| ৩ | বাঁশি
ইন্দ্র ফিরে এসে বলল—উৎসব, অনুষ্ঠান তার খুব ভালো লেগেছে। রঙিনকে আর মাকে নিয়ে যেতে পারলে আরও ভালো লাগত। বিশেষ একটা অভিজ্ঞতা বটে। কিন্তু রঙিনের স্কুলের প্রচুর বন্ধুর মধ্যে একজনেরও কি বাত মিৎসভা, কিংবা বার মিৎসভা উৎসব হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে, ওকে ডাকেনি তো তারা?—নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যে হঠাৎ বিধর্মীকে ডেকে এনে অযথা তাকে বিব্রত করতে চায়নি সম্ভবত।
হান্নার ব্যাপারটা একদম আলাদা। ওর জীবনে এটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান যতটা তার চেয়ে রাজনৈতিক অনুষ্ঠান অনেক বেশি।
.
আমরা রঙিনকে ওর কলেজ থেকে আনতে যাব এই বৃহস্পতিবার। ওর সামার ভেকেশন শুরু হবে। ডর্মিটরিও বদল হবে নেক্সট সেশনে। এখন ঘরে ওরা তিনজন থাকে, পরের বছরে শুধু দুজন থাকবে। এ বছরের রুমমেট দুজনের একজনকেও রঙিন পছন্দ করতে পারেনি। একটি ভিয়েতনামি কন্যা, সে কেবলই পড়াশুনোয় ডুবে থাকে, এবং রাতে আলো জ্বেলে পড়ে। অন্যটি মিডওয়েস্টের মেয়ে, হঠাৎ মুক্তির স্বাদ পেয়ে মেতে উঠেছে, পড়াশুনো করে না, পার্টি আর পুরুষ বন্ধু নিয়ে আছে—রাতে আলো জ্বালা নিয়ে রোজ ঝগড়া করে। সে নাকি চোখে কালোপট্টি বেঁধে ঘুমোতে পারে না রঙিনের মতো। রঙিনের স্বভাব ঝগড়াটে নয়। সে হাসিখুশি থাকতে ভালোবাসে, এবং ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চায়। এদের মধ্যে পড়ে তার খুব সুবিধে হয়নি। সামনের সেশনে সে তাই খুঁজে পেতে রুমমেট ঠিক করেছে।
সুনীতা পাঞ্জাবি মেয়ে, তারও জন্মকর্ম এই ক্যালিফোর্নিয়াতে। রঙিনের সঙ্গে তার দিব্যি ভাব হয়েছে। সুনীতার বাবার ভারতীয় পোশাকের দোকান আছে লিটল ইন্ডিয়াতে। শাড়ি-ব্লাউজ, পেটিকোট, সালোয়ার-কুর্তা, বিয়ের পোশাক, সব কিছু তৈরি করেন এবং কিনতে পাওয়া যায়। এবং একটা অংশে ভারতীয় গয়নাগাটি নিয়ে বসেন ওর মা। সুনীতার কাকা-জ্যাঠা সবাই এখানে। ওদের অনেকগুলি শহরে দোকান আছে। রেস্তোরাঁ আছে, মুদির দোকান আছে, ভিডিওর দোকান আছে। সুনীতার বাবা-মা দুজনেই সারাদিন দোকানে থাকেন বটে, কিন্তু ঠাকুমা-ঠাকুরদা বাড়িতে দিব্যি ঘর-সংসার সামলান। ঠিক যেন দেশের মতো। ওদের বাড়িতে গেলে রঙিনের খুব ভালো লাগে। সামনের সেশনে রঙিন আর সুনীতা একসঙ্গে রুমমেট হবে ভেবেই রঙিন মহাখুশি।
.
ইন্দ্র বলে, রঙিন নাকি বড় হয়ে ক্রমশ একটা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলছে নিজেকে। স্কুলে পড়বার সময়ে ওর প্রচুর সাদা আমেরিকান বন্ধুবান্ধব ছিল, তারা বাড়িতে আসত, ও-ও তাদের বাড়িতে যেত, নিয়মিত মেলামেশা চলত এদেশি মানুষের সঙ্গে। বড় হতে হতে ও ক্রমশ ভারতীয় বন্ধুবান্ধব বেছে নিচ্ছে, এখন স্কুলের বন্ধুত্বগুলো ভেঙে গেছে। মাত্র দুটি মেয়ের সঙ্গে এখনও ওর যোগাযোগ আছে—রেবেকা আর স্যালি। একাধিক ছেলেবন্ধুও ছিল ওর। ড্যানি আর রঙিন তো প্রাণের বন্ধু ছিল। ড্যানি পাশের বাড়ির ছেলে, একসঙ্গে বড় হচ্ছিল ওরা—হাইস্কুলের সময়ে শহর বদল হয়ে গেল। ইস্কুল বদল হয়ে গেল। বাড়ি বদল হয়ে গেল। বন্ধুও বদল হয়ে গেল। ড্যানি এখন বস্টনে পড়তে গেছে। শুনি নাকি ই-মেইলে যোগাযোগ আছে ওদের।
রেবেকা আর স্যালি দুজনেই এখনও ক্যালিফোর্নিয়াতে আছে, যদিও একজন স্যানডিয়েগোতে, আরেকজন সান্টা বারবারাতে পড়তে গেছে। মাঝে মাঝে আসে, ছুটিছাটায় দেখা হয়। এই তো সামনের বৃহস্পতিবার রঙিন যেমন বাড়ি আসবে, ওরাও এসে পড়বে—শনিবারে তিনজনে মিলে নাকি বিচে বেড়াতে যাবে ঠিক আছে। সুনীতাকেও নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে রঙিন। কিন্তু সুনীতাদের উইক এন্ড মানেই প্রবলভাবে আত্মীয় সমাগম। কাকা-কাকি, জ্যাঠা-জেঠি, তাদের ছেলেপুলে ঠাকুরদা-ঠাকুমার কাছে কেউ না কেউ ঠিক আসবেই। তখন সুনীতাকে থাকতে হয় বাড়িতে মাকে সাহায্য করতে। যদি ছুটিতে বাড়িতে থাকে, ওরা উইক এন্ডে বাড়িসুদ্ধু বিচে যায় পিকনিক করতে। ভাইবোনেরা আগে, তারাও যায়—সুনীতার খুব মজা হয়। রঙিনের তো এই সুযোগটা নেই। ওর ঠাকুমা ছাড়া এখানে তেমন আত্মীয়স্বজন আর কোথায়? আমাদের অবশ্য বন্ধুবান্ধবরাই প্রকৃত স্বজন। দু:খে-সুখে সর্বদা হাত বাড়ালে হাত ধরতে পারি। বিদেশে এসে বন্ধুর অভাব বোধ করিনি কখনও।
এখানে বেশিরভাগ উইক এন্ডেই বাঙালিদের আড্ডা থাকে কারুর না কারুর বাড়িতে। মাংসের ঝোল, ভাত আর ইলিশমাছ খেয়ে, রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে, বিয়ার আর সিগারেটের শ্রাদ্ধ করে স্বামীরা বাড়ি ফেরেন, বউরা গাড়ি চালিয়ে আনেন। কেন না তাঁরা হয় বিয়ার খান না, নয় নিতান্ত নামমাত্র। এই বাঙালি আড্ডায় ইন্দ্র আগে একদমই যেতে চাইত না। বলত, ‘অতি যাচ্ছেতাই, গোটা মেন্টালিটি—নিজেরা নিজেরা লিটল ক্যালকাটা বানিয়েই থাকবি যদি, তবে দেশ ছেড়ে এলি কেন?’
আসল উত্তরটা তার নিজেরও জানা। ইন্দ্রর নিজস্ব শিল্পী বন্ধুদের সার্কেল আছে। তারা এর স্টুডিয়োতে তার স্টুডিয়োতে মিট করে—বউ-বাচ্চা নিয়ে জমিয়ে আড্ডা নয় সেসব—সেখানে নিষিদ্ধ ধূমপানের ব্যবস্থাও থাকে। ইন্দ্র আমাকে নিয়ে যেত আগে আগে, ওর মনে মনে বোধহয় তখনও আমি ওর প্রেমিকা ছিলুম। একসঙ্গে দুজনের যাওয়া ক্রমশ কমে এল—বউরা কেউ যেত না দেখে। শুধু উইক এন্ডেই আমি বাড়িতে থাকি, ঠিক তখনই ইন্দ্র অন্যত্র থাকবে, এটাই বা আমার সহ্য হবে কেন? আমি আপত্তি শুরু করে দিলুম—’কেন? তোমরা তো যে কোনওদিনই আড্ডা বসাতে পারো, উইক এন্ডের বিশেষ মহিমা তোমাদের জীবনে নেই—কেন না তোমরা সপ্তাহে সাতটা দিনই কাজ করতে পারো, অথবা ছুটি করাতে পারো। না, উইক এন্ডটা আমার চাই! নইলে বিয়ে করা কেন?’
এদেশের জীবনটা কী অমানুষিক রকমের যান্ত্রিক। সোম থেকে শুক্কুর ছুট ছুট ছুট…সেই ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে কাটানো। তার ভেতরে ঘন্টা দুই-তিন গাড়ির মধ্যে। বাড়ি ফিরে একটু জিরিয়ে নিয়ে খাওয়া, ঘুম। কখনও সকালে স্নানের সময় না হলে রাত্রে স্নানও। এর মধ্যে কোনও অতিরিক্ত সময়ই বের করা যায় না। অনেক সময়ে অফিস থেকেই ফোন করার ফাঁক বের করতে হয়, কিংবা ই-মেইল চেক করার সুযোগ। বাড়ি ফিরে একটুও অবসর মেলে না। কত কী ভাবি, এই টিভি প্রাোগ্রামটা দেখব, এই বইটা পড়ব, ওই সিনেমাটা দেখব, এসব পরিকল্পনাই সার হয়। শুধু গান শোনা ছাড়া, আর কিছুই করে উঠতে পারি না। রান্নাটাও অনেক সময়ে ওই শনি-রবিবারেই করে, ফ্রিজ করে রাখি। বের করে, মাইক্রোওয়েভে গুঁজে দিয়ে, ব্যস টেবিলে এনে ফেলা। সপ্তাতে পাঁচদিন একরকম কেজো সাজপোশাক—দুদিন আর একরকম। অবসরের সাজ।
এই দেশের আদবকায়দা, বাঁচবার আইনকানুন সবই শিখে নিতে হয়েছে আমাদের। যা কিছু শিখে এসেছি, তা এখানে কাজে লাগে না বিশেষ। না সংসার করা, না বাচ্চা কাচ্চা মানুষ করা, না অতিথি আপ্যায়ন। এ-দেশের সঙ্গে মিশ খাইয়ে নিতে আমাদের কারুর কারুর খুব কম সময় লাগে, কারুর আবার কিছুতেই বিদেশটা রপ্ত হয় না। ইন্দ্র বলে, ওর কাছে সব দেশই বিদেশ। কোথাওই জীবনযাপনের কলকাঠিটা ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারেনি নাকি ইন্দ্র। দেশেও ছিল বিদঘুটে এক মানুষ, প্রবাসেও তাই। ওর মনের মতন দেশটা তবে কোথায়? ইন্দ্র হাসে বলে, ‘উনিশ শতকের ফ্রান্সে আমার জন্মানো উচিত ছিল। এটা রং টাইম, রং প্লেস।’ শুনে আমি আগে আগে চটে যেতুন। ঢং! কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয় কী জানি? হয়তো ওর কথাই ঠিক। আমিই কি ঠিক সময়ে ঠিক জায়গয় জন্ম নিয়েছিলাম?