উড়াল – ২

দুই – বিমল

সেই শুক্রবারের পরে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে আমাদের। সেন্ট্রাল পার্কে দুপুরবেলা পা ছড়িয়ে ঘাসের ওপর বসে কেতকী গেয়েছে ”আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…” তারপরেই আইসক্রিম খেয়েছে, গলা নষ্ট হবে কিনা ভাবেনি। যখন যেটা ইচ্ছে করে, তখন সেইটেই করা চাই। আমি ওকে দেখি আর মায়ায় মনটা ভরে যায়। এত অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে মেয়েটা। একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কতগুলো ল্যাম্পপোস্ট দেখিয়ে বলল—”এই বাতিগুলোকে লক্ষ্য করেছেন? একদম নতুন। কত বেশি আলো হয়। আর শাদা রঙের আলো। ঠিক মনে হয় চারদিক যেন চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে। দেখুন আকাশে কি চাঁদ আছে? নেই তো। অথচ এখানে জ্যোৎস্না! রাস্তার আলো যে এরকম ম্যাজিক্যাল হতে পারে কখনও ভাবিনি।” বলেই গান ধরলো—”ও আমার চাঁদের আলো/আজ ফাগুনের পূর্ণিমাতে। ধরা দিয়েছো—” একটুখানি গেয়েই হঠাৎ থেমে গেল। চুপ। একেবারেই স্তব্ধ।

—”কী হলো? গাইবে না?”

—”নো, পূর্ণিমার গান আমি গাই না। পূর্ণিমা আমার ভালো লাগে না, অত বড় চাঁদ দেখলে আমার কেমন গা ছমছম করে, ভয় করতে থাকে। মন খারাপ হয়ে যায়, … নো, আই অ্যাম নট আ পূর্ণিমা—পার্সন! আমার বাবা অমাবস্যাই ভালো। আমার আঁধার ভালো—ও আমার আঁধার ভালো—”

আবার গলায় সুর এসে গেল। তারপর,

—’কী আনফেয়ার দেখুন। পূর্ণিমার জন্য কত গান। অথচ অমাবস্যার গান নেই।”

—”অমাবস্যার গান আছে কিনা আমি জানি না কেতকী, থাকতেই পারে—একটা কবিতা আছে কিন্তু অমাবস্যার। শুনবে? ঠিক অমাবস্যার নয় অবশ্য, পূর্ণিমা আর অমাবস্যা দুটোকে মিলিয়ে।

আমার বক্ষের মাঝে

পূর্ণিমা লুকানো আছে

সেদিন দেখেছো শুধু অমা

দিনে দিনে অর্ঘ্য মম

পূর্ণ হবে প্রিয়তম

আজ মোর দৈন্য করো ক্ষমা”—

—”অমা মীনস অমাবস্যা? শর্ট ফর্ম?”

আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলি।

কেতকী হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল।

—”এ কী… তোমার রাস্তাটা ছাড়িয়ে এলাম নাকি?”

ওকে বাড়িতে এগিয়ে দিচ্ছিলাম। সোহো অঞ্চলে। আজই প্রথম এগিয়ে দিচ্ছি। হঠাৎ থেমে গেল কেন?

—”কিছু ফেলে এসেছো?”

ব্যাপার বুঝতে না পেরে আমিও দাঁড়িয়ে পড়ি।

—”ফীলিং সিক?’

ওর পিঠে হাত রাখি। নাড়ী দেখবো কিনা ভাবি। হলো কী মেয়েটার?

দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ বুজে কেতকী বুকে হাত রেখে নিজের হৃৎস্পন্দন অনুভব করলো একটুক্ষণ। তারপর বললো—”কি আশ্চর্য! এ তো আমারই কথা। কার লেখা?”

—”তোমার নাম কেতকী, আর তুমি ‘শেষের কবিতা’ পড়োনি। রবীন্দ্রনাথ।”

—”বলেছি তো আমি কোনো কবিতাই পড়িনি। কি শেষের কি বিগিনিংয়ের। আমি কি বাংলা বইটই পড়েছি নাকি? আয়াম ইললিটরেট ইন লিট—শুধু নিজের সাবজেক্টটুকুই পড়েছি, ইউ নো হাউ সায়েন্টিস্টস আর!”

—”সায়েন্টিস্টদের দোষ দিও না বাছা, আমি নিজেও তো তাই! ভুলে গেলে? দোষ মারিহুয়ানা দিল্লির। কলকাতাতে বড় হতে যদি, ‘শেষের কবিতা’ পড়তেই হতো ষোলো বছর বয়সে।

”বাই দি ওয়ে তোমাকে বলেছিলাম ওটা কবিতার বই না, রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস। তারই মধ্যে অনেক অসামান্য কবিতা আছে।”

—”ঠিক আছে বাবা—অল ইজ নট লস্ট—এখনও তো পড়া যায়? ষোলো বছর বয়েস নয় বলে কি বইটা পড়া বারণ? আরম্ভ করে দেব এবারে—আই ক্যান রীড বাংলা—’গীতবিতান’ পড়ব বলে বাংলা শিখেছিলাম না? একটু দেরি হয় পড়তে, দ্যাটস অল—”

ওর বাড়ির রাস্তা এসে গেল।

—”থ্যাংক ইউ ফর ওয়াকিং মি হোম—ওকে, দেন? গুড নাইট—” বলে রাস্তা থেকেই বিদেয় করে দিচ্ছিল আমাকে।

—”কোনটা তোমার বাড়ি?”

—”ওই ভিতরদিকে।”

—”চলো, বাড়ি অবধি যাই।”

—”নো নীড। এ তো আমার পাড়া, এভ্রিবডি নোজ মি। এটা খুব সেফ এরিয়া, এই রাস্তাটুকু একাই যেতে পারব—”

আমি তবু হেঁটে গিয়েছিলাম ওর পাশে পাশে। গুন গুন করতে করতে যাচ্ছিল। বাড়ির সামনে এসে থামলো। একটা পুরনো ভাঙাচোরা ওয়্যারহাউস। কয়েকজন শিল্পী ছেলেমেয়ে মিলে একসঙ্গে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে, কমিউন করে থাকে। কেউ গাইয়ে, কেউ বাজিয়ে, কেউ ছবি আঁকে।

”কার বাড়ি?”

”একজন আর্টিস্টের। ছেলেটি এসেছিল হল্যান্ড থেকে। তারপর থেকেই গিয়েছে। নিউ ইয়র্কের মায়াজাল। ছিঁড়ে বেরুতে পারেনি। আমার মতোই।”

ভিতরে গেলাম শেষ পর্যন্ত। বন্ধুরা কেউ কেউ ছিল। ছুটির মেজাজ। গানবাজনা চলছে। গাঁজার গন্ধে ভরপুর। কেউ বসে, কেউ শুয়ে আছে। বেশিক্ষণ থাকলাম না, চলে এলাম। কাল ভোরেই বেরুতে হবে প্লেন ধরতে। এরা বয়েসে আমার চেয়ে অনেক ছোট। এরা অন্য প্রজন্ম। কেতকীর কল্যাণে এদের সঙ্গে চেনাশুনো হচ্ছে। অন্য, অচেনা একটা জগৎ। আমাদের ডাক্তারদের ব্যস্ত পৃথিবী, সাকসেসফুল প্রফেশনালদের পৃথিবী থেকে এদের গ্রহটা দেখতেই পাওয়া যায় না। যেখানে ‘প্রফেশন’ ‘সাকসেস’ এই দুটো শব্দই মূল্যহীন। নিরালোক।

.

একত্রিশে ডিসেম্বরের রাত্রে কেতকীদের সোহোর বাসায় পার্টি ছিল। সাইকিডেলিক আলো চমকাচ্ছিল অন্ধকার ঘরে, পিটারের গীটারের সঙ্গে ব্রায়ানের বংগো, আর কেতকীর গান—তারই সঙ্গে চলছে নানারকমের শীধুপান, গাঁজার সিগারেট ঘুরছে হাতে হাতে—গাঁজা নয়, মারিজুয়ানা। ওঘরে থুম মেরে যারা বসেছিল, তারা ইনজেকশনের দল। অদ্ভুত রামধনু আলোতে অন্ধকার যেন আরো গাঢ় হয়েছিল, ফাঁকে ফাঁকে ছড়ানো ছিটানো ছিল মদনমন্থিত যুগলমূর্তি—কতরকমের ড্রাগ যে চলছিল, তা ওরাই জানে। ওরই মধ্যে শীধুপানের দলে যুক্ত হয়েছি অকস্মাৎ আমিও, কখন। এই বয়েসে শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকেছি তো বটেই—কিন্তু কেমন করে যে হঠাৎ নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম কেতকীর আলিঙ্গনে—কী যে ঘটেছিলো সেইরাত্রে, সকালবেলায় কিছুতেই ঠিক ঠিক স্মরণ করতে পারছিলাম না। চেষ্টা করেও মনে পড়ল না কেমন করে আমি জেগে উঠলাম কেতকীর বিছানায়।

নতুন বছর শুরু হলো এই ধন্দের মধ্যে দিয়ে। কেতকীও খুব একটা সাহায্য করতে পারলো না—ও তো হেসেই উড়িয়ে দিল গোটা ব্যাপারটা।

—”আরে, কেউ তো কোথাও শোবে? একটা না একটা বিছানা তো লাগবেই মানুষের? না হয় আমারটাতেই ঘুমিয়েছো, তাতে কী হলো? উই হ্যাড আ লাভলি টাইম! দ্য নাইট ওয়াজ গ্রেট! রিল্যাক্স—হ্যাভ ইয়োর কফি অ্যান্ড অ্যাসপিরিন অ্যান্ড এভ্রিথিং উইল বি ফাইন।”

.

কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন, আমি সদ্য হাসপাতাল থেকে ফিরেছি, জামাকাপড় বদল করা হয়নি তখনও, কেতকী এসে হাজির। লাফাতে লাফাতে। সেই প্রথম ওর আমাদের বাড়ি আসা। এর আগে আমরা বাইরেই মীট করেছি, আমিই গেছি ওদের বাসায়। রাত্রিবাস ওই একবারই, একত্রিশের রহস্যময় রূপকথায়। কেতকীকে আমার বাড়িতে দেখে মনটা খুশি হয়ে উঠল।

—”কী ব্যাপার?”

কেতকীর সর্বাঙ্গ দিয়ে খুশি যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

—”এত খুশির কি হলো, কেতকী?”

কোনো উত্তর নেই—ছুটে এসে আমাকে জাপটে ধরে প্রথমেই বিশাল এক চুম্বন—বেশ দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন—আমার প্রায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল—

—”ব্যাপারটা কী? কেতকী?” প্রায় জোর করেই ওকে একটু সরিয়ে, দু’হাত দিয়ে দূরে ঠেলে ধরে রেখে জিগ্যেস করি—’হোয়াটস দ্য ম্যাটার?”

উত্তরে চেঁচিয়ে উঠলো কেতকী।

—”আই হ্যাভ গ্রেট নিউজ! আই য়্যাম গোয়িং টু বি আ মাদার! গোয়িং টু হ্যাভ আ বেবি! মী! মাই ওন বেবি। অল বিকজ অফ ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ—”

দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে দিয়ে চিৎ হয়ে, মুখখানাকে স্বর্গের দিকে তুলে আকর্ণ হাসিতে মুখ উজ্জ্বল করে তুলে কেতকী বলেছিল—”ওহ! হোয়াট আ গ্রেট ফীলিং।” খোলা, এলোমেলো ভ্রমরকালো চুলগুলো তার পিঠে ঝামরানো—কোমর, নিতম্ব ছাড়িয়ে হাঁটুর দিকে ঝুঁকে পড়েছিল ওর দাঁড়াবার ভঙ্গির গুণে। বাগানের মধ্যেই ঘুরতে ঘুরতে নাচতে শুরু করে দিল কেতকী।

—”কোনওদিন ভাবতেই পারিনি—আমি মা হবো। কেতকীও মা হতে পারে। নেভার কুড ইম্যাজিন ইট। বাট ইটস ট্রু। অল বিকজ অফ ইউ!” তারপর একটু থেমে ভুরু কুঁচকে,—”ওয়েল, মোস্ট লাইকলি ইটস ইউ। অফ কোর্স আই কান্ট বি শিওর! ইউ নো হাউ ইট ওয়াজ—” বলেই হাসি… তারপরই হাত ধরে টান—

—”কাম অন, লেটস সেলিব্রেট।”

—ওহ! আমার মাথায় আবছায়া স্মৃতি—সেই থার্টিফার্স্ট নাইট।

আমার যে রাত্রির বিষয়ে কিছুই মনে নেই! মাস্ট বি দ্যাট নাইট। কেতকী যদি সত্যি কথা বলে। কেতকী কি সত্যি সত্যিই এসেছে আমাকে সুসংবাদটা শোনাতে? ব্যাস, এই—ই?

না, সে বিয়ের কথা তোলেনি। চাইলড সাপোর্টের প্রসঙ্গও তোলেনি। শুধুই আনন্দ করতে, ধন্যবাদ দিতে, সুখবরটি জানাতে তার আসা। প্রথমে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, সত্যিই কোনোই স্বার্থ নিয়ে আসেনি কি আর সে মেয়ে?…

আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম মেয়েটার পরিপূর্ণ পাগলামির এই স্বচ্ছ চেহারা দেখে। বিয়ে, সংসার, সন্তানের দায়—দায়িত্ব চাপানোর দিক দিয়েই গেল না সে। শুধু মা হবে, এই আহ্লাদেই ভরপুর। বরং তার উল্টোপাল্টা কথাগুলো আমার অভ্যস্ত সামাজিক কানে অবিশ্বাস্য শোনাচ্ছিল। জীবনে এর বিপরীতটাই হয়ে থাকে।

সেই মেয়ে আমাকে সম্ভাব্য জনকের ভূমিকা উপহার দিয়ে সম্মানিত করতে এসেছে বটে, কিন্তু দিব্যি নিজে নিজেই ঘোষণা করছে, ”আই কান্ট বি শিওর”—আশ্চর্য মেয়ে। সংশয়ীর ভূমিকাটা তো আমাকেই দেবার কথা ছিল? আগেভাগে সেইটেও নিজেই নিয়ে বসে আছে।

চোখ বুজে দু’হাত ছড়িয়ে ঊর্ধ্বমুখে আধখানা চিৎ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ। সুখবরের আমেজটা উপভোগ করছে স্থির হয়ে। যেন উপরে কাউকে মনে মনে ধন্যবাদ দিচ্ছে। তারপরেই দৌড়ে এসে আরেকবার আমাকে জড়িয়ে ধরলো কেতকী। জড়িয়ে ধরা মানে শুধু বাহু দুটি দিয়েই নয়, যেন কেতকী তার সম্পূর্ণ সত্তা দিয়েই আলিঙ্গন করেছিলো আমাকে। আর চুমুতে চুমুতে অস্থির করে দিয়েছিল।

—”থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ…”

আমি তো এর জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। এই উপচে পড়া আবেগকে গ্রহণ করবার যোগ্য গভীর পাত্রও আমার হৃদয়ে ছিল কিনা, সেই মুহূর্তে আমি জানতাম না। অস্বস্তি বোধ করছিলাম—এই বন্যায় আমার বাঁধ দেওয়া দরকার। আমি কেতকীকে শান্ত করবার চেষ্টা করলাম, ”চল, চল, ভেতরে যাই।”

”কী ভেতরে যাবো? দূর!” কেতকী ছিটকে উঠলো—”কান্ট য়ু সী, আই ওয়ান্ট টু ফ্লাই? শ্যাম্পেন খোলো। এইখানে। বাইরে এনে, আনডার দ্যা স্কাই।

….বিম জাস্ট ইম্যাজিন মাই এক্সাইটমেন্ট। ডাক্তার বলে দিয়েছে, ইটস পজিটিভ, হি’জ ডেফিনিট!”

তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু থমকে থেকে মৃদুস্বরে বলল, ”ও! তোমার ভয় করছে। তুমি খুশি হওনি। তুমি ভাবছো এটা আবার কি উটকো ঝামেলা! বুঝেছি।”

পিঠ থেকে আমার হাতটা আস্তে সরিয়ে দিয়ে, কেতকী আমার মুখের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল—”এটা আসলে আমার একলারই সেলিব্রেশন, আমার একলারই সুখবর। আমার হাতে একটু টাকা আসুক, আমিই শ্যাম্পেন খাওয়াবো তোমাকে—আই জাস্ট ওয়ান্টেড টু থ্যাংক ইউ, নট টু ইনভলভ ইউ! বিকজ—টু বি অনেস্ট—আই অ্যাম নট ইভন শিওর ইটস ইউ—আই ওয়াজ জাস্ট গ্যেসিং—ইট কুড বি হান্স, দ্য নেক্সট মরনিং, অর কার্লোস, টু ডেজ বিফোর—হু নোজ? ডোন্ট ওয়ারি বিম, তোমাকে দায়িত্ব নিতে হবে না, রিলাক্স। দ্য বেবি ইজ অল মাইন। আমার বাচ্চা শুধু আমারই—ওকে?”…

—”আরে আরে, আমি কি তাই বলেছি?” আমি লজ্জা পেয়ে যাই।

মেয়েটা কি অবোধ? না নির্বোধ?

সত্যি কি এতটা সততাও সম্ভব? মেয়েটা এত সহজে এত সোজাসুজি সবকিছু বলে ফেলতে পারে। লজ্জিত হই, কেননা সত্যি আমার সন্দেহ হচ্ছিল। কেমন করে ওর মনে হলো যে ওর বাচ্চাটা আমারই। ওর তো পুরুষ বন্ধুর সংখ্যা দু’হাতের পাতায় গোনা যাবে না। আমাকে কেন ধরেছে? আমাকে ধন্যবাদ দেবার এত ঘটা কীসের? কিন্তু আমারই এখন লজ্জা করতে লাগলো। সত্যি কী স্বভাবই গড়ে দিয়েছে আমাদের সভ্যতা। প্রথমেই একটা অসদুদ্দেশ্য খুঁজি, স্বার্থ খুঁজি সবার সব কাজে; দ্বিতীয়ত, নিজের গা বাঁচাতে সচেষ্ট হই যে কোনো পরিস্থিতিতে। আমার প্রথমেই মনে হলো—এর মধ্যে ওর পক্ষে জানা সম্ভবই নয় বাবা কে? কিন্তু মেয়েটা আমাকেই বেছেছে কেননা আমিই সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, বিত্তবান, সম্পন্ন গৃহস্থ। ওর বন্ধুদের মতো উড়নচণ্ডে ভবঘুরে নই। সংসারের নিয়মে বাচ্চার বাবা বাছতে হলে আমাকে বেছে নেওয়াই বুদ্ধির কাজ। এসব কথা বিদ্যুৎগতিতে আমার মগজে খেলে গিয়েছিল এবং সংশয়, অপ্রসন্নতা গ্রাস করেছিল আমাকে। আমার মুখ দেখে কেতকীর সেটা অনুভব করতেও সময় লাগেনি। কিন্তু এক লহমায় সে আমার সমস্ত অভ্যন্তরীণ বাধা গুঁড়িয়ে দিয়েছে তার সোজাসুজি খাঁটি কথার রোডরোলার চালিয়ে। এখন আমিই অপ্রস্তুত। সামাজিক চাতুর্য দিয়ে কি এই বন্য সততার মোকাবিলা সম্ভব? তবু চেষ্টা করি।

—”আমি মোটেই সেকথা ভাবিনি কেতকী, হঠাৎ করে খবরটা পেলাম তো কোয়াইট আনএক্সপেকটেড—আই ওয়াজ নট রেডি ফর ইট—তাই প্রথমটায় ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, বাট নাউ আয়্যাম হ্যাপি। হ্যাপি ফর আস বোথ—উই মাস্ট সেলিব্রেট—” যতটা বললাম ততটা হ্যাপি আমি ছিলাম না। সমস্ত মন, মেজাজ সন্ত্রস্ত, উদ্বিগ্ন, টেনসড—কেতকীর ঠিক বিপরীত অবস্থা আমার। তবুও বলে ফেললাম। কেননা তখন ওটাই বলা উচিত ছিল। তারপর কেতকীকে বুকে জড়িয়ে আদরও করলাম। করাটাই উচিত ছিল বলে। ঔচিত্যের বাইরে ভাবনাচিন্তার প্রতিক্রিয়া আমার হয় না।

কেতকী কিন্তু বুঝতে পারলো না আমার চালাকি। আমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে শরীরটাকে একেবারে আলগা করে ছেড়ে দিল। সেইভাবেই নিঃশব্দ নিষ্কম্প স্থির হয়ে রইলো বহুক্ষণ। চোখ বুজে।

যতক্ষণ না আমি—”চলো কেয়া” বলে ওর গালে আস্তে করে টোকা মেরে ওর চেতনাকে জাগ্রত করলাম। ”এবার শ্যাম্পেনের বোতলটা আনা যাক”—মনে হচ্ছিল মেয়েটা বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছে। নেশা করে এসে থাকলে সেটা অসম্ভব নয়। লম্ফঝম্ফটাও যেমন স্বাভাবিক, ঘুমিয়ে পড়াটাও তেমনি। কেয়া ঘুমোয়নি। চোখ মেলে, সহজ স্বরে, ”লেটস গেট ইট” বলে ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

আজ ওর পরনে জীনস নেই। লং স্কার্ট, ভারতীয় প্রিন্টেড কাপড়ের। গোল হয়ে দু’হাত ছাড়িয়ে ঘুরছিল যখন, ছাতার মতো ছড়িয়ে পড়ছিল ওকে ঘিরে। নীল শাদা ছোপ ছোপ স্কার্ট, ওপরে ছোট্ট শাদা টপ। গলায় তুলসীর মালার মতো একগুচ্ছ পুঁতির মালা, কানেও তেমনি তুলসীকাঠের পুঁতির ঝর্ণাঝর্ণা দুল। কখনও টিপ পরে না। একটা টিপ পরলে খুব মানাতো ওকে ওই প্রায়জোড়া ভুরুর মাঝখানে। আর একটা ওড়না নিলেই দেশী মেয়ে। আজ ওর এই পোশাকটা জিপসীদের পোশাকের মতো।

—”মাথায় একটা সিল্কের রুমাল বাঁধলেই, ব্যাস!”

—”কেন, সিল্কের রুমাল কী হবে?”

—”তোমাকে জিপসী মেয়েদের মতো দেখাতো।”

—”আমার ভিতরটাও তো জিপসীদের মতোই দেখতে। রুমাল—টুমাল বাঁধতে হয় না। ইটস দ্য স্পিরিট!” শাদা দাঁত ঝলসে হাসলো কেতকী।

আড়ম্বর করেই শ্যাম্পেনের বোতল খোলার ব্যবস্থা করি। আইস বাকেটে প্রচুর বরফ ভরে, তার মধ্যে বনেদী কায়দায় বসানো হলো শ্যাম্পেনের বোতলটি। ঠাণ্ডা হোক আগে।

.

বাচ্চা নিঃসন্দেহে কেতকীর। কিন্তু তার বাবাটি আমি কিনা, সন্দেহ আছে।

কেতকী নিজেই নিশ্চিত নয়। আমি তো নই—ই। কেতকীর যেকরম ছন্নছাড়া জীবনযাত্রা, তাতে ও যতই এখন আকুলভাবে চাক, পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে একটি শিশুকে মানুষ করে তোলা ওর পক্ষে শেষ পর্যন্ত কতটা সম্ভব হবে সন্দেহ আছে। সেদিক থেকে, শিশুটির জীবনে বোধহয় একটা বাবা থাকাই মঙ্গল। ধরে নিচ্ছি বাচ্চাটা আমার নয়। তবুও আমি যদি তাকে পালন করি—আমার ক্ষতি নেই, কিন্তু তার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল। আর যদি সে আমারই সন্তান হয়? আর আমি তাকে পালন না করি? তাতে শুধু তারই অমঙ্গল নয়, আমারও গভীর ক্ষতি। অতএব, বাচ্চা যারই হোক আমার পক্ষে উচিত হবে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া। যদি আমারই বাচ্চা হয়, তাকে অমন পথে—বিপথে উড়তে—পুড়তে ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব। আর যদি আমার সন্তান নাও হয়, একটি নিরপরাধ শিশুপ্রাণ তো? যার বাবা আমি হলেও হতে পারতাম। কেতকীর উল্লাসের এই মুহূর্তে ডি. এন. এ. টেস্টের প্রসঙ্গ তোলা যায় না।

শ্যাম্পেনে চুমুক দিতে দিতে এই ভাবনাগুলো মাথার মধ্যে বুদ্বুদের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল—আমি মন স্থির করে ফেললাম। বেশি সময় দিলাম না নিজেকে। কেতকীকেও না। ও—মেয়ে তো খাঁচায় ভরবার মেয়ে নয়, ও হলো বনপাহাড়ীর। ও খোলা আকাশের। রাজী হবে কি আমার প্রস্তাবে? তবুও প্রস্তাবটা করা জরুরি। বিয়ের শৃঙ্খল এবার ওর পায়ে পরানো দরকার। ভয় পেয়ে উড়ে না যায় আবার, কিংবা খেপে না ওঠে। নেশায় মানুষ বড্ড আনপ্রেডিকটেবল।

কিন্তু কেতকী নেশায় ছিল না। শান্তভাবেই উত্তর দিল। বলল, ভেবে দেখবে। এতবড় ডিসিশন এক্ষুনি নিয়ে ফেলতে পারছে না। ”বিয়ের মতো এমন সিরিয়াস কাজকর্ম আগে তো করিনি কখনও? লেট মি স্লীপ ওভার ইট। লেট মি থিংক। বিয়ে—টিয়ের কথা তো আমার ভাবাই হয়নি এখনও। টু আর্লি!”

—”মা হবার কথাও তো ভাবা হয়নি। সেটা যখন হয়েই যাচ্ছে, তখন এটাও না হয়—”

উত্তরে কেতকী এক মাথা চুল ঝাঁকড়ে ঝাঁকড়ে বলল—”কিন্তু দুটো তো এক ব্যাপার নয়? একটার দায়িত্ব আমি নিজে নিজেই নিতে পারব বলে আমার ধারণা, অন্যটা তো দুজন অ্যাডাল্টের যুগ্ম জীবনযাপনের ব্যাপার। ইউ হ্যাভ টু মেক কনস্ট্যান্ট অ্যাডজাস্টমেন্টস… সো মেনি কোয়েশ্চনস… সো মেনি ডাইমেনশনস… ডু আই নো ইউ দ্যাট ওয়েল? টু নো দি আনসারস টু অল দোজ কোয়েশ্চেনস? এইসব প্রশ্ন তো মাথায় আসছে। ম্যারেজ ইজ নট আ জোক। ইটস আ বনড। আ লাইফলং বনড। অ্যাট লীস্ট দ্যাটস হোয়াট আই বিলিভ। ওই জন্যই চট করে ডিসিশন নিতে পারছি না—সারাজীবন তোমার সঙ্গে কাটাতে পারবো তো? অ্যান্ড ইউ টু। তুমিও ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখে তারপরে বলো। ডোন্ট প্রোপোজ টু মি ইন আ হারি। বাচ্চার বাবা তুমি হতেই পারো, আবার নাও তো হতে পারো? ইউ মে অর মে নট বি রেসপনসিবল ফর ইট—হঠাৎ কেন বিয়ে—থার কথা বলছ? আমি তো তোমাকে রেসপনসিবিলিটি শেয়ার করতে বলিনি, শুধু আনন্দটাই। এতবড় আনন্দ! এটা কি একা একা সেলিব্রেট করা যায়? তুমি আমার দেশের মানুষ—তুমি বাংলা গান ভালোবাসো—সো আই কেম টু ইউ! হোয়াই কমপ্লিকেট ম্যাটারস?”

”শোনো কেয়া, লেট আস গিভ দ্য বেবি আ প্রপার হোম—একটা বাবা, একটা মা, যেমন থাকার কথা সব বাচ্চার…”

—”নট নেসেসারিলি! আই’ল বি ফাইন। আমি জানি তুমি আমাকে ট্রাস্ট করতে পারছো না। তুমি ভাবছো আমি ইররেসপনসিবল মা হবো? নো সার, আই’ল বি দ্য বেস্ট মাদার আনডার দ্য সান! আই শ্যাল চেঞ্জ মাই লাইফস্টাইল,—গেট আ পার্মানেন্ট জব—আই’ল সেটল ডাউন উইথ মাই চাইলড—আই’ল মুভ ইনটু আ প্লেস উইথ আ গার্ডেন—উই’ল বোথ বি ফাইন। মি অ্যান্ড মাই বেবি…”

অবাক হয়ে কেতকীর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। নতুন মুখ। উজ্জ্বল চোখদুটো স্বপ্নে মায়াময়, আত্মবিশ্বাসে ভরে উঠেছে। ওকে দেখে এবার আমার সত্যি সত্যি ওকেই বিয়ে করতে ইচ্ছে করলো। বাচ্চার জন্যে নয়, ওরই জন্যে। এই স্বপ্ন—দেখা মেয়েটার একটা সাথী দরকার, যে ওকে যত্ন করবে। ওর বাচ্চাকে যত্ন করবে। যত্ন পায়নি কোনোদিন ওই মিষ্টি মুখখানা, অনেকদিন পথে পথে, নিরাশ্রয়, এবারে ওর ঘর দরকার।

আমি এবার আমার পদ্ধতি বদল করি।

—”কেতকী, বাচ্চা উপলক্ষ মাত্র—এসো আমরা সংসার করি। নট ফর দ্য বেবিজ সেক, বাট ফর মাই সেক? আমাকে নেবে, কেতকী?” একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গেল কেতকী।

আমি ধ্রুপদী কায়দায় ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছিলাম। নাটুকে ভাবেই ওর হাতে চুমু খেয়ে প্রস্তাবটি রেখেছিলাম ওর সামনে। কেতকী উত্তর দেয়নি। আমিই উঠে ওকে আস্তে করে চুমু খেয়ে বুকে টেনে নিলাম। কেতকী বাধাও দেয়নি। ”কী গো কেয়াফুল? রাজী তো? আমাকে তুমি নেবে তো? তুমি আর তোমার বাচ্চা?” কেতকী এবারে আমার বুকে মুখ রেখেই নির্বাক হয়ে থাকে। ধরে নিলাম মৌন সম্মতিরই লক্ষণ।

.

শ্যাম্পেনের বোতল খোলবার পরে আমি ঢুকলাম রান্নাঘরে, আর কেতকী গ্লাস হাতে নিয়ে আবার চুপচাপ চলে গেল বাগানে। লিলিপুলের ধারে, সেই ঝর্ণার পাশে। পাথরের ওপরে গিয়ে বসলো লাল মাছেদের কাছে। শীতকাল, মাছেরা লুকিয়ে আছে জলের নিচে। ভোরের দিকে মাঝে মাঝে একটা পাতলা বরফের সর পড়ে এদিকের স্থির জলটাতে। ঝর্ণা সবসময়ে নাচছে বলে ঠিকঠাক জমতে পারে না লিলিপুলটা। ঠাণ্ডার মধ্যে ওখানেই বসলো গিয়ে কেতকী। আম রান্নাঘরে ঢুকে একটা স্যালাড তৈরি করলাম। ভালো স্মোকড স্যামন ছিল ফ্রিজে। ক্রিস্টালের পানপাত্র বের করে একটা প্রকৃতই ফরাসী দেশের বোরদ্যো ওয়াইন খুললাম। এ ক্যালিফর্নিয়ার বোরদ্যো নয়, অস্ট্রেলিয়ারও নয়—আসল বোরদ্যোর বোরদ্যো। রুপোর কারুকাজ করা একজোড়া মোমদানিতে দুটি মোটা, লাল, সুগন্ধী মোমবাতি জ্বালিয়ে, টেবিল সাজিয়ে, ঘরে ডেকে এনেছিলাম কেতকীকে। বলেছিলাম—”বিয়ের কথাবার্তা পরে হবে। দিস ডিনার ইজ ফর আওয়ার চাইলড’স লাভলি মাদার। লেটস সেলিব্রেট।”

”স্মোকড স্যামন স্যালাড!” বলে তক্ষুনি চেঁচিয়ে লাফিয়ে উঠেছিল কেয়া। বাচ্চা মেয়ের মতো।

—”অ্যান্ড আ ক্যান্ডল লাইট ডিনার। অল ফর মি?”

আবার মুগ্ধতা! সেই কৃতজ্ঞ দু’চোখের খুশি আমার স্মৃতিকে সুরভিত করে রেখেছে এখনও।

—”এমনি যদি রেঁধে বেড়ে রোজ রোজই খাওয়াও, আমার তাহলে বিয়েতে কী করে আপত্তি থাকতে পারে, বলো?”

—”এক্ষুনি রাজী হয়ে যেও না কেয়া। টেক ইওর টাইম। থিংক ওভার ইট। কিন্তু তুমি কোনওদিনই রান্নাঘরে ঢুকবে না, এরকমই নিয়মকানুন হবে নাকি তোমার সংসারের? ওয়েট আ মিনিট। তাহলে বাপু আমাকেও আরেকবার ভেবে দেখতে হবে।”

হৈ হৈ করে হেসে উঠেছিল কেতকী—”আই অ্যাম আ গ্রেট কুক। জানো? আই ক্যান বীট এনি কর্ডন ব্লো শেফ ইন ফ্রেঞ্চ কুইজিন।”

আমি বোরদ্যো খুলেছি শুনেও কেতকী বলল, বোরদ্যো নয়, ও চায় শাবলি। ফ্রেঞ্চ শাবলি! কিন্তু আমার বাড়িতে শাবলি ছিল না। ফুরিয়ে গেছে, শাবলি কিনিনি বেশ কিছুদিন। কেতকী জোর করতে লাগালো। ”নিশ্চয় আছে, দ্যাখো তোমার সেলারে, নিশ্চয় আছে।” বলতে বলতে নিজেই ছুটলো। আমিও ছুটলাম। সেলারে গিয়ে দেখি পরপর তিনটে বোতল রয়েছে, দামী ভিনটেজ শাবলির—যেগুলোকে বোরদ্যোর বোতল বলেই আমার নির্ভুল ধারণা ছিল। খানিকক্ষণ আগেও। এখন দেখছি শাবলি—ই সন্দেহ নেই।

আমি হতভম্ব। নির্বাক হয়ে বোতলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। তারপর তুলে নিই একটা—ফ্রীজারে ঢোকাবো। ঠাণ্ডা করতে হবে।

—”এগুলো তো চিলড নয়, শাবলি চিলড না হলে—” বলতে বলতে কেতকী নিজেই সমাধান করে ফেলে সমস্যার। ”দাঁড়াও, চিল করে দিচ্ছি এক্ষুনি—”

বোতল হাতে ছুটলো বাগানে, লিলিপুলের বরফঠাণ্ডা জলে ডুবিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ—তারপর ”এই নাও ঠাণ্ডা শাবলি” বলে ফিরিয়ে এনে দিল আমার হাতে—”এবারে বোতলটা খুলে ফেলা যাক।”

উৎসব করেই কেটেছিল সেই রাত। কেতকী ফিরে যায়নি তার অ্যাপার্টমেন্টে। গান শুনিয়েছিল সারারাত। সারারাত ধরে কেতকী তার একক শ্রোতাকে গান শুনিয়েছিল। বাংলা গান। রবীন্দ্রনাথ। সকালে ঘুমন্ত কেতকীর শান্ত মুখখানি দেখে আমার মনে হয়েছিল এই মেয়েটাকে আর একলা পৃথিবীতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। অনেকদিন একা একা ঘুরছে। অনেকদিন ওর মাথার ওপর ছাদ নেই। অনেকদিন নগ্নপদ। নগ্নশির। ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে। হি হি তুষারে। একা।

—পাশ ফিরে নিশ্চিন্ত মুখে ঘুমিয়েছিল বাঁ হাতের ওপর গলাটি রেখে। পরনে আমারই স্লিপিং স্যুট। অতবড় পোশাকের মধ্যে ওকে আরও রোগা, আরও কচি, আরও বাচ্চা দেখাচ্ছে। কিশোরীও নয়, যেন বালিকা। একবোঝা কালো চুল ছড়িয়ে আছে, বালিশ থেকে উপচে পড়েছে বিছানাতে। মেঘবরণ কেশ। ওই মুখ কোনোদিন মিথ্যা কথা বলতে পারে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *