উড়াল – ১৭

সতেরো – মালবিকার ডায়েরি

আজ টুবলুর শরীরটা খুবই খারাপ দেখে এসেছি। কিছুতেই খেতে পারছে না। সুপও খাওয়ানো গেল না। টুবলুকে উঠিয়ে বসালেও বসে থাকতে পারছে না। টলে টলে শুয়ে পড়ছে পিছনদিকে। কিন্তু মুখের হাসিটি অম্লান। দুই পাশে দুই হাত ছড়িয়ে এক মুখ হেসে আমাকে বললো, ”মালু, জানো আমি এইবারে উড়ে যাব। পরী হয়ে উড়ে যাব। আমার মা’র কাছে, পরীদের দেশে চলে যাব। আমার ডানাটা পুরো তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই দ্যাখো!”

ক্লান্ত হতেই ফ্রক তুলে আমাকে দেখালো।

—”সেই যে আমাকে একজোড়া স্লিপার দিয়েছিলে না তুমি, শাদা উলের বেডরুম স্লিপার? তাতে ঠিক এমনি নীল, হলুদ আর রুপোলি রঙের ফুটকি আছে না? ওই জুতোর সঙ্গে ম্যাচিং। ডানা তো গজাচ্ছে, কিন্তু কী করে উড়তে হবে, আগে মা একটুখানি দেখিয়ে দেবে—যদিও আমি জানি। তারপরে উই’ল ফ্লাই অ্যাওয়ে—দুজনে উড়তে উড়তে পরীদের দেশে চলে যাব। তুমি সেখানে যাবে, মালু?”

পিঠের শাদা ধবধবে পালকের ডানাদুটো সত্যিই বেশ পাখা—পাখা দেখাচ্ছে। ওড়া যেতেই পারে।

আগে আগে আমরা সবাই ওকে বকতাম। ও যখন বলতো—”আমার মা পরী। আমিও আসলে পরীই। আমার দুটো লুকোনো ডানা আছে। একদিন ঠিক উড়ে যাবো।” তখন ওকে বকুনি দেওয়া হতো—”ছিঃ টুবলু, ও কী কথা! কেন তুমি উড়ে যাবে? তুমি ইশকুলে যাবে, মাঠে খেলতে যাবে।”

টুবলু বলতো—”পরীদের রাজ্যেও ইশকুল আছে। পরীদের রাজ্যের খেলার মাঠটা এটার চেয়ে অনেক বেশি বড়।”

কিন্তু যখন থেকে ওর ডানা গজালো, আর ওকে ওসব বলি না। আজকে টুবলুর শরীর ভালো নয়। বড্ড রোগা হয়েছে গত ক’দিনে। হুশ হুশ করে ওজন কমে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও কিছু করা যাচ্ছে না, বিমলদা এতদিনে মনে মনে প্রস্তুত। বোধহয় রুণাও। আমি তো ডাক্তার। আমার প্রস্তুতির অর্থ আলাদা।

”টুবলুকে খাওয়ানো যাচ্ছে না,” রুণা আমাকে হসপিটালে ফোন করলো, ”টুবলুর আজ চোখ মেলতেও কষ্ট হচ্ছে মনে হয়!”

—”আমি আসছি, এক্ষুনি।”

বিমলদা বসেছিলেন টুবলুকে কোলে নিয়ে। রুণা দাঁড়িয়েছিল জানালায়।

রুণা কাঁদছিল।

—”টুবলু? আমি মালু।”

টুবলু অতি কষ্টে চোখ মেলে আমাকে দেখলো, জোর করে ঠোঁট টেনে হাসলো। তারপরে কথা বললো। বেশ স্পষ্ট গলাতেই বলে উঠলো—”মালু, ইউ নো হোয়াট? মা কেম টু মি! আজকে আমি মা’র সঙ্গে উড়ে যাব, পরী হয়ে উড়ে যাব, পরীদের দেশে আয়্যাম ফ্লাইয়িং আওয়ে উইথ মা টুডে—গিয়েই তোমাদের ফোন করে দেব, ডোন্ট ক্রাই, আচ্ছা?”

কথা বলতে বলতেই দুই চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো তার। বুজে গেল কণ্ঠস্বর। বিমলদা টুবলুকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সজোরে। রুণাও দৌড়ে এসে দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে জড়ালো—পাখি—মায়ের মতো করে ঢাকলো ওদের বাপ—বেটি দুজনকেই—দুটি প্রিয় মানুষকে।

আমি তো ডাক্তার। গুরুতর অবস্থায় রোগীকে অক্সিজেন দেবার চেষ্টা করলাম—বিমলদা হাত নেড়ে মানা করলেন। লাভ হতো না কিছুই, ঠিকই। আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। পায়ে পায়ে লিলিপুলের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আকাশে দিনের আলো। লিলিপুলের পদ্মিনীরা ফুটে রয়েছে। ঝর্ণার জলধারা একইভাবে ঝরে পড়ছে। কোথাও কোনো বদল হয়নি।

খানিক বাদে রুণাও বেরিয়ে এল। আমার কাছে এসে পাথরের ওপরে বসে পড়লো। দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে।

অনেকক্ষণ, অনেক মিনিট, বুঝি অনেক ঘণ্টা বাদে বিমলদা যেন ঘুম ভেঙে উঠে এলেন। এসেই বেশ স্বাভাবিক কেজো একটা গলার স্বর তৈরি করে চট—পটে সুরে বললেন—”চলো মালবিকা, রুণা, এবার সব ব্যবস্থাগুলো সেরে ফেলা যাক। উই নীড টু ফিল ইন সাম ফর্মস নাউ।—ও—কে রুণা, ডারলিং, কাম, লেটস গো ইনসাইড—”

আমরা জাগতিক জীব, নশ্বর জীবনের সমস্যার জন্য সর্বদাই প্রস্তুত। ঘরেই দু’দুজন ডাক্তার উপস্থিত—ব্যবস্থাপনার অসুবিধে ছিল না কিছুই। সবই রেডি। ডেথ সার্টিফিকেটটা লিখতে হবে আমাকেই। ওটার ভার বিমলদাকে দেওয়া যায় না—।

মোটামুটি প্রস্তুতি ছিলই আমাদের, টুবলুর সবচেয়ে প্রিয় লাল ভেলভেটের ফ্রকটাই ওকে পরানো হবে, রুণাও তাই বললো। ফ্রকটা নিতে ঘরে ঢুকেই রুণার তীক্ষ্ন আর্তনাদ:

—”ড্যা—ড!”

কী যে ছিল সেই কাতর স্বরে, অস্থির হয়ে আমিও ছুটে গেলাম। বিমলদাও এসেছেন দৌড়ে—রুণা বসে পড়েছে খাটের ওপরে।

পাশের বড় জানালা হাট করে খোলা।

পর্দাটা দুলছে।

খাটে টুবলু নেই।

শুধু একটা লম্বা, শাদা ধবধবে পালক পড়ে আছে।

বকের পাখার মতো দুধ—শাদা, রেশমের মতো নরম, তাতে স্পষ্ট নীল, হলুদ আর রুপোলি বুটি, যেন চান্দেরি ওড়নার একটা ছেঁড়া টুকরো।

হঠাৎ আকাশ থেকে একটা দমকা বাতাস এসে পর্দাটা উড়িয়ে দিয়ে গেল। আমরা স্পষ্ট শুনতে পেলাম, হাওয়ায়—ভাসা, পাতলা ঝিরঝিরে, খুশি—খুশি কচি গলায় টুবলু বলছে—”হাই ড্যাডি! হাই মালু! আমি এখন মা’র কাছে, আমরা পরীদের রাজ্যে চলে এসেছি, ইটস ভেরি বিউটিফুল হিয়ার ইন দ্য ফেয়ারিল্যান্ড, প্লীজ রুণা, ডোন্ট ক্রাই, আই লাভ ইউ, ড্যাড, আই লাভ ইউ অল”—

***

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *