| ২ | ইন্দ্র
বাঁশির বান্ধবী হান্নার পৈতের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলুম আমরা আজ। কোনও ইহুদি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ইতিপূর্বে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। খুব সুন্দর লাগল। গানগুলো ঠিক যেন কীর্তনের মতো, ভজনের মতো, প্রার্থনাসঙ্গীতই তো বটে? ভাষাটা হলই বা হিব্রু!
যিনি মূল গায়েন—কী চমৎকার তাঁর গলা। একজন পুরুষ আর একটি মহিলা, এই দুজনে মিলে অনুষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন। একজন পিয়ানোবাদক, আর একটি বেহালাবাদিকা ছিলেন সঙ্গতে। বড় ভালো লাগল পুরো অনুষ্ঠানটি—মাঝে মাঝে গলা মিলিয়ে, মাঝে মাঝে হাততালি বাজিয়ে, আর মাঝে মাঝে পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে মানবশৃঙ্খল তৈরি করে গান গাইছিলেন উপস্থিত সকলে। আমরা তো গানগুলি কিছুই জানি না। তবু অংশ নিচ্ছিলাম মানবশৃঙ্খলে। গান কিছু হিব্রুতে আর কয়েকটি গান ছিল ইংরিজিতেও। অনেকটা ক্রিশ্চান হিমস—এর মতোই শোনাচ্ছিল আমার কানে।—যতই আমরা উন্নাসিক যুক্তিবাদীরা বারব্রত পালনের, আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণের বিরোধিতা করি না কেন, আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিতে কিন্তু মন্দ লাগে না। ভাইফোঁটায়, বিজয়ায়, এমনকি সরস্বতী পুজোতেও দিব্যি লাগে। আর দুর্গাপুজোটাই বা কম কী? আনন্দের সুযোগ তো যত বেশি হয় জীবনে ততই ভালো।
আচার-অনুষ্ঠানের একটা জরুরি সমাজিক দিকে আছে। দিনকে দিন আমরা সবাই পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি—দূরে দূরে ছিটকে যাচ্ছি, কেউ যেন কারুর আপনার লোক নই—যে জগৎসুদ্ধু সবাই দূর-পর অনাত্মীয়, অবন্ধু। কোথায় হবার কথা ছিল বসুধৈব কুটুম্মকম—আর হল কী? বসুধার সকলেই যেন বৈরী, যুদ্ধ: দেহি ভান করেই আছি। প্রকৃতপক্ষে অথচ কেউই মৃত্যু চাই না, যুদ্ধ চাই না। কিন্তু সেই না-চাওয়াটা জোর করে বলতেও পারি না। কেন না, আমাদের ভুলভাল শিক্ষা দেওয়া হয়েছে— যুদ্ধে মৃত্যু নাকি গৌরবের। শত্রুকে সম্মুখ সমরে মেরে ফেলাও নাকি গৌরবের। কিছু মিথ্যে কথাও শিখিয়েছে বটে আমাদের যুগ যুগ ধরে! যুদ্ধে আছে শুধু লজ্জা, শুধু কলঙ্ক, শুধু পরাজয়। যুদ্ধে কেউই জেতে না। দুপক্ষই হেরে যায়। দুপক্ষই অকালমৃত্যুর অবর্ণনীয় দুর্দশায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আমাদের মহাভারতের শিক্ষা তো সেটাই।
শান্তিপর্ব কি শান্তিময়?
ধর্মযুদ্ধও যে ধর্মপথে হয় না, অধর্ম ছাড়া যে যুদ্ধই হয় না, মোটা দাগে তো এটাই অনুচ্চারিত শিক্ষা মহাভারতের।—আমার মতো অবুঝ অপন্ডিত মানুষরা অন্তত তাই ভেবেছে। তাই শিখেছে।
জীবন ইহুদিদের সহজ পথে চলতে দেয়নি। চিরদিন বাস্তুহারা, ভূমিহীন, সদাসর্বদা শত্রুতাড়িত একটি জাতি, অথচ তীক্ষ্ম ধীমান। কি শিল্পে, কি বিজ্ঞানে এই ছোট সম্প্রদায়টি মানব সভ্যতাকে নানাভাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে চলেছে। কিন্তু আজ ওখানে গিয়ে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল—আমাদের পরনের পোশাক, আমার কুর্তা-পাজামা-শাল, বাঁশির শাড়ি-খোঁপা-টিপ—আমাদের আলাদা করে দিয়েছিল। অনেকের চোখেই আমি কিন্তু বন্ধুতার অভাব দেখেছি। ‘ওরা আবার এখানে কেন?’ এমনি ভাব। বাঁশিকে যখন বললুম, বাঁশি বলল—’হস্টাইল লুকস? না না, তোমার মনের ভুল।’
একটু পরে যখন এক মহিলা স্পষ্টভাবে ওর সঙ্গে কিঞ্চিৎ দুর্ব্যবহার করলেন—তখন বাঁশি লজ্জা পেয়ে বলল, ‘সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই দু-একজন সাম্প্রদায়িক মানুষ থাকে—এখানেও থাকবে বইকি। ওরা এত অত্যাচারিত, এতই ছোট সম্প্রদায়, যে সর্বদাই শত্রু ভয়ে মরছে। তাই নিজেদের মধ্যে নিজেরা গুটিয়ে থাকে, এই বুঝি ওদের দলের কাউকে বাইরের লোকে ভাঙিয়ে নিল। ওদের কথায় কথায় আইডেনটিটি ক্রাইসিস হয়—ওদের দোষ ধরতে নেই।’
—সে কি? দোষ করবে আর দোষ ধরব না? বা:! হিটলার ওদের ওপরে অকথ্য অত্যাচার করেছিল বলেই ওরা আজ প্যালেস্টিনিয়ানদের ওপর অযথা অত্যাচার করবে? আমার দাড়ি অছে বলে কেউ কেউ নিশ্চয় আমাকে প্যালেস্টিনীয় ভেবেছে। পাজামা পাঞ্জাবি শালটাল তো আগে দেখেনি—Exotic dress।
—’ওরকম করে ভেব না তো!’ বাঁশি উলটে বকে দিল আমাকেই।—’ওরকম ভাবলে শুধু তোমার নিজেরই মন খারাপ হবে—ওদের ভারী বয়েই গেল। অত সেন্সিটিভ হলে জগতে চলা যায়? তোমরা শিল্পীরা বড্ড স্পর্শকাতরতায় ভোগো কিন্তু!’
বাঁশির বান্ধবী হান্নাও শিল্পী মানুষ—সে পিয়ানো বাজায়। কবিতাও লেখে। কবিতা পত্রিকায় সেসব কবিতা ছাপা হয়, দেখেছি। এবছর একখানা চটি বইও বেরিয়েছে ওর সানফ্রান্সিস্কোর ছোট এক প্রেস থেকে। তার আবার বিজ্ঞাপনের জন্যে পিকচার পোস্টকার্ড ছেপে বিলি করা হচ্ছে ওখানে—কভারের ছবি দিয়ে, দু-ছত্র কবিতা দিয়ে। এসব যে আমাদের দেশের কবিরা কবে করতে শিখবে? নাকি প্রকাশকদের শেখার কথা ওইসব প্রাোমোশনাল ট্যাকটিক্স?
হান্নার এই পৈতের উৎসবে গিয়ে অনেক কথা মনে পড়ছিল। অনিরুদ্ধর পৈতেতে খুব মজা করেছিলুম আমরা। তখন আমরা ক্লাস টেনে উঠেছি সদ্য—দুটো-একটা সিগারেট ফুঁকতে শিখেছি। ওইদিন সবাই মিলে ছাদে গিয়ে সিগারেট খেয়েছিলুম, শুধু একা অনিরুদ্ধ বাদে। পরবর্তী জীবনে অনিরুদ্ধ তার পরিবারের বামনাই মানেনি। সে এখন কানাডাতে ডাক্তারি করে, তার স্ত্রীর রোজিনাও ডাক্তার—বাংলাদেশি মেয়ে, ওরা যে যার ধর্মে আছে। অথবা বলা ভালো, মুক্তির মধ্যে আছে।
আমার সঙ্গে হান্নার মোটামুটি ভাব আছে—বাঁশির সব বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যেটা নেই। হান্না মেয়েটি খুব প্রাণবন্ত, খোলামেলা। ওকে বুঝতে কষ্ট হয় না। আমার পক্ষে ইদানিং চেষ্টা করে মানুষকে চেনা-বোঝা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে মনে একটা আলস্য এসেছে (জানি না এরই পরিণতির নাম বৈরাগ্য কিনা), যে-আলস্যের ফলে জীবনের অনেক দিক থেকেই আমার আগ্রহ সরে গিয়েছে। বাঁশি রাগ করে। ও বলে—’কিচ্ছু হয়নি তোমার। এটাকে প্রশ্রয় দিও না। এ হল নেশা ছাড়বার এফেক্ট মাত্র—উইথড্রয়াল সিনড্রোমেরই একটা লক্ষণ। জীবনে আগ্রহ কক্ষনো কমে যায়নি তোমার—তাহলে এমন করে ছবি আঁকতে পারতে না—এত কালারফুল ছবি হত না—ডাল, ডিপ্রেসিং ছবি বেরুত হাত থেকে।’ কিন্তু বাঁশি কি বুঝতে পারছে না, আমি এখন যে-ছবি আঁকি, তাতে আগের মতো উজ্জ্বলতা নেই, তাতে আগের মতো উচ্ছলতা নেই? অনেক শান্তশিষ্ট হয়ে গেছে আমার রং-তুলি? বাঁশির আনন্দের শেষ নেই আমার আঁকা দেখে। আমি যে আবার তুলি ধরেছি এতেই ও খুশি, ভালোমন্দের বাছবিচার করছে না।
মা থাকলে করতেন।
মা বলতেন, ইন্দ্র, তোর ছবির প্রাণ কমে গেছে। মা ঠিক ঠিক যা বলার আমাকে তাই বলে দিতেন। বাঁশি সমঝে কথা বলে।
বাঁশির উপায় কী, না সমঝে? ওর উপরেই তো আমরা সবাই ভর করে আছি। মা’র চিকিৎসা সম্ভব হল ওর জন্যে। বাঁশি বলছে মাকে এবারে বাড়িতে নিয়ে আসবে—মা’র ঘরটা সাফসুতরো করে রাখতে হবে। মাকে বাঁশি খুব যত্ন করে। ওর মা নাকি যত্নের অভাবেই মারা গেছেন। বঁশি তখন খুব ছোট্ট ছিল। ওর ক্ষমতা ছিল না মাকে রক্ষা করবার। বাঁশি আমার জীবনে এসে পড়েছে যেন সূর্যের রশ্মির মতো প্রাণসঞ্চারি শক্তি নিয়ে।—’আমার’ শুধু নয় আমাদের জীবনে।
এই বাড়ির মর্টগেজ, গাড়ি দুটো, আমাদের মা-ছেলে, এবং রঙিন—তিনজনের মেডিক্যাল ইনশিয়োরেন্স, এবং আমাদের অন্নবস্ত্র, মেয়ের শিক্ষা সব কিছুই তো বাঁশির পরিশ্রমে চলছে।
বাঁশির ইনশিয়োরেন্স ওর অফিস দেয়। বাঁশির আমার ওপরে অনেক রাগ থাকতে পারে, অনেক অভিমান থাকতে পারে, আমার কাছ থেকে কতটুকুই বা সুখ পেয়েছে সে? যন্ত্রণা পেয়েছে প্রচুর। সন্তান চেয়েছিল যখন, তখন আমি প্রস্তুত ছিলুম না পিতৃত্বের জন্যে। আমার যখন সময় হল, বাঁশির শরীরে তখন আর মাতৃত্বের প্রস্তুতি ছিল না। সেই প্রথম শিশুটিকে নষ্ট করতে গিয়ে ওর মাতৃত্বের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সব দোষ আমার। অবশেষে আমাদের জীবনে এল ছোট্ট রঙিন। রঙিন সুস্থ, স্বাভাবিক, সর্বাঙ্গীণ সুন্দর শিশু—কিন্তু প্রথম তিন বছর ও কথা বলেনি। তার পরেই অবশ্য ঝরনা ধারার মতো বাকপ্রবাহ শুরু হয়ে গেল মেয়ের। ওর নামের বানানটা নিয়ে ঝামেলা বেধেছিল। ‘রঙিন’ RONGEEN লিখেছিলুম আমরা।—স্কুলে RONNIE হয়ে গেল। বাঁশি নাম বদলে দিতে ক্ষেপে উঠেছিল, মা বাধা দিলেন,—’স্কুলে যাই বলুক, আমরা সব সময়ে রঙিন বলেই ওকে ডাকব। ও আমাদের রঙিন স্বপ্ন।’ এখানে চাকরিস্থলে বাঁশির এক শ্যাম-দেশীয় বন্ধুনী ছিল, তার নাম ‘সুন্দর সিন্ধুস্বপ্না’—বাঁশি সেই নামেই মেয়েকে ডাকবে বলে ঠিক করেছিল। আমরা দেশে থাকলে নিশ্চয়ই সেই নামটিই দিত সে রঙিনকে এখানেও চেষ্টা করেছিল ভালো নাম আর ডাকনাম, দুটো নাম দেখবার। কিন্তু Sundara Sindhu Swapna নামে মোট উনিশটা অক্ষর। তারপরে Ganguly সাত অক্ষর, মোট ছাব্বিশটা অক্ষরের সুদীর্ঘ নাম? কি অপরাধ করেছে ওই ক্ষুদে মানুষটা, যে তাকে এত বড় শাস্তি দিতে হবে? সুন্দরসিন্ধুস্বপ্না তাই স্বপ্নই রয়ে গেল।
রঙিন অবশ্য নিজেকে ‘রানি’ বলে না। এখন কলেজে উঠে গেছে—ওখানে জোর করেই ‘রংগিন’ নামটা চালাচ্ছে সে। নতুন বন্ধুরা ফোনে এখন ‘রংগিন’-কে চায়, ‘রানি’ কে নয়। অবশ্য বাড়িতে ওর ফোন কালেভদ্রে আসে—এখন তো তাদের হাতে হাতে সর্বদা সেলফোন আছে। নুরজাহানের হাতে যেমন গোলাপফুলটি। রঙিন আমাদের সত্যি সত্যিই প্রজাপতির পাখার মতো, ভারী সুন্দর হয়েছে। হালকা ফুরফুরে, ঝলমলে রূপসি।
মায়ের মতো?
না ঠাকুমার মতো?
উঁহু, কারুর মতোই নয়। রঙিন তার নিজের মতো রূপসি।
রঙিনের মা’র তাকে নিয়ে মহা গর্ব। স্কুলের রেজাল্টে কলেজে ভরতি হতে কোনও কষ্টই হয়নি। আংশিক বৃত্তিও পেয়েছে সে। ওর শিক্ষার জন্য আমরা যে টাকা জমিয়েছিলুম তার সবটা লাগেনি।
আমার মা’রও নাতনিকে নিয়ে গর্বের সীমা নেই।
আর আমার?
আমার নেশার অন্ধকার গর্ত থেকে সুস্থতার আলোয় ফেরার মধ্যে একটা শক্ত দড়ি ছিল, রঙিন।
ওর মা সব সময়ে আমাকে মনে করিয়ে দিত রঙিনের কথা।
‘মনে রেখো, রঙিন আছে।’