উইলিয়াম ব্রিজের প্রহরীরা
উনিশশো তিরানব্বইয়ের বর্ষায় উত্তরবঙ্গের কিছু জায়গায় যে ভয়ঙ্কর বন্যা হয়েছিল তার
কথা আজও অনেকের মনে থাকতে পারে। সেবার ডুয়ার্সের পূর্বদিকে ভুটানের সঙ্গে লাগোয়া অঞ্চলটাকে তছনছ করে দিয়ে গিয়েছিল পাহাড় থেকে হঠাৎ নেমে আসা একটা হড়পা বান বা ফ্ল্যাশ—ফ্লাড।
ডিমা, নিমাতি, ডায়না, কালজানির মতন ছোট ছোট নদী, যে সব নদীতে সারাবছর পায়ের পাতা ভেজানোর মতন জলও থাকে না, সেগুলোই হঠাৎ রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। জল থাকে না বলেই ওইসব নদীর চরে গরিব মানুষরা ঘর বাঁধে, কলার বাগান কিংবা তরমুজের খেতি করে, গরু বাছুর চড়ায়। কিন্তু উনিশশো তিরানব্বইয়ের পঁচিশে জুলাই রাতে— রাগী বাচ্চা যেভাবে হাতের এক ঝটকায় লুডোর বোর্ড থেকে যাবতীয় সাজানো ঘুঁটি ফেলে দেয়— ঠিক সেইভাবে ওইসব নদীর ফুঁসে ওঠা গেরুয়া জল সমস্ত বাগান, ফসল, ঝুপড়ি, গরু বাছুর ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল। মানুষও মারা গিয়েছিল অনেক।
শুধু যে নরমসরম গ্রামগুলোর ওপরেই আঘাত এসেছিল তাই নয়, ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল অনেক কঠিন জিনিস। হ্যাঁ, আমি ব্রিজগুলোর কথাই বলছি। অজস্র ইস্পাতের ব্রিজকে উপড়ে ফেলে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই বন্যা; কিংবা ভেঙেচুরে পিণ্ড পাকিয়ে দিয়েছিল। এখনও ওই অঞ্চলের নতুন করে গড়ে তোলা সেতুগুলোর ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় ডাইনে বাঁয়ে তাকালে চোখে পড়ে সেইসব পুরোনো ব্রিজের ভাঙা থামগুলো সার বেঁধে রিভার—বেডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
অদ্ভুত ব্যাপার হল, ওদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো যে ব্রিজটা, যেটার বয়েস তখনই ছিল প্রায় একশো ছুঁইছুঁই, সেই জুনালি নদীর ওপর উইলিয়াম ব্রিজ যেমনকার তেমনই রয়ে গেল। আমাদের মধুঝোরা চা বাগানের একদম গায়েই ওই জুনালি নদী আর উইলিয়াম ব্রিজ। বন্যার পরে বাগানের সকলেই ধন্য ধন্য করল ব্রিটিশ স্থপতি আর্চার উইলিয়ামের নামে। সকলেই বলল, এমনই মালমশলা আর ডিজাইন ব্যবহার করেছিলেন উইলিয়াম সাহেব, যে অমন ক্ষ্যাপা হাতির মতন হড়পা বানও একটা বল্টু অবধি খসাতে পারেনি ওই ব্রিজের গা থেকে।
শুধু আমাদের বৃদ্ধ নাইটগার্ড রঘুদা, রঘুনাথ ওরাওঁ, ব্রিজ ভেঙে না পড়ার কৃতিত্বটা দিলেন অলৌকিক এক শক্তিকে।
আমি রঘুদার সঙ্গে একমত হলাম। না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ উনিশশো তিরানব্বইয়ের পঁচিশে জুলাই গভীর রাতে আমি উইলিয়াম ব্রিজ পেরিয়েছিলাম। আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম সেই অলৌকিককে।
.
তখন আমি মধুঝোরা টি—এস্টেটের জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, সবে বছর তিনেক হল চাকরিতে ঢুকেছি। যেহেতু ‘জুনিয়র’, তাই ঝক্কিঝামেলার কাজ থাকলে চিফ ইঞ্জিনিয়ার পীযূষ সেন সঙ্গে সঙ্গে সেই কাজটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে যেতেন। সেদিনও তাই হল। শনিবার বিকেলের দিকে, চায়ের পাতাগুলোকে প্যাকেজিং—প্ল্যান্টের দিকে নিয়ে যায় যে কনভেয়র বেল্টটা, সেটার একটা গিয়ার—হুইল ভেঙে গেল। আমাদের প্ল্যান্টটার বয়েস প্রায় সত্তর বছর। অত পুরোনো মেশিনপত্রের পার্টস এখন আর কিনতে পাওয়া যায় না, তাই ভেঙে যাওয়া জিনিস সারিয়ে নিয়ে কাজ চালাতে হয়। গিয়ার—হুইলটা ভেঙে যাওয়ার খবর পেয়েই পীযূষদা বললেন, রুদ্র, তোমাকে তো তাহলে কাল একটু শিলিগুড়ি যেতে হচ্ছে। বুঝলাম, শিলিগুড়ি মানে পালবাবুর ওয়ার্কশপে। উনিই আমাদের মেরামতির কাজগুলো করেন। খুব অভিজ্ঞ কারিগর। পীযূষদাকে বললাম, ঠিক আছে যাব।
পরদিন রবিবার, দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর ভাঙা গিয়ার—হুইলটাকে একটা খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে অফিসের জোঙ্গা জিপটায় উঠে শিলিগুড়ির দিকে রওনা দিলাম। গাড়ি বেরোনোর জন্যে কারখানার লোহার গেটটা খুলে দিতে এসেছিলেন রঘুদা। আমাকে একা ড্রাইভ করতে দেখে বললেন, আরেকজন কাউকে সঙ্গে নিলে ভাল হত না সাহেব?
কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
না, যেরকম গুমোট হয়েছে, মনে হচ্ছে বিকেলের দিকে ঝড়বৃষ্টি হবে।
ঝড়বৃষ্টি আর এই ডুয়ার্সে নতুন কী? আমি উত্তর দিলাম। তাছাড়া আজ রবিবার। ছুটির দিনটা বরবাদ করে কে আমার সঙ্গে যেতে চাইবে বলো তো? এই বলে, রঘুদার সাবধানবাণী উপেক্ষা করেই বেরিয়ে পড়লাম।
শিলিগুড়ি নির্বিঘ্নেই পৌঁছলাম, কিন্তু তারপর গিয়ারটা সারাতে পালবাবুর অসম্ভব বেশি সময় লেগে গেল। কাজ শেষ হতে হতে বেজে গেল সন্ধে সাতটা। মনে একটু আশঙ্কা নিয়েই রাস্তায় নামলাম, কারণ সন্ধের পর জঙ্গলের রাস্তায় ডাকাতির ভয় খুব। তখনও অন্য কোনোরকম ভয়ের কথা আমার স্বপ্নেও মনে আসেনি।
দুপুরের সেই গুমোটটা ততক্ষণে আরও বেড়ে গিয়েছিল। গাড়ির জানলার কাচ পুরোপুরি নামিয়ে দিয়েছিলাম, তবু যেন একটুও হাওয়া ঢুকছিল না। দরদর করে ঘামছিলাম। তিস্তার ওপর জুবিলি ব্রিজ পেরোনোর সময় সামনে তাকিয়ে দেখলাম পাহাড়ের মাথায় ধোঁয়ার মতন মেঘ জমে রয়েছে। তার মানে ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে খুব। একটু বাদে সেই বৃষ্টি সমতলে নেমে এল। প্রথম ফোঁটাটা যখন আমার উইন্ডস্ক্রিনের কাচে আছড়ে পড়ল, তখন ঘড়িতে বাজে ঠিক আটটা, আর আমি পেরিয়ে গেছি তিনভাগের একভাগ পথ।
এরপরেই যেটা শুরু হল সেটাকে এক কথায় ‘প্রলয়’ বলা চলে। আমার চোখের সামনেই রাস্তার দুপাশের অনেকগুলো বড় বড় গাছ ঝড়ের দাপটে মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। বাজ পড়ছিল মুহুর্মুহু। তার সঙ্গে বৃষ্টি। সেরকম বৃষ্টি আমি তার আগে বা পরে আর কখনও দেখিনি। মনে হচ্ছিল যেন একটা জলপ্রপাত ভেদ করে চলেছি। একহাত দূরের রাস্তাও দেখতে পাচ্ছিলাম না। গাড়ির গতি একেবারে কমিয়ে আনতে বাধ্য হলাম। ভাগ্য ভালো, রাস্তায় আর কোনো গাড়ি ছিল না। থাকলে মুখোমুখি ধাক্কা লাগতেই পারত।
যে সময়ে আমার মধুঝোরা পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল, সেই সময়ে আমি পৌঁছলাম কালচিনি। মানে পুরো পথের মাত্র অর্ধেকটা। বাঁ দিকে বাঁক নিলাম। এরপর মধুঝোরা পর্যন্ত পুরো রাস্তাটায় আর কোনো লোকালয় নেই। মাঝে মাঝে চা বাগান, মাঝে মাঝে অরণ্য। আর প্রতি এক কিলোমিটার অন্তর একটা করে পাহাড়ি ঝোরা। চিরকাল সেই সব ঝোরার সামান্য জলের বুক চিরে অনায়াসে জিপ চালিয়ে পারাপার করেছি। কিন্তু আজ এ কী চেহারা হয়েছে সেই ছোট ছোট ঝোরাগুলোর! এইটুকু সময়ের মধ্যে এত জল কোথা থেকে এল ওদের বুকে! আমার জিপের চাকার প্রায় অর্ধেকটা ডুবে যাচ্ছিল সেই ঘোলা জলে। শেষ ঝোরাটা পার হওয়ার সময় হঠাৎই টের পেলাম আমার বাহন মাটির ওপর থেকে কামড় ছেড়ে দিয়েছে। আমাকে নিয়ে জলের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে আমার জিপ। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। এই কি তবে শেষ? এইভাবেই কি মৃত্যু হবে আমার? না। একটু বাদেই নদীর তলায় ছড়ানো পাথরে আবার চাকা আটকালো। টপ গিয়ার দিয়ে প্রাণপণে গাড়িটাকে তুলে নিলাম সেই ঝোরার ঢালু পাড়ের ওপর।
হয়তো তখনই একটা স্বস্তির নিশ্বাস পড়ার কথা ছিল, কারণ সামনে অল্প পথ বাকি। সেই পথে আর কোনো সেতুবিহীন ঝোরা নেই। রয়েছে একটা মরা নদী। জুনালি। এবং সেই নদীর ওপরে রয়েছে একটা ব্রিজ। একশো বছরের পুরোনো হলেও রীতিমতন ইট আর ইস্পাতে বানানো একটা বিরাট ব্রিজ। উইলিয়াম ব্রিজ। তবু কি জানি কেন ব্যাখ্যাহীন এক আশঙ্কায় আমার বুক কাঁপছিল। মনের ভেতর থেকে কে যেন বারবার বলছিল, রুদ্রদেব, বিপদ। ভীষণ বিপদ অপেক্ষা করে আছে তোমার সামনে।
অথচ সেই সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায়ও তো নেই। কারণ ইতিমধ্যে রাস্তাটাও হয়ে গেছে খরস্রোতা এক নদী। জিপের চাকার তলায় পরিষ্কার টের পাচ্ছি সেই নদীর প্রবল চোরাটান। আজ রাতে আর কিছুক্ষণ বাইরে থাকলে ওই বন্যার টান আমাকে আমার গাড়িশুদ্ধু টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে অসংখ্য পাহাড়ি নদীর কোনো একটার গর্ভে। তাই থামলে চলবে না।
নির্জন নিষ্ঠুর পথ ধরে আমি অন্ধের মতন এগিয়ে চললাম।
.
বৃষ্টি একইভাবে হয়ে চলেছিল, কমবার কোনো লক্ষণই দেখছিলাম না। কতক্ষণ চলেছিলাম জানি না। হঠাৎ একসময়ে চোখে পড়ল নিকষ অন্ধকারের মধ্যে অনেকদূরে চিকমিক করছে মধুঝোরা টি গার্ডেনের আলো। আমার বুকের মধ্যে চেপে বসা তীব্র আতঙ্ক সেই আলোর ছোঁয়ায় একটু হালকা হয়েছিল, কিন্তু প্রায় একই সঙ্গে এমন একটা দৃশ্য চোখে পড়ল যাতে সেই মৃত্যুভয় দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এল। আমি বুঝতে পারলাম আজ রাতে আমার পক্ষে বেঁচে ফেরা খুব কঠিন।
জিপের হেডলাইটের আলোয় আমি দেখতে পেলাম জুনালি নদীর ভয়াল রূপ।
এই জুনালিকে আমি চিনি না। এই জুনালি আমাদের টি—এস্টেটের পাশ দিয়ে বয়ে চলা সেই ছোট্ট ঝোরাটা নয়, যার জলে সারাদিন আমাদের কুলিব্যারাকের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঝাপাই জোড়ে, মেয়েরা কাপড় কাচে, এমনকী ছোট্ট ছাগলছানাটাও যে নদীর সামান্য জল নির্ভয়ে পার হয়ে যায়। এ এক অন্য জুনালি; এর শরীরে নিশ্চয় কোনো অশুভ আত্মা ভর করেছে। না হলে কেমন করে এর জল গভীর খাতকে ছাপিয়ে উঠে আসে রাস্তার পাশে? তীব্র স্রোতের আওয়াজ কানে তালা লাগিয়ে দেয়? একেকবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আর সেই আলোয় আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি— শিলিগুড়ি যাবার পথে যে শান্ত জুনালিকে আমি দেখে গিয়েছিলাম, কয়েকঘণ্টার মধ্যে সে এক মৃত্যুনদীতে রূপান্তরিত হয়েছে। তার জলে ভেসে যাচ্ছে গবাদি পশুর মৃতদেহ, বড় বড় গাছের উপড়ে আনা শরীর, এমনকী মানুষের শব অবধি।
আর উইলিয়াম ব্রিজ? আমি তীরে দাঁড়িয়েই পরিষ্কার দেখতে পেলাম সেই পুরোনো জরাজীর্ণ ব্রিজটা দুলছে। নদীর বুকে যে তিনটে পুরোনো আমলের ইটের স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রিজের লোহার শরীরটা, সেই স্তম্ভগুলোর গায়ে জলের ধাক্কা লেগে পাক খেয়ে উঠছে অজস্র ঘূর্ণি। সাদা ফেনা ছড়িয়ে পড়ছে চার দিকে। ওই জলের আঘাত সহ্য করে আর কতক্ষণ ভিতের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে ওই থামগুলো?
তবু আমাকে উঠতেই হবে ওই ব্রিজে। যে ভাবে হোক পেরিয়ে যেতে হবে এই নদীকে। কারণ হেড লাইটের ছড়িয়ে পড়া আলোয় আমি দেখতে পাচ্ছি জুনালির খরস্রোত হিংস্র পশুর মতন পাড় ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসছে এইদিকে। নদী এগিয়ে আসছে আমাকে গিলে খেতে। ভয়ে আমার স্টিয়ারিং—এর ওপর রাখা হাতদুটো থরথর করে কাঁপছিল। তবু অ্যাপ্রোচ রোডের বাঁকটা ঘুরে জিপটাকে তুলে দিলাম ব্রিজের রাস্তায়। আর তারপরেই প্রাণপণে ব্রেক চিপে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
.
বলা যায় বাধ্যই হলাম ব্রেক চিপতে, কারণ তিনটি শিশু দাঁড়িয়েছিল উইলিয়াম ব্রিজের মাঝখানে; রেলিং ধরে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল পায়ের সামান্য নীচ দিয়ে বয়ে চলা জলস্রোতের দিকে।
তিনটি শিশুই প্রায় উলঙ্গ। কোমরে একটা করে ন্যাকড়া জড়ানো। গায়ের রং কুচকুচে কালো। বুঝতে বাকি রইল না—আমাদের মধুঝোরা টি—এস্টেটের কুলি ব্যারাক থেকেই পালিয়ে এসেছে বাচ্চাগুলো। পালিয়ে এসেছে বন্যা দেখতে। জানে না মৃত্যুর কত কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। আসলে ছেলেগুলো ভীষণই ছোট, বিপদের বোধই ওদের তৈরি হয়নি এখনও।
এইইই! আমি জিপের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ওদের ডাকলাম। কী করছিস ওখানে?
ছেলে তিনটে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালো।
তেমন কোনো কারণ ছিল না, তবু আমি একটু কেঁপে উঠলাম। কী বিষণ্ণ ওদের চোখগুলো! সেই চোখে বন্যা দেখার আনন্দ কিংবা উত্তেজনা কিছুই নেই। আমার দিকে একপলক তাকিয়েই ওরা আবার মুখ ফিরিয়ে নিল নদীর দিকে। কী দেখছে ওরা অত মন দিয়ে? ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম নদীর উজানের দিকে, মানে যেদিক দিয়ে পাহাড় থেকে নেমে আসছে জলের ঢল।
কিছুক্ষণ থেকেই গুম গুম করে একটা শব্দ ভেসে আসছিল। এবার দেখতে পেলাম সেই শব্দের উৎসকে। নদীর বুক জুড়ে আড়াআড়ি এগিয়ে আসছে একটা কালো পাঁচিল।
পাঁচিল নয়, আসলে একটা ঢেউ।
সেই দানবিক ঢেউয়ের মুখে ওলটপালট খেতে খেতে এগিয়ে আসছে অসংখ্য উপড়ানো গাছ, ঘরের চাল, আস্ত একটা বাঁশঝাড় আর কয়েকটা মানুষের মৃতদেহ।
কেউ বলে দেয়নি, তবু কি ঘটেছে তা বুঝতে আমার এক মুহূর্তও লাগল না। পাহাড়ের ওপরে কোথাও একটা নদীর বাঁধ জলের চাপ সহ্য করতে না পরে ভেঙে গিয়েছে। বাঁধের বুকে জমে থাকা পুরো জলটাই জুনালির খাত ধরে নেমে আসছে। ওই একটা ঢেউয়ের মধ্যে জমে আছে সেই সম্পূর্ণ বাঁধভাঙা জলের শক্তি।
মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখে হঠাৎই আমার মনটা খুব শান্ত হয়ে গেল। আমি স্থির দৃষ্টিতে সেই ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম— আর কতক্ষণ? আধমিনিট? পনেরো সেকেন্ড? ওইটুকুই আমার আয়ু। সেই সময়টুকু পেরিয়ে গেলেই ওই জলের পাঁচিল এই উইলিয়াম ব্রিজকে, আমাকে আর ওই বাচ্চা তিনটেকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে।
বাচ্চা তিনটের কথা মনে পড়তে আমি সামনের দিকে তাকালাম। দেখলাম ওরা আর ব্রিজের ওপরে নেই। ওরা নদীর বুকে নেমে গেছে। জুনালির তিনটে থামকে আড়াল করে, দুপাশে দু হাত ছড়িয়ে ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে।
জলের ওপর ধোঁয়ার মতন দুলছে ওদের শরীরগুলো। ছোট্ট শরীরগুলো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে…মস্ত বড়। জলের বুকে এক ফোঁটা কালি যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে সেইভাবে হাওয়ার বুকে ছড়িয়ে পড়ছে ওদের শরীর। এখন আর হাত, পা, মাথা আলাদা করে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু চোখগুলো— সেই বিষাদ মাখানো তিন জোড়া চোখকে এই অন্ধকারের মধ্যেও কেমন করে জানি না, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। দেখতে পাচ্ছি আরও একটা জিনিস। চোখ না সরিয়েই সেই বিরাট ঢেউটাকে দেখতে পাচ্ছি এখন। তার এগিয়ে আসার শব্দ আমার কান ফাটিয়ে দিচ্ছে। এমনকী তার ভিজে ভিজে ঠান্ডা ঠান্ডা গন্ধও আমার নাকে ঢুকছিল।
ওই শিশু তিনটের রূপান্তর দেখে, হাতের এত কাছে মৃত্যুকে দেখে আমার হয়তো জ্ঞান হারানো উচিত ছিল। কিন্তু মানবমস্তিষ্কের রহস্য কে বলতে পারে? আমি চেতনা হারালাম না। আমি জিপের সিটে বসে বসেই দেখলাম, সেই করাল ঢেউ ওই তিন শিশুর শরীরে লেগে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল— স্তম্ভ তিনটেকে স্পর্শও করতে পারল না। থামের মাঝখানের শূন্য জায়গা দিয়ে তীব্র বেগে চলে গেল জলের রাশি, আর সামান্য একটু ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠল উইলিয়াম ব্রিজ। তারপর আবার স্থির হয়ে গেল।
শুনেছি, সেদিন অনেক রাতে, ঝড়বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে প্রচণ্ড এক সংঘাতের শব্দে সচকিত হয়ে উঠেছিল মধুঝোরার মানুষজন। দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল তারা ঘর থেকে। দেখেছিল বাগানের বন্ধ লোহার গেট ভেঙে ঢুকে এসেছে আমার জোঙ্গা জিপ। ড্রাইভারের আসন থেকে আমাকে যখন নামিয়েছিল তখন আমার জ্ঞান ছিল না। আমি জানি তার অনেক আগেই আমি চৈতন্য হারিয়েছিলাম। গাড়ি চালিয়েছিলাম, যেভাবে ঘুমের মধ্যে কোনো কোনো মানুষ হেঁটে যায়, সেইভাবে।
টি—এস্টেটের নিজস্ব হাসপাতালে বিভিন্ন সহকর্মী আমাকে দেখতে আসতেন। আমি বেঁচে ফিরেছি বলে তারা ভগবানকে ধন্যবাদ দিতেন, আর ধন্যবাদ দিতেন আর্চার উইলিয়াম বলে এক সাহেবকে, যিনি না কি একশো বছর আগে অজর অমর করে বানিয়েছিলেন ওই ব্রিজটাকে।
শুধু রঘুদা, মানে রঘুনাথ ওঁরাও আমাকে দেখতে এসে বললেন, ওরা কেউ বিশ্বাস করে না সাহেব, কিন্তু উইলিয়াম ব্রিজ কোনোদিনই ভেঙে পড়বে না। তার কারণ, ওই ব্রিজকে তিন ‘নানহা দেও’ রক্ষা করছেন।
নানহা দেও! মানে শিশু দেবতা! সে কীরকম? জিজ্ঞেস করলাম আমি।
রঘুদা গলা নমিয়ে, ফিসফিস করে বললেন, বাবার কাছে শুনেছি, ব্রিজের ভিত তৈরি করার সময় হেড মিস্ত্রি বিহার থেকে তিনটে গরিব বাচ্চাকে কিনে এনেছিল। একশো বছর আগে এসব প্রথা খুব চালু ছিল সাহেব। বাচ্চা তিনটেকে বলি দিয়ে রিভার বেডে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। তারপর ওদের শরীরের ওপর গেঁথে তোলা হয়েছিল উইলিয়াম ব্রিজ। তখনকার দিনে লোকে বিশ্বাস করত, ওই বাচ্চাদের আত্মা ব্রিজকে বন্যা থেকে, ঝড় থেকে রক্ষা করবে। আমরাও এখনও সে কথাই বিশ্বাস করি সাহেব।
আমার মনে পড়ে গেল সেই তিন জোড়া বিষণ্ণ চোখের কথা। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়েই আমি জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম বৃষ্টি—থামা সকালের আলোয় ভেসে যাচ্ছে শান্ত জুনালি নদী আর অটুট উইলিয়াম ব্রিজ। সেই দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি কিন্তু তোমার কথাই বিশ্বাস করি রঘুদা।