উড়াল – ১২

বারো – বিমল

কেতকীকে কত কিছু বলবার ছিল আমার। এত অল্প সময় দিল মেয়েটা কিছুই বলা হলো না। এখন বলি। এই পাঁচ বছর ধরে আস্তে আস্তে করে ওর সঙ্গে কথা বলি আমি। টুবলু যখন ঘুমিয়ে পড়ে ওর মুখের আদলের মধ্যে আমি কেতকীকে দেখতে পাই। সেই ছোট্ট কেতকী। যাকে ফেলে ওর মা চলে গিয়েছিলেন পরলোকযাত্রায়। চোখের কোণে জল নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে থাকে টুবলু। তখন ওকে বড্ড কেতকীর মতো লাগে। আমার খুব ইচ্ছে করে ওকে জাগিয়ে জিগ্যেস করি, কেন? কেন রে? চোখে জল কেন তোর? কেতকীকে কেউ জিগ্যেস করেনি।

বিছানায় প্রায় মিলিয়ে গিয়ে শেষদিকে কেতকী আমাকে বেশি করে জড়িয়েছিল, আঁকড়ে ধরেছিল। অদ্ভুত সব কথা বলতো আমাকে। তার কিছু কিছু আমি পরে আমার ডায়েরিতে লিখে রেখেছি।

টুবলুর জন্যে? নাঃ, আমার নিজের জন্যেই। যাতে ভুলে না যাই।

বাংলাতে কেতকী ভলো করে নিজেকে প্রকাশ করতে পারতো না। ইংরিজিতেই বলতো আদ্ধেক কথা। আমি চেষ্টা করেছি বাংলায় ধরে রাখতে ওর কথাগুলো। টুকরো টুকরো কথা। আমি গোছাতে চেষ্টা করিনি। টুকরো টুকরোই লিখে রেখেছি। যেমন যেমন বলেছে। অনেক সময়ে ওর কথাগুলোই আমারও কথা হয়ে গিয়েছে। ওর কথায় আমার কথা মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। যেমন এই সাহস আর ধৈর্যের ব্যাপারে ওর কথাগুলোই আমারও।

.

কেতকীর কথা

—”সাহস জিনিসটা এমনই যে পরীক্ষার সময়ে ছাড়া তার সঙ্গে দেখা হয় না। ধৈর্য জিনিসটার মতোই। বিপাকে পড়লে মানুষ কেমন করে সাহসী হয়ে ওঠে এমনকি ভীতু মানুষও, আমিই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

আমি খুব ভীতু।

আমি হারানোকে ভয় পাই।

পেয়ে—হারানোর মতো এত ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? আমি বারবার পেয়েও হারিয়েছি। মানুষের ভালোবাসার মৃত্যুকে ভয় পাই আমি। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুকেও।

আমাকে তুমি ‘ব্রেভ’ বলো, বলো ‘কারেজাস’। ভুল। সব ভুল। আমি ভীতু।

.

না। মৃত্যুভয় আমার নেই।

ছিল না কোনোদিন। নিজের মৃত্যুকে নিয়ে ভয় করবো কেন? ওটা তো হবেই—আর ওটার শোক তো আমাকে বইতে হবে না? না, মৃত্যুভয় নেই আমার—অলওয়েজ রেডি টু গো। কিন্তু ‘কারেজাস’ নই। ভয়ে আমার বুক ধুকপুক সর্বক্ষণ। মনে হয়, এই বুঝি হারিয়ে ফেলবো। মনে হয়, এই মুহূর্তও বুঝি সত্য নয়, স্বপ্ন। জানি তো স্থায়ী হবে না কোনো মুহূর্তই—তবু মুছে—যেতে—থাকা মুহূর্তগুলোকে গেঁতে গেঁথেই তো জীবন।

.

জীবনকে স্বপ্ন বলে মনে করলেই আর মৃত্যুভয় থাকে না।

মৃত্যু কেন, কোনো ভয়ই থাকে না।

স্বপ্ন তো ভাঙবেই একদিন। তাতে ভয়ের কি আছে? দুঃস্বপ্নও তো ভেঙে যায়—স্থায়ী হয় না। তবে আর ভয় কীসের? ভয়ের আর সুযোগ থাকছে কোথায়? কিন্তু তবুও ভয় করে।—

কোথায় যেন পড়েছিলাম, ‘‘every individual life is a dream’’—এই কথাটা আমি খুব ভাবি। প্রতিটি ব্যক্তিজীবন যদি স্বপ্ন হয়। তবে আমাদের ‘স্বকীয়তা’, ‘আমিত্ব’, এসব নিয়ে আর ভাবতে হয় না—’সেলফ’ কথাটা কোনো অর্থই বহন করে না তাহলে।

আঃ। কী আরাম!

‘আকাশভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ—’ তারই একটা কণা হয়ে গেলাম। এর চেয়ে আরামের আর কী আছে?”…

.

‘আকাশভরা সূর্য তারা’—এ গানটা গলা ছেড়ে বড়ো ভালো গাইতো কেতকী। নিজেকে বিশ্বভরা প্রাণের একটি কণিকা ভেবে নিতে ওর ভালো লাগতো। আমি ভাবি অন্য কথা। জীবন শুরুই করেছে ”নেতি” দিয়ে মেয়েটা। আমাদের উপনিষদে বলেছে ‘নয়’ ‘নয়’ ‘নয়’ করে ‘হয়’—তে পৌঁছুতে হবে। নেতি, নেতি, নেতি করে ইতি—তে। অথচ জীবনটা ‘নেতি’ দিয়ে শুরু করা কি বিপজ্জনক নয়? আগেই আমি কী কী নই, সেই জায়গাগুলোয় খুঁজতে খুঁজতে, ভেঙে ভেঙে টুকরো হতে হবে, তবে আমি কী হই, সেখানে এসে দাঁড়ানো। আমি এটা নই, আমি ওটা নই, আমি সেটাও নই—তবে আমি কে হই?”….

সুকুমার রায় সত্যিই মস্ত দার্শনিক ছিলেন। কত সহজে কত কঠিন কথা বলে গিয়েছেন। ইদানীং কেতকী কেবলই এসব ভাবছে।

কেতকীকে বলছিলাম, ”আত্মানং বিদ্ধি,” ‘‘know thyself,’’ এসব লম্বাচওড়া তত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না এখন, রোগশয্যায় অন্য অন্য কথা ভাবাই মঙ্গল। হালকা কথা।

ও বলল, ”না। এখনই ঠিক সময়। আমি কে? আমার রাগ, আমার অভিমান, আমার ব্যর্থতা, আমার যন্ত্রণা, আমার ভুল, আমার ভালোবাসা, আমার গান, আমার ভয়, আমার শূন্যতা, আমার আকাঙ্ক্ষা, আমার ঈর্ষা, আমার মাথার ওপর অনন্ত স্বপ্নের আকাশ, আর পায়ের তলায় তলহীন গহ্বর—এই সবকিছু নিয়েই তো আমি? সবগুলোই আমি। তাই না?…

কিন্তু, সত্যিই কি তাই?

সত্যিই কি এতটা নিরাশ্রয়, এত সময়তাড়িত, এত অনিশ্চয়, জর্জর অস্তিত্ব আমাদের? তাহলে তো মনুষ্যসভ্যতা টিকতই না। ডাইনোসরের মতনই পাথরের গায়ে মানুষের পায়ের ছাপ থাকত, আর রাজত্ব করত আরশোলার দল।

ওদের মাথাটা কেটে নিলেও নাকি আরশোলারা ন’দিন বেঁচে থাকতে পারে। আণবিক বিস্ফোরণেও ওদের কিছু হয় না। আরশোলাকে জগতের টাফেস্ট প্রাণী বলা হয়।

কিন্তু মানুষ?—আমি তো দেখলাম মানুষের মাথাটা কেটে বাদ দেবার পরেও, সে হেসে খেলে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। আপিস যায়, বিয়ে করে, সিনেমা দেখে, রান্না করে, ছেলেপুলে বানায়, শিল্পচর্চা করে, যুদ্ধবিগ্রহ করে, গান করে—দে মেক লাভ, দে মেক আর্ট, দে মেক বেবিজ, দে মেক ওঅর, দে মেক মিউজিক—অ্যান্ড অল দিস ইন আ হেডলেস স্টেট!

মাথাটা বাদ দিলেও বাঁচে মানুষ, হৃৎপিণ্ডটা বাদ দিলেও বাঁচে। আমাদের বেঁচে থাকতে যদি বুদ্ধিও না লাগে, আবেগও না লাগে, দুটোকে বিসর্জন দিয়েও আমরা যদি বেঁচে থাকতে পারি দিব্যি, তবে বেচারি আরশোলাতে টাফেস্ট প্রাণী বলছে কেন বিজ্ঞানীরা? কী অন্যায়!”…

আমি তর্ক করি।

—”কেন এত নেগেটিভ চিন্তা করছ কেয়াফুল? এত সিনিসিজম ভালো নয়। তোমার নিজের দিকেই তাকিয়ে দ্যাখো, এই কঠোর স্টেটমেন্টের বিপরীতটাই দেখবে। এই তো মালবিকাকেই দ্যাখো না? তুমি যেসব মানুষের কথা বলছো, সেই বিকট মানুষেরা শুধু রাজনীতি ক্ষেত্রেই আছে—হাটে—বাজারে আমরা যারা ঘুরে বেড়াই, আমাদের হৃৎপিণ্ডটুকু অন্তত আছে, মগজ থাক না থাক।”…

—”আমি তো ছোটবেলা থেকেই খুব ভীতু? কিন্তু আবিষ্কার করেছি, জীবনের কতগুলো মুহূর্তে আপনা—আপনি বুকের মধ্যে একটা অনন্ত খনি আবিষ্কৃত হয়। সাহসের খনি। চোখকান বুজে নেমে যাও, দু’হাত ভরে তুলে আনো সাহস—বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় মনোবল।

”এখন আমি টের পেয়েছি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মধ্যে লুকিয়ে বয়ে যাচ্ছে আরেকটা গভীর সাহসের নদী। সম্পর্ক গড়তে হয়, গড়ার চেষ্টা করতে হয়। বিশ্বাস, এবং আরও বিশ্বাস দিয়ে। ভালোবাসা এবং আরও ভালোবাসা দিয়ে। সেই চেষ্টার যোগফলই সাহস যোগাবে—বেঁচে থাকবার সাহস। শুধু টিঁকে থাকা নয়, হেসে খেলে গান গেয়ে বেঁচে থাকা। নট জাস্ট সারভাইভিং বাট লিভিং লাইফ ফুললি! এটা আমি শিখেছি তোমার কাছে এসে। বাঁচা কাকে বলে। ভালোবেসে বাঁচা—আগে শুধুই জীবিত ছিলাম।….

”একা থাকলে, একাকী বাঁচলে, পরিপূর্ণ বেঁচে ওঠা যায় না। শুধু জীবিত থাকা যায়। একটা ম্যাজিক—লাঠি আছে, যেটার এক মুড়োয় ‘বিশ্বাস’, আরেক মুড়োয় ‘ভালোবাসা’। ব্যস ওইটে হাতে থাকলে তোমার বুকের সাহস কোনোদিন ফুরোবে না। ‘ভয়’ তোমার ছায়া মাড়াতে ভয় পাবে। আমি খুব ভয় পেতাম—জানো, একটুও সাহসী ছিলাম না আমি—’বেপরোয়া’ মানেই কিন্তু সাহসী নয়। বরং উলটোটা!”…

.

কেতকীর কাছে শিখলাম বেপরোয়া মানুষ অনেক সময়েই ভীতু মানুষের বহিরঙ্গ।

প্রায়ই কেতকী বলত, ”আমার এখন অন্য ভয়—দারুণ ভয়—এত সুন্দর পরিপূর্ণ জীবনটাকে পেয়ে হারানোর ভয়। জীবনে সুখ এলো মাত্র দুদিনের অতিথি হয়ে। আসলে তো অসুখই আমার ঘরের লোক। যে—বিচ্ছেদকে আমার এত ভয়, জান সেই বিচ্ছেদেরই জয় হবে।

”টুবলু আমার মধ্যে বাঁচার লোভ উদগ্র করে তুলেছে—যতক্ষণ পারি ওকে জড়িয়ে রাখি, আগলে রাখি—আমি তো জানি আমি শেষ পর্যন্ত পারবো না—আমি তো জানি ওকে ফেলে রেখে আমাকে চলে যেতেই হবে। উপায় নেই। দরজা খুলে গেছে।”….

.

একদিন খুব রাগ করে কেতকী বলল—”আচ্ছা, চিরদিন, চিরন্তন, শাশ্বত, চিরকাল—এসব শব্দগুলো মানুষ কীজন্যে বানিয়েছিল বলো তো? তখনই তো জানতো এসব হয় না। প্রত্যেকটা শব্দই মিথ্যে।”

তারপর নিজেই উত্তর দিল—”আসলে কি জানো, ওই শব্দগুলোর শরীর স্বপ্ন দিয়ে গড়া। দূরাকাঙ্ক্ষা দিয়ে গড়া। স্বপ্ন আর দূরাকাঙ্ক্ষা এই তো চিরন্তন। যা নেই, যা নয়, তাই কেবল শাশ্বত। চিরন্তন।”

আমি আপত্তি করলাম, ”কেন, প্রেম? প্রেম বুঝি চিরন্তন নয়। স্নেহমমতা? এই যে টুবলুর প্রতি তোমার স্নেহ? এটা তো চিরন্তন।”

”এই যে তোমার প্রতি আমার প্রেম”—বলতে চেয়ে আমার বুক কেঁপেছিল—মুখে উচ্চারণ করতে পারিনি যে কথা, বুকের মধ্যে আছড়ে পড়েছিল—কেতকী সেটা বুঝতে পেরেই উত্তরে বলল—

—”হ্যাঁ ভালোবাসাকে চিরন্তন বলা হয়তো যায়। প্রেম, স্নেহ সবই তো ‘‘love’’, সবই তো ভালোবাসা। আমি চলে যাবার পরেও আমার ভালোবাসা তোমাদের ঘিরে থাকবে। তোমাকে, টুবলুকে। স্নেহ একরকমের ভালোবাসা, প্রেম আর একরকমের ভালোবাসা। কোনোটাই কি নিজে নিজে চিরন্তন হয়? সবই ব্যক্তি—নির্ভর। জানো বিম, আমি ছোটবেলা থেকেই বুঝতে চেষ্টা করতাম প্রেমটা কী বস্তু। সিনেমায় দেখি, বইতে পড়ি। রাস্তাঘাটে, বিজ্ঞাপনে, টিভিতে সর্বত্র প্রেম। এত প্রেম পৃথিবীতে, অথচ সংসারে তো দেখি না? জীবনে তো দেখি না? বাবা আর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর মধ্যে যেটা হয়েছিল, সেটাই কি প্রেম? তাহলে বাবা আর মায়ের মধ্যে কী ছিল, যার অভাবে মা আত্মহত্যা করল? নাকি নারী—পুরুষের মূল খেলাটাই প্রেম? ওটা তো আমি ছেলেবেলা থেকেই শিখে গেছি। মাস্টারের অভাব ছিল না। ওটার জন্যে এত?

যাঃ।

বড় হয়ে যখন ‘ভার্জিন’, ‘ভার্জিনিটি’ এসব ভারী ভারী ওজনদার শব্দগুলো শুনছি, পড়ছি, মানে বুঝতে চেষ্টা করছি, কিছুই বুঝতে পারছি না, ভার্জিনিটি বস্তুটি কী কেমন তা টের পাবার আগেই তো সেটা হারিয়ে বসে আছি। এক মা—মেরীর প্রসঙ্গ ছাড়া ‘ভার্জিন’ শব্দের মধ্যে অন্য কোনও অনুষঙ্গ কখনও মনেই আসেনি।

বাংলায় ‘কুমারী’ শব্দ আমরা শিখিনি। ছোটমাসি শিখিয়েছিল ‘কুমারী কেতকী মিত্র’ লিখতে। তার মানে আমি ‘Miss’, আমার বিয়ে হয়নি। বিয়ে হলে ‘Mrs’, শানাই, টোপর, আলো, বেনারসী, লোকজন, বিয়ের সঙ্গে তো নেমন্তন্নের যোগ, ভার্জিনিটির কী যোগ?

ভার্জিনিটির সঙ্গে আমার বেঁচে থাকার কী যোগ? ও তো যীশু আর মেরীর ব্যাপার। মিরাক্লের ব্যাপার। বিয়ের সঙ্গে ভার্জিনিটির যোগটা আমায় কেউ বুঝিয়ে দেয়নি, যেমন বেঁচে থাকার সঙ্গে মরে যাবার যে একটা যোগ আছে, সেটাও না। মা’র মরে যাওয়ার বিপরীতটা যে মা’র বেঁচে থাকা—এই দুটোর মধ্যে যে একটা গ্রন্থি আছে, একটা সত্য, যাকে ধরা যায় না, ছোঁওয়া যায় না, অদৃশ্য একটা সুতোর পাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা রয়েছে আমাদের বেঁচে থাকা আর মরে—যাওয়া, যেমন রাত্রিবেলার সঙ্গে বাঁধা থাকে সকালবেলা।”…

.

কেতকী মাঝে মাঝে কবিতার মতো ইংরিজি বলে। মাঝে মাঝে নিজেই গান বানিয়ে গাইতো তো? ও একটা গান গাইতো, টাইগার হিলে সূর্য ওঠার গান। এত সুন্দর সুর। এত সুন্দর কথা—”কে লিখেছে, বাংলায় টাইগার হিল নিয়ে এত সুন্দর গান?” কেতকী হেসে বলল—”একজন বাঙালিই,—অবভিয়াসলি!” ওর নিজের লেখা, নিজের সুর দেওয়া গান! বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেতকী যেসব কথাগুলো বলে, মাঝে মাঝে মনে হয় গানের মতো, কবিতার মতো। আমি ঠিকঠাক লিখতে পারছি না, আমার সে ক্ষমতা নেই।

.

—”…এই যে আমি এখনও বেঁচে রয়েছি, এই যে আমি আর কিছুকাল পরেই আর বেঁচে থাকবো না, দুটোর মধ্যে একটা যোগ তো রয়েছে। এবং থেকেও যাবে। ছিন্ন হবে না। একটা জায়গায় এই দুটো একসঙ্গে গেরো পাকিয়ে যাবে—টুবলুর জীবনে। তার বেঁচে থাকার সঙ্গে, তার মায়ের বেঁচে থাকার সঙ্গে তার মায়ের বেঁচে না—থাকা। এই দুটো বিপরীত অবস্থার মধ্যে গেরো—পাকানো, জট—পাকানো, ওলট—পালট জীবন কাটবে টুবলুসোনার—যদি না তুমি জটটা খুলে দাও, বিম? আমার তো উপায় নেই, যে জটটা ছাড়িয়ে দিয়ে যাই, গেরোটা খুলে দিয়ে যাই—সময় কোথায়? টুবলু যে এখনও বড্ড ছোট্ট! কিন্তু তুমি আছো।

তুমি ওর সব জট—পাকানো, গেরো—পাকানো ভাবনাগুলোকে সোজা—সরল করে দিয়ো। ওর জীবনের পথটা যেন সবটাই আলোয় আলো হয়ে থাকে—আমার মতন আলো—আঁধারির মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে চলতে হয় না যেন ওকে।

অথচ আমার মা তো নিজে নিজেই, ইচ্ছে করেই গেরোটা বাধিয়েছিল, ইচ্ছে করেই এতবড় জট পাকিয়ে দিয়েছিল আমার জীবনে। মা জানত, বাবা অন্য লোকের হয়ে গেছে, বাবা আমাকেও দেখবে না। মা তবুও আমার কথা ভাবেনি, শুধুই নিজের কথা ভেবেছিল।

আমি অন্তত সেটা করিনি। আমার অসুখ করেছে। যে—অসুখের ওষুধ বের হয়নি এখনও। আমি তো ইচ্ছে করে তোকে একলাটি ফেলে যাচ্ছি না রে টুবলুসোনা, আমার যে উপায় নেই। আমি তো বিমকেও ফেলে যাচ্ছি! আমার কি যেতে ইচ্ছে করছে? তোর বিম রইলো, বাবা রইলো তোর।

সত্যিকারের বাবা। আমার মতো মিছিমিছির বাবা নয়। একলাটি ফেলে যাচ্ছি না আমি তোকে। তোর বাবার কোলে রেখে যাচ্ছি। অনে—ক অনে—ক বড়ো হবি তুই। আমার আর সেটা দেখা হবে না। আমার উপায় নেই।”…

.

কেতকী পাগলীর কথাবার্তা বোঝা সোজা নয়। ওর সব কথা ঠিকঠাক বুঝতে হলে ওকে আপাদমস্তক বুঝতে হবে। টুবলুর কাছে আমার পরিচয় দিচ্ছে ”তোর সত্যিকারের বাবা”, ওদিকে নিজের জন্মদাতা পিতাকে বলছে, ”আমার মিছিমিছির বাবা।” অথচ এই নিয়েই কেতকী কী গোলমালটা করেছিল ঠিক বিয়ের মুখে মুখে। আমি প্রোপোজ করেছি। বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সবাইকে বলা হয়েছে, ডেট ফিক্সড, কেতকী নতুন করে ফ্যাকড়া তুললো।

—”শুধু শুধু কেন আমাকে বিয়ে করতে যাবে? সবই তো আন্দাজ। হতেই পারে দ্যাট ওয়াজ দ্য নাইট—আবার নাও তো হতে পারে? অনেস্টলি আই ডোন্ট নো হু দ্য ফাদার ইজ, দেয়ার কুড বি টু অর থ্রি পসিবিলিটিজ—আই ডোন্ট রিয়্যালি কেয়ার। আই নো হু দ্য মাদার ইজ অ্যান্ড দ্যাটস অল দ্যাট ম্যাটারস টু মি। প্লীজ বিম, বিয়েটা বাদ দাও। নো নীড। নট অ্যাট অল।”

—”ইয়েস দেয়ার ইজ নীড। বাচ্চা যারই হোক, দ্য বেবি নীডস আ ফাদার। আমারও তো হতেই পারে? তাহলে? বিয়েটা হওয়া খুব দরকার। দ্য বেবি শুড হ্যাভ আ ডিসেন্ট লাইফ। কাইন্ডলি কোঅপারেট।” ঘাসের লনে, ফুলের গাছে স্প্রিংকলার চলছিল। সেই ফোয়ারার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ভিজতে ভিজতে কেতকী বলেছিল :

—”বাট হোয়াট ডু ইউ গেন ফ্রম ইট? আমার মতো এত ওয়াইলড বউ কেউই চায় না, তার ওপর কার—না—কার বাচ্চা—সমেত। ইউ মাস্ট বি ক্রেজি, বিম।”

—”ও ইয়েস, ক্রেজি ওভার ইউ, কেয়াফুল, এখনও বুঝলে না? বাট টেল মি। হোয়াট ডু ইউ লুজ? তোমার ক্ষতিটা কী হচ্ছে, বিয়ে করলে? আমি কি অযোগ্য স্বামী? এত করে বাধা দিচ্ছ কেন? অনেকদিন তো ফ্রিডম উপভোগ করলে। কোলে বাচ্চা এলে অত ফ্রিডম আর থাকে না। এবারে সংসার করোই না? বুঝতে পারছি, আমাকে তোমার পছন্দ হচ্ছে না বুড়ো বলে, তাই এত ফ্যাকড়া তুলছ।”

—” ‘ফ্যাকড়া’? হোয়াট ইজ ফ্যাকড়া? আই ডোন্ট নো দ্য ওয়ার্ড। বাট ইউ হ্যাভ গট মি রং। তোমাকে পছন্দ হচ্ছে না নয়, ইউ আর টু গুড ফর মি—আয়্যাম নট দ্য রাইট উওম্যান ফর ইউ—ইউ ডিজার্ভ মাচ বেটার—আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু এক্সপ্লয়েট ইওর গুডনেস—টু বি অ্যাবসলুটলি ফ্র্যাঙ্ক—আমার মনে হচ্ছে তোমাকে ঠকানো হচ্ছে, আমি একটা খারাপ মেয়ে—আই অ্যাম নো ম্যাচ ফর ইউ, বিম।” অনেক কষ্টে তাকে ভুলিয়ে—ভালিয়ে রাজী করাতে হলো নতুন করে। অবশেষে সময় মতোই আমাদের সইসাবুদ হয়ে গেল। বিধিমতো বিবাহিত দম্পতির কোলেই এসেছে টুবলু। টুবলু এলো একমাথা কালো সিল্কের মতো চুল, বাদামী চামড়া, কালো কালো চোখের তারা নিয়ে, মায়ের মতোই রূপসী। নরডিক ব্লনড হানসের কোনো চিহ্ন তার কোথাও নেই—হানসের থিওরি বাদ চলে গেল। মেয়ে আমারই। আমার মতোই দেখতে, আমার অন্তত তাই মনে হলো। আমার বাঙালি মেয়ের শ্যামলী মুখখানি দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে কেতকীকে বলেছিলাম—”কি গো? নিশ্চিত হয়েছো তো এবারে? তোমার ছানার বাবাটি কে? হানসের কোনো গল্প নেই আর এর মধ্যে—”

উত্তরে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কেতকী বলল—”কেমন করে বুঝলে, যে তুমিই ওর বাবা? উইদাউট আ ডি.এন.এ. টেস্ট? হানস নাইবা হলো, কার্লোস তো হতে পারে? উই হ্যাড সেক্স টু নাইটস বিফোর দ্য থার্টি ফার্স্ট, আই টোলড ইউ?”—কার্লোস এক মেক্সিকান রেস্তরাঁর মালিক, খুবই সুদর্শন পুরুষ, অনেকটাই ভারতীয় চেহারা, কালো চুল, কালো চোখ, বাদামী চামড়া—নাচে চমৎকার। আমার অবাক লাগছিল। কেতকীর এই জবরদস্তি নিজেকে বহুচারিণী প্রমাণ করে, বাচ্চার বাবা যে আমি নাও হতে পারি, এমন একটা সংশয় আমার মধ্যে সঞ্চারিত করে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা কেন, আমি বুঝতে পারছিলাম না। বিয়ে যখন হয়েই গেছে, উলটোটা করাই তো এখন স্বাভাবিক হতো, সামাজিক হতো। তখন তর্ক তুলিনি, নিজেই মনে মনে সমাধান খুঁজতে চেষ্টা করেছি। উত্তর মেলেনি। শুধু কেতকীর রহস্যপ্রিয়তা তাকেই আরও রহস্যময়ী করেছে।

তার অনেক মাস পরে যখন কেতকী অসুস্থ, রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে নানা ধরনের দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনার চেষ্টা করে, আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—

—”কেতকী, তুমি কিছুতেই টুবলুকে আমার মেয়ে বলে মেনে নিতে দিচ্ছিলে না কেন?”

—”জাস্ট টেস্টিং ইউ।” একগাল হাসি। তারপরেই গম্ভীর। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে কেতকী যা বললো তাতে আমি নিরুত্তর হয়ে গেলাম।

—”তুমি যদি ওকে ভালোবাসো, তবে বাবা না হলেও বাসবে। আমি সেটাই চেয়েছিলাম। বাবার দায়িত্ব পালন করানোতে আমার ইন্টারেস্ট ছিল না, যেটা টাকা পাঠিয়েই সেরে দিতে পারা যায়। এখন টুবলু তোমার জীবনের অংশ, শি ইজ পার্ট অফ ইওর লাইফ—তার জন্য কোনো বায়োলজিক্যাল রীজনস লাগুক, এটা আমি চাইনি। তুমি ওর বাবা হয়েছো আউট অফ চয়েস—ঠিক এটা আমি চেয়েছিলাম। নট বাবা আউট অফ নেসেসিটি। আমি চেয়েছিলাম তুমি সেধে, ভালোবেসে ওকে তোমার সমস্ত সন্তানস্নেহ দাও। বাধ্য হয়ে নয়—দায়ে পড়ে নয়। এই যে মনের ভিতর থেকে মা—বাবা হওয়া, এটাই তো আসল। আমার ছোটমাসির মতো।”

টুবলুকে যে ফেলে রেখে ওকে যেতেই হচ্ছে—এজন্য কেতকী একবার বলে—”আমার দোষ নেই। আমার উপায় নেই”—আরেকবার বলে—”সব দোষ আমার, আমি কেন টুবলুর কথা ভাবিনি?”

নিজেকে নির্দোষ বলতে তার বিবেকে বাধে। আমি যদি ওকে বলতে চেষ্টা করি—”তোমার কোনো দোষ নেই, এটা তো অসুখ, এবং অ্যাক্সিডেন্ট—” তবে কেতকীই উলটে বলবে—”কিন্তু আমার কি সত্যিই কোনো দায়িত্ব ছিল না? আমি তো শিক্ষিত মেয়ে। ম্যালেরিয়া হলে ডাক্তার বলে, ‘মশারি টাঙাও?’ টাইফয়েড হলে বলে, ‘জল ফোটাও?’ ‘কেন জল ফোটাওনি?” ‘কেন মশারি টাঙাওনি?’ আর আমি? আমার বেলায় তোমরা কেউ কিছুই বললে না।

”ডাক্তারও বলল না কিছু। তুমিও না। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল? তাই বলনি? টুবলু বলবে হয় তো? বড় হয়ে টুবলু আমাকে বলবে—’মা তুমি আমার কথা ভাবলে না কেন?’

”আমি তো সত্যিই টুবলুর কথা ভাবিনি। আমি তো ভাবতেই পারিনি টুবলুর কথা। আমি কি নিজের কথাই ভেবেছিলাম? কেবল চেষ্টা করেছি কিছুই না ভেবে শুধু ‘জীবন’ যাপন করে যেতে। ‘জীবন’ নাম নিয়ে যেটাই সামনে এসে পড়েছে তাকেই জড়িয়ে ধরেছি, গান এলে গানকে, নেশা এলে নেশাকে, শরীরে এলে শরীরকে। এই তো, এটুকুই তো জীবন। বন্ধু খুঁজে খুঁজেই দিন গেছে আমার। শেষ মুহূর্তে মালুকে পেলাম। আর তুমি? তুমি কি শুধু বন্ধু?”

.

”স্কুলেও তেমন কোনো বন্ধু ছিল না আমার। ছিল না কলেজেও। বন্ধুত্ব করতে ভয় করতো—শৈশবে ড্রাইভারদাদুর ‘বন্ধুত্ব’ আমার সব বন্ধুত্বের মূল উচ্ছেদ করে দিয়েছিল। মা নেই, বাবা অফিসে। বাবার স্ত্রী নিজের ঘরে। আমি সারা দুপুর সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে। এর কোলে, তার কোলে। ড্রাইভারদাদুই বেশি আদর করতো, ‘দোস্ত’ বলে ডাকতো, কোলে বসিয়ে আমার সঙ্গে একটা খেলা খেলতো ‘দোস্তি’—র খেলা। আমি জানতাম সে—খেলাটা লোকজনের সামনে খেলতে হয় না। কেবল দুজনে আড়ালে, গোপনে, লুকিয়ে লুকিয়ে। শরীরী সুখের সঙ্গে তাতে অপরাধবোধ, লজ্জা ভয় মিশে ছিল। এসব কথাই মালুকে বলেছি আমি। তুমি কিছুই জানো না। আমি সত্যি সত্যি খুব খারাপ মেয়ে—ছোট থেকেই খারাপ। ড্রাইভারদাদুর সঙ্গে ওই খারাপ খেলাটার কথা আমি কাউকেই জানাইনি। একদিন বাবার অন্য বাচ্চাদের আয়া দেখতে পেয়ে গেল। বাবার স্ত্রী খেপে উঠে বাবাকে বললেন, সবই আমার দোষ, আমি খুব পাজী মেয়ে। তাঁর বাচ্চাদের নষ্ট করে দেব। বাবা তাঁর সব কথাই বিশ্বাস করতেন। আমাকে প্রচণ্ড শাস্তি দেওয়া হলো। ড্রাইভারদাদুকে কিন্তু ছাড়ানো হলো না। অনেকদিনের পুরোনো ‘বিশ্বস্ত’ কর্মচারী তো? আমাকেই পাঠিয়ে দেওয়া হলো বোর্ডিং স্কুলে। আমার বয়েস ততদিনে আট পূর্ণ হয়েছে। বাড়িতে কোথায় যে থাকি, কী করি, সারাদিন কেউ খোঁজই রাখতো না। এখন তো সেসবের আর প্রশ্নই রইল না। বোর্ডিং স্কুল থেকে ছুটিতে এসেছি। ড্রাইভারদাদু আবার আমাকে ধরলো। এবারে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে সবাই জেনে গেছে,—নতুন বাবুর্চিও খেলায় যোগ দিলো। আমার বয়েস একটু বেড়েছে। খেলার ধরনটাও দেখলাম পালটাচ্ছে, বাবুর্চির বয়েস দাদুর চেয়ে অনেক কম, তার সঙ্গেই খেলাটা বেশি ভালো লাগছে—আমার বাবার কাছে আবার খবর গেল। বাবা এবার হান্টার দিয়ে মারলেন। এবং মাসির বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন, কলকাতায়। সেটাই হলো আমার পক্ষে আশীর্বাদ। আমি ছোটমাসির বাড়িতে গিয়ে গান ভালোলাগা চিনলাম—মাসি চমৎকার গান গাইত। মাসির কাছেই বাংলা গান শিখেছি। বাবাকে বলে মাসিই স্কুলেও মিউজিক লেসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। স্কুলে ওয়েস্টার্ন মিউজিক, মাসির কাছে বাংলা গান—আমার নতুন জীবন শুরু হলো। জামশেদপুরে আর যেতাম না। ছুটিতেও না। মাসির ওখানটাই আমার ‘বাড়ি’ ছিল। ওখানেই ‘প্রেম’ দেখেছি। মেসো আর মাসির মধ্যে যেটা ছিল, সেটাই নিশ্চয় প্রেম। এখন তোমাকে পেয়েছি—এখন ঠিক চিনে ফেলেছি বিম, প্রেম জিনিসটা কী ব্যাপার। খুব দেরিতে হলেও জেনে তো গেলাম প্রেম কেমন?”

.

”শুধুই ভালোলাগার মধ্যে মিশে থাকতে চেয়েছি এতদিন। ছোটোবেলায় ‘জীবন’ বলতে বুঝেছি শুধু একাকিত্ব, ভয়, লজ্জা, দুঃখ, অপমান—কেবল কঠোরতা, কেবল না—পাওয়া।

” ‘পাওয়া’ কী প্রথম বুঝলাম ছোটোমাসির কাছে। গানে। গানকে নিজের মতো করে সব সময়ের সঙ্গী করে পেয়েছিল ছোটোমাসি—আমাকেও তার ভাগ দিল। আমার গলার সুর আমার ইচ্ছের সঙ্গে মানিয়ে চলত। গান আমার বাধ্য ছিল। গানই হলো আমার সঙ্গী। মানুষের কাছ থেকে আঘাত আসে। গানের কাছ থেকে শুধুই ভালোবাসা, শুধু ভরসা। যখনই মনে হয়েছে গড়িয়ে যাচ্ছি, ঢালু জমিতে পা সোজা রাখতে পারছি না, গান আমার হাত ধরে শক্ত মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আবার চলতে শুরু করেছি। তাই ধরেই নিয়েছিলাম মানুষের চেয়ে গান ভালো। মানুষের চেয়ে নেশা ভালো। মানুষ ওই শুধু একরাত্রে সঙ্গের জন্যেই ভালো। সারাজীবনের তো প্রশ্নই ওঠে না।….

”কী করতে যে সেদিন গ্রীনিচ ভিলেজে আমাদের কাফেতে গিয়েছিলে তুমি? আমার পৃথিবীটাই পালটে গেল। বিম, তোমাকে না দেখলে আমার জানাই হতো না, যে আমার জীবনেও ভালোবাসা আসা সম্ভব, আমার ভারও কেউ নিজের ইচ্ছেয় কাঁধে তুলে নিতে পারে। তুমি আমাকে নিশ্বাস নিতে শেখালে। তার আগে আমি কী করছিলাম বলো তো?

রুদ্ধশ্বাসে ছুটছিলাম।

নিশ্বাস বন্ধ করে দৌড়োচ্ছিলাম।

কোনো কিছুর দিকে নয়।

কোনো লক্ষ্য ছিল না।

গন্তব্য ছিল না কোনো।

”সামনে মরুভূমি না অরণ্য, খাদ না সমুদ্র, কিছুই খেয়াল ছিল না আমার, কখনও সমুদ্রের নোনাজলে ডুবেছি—ভেসেছি, কখনও মরুভূমির নির্জল আগুনে পুড়েছি, গলা বুক শুকিয়ে ঠাঠা, আবার কখনও খাদে পড়ে গেছি।

”সেই খাদ থেকে আর ওঠা যায় না, বিম। তুমি হাত ধরেছিলে, তুমি টেনে তুলে এনেছিলে অনেক ওপরে—কিন্তু আমার যে পা আটকে গেছে পাথরে। সেই খাদ আমাকে আজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে তোমার কাছ থেকে, টুবলুর কাছ থেকে, অনেক, অনেক দূরে। কে জানে কোন গভীরে। সেখানে হয়তো আমার মা—ও আছে। মা—ও তো খাদেই ঝাঁপ দিয়েছিল। আমাকে ফেলে। আমি কিন্তু কক্ষণো এই খাদে ঝাঁপ দিতাম না বিম, বিশ্বাস করো আগেই যদি টুবলুকে পেয়ে যেতাম। কক্ষণো না। মালু বোঝে আমার কথা। ভাগ্যিস মালুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল? মাই ওনলি ফ্রেনড!

”টুবলু যে এল বড্ড দেরি করে। তুমিও যে অনেক দেরিতে এলে, বিম। তখন ঘণ্টা বেজে গিয়েছে, ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছে, মুহূর্তের মধ্যে দ্রুতবেগে ছুটে যাবে আমাকে নিয়ে। আমি যে রওনা হয়েই গিয়েছিলাম!….”

.

”টুবলু যেন আমাকে মাপ করে দেয়। তুমি ওকে আমার কতা বুঝিয়ে বোলো। তুমি পারবে। মালু পারবে। এখন কেবল রুমাল ওড়ানোর সময়। জানলায় বসে থাকা। এখন কেবল হাত নাড়া। শেষে চুমু উড়িয়ে দেওয়া বাতাসে।

.

”তারপর মনে মনে কথা।….”

.

”কেতকীর সঙ্গে এখন আমার মনে মনে কথার দিন। টুবলুর সঙ্গেও কেতকীর কথা হয়। মনে মনে। টুবলুর সঙ্গে তার মায়ের খুব ভাব। কেতকী যা চেয়েছিল তা পেয়েছে। টুবলু তার মায়ের মেয়ে—মা—ই তার বেস্ট ফ্রেন্ড। মালবিকার কাছে টুবলু অনেক গল্প করে, মায়ের গল্প। কেতকী ছিল মা—হারা মেয়ে। তিন বছর মাকে পেয়েও পায়নি। টুবলুর চোদ্দ মাসে কেতকী চলে গেছে—কিন্তু টুবলু মা—হারা মেয়ে নয়। আপ্রাণ চেষ্টায় তার কাছে আমি পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছি তার মাকে। তার কাছে—না—থাকা মা যেন তার অস্তিত্বকে আড়াল করে রাখে। ছায়া দিয়ে ঘিরে রাখে। স্নেহে। কেতকী বলেছিল, স্নেহ চিরন্তন। যে—স্নেহ ওকে দেননি ওর গর্ভধারিণী। তাই চিরদৈন্যদশায় রয়ে গিয়েছিল কেতকী। মা নেই তবুও টুবলুর অঞ্জলি পরিপূর্ণ। তার ছোট্ট জীবনে কোনো দৈন নেই, স্বপ্ন দিয়ে ভরে নিয়েছে সে তার রুগণ, ছোট্ট বুক। ভালোবাসায়, আর ভালোবাসার স্বপ্নে। আদরে আদরে মহারানী হয়ে আছেন তিনি, এবং তার মা জননী। দুজনেই। এই সংসারে কেতকী এখনও উপস্থিত। টুবলুর মা না থাকলে চলবে কেন?

”এই ব্যাপারে আমাকে যে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে, সে মালবিকা। মালুই কেয়ার একমাত্র বন্ধু—জীবনের শেষ ধাপে এসে কেয়া একজন বন্ধু পেলো, মালুর মতন বন্ধু। টুবলুর জীবনে কেতকীকে, মা—কে অধিষ্ঠিত করার কাজে মালুরও প্রচুর সাহায্য পেয়েছি। অদৃশ্য মা—কে টুবলুর মনে জীবন্ত রেখেছি আমরা দুজনে মিলেই। মালবিকার কাছে এজন্য আমার কৃতজ্ঞতা অসীম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *