ইহজন্ম – ৮

| ৮ | বাঁশি

রমলার শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছিলেন গ্রাম থেকে। এসে ভীষণ উদ্বেগে আছেন ওঁরা।

মেদিনীপুরের গণ্ডগ্রামের ছেলে সুজিত মণ্ডলকে বিয়ে করে সটান বিদেশে চলে এসেছে রমলা পাল। আই. টি. একসপার্ট সুজিতের গ্রামে এখনও ইলেকট্রিসিটি নেই। সুজিত জোর করে তার মা-বাবাকে আনছে—রমলার গতবারে মিসক্যারেজ হয়েছিল বলে সে চায় তার মা ওর কাছে এসে থাকুন—রমলা যেহেতু মাতৃহীন। রমলা মেয়েটার খুব মিষ্টি স্বভাব এবং পড়াশুনোতেও ভালো, কেমিষ্ট্রি অনার্স পাশ করেছে সে মেদিনীপুর কলেজ থেকে—তারপরই বিয়ে হয়ে বিদেশযাত্রা।

সুজিতের মা-বাবা এসে অথই জলে পড়বেন এটা আগেই ভেবে নেওয়া গিয়েছিল। এলে, রমলার উপকারের চেয়ে হয়তো অপকারই বেশি হবে—এমন ভয়ও আমাদের অনেকের ছিল। কিন্তু সুজি এক নম্বরের গোঁয়ার ছেলে। কারুর কথা শোনা তার স্বভাব নয়—’দিদিভাই, আপনি কিছু ভাববেন না।—আমার বাবা-মা গ্রামের মানুষ হলে কি হবে, সব কিছু শিখে ফেলবেন। আমি শিখিনি?’

তাঁদের তো প্লেনে উঠেই ভীতি শুরু হয়েছে, তারপরে এত বড় এয়ারপোর্ট লস এঞ্জেলস নেমে ইমিগ্রিশনে তো প্রাণান্তর যোগাড়। আজকাল সিকিউরিটির নামে যা নাকাল করে! পা থেকে জুতো খুলে নেয়, গা থেকে গহনা খুলে নেয়, শেষে আঙুল থেকে টিপছাপ নিয়ে নেয়—প্রত্যেকটি বিদেশিই যেন সম্ভাব্য টেররিস্ট!

ওঁদের যে ভিসা জুটেছে সেটাই মস্ত কথা। ওঁদের সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সুজিতের এক বন্ধু শরদিন্দু। শরদিন্দুর সঙ্গে এসেছেন বলেই তাঁরা জীবিতবস্থায় বাড়ি পৌঁছেছেন, কিন্তু পৌঁছে মৃতপ্রায় হয়ে পড়েছেন। রমলাকে সাহায্য করতে সোহিনী গিয়েছে—সোহিনীর এখন ছুটি চলছে—সকাল থেকে সেই থাকে বাড়িতে, সুজিত যখন অফিসে যায়।

 সোহিনী দিল্লির মেয়ে—খুব স্মার্ট। মেয়েটি ভালো, বিয়ে হয়ে এসেছে অল্পদিন হল, পড়াশুনা করবে বলে চাকরিতে ঢোকেনি। ওর হাতে এখন সময় আছে। সোহিনীর কাছে গল্প শুনছি। হ্যাঁ, মাসিমা-মেসোমশাই কমোড ব্যবহার করতে পারছেন। কাগজও। কিন্তু বালতি-মগ দেওয়া হয়েছে, শাওয়ার কিউবিকলে শৌচের ব্যবস্থা করে দিয়েছে সুজিত। বারান্দাতে অত রোদ্দুরে যে কেন গামছা শুকোতে দেওয়া যাবে না, সেটা ওঁরা বুঝতে পারেননি বটে, কিন্তু মেনে নিয়েছেন। সমস্যা অল্প নয়। ইলেকট্রিকের সুইচ থেকে শুরু। না। শুরু মেইনগেট খোলানো থেকে। প্রথমে নম্বর টিপে হ্যালো বলতে হবে ফোনে, তারপর ‘খোলো, আমি তোমার বাবা’—বলতে হবে। সেইটে শুনে ওরা ওপরে বেল টিপবে। সেই বেল যতক্ষণ ধরে বাজবে, তার মধ্যে দৌড়ে ঠেলেঠুলে, হাতল ঘুরিয়ে, সদর দরজাটা খুলে, ঢুকে পড়তে হবে ভেতরে। ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে, দ্বিতীয় দরজা খুলে, লবিতে। সেখানে সুইচ টিপে লিফটকে নীচে ডাকতে হবে। লিফট এলে, চড়েই আগে বাইরের দরজাটা টানতে হবে, তারপরে ভেতরের দোর বন্ধ করতে হয়। নইলে লিফট নড়বে না। তারপরে দেখে দেখে সঠিক বোতামটি টিপতে হয়—B মানে বেসমেন্ট, L মানে একতলা, ওয়ান টিপে দোতলায় উঠবে। সেটাই একতলা।

ওর বাবাকে এটা বোঝাতে ওদের প্রচুর সময় লেগেছে। তারপর লিফট থেকে নেমে পড়বার আগেই তার দরজাটা তেড়ে আসে, বন্ধ হবে বলে। একহাতে সেই দোরকে সজোরে ঠেলে রেখে, দৌড়ে নেমে পড়তে হয়। নইলে হাতটা, আঁচল, কোট, কিছু একটা লিফটের মধ্যে আটকে যাবেই।

ওদের ফ্ল্যাট অবধি পৌঁছুতেই তো এত কসরত। তারপর ঢুকেই কি আরাম আছে?

সারাটা বাড়ি কার্পেটে ঢাকা। মেঝে বলতে কিছু নেই। মেঝে আছে কেবল বারান্দায়। সেখানে চটি না পরে বেরুনো বারণ, মেঝেয় বসাওও বারণ। চেয়ার টেবিলে ছাড়া বসতে নেই বারান্দায়। ধুলো-ময়লায় ভরতি নাকি। কই, দেখা তো যায় না কিছুই। মুছতেও দেবে না মেঝেটা। আর ঘরের কার্পেটে বুঝি ধুলো নেই? কার্পেট মানেই তো ধুলোর সিন্দুক। ঝাঁটপাট দেওয়ার বালাই নেই, ঘর মোছা হয় না। কী মুছবে? টেবিল মোছা হয় কেবল। ওই সকড়ি টেবিলেই সবাইকে খেতে হবে। ওর শাশুড়ি বলছিলেন উনি শনিবার আর বৃহস্পতিবার ব্রত করেন, নিরামিষ খান, আমিষের ছোঁওয়াও খান না। কিন্তু সর্বস্ব থাকে তো ওই রেফ্রিজারেটারের ভাঁড়ারে—মাছ, মাংস, ডিম থেকে দুধ, ফুল, মিষ্টি পর্যন্ত। ছোঁয়াছুঁয়ির আর কোনও বাবা-মা রইল না। অন্য কোথাও যে রেখে দেবেন একটু পরিষ্কার খাবার আলাদা করে, খাটের তলায়, কি জানলার তাকে, তারও উপায় নেই, না আছে খাটের তলা, না আছে জানালায় তাক। একটা জালের আলমারি পর্যন্ত নেই গো? শিকে-টিকের কথা বাদই দিচ্ছি। শ্বশুরের অভিযোগ—ঘরের ভেতরেও আদুড়-গায়ে থাকা যাবে না, এমনকী গেঞ্জি-লুঙ্গি পরেও থাকা যাবে না। শাশুড়ি-মা যে শেমিজের ওপরে সাধারণ করে শাড়ি পরে থাকেন—সেটা অবশ্য চলবে। শ্বশুরকে কিন্তু প্যান্ট আর শার্ট পরে থাকতে হচ্ছে। দেখেশুনে সোহিনী বলেছে ওঁর ঘরে পাজামা আর হাফহাতা গেঞ্জি পরলে কিছু ক্ষতি নেই।

সুজিতের মা-বাবা দুজনেরই প্রচণ্ড শক, কেলেংকারি কাণ্ড, এরা কাঁচা দুধ খায়। দুধ জ্বাল দেবার ব্যাপারই নেই মোটে। এমনকি দুধ গরম করেও খায় না। যে-ছেলে গরম দুধ ছাড়া মুখে তুলত না, সেই সুজিত এখন ফ্রিজ থেকে কাগজের ঠোঙা বের করে গেলাসে ঢেলে নিয়ে ঢকঢক করে কাঁচা দুধটা ঠান্ডা ঠান্ডাই খেয়ে নেয়। চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না, এতও বদল হয় মানুষের বিলেতে এলে? অথচ দেশে যখন যায়, তখন তো এসব করে না? দিব্যি জ্বাল দেওয়া দুধ গরম গরম জামবাটি ভরে সোনামুখ করে খায়। আগের মতনই। এখানে দেখছেন সব আলাদা। দেশে কেউ বাইর থেকে ঘুরে এলে আগে পা ধুয়ে, তবে ঘরে ঢোকে, সুজিতও তাই করে। অথচ এ-দেশে পা ধোয়াধুয়ির বালাই নেই—কলঘরের মেঝেতে মোটে জলই ফেলা চলবে না—জল ফেললেই সেই জল নাকি নীচের তলার লোকদের মাথায় পড়বে, কাঠের মেঝে লিক করে। এ একটা বাড়ি তৈরির ধরন হল? চানঘরের মেঝেতে জল ফেলতে বারণ? বাব্বা:!

সোহিনী ওঁদের বাথরুম ব্যবহার করতে শেখাচ্ছে খুব যত্ন করে—শাওয়ার কিউবিকলে ঢুকে পরদা টেনে স্নান করতে হবে, জল যেন একফোঁটাও না বাইরে পড়ে! বাথটবে নেমে শাওয়ার নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন শ্বশুরমশাই, ঘরময় জল ছড়িয়ে কেলোর কীর্তি। তা ছাড়া বাথটবে ঢুকতে বেরুতে বেশ ব্যালান্সের কায়দা লাগে। বুদ্ধিমতী শাশুড়ি-মা সে চেষ্টা করেননি। শ্বশুর টিভি চালানো শিখে ফেলেছেন ঝটপট—এবং টিভির পোকা হয়ে গেছেন অনতিবিলম্বে। টিভির সামনের সোফাতে আধশোয়া হয়ে, শান্ত চিত্তে টিভি দেখেন সারাদিন।

শাশুড়ি-মা ঘুরঘুর করেন, ঘরের কাজকর্ম করেন, জামাকাপড় পাট করেন, ইস্ত্রি করেন। ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করতেও শিখে ফেলেছেন, এবং তাঁর বিস্ময়ের সীমা নেই। যন্তরে কী সুন্দর আছড়ে আছড়ে কাপড় কাচছে! আবার নিংড়ে নিংড়ে জল বের করে দিচ্ছে। শুধু তাই? আবার কাপড় শুকোনোর জন্যেও মেশিন আছে—গরম বাতাসের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে ভিজে তোয়ালে পর্যন্ত শুকনো খটখটে হয়ে যাচ্ছে! ম্যাজিক দেখার মতো অবাক হয়ে যায় সুজিতের মা। সবচেয়ে অবাক হয়েছেন ওদের বাসন মাজার যন্তরটা দেখে। না, ওটা উনি ব্যবহার করতে রাজি নন। অতগুলো কাচের বাসন,প্লেট, গেলাস, কাপডিশ—সব ধুয়ে মেজে সাফ করেছেন অতটুকু মেশিন, সঙ্গে সঙ্গে সিলভারের কাঁটা-চামচও মেজে ফেলছে—এ যে দৈত্যপুরীর ম্যাজিক রে! উনি অবশ্য বাধা দেন না—যদি সুজিতরা মেশিনে বাসন ঢোকাতে চায় ঢোকাক। সেটা ওদের ব্যাপার। কিন্তু বড্ড নিঘিন্নে ব্যাপার! যত্তো এঁটো বাসন, মাছ-মাংস, দুধ, মিষ্টি—সব বাসনই একসঙ্গে ধোওয়া মাজা হচ্ছে। এই দৃশ্যও অসহনীয়। ভেঙেও তো কই যায় না বাপু? এত ঠোকঠুকি হচ্ছে। কাচের বাসনের সঙ্গেই হাঁড়িকড়া, হাতাখুন্তি সর্বস্ব মাজা হচ্ছে ওই বাক্সতে পুরে। সুজিতের মা সব শিখতে রাজি, শুধু ডিশ ওয়াশারটা তাঁর ঘেন্না করে। তিনি প্রত্যেকটা ধোওয়া বাসন তাক থেকে আবার নামিয়ে, আবার সাবানে ধুয়ে, মুছে, ঝকঝকে করে তুলে রাখেন। নইলে ওতে করে খেতে দিতে পারবেন কেমন করে? রমলা হাসে। শুধু সুজিত রাগ করে—’এ কী তোমার গোঁয়ার্তুমি বল তো মা?’

ডিশ ওয়াশারটাকে মেনে না নিলেও ওর মা-বাবা টেবিলে বসে খেতে শিখে ফেলেছেন। শনৈ: শনৈ: তাঁদের মার্কিন প্রবাস অভ্যস্ত হয়ে আসছে। রমলা থাকলেও সোহিনী রোজই এসে সাহায্য করে। কেন না রমলাকে বিশ্রামে থাকতে হবে, ডাক্তারের আদেশে। শাশুড়ি-মা তো উনুনে হাত দিতেই ভয় পাচ্ছেন, আগুনই জ্বলে না, এ কেমনধারা উনুন? তিনি দেশে গ্যাস দেখেছেন, কিন্তু এখানে ব্যাপারটা অন্য। আগুন জ্বলে না কিন্তু লোহার চাকতিগুলো গরম হয়। ছ্যÒাকা লাগে। দিব্যি ভাত ফোটে। এমনধারা অদ্ভুত চ্যাপটা, লোহার পাতের উনুন বাপু দ্যাখেননি তিনি, বাপের জন্মে, ওখানে আঁচ বুঝবেন কেমন করে, রাঁধবেনই বা কেমন করে? সোহিনী আস্তে আস্তে ওঁকে শেখাচ্ছে। শিক্ষক রমলার বদলে সোহিনী হওয়ায়, শাশুড়ি-বউমার অহংযুদ্ধের সমস্যা ঘটছে না। শাশুড়ি নাকি খুবই স্মার্ট মহিলা, কি লিফট ডাকা, কি ফোনে দোর খোলানো, সবই তিনি তাঁর কর্তার আগে আগে শিখে ফেলছেন। রান্নাঘরের সাজসরঞ্জামও আয়ত্তে আনতে তাঁকে বেশি বেগ পেতে হবে না। তিনি বিনয়ী এবং বুদ্ধিমতী। তাঁর স্বামীর ঠিক বিপরীত তিনি। এবং গ্রাম্য বঙ্গ মহিলার স্বভাব অনুযায়ী, যারপরনাই ধৈর্যশীলাও সোহিনী দেখছে তিনি শিখতে আগ্রহী। তাঁর ইংরিজি অক্ষরজ্ঞান আছে, অল্পস্বল্প পড়তে জানেন। সেটাও শিক্ষার কাজে লাগছে। রমলার শ্বশুর-শাশুড়িকে আমি একদিন ডাকব মা বাড়ি এলে। মা’র সঙ্গে দেখা হলে ওঁদের ভালো লাগবে। মা সুন্দর করে বুঝিয়ে দেবেন, এ দেশে এসে থাকার সুবিধে কী কী। অসুবিধে তো তিনিও অনুভব করেছিলেন এসে। কত সুন্দর মানিয়ে নিয়েছেন। রমলার শ্বশুর-শাশুড়িরও বিদেশ অভ্যেস হয়ে যাবে—শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ছেলেটা কিন্তু অসাধারণ। ওর আত্মবিশ্বাসের গভীরতা দেখে আমার ওর প্রতি সম্মান বেড়েছে। ওর হিসেবে ভুল ছিল না। শাশুড়ি এসে রমলাকে খুবই যত্ন করছেন। আর শ্বশুরমশাই টিভি দেখে মুগ্ধ। এত বড় প্লাজমা টিভি দেশের শহরেও নেই। ওঁদের গ্রামে তো বিজলিবাতিই নেই। ওঁরা ভাগচাষী, মাটির ঘরে বাস। খোলাখুলিই সব গল্প করছিলেন সেদিন। আমি যখন গিয়েছিলুম, শ্বশুরমশাই তখন দিবানিদ্রায় শুয়েছিলেন, পাশের ঘরে, শাশুড়ি-মা রমলার পাশে বসে বসে কাঁথা সেলাই করছিলেন। রমলা টিভিতে একটা হিন্দি সিরিয়াল দেখছিল, ওর রোজ সেটা দেখা চাই-ই চাই। নেশা। জি-টিভির এখানে বিশাল একটা খরিদ্দার গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, ওর পারিবারিক সিরিয়ালগুলোর কল্যাণে। রমলা এখন শাশুড়িকেও তার নেশার সঙ্গী করার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে প্রবাস জীবন অনেকটা অভ্যেস হয়ে গিয়েছে ওঁদের, ক্যালিফোর্নিয়াতে বাস করতে আর তত খারাপ লাগছে না। সোহিনীকে আসতে হয় না। আমাকে চা করে দেবার জন্যে উঠছিলেন। মাসিমাকে রমলাই বারণ করল। বলল—’বাঁশিদি অত চা খায় না। বরং এক গেলাস ফলের রস দাও খাবে। বাঁশিদিরও ঠান্ডা পছন্দ মা, তোমারই মতন।’

‘তাই? তাহলে একটু ঘোলের শরবত খাবে মা? আমি তৈরি করে রেখেছি। যা গরম, একটু ঘোষের শরবত খেলে দেহটা জুড়োয়। বউমাকেও খাওয়াই। শুনেছিলুম বিলেতে নাকি বরফ পড়ে—এ তো উলটো!’

চমৎকার ঘোলের শরবত বানিয়েছেন। আমি ওঁর সঙ্গে সঙ্গে কিচেনে গিয়ে দেখি ফ্রিজ থেকে জাগ বের করে, কাচের গ্লাসে ঢেলে,প্লেটে বসিয়ে, মাসিমা আমাকে শরবত দিচ্ছেন। সোহিনীর ট্রেনিং চমৎকার।

‘থাক থাক থাক’—করে আমি ওঁর হাত থেকে নিয়ে নিই। এদেশে এসে সত্যি সত্যি নতুন জন্ম হয়েছে ওঁদের।

এই যে আমি ব্লু জিনস আর টিশার্ট পরে আছি, যথেষ্ট বয়স্ক বাঙালি মেয়ে, আমার কলেজ পড়ুয়া কন্যা আছে—মাসিমা কিন্তু আমাকে দেখে চমকালেন না। সোহিনীর শর্টস আর স্যান্ডো গেঞ্জি দেখে ওঁর অভ্যেস হয়ে গেছে। রমলা কিন্তু আজকাল লম্বা স্কার্ট আর বড় টিশার্ট পরছে—পেন্টুলুন পরে এখন হয়তো অত আরাম নেই ওর।

সোহিনীর সঙ্গে রঙিনের বেশ ভাব হয়েছে। যদিও ওরা সমবয়সী নয় এবং সোহিনী বিবাহিত—তবু, কাছাকাছি বয়েসে তো? ওরা দুজনে আজ সকাল গেছে ভুরু থ্রেডিং করাতে। মা আজই আসবেন। বড় গাড়িটা নিয়ে আমরা তিনজনেই ওঁকে আনতে যাব। ওখানে মা’র জিনিসপত্তর তো কম জমেনি এই ক’মাসে।

মা আসবেন বলে ইন্দ্র, রঙিন দুজনেই খুব উত্তেজিত। আমি কেবলই ঈশ্বরকে বলছি—তুমি অসীম কৃপাময়। এমন ভাবে সবকিছু আবার ঠিকঠাক হয়ে যাবে, কে ভেবেছিল? এক বছর আগেও আমরা ছিলুম ছিন্নভিন্ন—রঙিন আর আমি দুজন দুজনের হাত যেন শক্ত মুঠো করে ধরেছিলুম। মেয়েটার জীবনের সেই বন্ধুর, দুর্গম, অস্থির সময়ে ওই লেট টিনসে রঙিনের বাবার সহসা অধ:পতন, আর অমন ধীর স্থির ঠাকুমার মানসিক বিপর্যয় ওকে যেন ভিতর থেকে উলটেপালটে দিচ্ছিল। হ্যাঁ, আমার খুবই ভয় করেছিল। ওর মধ্যে নিজের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে কোনও উদ্বেগবোধ দেখিনি কোনওদিনও। কিন্তু এই সময়ে মনে হচ্ছিল মেয়েটা কোনওভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে না তো, আমাদের দু:সময়ের নিমিত্ত মনে করবে না তো নিজেকে? না, সেসব ভয় বৃথাই।

রঙিন শক্ত মনের সুস্থ সবল মেয়ে। ওর বাবার জন্য আমরা সপরিবারেই কাউন্সেলিংয়ে গিয়েছি বহুবার। রঙিন তাতে আরোই শক্তি সংগ্রহ করেছে। সত্যি, আমার মেয়েই হয়েছে বটে রঙিন। আমি তো ওর চেয়েও অনেক বেশি নিরাশ্রয় ছিলুম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *