১৪) দ্বিতীয় পর্ব
গিধনি এসে গেছে। কস্তুরী বুক ভরে শ্বাস নিয়ে জিপ থেকে নেমে দাঁড়ালেন। দলমা পাহাড় দেখা যাচ্ছে অদূরে, তবে নিশ্চয়ই খুব কাছে নয়। এ জায়গাটায় বেশ জঙ্গল আছে, খেতও যথেষ্ট। ইনসপেকশন বাংলোটি খুব পুরনো পুরনো মতো। যেন অনেক দিন ব্যবহার হয় না। চৌকিদার হাত জোড় করে এসে দাঁড়াল—ডি এফ ও সায়েব ফোন করেছেন। আপনাদের দু’খান ঘর রেডি রেখেছি। কী খাবেন আজ্ঞা? মুরগি ভাত?
—আমি ভেজ, নিরামিষ খাই—যা হোক দেবে—কস্তুরী হুকুম করলেন, তুমার নাম কী?
—আজ্ঞা রতন, রতন কিস্কু।
—সাঁওতাল?
—যা বলেন মা।
—কেনো? যা বুলবো কেনো, তুমি যা তাই বুলবো!
ভয়েভয়ে লোকটি বলল—রান্না সব আমিই করি।
—করবে। লোকে তুমার হাতে খায় না, নাকি?
—খায় মা, আবার কারও কারও কদাচিৎ আপত্ত থাকে! তাই জিজ্ঞেস করে নিই। এই দিদিমণিরা, এখন কী খাবেন!
—এখন খাবার কী আছে রতন? শিখরিণী জিজ্ঞেস করল।
—রতনদা, চা পাওয়া যাবে তো? এই তোরা মুড়ি খাবি?
ঠিক হল মুড়ি আর চা—ই প্রশস্ত এখন। বিকেল মরে এসেছে। জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে, জামাকাপড় পালটাতে সময় লাগল।
কস্তুরী বললেন, আমি একটু বেরোব।
—এই অন্ধকারে?
—এখুনও তো আলো আছে। কেমন অদ্ভুত শোনাল ওঁর কথা। যেন উনি আর কিছু বলতে চাইছেন।
কাজল কিছু বলল না, খালি তার পাঁচ সেলের টর্চটা নিয়ে রেডি হল।
—তুমি কুথায় যাবে? কস্তুরী সন্দিগ্ধ করে বললেন।
—আপনার যেমন কাজ আছে, আমারও তেমন একটু কাজ আছে দিদি।
—সে কাজ কী? আমার পিছন পিছন আসতে নিতাইদা বলে দিয়েচেন?
—না। আমার নিজস্ব কাজ। কৌতূহল। আপনি আলাদা যেতে পারেন। কিন্তু এই পাথুরে রুক্ষ জায়গায় যদি চোট পান, আপনার আসল কাজ তো হবে না দিদি।
বাংলোর বাইরে বেরিয়ে উনি বললেন, কী আমার আসল কাজ? তুমি আমার চে বেশি ভাল জানো মনে হচ্চে।
খুব অবভিয়াস দিদি যে আপনি কাউকে খুঁজছেন, আপনার অতীতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। এইসব জঙ্গলমহলে তেমন কাউকে যদি আপনি খুঁজতে চান, আমার সাহায্য ছাড়া পারবেন না। আমি আফটার অল লোক্যাল লোক, এদের নিজেদের লোক। আমার কাছে ওপন—আপ করবে, আপনাকে কিছুই বলবে না।
হঠাৎ সেই আধা—অন্ধকারে কাজল বুঝতে পারল কস্তুরী কাঁপছেন। তারপর ওই ব্যক্তিত্বময়ী দুঁদে সমাজসেবিকা, ঝানু ব্যাবসাদার, মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলেন।
—কাকে খুঁজছেন দিদি! আপনার ছোটবেলার চেনা কোনও প্রিয় বিপ্লবীকে? আমাকে বলুন। আমি কাউকে বলব না। যথাসাধ্য চেষ্টা করব খুব কোয়ায়েটলি পাত্তা করতে। য়ু ক্যান ট্রাস্ট মি।
বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলেন উনি। তারপর নিজেকে সামলে ধরাধরা গলায় বললেন, য়ু নো হোয়ট কাজল! য়্যু ক্যান বি আ ফাইন ফ্রেন্ড, সো কেয়ারিং অ্যান্ড কমপিটেন্ট। অন্ধকারে কাজল হাসল, বলল, বুঝতে এত দিন সময় নিলেন দিদি? আমারই ভুল। সম্পূর্ণ একজন আউটসাইডারকে আপনি কী করে বিশ্বাস করবেন!
—না কাজল, ভুল আমারই। জেদ, বহোৎ জিদ্দি হুঁ ম্যায়। অ্যান্ড ইগো। আই সি আই হ্যাভ টেরিবল ইগো।
কাজল কিছু বলল না। অন্ধকার টর্চের আলোয় চিরে পথ ধরে দু’জনে খানিকটা এগোলেন, একটা শাল গাছের তলায় মোটামুটি বাঁধানো বেদি। কাজল বলল, এইখানে এদের গরাম দেবতার থান দিদি, শাল গাছের তলায় দেখছেন কত্ত আতপচাল পড়ে আছে? আরও কিছু থাকতে পারে, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। এখানে একটু বসুন।
—না না, দেবতা আছেন। রাগ করলে?
—কে রাগ করবেন? দেবতা? দেবতারা রাগ করেন না, আপনি জানেন না দিদি? রাগ মানুষই করে। যাদের থান তারা এখন এই মহুয়া শালের জঙ্গলের মধ্যে কোথায় তাদের ছোট্ট গ্রাম আছে সেইখানে ঘুমোনোর তোড়জোড় করছে। দেখতে আসছে না কে তাদের গরামথানে বসল, কি না বসল।
সে একটা বড় রুমাল বিছিয়ে দিল।
—তুমি?
—আমিও বসছি। আমার এই জিনস হল সর্বংসহা। জাস্ট একটু ঝেড়ে নিলেই হাঁসের পাখা থেকে জলের ফোঁটার মতো পড়ে যাবে। কাকে খুঁজছেন দিদি? আপনার মা?
চমকে উঠলেন কস্তুরীবেন।
—আপনার মা কি বাই এনি চান্স আদিবাসী ছিলেন?
—এ কোথা কেনো মনে হল?
—এই জায়গায় তাঁকে খুঁজতে এসেছেন বলে। এইসব জঙ্গলমহলে ট্রাইব্যালরা ছাড়া আর কেউ বাঁচতে পারে না দিদি। দু’বেলা পেটে অন্ন নেই। ইঁদুর, গোসাপ, ঢ্যামনা সাপ যা পায় জাস্ট পুড়িয়ে খায়। বনের মধ্যে কেঁদ পাতা তুলে বিক্রি করত। কেঁদ পাতায় বিড়ি হয় তো! তো সরকার তা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন তুললে বেচতে হবে সরকারকে, অনেক কম দামে। কাঠকুটো কুড়োয়, মাইল মাইল দূরে হাটে বিক্রি করে যেটুকু পয়সা পায় তেল নুন, কখনও কখনও চাল কিনে আনে। সন্ধেবেলা হয়তো পৌঁছোল তারপর কাঠকুটো জ্বেলে রান্না হবে। স্রেফ ভাত নুন, আর শাক পেলেই যথেষ্ট। তার ওপর বন থেকে খুঁড়ে কাঁটা আলু, চুড়কা আলু কি বাঁউল্যা আলু পেল তো রাজভোগ। সারাদিন পরিশ্রম। তারপর বাড়িতে বাড়িতে হাঁড়িয়া পচুই হয়, বড়রা সেই নেশায় মেতে যায়, সব—ভোলা নেশা, ছোটরা ঘুমিয়ে পড়ে। এর মধ্যে সভ্য জগতের কোনও মহিলা বাস করবেন—বিশ্বাস করা যায় না। সম্ভব নয়। তাই বলছিলাম…
—আমার মা বাঙালি, কাজল। আমার সমুস্ত শিক্ষা তাঁর কাছে। আমি তখন আবছা বুঝতে পারতুম, এখন পরিষ্কার দেখতে পাই শি ওয়জ অ্যান এক্সেপশন্যাল উওম্যান। ওঁরা, ওঁদের জেনারেশন। প্রি—ইনডিপেডেন্স। ওঁরা বহু আশ্চর্য মানুষের কাছে কাছে এসেছিলেন। আমি যতদূর বুঝি, ওঁরা পথ খুঁজছিলেন, কী ওঁদের কাজ হবে স্বাধীনতার পোরে। আমি সেসব কোথা কিছুই বুঝতাম না। খালি আই ইমবাইবড দা অ্যাটমসফিয়ার। খুব হ্যাপি, উৎসাহ ছিল। মা ছিলেন সেন্টার, বাবার কাচে শুনেচি—ওঁরা পার্টিশন আর দাঙা দেখে এতো শকড হয়েছিলেন, যে প্রথমটা বুদ্ধি কাজ করেনি। তারপর দে ওয়েটেড ফর সুভাষচন্দর টু কাম ফর আর লং টাইম, ইভন আফটার দা রিউমর অব প্লেন ক্র্যাশ। ওঁরা নিজেদের রেডি করছিলেন এই পার্টিশন চলে যাবে আবার ভারতে শান্তি ফিরে আসবে। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে…গাঁধীজি যে বলেছিলেন গ্রামে চলে যাও শিক্ষা বিস্তার করো—সেকথা কাজ করছিল, জওহরলাল যে ইনডাস্ট্রির কথা বলছিলেন, ওঁরা তাতে উৎসাহ পাচ্চিলেন, কিন্তু পুরা নয়। তারপর ফিফটিজ—এ আরও দাঙা হল। দে ওয়্যার ব্রোকন—হার্টেড। বাবা—মা’র মধ্যে কী হল জানি না, কিছুদিন ধরে হচ্চিল, টের পাচ্চিলাম। একদিন সকালে উটে মা দেখতে পেলাম না। কেউ খুঁজল না। বাবা দেখলাম খুব রাগ। আমাকে নিয়ে আমদাবাদ চলে গেলেন। ভেঙে গেল সোব আসর, ভাবনা—আদর্শ। …আমার জীবন। লেখাপড়া করলাম, বিজনেস। বাবাকে খুব ভাল বাসলাম। কিন্তু মা’র কোথা তুললে তিনি, আমার দাদা, দাদিমা সব খুব বিরক্ত হোতেন।
—এখন? এখন আপনার বাবা কিছু বললেন না?
—এখন? হি হ্যাজ পাসড অ্যাওয়ে।
—কোনও হিন্ট দেননি? কোথায় তিনি থাকতে পারেন? কেন বিচ্ছেদ হল?
—নাঃ, হি হ্যাড আ স্ট্রোক, আফটার দা ফার্স্ট স্ট্রোক উনি কীরকম হয়েছিলেন। ভাবনা করতেন, চুপিচুপি কাঁদতেন, আমি জিজ্ঞেস করেচি হোয়ট ওয়াজ বদারিং হিম। কিচু বলেন না। ডাক্তার বললেন সেরিব্র্যাল স্ট্রোকের পর এর্কম হয়। কন্ট্রোল থাকে না। সেকেন্ড স্ট্রোকের পর উনি চলে গেলেন। কাজল, দেন অ্যান্ড দেয়ার আই ডিসাইডেড, আই’ল প্রেব দিস মিস্ট্রি।
কাজল অবাক হয়ে রইল অনেকক্ষণ। একজন বাঙালি ভদ্রমহিলা হঠাৎ গৃহত্যাগ করলেন, তাঁর খোঁজ করল না কেউ, আজ এত বছর পর তাঁকে তাঁর মেয়ে খুঁজতে এসেছেন এই পশ্চিমবঙ্গ—ঝাড়খণ্ড বর্ডারে? সে নিজেও একদিন পালিয়েছিল। কিন্তু সে ছিল বাচ্চা। যখন বড় হল, উন্নত জীবনের স্বাদ পেল, তখনও তার নিজের মানুষদের খোঁজে যাওয়ার সুযোগ ছিল, ফাদার মরিসন এবং পরে দেওঘরের হৃদয়াত্মানন্দজি যখন নিশ্চিন্ত হলেন যে সে আর আদিম জীবনে ফিরে যেতে চাইবে না, তখন তাকে একরকম আদেশই করেছিলেন—মায়ের সঙ্গে বাবার সঙ্গে দেখা করে আসতে। সে তখন কোনও পিছুটান অনুভব করেনি। মা বলতে তখন তার চেতনায় ঢুকে গেছে রাফেলের মেরি, রামকৃষ্ণ মিশনের সারদা মা, নিবেদিতা। সে নিজেকে হাঁড়িয়া খেয়ে চুরচুর, শেষের দিকে তো দিনে রাতে সব সময়ে, সেই বাসন্তী মুণ্ডার সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত মনে করতে পারত না। আজও পারে না। একটা নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতি আছে। সেই ট্রাইব্যাল গ্রাম। গরাম—থান, করম পূজা, শিকার খেলা, সেই হতদরিদ্র ও হতকুৎসিত পাড়া।
উন্নত জীবন থেকে কলকাতার সবচেয়ে ভাল জায়গার তিনের এক ফার্ন রোড স্বাচ্ছন্দ্য, আদর্শ, স্বামী এবং বন্ধুদের সঙ্গে মতামতের আদানপ্রদান, ছোট্ট একটি মেয়ে এইসব ছেড়ে এই আদিম পৃথিবীতে?
সে বলল, কী করে আপনার ধারণা হল তিনি এদিকে এসেছেন? যাঁদের সঙ্গে দেখা করছিলেন, তাঁরাই বললেন?
উনি মাথা নাড়লেন, চাঁদ উঠছে, পরিষ্কার সামন্তভূমির চাঁদ। সেই আলোয় সে দেখল—ওঁর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও পড়ল।
কস্তুরী বললেন, ওঁরা কেউ কেউ হিন্ট দিলেন মা আর সুধাকাকু একসঙে এসেচেন। তাইতে বাবার রাগ—অভিমান আমি বুঝতে পারি। আই কান্ট চেঞ্জ দা পাস্ট। কিন্তু মাকে এক্সপ্ল্যানেশন দিতে হবে—তিনি একটা ছোট মেয়েকে ফেলে, স্বামীকে ফেলে এসেচিলেন।
এতক্ষণে ছবিটা স্পষ্ট হল কাজলের কাছে। সেই চিরন্তন ত্রিকোণ। তৃতীয় ব্যক্তি, কখনও পুরুষ, কখনও নারী। আদর্শ, মায়া, মমতা, প্রেম, বন্ধুত্ব সমস্ত কিছু শেষ পর্যন্ত এই ভয়ানক ত্রিকোণের সামনে এসে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে যায়। তাই এত ক্রোধ, এত জেদ, এত অশ্রু। এবং তাই সবকিছু এরকম জীর্ণ বাসের মতো ফেলে যাওয়া। সে নিরুত্তর বসে রইল। অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ। চাঁদ উঠল শালগাছের মাথায় মাথায়। সেদিকে তাকিয়ে তার মনে হল—এই ব্যাখ্যাতীত—এই—ই কি তবে প্রেম? যার জন্য সব ত্যাগ করা যায়! তার সমস্ত সত্তার মধ্যে একটা আলোড়ন যেন একটা প্রশ্নের মতো মাথা তুলল। সে কি এই প্রেম জানে না? কোনওদিন জানবে না? সে সত্যিই এখনও বোঝে না প্রেমের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়। ক্ষোভ, ঘৃণা, জিদ, কাজ, এখনও পর্যন্ত তার মনোলোক এই দিয়েই ভর্তি। কোনওরকম সেন্টিমেন্টের জায়গা সেখানে নেই। কিন্তু হঠাৎ সে পরিষ্কার বুঝতে পারল—পালচৌধুরী বাড়ির ওই সুন্দরী মেয়েটি কেন এই নিরুদ্দেশযাত্রায় শামিল হয়েছে। আসবার জন্য ও মরিয়া ছিল। ও কাজলকে চায়। এসব নিয়ে কাজল বাস্তবিকই কোনওদিন কিছু ভাবেনি, নিজের সমাজের কাউকে ও কোনওদিন চাইতে পারবে না। এটা নিশ্চিত। কিন্তু হিন্দুদের বাড়ির একটি সুন্দরী শিক্ষিত ব্যক্তিত্বশীল মেয়ে, তার জন্য একটা ত্যাগ করতে প্রস্তুত হবে সে কখনও ভাবেনি।
তার অস্তিত্বই ছিল কাজের মধ্যে। সারা পৃথিবীর আদিবাসীদের ইতিহাস, ভূগোল, মনস্তত্ত্ব, পুরাণ, বঞ্চনা, কেন তারা আটকে গেল পাথরের ফাঁকে বহতা নদীর নুড়ির মতো? নদী বয়ে চলে গেল, পাথরের নুড়ি পড়ে রইল সেই এক জায়গায়। ক্রমে শ্যাওলা জমল। ঘন কালচে সবুজ শ্যাওলা, তার তলায় লুকিয়ে থাকতে থাকতে একদম ভুলে গেল নুড়ি তার জন্মকথা। তাকে কোথাও যেতে হবে, যাবার কথা ছিল। স—ব। এখন তার কাজ চলছে আমেরিকায় আদিবাসীদের নিয়ে। অ্যাকোমা, থাকত নিউ মেক্সিকোয় গ্যালাস ও অ্যালবুকার্কের মাঝামাঝি ৬০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের ওপর প্রাচীনতম জনবসতি। শহরটিকে ইস্পাহানিরা আশমান নগর বা স্কাই সিটি নাম দেন তার মনে পড়ল অ্যালগনকুইয়ানদের কথা, উত্তর আমেরিকার বৃহত্তম গোষ্ঠী, যার মধ্যে বিভিন্ন উপজাতির মানুষ রয়েছেন। আটলান্টিক থেকে রকি পর্বতমালা পর্যন্ত এঁরা ছড়িয়ে রয়েছেন।
পশ্চিম ওরেগনের সিলেৎজ উপজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অ্যাপাচে ইন্ডিয়ানরা তো খুব বিখ্যাত। ‘আপাচু’ মনে শত্রু। এঁরা কিন্তু নিজেদের ন’দে বা দিনেহ বলেন, যার অর্থ জনগণ। ঠিক যেমন তারা সবাই—সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাওঁ, হো, লোধা, শবর সব্বাই নিজেদের ‘হড়’ অর্থাৎ মানুষ বলে—শুধু বিরহড় নয়। পুরাকালে ‘ঘেরওয়াল’ বা বনবাসী থাকার সময়ে সবাই ছিল হড়। কোনও সময়ে এদের মধ্যে কিছু বনচর হনুমান খেয়ে ফেলায় জাতিচ্যুত হয়। সম্ভবত শবর, খেড়িয়া, লোধারা। কুর্মিরা হিন্দু হয়ে গেল, সাঁওতালরা এঁদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসর, মুণ্ডারাও পিছিয়ে নেই। কিন্তু তার জন্মপল্লিতে দারিদ্র্য, অশিক্ষা আর হাঁড়িয়া খাওয়ায় মুণ্ডারা লোধাদের মতোই তো ছিল। কথিত আছে এঁরাই নাকি রাবণরাজার বিরুদ্ধে রামচন্দ্রকে সাহায্য করেন। ফাঁকাতে থাকত এই হড় জাতি, পাহাড়ে জঙ্গলে, কিন্তু জমি পরিষ্কার করলেই দিকুরা নিয়ে নিত। দীর্ঘদিন পরস্পরের প্রতি তারা ঘৃণা জিইয়ে রেখেছে, প্রকৃতপক্ষে কে—ই বা তাদের বন্ধু, না সাদা চামড়া, না দিকু, না, তুড়ুকরা। সবারই লক্ষ্য তাদের পরিষ্কার করা জমির ওপর খাজনা বসানো, কিংবা একেবারে নিয়ে নেওয়া। হরপ্পার দিন থেকে তারা আছে এবং ক্রমাগত তাড়া খাচ্ছে। তিলকা মাঝি, বা বীরসা মুণ্ডাও কিছু করতে পারেননি। সিদু—কানহোও না।
আচ্ছা, কুর্মিরা হিন্দু হয়ে গেল। কিন্তু করম পূজা, বাধনা, সারহাও সবই তো ওদের আছে! সঙ্গে সঙ্গে কালীপুজোর ফুটো ফুটো হাঁড়ির মধ্যে দীপ বসিয়ে আলোও তো জ্বালায়। ক্রিশ্চান হতে হলে অনুষ্ঠান লাগে, তুড়ুক বা মুসলমান হতে গেলেও, কিন্তু হিন্দু হতে গেলে কিছু লাগে না। কবে যে কে দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজাতে লেগেছে, কেউ খেয়ালই করে না। সঙ্গে সঙ্গে তুমি করম করো, পাঁচ বছর পরপর সিংবোঙার পুজো করো, কোনও অসুবিধে নেই। কোনও কোনও হাইওয়ের কাছে গরাম—থান তো বিখ্যাত। সবাই ওখানে মানত করে, মানে, পয়সা দেয়। সেখানে প্রধান পুরুত লোধা। ব্রাহ্মণ বসে লোধা পুরুতের নীচে।
শিখরিণী মেয়েটিকে সে হিন্দু বলল। কিন্তু নিজেকে তার থেকে কীভাবে আলাদা করবে ভেবে পেল না। তার গলায় ক্রস নেই, তার শুক্রবার নামাজ নেই। আসল কথা সে সম্পূর্ণ ধর্মমতহীন। শিখরিণী যদি চায়, তার সঙ্গে মিলিত হতে তার কোনও বাধা নেই। এবং হয়তো এমন মিলন ভাল। কেননা আর্য—অনার্য বিবাহের ফলে পরের প্রজন্ম আরও বুদ্ধিমান, আরও মৌলিক হয়ে জন্ম নেবে। দু’ধরনের জিন মিলবে উন্নততর জিন তৈরি করতে। সভ্যতা এগিয়ে যাক। উন্নততর মানুষ তৈরি হোক। আরও আরও মানবিক মানব, যেমন হবে তাদের উদ্ভাবন, মগজ, তেমনই হবে তাদের হৃদয়ের গুণ। আর দ্বিধাহীন মেশামেশির ফলে এক হয়ে যাবে সবাই। আলাদা করে এ আর্য, এ অনার্য ছাপ মেরে দেওয়া যাবে না। বাঙালিদের মধ্যে যেমন হয়েছে। শিখরিণী সম্পূর্ণ আর্য। খাড়া নাক, টানা চোখ, কাঞ্চনবর্ণ, পূর্বপুরুষের থেকে এই জিন পেয়েছে। তবে কোনও কোনও পরিবার অনেককাল ধরে মিশ্রণ থেকে নিজেদের সন্তর্পণে বাঁচিয়ে এসেছে। তাই সব গাঁই গোত্র, দক্ষিণ রাঢ়ি, উত্তর রাঢ়ি, তাই বৈদ্য, বারেন্দ্র। বৈদ্যরা যেমন অসম্ভব বুদ্ধিমান, ব্রাহ্মণ কায়স্থর মিশ্রণে হয়েছে। তাদের তো ব্রাহ্মণরা জাতিচ্যুতই করেছিল। শিখরিণীদের পরিবারেও হয়তো খুব গোঁড়া। কিন্তু মিঠুকে দেখলে বোঝা যাবে না, শিখরিণী যদি বাঙালি হয় তো সে—ও বাঙালি। মিঠু কালো। নাক খুব উঁচু নয়, আবার তার মতো থ্যাবড়াও নয়, মিঠুর চোখ বড় নয়। কিন্তু কী উজ্জ্বল! মিঠুর ঠোঁট পাতলা নয় একটু পৃথুল, কিন্তু ছোট। কপাল বড়, কোঁকড়া চুল, একটু তামাটে। মিঠু শিখরিণীর মতো না হলেও লম্বা। খুব সুগঠিত। কেননা, শরীরচর্চা খেলাধুলোর মধ্যে ও জীবন কাটিয়েছে। একেবারে বেতের মতো, স্প্রিঙের মতো লাফিয়ে ওঠে। কে জানে কী অতীত মিঠুর পরিবারের। ঊর্ধ্বতন তিন পুরুষ পর্যন্ত সাধারণত মানুষ জানে, তার আগে? তারও আগে? উত্তর ভারত থেকে আসা কোনও ব্রাহ্মণ এই বঙ্গভূমে কোনও সাঁওতালনি কি মুণ্ডানিকে ঘরে তুললেন। নিশ্চয়ই প্রচুর কোলাহল তুলেছিল সমাজ। তবে, তখন হয়তো পুরো বাংলাই জঙ্গলমহল ছিল। এখানে বুদ্ধ আসেননি, মহাবীর এসে তাড়া খেয়ে ফিরে গেছেন। সেই পাণ্ডববর্জিত মহলে একমাত্র ব্রাহ্মণ, কি সামান্য একদল ব্রাহ্মণ কী করেছিলেন না করেছিলেন ক্রুদ্ধ সমাজ—চোখ তার ওপর পড়েনি। তাই ব্যানার্জির ঘরে এমন কৃষ্ণা। তাদের নিজেদেরও তো স্বগোত্রে বিয়ে হয় না। স্বগোত্রের ছেলেমেয়ের ভাইবোনতুল্য। পারসিরা অন্তর্বিবাহ করেন, আজ তাঁদের লোকসংখ্যা এত কমে গেছে যে তাঁরাই ভয় পাচ্ছেন।
কস্তুরীবেন ভয়ে ভয়ে বললেন, কাজল, আমার মা যা—ই করে থাকুন, দেশকে, দেশের ভালবাসাকে ত্যাগ করেননি। তুমি নিউ জেনারেশনের ছেলে আমাকে মাকে ওল্ড ভ্যালুজ দিয়ে বিচার করবে না।
কাজল উঠে দাঁড়াল, কী বলছেন দিদি! তাই কখনও করতে পারি?
—তা হলে এতক্ষণ কোথা বলোনি। সিরিয়াস মুখে ছিলে, কেনো?
—আসলে আপনি তো বোঝেনইনি, এইসব জায়গা আমার নিজের জায়গা, ছোটবেলা। আপনার ছোটবেলা যেমন কলকাতা। আপনাকে সেখান থেকে চলে যেতে হয়েছিল আমদাবাদ গুজরাতে। দুটোই আপনার জায়গা হয়ে গেল। আমি কিন্তু ছোটবেলায় সাংঘাতিক কষ্ট পেয়েছি। সে একটা দুঃস্বপ্ন, আমি হয়তো জীবনেও ভুলতে পারব না। আমি নিজেই এখান থেকে পালিয়ে যাই, ক্রমে বাঁকুড়া ক্রিশ্চান মিশন হয়ে দেওঘর রামকৃষ্ণ মিশন। তারপর কলেজে পড়তে কলকাতা। তাই কলকাতাও আমার নিজের জায়গা, এই জঙ্গলমহলও আমার নিজের। এইসব ভাবছিলাম।
তো তুমি কী খুঁজো!
আমি তো কিছু খুঁজতে আসিনি দিদি, আপনার বন্ধু হয়ে এসেছি। আমার খোঁজ বইয়ের পাতায়, www ডট কম—এ, নানান ওয়েবসাইট। আমি রিসার্চ করছি। খোঁজ করছি এইভাবে। তবে এখন বুঝতে পারছি নিজেকে খোঁজা আমার বাকি রয়ে গেছে। আসুন, আর দেরি করবেন না। পোকাটোকা কোথায় কামড়াবে।