ইহজন্ম – ৯

| ৯ | বাঁশি

আমার নিরাশ্রয়তার ধরনটা ছিল একেবারেই আলাদা। মাথার ওপরে ছাদ ছিল, ধনী ব্যবসায়ী বাবাও ছিলেন, অর্থাভাব ছিল না। বাবা অবশ্য এখনও আছেন। কিন্তু আমাদের কাছে না থাকারই সমান। আমাদের বেড়ে ওঠার সময়টাতে বাবা তেমন কোনও ভূমিকাও গ্রহণ করেননি। একমাত্র টাকা যোগানো ছাড়া। মার মৃত্যু হয়েছিল আমার শিশু বয়েসে। ছোড়দা বোর্ডিংয়ে। বাবা ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে। সারাক্ষণই ট্যুর থাকে তাঁর। প্রায়ই বাড়ি ফেরেন না। সব সময়ে আগে থেকে জানাও থাকে না আমাদের, রহমানভাই এসে খবর দেয়। সেদিন দুপুরে আমি মার কাছে শুনে শুয়ে ছবি আঁকছিলাম। মা ঘুমোচ্ছেন। আমার ডাকে মা কিছুতেই সাড়া দিচ্ছিলেন না। আমাকে পিঁপড়ে কামড়েছিল—ঠেললেও উঠলেন না মা। আমি ঘুমন্ত মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।

বিকেলে মন্টুর মা ঘর মুছতে এসে মড়াকান্না জুড়ে দিল। পাড়াপ্রতিবেশীরা এলেন। হস্টেল থেকে ছোড়দাও এসে গেল। বাবা এলেন পরদিন, এক বান্ধবী সমেত। বাবা যে কোথায়, কেউই জানত না, তাই খবর দেওয়া যায়নি তাঁকে। শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেলে ছোড়দা নরেন্দ্রপুরে ফিরে গেল। কিন্তু আমার কী হবে? আমি কি এতবড় বাড়িতে একা একাই থাকব? তখনও আমার ইস্কুলে যাবার বয়েস হয়নি, পাড়ার মন্টেসারি স্কুলে যাই। তখনও আমাকে বোর্ডিং-এ দেওয়া যাবে না—তাই বাড়িতে এল টুসাং। সিকিমের মেয়ে, গভর্নেস-কাম-আয়া। ভারী চমৎকার মেয়ে ছিল টুসাং। আমাকে খুব আদরযত্ন করত। লেখাপড়াও করাত, গল্প বলে ভাত খাইয়ে দিত। টুসাংয়ের কাছেই আমি বড় হচ্ছিলাম। মাকে ভুলে, যতদিন না বাবা কীভাবে যেন টুসাংকে অপমান করে, তাকে চলে যেতে বাধ্য করলেন। টুসাং কিছুতেই রইল না। আমি একা বাড়িতে চাকরদের মধ্যে থাকি কীভাবে? বাবা আমাকে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া মনস্থ করলেন।

আমার মামাবাড়ি ছিল ভাগলপুরে। কিন্তু আমার ছোটমামিমা কার্শিয়াঙে একটা ভালো মিশনারি স্কুলে টিচার ছিলেন। তিনিই ব্যবস্থা করলে, ভাগলপুরের বদলে আমাকে কার্শিয়াং-এ পাঠানোর। সেই একবারই বাবার সঙ্গে যাওয়া। আমাকে বাবা কার্শিয়াঙে ছোটমামির কাছে রেখে এলেন। ছোটমামি আমাকে তাঁদের স্কুলে ভরতি করে নেবেন পাঁচ পূর্ণ হলেই। আমিও বোর্ডিংয়ে থাকব, ছোড়দার মতো। আমার অনেকপ্রস্ত পোশাক তৈরি করানো হল। গ্রীষ্মের, শীতের, অনেকরকম জামা-কাপড়। বোর্ডিং-এ যেতে বেশ আগ্রহই হচ্ছিল আমার। মা যেখানে নেই, সেই বাড়িতে আমার একটুও থাকতে ভালো লাগছিল না, তবু টুসাং ভুলিয়ে রাখত। বাবা যে টুসাংকে কী অপমান করেছিলেন, সেটা বুঝতে আমার দশ বছর সময় লেগে গিয়েছিল। বাবা যে কতটা নীচে নামতে পারেন আমি জানতাম না, ছোড়দার খানিকটা ধারণা ছিল। ছোড়দা ছিল আমার চেয়ে বারো বছরের বড়। ছোট থেকেই ছোড়দা নরেন্দ্রপুরে। যখনই আসত বাড়িতে যেন উৎসবের আনন্দ, মা এত খুশি হতেন।

আমাদের বাড়িটা স্বভাবত নিরানন্দ ছিল। বাবার নিত্যনতুন বান্ধবীদের আনাগোনা আমরা মেনে নিয়েছিলাম। তারা আসত যেত। বাড়িতে দুটো গাড়ি, দুজন ড্রাইভার, অজস্র কাজের লোক। কিন্তু সিনেমাতে যেমন দেখা যায় কোনও বিশ্বস্ত নায়েব, অথবা স্নেহময়ী ধাইমা, কিংবা পুরাতন ভৃত্য—সেসব কিছুই আমাদের জীবনে ছিল না। অনবরত নতুন নতুন লোক আসে, দু-চারদিন থাকবার পরেই বাবার দুর্ব্যবহারে তারা চলে যায়। শুধু দুজন—বাবার গাড়ির ধবধবে ড্রেসে সর্বদা ফিটফাট ড্রাইভার রহমানভাই, আর মার গাড়ির বুড়ো ড্রাইভার রামুদাদা—এরাই কেবল পুরোনো ছিল। জানি না, বাবা কেন এদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন না। রামুদাদার সব চুল সাদা ছিল। রামুদাদা নাকি মার ছোটবেলাতে দাদুর গাড়ি চালাত। বাবা রামুদাদাকে বকাককি করত না। আর রহমানভাই এতই সভ্যভব্য, এত কেতাদুরস্ত, এত গম্ভীর, ওকে ধমক দিতে রীতিমতো এলেম লাগে। বাবা ওকে একটু মান্য করেই চলতেন বলে মনে হত। এখন বুঝতে পারি বাবার ব্যবসার সব কলকাঠি আর ব্যক্তিজীবনের সব রহস্য রহমানভাইয়ের জানা ছিল। ওকে চটানো, বাবার পক্ষে প্রচণ্ড ক্ষতিকর হতে পারত। রামুদাদা গার্জেন হতে পারত আমাদের, কিন্তু বাবার কড়া নিয়ম ছিল, ড্রাইভাররা কেউ ভেতরবাড়িতে ঢুকবে না। মা চলে যাবার পরে যখন টুসাং এল, আমার দেখাশুনো করতে—তখন রামুদাদাকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হত না। আমাকে দেখতে হলে সে নীচে এসে চেঁচাত, ‘বাঁনসুরী দিদি—একটুখানি বাইরে আয়’—আমি বারান্দায় ছুটে যেতাম—রামুদাদা তখন আমার জন্যে গোলাপি শণের নুড়ি বুড়ির চুল কিনে ওপরে পাঠিয়ে দিত।

বাবার বহির্মুখী জীবন একটুও কমল না, বরং মার মৃত্যুর পর আরও বেড়ে গেল। বাড়ি থাকলে বাড়িতেই মদের আড্ডা বসাতেন। শুধু বান্ধবী নয়, আজেবাজে যত নিম্নশ্রেনির লোকজন ডেকে এনে হইচই শুরু করে দিতেন। আমি হস্টেল থেকে তিনমাসের উইন্টার ভেকেশনে কলকাতাতে এসে অস্থির হয়ে যেতাম। ছোড়দা যতটা পারে এসে বাড়িতে থাকত সেই সময়টা। সংসারে দাদা ছাড়া আমার কেউ ছিল না। না, আর ছিলেন মামিমা। বিধবা ছোটমামিমা আমাদের দূর থেকে মাতৃস্নেহে ঘিরে রেখেছিলেন। তাঁর নি:সন্তান জীবনে আমার নিজস্ব একটি স্থান হয়েছিল। ছোটদের টিচার ছিলেন তিনি—নীচু ক্লাসে পড়াতেন। ইস্কুলে তাঁর উপস্থিত খুব জরুরি ছিল আমার কাছে। যখন বড় হলাম, পড়াশুনোতে যে ভালো হলাম, সব মামিমারই উৎসাহে। মামিমারই আগ্রহে। অনেকটাই তাঁর মুখ চেয়েও। সেই স্নেহের যোগ্য প্রতিদান দিতে পারিনি।

এই ছোটমামিমা ক্রিশ্চান ছিলেন। ছোটমামার সঙ্গে ওঁর বিয়ে দাদু মেনে নেননি। ছোটমামা মামিমাকে নিয়ে আলাদা সংসার পেতেছিলেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই দাদু মারা যান। দাদুর মৃত্যুর পর মাস না ঘুরতেই ছোটমামার প্রচণ্ড টাইফয়েড জ্বরে মৃত্যু হয়। দিদিমা তারপরেই নাকি নিজে গিয়ে ছোটমামিমাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। নববধূ হয়ে ঠাঁই না পেলেও বৈধব্যে মামিমা শ্বশুরঘরে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সেই সময়েই কার্শিয়াঙে মিশনারি স্কুলে চাকরি পেয়ে ছোটমামি পাহাড়ে চলে যান। দিদিমার অনুমতি ছিল। দিদিমাকে আমি চোখে দেখিনি। কিন্তু খুব দেখতে ইচ্ছে করে। মাকে দেখেছি অতি শৈশবে। মাত্র চার বছরই—তবু মাকে স্পষ্ট মনে আছে। মাকে আমার মনে পড়ে খুব স্নেহময়ী খুব নরম, আর দু:খী মানুষ বলে। মা যে কেন, কীভাবে মারা গেলেন দুপুরবেলায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, তা আমি কোনওদিন জানতে পারিনি। হার্ট অ্যাটাক বলেই জেনেছি সবাই। হয়তো সেটাই সত্য। বাবা সেদিন শহরে ছিলেন না। ছোড়দা বোর্ডিং-এ ছিল। কোনও পুলিশ কেস হয়নি। কোনও চিঠিপত্র ছিল না।

.

বাবাকে দেখে দেখেই বোধহয় ছোড়দার ধনী মানুষে আর রুচি ছিল না। ইন্দ্রর সঙ্গে আমার সংযোগ ঘটিয়েছিল ছোড়দা—ইন্দ্র একজন আদর্শবাদী, রুচিমান, শিল্পী মনের যুবক বলে। হোক সে জেলখাটা, ছোড়দার আপত্তি হয়নি ইন্দ্রকে তার বোনের জীবনসঙ্গী বলে মেনে নিতে। সেই ইন্দ্র যে মদ্যপ হয়ে যাবে, বাবার মতোই উড়ানচণ্ডেপনা করবে, এটা ভাবেনি ছোড়দা।

ইন্দ্র কিন্তু ছোড়দাকে খুব ভালোবাসে। শ্রদ্ধা করে। ইন্দ্র যে আজ নেশা ছাড়তে পেরেছে, সেটা আমার জন্যও নয়। ওর মায়ের জন্যও নয়। এমনকি রঙিনের জন্যও নয়। আমি মনে মনে জানি ওর সবচেয়ে বড় লজ্জা ছোড়দার কাছে। যে-ছোড়দা জেল থেকে বোনের পাত্র খুঁজে এনেছিল, তাকে বিফল হতে দেওয়া যায় না। এত বড় বিশ্বাসের অমর্যাদা করতে চায়নি ইন্দ্র। প্রবল চেষ্টা করে নিজেকে ফিরিয়ে এনেছে।

এখন বাকিটুকু ভরে তোলার অপেক্ষা। মা সুস্থ হয়ে ফিরছেন। রঙিনের কলেজ ছুটি হয়ে সে-ও সামার ভেকেশনে বাড়িতে। ইন্দ্রকে এখন পুরোপুরি নিজের মধ্যে নিজেকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। ও চেষ্টা করছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *