উড়াল – ১৪

চোদ্দ – বিমল

—”সোনা, একটু মুখে দে স্যান্ডুইচটা।”

—”বাবা, আমি বাতাস হয়ে যেতে পারি, জানো?”

—”হ্যাঁ, সোনা? সত্যি? বাতাস হয়ে যেতে পারিস তুই? কেমন করে পারিস? দেখিয়ে দে তো?”

—”দেখিয়ে দেওয়া যায় না, ওটা ম্যাজিক!”

—”তুই ম্যাজিক জানিস, না সোনা?”

—”জানিই তো। আমার মা পরী না? পরীরা তো ম্যাজিক জানে।”

—”তোর মা পরী ছিল বুঝি?”

—”ছিলই তো? তাই তো পরীদের রাজ্যে উড়ে চলে গেছে। পরীরা বেশিদিন থাকতে পারে না তো মাটিতে। আকাশে থাকে। বাতাসে থাকে।”

—”সোনা, তোকে এসব কে বলল? মালা?”

—”না তো, কেউ বলেনি, আমি জানি।”

—”কেমন করে জানলি?”

—”নিজে নিজে।”

—”নিজে নিজে? কে—উ বলেনি? ঠি—ক?”

—”কে—উ না। শুধু মা বলেছে?”

—”মা? মা কখন বলল?”

—”মা বলেছে, আমরা বাতাস হয়ে যেতে পারি। মা তো বাতাস হয়ে আছে। এই তো মা এই ঘরেই আছে। বাতাস হয়ে। আমিও মার মতন বাতাস হয়ে যাবো।”

—”না! মাগো, না! তুমি বাতাস হয়ো না—তুমি আমার কোলের মধ্যে এমনি করেই টুবলু হয়ে থাকো। মাটিতে। তোমাকে বাতাস হতে হবে না। নাও, মুখ হাঁ করো—”

—”কিন্তু বাবা, আমিও তো পরী। আমাকে তো আকাশে ফিরে যেতেই হবে। পরীরা কি মাটিতে থাকতে পারে? পারে কি? তুমিই বলো? পরীরা তো মেঘের মধ্যে থাকে। তাই না? আমার যে ডানা আছে, বাবা।”

—”না, মামণি, তুমি পরী নও, তুমি ছোট্ট একটা মেয়ে। আমার ছোট্ট মিষ্টি টুবলু—সোনা, তোমার পরী হয়ে কাজ নেই—হাঁ করো—”

—”বাবা, তুমিও কি পরী হতে পারো না? শুধু কেবল মেয়েরাই কি পরী হয়?”

—”হ্যাঁ সোনা। পরীরা সবাই মেয়ে, মেয়েরাই শুধু পরী হয়।”

—”কিন্তু বাতাস? বাবা, তুমি কি বাতাস হতে পারো না? আমি তো পারি।”

—”আমি যে একটাও ম্যাজিক জানি না। আমার মা তো পরী ছিল না? আমার মা তো এমনি মানুষ—মা ছিল, কিন্তু ম্যাজিক জানত না। টুবলু, তুমি খালি কথা ঘোরাচ্ছো, একটুও খাচ্ছো না।”

—”তাই তোমার মা বাতাস হয়নি। তোমার মা যে বাতাস হবার মন্তর জানতো না। আমি কিন্তু জানি। মা’র মতন।”

—”মন্তরটা আমাকে শিখিয়ে দিবি, মামণি? আমিও তোর সঙ্গে বাতাস হয়ে যাবো?”

—”ওটা তো মনে মনে জানতে হয়। আমাকে কেউ শেখায়নি বাবা—আমি মনে মনেই জেনে গেছি। আচ্ছা বাবা, আমি এখন একটু ঘুমোই?”

—”নিশ্চই ঘুমোবে, মাগো, কিন্তু আগে একটুখানি খাও, এই দুধটুকু খেয়ে নাও। সকাল থেকে কিছুই খাওনি। এমন করলে কি চলে?”

—”খেতে ইচ্ছেই করছে না আমার। বাতাসের কি খিদে পায়?”

—”বাতাসের ঘুম পাচ্ছে যখন, তখন খিদে কেন পাবে না? একটুখানি দুধ, দ্যাখো কী সুন্দর চকলেট গুলে দিয়েছি, খুব ভালো লাগবে—”

—”ভালো লাগবে না। ঘুম পেয়েছে।”

—”না খেলে গায়ে জোর হবে কেমন করে? বাতাসের গায়ে কত জোর দেখেছো? ঠাশ ঠাশ করে জানলা—দরজাগুলো বন্ধ করে, কাচ ভেঙে ফ্যালে, বড় বড় গাছ পর্যন্ত উপড়ে ফ্যালে—না খেলে তুমি কেমন করে—”

—”দূর! সে তো ঝড়। সে তো দুষ্টু বাতাস। আমি ঝড় হবো না বাবা। আমি মা’র মতন এমনি লক্ষ্মী বাতাস হবো। এমনি হাওয়া হবো। শুধু হাওয়া। দরজা—জানলা কিচ্ছু ভেঙে ফেলবো না। কোনো গাছ উলটে দেব না—এমনি করে তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে দেবো কেবল—মা যেমন আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়—মা তো এমনি হাওয়া হয়ে এ—ঘরে থাকে।”

—”তুমি হাওয়া—বাতাস কিচ্ছু হবে না। সোনামণি, তোমাকে ইশকুলে যেতে হবে। পড়াশুনো করবে না?”

—”বাতাস বুঝি পড়তে পারে না? বাতাস সব পারে।”

—”মুখটা খোলো। একটু কিছু খাও। আইসক্রিম খাবে? বাটারস্কচ তো তুমি ভালোবাসো, দ্যাখো, আজ তোমার জন্যে রুণা বাটারস্কচ আইসক্রিম এনেছে।”

—”পরীদের যে খিদে পায় না, বাবা!”

—”অত পরী হয়ে আর কাজ নেই তোমার—একটু কিছু খেতেই হবে, মাটিতে থাকলে পরীদেরও খেতে হয়—লক্ষ্মীটি টুবলু, একটু পেটে কিছু পড়া দরকার, দুধটা চুমুক দিয়ে চট করে খেয়ে নাও।”

”পারছি না, বাবা। খেতে ইচ্ছে করছে না।”

—”আচ্ছা, মনে করো, আমরা অনেক দূর দেশ থেকে হাঁটতে, হাঁটতে, হাঁটতে, হাঁটতে আসছি—পথে কত জঙ্গল ছিল, কত পাহাড় ছিল, উঁচু উঁচু, তুমি সেই গভীর জঙ্গল পার হয়েছো, সেই উঁচু পাহাড় পার হয়েছো। তোমার খুউব তেষ্টা পেয়েছে, কোত্থাও জল নেই। খুউব খিদে পেয়েছে, কোত্থাও খাবার নেই—জনমানব নেই তো, কেউ নেই সেই পাহাড়ে জঙ্গলে, মানুষের বসতিই নেই—একটাও পুকুর নেই। ঘর নেই, একটাও বাড়ি নেই—হাঁ করো তো, দেখি এই আইসক্রিমটুকুনি—হ্যাঁ—তারপর অনেকদূরে কী যেন ঘুরছে, একটা গরু চরছে দেখা গেল। গরুটাকে খুব সুন্দর দেখতে, গায়ের রং সাদা, আর চকোলেট ছোপ ছোপ। তুমি কাছে আসতে, গরুটা তোমাকে বলল—টুবলুরানী, আমি জানি তুমি অনেক দূর থেকে হেঁটে হেঁটে আসছো, তাই তোমার খুব খিদে পেয়েছে, আর খুব চেষ্টাও পেয়েছে, তুমি দু’হাত পাতো, বাটির মতন করে, আমার বাঁটে গরম গরম চকোলেট দুধ আছে, আমি দিচ্ছি—খেয়ে নাও। খিদেও মিটবে। তেষ্টাও মিটবে—।

”তখন তুমি করলে কি, এমনি করে কোষ করে হাতদুটো জোড়া করে বাটি বানিয়ে গরুর পেটের তলায়, যেখানে দুধের বাঁট থাকে, সেখানে অঞ্জলি পেতে ধরলে, আর অমনি কল খুলে জল পড়বার মতন, চকোলেট—মিল্ক ঝরতে লাগলো। তুমি পেট ভরে সেই চকোলেট মিল্ক… এই যে, এবার চট করে এটুকুন খেয়ে ফ্যালো, এইটেই সেই গরু—মামণির চকোলেট দুধ—”

—”বাবা? সেই গরুটা কি আমার মা ছিল? মা তো পরী, পরীরা যেমন খুশি তেমন সাজতে পারে—না বাবা? গরুও সাজতে পারে?”

—”হ্যাঁ মা, গরুটা তোর মা ছিল। তোর ম্যাজিকওয়ালী পরী মা। নে, এবার মুখটা কুলকুচো করে, দাঁত মেজে ঘুমিয়ে পড়। দাঁড়া। জলটা আনি।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *