ইহজন্ম – ১৩

| ১৩ | বাঁশরি

‘ইন্দ্র! আশরাফ! রঙিন!’

মধুলিকার আর্তনাদে হঠাৎ মনোপলি খেলা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল—রঙিন ছুটল সবার আগে। আশরাফ, ইন্দ্র এসে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গেই মুধলিকা বলে ওঠে—’কল নাইন নাইন নাইন—কল দি অ্যাম্বুলেন্স—কুইক—শি নীডস মেডিক্যাল কেয়ার—’

ততক্ষণে বাকিরাও এসে পড়েছে হান্নার বিশাল, আধুনিক রান্না ঘরে।

বাঁশি চোখ বুজে এলিয়ে রয়েছে মধুলিকার দুই হাতের বাঁধনের মধ্যে—দেখে মনে হচ্ছে চেতনা নেই।

কী হল? কী হয়েছে? ব্যাপার কী?

‘জানি না—একটু আগেই বলছিল মাথা ঘুরছে। আমি বললাম, রান্নাঘর থেকে বেরোও, বাইরে ঘুরে এসো। ফ্রেশ এয়ারে ভালো লাগবে—তা এই রুটিগুলো সেঁকতে দিয়েই বেরুত, তার আগেই হঠাৎ দেখি পড়ে যাচ্ছে—’

‘ভাগ্যিস তুমি দেখতে পেলে, ধরে ফেললে, নইলে মাথা ফেটে যেত ওই টেবিলের কর্নারে লেগে—’

‘হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে পড়ল কেন? ঘর তো দিব্যি খোলামেলা, তেমন তো গরম হয়নি? ওর কি এপিলেপসি আছে?’

কষ বেয়ে একটি বমির রেখা নামছে।

‘ধ্যাৎ, এপিলেপসি থাকলে তুমি এতদিনে সেটা শুনতে পেতে। প্রেশার টেশার? ওর কি সুগার আছে? অনেক সময়ে হাইপোগ্লাইসিমিয়াতে সুগার লেভেল ফল করলে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়।’

যত্ন করে বমিটা মুছিয়ে দিল রঙিন। নানাজনের নানা ভাবনার মধ্যে বাঁশিকে এনে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে ড্রয়িংরুমের সোফাতে। ওর মাথাটা কোলে নিয়ে বসেছেন কুমুদিনী; নাড়ি ধরে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে মধুলিকা; ব্যাকুল, আর্ত চাহনিতে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে পাশেই মেঝেয় বসে পড়েছে রঙিন। ভীতমুখে অর্ক ওর কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।

‘না, ওর সুগার নেই, প্রেশারের প্রবলেমও ছিল বলে জানতুম না—’ ইন্দ্র আস্তে আস্তে বলে।—’কোনওদিনই ওকে অজ্ঞান হয়ে পড়তে দেখিনি।’

‘হয়তো খুব বেশি স্ট্রেস যাচ্ছিল। অনেকদিন ধরেই একটু একটু করে—আমরা সকলেই তো ওর মনের ওপরে প্রচুর চাপ তৈরি করেছি—ওকেই তো সকলকে দেখতে হয়—’ খুব আস্তে, প্রায় আপনমনে, ফিসফিস করে বলেন কুমুদিনী। চোখ বুজে ইষ্টনাম জপ করছেন তিনি মাথাটি কোলে নিয়ে বসে। ইন্দ্র আবার বারান্দায় বেরিয়ে গেছে। সিগারেট ধরিয়েছে একটা।

নন্দিনী রান্না ঘরে ঢুকে, উনুনগুলো নিবিয়ে দিয়ে এল। বন্ধুবান্ধবরা ছোট ছোট জটলা করছে। অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করা হয়েছে, এখন আসার অপেক্ষা। মধুলিকা নাড়ি ধরে আছে। ইন্দ্র ও ঘরে যেতে পারছে না।

শায়িত বাঁশির চোখবোজা মুখটা সে দেখতে চায় না। অমন দৃশ্য তার ভাবতেও ভয় করে। কী হল? কেন হল? বাঁশির হল কেন? বাঁশির বদলে এটা ইন্দ্রর হল না কেন? নিজের জীবনের দাম সে নিজেই নষ্ট করেছে। বাঁশির জীবনটা বড় দামি। মহার্ঘ। নেশার ঘোরে সস্ত্রীক আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেছিল ইন্দ্র। শুনে রেগে উঠে বাঁশি বলেছিল—’তোমার যদি মরতে ইচ্ছে করে তুমি মরো গিয়ে, কিন্তু আমি বাঁচতে চাই। আমাকে তো বাঁচতেই হবে—তোমার মায়ের জন্যে, তোমার মেয়ের জন্যে। আমাকে বাবা বেঁচে থাকতে হবে, আমার অনেক কাজ বাকি—আমার অমন পালালে চলবে না। তা ছাড়া, তুমি ভুলে যেও না ইন্দ্র, আমার কাছে আমার জীবনটাও কিন্তু খুব দামি। অনেক চেষ্টায়, অনেক পরিশ্রমে আমি এই অবস্থানে এসে পৌঁছেছি—’ বাঁশির সেদিনকার সেই কথাগুলো ইন্দ্রর কানে এখন বাজাছে। কী আশ্চর্য, তবে কেন এমন দায়িত্বহীনের মতো কাজ করলেন বিধাতা?

—’ডোন্ট বি সো ডিপ্রেসড, ইন্দ্র’ আশরাফ ওর পিঠে হাত রাখে, ‘সেরে উঠবে নিশ্চয়ই, এখনই তো ওর চিকিৎসা শুরু হয়ে যাবে—তা ছাড়া কী হয়েছে তাই তো আমরা জানি না। আগেই কেন worst-টা ভাবছ ইন্দ্র? ইট মে নট বি আ স্ট্রোক—ওর তো কোনও হাই পেশারের হিস্ট্রিও নেই-ভয়ের কী আছে?’

‘কিন্তু ওর মা মারা গিয়েছিলেন খুব হঠাৎ করে, ঘুমের মধ্যে, কেউ বোঝেনি কেন—মা-মেয়ের তো ধাত একরকম হতেই পারে? শি ডায়েড ইয়ং—’

‘কু-চিন্তা কোরো না ইন্দ্র—থিংক পজিটিভ—লুক ইন্দ্র, বাঁশি ইজ অ্যালাইভ! অ্যান্ড শি উইল বি। ও নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে উঠবে—মাস্ট বি ওভার স্ট্রেসড—’ নন্দিনী সাহস দিচ্ছে।

তীব্র সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়ল।

.

মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে বাঁশির জ্ঞান ফেরেনি। তিনদিন পূর্ণ হয়ে গেছে, কোমা অবস্থা কেটে যায়নি। ডাক্তার বলছেন ম্যাসিভ সেরিব্রাল অ্যাটাক—মাথার ভিতরে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে, ঝরা রক্ত জমে আছে অপারেশন করে বের করে দেওয়া দরকার। কিন্তু সেটা খুব ডেলিকেট, খুব কমপ্লিকেটেড অপারেশন—শহরের বড় হাসপাতালেই সেটা সম্ভব—এই সাগরতীরের গ্রামের ছোট হাসপাতালে সে-ব্যবস্থা নেই। অথচ এখন ওকে নড়ানোও সহজ নয়, অ্যাম্বুলেন্সে করে দূরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাতে আরও ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

‘ইন এনি কেস, দেয়ার ইজ হার্ডলি এনি চান্স অফ রিকভারি।’ মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে এমনই প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছে, যে বাঁশি আর চেতনায় ফিরবে বলে ডাক্তারদের মনে হচ্ছে না। তবে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের সহায়তায় বেঁচে সে থাকবে। কতকাল যে সেটা চলবে, সেও কেউ বলতে পারে না। এখন বাঁশি অচেতন। গভীরভাবে ঘুমন্ত। ডিপ কোমা-তে ঢুকে গেছে তার চৈতন্য। কিন্তু বয়েস মাত্র সাতচল্লিশ। তার জাগ্রত জীবন এখানেই থমকে রইল—এখন অনি:শেষ অন্ধকারে চলা। এ চলায় তার কোনও সঙ্গী নেই।

.

বাঁশির দাদা বাদল এসে পৌঁছেছেন। বাঁশির একমাত্র আপনজন ওর আদরের এই ছোড়দাটি। বড়দাদা বাল্যকালেই মারা গেছেন—বাদল আর বাঁশরি মাতৃহীন দুটি ভাইবোন দু-জায়গায় একা একা বেড়ে উঠেছে— একজন নরেন্দ্রপুরে, অন্যজন কার্শিয়াঙে, দুই ধর্মের মিশনারিদের স্নেহের আশ্রয়ে। বাদলই চিরকাল বাঁশির প্রকৃত গার্জেন। একাজে সে স্বনিযুক্ত, কেন না ওদের ব্যবসা-ব্যস্ত বাবার সন্তান স্নেহে গাফিলতি ছিল সর্বজনবিদিত। বাদলের চেয়ে বয়সে অনেকটা ছোট বাঁশরি দাদার অন্ধ স্নেহের পাত্রী। খবর পেয়েই উড়ে এসে পড়েছে বাদল তার প্রিয় বোনটির বিছানায় পাশে। বাদলের সঙ্গে ডাক্তারদের আলোচনা হচ্ছে রোজ—ইন্দ্রর মতন ভীরু নয় বাদল—সোজাসুজি জানতে চায় জ্ঞান ফিরবার সম্ভাবনা কতটা। ডাক্তারে খুব উৎসাহব্যঞ্জক কিছুই বলতে পারেনি।

তবে অপারেশন করে জমাট রক্ত বের করে দিলে খানিকটা উন্নতি নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু সে রিস্ক কে নেবে? এখন তো কথায় কথায় মানুষ কোর্টে ছোটে —মকদ্দমা ঠুকে দেয়—কনজিউমার্স ফোরামের কাছে নালিশ করে। লক্ষ লক্ষ ডলার জরিমানা হয়ে যায় ডাক্তারদের সামান্য কোনও ত্রুটি হলেই—ডাক্তাররা এখন তাই কিছুতেই কোনও রিস্ক নিতে রাজি হয় না। যদি ভুল কিছু ঘটে যায়,—’না বাবা, আমরা ওসব ডেলিকেট অপারেশনের রিস্ক নিতে পারব না। এমনি এমনি শুশ্রষায় যেটুকু উন্নতি হয়, সেইটুকুই ভালো। অপেক্ষা করা যাক। জ্ঞান ফিরুক।’

কিন্তু বারোদিন কেটে গেল, জ্ঞান ফেরার কোনও লক্ষণ নেই। কাচের ঘরে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে রঙিনের মা। রঙিন খুবই ভেঙে পড়েছে। মুখখানা ভয়ে শুকিয়ে এতটুকু। হাসিখুশি কোথায় উবে গেছে—মুখের কথাও যেন ফুরিয়ে গিয়েছে তার। ভরা বর্ষার মেঘলা আকাশের মতো আঁধার হয়ে আছে তার মুখ—টোকা দিলেই বর্ষা নামবে। ইন্দ্র আরও ভেঙে পড়েছে। ধুমপান খুব বেড়েছে। কুমুদিনীর ভয় করছে ইন্দ্র হয়তো আবার নেশা করতে শুরু করে দেবে এবার—এই উদ্বেগ, এই উৎকন্ঠা সইবার মতো মনের জোর কি আছে তার? তবু ভালো এবার বাদল এসে ইন্দ্রর পাশে দাঁড়িয়েছে—জগতে যদি ইন্দ্র কাউকে শ্রদ্ধা করে, সে এই বাদলকে। জেল থেকে পাত্র ধরে আনাতে ওদের বাবা প্রবল আপত্তি করলেন, অথচ মেয়ের ভবিষ্যতের জন্যে তাঁর বিন্দুমাত্র ও ভাবনাচিন্তা ছিল বলে এর আগে বোঝা যায়নি। মেয়ে ছাত্রী ভালো, কলেজে সে পড়ছিল স্কলারশিপে, ছুটি কাটাতে যেত ছোটমামির বাড়িতে। বাবার সঙ্গে যৎসামান্যই যোগ। বাবা তো ঘূর্ণ্যমান, নিজের ব্যাবসার কাজে আজ হংকং কাল সিঙ্গাপুর, পরশু লন্ডন। বাড়ি বলতে কিছু দাসদাসীর অবাধ রাজত্ব। বাদল প্রেসিডেন্সি জেলে তার নিজস্ব কোয়ার্টারেই বসবাস করত। আর বাঁশি থাকত, যাদবপুরের হস্টেলে। কখনও কখনও উইক এন্ডে বাড়ি আসত না যে, তা নয়। রামুদাদা গিয়ে ধরে আনত ওকে কিন্তু লম্বা ছুটিগুলোতে ও যে ছোটমামির কাছে, শান্তিনিকেতনে। কার্শিয়াঙের স্কুল থেকে রিটায়ার করে মামি শান্তিনিকেতনে বাড়ি করেছেন। বয়স্ক মানুষের একা থাকার পক্ষে জায়গাটি ভালো ছিল এতদিন। এখন তার চরিত্র বদলাচ্ছে। প্রচণ্ডভাবে এন আর আই অধ্যুষিত শান্তিনিকেতন এখন ধনীদের বিলাস পুরীতে পরিণত হতে চলেছে। ছোটমামির ছোট্ট বাড়িটি মস্ত বড় বাগানের মধ্যে। বাঁশি সেখানে এ. সি. লাগিয়ে দিয়েছে। রঙিন ভীষণ ভালোবাসে দিদুনের বাড়িতে যেতে। দু-বছরে একবার যায় ওরা ছোটমামির সংসার বলতে তো ওরাই। বাদল ভাবছে ছোটমামিকে খবর দেবে কিনা। ওঁকে এখন নিয়ে আসা মুশকিল। কুমুদিনীরই বয়সি হবেন, পাসপোর্টও করানো আছে, কিন্তু ভিসা করানো এই বয়েসে, এত তাড়াতাড়ি অসম্ভব। বাদল ঠিক করল তারচেয়ে খবর না দেওয়াই ভালো। দেখা যাক, অবস্থা কোনদিকে যায়।

তা ছাড়া মামি এলেও বাঁশি তো তাঁকে দেখতে পাবে না বুঝতেও পারবে না, তিনি ওর কাছে এসেছেন। এবং মামির পক্ষেও এই দৃশ্য চোখে দেখা, শেষ স্মৃতি হিসেবে খুবই যন্ত্রণাদায়ক হবে। না: ছোটমামিকে এই বেদনা থেকে রেহাই দেওয়াই কর্তব্য। পরে যখন জানবেন তখন জানবেন।

বাঁশরির বাবাকে জানানো হয়েছে।

বাবা বলেছেন টাকাকড়ি লাগলে ওঁকে জানাতে—যেন অর্থের জন্য চিকিৎসায় কোনও ঘাটতি না হয়। আর্থিক দায়িত্ব, কর্তব্য, এগুলো তিনি বোঝেন। বাবা একবারই এসেছিলেন। রঙিন তখন ছোট। বাবার এ-দেশে বসবাস করতে ভালো লাগেনি। তাঁর দাসদাসীর সেবার অভ্যেস, নইলে ফাইভ স্টার হোটেলের সেবা। মেয়ের এখানে তাঁর সুবিধে হয় না।

মাঝে মাঝে টেলিফোনে বাঁশি বাবার খবর নেন। ইন্দ্র দু:সংবাদটা তাঁকেই জানিয়েছিল। বাদল বাড়িতে থাকে না—তার উচ্চপদের সরকারি চাকরিতে চমৎকার বাংলো জুটেছে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। ওখান থেকেই বাবার খোঁজখবর দেখাশুনো করে। সেই এখন বাবার লোকাল গার্জেন।

.

বাঁশির অফিস থেকে ওর যে হেলথ-ইনশিয়োরেন্স করিয়ে দিয়েছে, সেটা প্রথম শ্রেণির। বাবার অর্থসাহায্য বাঁশির লাগবে না বলেই মনে হচ্ছে।

বাঁশির কোনও উন্নতি হচ্ছে না দেখে ইন্দ্র, রঙিন ক্রমশই ভেঙে পড়ছে—বাদলও এবারে আর ‘পজিটিভ থিংকিং করো’—বলতে পারছে না। মনে হচ্ছে তো বাঁশির ব্রেন ডেড অবস্থা—আর জ্ঞান ফিরবে না। এখন সে চেষ্টা করছে ইন্দ্র আর রঙিনকে মনোবল যোগাতে, যাতে বাঁশির না-থাকাটা ওরা সহ্য করে নিতে পারে। প্রস্তুতি প্রয়োজন। প্রায় দুই সপ্তাহ কেটে গেল, এখনও জ্ঞান ফেরেনি। এবারে তৈরি হও। মা কারুরই তো চিরকাল থাকে না। বাদল-বাঁশরি তো মাকে পায়নি। রঙিনের কত সৌভাগ্য, সে উনিশ বছর মার কোলে থেকেছে। এবার সে বড় হয়ে উঠেছে। এবার তাকেই সংসারের হাল ধরতে হবে—বাবাকে ঠাকুমাকে দেখতে হবে তাকেই।

এই সংসারে বাঁশির রোজগারটাই ছিল প্রধান উপার্জনের উৎস। এখন তার অসুস্থতায় কী ব্যবস্থা হবে, কে জানে। খবর নিতে হবে। ও যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন ওকে অফিস থেকে আংশিক অর্থসাহায্য দেবে কিনা। চাকরি করতে করতেই তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ইন্দ্রকে জোর করছে বাদল, মন ঠিক করে একটা কাজকর্ম খুঁজতে। ওকে এবার প্রধান রোজগেরে হতে হবে। নতুবা, দেশে ফেরার কথাও ভাবতে হবে। রঙিনের এদেশের কলেজে পড়ার খরচ প্রচুর। কিন্তু বাঁশিকে এভাবে হাসপাতালে রেখে দিয়ে তো দেশে ফেরার প্রশ্ন নেই। সমস্যা জটিল।

‘ধরেই নিতে হবে যে বাঁশিকে আমরা হারিয়েছি। লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের দৌলতে ওর হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, সব কাজ করছে বটে—কিন্তু মগজ ঘুমোচ্ছে।’ মগজটাই তো মানুষ। বাঁশির রিকভারির চান্স নেই, এটাই বলছে এরা বারবার। সেই শক্তিমতী, ইয়ং অ্যাডাল্ট, তারই দায়িত্ব বহনের ক্ষমতা সব চেয়ে বেশি হবার কথা।

‘আমাদের সকলেরই মানসিক প্রস্তুতি দরকার।’ বাদল ইন্দ্রকে, রঙিনকে বোঝাচ্ছে। কুমুদিনী চুপ করে সব শোনেন। নির্বাক। ইন্দ্র বাদলকে একবার আড়ালে তো বলেই ফেলল—’মা ভীষণ ভেঙে পড়েছেন মনে হচ্ছে। ভিতরে ভিতরে আবার গুঁড়িয়ে গেছেন, এই তা সদ্য ফিরলেন ডিপ্রেশনের চিকিৎসা করিয়ে হাসপাতাল থেকে, সঙ্গে সঙ্গে এত বড় আঘাত! আমার ভীষণ ভয় করছে। মা কিন্তু আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন! রঙিন, তুই ঠাকুমার সঙ্গে সব সময়ে কথা বলবি। কিপ হার এনগেজড।’ কিন্তু রঙিন বলল—’ঠাকুমা ইজ ও কে—ঠিকই আছে। ওই তো সকালে চা করে দেয়। ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করে। লাঞ্চের প্ল্যান করে। শি ডাজনট ইন্টারফিয়ার ইন ইওর প্ল্যানস। বাট শি ইজ টেকিং কেয়ার অফ আস অল। ওনলি শি ইজ টু-উ স্টানড টু স্পিক।’

অবশেষে সকলের সব দুর্ভাবনা শেষ করে দিয়ে কুমুদিনী কথা বললেন।

‘বাঁশি বেঁচে থাকতে থাকতেই তাহলে তোমরা হাল ছেড়ে দিলে, ইন্দ্র? বাদল? এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে চলে? এত সহজে বাঁশি নেই বলে মেনে নেবে তোমরা? যখন বাঁশি সত্যি সত্যিই বেঁচে আছে? মা’র সাতচল্লিশ বছরের মেয়ে, ওর সামনে এখনও অন্তত পঁচিশ-তিরিশ বছরের জীবন পড়ে রয়েছে। না বাপু; আমি এত সহজে ওকে ছেড়ে দিতে পারব না। আমি তো শুনলুম ডাক্তাররা প্রথমে বলছিল কোনও বড় হাসপাতালে নিয়ে গেলে অপারেশন করে ওর মাথার খুলি থেকে জমাট রক্তগুলো বের করে দিলেই বাঁশি অনেকটা সুস্থ বোধ করবে। তোমরা কেউ সে চেষ্টা করছ না কেন?’

‘কিন্তু মা, ওকে বড় হাসপাতালে ওরা নেবে কী করো? চারশো মাইল রাস্তা গাড়ি করে ওকে নিলে, ও আর এমনিতেই বাঁচবে না যে?’

‘কেন, আর কোনও উপায় নেই?’

‘আর কী উপায় থাকবে? বাদল বিষণ্ণ হাসে। অবসাদের হাসি। অবুঝ বৃদ্ধার আবদার শুনে মমতার হাসি।

‘কেন, সেদিনই তো কাগজে পড়লুম—কে একজন অ্যাক্টেসের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, কোমায় চলে গিয়েছিল—তাকে ছোট হাসপাতালে অপারেশন করতে পারেনি। তাই হেলিকপ্টারে করে বড় হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেখানে অপারেশন করেছে, সে ভালো হয়ে উঠছে। কেন, তোমরা পড়নি সে-খবর? অ্যাক্টেসের নামটাম আমার মনে নেই—’

ইন্দ্রের মাথায় ঠং করে একটা ঘন্টা পড়ল। হেলিকপ্টার! তাই তো? রঙিন চেঁচিয়ে উঠল—’রাইট! কোয়াইট রাইট! জুড়ি টমসনকে তো তাই করল। শি ইজ রিকভারিং—শি স্পোক টু হার হাজব্যান্ড ফ্রম হার বেড, হ্যাঁ তো, কাগজে ছবি দেখেছি। ইয়েস, দ্যাট ইজ আ পসিবিলিটি! বাবা, লেট আস থিংক অ্যাবাউট অ্যারেঞ্জিং আ হেলিকপ্টার—হোয়াই নট?’

ইন্দ্র বলল—’তার আগে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে দেখি। হোয়েদার ইট ইজ ওয়ার্থ দ্য ট্রাবল—আর ঠিক কোন হাসপাতালে, কোন ডাক্তারের আন্ডারে ওকে নিয়ে যাবেন, সেসব আগে ঠিক করা হোক তারপরে—তা ছাড়া, হেলিকপ্টারের খরচটা ইনশিয়োরেন্স দেবে কিনা—’

‘ইনশিয়োরেন্স না দিলে, সেটা আমরাই দিয়ে দেব, আমাদের বাবা অন্তত সেটা দিতে পারবেন—’ বাদল বলে ওঠে সোৎসাহে—’সত্যিই তো, মাসিমা একদম হক কথা বলেছেন, এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়া উচিত নয় আমাদের। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। চলো ইন্দ্র, আমরা আজই বিকেলে ডাক্তার রুবেন্সকে জিগ্যেস করি এই বিষয়ে। ওরা তো বলেছিল। আমরাই তেমন উৎসাহ দেখাইনি তখন। ঠিক বুঝতে পারিনি।’

রঙিন ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল অনেকগুলো।—’ঠাকুমা ইজ আ জেম, ও:। শি ইজ অ্যাবসল্যুটলি রাইট। আমাদের শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। চোদ্দোদিন বেঁচে আছে যখন, নিশ্চয় বেঁচে উঠবে মা। উই মাস্ট নট গিভ আপ সো আর্লি। ছোটমামা, লেট আস টক টু ডক্টর রুবেন্স দিস আফটারনুন—’ রঙিন প্রায় লাফিয়ে ওঠে। ক্লান্ত মনমরা, কালিমাখা মুখখানা হঠাৎ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি। চোখে ভরসা। ইন্দ্র হাতের সিগারেটটা পায়ের নীচে দুমড়ে ফেলে বলে ওঠে—’ইয়েস, হেলিকপ্টার ইজ আ গ্রেট আইডিয়া।’

‘বাবা, তোমার কিন্তু ঘাসের মধ্যে সিগারেট বাটস ফ্যালবার কথা নয়। ওধারে একটা স্যান্ডবক্সের মতো জায়গা আছে ওর জন্য।’ রঙিন এর মধ্যেও আইন-মানাতে চেষ্টা করে ওর আইন-ভাঙা বাবাকে। বাদলের মুখ-চোখও পালটে গেছে। কুমুদিনী বলেন—’ঠাকুরের ইচ্ছে হলে সবই ঠিক হয়ে যাবে—কিন্তু সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করাটা তো আমাদেরই হাতে? আগে পুরো চেষ্টাটা করে দেখি। বাঁশিকে কি আমাদের লড়াই না করে অমনভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত? সে কিন্তু সহজে ছাড়ত না।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *