ষোলো – মালবিকার ডায়েরি
টুবলুর শরীর আস্তে আস্তে খারাপ হচ্ছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। কিন্তু ওই চেষ্টাটুকুই শুধু সাধ্যে কুলোয়। যে রোগের নিরাময় অথবা উপশম, কোনোটাই ডাক্তারের ক্ষমতার মধ্যে নেই, ডাক্তার নিজেই যেখানে রোগের প্রবল প্রতাপে ভগ্নজানু হয়ে সময়ের কাছে করুণা প্রার্থনা করছে, সেইরকম রোগীর দেখাশুনো করা শুধু তার সৃষ্টিকর্তার পক্ষেই সম্ভব।
টুবলুর দেখাশুনো তার সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দিইনি অবশ্য আমরা। মানুষের সামান্য ক্ষমতায় যতটুকু শুশ্রূষা, যতটুকু সেবা, সমাদর সম্ভব, বিমলদা তার সবখানি ঢেলে দিয়েছেন সন্তানের প্রতি। ঠিক যেমন ধৈর্য ও স্নেহ নিয়ে সেবা করেছিলেন টুবলুর মাকে। বিমলদা ঠিক যেন একজন মা।
.
আমার ভারি আশ্চর্য লাগে। কেবলই আমাদের বাবার কথাটা মনে পড়ে। মা প্রবল জ্বরে উঠতে পারছেন না, বাবা এসে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বলছেন, ”ওঠো ওঠো, ন্যাকামো করতে হবে না। ভাত বাড়ো।” সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে, কেননা বাবার ভাত আমি বেড়ে দিয়েছি, বাবাকে খেতে ডেকেছি। বাবা সে থালাটায় খাবেন না। মাকেই উঠে বাবার ভাত বেড়ে দিতে হবে। তবে বাবা খাবেন। ফর্সা ধুতি, ফর্সা ফতুয়া গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ইশকুলের দেরি হয়ে যাবে, ভয়ে মাকে উঠতেই হচ্ছে। রোগা পাতলা, ফর্সা ধবধবে, হাড়—বের—করা, শিরা—ফুটে—ওঠা ছোট্টখাট্টো মানুষটি আমাদের মা। ভোর থেকে উঠে মধ্যরাত্রি অবধি পরিশ্রম করছেন। বাবা ছিলেন কড়া মনিব। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করতেন ওই অ্যানিমিক, ম্যালেরিয়া রোগী মা। বাবা দেখতেও পেতেন না মা কী করছেন না করছেন। বাবা, জ্যাঠামশাই, আমরা ছ’জন। মা সকলের জন্যে একা খাটতেন। আমরাও অবশ্য দ্রুত ঘরের কাজকর্ম শিখে ফেলে মা’র অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু বাবাকে কখনও কোনো কাজে হাত দিতে দেখিনি। মা’র জ্বর খুব বাড়লে কবিরাজমশাইকে ডাকতে যেতাম আমরাই। ওষুধ খাওয়াতাম আমরাই। পথ্য বানাতাম আমরাই। বাবারাও যে সংসারের কোনো কাজে লাগেন, সেটা জানার সুযোগ হয়নি।
তাই অবাক হয়ে যেতাম যখন দেখতাম বিমলদাকে কেতকীর সেবাযত্ন করতে। কোনো ক্লান্তি নেই, কোনো অধীরতা নেই, কোনো অপটুতা নেই। তারপরে এই পাঁচ বছর টুবলুকে মানুষ করা। মুগ্ধ হয়ে দেখি কেমন পরিপাটিভাবে তিনি মা—হারা টুবলুর মা হয়ে বসেছেন। এই পাঁচ—ছ’ বছরে কোথাও তাঁর ক্লান্তি দেখিনি এতটুকু। ব্যবহারিকভাবে মেয়েকে যেমন মায়ের অভাব তিনি বুঝতেই দেননি, উপরন্তু মায়ের গল্প করে করে টুবলুর মনের জীবনে একজন অদৃশ্য মাকে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। টুবলুর সঙ্গে তার মায়ের যোগাযোগ আছে, কথোপকথন হয়।
টুবলুর প্রাত্যহিক জীবনে ‘মা’ বলে একজন স্নেহময়ী উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের অদৃশ্য কিন্তু সুরেলা উপস্থিতি গড়ে দিয়েছেন বিমলদা। সেই উপস্থিতি যেমন প্রবল, তেমনি কোমল এবং সর্বশক্তিমতী। মনে দুঃখু হলে টুবলু মাকেই জানায়। আনন্দ হলেও মাকে। এদেশে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়বার আগে বিছানায় বসে ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানায়, তাঁর করুণার জন্য তাঁকে ধনবাদ দেয়। প্রিয়জনদের সকলের মঙ্গল কামনা করে; নিজের দোষত্রুটির জন্য মার্জনা চায়, আর ভবিষ্যতে যাতে সেইসব ত্রুটি আর না ঘটে, সেই আবেদনও পাঠায়।
এই প্রার্থনাটি টুবলু প্রতি রাত্রে জানায় ঈশ্বরকে নয়, তার মাকে।
—”মা গো, আজ আমাদের বাগানে একটা টমক্যাট এসেছিল, কিন্তু সে ওয়াইলড ক্যাট নয়। তাকে ভয় করেনি। সে নিজেই ভয় পাচ্ছিল আমাকে। আমি তখন লালমাছেদের পাহারা দিচ্ছিলাম যাতে ওরা হুলো বেড়াল দেখে ভয় না পায়। বনবিড়াল হলে তারা নাকি মাছ ধরে খেয়েই নেয়। কিন্তু টমক্যাট কিচ্ছু করেনি। শুধু বসেছিল পাঁচিলের ওপরে অনেকক্ষণ।” এইরকম সব গল্পগুজবও চলত ওর মায়ের সঙ্গে। রাত্রেই শুধু নয়, একা ঘরে থাকলে মাঝে মাঝেই মা’র সঙ্গে কথা হয়।
—”মা, আমি আজ একটা অন্যায় কাজ করেছি। পাশের বাড়িতে আমার বলটা পড়ে গিয়েছিল, আমি বাবাকে বলিনি। ওটা হারিয়েই গেল। পাশের বাড়ির বিশাল কুকুরটা আমাকে দেখলেই এমন ভৌ ভৌ শুরু করে যে ও—বাড়িতে আমার বল কুড়োতে যেতে ইচ্ছে করেনি। আমার ওইদিকে বলটা ছোঁড়াই উচিত হয়নি। আগেও একদিন বলটা ও—বাড়ির সুইমিং পুলের মধ্যে গিয়ে পড়েছিল। ওরা সেদিন দিয়ে গিয়েছিল। আজকে দেয়নি। হয়তো বাগানের ঝোপঝাড়ে ঢুকে আছে। ওরা দেখতে পায়নি। কিন্তু ওই বিরাট কুকুরটা ঠিকই দেখতে পাবে, গন্ধ শুঁকে শুঁকে খুঁজে বের করবেই আমার বল। আমার গন্ধ তো চেনে। কুকুরেরা সব গন্ধ চিনতে পারে। মাগো, তুমি বলটা ফেরত পাঠিয়ে দাও না। প্লীজ—বলটা যেন ওদের বাড়ির ভালো লোকেদের কারুর চোখে পড়ে। ওই বলটাই আমার বেস্ট বল। বাবা জন্মদিনে দিয়েছেন।”
ছোট্ট জনির মতো যদি টুবলু ডায়েরি রাখতে পারত তাহলে এইসব কথাবার্তাগুলো নিশ্চয় মুখে না বলে, জার্নালে লিখে রাখত। আমরা একদিন এই নিয়ে কথা বলছিলাম। রুণার মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল। ও বলল,—”আমরা একটা কাজ করি না কেন, টুবলুর কথাগুলো টেপ করে রাখি। ওর ঘরে একটা টেপ রেকর্ডার চালু থাকুক। ও যখনই যা বলবে, সব রেকর্ডেড হয়ে যাবে। তারপর আমরা বসে বসে সেসব লিখে ফেলবো, ট্রান্সক্রাইব করে। দ্যাট ওয়ে উই গেট টু হিয়ার হার ভয়েস ইভন আফটারওয়ার্ডস অ্যান্ড শি উইল হ্যাভ আ জার্নাল অ্যাজ ওয়েল।” জনির মতো না হোক কিছু তো থাকুক তোলা। সকলেই আগ্রহী হলাম রুণার এই প্রস্তাবে।
ওর মায়ের কিছু গান টেপ করে রাখা আছে বিমলদার কাছে। আর টুবলুর প্রতি উচ্চারিত কিছু কথা। সেগুলো কেতকী আশা করেছিল শোনবার উপযুক্ত হবে টুবলু একদিন। সেই টেপটি বন্ধ আছে, চাবি দেওয়া। টুবলুর ষোলো বছর বয়েসের জন্মদিনে ওকে দেওয়া হবে সেই চাবি। ততদিন ধরে সযত্নে তুলে রাখতে হবে তার মায়ের দেওয়া উপহার—প্রয়োজন হলে উন্নততর মানের টেপ—এ ট্রান্সফার করে নিতে হবে, কিন্তু আমাদের শোনা চলবে না। গোপন কথা। শুধু টুবলুরই একলার শ্রবণের জন্যে বলা।
সেসব এখন বিমলদা সিডিতে ট্রান্সফার করেছেন। জানি না, আমাদের কখনো শোনবার সুযোগ হবে কিনা। অন্তত গানগুলো আলাদা সিডিতে তুলে সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারতেন এই পাঁচ বছরে। কিন্তু দেননি। টুবলুর জন্য আগলে রেখেছেন। হোপিং অ্যাগেনস্ট হোপ! যদিও জানি মায়ের এই উপহার টুবলুর কাছে পৌঁছবে না। টুবলুর ষোলো বছরের জন্মদিনের উৎসবে আনন্দ করবার সুযোগ আমরা পাব না। খুব দ্রুত ভেঙে পড়ছে ওর শরীরের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রপাতি। কচি শরীর নিয়ে ও যুঝছে ব্যাধির সঙ্গে—কেবল মনের জোরে। সদানন্দময়ী স্বভাবের জোরেই এতদিন আমাদের কাছে রয়ে গেছে টুবলু। মনে মনে ও একটা নিজস্ব রাজ্য গড়ে নিয়েছে, অন্য একটা জীবন, যেখানে মৃত্যুর ঠাঁই নেই। আমি অবাক হয়ে দেখছি, ডাক্তারি শাস্ত্র অনেকদিন আগেই হার মেনে নিয়েছে, কিন্তু টুবলু হার মানেনি।