উড়াল – ১৩

তেরো – মালবিকার ডায়েরি

ট্রেনে যেতে যেতে পড়বো বলে তুলে নিয়েছিলাম কাগজ। পাশের সীট থেকে। কেউ পড়ে ফেলে রেখে গিয়েছে। বেওয়ারিশ কাগজ তুলে নেওয়াতে কোনও দোষ নেই। হামেশাই ঘটছে আন্ডারগ্রাউনডে। কে আর পড়া—কাগজ বয়ে বেড়াতে চায়? একটা সানডে সাপ্লিমেন্টের কয়েকটা পৃষ্ঠা। উলটে পালটে দেখছিলাম কী কী খবর আছে। হঠাৎ একটা বাচ্চার ছবি। সিঁড়ির ওপরে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। হাসিহাসি মুখ, মস্তবড় একখানা চশমার পিছনে ঝকঝকে দুটি চোখ। গালে হাত দিয়ে, মাথাটি একদিকে হেলিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে। যেন একটা গোপন রসিকতা করছে আমাদের সঙ্গে। একমাথা ঝাঁকড়া চুল এলোমেলো হয়ে কপালের ওপর, কান ঢেকে, মুখের চারিপাশে ঝামরে পড়েছে। যেন খুদে আইনস্টাইন বসে আছেন তাঁর ডেস্কে। বসে, প্রেস ফোটোগ্রাফারকে ‘পোজ’ দিয়েছেন। মুখে হাসি, সেই হাসির মায়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চোখ, কিন্তু চঞ্চলতা নেই সেই চোখে। বরং একটু চাপা ক্লান্তির রেশ। ছোটো পা দুটি মাটিতে রাখা, তাতে বড় বড় এক জোড়া গামবুট। কার পথ চেয়ে সিঁড়িতে বসে আছে ছেলেটা?

সঙ্গের হেডিংটা পড়লুম। ”ছোট্ট জনির শেষ ক’দিন।” বক্সের বিবরণ, লিউকিমিয়াতে অসুস্থ ছেলেটি একটি ডায়েরি রেখেছিল। তার শেষ ক’টি দিনের ভাবনা। ছেলেকে বিদায় দেবার পরে আট বছরের জনির শেষ ভাবনাগুলি তার মা—বাবা কাগজে ছাপিয়ে দিয়েছেন।

কচি মুখটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি ওই ছবিটার মধ্যে অন্য একটি কচি মুখ দেখতে পেলাম, যেটি আমার খুব চেনা, আদুরে মুখটার প্রায় আধখানা ঢেকে ফেলেছে মস্ত বড় গোল চশমা—এই ছবিটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট—আমি মনে মনে যে মুখটি দেখতে পাচ্ছি তার ফ্রেমটার রং গোলাপীর সঙ্গে সোনালি চিকিরমিকির, মুখখানি নীরক্ত বাদামী। কোঁকড় ঝাঁকড়া চুলগুলো আরেকটু বড় বড়, কাঁধে লুটোচ্ছে। পরনে গোলাপী ফ্রক—তাতে আপেল, কমলালেবুর ছাপ। ছোটো ছোটো পায়ে বুটের বদলে একজোড়া নরম কাপড়ের জুতো—শাদার মধ্যে হালকা নীল, সোনালি—রুপোলি বুটিদার… মুখের মধ্যে আশ্চর্য একটা মায়া মাখানো—যেন এই পৃথিবীর কেউ নয় সে….

টুবলুও ভারি সুন্দর সুন্দর কথা বলে। কিন্তু টুবলুর বেলায় আমরা তো কোনো ডায়েরি রাখছি না? টুবলুর কিছু কথা, কিছু স্বপ্ন অবশ্য এলোমেলো টুকে রাখি আমি কিন্তু সে তো এরকম সুষ্ঠু ডায়েরির মতো নয়। কেতকীর শেষদিকের কথাও কিছু কিছু লিখে রেখেছিলেন বিমলদা। কিছুই ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখা হয়নি, প্রকাশযোগ্য করে তো নয়ই। আমরা বাঙালিরা বড়ই অলস, আবেগপ্রবণ। ওরকম গুছিয়ে ভাবনার স্বভাব নয় আমাদের। রুণা ইদানীং টুবলুর কিছু কিছু ভিডিও তুলে রাখছে—কেতকীর বেলায় হয়নি। রুণা যে তখন ছোট্ট ছিল। ওর এই ভিডিও ক্যামেরাটি ষোলো বছরের জন্মদিনের উপহার। ও তো ফিল্ম মেকিং পড়ছে।

খবরের কাগজে পথের ধারে সিঁড়ির ওপরে প্রতীক্ষায় বসে থাকা বাচ্চার ছবিটা দেখে, ছেলেটার বসার ভঙ্গিটি দেখে মনে পড়ে গেল আরেকজনের কথা—আরেকটা ছোটো ছেলেকে। সেই ছেলে জানলার ধারে বসে বাইরে চেয়ে থাকতো সারাদিন। জীবনকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে চেয়ে। তার নাম অমল। অমল যে এমনভাবে আমার জীবনকে জুড়ে বসবে, কখনও ভেবেছিলাম? ‘ডাকঘর’ তো সবার মতোই আমিও পড়েছিলাম। কিন্তু সেই অমলের সঙ্গে আমার যে সত্যি সত্যিই দেখা হয়ে যাবে, তা কল্পনাও করিনি। ওই তো ছোট্ট জনি তার সিঁড়ির ওপরে বসে আছে ডাক—হরকরাদের প্রতীক্ষায়।

সেও জানে তার চিঠি আসছে।

টুবলুও জানে।

টুবলুও এমনিই বসে আছে, পথের ধারে, মনে মনে, চিঠির অপেক্ষায়।

.

এমনিভাবেই, অবিকল এমনিভাবে, বড় বড় চশমার পিছনে আরও দুটো চোখ ভেসে থাকে, এমনি আকুল বিশ্বাসে, প্রতীক্ষায়। টুবলুকে দেখতে দেখতে আমারও অমলের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমিই প্রথম নই। ডাঃ কোচেক প্রথম।

.

কার যেন একটা লেখায় একবার পড়েছিলাম, নামটা ঠিক মনে পড়ছে না, বোধহয় নবনীতা দেবসেনই হবে, ইস্রায়েলের একটা আশ্চর্য যাদুঘরের কথা। জেরুসালেমের কাছাকাছি একটা ছোটো পাহাড়ের মাথায় ইয়াদ ভাশেম (YAD VASHEM) নামে একটি স্মৃতি—সৌধ আছে। স্মৃতি—সৌধ না শোক—সৌধ। জর্মনির কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মৃত শত সহস্র নিরপরাধ ইহুদী নরনারী ও শিশুর জন্য এই স্মারকনিধিটি যেন দীর্ঘনিশ্বাস আর অশ্রু দিয়ে গড়া। সেই ইয়াদ ভাশেমেই রয়েছে অত্যাশ্চর্য একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি। একটি বয়স্ক মানুষের সঙ্গে একদঙ্গল বালকবালিকা একসঙ্গে, একলক্ষ্যে চেয়ে রয়েছে। ডক্টর কোচেক ও তাঁর অনাথ শিশুরা। ডক্টর কোচেক ছিলেন পোল্যান্ডের একজন ডাক্তার। নিজে ইহুদী না হলেও তিনি হিটলারের রাজত্বে সন্ত্রস্ত চল্লিশজন ইহুদী শিশুকে নিজের কাছে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাদের নাৎসীদের হাতে তুলে দেননি। যতদিন সাধ্য শিশুগুলিকে রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। যেদিন বাচ্চাদের ধরতে সৈন্যরা আসছে, তারা আগে থেকে ডক্টর কোচেককে খবর দিয়েছিল, যাতে তিনি সময়মতো পালিয়ে যেতে পারেন। তিনি তো ইহুদী নন। ডক্টর কোচেক অবশ্য পালাননি। আশ্রিত বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁর দায়িত্বে যে শিশুরা ছিল তিনিও আমৃত্যুই তাদের অভিভাবক, তাদের বন্ধু, তাদের মা—বাবা হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন।

কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থাকাকালীন ডক্টর কোচেক ওই বাচ্চাগুলিকে নিয়ে একটি আশ্চর্য নাটক অভিনয় করিয়েছিলেন। কোনো ভারতীয় কবির লেখা বড় অদ্ভুত এক নাটক। নিজেই ঐ নাটকটি ইংরিজি থেকে পোলিশে অনুবাদ করে নিয়েছিলেন তিনি—ছোট্ট অমলের কাহিনী। ছোট্ট অমলের কাছে রাজার চিঠি আসার কাহিনী।

তিনিও চেয়েছিলেন তাঁর শিশুদের প্রস্তুত করে নিতে, যা অবধারিত তারই জন্য। অমলের নাটক অভিনয় করতে করতেই বাচ্চারা বুঝে নিয়েছিল অমলের ঐ চিঠির জন্যে অপেক্ষা করার অর্থ কী। শিখেছিল কেমনভাবে প্রস্তুত থাকতে হয়। আরও জেনেছিল মৃত্যুই শেষ কথা নয়।

সুধা কিন্তু অমলকে ভোলে না।

আমি ইনটারনাল মেডিসিনের ডাক্তার। ‘টার্মিনালি ইল’ শিশুদের ওয়ার্ডে গেলেই ডক্টর কোচেকের ‘ডাকঘর’ অভিনয় করানোর কথাটা আমার মনে পড়ে যায়। হ্যাঁ, টুবলুর সঙ্গে যথাসাধ্য ‘স্বাভাবিক’ আচরণই করছি আমরা—যে ক’টা বছর ওকে কাছে পেয়েছি।

ওর মা জেনে যায়নি যে তার টুবলুর জন্যে একটা আলাদা জীবনসূচী তৈরি করে দিয়েছিলেন ঈশ্বর। ভাবখানা এই, যেন ছ’বছরের বাচ্চা মেয়েদের জীবন তো এইরকমই হবার কথা, এতে আশ্চর্যের কী আছে?

.

বিমলদা ভাবেন, টুবলু যে চলে যাবার জন্যে অমনভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে তার সবটা কৃতিত্ব আমার। কিন্তু আমি জানি সেটা ঠিক নয়। আমি যদি এই হাসপাতালের ডাক্তার না হতাম, আর টুবলু যদি আমার তত্ত্বাবধানে না—ও থাকতো, তবুও, আমার দৃঢ় বিশ্বাস—টুবলু নিজেকে নিজে—নিজেই ঠিক তৈরি করে নিতো। অবিকল এমনিভাবেই। যেভাবে ও তৈরি হয়েছে। ওর এই সহজ প্রস্তুতির মধ্যে ডাক্তারীবিদ্যের চেয়ে বেশি কারিকুরি বিমলদার, আর রূপকথার। টুবলুকে প্রস্তুত করেছেন তিনিই যিনি ওকে সৃষ্টি করেছেন। ঈশ্বরের করুণা ভিন্ন ওইভাবে একটি শিশু কি নির্ভয়ে মৃত্যুর দিকে করমর্দনের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে?

কি জানি, হয়তো শিশুরাই পারে। যাদের আত্মা অমলিন। যাদের বুকের মধ্যে এখনও অন্ধকারের চোরা বাতাস লাগেনি, আছে কেবল সরল বিশ্বাসের ম্যাজিক। সেই দৈব যাদুর কাছে মৃত্যু হার মানে। সারল্যের শক্তি যে কত প্রবল হতে পারে তা আমারও জানা ছিল না। এতদিন আমিও ভাবতাম ছোটরা বুঝি কোমল, ছোটরা বুঝি দুর্বল। কোমল? নিশ্চয়ই। কিন্তু দুর্বল? মোটেই না। এটা শিখলাম টুবলুর কাছে।

বিমলদাকেও তো দেখলাম। প্রিয়জনদের একটু একটু করে মৃত্যুর অতল গহ্বরে নেমে যেতে দেখছেন—অসীম ধৈর্যে, অসীম স্নেহে, অসীম ক্ষমায় স্ত্রীকে সেবা করে গেছেন। শেষ দিন, শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত পাশে ছিলেন, কেতকীর ক্ষীণ সরু হাতটি নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে। ছেড়ে দেননি।

.

বিমলদাকে দেখতাম কেতকীকে শুশ্রূষা করছেন, আপ্রাণ যত্ন করছেন আর আমি ভাবতাম আমার মায়ের কথা।

আমার রোগা মা বারান্দাতে তোলা উনুন নিয়ে ভাত বসাচ্ছেন—বৃষ্টিতে উঠোন ভেসে গেছে, গোয়াল ভাসছে, রান্নাঘর ভেসে গেছে—মা কাঁথা জড়িয়ে ধুম জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে ট্যাংরামাছের ঝাল বসাচ্ছেন বাবার জন্য। বাবা গ্রামের স্কুলের সামান্য মাস্টারমশাই—মেজাজখানা জমিদারি বলব, না মিলিটারি বলব? আমরা পর পর ছ’টি ভাইবোন। মাকে চিরকালই রুগণ দেখেছি, মাঝে মাঝেই জ্বর হতো মায়ের, উঠতে পারতেন না, আমরাই রান্নাবান্না করতাম, ভাইবোনদের কাঁথাকানি কেচে দিতাম—আমরা মেয়েরাই শুধু না—আমার দাদাও ভাত রাঁধতে, কুটনো কুটতে পারতো। কিন্তু আমরা বাবাকে ভাত বেড়ে দিলে বাবা খেতেন না।—থালাটা টান মেরে উঠোনে ফেলে দিয়েছেন, ভাত—তরকারি ছড়িয়ে পড়েছে, আমরাই থালাটা কুড়িয়ে এনে মেজে রেখেছি। যতই অসুস্থ হোন বাবার জন্য মাছটা অন্তত মাকে রান্না করতেই হবে—নইলে কুরুক্ষেত্র। এ দৃশ্য আমরা দেখেছি। মা কিছুই বলেননি কোনোদিন—ঘোমটা টেনে বাবার খিদমত খেটেছেন, আর জ্যাঠামশাইয়ের হুকুম তামিল করেছেন। জ্যাঠামশাই ছিলেন অবিবাহিত, আধাসন্ন্যাসী, কীসব তান্ত্রিক পুজো—আচার, জপতপ করতেন, জ্যাঠামশাইকে আমরা সকলেই ভয় পেতাম। আমাদের মিলিটারি বাবাও জ্যাঠামশাইয়ের মুখের ওপর কথা বলতেন না। মা জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে কথাই বলতেন না। ঘোমটা টেনে পুজোর যোগাড় করে দিতেন—খাবার বেড়ে দিয়ে আমাদের বলতেন জ্যাঠামশাইকে ডেকে দিতে।—ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতেন সর্বদা। সেই মা আর জ্যাঠামশাই এখন গ্রামের বাড়িতে—দুটি প্রাণী। বাবা মারা গেছেন, ছ’জনের মধ্যে আমরা পাঁচজন আছি—দাদা সত্তরের বলি। পাঁচজন পাঁচদিকে ছড়িয়ে পড়েছি—মা একা। এখন মা জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে কথা বলেন, ভাববাচ্যে বলেন। আমি বিদেশ আসার আগেই দেখে এসেছি।

বিমলদার কেতকীকে যত্ন করা যত দেখি, তত আমার বাবার কথা মনে পড়ে।

জ্বরে লালচোখে আমার রুগণ মা’র কাঁথা জড়িয়ে বাবার জন্য ট্যাংরামাছের ঝাল রান্নার দৃশ্য আমার চোখে কাঁকরের মতো জড়িয়ে যায়। উঠোনে ছড়িয়ে ফেলে দেবার মতো উদ্বৃত্ত অন্ন আমাদের ঘরে ছিল না—মাকেই না খেয়ে থাকতে হতো, বাবাকে নতুন করে ভাত দেবার পরে।

মা’র ওপরেই রাগ হতো। কেন? কেন সহ্য করেন বাবার অত্যাচার? জ্যাঠামশাই অত্যাচারী ছিলেন না, কিন্তু তিনি অবুঝ, অসংসারী মানুষ।

আমাদেরও সাহস ছিল না বাবার কাজের ওপর কথা বলবার। তাই একটু বড় হয়েই এক এক করে আমরা বাড়ি ছেড়েছি—বাবাকে ছেড়েছি। প্রথমে দাদা। তারপর মেজদা। যেই দাদা—মেজদা কলকাতায় চলে গেল, আমিও সুর ধরলাম। তারপর বাচ্চু, তারপর সাগরিকা, সুচরিতা—একে একে সকলেই চলে এলাম। আর ফিরিনি। সবাই নিজস্ব জীবন খুঁজে নিয়েছি। আর দাদাকে খুঁজে নিয়েছে মহাজীবন।

কেতকীকে বিমলদা হাতে করে খাইয়ে দিয়েছেন কতদিন। সম্পর্কটায় যেন পিতৃস্নেহের মায়া মাখানো। বয়েসে অনেক ছোট, কেতকীর প্রতি বিমলদার প্রেমের মধ্যে নিম্নগামী স্নেহের লক্ষণটাই ছিল বেশি। বারবার আমার মনে মায়ের সঙ্গে তুলনা ভেসে উঠত—মাও ছিলেন বাবার চেয়ে অনেক ছোট, বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী। দাদার মা দাদাকে রেখে মারা গিয়েছিলেন, সেই স্ত্রীরই সম্পর্কে ছোট বোন আমাদের মা। কিন্তু বাবার মধ্যে তো এই স্নেহের চিহ্ন দেখিনি,—ছোট বলে, দুর্বল বলে, বাবা শুধু দাপটই চালিয়ে গেছেন মায়ের ওপরে। মা’র বাপের বাড়ি ছিল না। পালাবার, লুকোবার ঠাঁই ছিল না মা’র।

.

বিমলদাকে না দেখলে আমার মনে জীবন বিষয়ে, মানুষের—সঙ্গে—মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে অনেক ভ্রান্তি থেকে যেত। বাবা, জ্যাঠামশাই, তারপরে আমার স্বামী, জাফর। জাফরের হাতে মার খেয়ে আমার চৈতন্য উদয় হয়েছিল—জাফরের সন্তানকে ফেলে রেখে চলে আসতে সাহস পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল বড় হলে সেও তো জাফরই হবে। বিমলদা আমাকে আশ্চর্য একটা ভালোবাসার পৃথিবীর, ত্যাগের পৃথিবীর ঠিকানা দিলেন যে ঠিকানার খবর আমার মা কোনোদিন পাননি। আমার আজকাল একটা কথা মাঝে মাঝে মনে হয়। মাকে আমার কাছে নিয়ে আসি না কেন? জ্যাঠামশাই? জ্যাঠামশাইকে তাঁর ঠাকুরদেবতারাই দেখাশুনো করতে পারবেন।

সন্ন্যাসী মানুষের অত সেবা লাগবে কেন? মাকে আমার কাছে নিয়ে এসে দুদিন বিশ্রাম দিই না কেন? একটু আদর করি না কেন? মা তো জীবনে কোনোদিন বিশ্রাম পাননি, আদর জানেননি।

.

বিমলদা এখন আগলে রয়েছেন টুবলুকে। একজন ব্যস্ত ডাক্তার যে এমনভাবে সব কাজ ফেলে একটি শিশুর পাশে আত্মনিবেদিত হয়ে থাকতে পারে, এটা যে—কোনো দেশেই অতি দুর্লভ দৃশ্য। অথচ শিশুটি সত্যি সত্যি সত্যি বিমলদারই সন্তান কিনা, তাও জানা নেই—বিমলদাই ডি.এন.এ. টেস্টে রাজী হননি। পাছে স্বপ্ন ভাঙে।

—”আমি এবার ঠিক পাখির মতন উড়ে যাব মালু, মেঘের মতন আকাশ দিয়ে ভেসে যাব, তোমরা ঠিক দেখো, আমি তো উড়তে জানি—” এটা টুবলুর মুখের ভাষা। এই পাখি—হয়ে উড়ে— যাওয়ার খেলাটি ছোট্টবেলা থেকে টুবলুর সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল। মুখ নিচু করে ঝাঁকড়া মাথাটি অনেকখানি সামনে ঝুঁকিয়ে, দুটি হাতকে পিছনদিকে পিঠের ওপর ডানার মতন উঁচিয়ে তুলে ধরে, মুখে কিচিরমিচির শব্দ করতে করতে ছোট্ট এত্তোটুকুনি শরীরটা ছুটে যাচ্ছে—”টুবলু! টুবলু! ওয়াচ আউট! টুবলু, মুখ তোলো, ধাক্কা লাগবে সোনা, থামো, সামনে টেবিল!” —আমরা চেঁচাচ্ছি। কিন্তু কে কার কথা শোনে! টুবলুর মুখ নিচু, কিচির মিচির বন্ধ করে খিল খিল হাসতে হাসতে ছুটে যাচ্ছে। দৌড়ে গিয়ে যদি জড়িয়ে না ধরতাম, বিরাট ধাক্কা খেত মেয়েটা সেদিন ডাইনিং টেবিলের পায়ার সঙ্গে। মানুষটা তো এত্তোটুকুন, কিন্তু তার জেদ কতখানি! মায়ের মতোই একগুঁয়ে মেয়ে। কোনদিন সত্যি সত্যি উড়ে পালাবে!

.

‘ছোট্ট জনির দিনলিপি’ আমি ভাঁজ করে ব্যাগে ভরে এনেছি। আবার পড়ব। লেখাটা হাসপাতালে রেখেছি। সেখানে আরও জনি রয়েছে। আরও অমল। এ দিনলিপি তাদেরও।

তবু চেষ্টা করে যেতে হয়। ডাক্তার হয়েছি যখন, তখন মৃত্যুর মোকাবিলা আমাকে করতেই হবে। আমার যুদ্ধ তো তারই সঙ্গে। কিন্তু বিজ্ঞানই শেষ হাতিয়ার নয়—বিজ্ঞান জবাব দিলে, বিশ্বাস শেষ হাতিয়ার। সেই হাতিয়ারের যোগান, হায়, ডাক্তারি শাস্ত্র দিতে পারে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *