উড়াল – ১

এক – বিমল

”এক্সকিউজ মি।”…

চমকে উঠেছি।

আমার সামনে সেই মেয়ে। যাকে ক’দিন ধরেই লক্ষ্য করছি। ও—ও কি সেটা খেয়াল করেছে? ঘন চন্দনবাটার মতো রং। এক—পিঠ কালো চুল। পুয়ের্তোরিকান? মেক্সিকান? নাকি ক্রেওল? অ্যাকসেন্ট থেকে বোঝা গেল না। কি জানি কালো মেয়েও হতে পারে। অনেক কৃষ্ণাঙ্গদের গায়ের রং বেশি কালো হয় না। নাঃ, কৃষ্ণাঙ্গ নয়। হতে পারে না। ওই নাক, ওতে অন্য ইতিহাসের চিহ্ন। হয়তো ইহুদী হতে পারে। টানা সোজা, লম্বা, কালো চুল কোমর পর্যন্ত। চওড়া কালো চামড়ার ওপরে রুপোলি স্টীলের বোতাম লাগানো বেলট—টা পর্যন্ত একটা ভারী সিল্কের পর্দার মতো ঝুলছে। হিস্পানিক মেয়েই হবে। ইংরেজি উচ্চারণ যদিও খুব স্পষ্ট, হিস্পানিক অ্যাকসেন্ট নেই।

ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে, মুখখানাই উঁচু করে তুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। কথাবার্তা বিশেষ বলায় বিশ্বাস করে না দেখছি। ভঙ্গিতে মনে হয়, ওর সিগারেট ধরিয়ে দিতে বলছে। আমার ঠোঁটেও সিগারেট যেহেতু।

দেশলাইটা চাইতে পারতো।

তা না করে সিগারেট সমেত মুখখানা বাড়িয়ে দিয়েছে, ইঙ্গিতে ”মুখাগ্নি করো” বলছে। আজকের শিকার কি আমিই? ক’দিনই লক্ষ্য করছি, কি প্রচণ্ড ফ্লার্ট করতেই না পারে। এই ”এল কামিনো” কাফে—তে খাবারটা ভালো, কফিটা তো দারুণ। আর এই মেয়েটার গান। মেয়েটার গলায় কী একটা মায়া আছে, অদ্ভুত আবেশ সৃষ্টি করতে পারে—আর মজা হচ্ছে, যখন ফ্রেঞ্চ গান গায় তখন মনে হয় ক্রেওল মেয়ে, যখন স্প্যানিশ গায় মনে হয় হিস্পানিক, ব্লুজ ধরলে মনে হয় দক্ষিণের কালো মেয়েই। আবার হ্যারি বেলাফন্টের গান গাইবার সময়ে মেয়েটা একেবারেই ব্রিটিশ গায়ানার পিজিন ইংলিশ বলে।

গানে যেমন বৈচিত্র্য, তেমনিই বৈচিত্র্য ওর পুরুষ বন্ধুতে।

এক এক সন্ধ্যায় এক একজন নতুন সঙ্গী খুঁজে নেয় মেয়েটা। দেখলে মনে হবে সেই যেন ওর চিরদিনের সখা। পরদিনই দেখি আরেকজনের বাহুলগ্না। আমি ভাবতে চেষ্টা করেছি, কেন ও এমন করে? কিসের সমস্যা ওর? কোন নিরাপত্তাবোধের অভাব ওকে এভাবে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে? কী নেই ওর? রূপ, যৌবন, সে তো যথেষ্টই আছে, এবং ওইরকম যার গানের গলা, তথা ভাণ্ডার, তার গুণেরও সীমা নেই। তবে কেন ওর এই অস্থিরতা, এই খুঁজে বেড়ানো? এসব ভাবনা ভেসে বেড়াতো মনে মনেই। কোনোদিনই এগিয়ে গিয়ে আলাপ করবার কথা ভাবিনি। আজ সেই নিজে থেকে এগিয়ে এসেছে। বুকটা একটু দুপদুপ করছে বৈকি। কী চায় মেয়েটা? উদ্দেশ্য কী ওর? এই ফ্লার্টেশন কি ওর চরিত্রগত দোষ, নাকি সামাজিক অভ্যাস,—ঘরে হয়তো স্বামী আছে? নিদেনপক্ষে স্থির প্রেমিক? এটা হয়তো ব্যবসায়িক চাল? কি জানি, ওর কি হৃদয়ে কোনো গোপন ক্ষত আছে, যাতে প্রলেপ দিতেই ওর এই ফ্লার্টেশন, নাকি এটা আমারই বাঙালি সেন্টিমেন্টাল ব্যাখ্যা? ওর মুখের সিগারেটটা ধরিয়ে দিই না, আমার জ্বলন্ত সিগারেটটা আমি ওর হাতে তুলে দিই। কোনো কথা বলি না। নিজের সিগারেটটি ধরিয়ে নিয়ে, একটা আরামের টান মেরে, আমারটা আমাকে ফিরিয়ে দিল মেয়েটা। আর আশপাশ গাঁজার গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।

গ্রীনিচ ভিলেজে, যেখানে জ্যাজ বাজে, এমন ধারা কাফে—তে এই গন্ধ একটুও অপরিচিত নয়। ও নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

—”থ্যাংক ইউ।”

—”ওয়েলকাম”।

মেয়েটি হাসলো।

হাসিটা দেখে মনে হলো বুঝি বাঙালি মেয়ের হাসি। হঠাৎ শর্মিলা ঠাকুরের গালের টোলটা মনে পড়ে গেল। মেয়েটার বাঁ গালে ঠিক শর্মিলার মতো টোল পড়ে। আমি মনে মনে সতর্ক হই।

মেয়েটির শরীরের ভাস্কর্য থেকে আমি চোখ ফেরাতে পারছি না। মেয়েটা বোধহয় সেটা টের পেয়েই, আমার চোখে চোখ রেখেই আরেকবার হাসে। আবার শর্মিলা।

আমি বুঝতে পারছি না এটা কোনো সংকেত কিনা। অনেকদিন হয়েছে আমি নারীসঙ্গ করি না। আর এই বয়সের মেয়ের সঙ্গ তো নয়ই। এমিলি চলে যাবার পরে হাসপাতালেই বন্ধুত্ব হয়েছিল মেরি অ্যানের সঙ্গে। মেরি অ্যান আমার সহকর্মিণী। প্রায় সমবয়স্কা ডাক্তার। আমাদের সম্পর্কটা ঠিক প্রেম নয়—শরীরের খেলা। তার স্বামী আছে, সংসার আছে।

কিন্তু এসব হাসির জাতই যে আলাদা। ওদের চোখের ভাষা পড়তে আজকাল আমার ভয় করে।

মেয়েটা কি আমাকে কিছু বলতে চায়? হাসিতে কোনো ইশারা আছে?

ইজ শি ট্রায়িং টু পিক মি আপ?

এইসব হিস্পানিক মেয়েগুলো সত্যি খুবই…নাঃ। ছি। এভাবে জাত তুলে জেনেরালাইজ করাটা মহা অপরাধ। মনে মনেও এমন মন্তব্য করা ঠিক নয়। নিজের প্রতিক্রিয়া দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমি বোধহয় নিজেকে ককেশীয় সাদা পুরুষদের সঙ্গে একাত্ম করে দেখাতে শুরু করেছি। নইলে…”এইসব হিস্পানিক মেয়েগুলো—” এর মতন এমন একটা রীতিমতো আপত্তিকর বাক্য আমার মনের মধ্যেই বা তৈরি হবে কেন? ছি!

আমাকে দেখে ও যদি মনে মনে ভাবে—”এইসব ভারতীয় পুরুষগুলো সব, সত্যি…” সেটা কি রকম হবে?

সম্প্রদায় হিসেবে মানুষকে বিচার করাই তো সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি। নিজের কাছেই নিজে অপরাধী বোধ করে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় দু’পা এগিয়ে যাই মেয়েটির দিকে।

—”অ্যায়াম বিমল, ফ্রম ক্যালকাটা,” বলে, হাতটা বাড়িয়ে দিই।

একমুখ খোলা হাসি হাসে মেয়েটা। সিগারেট নামিয়ে আমার হাতে হাত মেলায়। তারপর স্পষ্ট বাংলায় বলে ওঠে—”তাই ভাবছিলাম। আমিও কলকাতার। ঠিক কলকাতা নয়, জামশেদপুরের। আমি কেতকী। নমস্কার।”

আবার শর্মিলা। পিঠে অত লম্বা চুল, কিন্তু মুখের চারপাশ ঘিরে কায়দা করে চুল কাটা, বারবার মাথা ঝাঁকিয়ে চোখ থেকে সরাতে হয়। ও, তাহলে এজন্যেই আমাকে বেছে নেওয়া। কলকাতা। দেশের লোক বলে আন্দাজ করেছিল। একটু হালকা হয়ে যাই।

ইতিমধ্যে তার সাঙ্গোপাঙ্গরা বেরিয়ে এসেছে। আরো চার—পাঁচজন, সকলেরই ওই কুড়ির ঘরে বয়েস হবে, সাদা, কালো, বাদামী—তিন রঙেরই ছেলেমেয়ে রয়েছে ওদের দলে। ভিতরে ওরা নাচছিল। প্রচণ্ড শব্দে ব্যান্ড বাজছে—একটা বিখ্যাত ‘রেগে’—ব্যান্ড ওদের এখানে বাজাচ্ছে আজ। মেয়েটার গান আজ এখনও শুরু হয়নি। ভিতরে প্রচণ্ড ধোঁয়া, শব্দ, মেয়েটি আমার মতোই টাটকা বাতাসের জন্যে বেরিয়ে এসেছিল বোধহয়। নাচের ফ্লোর থেকে সরে আসা, নেশার টানে। বাঙালি মেয়ে, এখানে এসে নেশা করছে। রাতবিরেতে অচেনা মানুষের কাছে গাঁজার বিড়ি ধরাবে বলে আগুন চাইছে—মোটেই ভালো লাগলো না আমার। ওকে তো এই ক’দিনই দেখছি, বাঙালি মেয়ে বলে একবারও মনে হয়নি ওর হাবভাব দেখে। ভাবতেই পারিনি মেয়েটা বাঙালি হতে পারে—কত কিছুই তো ভাবছিলাম।

নিশ্চয় ভালো ছাত্রী ছিল, নইলে বিদেশে এল কেমন করে? এরকম তো এদেশে আকছার হচ্ছে। ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা দেশ থেকে এখানে এসে হঠাৎ এতখানি স্বাধীনতা পেয়ে নষ্ট হয়ে যায়। পারে না আর মনঃসংযোগ করে পড়ায় লেগে থাকতে, মোটিভেশন নষ্ট হয়ে যায়। বানের জলে ভেসে যায় তাদের বিদেশযাত্রার মূল উদ্দেশ্য, ধুয়েমুছে যায় পূর্বস্মৃতি, চোখের সামনে উঠে আসে অন্য এক জগৎ, অন্য এক তীব্র অস্তিত্বের ছবি, অন্য এক মাত্রার জীবন। ড্রাগ আর সেক্স এই দুটোর যে কোনও একটা তাদের গ্রাস করলেই যাত্রা সমাপ্ত। কখনো আবার দুটোই একত্রে পথ ভোলায়। দেশে পড়ে থাকেন পিতামাতা তাঁদের পুরাতন আদর্শ আঁকড়ে। তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ পাছে হয়, সেই ভয়ে এরা কেউ আর দেশেই ফেরে না।

এই কেতকীকে দেখে মনে হচ্ছে এও সেই কোনোদিনই—ফিরে—না—যাওয়াদের দলেই। এ মেয়েকে জামশেদপুর আর দেখতে পাবে বলে মনে হয় না। আটলান্টিকের এপারেই ফুটে থাকবে এই কেয়াফুল, নোনা বাতাসে সুগন্ধ ছড়াবে। এ—মেয়ে দেশে ফিরে যাবে না কোনোদিনও…

—’উড ইউ লাইক সাম কফি কেতকী।”

—”নো, থ্যাংকস।”

—”সাম ওয়াইন, মে বি, অর আ বিয়ার?”

—”নো বিয়ার, থ্যাংকস, তবে ওয়াইন চলতে পারে। ইন ফ্যাকট এদের হাউস ওয়াইনটাই যথেষ্ট ভালো, এস্পেশালি দ্য রেড।” কথাবার্তা দিব্যি সোজাসাপ্টা। ফ্লার্টেশনের লক্ষণ নেই। একটা টেবিলে গিয়ে দু’জনে বসি। রেড ওয়াইন অর্ডার দিই। ও বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হাসে।

—”আপনার বন্ধুরাও কি এখানে কাজ করেন, আপনার মতো?”

—”দু’জন মিউজিক বাজায়, স্যাক্সোফোন আর বংগো আমার দুই বন্ধু বাজায়। অন্যরা এমনি আসে মজা করতে। আমরা আছি, তাই।”

—”আপনি এতগুলো বিদেশী ভাষাতে এত চমৎকার গান করেন, আমি তো ভাবতেই পারিনি আমাদের দেশের মেয়ে। কোথায় শিখলেন এসব?”

—”আমি দেশ থেকেই নানারকম গান জানি। এখানে এসে আরো বেড়েছে গানের ভাঁড়ার—”, আবার হাসি।

—”একদিনও তো ভারতীয় ভাষার কোনও গান গাইতে শুনলাম না? দিশি গান জানেন না?”

—”ওমা, জানবো না কেন? এখানে তো এদেশী গানই গাই—বেশির ভাগই ইংরিজি তো কান্ট্রি মিউজিক। কিছু স্প্যানিশ, কিছু ফ্রেঞ্চ। ব্যাস। এই তো?”

—”শুধু কান্ট্রি কেন? ব্লুজও তো গান, সেদিন তো হ্যারি বেলাফন্টেও গাইছিলেন।”

—”সবই তো ইংরিজি, ডায়লেক্ট আলাদা।”

—”ভারতীয় গান করেন না এখানে? আজকাল তো ভারতীয় সংস্কৃতিতে ইন্টারেস্ট হয়েছে—”

—”করি না তা নয়। করি মাঝে মাঝে। পাঞ্জাবী গান, দালের মেহেন্দি। হিন্দিও গাই, ফিল্মি গানা। নইলে গজল। গজলের চেয়ে এদের দালের মেহেন্দিই বেশি পছন্দ। নাচতে পারে।”

—”আমি তো একদিনও শুনিনি।”

—”শোনেননি বুঝি? শুনিয়ে দেবো।”

—”রবীন্দ্রসঙ্গীত?”

—”দূর। ওসব এরকম জায়গায় জমে নাকি?”

”হেসে ফেলল আবার…”যেসব গানের সঙ্গে এরা নাচতে পারবে সেই গান জমবে।”

—”তা কেন? কান্ট্রি মিউজিকের সঙ্গে কেউ নাচে?”

—”তার তো কথাগুলো বোঝে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা কে বুঝবে?

—”কিন্তু এ শহরে তো সাউথ এশিয়ান কম নয়। বাংলাদেশীর সংখ্যাও প্রচুর—”

—”তারা এসব জায়গায় অত আসে না। এখানে অবশ্য ইনডি—পপ বেশ ভালোই পপুলার হয়েছে। সেসব গাইলে, হ্যাঁ, ঠিক আছে। এখন সেন্টিমেন্টাল বাংলা গান গাইলে, অতুলপ্রসাদ কি রবীন্দ্রনাথ গাইলে লোকে পালিয়ে যাবে।”

—”কেন? পালাবে কেন? কান্ট্রি মিউজিকও তো ভীষণ সেন্টিমেন্টাল, নস্টালজিক”—

—হ্যাঁ। কিন্তু সে তো ইংরিজিতে। সেখানে তো ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যারিয়ার নেই, ভাষার মাধ্যমে আইডেন্টিফিকেশন হচ্ছে। যেখানে ভাষার অ্যাকসেস নেই, যেমন বাংলায়, সেখানে মিউজিকটা অ্যাকসেসিবল হতেই হবে। তাই না?”

আমিও ভেবে দেখি। কথাটা ভুল নয়।

—”রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথা না বুঝলে গানটা তো পুরোই ওয়েস্টেড অন দি অডিয়েন্স!”

কী যেন বলছিল? মেয়েটার ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বরে একটা মাদকতা আছে। কথা শুনতে শুনতে, হঠাৎ কথার বদলে শুধু কণ্ঠস্বরের ওঠাপড়াতেই মনটা আটকে থাকে। কথাগুলো ভেসে যায়। হঠাৎ শুনলাম বলছে,—”রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই যে এই অডিয়েন্সের। এখানে কাকে শোনাবো?”

হঠাৎ আমার কানে শব্দ করে বেজে উঠল বাক্যটি।

কাকে শোনাবো?

অর্থাৎ মনের মতো শ্রোতা পেলেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো এই ব্লু—জীনস আর সরু—সাদা—ট্যাঙ্ক—টপ— গেঞ্জিপরা এলোকেশী—রূপসী, যাকে আমি হিস্পানিক ভেবেছিলাম। সারা সন্ধ্যা নিশিরাত অবধি যে অকাতরে ফ্লার্ট করে চলে নিত্য নতুন সঙ্গীকে নিয়ে, সে দুঃখ করছে এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবহ নেই বলে। নকল কথা মনে হয় না।

মেয়েটাকে আজ যেরকম দেখছি তাতে ওর সব কথাই গ্রাহ্য মনে হচ্ছে।

একটু ইতস্তত করে বলে ফেলি—”আমাকে শোনাবেন?”

এবারে ঠোঁট ছড়ানো হাসি নয়, হেসে ফেলল খিলখিলিয়ে। বাচ্চা মেয়ের হাসি। চেহারার সঙ্গে মিললো না হাসিটা। ফ্লার্ট করাটা আজ অফ করে রেখেছে। কল খোলবার মতন ওটাকে ও বোধহয় খোলে বন্ধ করে।

দুই চোখ কপালে তুললো মেয়ে। যেন কোনো আজব আবদার শুনেছে এবং ওর চোখদুটি লক্ষ্য করলাম। বাদামী, দীর্ঘপক্ষ্ম, নরম চোখ।

—”আপনাকে? এখানে? ধ্যাৎ! মাত্র একজন মানুষের জন্যে গান গাওয়া মুশকিল এইসব জায়গায়, যদি না পরিচিত গান হয়।”

—”এখানে কেন? অন্য কোথাও। মাঠের মধ্যে। নদীর ধারে। গাছের তলায়। বাগানে। আমার বাড়িতে। ইচ্ছে থাকলে কি জায়গার অভাব?”

মেয়েটা এবার গম্ভীর হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় মাপছে। মাপ নিচ্ছে। বুঝতে চেষ্টা করছে আমাকে। এর উদ্দেশ্য কী?

কী চায় লোকটা?

গানই, না আর কিছু? ওর চোখ দেখে মনে হলো এইসব কথাই ভাবছে।

—”কী ভাবছেন? আমি লোকটা কেমন? কী করি? কেন গান শুনতে চাইছি? এইসব কথা তো? গায়ে—পড়ে বাংলা গান গাইতে বলছে, লোকটার আলটিরিয়র মোটিভখানা কি?

”আচ্ছা বলছি শুনুন। রিল্যাক্স! কোনোই গভীর উদ্দেশ্য নেই আমার। এমনিই বলছি। গান শুনলাম, ভালো লাগলো, আরো শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে, ব্যাস এটুকু।

”দেখা হয়ে গেল, তাই এতবড় শহর নিউ ইয়র্ক, এতবড় এই গ্রহে ক’টা মানুষের সঙ্গেই বা দেখা হয় আমাদের? এখন না গাইতে ইচ্ছে করে এক্ষুনি গাইতে হবে না। যেদিন আপনার নিজের ইচ্ছে করবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে কাউকে শোনাতে সেদিন আমার কথা মনে করবেন। হাউ অ্যাবাউট দ্যাট?”

আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। এখনও মাপ নেওয়া শেষ হয়নি।

আমি পকেট থেকে কার্ডটা বের করি। এগিয়ে দিই ওর দিকে টেবিলের ওপর দিয়ে। কেতকী তুলে নিল। চোখ বোলালো।

—”ফোন করে যদি বলি, কেতকী বলছি। চিনতে পারবেন?”

—”অতি অবশ্যই। ওই নামে আর কোনো মেয়েকে চিনি না। কেটি—কে ছাড়া।”

—”কেটি কে?”

—”শেষের কবিতার।”

—”সেটা কি?”

—”ঈশ… ‘শেষের কবিতা’ জানেন না?”

—”আমি বাংলা কবিতা কিছুই জানি না—”

—”এটা কবিতা নয়, নভেল। রবীন্দ্রনাথের লেখা।”

—”স্যরি পড়িনি। বাংলায় আমি গান ছাড়া কিছুই পড়িনি। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’ জানি, ওটাই পড়েছি।”—

কার্ডটা টাইট জীনসের পকেটে গুঁজলো। একদিকে বেঁকে গিয়ে, অল্প উঠে দাঁড়িয়ে, বেশ কায়দা করেই গুঁজতে হলো। হাতে কোনো ব্যাগের বালাই নেই। ও—কার্ড অবশ্যই হারিয়ে যাবে। গাঁজার সিগারেট রোল করার সময়ে পকেট থেকে বেরিয়ে বাইরে পড়ে যাবে।

কেতকীর ফোন নম্বরটা চাইবো কি চাইবো না মনস্থির করে ওঠার আগেই ও উঠে পড়লো। ওয়াইনের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে অল্প হাত নেড়ে, হেসে বললো, ”দেখা হবে”, তারপর উড়ে চলে গেল ওর বন্ধুদের মধ্যে।

হাত নাড়বার সময়ে ঝুনঝুন শব্দ হলো। লক্ষ্য করলাম হাতে অনেকগুলো রুপোর চুড়ি। কানে দীর্ঘ, ঝিরিঝিরি, ফিলিগ্রি রুপোর দুল।

একটু পরেই গান শুরু হলো কেতকীর।

—”দোজ ওয়্যার দ্য ডেজ মাই ফ্রেন্ড। থট দে’ল নেভার এন্ড—” জ্যানিস জপলিনের সেই মনকেমন করানো গান। জপলিনের অসামান্য গলায় এই গানটা শুনলে আমার যেখানে যত জমা হওয়া কান্না আছে, এসে গলার কাছে দানা বাঁধে, জমা হয়। কীভাবে মারা গেল, সত্যি, কত অসময়ে, অত গুণী মেয়েটা! এই ড্রাগের নেশাই ষাটের দশকের গাইয়েদের শেষ করলো। ষাট কেন? চল্লিশ বছর বাদেও কি তার দাপট কমেছে?

কেতকীর গলায় মাধুর্যের সঙ্গে বেশ জোরও আছে, মধুঢালা গলা নয়, অস্পষ্ট ভাঙা ভাঙা, বেশ একটা চরিত্র আছে ওর কণ্ঠস্বরের। রবীন্দ্রসঙ্গীতের চেনা গলার মতো এটা নয় ঠিকই—তবে এ—গলায় যা গাইবে, মাত করে দেবে। মাতাল করবার মতো একটা ব্যাপার আছে ওর গলায়। কথা বলবার সময়েও সেটা বোঝা যায়। একেই বলে, ‘মাদকতাপূর্ণ?’

দূর থেকে তাকালে ওর মধ্যে বাঙালিয়ানা চোখে পড়ে না। হিস্পানিক মনে হয় সত্যিই। শুধু কাফে—র নাম ”এল কামিনো” বলেই আমার এমন মনে হয়নি।

‘দোজ ওয়্যার দ্য ডেজ’—এর আকুল টান থামতে না থামতেই লাগলো আর এক চমক। দ্রুতলয়ে শুরু হয়ে গেছে বাংলা গান। কোন গানটা? ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়—ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়…”

‘দোজ ওয়্যার দ্য ডেজ’—এর শেষদিকে বাইরে এসেছিলাম ফ্রেশ এয়ার নিতে। এটা শুরু হতেই দুদ্দাড় করে ভিতরে ঢুকে পড়ি। এ গানের শ্রোতা তো একা আমিই। মাইক নিয়ে দুলে দুলে গাইছে মেয়েটা।

দিব্যি নাচছেও দেখলাম কয়েকজন এই গানেরই সঙ্গে। নামেই রবীন্দ্রসঙ্গীত, সুরটি তো স্কটল্যান্ড থেকে ধার করা। গাইতে গাইতেই আমার দিকে অন্য হাতটা তুলে দোলালো কেতকী, যেন একটা পাখিকে বাতাসে ছেড়ে দিলে। যাও গান, তোমার দেশের মানুষের কাছে যাও।

গানে গানে রাত গড়িয়ে চলল ভোরের দিকে।

কেতকী স্টেজ থেকে নেমে আসতেই আমি এগিয়ে গিয়ে অভিনন্দন জানাই। এবং ধন্যবাদ। আরো অনেকে ঘিরে ধরলো ওকে। ক্লান্ত হয়তো দেখাচ্ছিল একটু—কিন্তু শ্রোতাদের সমবেত অভিনন্দনে ঝলমল করছিল মেয়েটা। আমি একটু ফাঁক পেয়েই বলি—”শুক্রবার রাতে কী করছেন?”

—”কেন?”

—”আমার সঙ্গে ডিনার খেলে খুব খুশী হবো।”

—”কী খাওয়াবেন আগে বলুন শুনি?”

—”কী খেতে আপনি ভালোবাসেন?’

চোখ বুজে, হাসিমুখে এক মুহূর্ত ভেবে উত্তর দিল,—”ইন্দোনেশিয়ান খাবার।”

—”বেশ। ডান। ইন্দোনেশিয়ান ডিনারই হবে শুক্রবার।”

—’রেস্তরাঁ চেনেন? কোথায় বলুন তো?”

—”শুক্রবার জানতে পারবেন। নিউ ইয়র্ক সিটির ম্যানহ্যাটন দ্বীপেই খাওয়াবো আপনাকে—জাকার্তায় নিয়ে যাবো না।”

মেয়েটা দুষ্টু হেসে বলল, ”ঈশ! যাবেন না? আমি তো ভাবলাম জাকার্তা যাব। কিন্তু প্রবলেম আছে। শুক্রবার, শনিবার, রবিবার—এই তিনটেই তো আমার গান গেয়ে দু’পয়সা রোজগারের দিন—বরং আপনি অন্যদিনে ডিনার খাওয়ান না কেন? উইক—ডে—তে হয় না?”

—”আমি তো ডাক্তার। জানেনই তো কেমন শেডিউল—সারা সপ্তাহটাই ভীষণ ব্যস্ত থাকি। ওই শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই আমার সময় ফাঁকা হয়। তাহলে আসুন এক কাজ করি। আপনার গানের পালা সাঙ্গ হলে, তারপরে চলুন ডিনার খেতে যাবো—”

—”সে তো অনেক দেরি—তখন সব রেস্তরাঁ—”

—”একটু তাড়াতাড়িই শেষ করবেন না হয় সেদিন—”

—”তাড়াতাড়ি মানেও একটা—দেড়টা—গান তো শুরুই হবে ন’টার পর। দশটায়। লুক, উই কুড গো ফর আ ড্রিংক, ডিনার থাক না—”

—”না। তাহলে আগে। ছ’টায় ডিনার খাই চলুন, ন’টায় চলে আসবেন। হাউ অ্যাবাউট দ্যাট?”

—”দ্যাটস বেটার।”

—”ডান। শুক্রবার সন্ধ্যা ছ’টায় আমি আপনার জন্য এইখানেই অপেক্ষা করবো। ঠিক আছে?”

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কেতকী বলল—”ঠিক আছে।”

.

শুক্রবার সন্ধ্যাটা খুব ভালো কাটলো। ঠিক সময়ে আসেনি অবশ্য। আধঘণ্টা বসেছিলাম একটা কফি নিয়ে, তারপরে এলো। সেই জীনস আর গেঞ্জি, আজ পরেছে সাতরঙা ডুরে গেঞ্জি, হাতকাটা পেটকাটা। কাঁধে দেখলাম লম্বা স্ট্র্যাপ থেকে ঝুলছে ছোট কালো একটা ব্যাগ, তাতে নানা রঙের পুঁতি বসানো। চুল খোলা। ভাগ্যিস বিনুনি বেঁধে ফেলেনি। ওর এই খোলা চুলটা দেখে দেখে যেন আশ মেটে না। অনেক রহস্য, অনেক মায়া মাখা।

‘গরুড়’—এ খেলাম, ওর সাধের ইন্দোনেশীয় ডিনার। খেতে দিব্যি ভালোবাসে কিন্তু খায় নামমাত্র। খিদে থাকবে কেন, চেইন স্মোকার যে! এমনিতেই এত রোগা—মুখখানি ঢলঢলে বলে বোঝা যায় না।

—”আমি চিরকালই রোগা, কোনো কালেই মোটা হইনি—ছোটমাসি চেষ্টা করত ছুটির সময়ে খুব খাইয়ে, মোটা করে দিতে। হস্টেলে থাকতাম তো সারা বছর?”

ছোট্ট থেকেই হস্টেলে হস্টেলে ঘুরছে। প্রথমে কার্শিয়াঙ, মিশনারীদের বোর্ডিং স্কুলে, তারপর দিল্লিতে, মিরান্ডা হাউসে। সেখান থেকে নিউ ইয়র্কে। কলাম্বিয়ায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। কলাম্বিয়াতে এসে শেষ অবধি গ্র্যাজুয়েট স্টাডি সম্পূর্ণ করেনি। এম.এ.—টাও নেয়নি। না, ও পড়ছে না। পড়বে না।—কলেজে যাবে না আর মোটে। পড়াশুনো ওকে টানে না। যখন টেনেছে তখন পড়েছে। ভালো ছাত্রীই ছিল চিরদিন। এদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছিল। সে স্কলারশিপ কবেই খতম, পড়ার পালাও গেছে চুকেবুকে। বাবা কিছুদিন পড়ার খরচ চালিয়েছিলেন, তারপরে মেয়ে পড়ছে না বুঝতে পেরে বন্ধ করে দিয়েছেন। পড়াশুনোর খরচ না দিলেও জীবনধারণের জন্য খানিকটা টাকা পাঠিয়ে যাচ্ছেন এখনও। নিয়মিত ব্যাংক থেকে ব্যাংকে টাকা এসে যায় বাবার কাছ থেকে। কিন্তু যোগাযোগ রাখেন না। ওই টাকাটুকু দিয়েই তাঁর পিতৃত্বের দায় সম্পূর্ণ। মেয়ে কীভাবে বেঁচে আছে, কেমন আছে, সে বিষয়ে বিশেষ উৎসাহ নেই তাঁর।

ওই টাকাটুকুতে আজকাল কেতকীর আর চলে না। মাঝে মধ্যে বাবাকে ফোন করে টাকা চাইতো, বাবা জানিয়ে দিয়েছেন দেবেন না। আর বাবাকে ফোন করে না। তিনিও শুধু জন্মদিনের দিন নিয়মরক্ষার ফোন করেন। তাছাড়া নৈঃশব্দ্যই সেতু। বাবার বিরক্তি অতি স্পষ্ট।

বাবা বোঝেন না কেতকীর তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা লাগে। গান গেয়ে খানিকটা ওঠে। দোকানে পার্টটাইম চাকরি করে খানিকটা। না, দেশে ফিরবে না। কার কাছে ফিরবে? বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে মনে হলো না। মা যখন মারা যান, তখন ও খুবই ছোট; বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীও এসেছেন তখনই। কিন্তু তিনি ”বাবার সেকেন্ড ওয়াইফ” থেকে গেছেন। মা হননি দেখা গেল। বয়েস কত হবে মেয়েটার? পঁচিশ—ছাব্বিশ? খুব ছোটমাসির গল্প করছিল। হস্টেলের ছুটিতে ও বাবার কাছে যেত না, ছোটমাসির কাছেই যেত। বাংলা গান বাংলাভাষা সেখানেই শিখেছে, ছোটমাসি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। সেই ছোটমাসি, ছোট মেসো একসঙ্গে মোটর দুর্ঘটনায় চলে গেছেন। কেতকী তখন এদেশে। শেষ দেখা হয়নি।

—”আই হ্যাভ নোবডি দেয়ার—নট রিয়্যালি—”

—”তুমি দেশে ফিরবে না?”

—”দেশে? হোয়াই?” অবাক চোখে আমার চোখে তাকিয়ে আমাকে বলেছিল কেতকী, ”আই হ্যাভ নো ওয়ান টু গো ব্যাক টু ইন ইনডিয়া—”

ঠোঁটের ‘জিতান’ সিগারেটে দীর্ঘটান দিয়ে কড়া রোস্টেড টোবাকোর পুরুষালী গন্ধের ধোঁয়া ছেড়ে, গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইলো জানলার বাইরে চোখ মেলে। আমিও অবোধ হয়ে ”কেন, তোমার বাবা?”—নিরুত্তর প্রশ্নটা করলাম না।

—”বাট আই নো আই ডু নট বিলং হিয়ার আইদার।” কেতকী চোখ ফিরিয়ে আনলো ঘরের বাস্তবতায়।—”দিস ইজ নট মাই হোমল্যানড, ইট নেভার ক্যান বি…”

ঘর খোঁজার চেষ্টাও করেনি কেতকী, বাসা বেঁধেছিল চির প্রবাসে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *