ইহজন্ম – ৪

| ৪ | ইন্দ্র

আমি মাকে কখনও বিদেশে আনবার কথা কল্পনাও করিনি। কিন্তু বাঁশি মাকে দেশে ফেলে রেখে এ-দেশে বসবাস করার কথা কিছুতেই মানতে পারছিল না। মা যখন এলেন, তখন কিন্তু রঙিন বেশ বড়, ইশকুলে যাচ্ছে। অর্থাৎ রঙিনের দেখাশুনো করবার জন্যে মাকে আনেনি বাঁশি। বাবা যতদিন জীবিত ছিলেন, মা আসতে রাজি হননি, বাঁশি যদিও অনেকবার ডেকেছে দুজনকেই। বাবা একবার একা এসে ঘুরে গেলেন। মাকে আনলেন না, যদিও দুজনের টিকিটই আমরা পাঠাচ্ছিলাম। মাকে না আনার কারণ? সিজারকে কে দেখবে? বাবার আহ্লাদি কুকুর সিজার—বাবা তাকে আহ্লাদ দেন, আর মা তার যত্নআত্তি করেন।

বাবা এসে বেশ ফুর্তিতেই ছিলেন। রঙিনের আগমন হয়নি তখনও আমাদের জীবনে। আমি দিনভর স্টুডিয়োতে পড়ে থাকি, বাঁশি থাকে আফিসে। বাবা দিব্যি পার্কে হাঁটতে যেতেন, টিভি দেখতেন, কাগজ পড়তেন, নিজের লাঞ্চটা মাইক্রোওয়েভে দিয়ে গরম পর্যন্ত করতে শিখে ফেলেছিলেন। বাবাকে আমরা কেউ কোনওদিন এত শান্তশিষ্ট, এত ভদ্র, এত মানিয়ে-চলা মানুষ বলে দেখিনি। মা’র প্রশ্রয়েই সম্ভবত বাবা অতটা বেড়ে উঠেছিলেন। বাবার প্রেম—প্রণয়ের অভ্যেসটাও এখানে প্রকাশ পায়নি। কোনওরকম বেচাল দেখিনি তাঁর। যদিও একমাস পরেই পালিয়ে গেলেন, এমন দেশে মানুষে কেন যে আসে, কেন যে থাকে, সেই প্রসঙ্গে গভীর প্রশ্ন মনে নিয়ে। তাও তো এটা ক্যালিফোর্নিয়া, এখানে আবহাওয়াটি ঈশ্বরের কৃপার দান। বরফ পড়াও দেখেননি বাবা, গা-পুড়ে যাওয়া গ্রীষ্মও দেখেননি। বাবাকে পড়ার পাবলিক লাইব্রেরিটা চিনিয়ে দিয়েছিলুম, কিন্তু বাবা খুব একটা যেতেন না। টিভিই পছন্দ ছিল তাঁর। নইলে বাসে চড়ে বেড়িয়ে আসা।

মা’র বেলায় ঠিক উলটো হল। মা’র প্রতিদিন লাইব্রেরিতে যাওয়া চাই-ই। মা যে কলেজে পড়েননি কখনও লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশুনো করা হয়নি তাঁর, সেটা পুষিয়ে নিয়েছেন এখানে এসে। মা’র বৈধব্যদশা যেন মাকে নতুন জীবন এনে দিল। এ কথাটা সন্তানের মুখে উচ্চারিত হলে বেখাপ্পা শোনায় বটে কিন্তু কথাটা সত্যি। বাবার চাপে চিরজীবন নিষ্পিষ্ট হয়ে মা যেন অন্য একজন মানুষ হয়ে বেঁচেছিলেন। এখানে এসে মা পত্রেপুষ্পে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন। ইংরিজি বই পড়তে তো শুরু করলেনই মন দিয়ে। এমনকি আমার রং-তুলি নিয়ে ছবিও আঁকতে শুরু করলেন মা। মাকে উৎসাহ দিতে বাঁশি তাঁকে ড্রইংবোর্ড, ইজেল সবকিছুই কিনে দিল। মা অত্যন্ত চমৎকার কিছু অয়েল আঁকলেন। প্রথমে স্টিল লাইফ, তারপরে হঠাৎ একদিন দেখি রঙিনের একটা ছবি এঁকেছেন। দিব্যি চেনা যাচ্ছে রঙিনের হাসিমুখ। মা আর বাঁশি দুজনকে নিয়ে রঙিন বড় হয়ে উঠছিল ভারী সুন্দর করে—আমি তো থেকেও নেই।

আমি যে সংসারে আছি, সেটার ক্রেডিট সবটা বাঁশির। আমার থাকার কথা ছিল জেলে, কিংবা হাসপাতালে, কিংবা ফুটপাথে। আমার মধ্যে কোনও নিয়ম মানার প্রবৃত্তি নেই। সেটার জন্য এক এক সময়ে এক-একটা কারণ খুঁজে বের করি আমি। কখনও রাজনীতির অজুহাত, কখনও শিল্পের অজুহাত, কখনও নেশার অজুহাত—সবই কিন্তু আসলে অজুহাত মাত্র। আমি জানি, প্রকৃত উদ্দেশ্য অনিয়মে, উচ্ছৃঙ্খলতায় জীবনযাপন করা। আমার বাবার ভিতর থেকে এই বস্তুটি আমার মধ্যে এসেছে। বাবার প্রকাশ ছিল অন্য রকমে। নানা অসঙ্গত আচরণের মধ্য দিয়ে, স্থূল অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে বাবা তাঁর উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ করেছেন। আমি বাবার চেয়ে অনেক বেশি সূক্ষ্ম, বেশি বুদ্ধিমান, বেশি শিক্ষিত, আমি জানি কীভাবে অজুহাত তৈরি করতে হয়। কিন্তু আমি আর একটি জিনিসও জেনেছি। বাঁশির কল্যাণে। বাবা যেটি মা’র কাছে থেকে শিখতে পারেননি। আমি ভালোবাসতে জানি। মা বাবাকে ভয় পেতেন, মা বাবাকে ভালোবাসতে পারেননি কোনওদিন। ভালোবাসতেন না বলেই বাবার মৃত্যুতে মার মুক্তি ঘটল। মার ভিতর থেকে আর একটা মানুষ যেন পরদা সরিয়ে বেরিয়ে এল—বাঁশির ভালোবাসায় সাড়া দিয়ে।

আমি তো মা’র শরীরের মধ্যে বেড়ে উঠেছি। আমি মাকে ভালোবাসব তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। মা’র আমি একমাত্র সন্তান। মা যে ইন্দ্র বলতে মূর্ছা যাবেন, সেটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু বাঁশি যেভাবে মাকে ভালোবেসেছে, এবং মা’ও যেমন করে বাঁশিকে কন্যাস্নেহে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন, এই দুটোই রীতিমতো বিশেষ ঘটনা। আমি দেখতে পাই দুজনকেই—দুজনের আন্তরিকতাই আমার স্বচ্ছ চোখে ধরা পড়ে। মায়েতে-মেয়েতে অভিমানও হয়, মিটেও যায়। আমি ওদের মধ্যে ঢুকি না।

আমি জানি, আমিই ওদের দুজনের মধ্যে হাইফেন। আমাকে নিয়েই, আমাকে ঘিরেই, ওদের সম্পর্ক শুরু হলেও এখন আর সেটা সেইটুকুর মধ্যে স্বার্থের শেকলে আটকে নেই। এখন আমাকে বাদ দিয়েও, আমাকে ছাড়িয়েও ওদের দুজনের মধ্যে অন্য এক গভীরতর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে—বন্ধুতার, বিশ্বাসের, নির্ভরতার। দুটি অসমবয়সি মানুষ এখন পরস্পরের একান্ত নির্ভর। আমার নেশার অসুস্থতা মা সহ্য করতে পারেননি, ভেঙে পড়েছিলেন। বাঁশি তখন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল মা’র পাশে। মাকে সুস্থ করে তুলেছে সে, আমাকেও। হ্যাঁ, রঙিনও ওদের মধ্যে জরুরি একটি সেতু। আমার আর বাঁশির মধ্যেও যেমন। কোনওদিন যে রঙিন ছিল না আমাদের জীবনে, আমাদের সংসারে, সেটা যেন ভাবতেই পারি না।

 এই বৃহস্পতিবার রঙিনের বাড়ি ফিরে আসার দিন। ছুটি পড়ে যাচ্ছে শুক্রবার থেকে। রঙিন কলেজে চলে যাবার পর থেকেই বড়িটা শূন্য হয়ে গেছে, ও বাড়ি ফিরলেই আবার সংসার জমজমাট। এখন অবশ্য বাড়িটা অতিরিক্ত ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মা’ও নেই, রঙিনও না। কিন্তু এবারে এ সংসারের দৈন্যদশা ঘুচবে, মা’ও বাড়ি ফিরবেন। শনিবার রঙিন যাবে ওর বন্ধুদের সঙ্গে বিচে বেড়াতে, আর বাঁশি যাবে মাকে নিয়ে আসতে, একেবারে হাসপাতালের পালা চুকিয়ে।

মা ভালো আছেন। মা’র ডাক্তার খুব খুশি হয়ে বলেছেন, এই বয়েসে এরকম রিকভারি চট করে দেখা যায় না—প্রচণ্ড মনের জোর আছে আমার মায়ের। এবার থেকে উনি বাড়িতেই থাকবেন। মাসে একবার শুধু চেক আপ করাতে নিয়ে যেতে হবে আউটডোরে। সাময়িক ব্রেকডাউন হয়েছিল মাত্র, পারমানেন্ট কোনও ড্যামেজ হয়নি। তবে হ্যাঁ, বাঁশিও বলে দিয়েছে, আমি যদি সুস্থ থাকি, মা’ও তবে সুস্থ থাকবেন। আমি যদি আবার নেশায় ফিরে যাই, এই বয়সে মা’র যদি আরও একবার ব্রেকডাউন হয়, তবে কিন্তু আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কমই। মা’র ব্রেনসেলগুলো কত আর ধকল সইবে এই বয়েসে? মনের জোরে কতদিন, কতবার মা সুস্থ করে তুলবেন নিজেকে?

ডা: ভাইমার এ-দেশের ডাক্তার তো? বাঁশির এই শাশুড়িপ্রীতি তিনি বুঝতে পারেন না। এদেশে গর্ভধারিনী মায়ের জন্যেও মেয়েরা এমনভাবে আকুল হয় না, বাঁশি আমার মায়ের জন্য যেমন কাতর হয়। ডা: ভাইমোরের বিস্ময় প্রকাশ পেয়ে যায় মাঝে মাঝেই, তাঁর কথাবার্তায়, অথচ মানুষের সঙ্গে মানুষের যে কত রকমের সম্পর্ক হতে পারে—সেটা তো তাঁরই সবচেয়ে ভালো বোঝা উচিত। মনের ডাক্তার তো?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *