উড়াল – ১১

এগারো – মালবিকার ডায়েরি

ভাবতেও পারছি না।

পৃথিবীতে ছত্রিশ কোটি মানুষের এইডস হয়েছে। তার মধ্যে দুই—তৃতীয়াংশ আফ্রিকায়, এবং প্রধানত মেয়েদের মধ্যেই। মায়েদের কাছ থেকে সংক্রমণ যাচ্ছে শিশুর রক্তে।

আগে আগে ধারণা ছিল, রোগটা শুধুই হোমোসেকশুয়াল পুরুষদের বিশেষ প্রণয়—পদ্ধতিজনিত কারণে বেশি বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। শ্লেষ্মাঝিল্লী ছিঁড়ে যায়, রক্তের সঙ্গে মিশে যায় দেহনিঃসৃত রস—যাতে রোগের বীজ। এসব আশির দশকের গোড়ায় ভাবা হতো। ভারতবর্ষে অবশ্য তখনও এ বিষয়ে উচ্চবাচ্যই ছিল না। আবছা ধারণা ছিল, সমকামী পুরুষদের রোগ।

পরে তো বোঝা গেল এটা হেটেরো—সেকশুয়ালদেরও রোগ, অন্যান্য সেকশুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজের মতোই স্ত্রী—পুরুষ সংসর্গে ছড়িয়ে পড়েছে, বেশ্যালয়েই এদের প্রধান রমরমা। ‘সেফ সেক্স’—এর বিজ্ঞাপনে পৃথিবী ভরে গেল, কনডোম এখন কেবল জন্মনিয়ন্ত্রণই করে না, করে মৃত্যু—নিয়ন্ত্রণও। এটা কেউ মনে রাখে না, তাই ভারতীয় বেশ্যালয়ের বিচিত্রবীর্য পুরুষ—অতিথিরা প্রবলভাবে কনডোম—বিরোধী। দেশে কিছুদিন কাজ করেছিলাম বম্বেতে, একটি এন.জি.ও—র সঙ্গে। কাউন্সেলিং—এর কাজ। যৎসামান্য মাইনে। প্রবল মানসিক চাপ। তবু করেছিলাম, সেই থেকে আমার নতুন করে ইনটারনাল মেডিসিন পড়ার আগ্রহ।

কলকাতাতেও প্রচুর কাজকর্ম চলছে, এখন একাধিক এন.জি.ও. হয়েছে যারা যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।

আমি প্রধানত বেশ্যালয়ের বাইরের এইডস ভিকটিমদের কথা ভাবছি। বেশ্যালয় থেকে যাঁরা এই রোগটি বাড়িতে বয়ে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীকে সপ্রেমে উপহার দিচ্ছেন, তারপর স্ত্রীর মারফৎ গর্ভস্থ সন্তানকে, তাঁদের জন্য কোন এন.জি.ও. কাজ করতে পারবে?

যে পুরুষ এইডস রোগীরা অন্যত্র থেকে রোগ নিয়ে এসে দেশের যৌনকর্মীদের মধ্যে রোগটি বিলি করে যাচ্ছেন এবং যে পুরুষ খদ্দেররা আবার সেই রোগটি তুলে ঘরে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন—সেই মানুষগুলিকে কারা কী উপায়ে শিক্ষিত করবে? তাঁরা যদি অবাধ্য হন, কনডোম—বিরোধী তুচ্ছ সুখান্বেষী হন, তবে তো তাঁরা জীবন—বিরোধী। মৃত্যুর অন্বেষায় পথে নেমে পড়েছেন। রক্ত পরীক্ষার জন্য ডাক্তারখানায় গেলেও এঁদের আর পরবর্তীকালে কোনো খোঁজ মেলে না। উধাও হয়ে যান, মুছে যান সরকারী স্ট্যাটিসটিক্স থেকে।

কিন্তু আমাদের সমস্যা অন্য। কেতকীর রোগের সূত্রপাত ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে। ড্রাগ পার্টিতে, খেলায় খেলায়। ড্রাগ অ্যাডিকশনের নানান বিপদের মধ্যে অন্যতম প্রধান বিপদ এইচ.আই.ভি.। কার রক্তে এইডস আছে জানা নেই, একই সুঁচে ড্রাগটি যাচ্ছে একদঙ্গল তরুণ নেশাড়ুর রক্তে। ড্রাগের সঙ্গে রোগের বীজাণুও ছড়িয়ে পড়ছে। এইভাবেই অসুখটি পেয়েছিল কেতকী। তার গাইয়ে—বাজিয়ে বন্ধুদের মধ্য থেকেই, অতি অ্যাডভেনচারাস কোনও বন্ধু একদঙ্গল অতি অল্পবয়সী শিল্পীর আয়ুষ্কাল সীমিত করে দিয়েছে।

কেতকীর রোগ ধরা পড়ার পর ওর দলের সব বন্ধুদের বলা হয়েছিল ইলাইজা টেস্ট করানোর কথা। জানি না কে কী করেছে। এইচ.আই.ভি. রক্তে প্রবেশ করার দশ বছর পরেও এইডস ফুটে বেরুতে পারে। জেনে তো রাখা দরকার। যাতে তুমি তোমার প্রিয়জনদের মধ্যে ভাগ—বাঁটোয়ারা করে দিতে না পারো এই মারণবিষ। সতর্ক থাকার জন্যও জানাটা জরুরি। অথচ এদের কারুরই ব্লাড টেস্ট করানোর উৎসাহ নেই, জানতে গা নেই।—এই যে ছোট্ট টুবলুরানী। তার জন্মই হয়েছে এইচ.আই.ভি. পজিটিভ রক্ত নিয়ে। তার কোনো মুক্তির পথ নেই। এই বছরে, ইংলন্ডে, সেদিন একটা ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে পড়লাম, চৌত্রিশ হাজার মানুষের এইচ.আই.ভি. ধরা পড়েছে, তার মধ্যে দু’হাজার শিশু।

ভারতবর্ষের কোনো হিসেব নেই। শুনছি পৃথিবীর বৃহত্তম এইডস মহামারী ভারতবর্ষেই হবার সম্ভাবনা তিন বছরের মধ্যেই। আন্তর্জাতিক হিসেব তাই বলছে। কিন্তু আমাদের দেশে জাতীয় হিসেব বলে কিছু নেই। মহামারী নিয়ে ভয়—ভাবনাও নেই কারুর। থাকবে কেমন করে? আজকাল প্রাইভেট ক্লিনিকে HIV রোগীরা আসতে শুরু করেছে। ডাক্তারবাবুরা তাদের চিকিৎসা করেন না—ভয় পান। সরকারী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে অবহেলা পেয়ে তারা উধাও হয়ে যায়। পাটনার একটা খবর পড়েছিলাম, একটাই ক্লিনিকে ছশো পনেরোজন HIV positive প্রমাণিত হয়েছে, রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু সরকারী হিসেবে সারা রাজ্যে মোট চারশো বিয়াল্লিশ জন। সত্য প্রকাশ করবার চেষ্টাই নেই। এই তো আমাদের দেশ।

সবচেয়ে বিপজ্জনক—দেশের বহু ব্লাড ব্যাংকের রক্তদাতাদের সর্বদা এইচ.আই.ভি. টেস্ট করে নেওয়া হয় না। প্রচুর ড্রাগ অ্যাডিক্ট আছে যারা নেশার খরচ তুলতে অনবরত রক্ত বেচে। বাধ্যকারী তিন মাসও অপেক্ষা করে না। বিভিন্ন ব্লাড ব্যাংকে ঘুরে ঘুরে, দর করে রক্ত বিক্রি করে বেড়ায়। তাদের রক্তে মৃত্যুর বিষ মিশে রয়েছে। বিনা দ্বিধায়, বিনা বিবেকে, বিনা উদ্বেগে, অপরীক্ষিত দূষিত রক্ত আমরা সস্তায় ব্যবসার খাতিরে প্রাইভেট ব্লাড ব্যাংকে কিনি, এবং রোগীকে অক্লেশে বেচি। এইরকম দায়িত্বহীন, বিপজ্জনক ব্লাড ব্যাংক সারা ভারতে অগুনতি ছড়িয়ে আছে। রক্তে বোতলে ‘‘HIV tested’’ ছাপ থাকার কথা। দেশে ক’জন ক্রেতা জানেন, গ্রুপ দেখে রক্ত কেনেন ক’জন? ব্লাড ট্রান্সফিউশান থেকে এইডস—প্রাপ্তি নতুন কোনও অজ্ঞাত সোর্স নয় এই রোগের। এইসব পশ্চিমী দেশে অবশ্য এখন আর এসব সমস্যা হয় না। আশির দশক থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে অপরীক্ষিত রক্ত কেনা—বেচা। আমাদের দেশেও বহুদিন আগে আইন চালু হয়ে গেছে কিন্তু প্রয়োগ চালু হতে চাইছে না। খানিকটা ব্যবসায়ীদের নির্বিবেক লোভ ও খানিকটা রোগীর অভিভাবকদের অজ্ঞতার কারণে। ভারতবর্ষে NACO নানাভাবে বিজ্ঞাপন দেয়, কিন্তু কতটা সফল হচ্ছে? অথচ এদেশে অনেকদূর এগিয়ে গেছে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ। তিনভাবে এইডস প্রধানত ছড়াতে পারে, ব্লাড ট্রান্সফিউশনে, ড্রাগ অ্যাডিক্টের ছুঁচের ডগায়, আর রোগীর সঙ্গে যৌন সংসর্গে। সেটা হেটেরোসেকশুয়াল, না হোমোসেকশুয়াল, তাতে কিছুই এসে যাচ্ছে না।—এবং চতুর্থও একটি পথ আছে। মাতৃজঠর। রুগণ মায়ের গর্ভস্থ সন্তানকে রোগসংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে কী উপায়ে? আফ্রিকাতে এটাই হয়েছে মূল সমস্যা। তারা বুঝতেই পারছে না ব্যাপারটা কত জটিল, কত ব্যাপক এ বীজাণুর ধ্বংসক্ষমতা। ভ্রূণের মধ্যে ঢুকে যায় মৃত্যুবীজ, তার কামড় থেকে রক্ষে নেই।

তবে নর্থ আমেরিকাতে ইদানীং মেডিক্যাল রিসার্চ অনেক এগিয়ে গেছে। এই আজন্ম পাপেরও মোচন সম্ভব। গর্ভস্থ শিশুটি ভূমিষ্ঠ হবার মুহূর্তে তার দেহ থেকে মায়ের সব অসুস্থ রক্ত শুষে বের করে ফেলে দিয়ে, ওর শিরাধমনিতে ভরে দিতে হবে সুস্থ, স্বাভাবিক রক্ত। নতুন রক্ত। নীরোগ রক্ত পেলে শিশুও নীরোগ জীবনে নতুন করে বেঁচে উঠবে। আফ্রিকাতে এসব অবশ্যই স্বপ্ন কল্পনার পর‍্যায়ে—ভারতবর্ষেও। আমাদের দুর্ভাগ্য টুবলু সোনা এই নর্থ আমেরিকাতে জন্মেও এ সুযোগ পেল না—পাঁচ বছর আগে তো এ চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওর শরীরে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।

দিনে দিনে এগিয়ে যাচ্ছে এইডস চিকিৎসার প্রণালী। প্রত্যহ নতুন আবিষ্কারের খবর আসে। আমাদের হাসপাতালেই সেদিন একটি কালো শিশুকে ঐভাবে ব্লাড ট্রান্সফিউশান দিয়ে বাঁচিয়ে তোলা হলো—সে এখন সম্পূর্ণ এইচ.আই.ভি. ফ্রী। সারা হাসপাতাল আনন্দে সেলিব্রেট করল। কিন্তু আমাদের শিশুবিভাগে রয়েছে আরো সাতজন। যাদের ব্লাড ট্রান্সফিউশন দেওয়া যায়নি—এবং আছে টুবলু। যে এখন আর হাসপাতালে থাকে না। যার বাসা এখন বাড়িতেই। একা।

হাসপাতালে ওর খুদে বন্ধুদের মধ্যে টুবলু খুশিতে ছিল—ভেবেছিলাম বুঝি বাড়িতে গিয়ে মনখারাপ হবে। কিন্তু না। কার্যত দেখা গেল টুবলু বাড়িতেও খুব খুশিমনে আছে। বরং একটু বেশিই খুশিতে। ভাগ্যিস বিমলদা ওকে এদেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন, কেতকীর কথা শুনে দেশে রেখে দেননি। কেতকী যাবার পরেও ও পাঁচটা বছর রয়েছে—দেশে ওর বছর ঘুরত না। এক তো ওর ইমিউনিটি নেই, আর রোগের সীমা নেই দেশে। দুই, খেলতো কার সঙ্গে? কে ওর সঙ্গে খেলতে আসতো, কার মা—বাবা তাদের শিশুকে HIV positive বাচ্চার সঙ্গে খেলতে দেবে? খেলতে খেলতে তো হাত—পা কাটছেই অনবরত, খুব বিপজ্জনক। রোগের কথা না জানিয়েও মিশতে দেওয়া অনুচিত, সেটা ইমমর‍্যাল হয়—

স্কুলেও জানানো দরকার—বললেই অবশ্য আর স্কুলে ওকে নেবে না। দেশে থাকলে এই টুবলুকে আমরা পেতাম না।

হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে অবধি টুবলু কেমন বলছে ওর ডানার গল্প। ওর পিঠে যে দুখানা হালকা মতন পাখনা গজাচ্ছে, এটা আর কথার কথা নেই। খচমচ করে অল্প অল্প খোলা যাচ্ছে, বন্ধ করা যাচ্ছে সেই ডানাদুটো—টুবলুর আহ্লাদ আর ধরছে না। আমার কিন্তু একটুও ভালো লাগছে না। ডানাদুটো যেদিন ও পুরোপুরি মেলতে পারবে, সেদিনই উড়ে চলে যাবে ওর মায়ের কাছে। এটা আমি বেশ টের পাচ্ছি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *