উড়াল – ৪

চার – মালবিকার ডায়েরি

অনেকবার শুনেছি সেই গল্প। বিমলদার সঙ্গে কেতকীর দেখা হওয়া, গ্রীনিচ ভিলেজে। বিমলদা গেছেন কফি খেতে, আর জ্যাজ শুনতে। কেতকী সেখানেই তার দলের সঙ্গে গুলতানি করছিল। বাঙালি মেয়ে বলে তাকে চিনতেই পারেননি বিমলদা। আঁটোসাঁটো, পেট বের করা, সরু একফালি একটা সাদা গেঞ্জির কাপড়ের ট্যাংক—টপ পরেছিল টাইট ব্লু জীনসের ওপরে। ঠোঁটে গাঁজার সিগারেট। কানে অনেকগুলো মাকড়ির নিচে দীর্ঘ দীর্ঘ ঝিরিঝিরি ফিলিগ্রির সূক্ষ্ম কারুকাজ করা রুপোর দুল। আমার মনে হয় ভারতীয় গয়নাই, নইলে আরব দেশের, না হলে দক্ষিণ আমেরিকার হবে। ফিলিগ্রি কাজের গয়না এসব দেশেই হয়। খুব মানিয়েছিল ওকে। বিমলদার চোখে লেগেছিল সেদিনকার সেই রূপ। কেতকী চলে যাবার পরেই তো শুনেছি এসব গল্প।

বিমলদা ভেবেছিলেন স্প্যানিশ মেয়ে, অনেকটা হিস্পানিক ধাঁচের চেহারা ছিল কেতকীর। ওকে পুয়ের্তোরিকান ভেবে নেওয়া ঢের বেশি স্বাভাবিক, বাঙালি মেয়ের চেয়ে অনেকটা লম্বা। বন্ধুবান্ধবরা ছিল মিশ্র—শাদা কালো দু’রকমেরই। হৈ—হুল্লোড় করছিল ওরা। দীর্ঘ, শক্তসমর্থ শরীর, সরু, মুঠোয় ধরা যায় বোলতার মতন কোমর, আর খোলা, সোজা, কালো চুল কোমর ছাড়িয়ে পড়ছে।

.

পরে জেনেছিলেন বিমলদা খুবই দামি ওই ডিজাইনার ব্লু জীনস—সরু শাদা জামাটাও ডিজাইনার টপ, এমনকি কোমরের বেলটটা পর্যন্ত। বিমলদা যখন কেতকীর এসব বড়মানুষী অভ্যেস টের পেলেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তখন টুবলুর পৃথিবীতে নেমে আসার সময় হয়ে এসেছে। আর কেতকী দোকানে দোকানে মনের আনন্দে ঘুরে যা খুশি তাই দামে বাচ্চার জন্যে শখ মিটিয়ে জামাকাপড়, খেলনাপাতি, আসবাবপত্তর কিনেই চলেছে ক্রেডিট কার্ডে। বিমলদার অর্থাভাব ছিল না। ছিল না ঔদার্যের অভাবও। কিন্তু তাঁকে মাসে মাসে দেশে টাকা পাঠাতে হয়, বাড়ির মর্টগেজ শুধতে হয়, রুণার প্রাইভেট স্কুলে পড়ার এবং হেলথ ইনস্যুরেন্সের খরচ দিতে হয়, গাড়ির লোন শুধতে হয় এবং কেতকীর অজস্র অজ্ঞাতপূর্ব লোনের বোঝা শোধ করতে হয়। খরচের ব্যাপারে কেতকী ছেলেমানুষের মতো অবোধ। বিমলদার বাধা সে শোনেনি। বিমলদার জন্যেও নিত্য নতুন উপহার কিনে আনতো—এবং তা মহার্ঘ।

কিন্তু খুব বেশিদিন এটা চলেনি। দু’বছরের মধ্যেই প্রবল ব্যাধি আক্রমণ করেছিল কেতকীকে। চোদ্দ মাসের টুবলুকে আমাদের কাছে ফেলে রেখে তাকে চলে যেতে হলো।

.

আমার সঙ্গে যখন কেতকীর আলাপ, তখন তার ছেলেমানুষি আর নেই। সে—পর্ব সারা। কেতকীর খরচেপনার গল্প বিমলদা অভিযোগের সুরে বলেননি, বলেছেন ওর ছেলেমানুষির উদাহরণ হিসেবেই।

বিমলদার আগের বউকে আমি দেখিনি। কিন্তু মেয়েকে চিনি। আগের বউটি ছিল মার্কিনি মেয়ে। সেই বিয়ে ভেঙে গেল বিয়ের চোদ্দ বছর পরে। ছোট্ট রুণা তার মায়ের সঙ্গে থাকতে চলে গেল পেনসিলভেনিয়ায়। এ সব গল্পই আমার বিমলদার কাছে শোনা। তাঁর মস্ত বাড়িতে একেবারে একলা হয়ে পড়লেন বিমলদা। এমিলি চলে গিয়েছিল তার তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ সহকর্মী অ্যালভিনের সঙ্গে। বিমলদা আটকাতে চেষ্টা করেননি। যে যেতে চাইছে তাকে কি আটকানো যায়? যেতে চাওয়া মানেই তো চলে যাওয়া। সে তো মনে মনে চলেই গেছে। অথচ এই কথাটা ক’জন মানুষে বুঝতে পারে?

জাফর তো কিছুতেই বুঝতে চায়নি। আমাকে ধরে রাখবার জন্যে জাফর কী কুৎসিত কাণ্ডই না করেছিল। যত চেষ্টা করেছি পালাতে, সবেতে বাধা দিয়েছে, শেষে ইউনাইটেড স্টেটসে পর্যন্ত ধাওয়া করে এসেছিল আমাকে জেড্ডাতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে।

আর যাকে ধরে রাখতে পারা যায় সেই ছোট্ট মানুষটিকে তার বাড়ির পনেরোজন নারীর প্রহরায় বন্দী করে রেখেছিল—যাতে তার জন্যও আমি ফিরতে বাধ্য হতে পারি। আমি ফিরিনি। নাড়ী ছিঁড়েই চলে এসেছি। নাড়ী—ছেঁড়া ধনটিকে ফেলে। আয়ান যদি মেয়ে হতো, না—নিয়ে আসতাম না। কিন্তু ও পুরুষ বাচ্চা। ঠিক থাকবে, যত্ন পাবে।

.

যে যাব—যাব করে অস্থির, যে চলে যেতে চাইছে, তাকে কি ধরে রাখা যায়? সে তো চলেই গেছে। বিমলদা বুঝতেন, তাই এমিলিকে বাঁধতে চেষ্টা করেননি, টানাহেঁচড়া করেননি রুণাকে নিয়েও। ছোটো শিশু, কন্যাসন্তান, তাকে তার মায়ের কাছে রাখাই ভালো। নিজে তো ব্যতিব্যস্ত থাকেন কাজেকর্মে, কখন নজর দেবেন বাচ্চার দিকে? রুণা বরং মায়ের কাছেই ভালো থাকবে। বিমলদাই রুণার পড়ার খরচ যোগান। প্রত্যেক ছুটিতে রুণা আসে বাবার কাছে বেড়াতে। রুণা হাইস্কুল শেষ করে, কলেজে ঢুকলো এবছর। শিকাগোয় অ্যাডমিশন পেয়েছে, রাটগার্সেও। রাটগার্সেই আসছে। বিমলদা এতে ভারী খুশি, কাছাকাছি পাবেন রুণাকে।

রাটগার্স ইউনিভার্সিটি তো এই নিউ জার্সিতেই। দিব্যি বাড়ি থেকে কলেজ করতে পারতো, কিন্তু থাকবে হস্টেলে। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম রুণা অযথা খরচ করে হস্টেলে থাকবে কেন? নিজেদের এত চমৎকার, এত বড়ো বাড়িটা যখন এত কাছে, শূন্য পড়ে আছে? বাবার বাড়িটা তো তারও বাড়ি। তবে? এখন অবশ্য বুঝেছি। স্বাধীনতা। এদেশের ছেলেমেয়েরা কলেজে ভর্তি হলেই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, নিজস্ব সংসার পাতে বন্ধুদের সঙ্গে। উদ্দেশ্য : মুক্তি। বাবা—মায়ের নজরদারি থেকে ছুটি নিয়ে নিজস্ব জীবনচর‍্যা শুরু করা। এতটুকু তো বয়েস। বাবা—মাও মুক্তির নিশ্বাস ফেলেন। দায়িত্ব শেষ। এবার ছুটি।

.

এদেশে এসেছিলাম উচ্চশিক্ষা নিতে, রিসার্চের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এসে অবধি জীবন বিষয়ে যতটা উচ্চশিক্ষা লাভ করেছি আর মনুষ্য চরিত্রে যে পরিমাণ রিসার্চ হলো তা ডাক্তারি বিদ্যের চেয়ে ঢের বেশি। ব্যক্তি—স্বাধীনতার জন্য এরা মরিয়া। ঠিক যার বিপরীত পরিস্থিতি দেখে এলাম জেড্ডায়। সেখানে অন্য এক পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় হলো।

বর্ধমানের মেয়ে আমি, প্রথম প্রথম কলকাতা শহরটাকেই মনে হতো বিরাট এক অজানা জগৎ—যখন ডাক্তারি পড়তে এলাম। তারপরে নিউ ইয়র্ক। এবং জেড্ডা। পুনরায় নিউ ইয়র্ক। ইতিমধ্যে হারিয়ে গেল বর্ধমান। গলসির সেই শ্যাওলাপড়া শান্ত পুকুরঘাটে আম—কাঁঠালের বাগানঘেরা ইঁট—বের—হওয়া বসতবাড়ি, যেখানে আমার স্বেচ্ছাচারী জ্যাঠামশাইয়ের তাঁবেদারি করছেন আজও আমার রোগাপাতলা মা। মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে যাঁর মেয়ের মুখ দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন জ্যাঠামশাই। শুধু চিঠি লেখেন। টাকা পাঠাই, টাকা পৌঁছোলে মা চিঠি লেখেন। টাকার হিন্দু—মুসলমান নেই, জ্যাঠামশাইয়ের আপত্তি নেই মা’র আমার কাছে টাকা নেওয়ায়। মেয়ে যে এখন আর মুসলমান নেই, মা জানেন। জ্যাঠামশাইও। তবু, তিনি জীবিত থাকতে ও—বাড়িতে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ। বিমলদা অবশ্য বলেন একদিন চলে যেতে। গেলে ঠিকই বাধা টুকরো হয়ে যাবে। বিমলদার মতে সবটাই ঠুনকো। ওটা নাকি পুরুষমানুষের ইগোর ব্যাপার। একবার মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন বলে জ্যাঠামশাই আর কথাটা ফেরত নিতে পারছেন না, অত মনের জোর নেই তাঁর। কিন্তু আমি গেলে ফেরাতে পারবেন না, সেই মনের জোরও তাঁর থাকবার কথা নয়।

মাঝে মাঝে বিমলদার এই প্রস্তাবটা নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করি। চলে গেলেই হয় গলসির বাড়িতে একদিন? মা’র কাছে? কত বছর দেখিনি মাকে?

বিমলদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল কেতকীর জন্যই। কেতকী এসেছিল আমাদের হাসপাতালের রোগিণী হয়ে, আমারই অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে। কেতকীর চিকিৎসায় স্যারকে সাহায্য করতে করতেই হাতেকলমে শিক্ষা হচ্ছিল আমার। কিন্তু সেইসঙ্গে আরও কিছু শিখছিলাম। এইডস প্রোগ্রামে কাজ করতে গিয়ে আমার প্রধান শিক্ষাটি হচ্ছিল জীবন বিষয়ে। বাঁচা—মরা তো সব ডাক্তারেরই কার্যকরণের মূল বিষয়বস্তু। এটা শুধু তা নয়। এ অন্য বাঁচা, অন্য মরা। মানব সম্পর্কের অন্য একটা চেহারা ফুটে ওঠে এই রোগের আয়নায়।

কেতকীকে দেখে আমি অনেক কিছু শিখেছি। শিখেছি মানুষের বাঁচা কাকে বলে। মানুষকে কীভাবে বাঁচতে হয়, আর কীভাবে বাঁচতে হয় না। যদিও প্রধানত ”কীভাবে বাঁচতে হয় না”—টাই শিখিয়েছিল কেতকী। কিন্তু সেই সঙ্গে তার জীবনের শেষ দিকে দিয়ে গিয়েছিল বিপরীত শিক্ষাটাও।

.

হ্যাঁ, মৃত্যু অবধারিত জেনেও কীভাবে মাথা তুলে বাঁচতে হয়, মানুষ হয়ে, স্থির হয়ে মা হয়ে বাঁচতে হয়। কেতকী শেষটুকুনি—এক বছরের মধ্যেই তার সব শেষ—ছিল বীরত্বে ভরা। টুবলু তখন ছোট্ট—এইটুকুনি, মাত্র ক’মাসের শিশু। বিমলদাই তার সম্পূর্ণ ভার নিয়ে, একসঙ্গে তার মা এবং বাবা হয়ে ঘিরে আছেন এতগুলো দিন। এতগুলো সপ্তাহ। এতগুলো মাস। এই ক’টা বছর ধরে সে রয়েছে বাবারই কোলে। বাবার চোখের মণি হয়ে।

রুণাকেও দেখলাম। সহোদরা নয়, কিন্তু মনপ্রাণ দিয়েই ভালোবেসেছে টুবলুকে। যখনই আসে এখানে দিদির মতোই যত্ন করে—সাধ্যের অতিরিক্ত করে। তার তো হাইস্কুল আছে, পড়াশুনো আছে, বন্ধুবান্ধব, ডেটিং—পার্টিয়িং আছে, আছে সদ্যযৌবনের ব্যস্ততা, তার নিজস্ব টীন—এজ স্পেশ্যাল লাইফ আছে—সব কিছু নিয়েও সে ছোট্ট রুগণ বোনটিকে অনেকটা সময় দেয়—যতটা সম্ভব। টুবলুর অসুস্থতা রুণাকে আর বিমলদাকে খুব গভীরভাবে কাছাকাছি এনেছে।

রুণার মধ্যে বিমলদার স্পর্শকাতর মনটি আমি দেখতে পাই। কেতকীর সঙ্গেও দিব্যি ভাব হয়ে গিয়েছিল রুণার। কেতকীর সহজ স্বচ্ছ স্বভাবে একটা শিশুসুলভ ব্যাপার ছিল, যা ছোটদের মনের মধ্যে বিশ্বাস উদ্রেক করতো। সদ্য কিশোরী রুণাকে কেতকীর মৃত্যু রীতিমতো বিচলিত করেছিল। ওটাই তার ছোট্ট জীবনে প্রথম মৃত্যুর অভিজ্ঞতা। এবং অকালমৃত্যু।

মারা যাবার সময়ে কেতকীর বয়েস হয়েছিল মাত্র ঊনত্রিশ।

অজস্র ইচ্ছে, অনন্ত স্বপ্ন অপূর্ণ রেখেই চলে যেতে হল তাকে। জীবন বিষয়ে রুণা অনেক জরুরি শিক্ষা পাচ্ছে এবাড়ি থেকে, অনেক পরিণত হয়ে উঠছে মেয়েটি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *