| ৫ | বাঁশি
ইন্দ্রের সঙ্গে রঙিনের আজ গাড়িতেই বেধে যাচ্ছিল, আরেকটু হলেই—যেই রঙিন বলতে শুরু করেছে ওর রুমমেটেদের কাছ থেকে দূরে যেতে পেরে ওর কতটা স্বচ্ছন্দ লাগছে, অমনি ইন্দ্র বলল—’তোরও সেই বাঙালিদের মতন গেতো মেন্টালিটি হয়েছে, দিশি ছেলেমেয়ে ছাড়া বন্ধু পছন্দ হয় না।’
রঙিন বলে উঠল—’বাবা, দিশি কি বিদেশি সেটা হিসেব করে তো বন্ধুত্ব হয় না, তোমার সঙ্গে কার কতটা মিলছে সেটাই আসল। যদি দিশিদের সঙ্গে মিশতেই আমার বেশি আরাম হয়, যদি মনে হয় উই শেয়ার আ লট, উই কাম ফ্রম সিমিলার ব্যাকগ্রাউন্ডস, উই আনডারস্ট্যান্ড ইচ আদার বেটার, তাহলে তো তাদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হবে? নাকি সাদাদের দেশে এসেছি বলে ওদের সঙ্গেই শুধু মিশতে হবে—সেটাই বেশি বেশি সোশ্যাল আপগ্রেডিং, আর নিজেদের মধ্যে মিশলেই সেটা লো গ্রেড হয়ে যাবে? গেতো কি এমনি এমনি হয়? গেতোর মধ্যে কমফর্ট আছে। ইউ আর অ্যামাং ইওর ঔন পিপল—হোয়ার্টস রং উইথ দ্যাট, বাবা?’
আমি তাড়াতাড়ি মধ্যস্থতা করি—’বাবা বলছেন অনেক সময়ে তো উলটোও হয়—জেনোফোবিয়া হয়ে যায় প্রবাসী মানুষদের। তারা কিছুতেই মূলস্রোতে মিশে যেতে পারে না, বিদেশের মানুষদের কিছুতেই আপন ভাবতে পারে না। তুমি তো আমেরিকান বর্ন—এখানেই তোমার জীবন—’
—’হ্যাঁ, বর্ন, কিন্তু অল আমেরিকান গার্ল তো নই আমি? আমার মা, বাবা, ঠাকুমা, সবাই ইন্ডিয়ান, আমি কেন ইন্ডিয়ান না হয়ে অন্য কিছু হব? কালচারালি আমরা নাইদার হিয়ার নর দেয়ার—মা!’
ইন্দ্র ব্যাপার বুঝে সামলে নিল—’বুঝেছি, বুঝেছি, তোমরা হলে ABCD আমেরিকা-বর্ন-কনফিউজড দেশি মাল।—তাই তো? সব সাউথ এশিয়ান ছাত্র-ছাত্রী তো নিজেদের তাই বলে—তা বলে—’
—’সব সাউথ এশিয়ানরা না, বাবা। যারা দেশ থেকে পড়তে আসে, তারা কনফিউজড না। যদি না ইচ্ছে করে ওইরকম হয়ে যায়। আমরা যারা জন্মেছি এ-দেশে, বাড়িতে পুরো দেশি ভ্যালুজে বড় হচ্ছে, আর স্কুলে পুরো বিদেশি ভ্যালুজ শিখছি, তাদেরই যত কনফিউশন হয়। কোনটা নেব? অন্য অন্য ‘দেশি’ বয়েজ অ্যান্ড গার্লস অলসো ফিল দ্য সেমওয়ে, বাবা, তাই আমাদের মধ্যে যদি বেশি মিল হয়, ইটস ওনলি ন্যাচারাল, তাই না? জানি না, পরে কীরকম লাগবে, যখন বেশিদিন কলেজে থাকা হয়ে যাবে, মে বি উইল ফিল মোর কনফিডেন্ট—কিন্তু এখন, এই তো প্রথম বাবা-মায়ের ঘর ছেড়েছি, উই আর লিভিং অ্যাওয়ে ফ্রম আওয়ার হোমস ফর দ্য ফার্স্ট টাইম—ন্যাচারালি অন্যরকম লাগবে, তাই না? সুনীতারও তাই লাগছে, শি টু ইজ ফিলিং অকওয়ার্ড—যদি দুজনে একসঙ্গে থাকি, উইল বি মোর রিল্যাক্সড, পড়াশুনো বেটার হবে—ট্রাই টু আনডারস্ট্যান্ড আস, বাবা, ডোন্ট জাজ আস—জাজিং ইজ ব্যাড—’
ইন্দ্র হেসে ফেলল—’নাউ হু ইজ জাজিং হুম? অ্যাঁ? কে এখন গুড আর ব্যাড-এর অংক কষচে? বাট আই এগ্রি, জাজিং ইজ ব্যাড, ইয়েস, ইউ আর রাইট!’
বাপেতে-মেয়েতে মিটমাট হয়ে গেল। আমি অন্য প্রসঙ্গ তুলি—’তারপর? নাচের ইস্কুলের ফাংশন তো এসে গেল রে। রিহার্সাল শুরু হবে এবার—’
মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল রঙিন—’রাইট! কী মজা! এবারে আমরাই তো সিনিয়ার মোস্ট—প্রীতিদি বলেছে আমাকে সোলো দেবে, আর রেণুকে। আমি ওর চেয়ে লম্বা, বোধহয় তাই আমাকেই কৃষ্ণ করবে, রেণু রাধা। জানো, এবারে ”ঝুলন” করা হচ্ছে, মা!’
রঙিন কত্থক শেখে। বছরে একবার করে ওদের স্কুল থেকে বড় করে অনুষ্ঠান করা হয়, সামার ভেকেশনের সময়ে মেয়েরা যাতে ঠিকমতো রিহার্সাল দিতে পারে। টিকিট বিক্রির একটা ঝামেলা আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে তখন এই যা। গার্জেনরা না কিনলে কে কিনবে? তা, মেয়ের পড়াশুনোর সময়ে স্কুল থেকেই কি কম ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়ত? রঙিন কখনও একগাদা কুকিজ নিয়ে এসে বলত,—’এগুলো বিক্রি করতে হবে, পয়সা এনে দাও।’ কখনও স্কুল থেকে একগাদা ফ্ল্যাগ দিল বেচারিকে বিক্রি করতে।—কে কাকে বেচবে বল তো ফ্ল্যাগ? একবার পঞ্চাশ শিশি ‘অরেগানো’ মশলা দিয়ে পাঠাল মেয়ের হাতে, বিক্রি করে টাকা এনে দাও। কাকে আর বিক্রি করব আমরা পঞ্চাশ শিশি অরেগানো? অত ইটালিয়ান রান্না কে করছে? সব দাম পকেট থেকেই দিয়ে দিলুম, তারপর অফিসে নিয়ে গিয়ে ওই অরেগানোর হরির লুট দিলুম—অর্থাৎ যাকে সামনে পাচ্ছি, তাকেই গিফট করছি—’কিগো, একটু অরেগানো নেবে? ফ্রি গিফট ফ্রম মাই ডটর।’ সত্যি বড়ই যাচ্ছেতাই সব নিয়ম এদের ইস্কুলের ফান্ড রেইজিংয়ের।
নাচের ইস্কুলেরও ওটা ফান্ড রেইজিং ড্রাইভ। নাচ দেখতে অবশ্য ভালোই লাগে। বাচ্চা মেয়েগুলো সেজেগুজে নাচে ভালোই। পাঞ্জাবি, গুজরাটি, আর দক্ষিণী মেয়েই বেশি—দুটি মাত্র বাঙালি মেয়ে আছে ওদের নাচের স্কুলে। রঙিন একজন, অন্যটির নাম সোমা। সে আরেকটু ছোট। সোমার মাকে আমি চিনি, ওখানেই আলাপ হয়েছিল। মেয়েটি সফটওয়্যার এঞ্জিনিয়র রচনা মিত্র। সিংগল মাদার। রচনা একটু গম্ভীর—ওকে সোমার বাবার কথা জিগ্যেস করিনি। সোমাও বিশেষ মিশুকে নয়, রঙিনের সঙ্গে ওর ভাব হয়নি। সে অবশ্য এখনও হাইস্কুলে। খানিকটা ছোট রঙিনের চেয়ে। রচনা মিত্রকে কিন্তু আমার বেশ লাগে। এত কচিকাঁচা চেহারা, মনেই হয় না সোমা ওর মেয়ে। সোমাকে বেশ বড়সড় দেখতে, ফরসা, নীল চোখ, কালো চুল। দেখে মনে হয় ওর বাবা বিদেশি।
গুজরাটি আর পাঞ্জাবি মেয়েদের মায়েরা রচনার চেয়ে বেশি মিশুকে—তাদেরই সঙ্গে বরং আমার বেশি ভাব হয়েছে।
রঙিন ওর নাচের স্কুলটা খুব উপভোগ করে। নাচ শিখতে যেতে ভালোবাসে মেয়েটা, ওর শরীরের মধ্যেই নাচের ছন্দ আছে, নাচ ওর স্বভাবগত। মা আমাকে বলেন, ‘রঙিন যখন নাচে, তখন মনে হয় একটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে।’ যখন ছোট ছিল, তখন ওকে ব্যালের ক্লাসে দিয়েছিলুম। সাদা ফ্রক পরে ও যখন ব্যালে নাচত, তখন সত্যি সত্যিই মনে হত যেন একটা ফুরফুরে সাদা ছোট্ট প্রজাপতি উড়ছে।
কিন্তু আমরা অন্য শহরে চলে এসেছি, এখানে কত্থক স্কুল পেয়ে, সেখানেই ভরতি করলুম রঙিনকে। ব্যালে শেখা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ওর টিচার বলেন, ব্যালে শিক্ষা ওর কত্থকেও নাকি কাজে লেগেছে। কী জানি নাচের অ-আ-ক-খও তো আমি শিখিনি।
আমি যেখান থেকে আজ যেখানে এসে পৌঁছেছি, যখন মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে বসি, মনে হয় যেন রূপকথা।
রূপকথা কিন্তু অনেকই প্রত্যক্ষ করেছি এই মার্কিন দেশে এসে। না হয় আমার কথাটা বাদই দিচ্ছি। সত্যি, আমার জীবনটা যেন একের পর এক ম্যাজিকের খেলা।
ইন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রঙিন পর্যন্ত।
আমার দু:খিনী মা, আমার অভাগিনী মা কিছুই দেখে যেতে পারলেন না, কিছুই জেনে যেতে পারলেন না। শুধু যন্ত্রণা আর ভয় ছাড়া তাঁর জীবনে আর কীবা ছিল?