| ৬ | ইন্দ্র
নটবর ভাওসারের স্টুডিওতে একবার লাঞ্চ খেতে গিয়েছিলুম বাঁশিকে নিয়ে। সেই প্রথম প্রথম আমার সঙ্গে আর্টিস্টদের পাড়ায় যাতায়াত আরম্ভ করেছে বাঁশি। সোহো অঞ্চলে পা দিয়েই বাঁশির অবাক হওয়ার শুরু। কলকাতাতে আমার বন্ধুবান্ধবদের বাঁশি ভালোই চিনত, শিল্পীদের স্বভাব-চরিত্র আচার-আচরণ তার অজানা ছিল না। কিন্তু এরকম বড়ো স্টুডিও-স্পেস তো বাঁশি দেখেনি! একটু পুরোনো বাড়ির ওপরের তলায়, ভাঙাচোরা খুদে জেলখানার মতো দেখতে একখানা লিফটে চড়ে সেখানে পৌঁছুতে হয়। সেই যাত্রাপথটাই খুব অদ্ভুতুড়ে। আর বাঁশির কাছে তো জীবনের সমস্ত কিছুই রোমান্টিক। জানি না ওই যুদ্ধ করে এসেও মেয়েটার মধ্যে এমন সীমাহীন রোমান্টিকতা, জীবনের প্রতি এমন তলহীন বিশ্বাস কী করে রইল! প্রবঞ্চনা, যন্ত্রণা, ঘৃণা সবকিছুই সে পুরোদমে চিনে এসেছে আশৈশব। তুবও এত পজিটিভ থাকে কী করে সারাজীবন?
নটবরের সেই পেন্ট স্টুডিওতে গিয়ে বাঁশির কী বিস্ময়, কী ফুর্তি! একটা পুরোনো ওয়্যারহাউসের মধ্যে এই বিশাল স্টুডিও—উঁচু উঁচু ছাদ, খোলা মাঠের মতো ঘর—নানারকমের আলো লাগানো আছে ছাদে, দেওয়ালে, যদিও বিশাল বিশাল কাচের জানালা দিয়ে দিনের আলো আসছে। দেশে এইসব সুযোগ সুবিধে আমাদের কোথায় ছিল? নটবর নিরামিষাশী—সুন্দর স্যালাড লাঞ্চ বানিয়েছিল নিজে। বাঁশি আর আমি তো অবাক। লোকজনকে ডেকে এনে এই ঘাসপাতা খাওয়ানো? সঙ্গে আবার ওয়াইন? কোনওরকমে লাঞ্চ সারা হল—চিজ বিস্কিট ছিল ভাগ্যিস, আর সুস্বাদু কালো রুটি। জুইশ ব্রেডও সেই প্রথম দেখল বাঁশি—পামপারনিকল ব্রেড। এমন কালো বিদঘুটে রুটি? চকোলেট কেক নয়? এ ম্যা! এখন বাঁশি নিজেই পামপারনিকল রুটির ভক্ত হয়েছে। এখন বাঁশি নিজেই স্যালাড খেতে বেশি পছন্দ করে রান্না করা খাবারের চেয়ে। এখন বাঁশি দিশি খানার চেয়ে বিদেশি খানা রান্না করে বেশি। যদিও জাংকফুডে তার অরুচি। রঙিনকে কিছুতেই KFC আনতে দেবে না! ম্যাকডোনাল্ডে অবশ্য আমরা যাই না, পলিটিক্যাল কারণে ওটা বয়কট করি। খাবার-দাবারটাও বড্ড আনহেওলদি। জাংকফুড সাধে বলে?
নটবরের স্টুডিয়ো কথাটা মনে পড়ল, কেন না আজ ওর একটা কার্ড এসেছে, একটা এক্সিবিশন হচ্ছে বোসের গ্যালারিতে । এই একটা ছেলে বটে! যামিনীদার কাছে দেখেছিলুম অনেকদিন আগে—আর্টে খুব আগ্রহ ছিল ছেলেটির।
সে-ই এখন নিউইয়র্কে এক গ্যালারি তৈরি করেছে—ভারতীয় শিল্পীদের ছবির প্রদর্শনী হয় সেখানে, মার্কিন শিল্পীদেরও ছবি থাকে। বাঁশির খুব ইচ্ছে ওখানে আমারও একটা প্রদর্শনী হোক। কিন্তু তার আগে কিছু ভালো ভালো নতুন ছবি আঁকতে হবে। শুধু পুরোনো ছবি দিয়েই প্রদর্শনী সাজানো ঠিক নয়, শিল্পী যখন জীবিত। নটবরের এই প্রদর্শনীতে আমরা উপস্থিত হতে পারব না। পশ্চিম উপকূলে আছি, চট করে অতটা খরচ করা সম্ভব নয়। গেলে অবিশ্যি ভালো হত, পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হত।
ক্যালিফোর্নিয়ার শিক্ষাজগৎও খুবই প্রাণবন্ত, কিন্তু আমি কলকাতার ছেলে তো? আমার কাছে নিউ ইয়র্কের সঙ্গে আর কোনও শহরের তুলনা হয় না। বাঁশির চাকরি এখনে, আমাদের সংসার তাই এখানেই পাতা। সানফ্রান্সিস্কো শহরের শিল্পীদের মধ্যে যে যৌন স্বাধীনতা চালু আছে, সমকামী শিল্পীদের এখানে স্বচ্ছন্দে সামাজিক সম্মানের সঙ্গে বসবাস করার সুবিধে আছে, সেদিনই তো সানফ্রান্সিস্কোর মেয়র ওই অপূর্ব টাউনহলের (এরা বলে সিটি হল) সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ সমকামী দম্পতিকে ‘বিবাহিত’ বলে ঘোষণা করলে—আমার তো সেই স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই।
আমার মুক্তির এলাকা অন্যত্র। আমি চাই আর একরকমের বেনিয়ম, যৌনতার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই—তার সম্পর্ক কেবল আমার সঙ্গে বাদবাকি জগৎসংসারের। সেই মুক্তি কিন্তু বাঁশিকে বাদ দিয়ে নয়, রঙিনকে বাদ দিয়ে নয়, মাকে বাদ দিয়ে নয়—ওদের প্রত্যেককে আমার চাই—ওদের মধ্য দিয়েই আমি নিজেকে ছুঁতে পারি, নিজেকে চিনতে পারি—মাঝে যেটা ঘটেছিল, সেটা মুক্তি নয়—ছুটি নয়। এখন বুঝতে পারি সেটাই ছিল আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধন, সেটাই ছিল নেশার কারাগারে বন্দিত্ব। নেশা শুধু শিল্পীকে বিভ্রান্ত করে। নেশা, ‘মার’-এর সহচরী। শিল্পীর তপস্যাভঙ্গ করতে দক্ষ সে—আমার কাজ ক্রমশ নষ্ট হতে হতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন আমাকে নতুন করে জন্ম নিতে হচ্ছে। এই জন্ম আমাকে দিচ্ছে বাঁশি, আমার স্ত্রী। সে কি জানে, যে আমি জানি, আমাকে সে এখন তার গর্ভে ধারণ করে আছে, খুব সাবধানে, নতুন করে জন্ম দেবে বলে?
নটবরের প্রদর্শনীর উদ্বোধনে যেতে পারলে অবশ্যই ভালো হত—অনেক পুরোনো শাগরেদদের সঙ্গে দেখা হত। শুনেছি যতীন দাসের আসার কথা আছে, সুজার কতগুলো ছবি একটা গ্যালারিতে দেওয়া হচ্ছে, সেই বিষয়ে বন্দোবস্ত করতে। যতীনের অজস্র গুণের মধ্যে এটাও একটা। সমকালীন শিল্পীদের সম্মান করা। এমনই একটা পৃথিবী আমাদের, প্রচণ্ড প্রতিযোগিতায় বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যেতে বসে।
আমার অধ:পতনের মূলে সেটাও ছিল, একটা কারণ। প্রচণ্ড কম্পিটিটিভ এই আর্ট ওয়ার্লড—হয় একা একা ছোটখাটো হয়ে বাঁচো, আপন মনে কাজ করে যাও, বেশি নাম করতে চেয়ো না, বেশি টাকা রোজগার করতে চেয়ো না। মিডিওক্রিটিতে তুষ্ট থাকতে পারলে কিন্তু তোমার দিব্যি দিন চলে যাবে, অর্থের সমস্যা হবে না। বন্ধুত্বেরও না। কিন্তু যদিও হও উচ্চাভিলাষী, তাহলেই তোমার সমূহ বিপদ।
আস্তে-আস্তে দেখবে চারিপাশে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, বন্ধুরা মুছে যাচ্ছে। যথাকালে ঠিক-ঠিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারলে দেখবে তোমার কাজের সমালোচনার হাওয়া বদলে যাচ্ছে বিপরীত মুখে। গতকাল যেটাকে ভেবেছিলে পুর্বদিক, যেখানে সূর্য উঠবে ভাবছিলে, আজ দেখবে আরে, কী আশ্চর্য, সূর্য তো ঠিক ওইখানেই অস্তে নামছে! শিল্পের সংসারেও প্রচণ্ড দলবাজি আছে। শিল্পীর গুণগত যোগ্যতাই যথেষ্ট নয়। সঠিক কলকাঠি নাড়তে না জানলে ছবি বিক্রি হয় না, ছবির প্রশংসা হয় না, এমনকী ভালো গ্যালারিতে প্রদর্শনীর বন্দোবস্তও করা যায় না। সর্বত্র দালাল চাই, এজেন্ট চাই—দলের লোক থাকা চাই।
আমার স্বাভাবের মধ্যে এটা নেই, আমি বড্ড অগোছালো। শিল্পীরা কিন্তু সকলেই কিছু অগোছালো হয় না, অনেকেই দিব্যি আখের গুছিয়ে নিতে জানে। কেউ কেউ পারে না। কেউ পারে। আমি ওই না-পারাদের দলে। আর সেইজন্যেই আমার যত গোলমাল। মা ব্যাপারটা বোঝেন! মা’র তো চেষ্টার কমতি ছিল না। মা, বাঁশি, রঙিন—আমার জীবনের তিনটি নারীই ঠিক তিনটি দেবদূতের মতো আমাকে স্নেহে-প্রেমে-ভালোবাসায় ঘিরে রেখেছে। কিন্তু সেটাকে তো একজন পুরুষমানুষের জাগতিক সাফল্যের শেষ মাপকাঠি বলে মেনে নিতে পারিনি আমি। আমি চেয়েছিলুম শিল্পজগতে খ্যাতি, শিল্পজগতে প্রতিপত্তি। অথচ তার জন্য যতটা ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো উচিত ছিল আমার, হয়তো ততটা শক্তি আমার মধ্যে নেই। শুধু তো ট্যালেন্ট থাকাই যথেষ্ট নয়, সেই ট্যালেন্টকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরবার শক্তিও থাকা চাই। বাজারে নামাতে হলে বাজারি বুদ্ধিও থাকতে হবে বইকি। আমি স্বভাবত অলস। ঘরকুনো মানুষ। নিবুর্দ্ধিও বটে। যথাকালে যথাস্থানে উপস্থিত হতে আমি কোনওদিনই পারিনি। যখন যাদের সঙ্গে মেলামেশা করলে আমার উপকার হত, তখন তাদের পাত্তা দিইনি। পরে পস্তালে আর হবেটা কী? যতদিন নিউইয়র্কে রইলুম, নিজের মনে রইলুম, ঠিকমতো শিল্পী সংসর্গ করিনি। এখন এখানেও অবিকল তাই করছি। একা থাকি। একা আঁকি। কিন্তু এবার একটা পরিবর্তন এসেছে আমার মধ্যে। খুব জরুরি পরিবর্তন। আমি আর খ্যাতির ভিখারি নই।
আমি তো চোখে দেখলুম খ্যাতি শিল্পীকে সুখ দেয় না, শান্তি দেয় না, শুধু অর্থ দেয়।
আমার নেশামুক্তির সময়টাতে আমি অনেক কিছু বুঝতে শিখেছি, ভাবতে শিখেছি। অভ্যস্ত মুল্যবোধগুলোর বিচার করতে বসে বুঝেছি অনেকরকম ভুলকে মূল্য দিয়েছি জীবনে। আর দেব না।
বাঁশি সবসময় বলে, ‘হ্যাঁ, সময় আছে। সময় কখনও ফুরোয় না।’ ‘সময় ফুরিয়েছে’ কথাটা ভুল, শেষ নিশ্বাসটা যখন পড়ে, শুধু তখনই সময় ফুরোয়। তার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের সময় আছে।’
ভালো করে বাঁচবার সময় আছে। সুন্দর করে জীবনকে গড়বার সময় আছে। জীবনের অর্থ খুঁজে পাবার নামই তো ‘সার্থকতা’? স + অর্থ করে তোলা এই মনুষ্য জীবনকে? অন্যের বেঁধে দেওয়া কোনও অর্থে নয়, নিজের তৈরি করা অর্থে চিনে নিতে হবে জীবনকে। তার সময় কখনও ফুরোয় না।
এই যে আমি একটা গভীর অন্ধকার গুহা থেকে আস্তে আস্তে আলোয় ফিরছি, আমি জানি, এই আলোটা আগের চেয়েও উজ্জ্বল। বহুদূর পর্যন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে এই নতুন আলোতে। আমি যদি এই আলোকিত অস্তিত্বের সুযোগ নিতে না পারি, আমরা শিল্পের যদি মোড় না ফেরাতে পারি, তাহলে কিন্তু নিজের কাছেই নিজে হেরে যাব।
এখন আমি নতুন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামব—পুরোনো ইন্দ্রের সঙ্গে নতুন ইন্দ্রের। বাঁশির গর্ভ থেকে যে ইন্দ্রের জন্ম হচ্ছে, তাকে কোনওমতেই হারলে চলবে না। আমার মা, আমার মেয়ে চোখ ভরে, মন ভরে দেখবে। দেখবে, তাদের প্রিয় ইন্দ্র কেমন করে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে, কেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বাঁশির এত চেষ্টার, ওর মনপ্রাণ ঢালা এত শুশ্রূষার একটাই প্রতিদান দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব—নতুন, উজ্জ্বল, সপ্রাণ এক শিল্পীকে পুন:প্রতিষ্ঠা করতে হবে আমার জীবনে।
যাকে দেখে বাঁশি এসেছিল, একে হতে হবে তার চেয়েও উজ্জ্বল। তবেই না মেয়েটার এত সহ্যের, এত ধৈর্যের যথার্থ ফসল ফলবে?
না, আর না। যা করে ফেলেছি, তা এখন অতীত। সেই দাগ আমি মুছতে পারব না।— যে কষ্ট ওকে দিয়েছি, যে-অপমান ওকে করেছি, তার বদলে ও আমাকে দিয়েছে কেবল ক্ষমা। যখনই চুপচাপ ভাবতে চেষ্টা করি, স্তম্ভিত হয়ে যাই। ও আমাকে সহ্য করত কী করে? মা পারেননি। পারেননি, তাই নিজেও গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিলেন। বাঁশি মাকেও দুই অঞ্জলি ভরে কুড়িয়ে এনে গেঁথে তুলেছে। বাঁশি পারে কেমন করে?