ইহজন্ম – ১৫

| ১৫ | বাদল

আরও দুটো দিন গেল। বাঁশি আর পা নাড়েনি। আমাকে অফিস থেকে তাড়া মারছে—এবার আর ছুটি বাড়ানো সম্ভব নয়। বাঁশিকে এই অবস্থায় ছেড়ে যাই-ই বা কেমন করে? না ঘরকা, না ঘাটকা। অথচ ইলেকশন এসে যাচ্ছে, আমাকে ফিরে যেতেই হবে। আর থাকতে পারব না। যাওয়ার আগে আরও জোরে চেষ্টা করতে হবে আমাদের।

আজ একটা বড় লিপ হয়েছে মনে হয়। রঙিন মায়ের কানের কাছে ঝুঁকে বলছিল, ‘মামমাম—আমি বলছি, আমি রঙিন, ইফ ইউ ক্যান হিয়ার মি, প্লিজ রেসপন্ড—প্লিজ ফ্লাটার ইওর আইল্যাশেস—ইওর আইল্যাশেস! মামমাম—ট্রাই টু ওপেন ইওর আইজ—লুক অ্যাট আস, উই লাভ ইউ, মা গো!’ রঙিনের স্বর আবেগে বুজে যাচ্ছিল। একটা অভিমানের কান্না ছিল ওর গলায় ভরা।

এরপর প্রত্যেকটা মুহূর্ত পার হয়ে চেপে বসছিল আমাদের বুকের ওপরে—বাঁশির চোখের দিকে তাকিয়ে আছি সবাই।

হঠাৎ দেখা গেল বাঁশির চোখের পল্লবগুলো ঝিরঝির করে কাঁপছে, বাঁশি চোখের পাতা নাড়তে চেষ্টা করছে, চোখ মেলতে চেষ্টা করছে বাঁশি। রঙিন চেঁচিয়ে উঠল যেন চিয়ার গার্লদের মতো করে—’গো অন, গো অন মামমাম, গো গো গো—’ বাঁশি, বাঁশি, এই যে আমরা, চোখ খোলো।

আরও একদিন গেল। বাঁশি আর চোখ খোলেনি। ক্লান্তিতে চোখ বুজেই রইল। কী জানি এত কষ্ট হয় ওর, অতটুকু প্রয়াসে কতটা এনার্জি ব্যয় হয়। আমরা হয়তো অবুঝের মতোই জোরজুলুম করছি? কাল আমি চলে যাব। আজ একবার শেষ চেষ্টা করতে বাঁশির কানের কাছে মুখ নিয়ে বললুম—’বাঁশি রে, ও বাঁশি, আমাদের বাঁশবাগানের পেতনিটা কই? চোখ মেলে দ্যাখ আমি ছোড়দা এসেছি, বাদল, তোর ছোড়দা রে—এই যে, আমার হাতটা একটু ধরবি না? এই যে এইটে আমার আঙুল, তোর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছি, তুই মুঠো করে ধরে থাক—এই যে, আঙুলটা ধর দিকিনি? শক্ত করে ধরে থাক—ধরতে চেষ্টা কর দিকি? হাতটা মুঠো কর, মুঠো কর—’ আমার তর্জনীর চারিপাশে ওর নরম, লম্বা, লম্বা, ঠান্ডা আঙুলগুলো নড়াচড়া করতে থাকে—দুর্বলভাবে, আলতো করে, আলগা করে মুঠো বাঁধতে চেষ্টা করছে আঙুলগুলো।

মুঠো হল না।

হল না বটে, কিন্তু ওর প্রচেষ্টাটি ছিল স্পষ্ট। সন্দেহ নেই আমাদের লড়াকু মেয়েটা ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড লড়ছে।

এটাই তো চাই।

মধুলিকা বলছিল, ‘ওয়ান্স উই নো শি ইজ ট্রাইং টু রিকভার, উই নো, শি ইজ ওভার দ্য হ্যাম্প। সো, উই আর ওভার দ্য হাম্প অ্যাজ ওয়েল। ডাক্তার ঠিক বলেননি,—”বিয়ন্ড রিকভারি” কথাটা ভুল ছিল।’

বাঁশি জেগে উঠছে।

আমি ফিরে যাচ্ছি। ইন্দ্র ঠিকঠাকই আছে। এত বড় সংকটেও ইন্দ্র নেশার দিকে ফেরেনি, এটা সোজা কথা নয়। রঙিন সমানে বাবার পাশে আছে। আমি চলে গেলেও ইন্দ্রর গার্জেন থাকবে, নজর রাখবে।

তা ছাড়া মাসিমা একটি অসামান্য ডিসকভারি, ঘরসংসার সামলাচ্ছেন, আর একবার করে হাসপাতালে এসে বাঁশির মাথার কাছে বসে থাকছেন। চোখ বোজা, ঠোঁট দুটি নড়ে। প্রার্থনায়। আমরাও মনে মনে বলছি, বাঁশিকে যেন তার এ-জন্মের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেন বিধাতা। রঙিন তার মাকে নিয়ে যেমন মহা গর্বিত ছিল, এখন দেখছি ঠাকুমাকে নিয়েও তেমনি তার গর্বের সীমা নেই।

‘শি ইজ আনবিলীভেবল মাই ঠাকুমা! অ্যান আনএন্ডিং সোর্স অফ স্ট্রেংথ!’

ঠাকুমা তাকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছেন। সেদিন শুনছি বলছেন—’ভাইফোঁটার মন্তরটা তো জানিস? দিস তো দেখেছি থালা সাজিয়ে অর্ক-অভ্রদের ভাইফোঁটা। বল তো ”যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা”-র মানে কী? মানে, যমের দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হল। ভায়ের আয়ু বেড়ে গেল। যম কে? জানিস তো সেটা? যমই মৃত্যু। যমের দুয়ারে কাঁটা মেয়েরা সত্যি সত্যি দিতে পারে; হ্যাঁ রে, ভালোবাসা দিয়ে যমকেও আটকে দেওয়া যায়, সত্যি।’

সাবিত্রীর গল্পটা জানিস? বেহুলার গল্প? জানিস? বা:! তবে তো তুই জানিস যমের দরজা থেকে ভালোবাসার জোরে মানুষকে ফিরিয়ে আনা যায়। ধ্যাত, শুধু বর কেন? মাকেও যাবে। সন্তানকেও। তেমন করে চাইতে হবে ঠাকুরের কাছে—তেমন করে ভালোবাসতে হবে—ফেরানোর হলে তিনি ফিরিয়ে দেবেন, কিন্তু আমাদের চেষ্টায় যেন ত্রুটি না থাকে—’

গল্পচ্ছলে বলা কথাগুলো আমিও শুনছিলুম, মনে হচ্ছিল মাসিমা যা বলছেন, সেটা নির্ভুল। রঙিন সত্যি সত্যি অনেক মনের জোর পেয়েছে ওঁর কাছে। আমাকে বলছিল—’মামু জানো ঠাকুমা বলেছে, উই উইমেন নেভার গিভ আপ। উই উইমেন ক্যান ওয়র্ক ওয়ন্ডার্স—লাইক সাবিত্রী অ্যান্ড বেহুলা—যমের দরজাতেও কাঁটা দেওয়া ইজ পসিবল, অ্যান্ড উই উইমেন ক্যান ডু দ্যাট, জাস্ট ভালোবেসে—’ রঙিন জানে, ওর অচেতন মাকে ওরা ফিরিয়ে আনবে চেতনায়।

‘ইটস ওনলি আ ম্যাটার অফ ডেজ!’

মা ফিরবে।

রঙিন জানে।

প্রথম সংস্করণ—জানুয়ারি ২০০৭

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *