উজান-যাত্রা – ১

১) আমি তিনি ও সে

শুনেছি ওঁর বাবা গুজরাতের কটন কিং। ছিলেন, না এখনও আছেন, গত না জীবিত, অতশত জানি না। নিতাইদা পাঠিয়েছেন, ওঁকে নিতে এসেছি। হাওড়া—আমেদাবাদ এক্সপ্রেস পাক্কা সাত ঘণ্টা লেট। খোঁজখবর করে জানতে পারি নাগপুর পার হয়ে থেকেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসছে। ঠিক কী গোলমাল ওরা বলল না। সম্ভবত যান্ত্রিক। ভাল বাবা, খোঁড়াতে খোঁড়াতেই আসুক, দুর্ঘটনায় পড়ার চেয়ে ভাল। চারপাশে থিকথিক করছে লোক। অনেকেই এক্সপ্রেসটার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে খেপে যাচ্ছে। মুখ—খারাপ করছে খুব। কাজল সাধারণত চুপচাপ থাকে। তবে আজ ওর ভুরুতে কোঁচ ধরেছিল। পাশের ভদ্রলোককে বলল, আপনার কে আসছেন, জানতে পারি!

আরে আর বলবেন না—মেয়ে জামাই—বিয়ের পরে ফার্স্ট টাইম। এখন এই খচড়া দেশের খচড়া রেল তো কোনও কাজই টাইমে করে না!

কাজল ওঁর আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, সময়ে আসাটা ইমপর্টান্ট? না গোটা আসাটা?

মানে? কী বলতে চাইছেন?

যান্ত্রিক গোলযোগকে অগ্রাহ্য করলে যে—কোনও সময়ে অ্যাকসিডেন্ট ঘটে যেতে পারে, জানেন তো?

ভদ্রলোক কটমট করে চেয়ে ওর থেকে কয়েক গজ দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। মুখখানা কালো হয়ে রয়েছে।

অলুক্ষুণে কথা বলিস কেন রে? আমি বিরক্ত হই।

কাজল উত্তর দিল না, একটু পরে বলল, একটা বাজল, চল কিছু খেয়ে আসি।

রেলওয়ে রেস্তোরাঁটা সুবিধের নয়। তবু অনেক ডেলি প্যাসেঞ্জার, কাছাকাছি অফিস—টাইমের লোক এখানে খেতে আসে। আমরা মশলা ধোসার অর্ডার দিয়ে বসি। সেফেস্ট, যদি—না আলু পেঁয়াজের পুরটা অলরেডি গেঁজে গিয়ে থাকে। কাজলের ভুরুর কোঁচ ফিকে হয়েছে কিন্তু এখনও পুরোপুরি যায়নি। কাপড়টাপড় ইস্ত্রি করতে গেলে পয়লাবার ইস্ত্রি চালাবার পর যেমন হালকা একটা অমসৃণ ভাব থেকে যায়, তেমন।

বলল, দেশটা কার? রেলটা কার?

বুঝি, সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে ঝগড়ার দ্বিতীয় দফাটা আমায় শুনতে হবে।

নোংরা, লেট, চোর ঘুষখোর, অরাজক হলেই ‘এই দেশ’। কিন্তু হরগোবিন্দ খোরানা, অর্মত্য সেন, অরুন্ধতী রায় হলেই দেশটা আমাদের হয়ে যায়, ‘আমাদের ছেলে, আমাদের মেয়ে।’

তুই ওঁকে বললি না কেন ‘আমাদের এই খচড়া দেশ’ বলতে? তা হলেই তো আর কোনও ব্যাকরণের ভুল থাকত না। মুচকি হাসি আমি।

থাকত। ও গম্ভীরভাবে বলল, বলা উচিত ছিল ‘আপনাদের মতো খচড়াদের দিয়ে তৈরি দেশ।’

সর্বনাশ, খুব বেঁচে গেছি। তুই তো আর. ডি. এক্স—রে! সঙ্গে ঘোরা বিপজ্জনক! কখন ফাটবি, নিজেও যাবি, আমাকেও উড়িয়ে দিবি! ডেঞ্জারাস!

কথাটা তোর মনে হয় না? সোশাল সার্ভিস করিস তো? চেতনা বাড়াবার জন্যে কিছু করতে পারিস না? জাস্ট নাগরিক চেতনা! রাস্তায় ময়লা ফেলতে নেই, বাসে স্মোক করতে নেই, গাঁক গাঁক করে লাউডস্পিকার চালাতে নেই, কিউ ভাঙতে নেই, নিজের কাজটা করতে হয়।…

বাস, বাস, তোর ‘নেই’ আর ‘হয়’—এর লিস্টটা পরিষ্কার হয়ে গেছে আমার কাছে।

রিয়ালি? তো করিস না কেন কিছু?

করব, করব, শিগগিরই করব ভাবিসনি।

বিরক্ত মুখে ধোসার ওপর ছুরি চালাল কাজল। যেন আমজনতা, অর্থাৎ ওই ‘নেই’ আর ‘হয়’গুলো যারা মানে না, তাদের ওপর দিয়ে। আমিও বাদ যাচ্ছি না। একে কিচ্ছু করি না, তার ওপর আবার ফাজলামি।

ছবিগুলো আর একবার ব্যাগ থেকে বার করে দেখি। একগাদা ভিড়ের মধ্যে কখনও আধা মুখ কখনও সিকি মুখ, কখনও দু’দুটো মাইক্রোফোনের পেছনে বক্তৃতারত ভ্যাটকা মুখ। দুর! এভাবে একটা মানুষকে শ’য়ে শ’য়ে যাত্রীর মধ্যে থেকে চিনে নেওয়া অসম্ভব। নিতাইদা তো ফোটোগুলো দিয়েই খালাস। কাজল ফট করে ওর ঝোলা থেকে একটা লম্বাচওড়া চার্ট পেপারের রোল বার করল। বলল, ‘তোর হাতের লেখাটা তো ছাপা হরফের মতো, লিখে ফেল দেখি নামটা। বড় বড় করে।’ একটা বেগুনি রঙের ফেল্ট পেনও বার করে দিল। সুতরাং হাতের লেখার সুনাম রাখতে আমি বড় বড় করে লিখি KASTURI BEN। লেখার সময়েই খেয়াল হয়েছিল ওঁর পদবিটা আমরা জানি না। সত্যি কথা বলতে কি এই গুজরাতিদের ভাই আর বেন—এর জ্বালায় পদবিটা উবেই যায়। ভুলাভাই, শরদভাই, নমিতা বেন, নীলম বেন। তবে আমরা কেউই স্বপ্নেও ভাবিনি উনি একটা সাধারণ স্লিপার বা শয়নযান থেকে কাঁধে একটি ঝোলা, আর হাতে একটা মাঝারি ক্যারি—অন নিয়ে নেমে আসবেন। উনি গটগট করে আসছিলেন একটা সচল গাছের মতো। আমাদের প্ল্যাকার্ডের দিকে। অর্থাৎ স্টেশনের উলটোমুখো। কেননা আমরা ওঁকে সামনের দিকে এ.সি. ফার্স্ট ক্লাস কোচগুলোয় খুঁজছিলাম। কিন্তু যেই দূর থেকে দেখলাম, এক লহমায় আবছা, আধা—সিকি ফোটোগ্রাফগুলোর খাপে খাপে বসে গিয়ে উনি জ্যান্ত হয়ে উঠলেন। দেখলে কে বলবে কটন—কিং—এর মেয়ে! স্মার্ট খুব, কিন্তু ড্যাশিং টাইপ লাগছিল না। খুব কেজো মহিলা। প্র্যাকটিক্যাল, শান্ত কিন্তু দৃঢ়। এরকমটাই আমার প্রথম মনে হল। সাদা ধ্বধবে মিলের শাড়ি পরেছেন। সাদা লেসের পাড়। শাড়িতে ছোট ছোট সাদা চিকনের ফুল। ভদ্রমহিলা ময়দার মতো সাদা ফরসা। মজবুত ফিগার। দারুণ একটা ব্যক্তিত্বের আঁচ পাচ্ছিলাম। থাকবেই। নইলে আর কাজগুলো করেন কী করে! ফোটোর চেয়ে অনেক কম বয়স, বেশি অ্যাট্রাকটিভ লাগে। তবে মাঝবয়সি তো নিশ্চয়ই। এবং গুজরাতি কটন কিং—এর মেয়ের নাকে কানে হিরে নেই। আশ্চর্য!

প্ল্যাকার্ড এবং পেছনে আমাদের দেখে উনি থেমেছিলেন, একটু টানযুক্ত বাংলায় বললেন নিতে এসেচ আমায়? কেন? সেকী? আমি ঠিক চলে যেতে পারতুম।—চলছেন আমাদের সঙ্গে সমান তালে। কিছুক্ষণ ওঁর সঙ্গে গটগট করে চলতে চলতে ভাল লাগে খুব। যেন আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

আপনি এত ভাল বাংলা বলেন!—বিগলিত হয়ে জিজ্ঞেস করি। কস্তুরী বেন চলতে চলতে বললেন, কেনো? নিতাই বোলেনি আমার ছুটবেলা কেটেচে কলকাতায়। জোম্মো থেকে।

একথাটা অবশ্য আমরা জানতাম না। শুধু জানতাম এখানে ওঁদের কিছু সম্পত্তি আছে। থাকতেই পারে। গুজরাতি মিলের শাড়ি ধুতি চাদর তো এখানকার বাজার ছেয়ে আছে।

সেই থেকে এতদিন পরেও মনে রেখেছেন?—আমি না বলে পারি না। একটু গম্ভীর অন্যমনস্ক গলায় উনি বললেন, ছুটোতে মানুষ যা শিকে আর ভুলে না। ছুটোবেলাই সব বেলা।

শেষ কথাটা ভাল বুঝলাম না! ছোটবেলাই সব বেলা? কী অর্থে? এই যে আমাদের উৎসাহ—ছটফট যৌবন, ওঁর এত কেজো সফল প্রৌঢ়ত্ব, এগুলো? এগুলোর চেয়ে ছোটবেলার গুরুত্ব বেশি? কাজলের সঙ্গে চোখাচোখি করি। মিটিমিটি হাসছে। মানে আমার ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা উপভোগ করছে। ভাল বাবা, কর। তুই সব কথার মানে বুঝিস, কখনও ভ্যাবাচ্যাকা খাস না, তোর কাছে প্রশ্ন কম, উত্তর বেশি। সে উত্তরগুলো দিতেও তোর যথেষ্ট কার্পণ্য। তোর উইজডম—এর চড়া দাম। আমি বাবা একটু অভিভূত ধরনের মানুষ। যারা বশংবদ থাকে, দূর থেকে পুজো করে, নিজেকে অন্যের তুলনায় সামান্য মনে করে, শেখবার জন্য, নতুন কিছু করবার বা দেখবার জন্যে যারা উন্মুখ হয়ে থাকে। এটা কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাব জাতীয় জিনিস নয়। এটা আমি কাজলকে বোঝাতে পারি না। ও বলে ‘হম কিসিসে কম নহি, কম নহি’ মন্ত্র জপ করতে থাক, ঠিক হয়ে যাবি।

মন্ত্র জপ করলেই সব্বার থেকে তালেবর হয়ে যাব? এত সোজা!

তা তো বলিনি! ব্যাপারটা হল এই যে, তুমি হতে পারো নামকরা সেতারি কি সরোদিয়া, লাখ লাখ কামাও, ডিজাইনার জামাকাপড় পরে আসরে বসো, আংটি থেকে হিরে ঝলকায়, কিন্তু আমিও একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষ। আমার কাজটা আমি ষোল আনা সৎভাবে করি। আমি জীবনের প্রতিটি ধাপ জানতে জানতে, বুঝতে বুঝতে, লড়াই করতে করতে এইখানে পৌঁছেছি।

আমি বলি, কার কথা বলছিস? তোর কথা?

ভীষণ রাগ করে কাজল, ইয়েস, আমার কথা। কিন্তু তোরও কথা। যে ছেলেগুলো খেত—মজুরি করে বই ভাগাভাগি করে পড়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করে, জয়েন্টে চান্স পায়, তাদেরও কথা, যে ভদ্রলোক এই কাপুরুষের দেশে সাহস করে কোনও মেয়ের অপমানের জবাব দেন তাঁরও কথা, যে কুলি সারাদিন ঠেলায় লোহার রড বয়ে বয়ে রাত এগারোটায় রাস্তার কল থেকে জল নিয়ে ছাতু ভিজিয়ে খাচ্ছে, তারও কথা।

ওকে বোঝানো মুশকিল। তাঁর নিজের ক্ষেত্রে একজন সেতারি কি সরোদিয়া যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, একজন সমাজকর্মী হিসেবে আমি বা অন্য যেসব সৎ আন্তরিক মানুষদের কথা ও বলল—আমরা কি আমাদের কাজের জায়গাতেও সেইখানে দাঁড়িয়ে আছি?

সততার, সিনসিয়ারিটির, স্ট্রাগল—এর কোনও ফার্স্ট সেকেন্ড হয় না মিঠু, কোনও সেলিব্রিটি স্টেটাস হয় না। ধান্দাবাজির সমাজসেবা তো আর করিস না!

কোথা থেকে কোথায় চলে গেল—যাঃ। এই হল কাজল।

ওর যুক্তি—তর্ক সত্ত্বেও কিন্তু আমার বীরপূজার বাতিক কমে না। আমি আমার দেবতাদের থেকে অটোগ্রাফ নিতে নিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি, বিহ্বল হয়ে যাই—সে গায়ক, বাদক, লেখক যিনিই হন না কেন। আমি তো কাজলেও মুগ্ধ, অভিভূত। একজন ট্রাইব্যাল ছেলে যতই কেন সুযোগ—সুবিধে পাক, এমন করে সব কমপ্লেক্স ঝেড়ে ফেলবে গা থেকে ময়লা ঝাড়ার মতো, তথাকথিত মূল স্রোতের ছেলেমেয়ের সঙ্গে সহ—ও প্রতিযোগিতা করে এইখানে এসে দাঁড়াবে এবং নিজের পদবি বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করবে, এটা মোটের ওপর অভাবনীয়। বাংলা ইংরেজি দুটোই বলে অবলীলায়, জলের মতো। নাক—উঁচুদের সঙ্গে যখন মেশে তখন ওর ব্যক্তিত্ব থাকে সবাইকে ছাড়িয়ে অন্য উচ্চতায়, যদিও সেভাবে বোঝা যায় না কথায়, পোশাকে, ব্যবহারে বা আদবকায়দায়। একদম সহজ। আলাদা হয়ে থাকে শুধু সামান্য একটু উন্নাসিকতা আর ওর কষ্টিপাথরের চকচকে চেহারাটা। একটু থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট, চৌকো মতো মুখ, বডিবিল্ডিং না করেও প্রায় এক বডি—বিল্ডারের মতোই সৌষ্ঠব। ওকে পুজো করব না তো কী? ওর চেনাশোনা অনেক, জানি তারাও ওকে প্রশংসা সম্ভ্রমের চোখে দ্যাখে। কাজল! ওহ, ও তো একসেপশন্যাল। কিন্তু তারা ওকে কাজল বলে মনে রাখে, মুণ্ডাটা ভুলে যায়। ইচ্ছে করেই কি না, জানি না। চেহারার আদিবাসী মহিমা অবিকৃত রেখে ত্বকের দ্যুতি ছড়িয়ে, বিদ্যাবুদ্ধি ঝলমলিয়ে যখন একমুখ বিরল হাসির ফোয়ারা ছুড়ে বলে, ওহ নো, নট মুন্দ্রা, মুণ্ডা। কাজল মুণ্ডা। গট ইট? আমাদের কোনও এক কমন ফ্রেন্ডের একদিন কী দুর্মতি হয়েছিল, বলেছিল দ্যাখ, লোকে সরকারি সুবিধে পাবার জন্যে পদবি বদলে এস.সি. এস.টি. হয়ে যায়। গ্রামের দিকে বিশেষত। ভাবতে পারবে না, আমাদের বাবার কালের কাজের লোক শিডিউলড কাস্টে নাম লিখিয়ে রজক দাস হয়ে এল, শুনতে পাই সরকারি নিয়মের ফাঁকফোকর দিয়ে জমিজমা, ছেলেদের চাকরিফাকরি সব বাগিয়েছে। তা কাজল, তুমি তো উলটোটাও করতে পারো, কারও সাধ্য নেই বোঝে তুমি সাত পুরুষে শিক্ষিত নও। কাজল রাগ করেনি, শান্ত, হাসি ছিল চোখে, বলল, তোমরা চট করে রং বদল করতে পারো। আমি পারি না—নাকের ওপর হাত রেখে বলেছিল—আমার পরিচয় এইখানে দাগা আছে, অনাস। সেই ঋগবেদের যুগ থেকে। তা ছাড়া করব কেন? আমি ইতিহাস। ৭০০০ বছরেরর ইতিহাস। ব্রোঞ্জ যুগ থেকে বর্তমান স্যাটেলাইট, কম্পিউটারের যুগে মানুষের উৎক্রান্তির ইতিহাস। রেয়ার স্পেসিমেন। হোয়াই শুড আই ডেসট্রয় ইট!

হাওড়া স্টেশনে একটা মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেন এলে ট্যাক্সির লাইন আদি—অন্তহীন হয়ে যায়। তবে কিছু কালোবাজারি ট্যাক্সি থাকে, তারা প্রি—পেড ট্যাক্সির মতো আগে থেকে ভাড়া ঠিক করে নিয়ে চুপিচুপি প্যাসেঞ্জার নিয়ে আউট অব টার্ন চলে যায়। অবশ্যই ভাড়া দেড়া, কি ডবল। এইরকম একটা ট্যাক্সি ধরবার চেষ্টায় ছিলাম, কস্তুরীবেন বললেন, কিউটা কীসের?

কিউয়ে দাঁড়ালে ভীষণ দেরি হয়ে যাবে দিদি—কাজল বলল।

আমরা অন্য ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা করছি।—আমি তাড়াতাড়ি বলি, এখানে এরকম না করে কোনও উপায় নেই।

—কিউয়েতে দাঁড়াতে অসুবিদে কী? তোমাদের পায়ে বেথা বা তাড়া কিছু?

আমি বলি, না। আসলে আপনি এতটা ট্রেন জার্নি করে এলেন, সাত ঘণ্টা লেট।

আমাকে থামিয়ে উনি বললেন, লেট তো হচ্ছেই। এতো জার্নি তো শেষ হোয়নি এখনও। এখনও কি ঠিক অ্যাড্রেসে পৌঁছোতে পেরেছি?

এমনভাবে কথাটা বললেন যে, মনে হল ‘ঠিক অ্যাড্রেস’ বলতে উনি মোটেই তিনের এক ফার্ন রোডের রোডটাই বোঝাচ্ছেন না। আরও কিছু, তারও অতীত, তারও অতীত। এত দূর, দৃষ্টির অগোচর কোনও ঠিকানার দিকে চোখ রেখে কোনও মানুষ পথ চলতে পারে? সন্দেহ নেই, ইনিও আমার এক অটোগ্রাফ—হিরো বা হিরোইন হতে যাচ্ছেন।

কাজল বলল, আমি এখানে থাকা সত্ত্বেও আপনাকে কষ্ট করতে হবে কেন?

কস্তুরীবেন এতক্ষণে মিটিমিটি হেসে বললেন, সেটা এনডিওরেন্স ওয়াইজ বুঝতে হবে। তুমাকে হাটকাট লাগছে—খুব বেয়াম ওয়েটলিফটিং করো নাকি?

হাটকাট মানে হাট্টাকাট্টা আর কী!

কাজল বলল, সামান্য। অ্যাথলিট হিসেবেও মন্দ না। আপনাকে কাঁধে করে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারি।

বোটে!—উনি হাসিহাসি চোখে বললেন।

আধ ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্যাক্স পাওয়া গেল। জ্যামট্যাম, লাল—বাতিটাতি পেরিয়ে যখন তিনের এক ফার্ন রোডে পৌঁছোলাম তখন সন্ধে হয়ে গেছে। বাড়িটা বেশ বড়, তিনতলা। একটু তেধেড়েঙ্গে—টাইপ, আজকালকার আর্টিটেকচার নয়। কেয়ারটেকার রামলাখনের কাছ থেকে চাবি নিয়ে উঠতে উঠতে আমাদের ওপরে ডাকলেন, দরজা খুললেন উনি। এই তেতলাতেই উনি থাকেন মনে হল। জানি ওঁরা ধনী। কিন্তু ফ্ল্যাটটা বা বলা ভাল তিনতলাটা, যত বিরাট তত সাজানো—গোছানো কিছু নয়। একটা ঘরে দেখলাম তক্তপোশ পাতা, ওপরে সাধারণ একটা তোশকের ওপর সাধারণ হ্যান্ডলুমের বেডকভার। একটা গোদরেজের আলমারি, একটা গদিঅলা হাতলহীন চেয়ার। সাধারণ টেবিল, দেওয়ালে লাগানো তাকে কিছু বই। এ ঘরে মালপত্র রেখে উনি আর একটা ঘর খুললেন—বৈঠকখানা, তক্তপোশ, গদি, গোটা চার তাকিয়া, নিচু টেবিল, গদি দেওয়া কাঠের বেঞ্চি। পুরনো দিনের কিছু সুন্দর মোড়া। দেওয়ালে প্রচুর ছবি, যেমন সরকারি অফিসে টাঙানো থাকে—গাঁধীজি, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্রকে চিনতে পারলাম। অন্যদের নামগুলো জ্বলজ্বল করে লেখা না থাকলে আমি অন্তত চিনতে পারতাম না—স্বীকার করাই ভাল। গোখেল, সুরেন ব্যানার্জি, বিপিন পাল, উল্লাসকর দত্ত, সূর্য সেন, লালা লাজপৎ রায়, বালগঙ্গাধর তিলক। ক্ষুদিরামকে চিনলাম ওঁর ফাঁসির গানের সঙ্গে সঙ্গে চেহারাটাও খুব পাবলিসিটি পায় তো! প্রফুল্ল চাকী আর সূর্য সেন বোধহয় এই প্রথম দেখলাম। কস্তুরীবেন দেখি ঘরটাতে দাঁড়িয়েই আছেন, দাঁড়িয়েই আছেন, যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য।

এই পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আমরা চলে যাব কিনা ভাবছিলাম। একটু অস্বস্তিও লাগছিল, মানুষটি এখন স্মৃতির রাস্তা দিয়ে পেছনে চলেছেন, বুঝতে পারি। কিন্তু উনি বেশ আদেশপূর্ণ গলায় বললেন, বসো।

কাজল দাঁড়িয়েই রইল, কিছু খাবারটাবার আনি দিদি।

সোব হোচ্ছে, সোব হোচ্ছে, ইমপেশেন্ট হোবে না। বসো।

অসহায়ের মতো বসে রইলাম দু’জনে। আর কী আমাদের করণীয় আছে কে জানে! নিতাইদা বলে দিয়েছেন, ওঁর দেখাশোনা করতে, কথা শুনতে। তো বসি। বৈঠকখানার ফাঁক দিয়ে একটা লাইব্রেরি মতো দেখা যাচ্ছিল। দেওয়ালে দেওয়ালে আঁটা আলমারিতে বই। টেবিল চেয়ার, একটা আরাম—চেয়ারও। সামনের দিকে তাকালে দেওয়ালে বিবেকানন্দ ও শ্রীঅরবিন্দের ফোটো চোখে পড়ে। এই ছবি দুটো অর্থাৎ ওঁর শোওয়ার ঘরে স্থান পেয়েছে।

উনি ব্যস্ত হয়ে একবার ঘুরে গেলেন, চুপ বসে কেনো? গোল্পো কর, গোল্পো করতে বাধা নেই। ইস্কুল নয়, কি জেলখানা।

কাজল আমার দিকে তাকায়। অর্থাৎ কী আর করা! অপেক্ষা করো, কী দুরূহ ডিউটি এবার পড়বে, এবং ইতিমধ্যে গোল্পো কোরো।

আমি গভীর কৌতূহলে লক্ষ করি গত শতাব্দীর এইসব সাজসজ্জা। উঁচু সিলিং, পুরু দেওয়াল, গরাদের জানলা, চার ব্লেডের ফ্যান, রদ্যাঁর থিংকারের একটা রেপ্লিকা রয়েছে, এতক্ষণ দেখিনি। উনি এঘর থেকে ওঘর ব্যস্তভাবে ঘোরাফেরা করেছিলেন আর মাঝে মাঝে—রামলাখন, রামলাখন বলে হাঁক পাড়ছিলেন। রামলাখনের ‘হাঁ জি, হাঁ জি’ও শোনা যাচ্ছিল। কাজলও মনের মধ্যে সব টুকে রাখছে বুঝতে পারছি। তবে ব্যাটা মহা চালাক। জানতে দেবে না।

এমন সময়ে চানটান করে ফ্রেশ জামাকাপড় পরা কস্তুরীবেন ঢুকে বললেন, রাত হয়ে যাচ্ছে। এসো আমরা তিনজুনে এইখানে বসে খাওয়া সেরে নিই।

আমরা দু’জনেই হাঁ হাঁ করে উঠি। উনি এবার গম্ভীর চোখে চেয়ে বললেন, কেনো? বাড়িতে মাংস আছে? না ইলিশ রান্না হোচ্ছে, পাতুরি, কেলাপাতা মোড়া? তিনজনেই হেসে ফেলি।

রামলাখন তিওয়ারি খাবার দিয়ে গেল। গরম গরম মোটা মোটা আটার রুটি, তুলতুলে নরম, অড়হর ডাল, আর রসগোল্লা।

বাথরুম থেকে হাতমুখ অগত্যা ধুয়ে আসতে হয়। ন্যাপথলিনের গন্ধঅলা কবেকার সবুজ বর্ডার দেওয়া সাদা টার্কিস তোয়ালেতে হাত মুছে এসে বসি। উনি বললেন, কোতো সোকালে গেছ। কোতো কোষ্ট হয়েছে আমার জন্যে! দুপুরবেলা কী খেয়েছেন—মিষ্টি? বেচারা!

আমাদের যে তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি, অভুক্ত নেই—এসব বলে কোনও লাভ হল না। চামচ করে মাখন লাগিয়ে দিলেন রুটিতে। আমার ফিগারের বারোটা বাজল।

খাবার সময়ে উনি একটাও কথা বললেন না। কোনও নিয়ম মানেন? না কী? ওঁর মতো আধুনিক মনের মানুষ কোনও পুরনো নিয়মে আটকে আছেন ভাবতে ভাল লাগল না। কী আর করা যাবে! তবে ক্রমশই ওঁকে খুব আত্মমগ্ন লাগছিল। ঠিক চিন্তাগ্রস্ত নয়। কিন্তু কিছু একটা জরুরি বিষয় আছে যা নিয়ে উনি ভাবছেন। রসগোল্লার রস টিপে খাচ্ছি দেখে হঠাৎ যেন সংবিতে ফিরে এলেন।

—ফিগার কনশাস?

আমি চমকে উঠি। একটু লজ্জা পেয়ে বলি, মিষ্টি বেশি খেতে পারি না।

—রসই যদি ফেলে দিলে তোবে আর রসগোল্লা কী? দিস ইজ আওয়ার স্পেশ্যাল ফেভারিট ইন আমেদাবাদ। আগে জানলে তুমাকে তিত গোল্লা খাওয়াতে পারতুম।

—কোত্থেকে? আছে আপনার কাছে?—কাজল হেসে জিজ্ঞেস করল।

উনি বললেন, আছে। জড়িবুটি দিয়ে বানানো গোলি। আমি রোজ সোকালে একটা করে খাই। কুনও রোগ কাছে ঘেঁষতে পারে না।

—কোথায় পাওয়া যায়?—আমাকে আমার স্বাস্থ্যবাতিকে বাবা—মায়ের জন্য অনেক কালমেঘ খেতে হয়েছে, তেতোকে আমি ভয় পাই না।

—কুত্থাও পাবে না। এ আমাদের ফেমিলির নিজস্ব ফরমুলা। আমরা সোব বাড়িতেই বানাই তো! আচার, মিষ্টি, ওষুধ—সোব।

—আপনাদের তা হলে ডাক্তার লাগে না বলুন।

—ফাংশন্যাল ডিজিজের জন্যে খুব কম। কোনও অর্গ্যান খারাপ থাকলে বেচারি কী করছে?

এ ভাবেই শেষ হয় কস্তুরীবেনের সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *