই আমারও খুব ডিপ্রেশান হয়েছিল। দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠেছিল—আর মনে হয়েছিল খাটে বসে ঝুলন্ত মায়ের পা ধরে যে টানছে, সে বাচ্চাটা আয়ান।
আমিও তো এটাই করেছি।
নিজেকে রক্ষা করতে তাকে ফেলে রেখে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি। তার দুজন সৎমা এবং অগুনতি মাসিপিসি—ধাইমাদের মধ্যে সে যদিও রাজার হালেই থাকবে—ওদের পরিবারে পুরুষ—শিশুর দেবতুল্য সমাদর—তবু, বড় হয়ে ওর কি কখনও মনে হবে না, ওর নিষ্ঠুর ভারতীয় মা—টা ওকে ফেলে চলে গিয়েছিল? আমার চয়েস ছিল, হয় আয়ানকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জেড্ডায় বন্দী হয়ে মৃত্যু যাপন, নয় আয়ানকে বাদ দিয়ে মুক্তির মধ্যে প্রাণধারণ, জীবনযাপন। আমার মধ্যে নতুন মাতৃত্বের চেয়েও আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিটা বড় হয়ে উঠেছিল। আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি, মাতৃস্নেহ, দুটোই তো জৈব প্রকৃতি—তার মধ্যে একটার কাছে আরেকটা তো হার মানতেই পারে। মানবসভ্যতা চিরকাল বিপরীতটাই দেখেছে—মাতৃস্নেহের কারণে নিজেকে বলি দেন মায়েরা—তাই সেটাই আদর্শ আচরণ। পিতৃস্নেহের জন্য আত্মবলি বাপেরা দেন না—তাই তাঁদের বেলায় অন্য হিসেব।
আমার কি পাপবোধ থাকা উচিত? এই যে আমি চার মাসের ছেলেকে তার বাপের প্রাসাদে রেখে চলে এসেছি, এটা কি অপরাধ?
আমি মনে করি না।
আয়ানকে আমি চাইনি।
আমি চলে আসতে চেষ্টা করছিলাম, বারবার পালানোর চেষ্টা করছিলাম, জাফর নানাভাবে আমাকে আটকাতে চেষ্টা করছিল—আয়ান সেই চেষ্টার একটা চরম পরিণতি। যে—রাত্রে আয়ান আমার গর্ভে এল সেই বীভৎস রাত্রের স্মৃতি সুখস্মৃতি নয়। ম্যারিটাল রেপ—এর ফলে আয়ানের জন্ম। বাঞ্ছিত শিশু হয়ে সে আসেনি আমার কোলে। আমার পায়ের শৃঙ্খল হবার জন্যই জোর করে তাকে সৃষ্টি করেছিল জাফর। ফাঁদ পেতেছিল। স্বামী—স্ত্রীর প্রণয়মিলনের ফল সে নয়। অনিচ্ছুক নারী দেহের ওপর স্বেচ্ছাচারী পুরুষের জবরদস্তির ফল। আয়ান জাফরেরই সন্তান। সে জাফরের কাছে আছে। ঠিকই আছে। একথা আমি কাউকে বলি না। মা হয়েও সন্তানের প্রতি টান অনুভব করি না—একথা শুনলে আমাকে কেউ ক্ষমা করবে না, উলটে ডাইনি বলবে। কিন্তু আয়ান ফাঁদ। ওর ফাঁদে বন্দী হয়ে পড়ব না কিছুতেই—এই মরিয়া জেদও ছিল। তাতে ওকে ছেড়ে যেতে হলে ছেড়েই যাব।
কেতকী যতবার ওর পলাতকা মায়ের ওপরে রাগ করে ততবারই আমার গায়ে ফোসকা পড়ে। আমিও তো একজন পলাতকা মা। আয়ান তো কোনোদিনই দেখতে পাবে না, জানতে পারবে না তার গর্ভধারিণীকে—যদিও তার মায়ের অভাব হবে না, মাতৃস্নেহেরও না। মাতৃদুগ্ধেরও অভাব হয়নি তার। কেতকীর মতো পরিস্থিতিতে সে পড়বে না কোনোদিন। সে থাকবে তার পিতৃকুলের শিরোমণি হয়ে।
তবু, অপরাধবোধের চাপ থেকে মুক্তি নেই। যদিও এখন আগের মতো বুকের মধ্যে আর মোচড় দিয়ে ওঠে না, রাস্তায় যখন হঠাৎ কোনো প্র্যামে—চড়া ন্যাড়ামাথা ক’মাসের বাচ্চা দেখতে পাই। কেতকী তিনবছরের মেয়ে ছিল, আয়ান মাত্র চার মাসের। সে তার মাকে চেনেনি। সে মনোকষ্টে ভুগবে না মায়ের জন্য। মনোকষ্টে যদি কেউ ভুগতো, সেটা তার মা—ই। কিন্তু অনেক অসুস্থ শিশুর মধ্যে কাজ করতে করতে আমি সে কষ্ট সামলে উঠেছি। সন্তানহারা মা—বাবাদের সঙ্গে আমার প্রত্যহ সাক্ষাৎ হচ্ছে। তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়াও আমার অন্যতম কাজ। না, আয়ানের কথা আমি মনে রাখিনি। সে যেখানে আছে ভালো আছে নির্ঘাৎ। পুরুষবাচ্চারা সেখানে খুব ভালোই থাকে।
কেতকীর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করলে বুঝতে পারি, কত স্বাভাবিক শৈশব ছিল আমাদের। মায়ের ঝুলন্ত মৃতদেহের সঙ্গে সারারাত্রি ঘরের মধ্যে বন্ধ হয়ে ছিল যে শিশুটি, সে তো পৃথিবীর কাছে অনেক বেশি মনোযোগ দাবি করতেই পারে। অনেক, অনেক বেশি স্নেহ—মমতা পাওনা ছিল তার।
বয়েসে বড়ো হলে কি হবে, আমি অনেক শিখেছি কেতকীর কাছে।
জন্মদাত্রীর এবং জন্মদাতার যে কীদৃশ আচরণ করা একেবারেই উচিত নয়—সেইটে শিখেছি কেতকীর কাছে। দুটোরই প্রকৃষ্ট উদাহরণ ওর ছোটবেলা। ওর বড়বেলাও। কেতকী চেয়েছিল তার বিপরীত ঘটুক তার সন্তানের বেলায়। আদর্শ মা হতে চেয়েছিল সে। নিয়তি তাকে সেই সময় দেয়নি। কিন্তু বিমলদার আশ্চর্য ভালোবাসায় তার সেই স্বপ্ন পরিপূরিত হয়েছে। টুবলু তার রোগশয্যায় একজন সদাসতর্ক, সাদা মনোযোগী বাবার সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছে একজন অদৃশ্য, কিন্তু সর্বদা উপস্থিত স্নেহশীলা মা—কেও। এই অত্যাশ্চর্য উপহার সে পেয়েছে তার বাবার কাছে। আমরা দুজনেই—বিমলদা এবং আমিও, গল্পে গল্পে কেতকীকে জ্যান্ত করে রেখেছি টুবলুর কাছে। টুবলুর এখন মা’র সঙ্গে খুব ভাব।
কেতকীর যেটা ছিল না।
ছ’সাত বছর হলো বিমলদাকে দেখছি। এমন মানুষ দ্বিতীয় দেখিনি। সব অর্থেই বিমলদা আদর্শ পিতা। তিনি টুবলুর সর্বক্ষণের সঙ্গী। কেতকী যেটা হতে চেয়েছিল, কর্মব্যস্ত পুরুষমানুষের পক্ষে যেটা সাধ্যাতীত বলে মনে করেছিল কেতকী, ঠিক সেইটেই ঘটিয়েছেন। অসাধ্য—সাধন করেছেন বিমলদা। মাতৃস্নেহ—পিতৃস্নেহ দুটি ধারাই একযোগে ক্ষরিত হয়েছে বিমলদার হৃদয় থেকে। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন যেন টুবলুর জীবনে কোনো ফাঁক না থাকে। তার অনুপস্থিত মাকেও যথাসাধ্য জড়িয়ে দিয়েছেন বিমলদা টুবলুর জীবনের সঙ্গে, গল্পে গল্পে, কথায় কথায়। অনুপস্থিত হয়েও কেতকী সত্যিই টুবলুর মনে মনে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। অথচ বিমলদা কবি নন—বিমলদা শিল্পী নন। কিন্তু নিষ্ঠুর জীবনকে যিনি কোমল এবং সুষ্ঠু শিল্পে পরিণত করতে পারেন, শুধুই কল্পনাশক্তি এবং সহৃদয়তার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে, তাঁকে আমি কোন নামে ডাকবো?