উড়াল – ৩

তিন – বিমল

তখন আমি একা। রুণাকে সঙ্গে নিয়ে এমিলি চলে গিয়েছে অ্যালভিনের হাত ধরে বছর দুই আগে।

রুণা এতদিনে একাদশী কিশোরী হয়ে উঠেছে। ন’বছরের মেয়েটি মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল বটে, কিন্তু এখন রুণা এ বাড়িতে থাকতে চায়। প্রত্যেক উইক এনডে আমার কাছে চলে আসে, ছুটিগুলোয় আমার সঙ্গে বেড়াতে যায়, বন্ধুদের সঙ্গে ক্যাম্প—ট্যাম্প সারবার পরে। এমিলি এই বিষয়ে খুব বুঝদার। তাছাড়া ওখানে ওদের ছোট অ্যাপার্টমেন্ট—রুণা বড় হয়েছে এখানে, এতবড় বাড়িতে। বাগানে খেলা করে, হাত—পা ছড়িয়ে থাকতেই অভ্যস্ত ও। এমিলি ওকে বাধা দেয় না আসা—যাওয়ায়। রুণার জন্যে বাগানে একটা পাহাড় গড়ে তাতে ঝর্ণা বানিয়ে দিয়েছিলাম। গুহা থেকে জলস্রোত বেরিয়ে জলপ্রপাত হয়ে ঝরে পড়ছে, নিচের ছোট্ট পাথরের তৈরি পুকুরে। এমিলি সেই পুকুরে আদর করে লালমাছ নীলমাছ ছেড়েছিল, বীজ পুঁতেছিল ওয়াটার লিলির। একটুখানি তটিনীর মতনও বানিয়েছিল বাগানের মধ্যে দিয়ে, ঝিরিঝিরি ছোট নদী এঁকেবেঁকে যায়। লালমাছেরা এখনও বংশবৃদ্ধি করে চলেছে, আর ওয়াটার লিলিরা পাতায় পাতায় ফুলেফুলে আমার বাগানটা অবিকল মোনের ওয়াটার লিলি গার্ডেন বানিয়ে ফেলেছে। রুণা যখন আসে, ওই লালমাছেরা আর ওয়াটার লিলিরা নিশ্চয় খুব আনন্দিত হয়। রুণারই তো বন্ধু ওরা।

.

এমিলির স্বপ্ন ছিল ওর একদিন একটা বিশাল, ছড়ানো বিলাসী স্নানঘর হবে—খুব কষ্টে গরিব পাড়ায় ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে অনেক ভাইবোন মিলে বড় হয়েছিল ওরা। ফ্ল্যাটের টয়লেট ছিল, কিন্তু বাথ ছিল না। বাথ—টা আবার শেয়ার করতে হতো পাশের ফ্ল্যাটের সঙ্গে। তাই স্নান ছিল একটা ভয়াবহ, কষ্টকর কর্তব্য পালন ওদের ছেলেবেলায়। নোংরা, ভাঙাচোরা, ভাগের স্নানঘরে স্নান সেরে নিতে হতো কোনোরকমে।

এমিলির জন্যেই জাকুসি স্নানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। বিশাল ছড়ানো ঘরের মাঝখানে মস্ত জাকুসি—বাথটব, তাতে সপরিবারে স্নানে নামা যায়। ঘরে নানা রঙের নানা পাওয়ারের আলো, এককোণে তাকে ভর্তি বই, তার ওধারে ক্রিস্ট্যাল ডিক্যান্টারে ওয়াইন রাখা আছে। দেওয়ালে আছে অদৃশ্য মিউজিক সিস্টেমের সঙ্গে মাইক্রোফোন লাগানো—আছে টিভি, আছে টেলিফোন। এমিলি যাতে উষ্ণ, চঞ্চল, ঢেউ তোলা জাকুসিতে গা এলিয়ে বসে এক হাতে পসন্দসই বই অন্য হাতে ওয়াইনের গ্লাস নিয়ে মৃদু বাজনা শুনতে শুনতে রিলাক্স করতে পারে।

জানি না আমি কী দোষ করলাম,—না অ্যালভিন তাকে আরো মেদুর, আরো সঘন রঙিন স্বপ্ন কী দেখালো, যার টানে এসবই ফেলে এমিলি চলে গেল, তার নিজের হাতে গড়া চোদ্দ বছরের সংসার ছেড়ে, নেহাত ছেলেমানুষ অ্যালভিনের পাশে থাকতে। কিন্তু রুণা সেখানে আরাম পায় না—সে যে—বাড়িতে বড় হয়েছে, সেখানেই থাকতে চায়। এমিলির তাতে বাধা নেই—হাইস্কুলে গেলে রুণা এ বাড়িতেই থাকবে ঠিক হয়েছে। এখান থেকে হাইস্কুলটি কাছে। ওর বন্ধুরা সবাই এপাড়ায়—তারা যাবে ওই হাইস্কুলে। রুণা তাদের সঙ্গ ছাড়তে চায় না।

ঝর্ণার তলায় যে ছোট্ট জলাশয়টুকু, যেখানে ওয়াটার লিলি ফুটে থাকে, আর লালমাছ, সোনালিমাছেরা খেলে বেড়ায়, রুণার সেই লিলিপুলের ধারে ধারে আছে অনেক ছোট্ট ছোট্ট ব্যাঙ, আর ব্যাঙের ছাতা; আর জলের মধ্যে প্রচুর ঘাস, ঝাঁঝি, লতাপাতা। এই যে মাছগুলো এখানে খেলা করে, সিঁদুর লাল, আর কাঁচাহলুদের মতো রং, তাদের এদেশীয় নামটা খুব মজার। কৈ মাছ! Koifish! মোটেই আমাদের কৈ মাছের জ্ঞাতিকুটুম্ব নন এনারা! কিন্তু ভারী সুশ্রী মাছ! লতাপাতা ফুলের ফাঁকে ফাঁকে লেজ নেড়ে নেড়ে খেলে বেড়ায়, বড়ো সুন্দর দেখায়। হঠাৎ হঠাৎ রঙের ঝলক মারে কালো জলে।

লিলিপুলের ওয়াটার লিলিকন্যেদের দেখতে শাপলা—শালুকের মতোই, পদ্মফুলের মতো নয়। কিন্তু জাতে এরা কুমুদ্বতীর জ্ঞাতি নয়, কমলিনীরই বোন। কুমুদ তো রাত্রি জাগরণে বিশ্বাসী, সে চাঁদের সখী। চাঁদ উঠলে ফোটে, চাঁদ ডুবলে ঘুমিয়ে পড়ে। পদ্মফুলের কিন্তু সূর্যমুখী স্বভাব, সূর্য ডুবলে তার সবগুলি পাপড়ি বুজে যাবে, সূর্য এসে ডাক দিলেই দলগুলি মেলবে। এসব ওয়াটার লিলিও দিবসবিলাসী ফুল। দিনেই যত হাসিখেলা ; যতক্ষণ দিনের আলো, এই ফুলগুলোও ততক্ষণই রসেবশে থাকে। রাত নেমেছে কি চোখে ওদের ঘুম নেমেছে। রাত্রের রহস্যে ওদের উৎসাহ ছিল না, মাছেরাও ঘুমোয়, ফুলেরাও ঘুমোয়, আমার রুণাও ঘুমোয়। ফুল, মাছ যদিও এমিলি নিজেই এনেছে, এমিলির নিজের কিন্তু আগ্রহ ছিল না ওতে। পাহাড়, ঝর্ণা যে কোম্পানিকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করেছিলুম, তাদের ব্রোশিয়োরেই রঙিন ছবি ছিল এরকম লিলিপুলের, ফুলে ভরা লালমাছেরা খেলছে। সেই দেখাদেখিই ওদের আনা। মাছেরা আছে যখন, তাদের খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল এমিলি, জল পরিষ্কার করার নিয়মিত ব্যবস্থাও। রুণার খুদে বন্ধুদের প্রধান উৎসাহ ছিল ওই লিলিপুলে। তাদেরই খেলার জায়গা ছিল ওটা।

.

কেতকী এ বাড়িতে এসেই লিলিপুল নিয়ে মেতে উঠলো। নীল ফুল, শাদা ফুল, বেগুনি ফুল, গোলাপী ফুল—প্রত্যেকটা দেখেই ওর সে কি উত্তেজনা। নীল ফুলটা দেখেই ও নাম দিয়ে দিল—”এটাই তো রামচন্দ্রের চোখ, নীলকমল! আই হ্যাভ রেড অল অ্যাবাউট ইট।”

আর লালমাছ সোনালিমাছেদের নিয়েও কেতকীর আহ্লাদেপনার অন্ত ছিল না। ঝর্ণা আর লিলিপুল নিয়ে কেতকী আত্মহারা। দুটো একটু বড় বড় মাছ ছিল, ও তাদের নাম দিল রোমিও আর জুলিয়েট। আশ্চর্য, কেমন মোহমাখা সুরে যে কেতকী ওদের ডাকতো জানি না, কিন্তু কেতকী ওদের রোমিও, জুলিয়েট বলে ডাকলে, ওরা সাড়া দিতে শুরু করলো। ভুস করে ভেসে উঠতো দুজনে জলের ওপরে। খেলে বেড়াতো কাছাকাছি।

কেতকীকে দেখতে দেখতে অল্প অল্প যেন বুঝতে পারছিলাম মেয়েটাকে। পরতে পরতে খুলে যাচ্ছিল কেতকীফুলের পাপড়িগুলো—তবুও স্বচ্ছ হয়নি, রহস্য লেগেই ছিল তার গহন চুলে, একটু একটু বুঝতে পারছিলাম কেতকী কেন অত চঞ্চল, কেন অমন নেশার মধ্যে পালাতে চায়।

মা—হারানো সেই ছোট্ট মেয়েটার, সেই শিশুটির পূর্ণ আত্মপ্রকাশ ঘটলো যেন এই বাড়িতে এসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লিলিপুলের ধারে বসে মাছেদের সঙ্গে, ফুলেদের সঙ্গে ও যে কী খেলতো ও—ই কেবল জানে।

দেশে থাকতে কখন যেন ওর শৈশব, কৈশোর ওকে সুদ্ধু চুরি করে নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে কেতকী হঠাৎ সেই হারিয়ে—ফেলা ছোটোবেলাটাকে খুঁজে পেয়েছে—সেই হারানো মেয়েটাকেও আমি একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছি।

তিন বছর বয়েস থেকে মানুষ হয়েছে মাইনেকরা লোকজনের কোলেপিঠে। বেয়ারা—আয়া—বাবুর্চি—ড্রাইভার—এদের মধ্যেই বড় হচ্ছিল কেতকী যতদিন না বাবা ওকে পাহাড়ে, কার্শিয়ঙে, মিশনারীদের স্কুলের হস্টেলে পাঠিয়ে দিলেন। কনভেন্টে পাঠিয়ে মেয়ের দায়িত্ব কাটিয়ে দিয়েছিলেন বটে ওর বাবা, কিন্তু গানবাজনার ঝোঁক দেখে ওর জন্যে স্পেশ্যাল মিউজিক লেসনের ব্যবস্থাটা করেছিলেন। স্কুলে ছিল কেবল পাশ্চাত্য সঙ্গীত শিক্ষার ব্যবস্থা—ও শিখেছিল পিয়ানো এবং ভায়োলিন। বাড়ি যেত, শীতের ছুটিতে। তিন মাস থাকতো গিয়ে ছোটমাসির কাছে ভবানীপুরে। কিছুতেই বাবার কাছে যেতে চাইতো না আর। বাবার দ্বিতীয় পত্নী, তাঁর পুত্রকন্যাদের সংসারে, নিজেকে অবাঞ্ছিত অতিথির মতো লাগতো কেতকীর। কিন্তু ছোটমাসি আর ছোটমেসোর কাছে আদর পেয়েছিল অনেক—ছোটমাসি গাইতেন বাংলা গান। রবীন্দ্রসঙ্গীত, অতুলপ্রসাদ, সলিল চৌধুরীর গান। মাসির সঙ্গে কেতকীও গাইতো। ওখানেই বাংলা শিখেছে, ‘গীতবিতান’ পড়বে বলেই বাংলা শেখা ওর।

নিজের চেষ্টায় বাঙালি হয়েছিল কেতকী। ছোটমাসি থাকতেন ভবানীপুরের দোতলা বাড়িতে। বাবার প্রাসাদের মতো বাংলো জামশেদপুরে। মেয়ে বাঙালি হলো কি ফিরিঙ্গি হলো তাতে তাঁর আগ্রহ ছিল না।

কার্শিয়ং থেকে মিরান্ডা হাউস হস্টেল, দিল্লি। তারপরেই বার্নার্ড কলেজ কলাম্বিয়া নিউ ইয়র্ক। বাবা খরচ যুগিয়েছেন স্বেচ্ছায়। কিন্তু সংযোগ ক্রমশ ক্ষীণতর হয়ে এসেছে, মেয়ের জীবনযাপনের কোনোই খবর রাখতেন না তিনি। মিরান্ডা হাউস হস্টেল থেকে মেয়েরা যে রাত্রে লুকিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ফাইভ স্টার হোটেলে কলগার্ল হয়ে রোজগার করে আসছে আজকাল, সে—খবর কাগজে পড়েও মেয়ের কথা মনে হয়নি তাঁর।

মেয়েদের এইসব অতিরিক্ত টাকাকড়ি লাগে ড্রাগ কিনতে। কেতকীর টাকাকড়ির প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ করেনি—ড্রাগ—অ্যাডিকশান হয়নি তখনও তার। মজা করছিল শুধু বন্ধুদের দলে পড়ে।

সেসব ঘটেছে নিউ ইয়র্ক সিটিতে আসার পরে। অ্যাডিকশন। আস্তে আস্তে পড়াশোনা বন্ধ। এখানে—ওখানে খুচরো কাজকর্ম—দোকানে সেলসগার্ল, রেস্তরাঁয় ওয়েট্রেস, তারপর গান। গানের মধ্যে দিয়ে একটা ঋজু জীবন খুঁজে পেয়েছে কেতকী।

যে—বাসাটাতে ওরা ক’জনে থাকতো, সেখানে প্রত্যেকেই ড্রাগাসক্ত, ড্রাগই তাদের একত্র জড়ো করেছে। গুণী ছেলেমেয়ে ওরা সকলেই—কেউ ছবি আঁকে, কেউ গান গায়, কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজায়। শিল্পী ওরা প্রত্যেকেই। একটি ছেলে দারুণ ফোটোগ্রাফার। সে কেতকীর কয়েকটা ছবি তুলে বিক্রি করেছে, ন্যুড ছবি। তাতে কিছুদিন ভালোই চলেছে ওদের। মহোৎসাহে সেই ছবির কপি আমাকে দেখাল কেতকী। সত্যি সুন্দর। ন্যুড ছবি, কিন্তু একটুও অশালীন ছবি নয়। ছবিটি দেখলে হঠাৎ মনে হয় মেয়েটির পা নেই, পায়ের জায়গায় বুঝি মাছের লেজ আছে। সমস্ত গায়ে মুক্তোর মতো চিকচিক করছে জলের ফোঁটা, ভিজে চুল সেঁটে আছে বুকে পিঠে—এমনভাবে বসেছে দু’হাঁটু জুড়ে—মনে হচ্ছে যেন মৎস্যকন্যা।

—”ছবিটার ক্যাপশনও ছিল দি মারমেইড”—হেসে উঠে বলেছিল কেতকী—’আমি তো ইচ্ছে করলেই মারমেইড হয়ে যেতে পারি—জানো না?”

তা হয়তো পারে। ওই গান, আর হেরোয়িনের নেশায় এই পাগলী, উদ্দাম, বেপরোয়া মেয়েটা তো মৎস্যকন্যা হতেই পারে। ওর গান শুনতে শুনতে মাঝে মাঝেই আমার মনে হতো আমি অন্য গ্রহের সুর শুনছি।

আমার কাছে কেতকী হতে চাইতো শুধু একটা বাঙালি মেয়ে। আমি তো ওর মধ্যে দেখতে পেতাম একটি আকুল বালিকাকে—ভীতু, নরম, স্নেহের কাঙাল, একটি বাচ্চা বাঙালি মেয়েকে।

অথচ কেতকীর ভাগ্যে না হয়েছিল ”বাচ্চা মেয়ে” হওয়া, না ”বাঙালি মেয়ে” হওয়া।

যদি বা সেই সুযোগ এলো জীবনে, নিয়তি সেটা ভোগ করতে দিলেন না। ক’টা দিনই বা কেটেছে এ বাড়িতে কেতকীর? ধীরেসুস্থে গুছিয়ে বসে ঘরসংসার করবার বাঙালি মেয়ে, বাঙালি বউ, বাঙালি মা হয়ে সুখে না হোক স্বস্তিতে জীবনযাপন করবার ব্যবস্থা করেননি তার বিধিলিপিতে তার সৃষ্টিকর্তা। তার জন্য ছিল অন্য হিসেব।

যে জাকুসি—বাথ তৈরি হয়েছিল এমিলির জন্যে, যে বিলাসী স্নানঘর অনায়াসে পরিত্যাগ করে তার নবীন প্রেমের টানে চলে গিয়েছিল এমিলি, সেই ঘরে পা দিয়ে, সেই জাকুসি—বাথে স্নান করে কেতকীর সে কী উল্লাস! আনন্দ উপচে পড়ছিল ওর সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে, নখে—চুলে—রোমে তার প্রকাশ ছিল। সার্থক করে দিয়েছে ও আমার স্নানঘর তৈরি করা, জাকুসি—বাথ লাগানো।

এমিলির বাথরুম আর রুণার বাগান। রুণার পাহাড়, ঝর্ণা, লিলিপুল, রুণার জন্য লালমাছের ঝাঁক, ওয়াটার লিলির ফুলের শোভা—সবকিছুই কেতকী উপভোগ করেছে পরিপূর্ণভাবে, তারই ভোগে লেগেছে এইসব স্বপ্নগুলি—যদিও খুব অল্প সময়। জাকুসিতে বসে, হাতে ওয়াইনের গ্লাস, চোখে স্বপ্ন, গলায় গান নিয়ে সে নোনা জলের ঢেউ খেতে ভালোবাসে।

যখন কেতকী জাকুসিতে স্নানে নামে, জলের রং ক্রমশ নীলচে সবুজ হয়ে ওঠে, ঢেউগুলি জোরে জোরে আসতে শুরু করে, ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের মাথায় ফেনা জমতে থাকে—শাদা দুধের ফেনার মতো ফেনা—কেতকী যতক্ষণ জলে থাকে ততক্ষণ গুনগুন করে গান করে—আমি দেখেছি জলে নামলেই ওর গানের ভাষাটা পালটে যায়। আমি যেন আর বুঝতে পারি না, সুরটা খুব চেনা চেনা, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারি না কেন এত চেনা, কোন সুর, কোথায় শুনেছি। আমি দেখেছি কেতকীর চুলে সবুজ শ্যাওলা লেগে থাকে যখন সে জাকুসি থেকে উঠে আসে, একদিন দেখেছিলাম লম্বা, কালচে জলঝাঁঝি জড়িয়েছিল ওর ফর্সা পায়ে। কেতকী স্নান করে উঠে আসার পরে বাথটবে দু’একটা ঝিনুক পড়ে থাকে। জাকুসিটা বড়ো মাপের, ফ্যামিলি সাইজ, আমরা যাতে তিনজনেই নামতে পারি তাতে, তেমনি ভেবেচিন্তে কিনেছিল এমিলি। কেতকী আমাকে যেদিন হাত ধরে টেনে নামিয়ে নিল জলে, আমি চমকে দেখলাম জলের স্বাদ নোনা। রং নীলচে সবুজ। ছোটো ছোটো তরঙ্গগুলি মাথায় ছোটো ছোটো শাদা ফেনার মুকুট পরে গোলাপী বাথটবের গায়ে আছড়ে পড়ছে। আমি দেখলাম বাথটবে দুটো চারটে করে ঝিনুক এসে পড়ছে—যত্ন করে কুড়িয়ে জড়ো করতে লাগলাম ঝিনুকগুলো, রুণাকে দিতে হবে। আমি যখন একা স্নান করি তখন কিন্তু ঝিনুক আসে না। ঢেউয়ে ফেনা ভাসে না, জলও নোনতা লাগে না। এ কি কেতকীর গানের গুণ? হবেও বা। কেতকীর গানের ভাষাটা আমাদের লিলিপুলের লালমাছেরা চেনে, ওরা ওর সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গায়, সেটা আমি চোখে দেখেছি।

ঝর্ণার লালমাছেদের সঙ্গে দিব্যি ভাব জমিয়েছিল কেতকী। জলের ধারে ধারে থোকা থোকা শরবন, আর কাশবন, তাদের সঙ্গেও কী একটা গোপন যোগসূত্র তৈরি করেছিল ও। জোর করে পুলের ঝিরিঝিরি নদীটার ওপরে ছোট্ট একটা সবুজরঙের জাপানী সাঁকো বানালো কেতকী, অবিকল মোনের ছবিতে যেমন সবুজরঙের সাঁকোটি রয়েছে, তার মিনিয়েচার। বড় বড় ঝোপঝাড়ের ফুলগাছ লাগালো, জলের কাছটা যাতে আরো মায়াময়, রহস্যঘন, ছায়াছায়া হয়—আর বসন্তে দপ করে জ্বলে ওঠে লাল—হলুদ—বেগুনি রঙে। সেই ছমছমে রহস্যময়তা, সেই চড়া রংয়ের আগুনের ওম নেবার মতো সময় সৃষ্টিকর্তা ওকে দিলেন না। টুবলুকে দিয়েছিলেন তবু খানিকটা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *