উড়াল – ১০

দশ – বিমল

—”আমার ডানা গজাচ্ছে, বাবা দ্যাখো? দেখেছো? এই যে দ্যাখো, ডানার মতন? এইগুলোই তো বড় হয়ে ডানা হবে। আমি তো পরী? আমি পরী হয়ে উড়ে চলে যাবো—” মহা উৎসাহে একগাল হেসে ভীষণ রোগা হয়ে যাওয়া কাঁধের ফুটে ওঠা হাড়দুটো দেখালো টুবলু। মনে হলো, সত্যিই যেন সেখানে ডানার মতো কিছু গজিয়ে উঠছে।

—”কোথায় উড়ে চলে যাবে সোনা?”

—”কেন? আকাশে? ওই যে ওইখানে।”

টুবলু আঙুল বাড়িয়ে জানলার বাইরে দুপুরবেলার আকাশ দেখালো। টিনের চাকতির মতো আকাশে একটা পাখি। মনে হলো যেন একটা চিল চক্কর মারছে। স্মগ—ছাওয়া গম্ভীর আকাশটা হঠাৎ ঠিক কলকাতার আকাশের মতো দেখালো।

কলকাতায় আমাদের সামনের বাড়ির নারকোল গাছে একজোড়া চিল বাসা বেঁধেছিল। তাদের একটি বাচ্চাও হয়েছিল। বাবা আর মা তাকে পালা করে কী সুন্দর পাহারা দিত সারাদিন। কোনোপ্রকার উইমেন্স লিব—এর তাগাদা ছাড়াই। একদিন সেই বাচ্চাও ডানা মেললো। ভেসে গেল আকাশে। আশ্চর্য কথা এই যে, তারপরেও অনেকদিন, বাচ্চাটা বড় চিল হয়ে যাবার পরেও, ওই নারকোল গাছের বাসায় তিনটে চিলই থাকতো। ছিল ওইভাবে অনেকদিন। শেষকালে একদিন সঙ্গীর সন্ধানে উড়ে গেল বাচ্চা চিল। প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন করার সাধ্য কি চিল মা—বাবার! কতকাল স্নেহ দিয়ে আটকে রাখবে সন্তানকে? সাধ্য নেই মানুষ মা—বাবারও। প্রকৃতির থেকে যতদূরেই চলে আসি না কেন, যতই চেষ্টা করি না কেন প্রকৃতির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে, যতই অত্যাচার করি না কেন ধরিত্রীর ওপর, আমরা জিতব না।

প্রকৃতির শরীরে আমাদের ধর্ষণের নিত্য নতুন চিহ্ন ফুটে উঠছে। জলে, স্থলে অন্তরীক্ষে এবং ভূগর্ভে, সভ্যতার অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমরা নিদারুণ আক্রমণ করে চলেছি আমাদের জননীকে। যেখানে পর্বত ছিল, সেখানে টানেল ফুটিয়ে রেললাইন, যেখানে গহন অরণ্য ছিল সেখানে গাছ কেটে মরুভূমি, যেখানে জলাশয় ছিল সেখানে আবর্জনা দিয়ে বুজিয়ে জনপদ। নদীর স্রোত ঘুরিয়ে দিয়ে, মানুষের বসতি, ক্ষেতের ধান ভাসিয়ে দিয়ে করছি বাণিজ্যের উন্নতি। মাটির পাঁজরের ভিতরে, সমুদ্রের জরায়ুতে ফাটাচ্ছি পারমাণবিক বোমা। সর্বংসহা প্রকৃতির শরীরের ওপরে কী অনাচার, কী দুরাচারই না চালাচ্ছি আমরা। সবই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে একদিন। এত কাণ্ড করেও আমরা কি প্রকৃতির মাথায় পা দিয়ে চলতে পারছি? শেষ জিৎ তো মায়েরই। সেই মায়ের কোলেই ফেরৎ যেতে হবে। যেখান থেকে এসেছিলাম।

”আমার টুবলুকে আমি ছাড়ব না” বলে যদি সত্যাগ্রহ করে বসে থাকি, তাতে কর্ণপাত করবেন না প্রকৃতিদেবী। তাঁর কানই নেই।

.

—”বাবা, আমি উড়তে পারি। সত্যি বলছি! তুমি দেখবে?”

—”ঠিক আছে টুবলু, আমি বিশ্বাস করছি। তোমাকে উড়ে দেখাতে হবে না।”

—”এ বারান্দা থেকে উড়ে আমি ওই বারান্দায় চলে যেতে পারি। তুমি দেখবে, বাবা? যাবো?”

—”খবরদা—র! টুবলু!” কর্কশ চিৎকার করে উঠি আমি—”খবরদার সেই চেষ্টা করবে না তুমি! কোনোদিনও না। ওইভাবে উড়তে মানুষ পারে না। তুমি মানুষ—পড়ে যাবে তুমি! ‘মাধ্যাকর্ষণ’ বলে একটা টান আছে পৃথিবীতে। সব্বাইকে মাটির দিকে টেনে নেয়। এই যে আমার হাতের কলমটা—আমি যদি এমনি করে উড়তে ছেড়ে দিই, সেটা কি উড়বে? উড়বে না। মেঝেয় ঠকাস করে, এমনি করে, পড়ে যাবে। আমরা উড়তে গেলে আমাদেরও তাই হবে। কলমটার মতন। ধপাস করে একেবারে রাস্তায়। চিৎপটাং, ডেড!”

—”কিন্তু আমার তো হবে না, বাবা। আমার মা তো পরী ছিল। আমি তো পরীর বাচ্চা! কলম তো শুধু কলমই হয়। আমি তো জন্মেই উড়তে জানি। ডানাটা এতদিন লুকিয়ে ছিল তো, তাই কেউ দেখতে পায়নি। এবারে ঠিক দেখা যাবে। আমি হাঁটি—হাঁটি—পা—পা করে হাঁটতে শিখলাম তো। পরীর ছানাদের উড়তে শিখতে হয় না। বুঝেছো তো?”

—”বুঝলাম। তোমাকে এত খবর কে দিল মামণি?”

—”কে আবার দেবে? আমি নিজে নিজেই জেনে গেছি।”

—”আজ তুমি কেমন আছো সোনা? আজ কী খাবে বলো তো? ট্রাউট মাছের ঝোল? না রোস্ট চিকেন? না স্মোকড স্যামন খাবে আজকে?”

টুবলু সীরিয়াস মুখে চুপ করে ভাবতে থাকে। ঝাঁকড়া, কোঁকড়া লালচে চুলগুলো মুখের চারপাশে উড়ছে, তাতে আশ্চর্য একটা আলো এসে পড়েছে জানলা দিয়ে, কেমন যেন জ্যোতির্মণ্ডলের মতো, ‘হেলো’—র মতো দেখাচ্ছে। টুবলু ভাবছে।

স্যামন। না ট্রাউট। না চিকেন। ভেবে—চিন্তে টুবলু বলল—”ট্রাউট মাছ। ঝোল না। গ্রিলড।” তারপরেই—”আচ্ছা ড্যাডি। মা কোনটা বেশি ভালোবাসতো? ট্রাউট, না স্যামন?”

—”তোমার মার ফেভারিট স্মোকড স্যামন—ট্রাউট তত পছন্দ ছিল না ওর। তোর মা তো মাছই ভালোবাসত না। এক সী—ফুড ছাড়া। লবস্টার, প্রন, শ্রিম্প, স্ক্যাম্পি, ক্র্যাব—এইসব ওর ভালো লাগত। আর ইলিশ মাছ।”

—”আমিও ক্র্যাব, শ্রিম্প, প্রন, এইসব খুব ভালবাসি বাবা। কিন্তু ইলিশ মাছ ভালোবাসি না। ভীষণ কাঁটা। তার চেয়ে স্যামন মাছ ঢের ভালো, কাঁটা হয় না।”

—”ঠিক। তোমাকে ইলিশ মাছ খেতে হবে না সোনা। তুমি স্যামনই খেয়ো। আজ গ্রিলড ট্রাউট, কাল স্মোকড স্যামন। ক্র্যাবটা খাবার আগে একটু দেখে নিতে হবে—একটা ছোট্ট অ্যালার্জি টেস্ট করিয়ে নেবো তোমার। ইতিমধ্যে যদি আবার নতুন কোনো অ্যালার্জি—”

—”মালু কখন আসবে, ড্যাডি?”

—”এই তো এবার এসে পড়বে। আমি ততক্ষণ তোমাকে একটা গপ্পো পড়ে শোনাই এসো, ভারী মজার গপ্পো। একটা ছেলে ছিল। তার নাম পাগলা দাশু। ওর গল্পটা মালু কি তোমাকে বলেছে?”

—”মজার গল্প শুনব না, ড্যাডি।”

—’তবে কীসের গল্প শুনবি? রূপকথা?”

—’আজ গল্প শুনব না, ড্যাডি, আজকে ছড়া বলো।”

—”ছড়া তোমার ভালো লাগে?”

—”খুব ভালো লাগে।”

—”তবে শোন—তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ করো/তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো/ তার বেলা?”

অন্যমনস্কভাবে টুবলু বলল—

—”আচ্ছা, আমিই তোমাকে একটা ছড়া বলছি। মজার ছড়া। শুনবে? মালু শিখিয়েছে। ছবিও দেখেছি।”

—”কী ছড়া? বল শুনি।”

টুবলু চেষ্টা করে খানিকটা সোজা হয়ে উঠে বসলো বিছানায়। গোল গোল গোলাপী—সোনালি ফ্রেমের চশমায় ওর চোখদুটিকে অনেক বড়ো দেখায় মোটা কাচের পিছন থেকে। সরল চোখদুটোকে খুব জরুরিভাবে পাকিয়ে গোল গোল করে টুবলু বলতে শুরু করলো—

—”হুঁকোমুখো হ্যাংলা/বাড়ি তার বাংলা/মুখে তার হাসি নেই/দেখেছো?”

টুবলুর বাংলা উচ্চারণ খুব সরল নয়। তবু মেয়েটা বাংলা বলে তো? নর্থ আমেরিকায় জন্মে, বড় হয়ে, সেটাও যথেষ্ট। টুবলুর পাতলা সিল্কের মতো চামড়া আগে বাদামী ছিল, এখন ধবধবে—প্রায় স্বচ্ছ—নিচে দিয়ে শিরার প্যাটার্ন ফুটে উঠেছে। একেই পাণ্ডুর বর্ণ বলে। মহারাজা পাণ্ডুর গায়ের বর্ণ নিশ্চয় এইরকম ছিল—আর ওর সেই রোগটা সম্ভবত স্ট্রং অ্যানিমিয়া। এই টুবলুর এখন যেমন। ছড়া বলতে বলতে মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে—দেখে আমার বুকের ভেতর কুরে কুরে যন্ত্রণা হতে থাকে।

.

টুবলুর ছোট্ট শরীরটা আর কোনো কথা শুনছে না আমাদের। তার নিজের খেয়ালখুশি মতো চলতে শুরু করেছে। এমনকি টুবলুর শাসনও সে মানছে না। টুবলুর খুব কড়া শাসন। শরীরের ওপর মনের সর্দারিটা সে বজায় রাখবেই। শরীর যতই বেয়াড়াপনা করে, টুবলুর শাসন ততই কড়া হয়। চব্বিশ ঘণ্টা নিজের চোখে না দেখে, অন্যের মুখে শুনলে, হয়তো বিশ্বাস করতাম না। ছ’বছরের মেয়ের পক্ষে এমনভাবে মৃত্যুর সঙ্গে মোকাবিলা করাও কি সম্ভব?

টুবলুকে জানানো হয়েছে সব। তার আয়ুর দৈন্যের খবর।

মা—মেয়ে দুজনের রক্তে যে অচ্ছেদ্য বাঁধন। তার খবর। শেষটুকু যে তার দেখে যাওয়া হবে না, সেই কথা।

সেটা একরকমের জানা।

কিন্তু টুবলু নিজে নিজেই আপনমনে অন্য একরকমের জানা জেনে ফেলেছে। সেটা তার পরীবংশের কাহিনী, জন্ম—মৃত্যুর অন্য একটা রূপকথা। আমাদের সেটা বুঝতে সময় লাগছে। স্নান করাতে গিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যিই টুবলুর পিঠে দুটো পাখা গজিয়েছে। গত দু’বছরে টুবলুর কল্যাণে যতটা চিনেছি নিজেকে, আর মানুষের পৃথিবীকে, আমার এই পঞ্চাশ পার হওয়া তিন মহাদেশে দৌড়ে—বেড়ানো জীবনে তার অল্প এক টুকরোও শেখা হয়নি।

আজন্মই তো শুধু মৃত্যুর গল্প শুনিয়েছি মেয়েটাকে। এমনই দুর্ভাগা বাবা আমি, যে সন্তানকে একটাও শুভ সংবাদ উপহার দিতে পারিনি। প্রথমেই দিয়েছি তার মায়ের মৃত্যুর খবর।

আর তারপরে তার নিজের অবশ্যম্ভাবী স্বল্পায়ুর কঠিন সংবাদ। আয়ু শেষের উপলব্ধি তার মুঠোয় ভরে দিয়েছে কিছু স্বপ্ন। কিছু সুধাময় অবাস্তব আশা—আমি তার কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। আমি শুধু টুবলুকে জড়িয়ে ধরেছি আমার সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে—আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অগ্রাহ্য করে। যতগুলো বছর, যতগুলো মাস, যে ক’টা দিন, যে—ক’টি ঘণ্টা টুবলু এই মাটির পৃথিবীতে থাকবে ওকে ভালোবাসায় ভরে রাখা, ওকে সুখস্বপ্নে ঘিরে রাখা আমারই কর্তব্য।

মা—মরা মেয়ে।

এমনিতেই মা—মরা মেয়েদের জীবন সহজ হয় না। তাদের শৈশব ফুরিয়ে যায়। সারল্য হারিয়ে যায় চট করে। টুলুর মা—ও ছিল মা—মরা মেয়ে। আর সেই মূলেই নিহিত আমাদের যাবতীয় যন্ত্রণার বীজ। ছোট্ট টুবলুর জীবনে মৃত্যুবীজটি বপন করে গেছেন তার মৃত দিদিমাই। সেই বিষাক্ত ফাঁদ থেকে কেতকীর মুক্তি ছিল না, টুবলুকেও বাঁচাতে পারলাম না। ওর ডানাদুটো অমোঘভাবে জেগে উঠছে। যেদিন পুরোপুরি তৈরি হয়ে যাবে—সেদিন উড়ালের থেকে নিস্তার নেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *