ইহজন্ম – ১৪

| ১৪ | ইন্দ্র

মধুলিকা নানাভাবে সাহায্য করছে। এই সময়ে দেখা গেল বাঁশির বন্ধুরা সত্যিই বন্ধু। হান্না এখনও ইজরায়েলে, ও থাকলে ঝাঁপিয়ে এসে পড়ত। সোহিনী সর্বক্ষণ রঙিনের কাছে থেকেছে, নন্দিনী এসে মা’র দেখাশুনো করেছে, সংসারের কিছু লাগবে কিনা দেখেছে। বাঁশি যেভাবে প্রত্যেকের জন্যে করত, প্রয়োজনের সময়ে প্রত্যেকেই দেখছি বাঁশির মঙ্গলের প্রার্থনায় ব্যাকুল।

বাঁশিকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে আসা হয়েছে শহরে। বড় হাসপাতালে। অপারেশন হয়ে গিয়েছে। ওরা আর দেরি করতে চাইল না। বলছে তো অপারেশন সাকসেসফুল। আর কয়েক দিন পরেই ওরা ওকে আই সি ইউ থেকে বের করে সাধারণ বেডে দিয়ে দেবে বলছে। বাঁশি নিজেই শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে, ভেন্টিলেটারে নেই। নাক দিয়ে তরল খাদ্য গ্রহণ করতে পারছে দিনে একবার। মলমূত্র ত্যাগও করতে পেরেছে স্বাভাবিকভাবে। সবই খুব সুখবর। বাঁশি ভালো আছে।

তবে ঘুম ভাঙেনি তার।

ডাক্তাররা ঠিক করে ভরসাও দিতে পারছেন না—এ ঘুম কখনও ভাঙবে কিনা। তবে ডক্টর রুবেন্স বলেছেন, সময় লাগবে, দেরি হবে। কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসা একেবারে অসম্ভব নয়। লেটস ওয়েট অ্যান্ড সী। প্রতীক্ষা করতে হবে। নিরাময় যদিও বা হয়, সেটা হবে সময় সাপেক্ষ। কিন্তু এই ‘যদি’-র স্পেসটুকু তো ঢুকছে এবার আমাদের জীবনে? এতদিন তো শুনছিলুম বিয়ন্ড রিকভারি। মায়ের উদ্যোগেই অপারেশনটা সম্ভব হল। এখন শুধু দিন গোনা। চোখ মেলবার দিন। প্রতীক্ষা করতে হবে। ধৈর্যে আর প্রার্থনায় ভরে আছে আমাদের দিন, আমাদের রাত।

বাঁশির বাবার কাছে অর্থসাহায্য নিতে হয়নি আমাদের। কিন্তু ওরা বাবা নিয়মিত ফোন করে মেয়ের খবর নিচ্ছেন বাদলদার কাছে। এও এক নতুন অভিজ্ঞতা। ওই ভদ্রলোককে ইতিপূর্বে কখনও আর কাউকে নিয়ে ভাবতে দেখিনি। আমাদের বিয়েতে বাগড়া দিতে চাওয়া ছাড়া।

আমার এতদিনের চেনা মা-জননীকেও নতুন করে চিনলুম। যে-মানুষটা মেন্টাল হোমে ছিল মাত্র ক’দিন আগেও, তার বুকে এতটা জোর এল কোথা থেকে? ডাক্তারদের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি, দু-হপ্তা ডীপ কোমার পরে কেউ ফেরে না—ঠিক তখনই মা শক্ত হাতে নিজে হাল ধরলেন। মা’র জন্যেই ওকে এখানে আনা, অপারেশন করা সম্ভব হল। ডাক্তাররা গা করছিল না। অদ্ভুত মনের জোর—মনের জোর না বলে ওটাকে বোধ হয় স্নেহের জোর বলাই ঠিক। ওর মা ছিল না বলে বাঁশির মনে আজীবনের জমাট বাঁধা শোক ছিল। সেই দু:খ ওর থাকা উচিত নয়—এই প্রাণঢালা মমতা, এই আকুলতা, এই দৃঢ় বিশ্বাস, ঈশ্বরের ওপর এমন বলভরসা, এ শুধু মায়ের বুকেই থাকা সম্ভব। কিন্তু বাঁশি কি কোনওদিন জানতে পারবে, তার একটা মা ছিল?

ডাক্তার বলছে ক্লিনিক্যালি বাঁশির উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু বাঁশি তো চোখ মেলছে না।

মা রোজ রোজ আমাদের প্রত্যেককে ডেকে ডেকে অনুরোধ করছেন—’তোরা একটু চেষ্টা কর না ইন্দ্র? তেমন ভালো করে ডাকলে কি ও শুনতে পাবে না? ডাক না একটু আদর করে?’ বাদলদাকে বলছেন—বাবা বাদল। তুমি ওকে ঠিক জাগাতে পারবে—আজন্মের চেনা গলা, চেনা ডাক, ঠিক ওর মর্মে গিয়ে পৌঁছোবে—’

আর নিজে তো অনবরতই আদর করে ডাকছেন, বাঁশি, ও বাঁশি, ওঠ, উঠে পড়, চা খাবি না?’

মাগো, ঠিক কেমন করে ডাকলে যে ডিপ কোমার ঘুম ভাঙানো যায়, তা কি আমরা কেউ জানি?’

আজ একটা বিরাট সুখবর আছে। ডাক্তার রুবেন্স বললেন, ওর পায়ে সুড়সুড়ি দিলে ও নাকি রেসপন্ড করছে। আমরাও চেষ্টা করে দেখতে পারি। এটা একটা মস্ত সুসংবাদ।

অমনি রঙিন ছুটে গিয়ে মায়ের ঘুমন্ত পায়ের তালুতে অনেকক্ষণ ধরে সুড়সুড়ি দিল। মনে হল যেন ওর পা-টাতে যৎসামান্য একটা কিছু প্রতিক্রিয়া, একটু কাঁপনের মতো কিছু হল। মনে তো হল, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারিনি ওটা আমাদের মনগড়া কিনা। রঙিনের অবশ্য উৎসাহের অন্ত নেই। দিনের পর দিন সে এই চেষ্টাটা চালাবার পরে একদিন আমরা সকলেই স্পষ্ট দেখতে পেলুম সত্যি সত্যিই পা-টা নড়ে উঠছে। এইটুকুতেই আমরা হাতে স্বর্গ পেলুম। ফিরছে বাঁশি ফিরছে।

.

আজকে তাই আরেকটা এক্সপেরিমেন্ট করেছি। আমি বাঁশির কানে কানে বললুম—বাঁশি, বাঁশি? আমি ইন্দ্র, তুমি শুনতে পাচ্ছ? যদি শুনতে পাও তবে পায়ের বুড়ো আঙুলটা একটু নাড়তে চেষ্টা করো না? চেষ্টা করো যে-কোনও পায়ের বুড়ো আঙুলটা একটু নাড়তে—’

আমরা একদৃষ্টে ওর চাদরের তলা দিয়ে বেরিয়ে থাকা পা দুটোর দিকে চেয়ে আছি। শুকনো, ফরসা, অচঞ্চল দুটি পা। আমি সমানেই কানে কানে বলছি, ‘বাঁশি, পায়ের বুড়ো আঙুলটা একটুখানি—’ হঠাৎ একটি বুড়ো আঙুলে একটু কাঁপন লাগল। ওই তো, ওই তো আবার কেঁপে উঠেছে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল। হ্যাঁ, ও নিজেই নাড়াতে চেষ্টা করছে ওর পায়ের বুড়ো আঙুলটা। ওই তো, পেরেছে পেরেছে, বাঁশি পেরেছে! বাঁশি নিজের ইচ্ছেমতো পায়ের আঙুলটা নাড়তে পারছে। বাঁশি কানেও শুনছে, বুঝতেও পারছে আমরা ওকে কী করতে বলছি, এবং সেটা করতে চেষ্টাও করছে।

হে ঈশ্বর! তার মানে ও ঘুমন্ত নেই, বাঁশি জেগে উঠছে।

ব্রেন-ডেড তো নয়ই, ওর ব্রেন কোমাতেও নেই আর। জেগে উঠছে। চৈতন্য ফিরে আসছে বাঁশির। থ্যাংক গড, শি ইজ রেসপন্ডিং—শি ক্যান কমিউনিকেট!

বাঁশিই সব সময়ে আমাকে বলত,—’সব সময়ে সময় আছে, ভালো করে বাঁচবার সময় কখনও ফুরিয়ে যায় না—’ আজ সেই কথাটা মনে পড়ে গেল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *