| ১১ | ইন্দ্র
ঘরে ওরা প্রচণ্ড কলরোল করছে—মনোপলি খেলা চলছে, হোহো হাসির সঙ্গে চেঁচামেচি—ব্যাবসা জমে উঠেছে—ধনৈশ্বর্যে লক্ষ্মীলাভ হচ্ছে কারুর, আর কেউ কেউ পথে বসছে, এই জেলে ঢুকছে, এই জেল থেকে বেরুচ্ছে। সবই যেন জলের মতো সরল সহজ। আসলে জীবন তো এরকম নয়। আমার মনোপলি খেলাটা ভালো লাগে না কোনওদিন। ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি না থাকলে এতে জেতা যায় না। জমি কিনছে, বাড়ি করছে, হোটেল করছে, দাঁও মারছে—ইশ!
‘আমি ততক্ষণ বাইরে থেকে একটু হেঁটে আসি’—এই বলে বেরুলাম। আমার সঙ্গে স্কেচ খাতা আছে। আজকের দিনটা স্বচ্ছ, পরিস্কার। আকাশ নীল, সাগরও নীল, যতদূর চোখ যাচ্ছে নীল সমুদ্রে সাদা সাদা পাল তুলে সেলিং বোট ঘুরছে। আজ প্রচুর নৌকো নেমেছে জলে। একে শনিবার তায় এমন চমৎকার আবহাওয়া। অফিসিয়ালি সামার পড়ে গেছে, ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষরা পথে বেরিয়ে পড়েছে।
আমারও বেরিয়েছি। বাঁশির বন্ধুদের সঙ্গে জুটে আজ আমরা তিনটি বাঙালি পরিবার বেড়াতে এসেছি বিচে। এই সমুদ্রতীরে হান্নার একটা বাড়ি আছে। হান্না তার চাবি দিয়ে দিয়েছে বাঁশিকে। আজ আমাদের উৎসব মাকে ঘিরেই, মা বাড়িতে এসেছেন। মায়ের বাড়িতে ফিরে আসাটা যে আমাদের কাছে কত বড় আনন্দের ঘটনা, বাঙালির দুর্গাপুজোর আনন্দও তার কাছে লাগে না। আমার মায়ের সুস্থতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমারও সুস্থতা—এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রঙিনের খোশমেজাজ আর বাঁশির সব পরিশ্রমে সাফল্য। আজকের দিনটা তাই আমাদের কাছে মস্তবড় উৎসবের দিন।—বাঁশি আনন্দ করে এই বিচের পার্টির আয়োজন করেছে।
মনোপলি খেলায় বাঁশিরও মন নেই। সে রান্নঘরে। ওই দাঁও মারা, জমির প্লট কেনা, হোটেল তৈরি করা ও-সব জোতদারির খেলাতে বাঁশিরও রুচি নেই। রঙিনটা দিব্যি মেতে উঠেছে দেখছি। চেঁচাচ্ছে, তালি বাজাছে, হাসছে, আর্তনাদ করছে—যা কিছু করছে সবেতেই ওর প্রাণের উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে। খুব প্রাণোচ্ছল হয়েছে মেয়েটা। ওর ঢ্যাঙা রোগা শরীরটা দেখে মনে হয় ফুঁ দিলে উড়ে যাবে—কিন্তু বডি বিলডিং প্র্যাকটিস করে হাতের গুলি পাকচ্ছেন তিনি। এ দেশে কত কিছুই করার আছে ছোটদের। কলেজে নিয়মিত জিম-এ যায় রঙিন। আবার ভায়োলিন ক্লাসও নিচ্ছে। বাঁশির ইচ্ছে ছিল ও ফ্লুট শেখে।
.
ডানদিকে মালাগা কোভ-এর উঁচু পাথুরে খাড়া চুড়ো। সামনে প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউহীন বিস্তার আকাশ পর্যন্ত। চোখটা ডানদিকে সরিয়ে আনলে দেখতে পাচ্ছি কালো পাথরের গায়ে অনেক নীচে, পাথুরে উপকূলে আছড়ে পড়ে ছিটকে উঠছে সাদা ফেনার উচ্ছল ফোয়ারা—সামুদ্রিক ঝাঁঝি জড়িয়ে আছে পাথরে, যেন লাল-সবুজ দোরঙা চাদর। শুনেছি এই উঁচু পাথরটা থেকে প্রায়ই টিন-এজাররা সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়। আর ওঠে না। তাদের সমুদ্র বুকে টেনে নেয়। এই অতিরিক্ত প্রাপ্তির দেশেও এত শূন্যতা টিন-এজারদের বুকে। কীসের অভাব? কী খোঁজে তারা? আমাদেরও ঘরে একজন টিন-এজার বেড়ে উঠছে—তার জন্যে বুকের মধ্যে একটা গহন ভয় যেন সব সময়েই থমকে থাকে। তবে এখনও অবধি তো রঙিনের মধ্যে কোনও বেহাল হওয়া দেখিনি—কলেজে গিয়েও দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে, কোনওরকমের অসুবিধে বোধ করেনি বাড়ির বাইরে থাকতে। বাড়ির সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছে পুরোপুরি। যদিও আমি মাঝে মাঝে চেঁচামেচি করি, ‘তোর কেন কেবলই ভারতীয় বন্ধুর সংখ্যা বাড়ছে? মনে মনে বুঝতে পারি রঙিনের মধ্যে বাঙালি হওয়ার, ভারতীয় হবার আকাঙ্খাটা এত জোরালো কেন। বড় হচ্ছে মেয়েটা—এখন তো নিজের আইডেনটিটি নিয়ে চিন্তা হবেই ওর মনে—আমি ঠিক কে? আমি ঠিক কী? কোন পরিচয়টা আমার পক্ষে সবচেয়ে মানানসই হবে? সবচেয়ে আরামপ্রদ হবে কোন পরিচয়টা? ও নিজেকে মনে করে একজন বাঙালি ভারতীয় মেয়ে বলে, যার জন্ম হয়েছে আমেরিকায়। কিন্তু, আমি জানি, রঙিনের মনের কী ইচ্ছে। ভারতবর্ষে গিয়ে বাস করতে চায় সে। বি. এ. পড়তে ঢুকবার আগেই সে একবছর ভারতবর্ষে গিয়ে কাজকর্ম করতে চেয়েছিল—আমিই বাধা দিলুম—বললুম, আগে গ্র্যাজুয়েশনটা হয়ে যাক। তারপরে ইন্ডিয়া। জীবনে কখন কী যে বাধা পড়ে, তাই পড়াশুনোটা আগে শেষ করে ফেলাই ভালো। রঙিন মেনে নিয়েছে, কলেজে ভরতি হয়েছে, কিন্তু ওর দেশে ফেরার ইচ্ছেটা ক্রমশ পরিণত হচ্ছে পরিকল্পনাতে। ইন্টারনেটে যোগাযোগ করছে দু-একটা N.G.O-র সঙ্গে—বাঁশি বলছিল।
.
অনেকদিন আগে এই পয়েন্টটাতে আমরা দুজনে হাঁটতে আসতুম একদা। এই মালাগা কোভে। পরে, যখন নেশার ঘোরে আমি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ফুরিয়ে যাচ্ছি, তখন প্রায়ই আমি বাঁশিকে বলতুম, আমরা ওইখানে ফিরে গিয়ে জলে ঝাঁপ দিই—’চলো, দুজনে মিলে একসঙ্গে যাই, নিশ্চিন্ত হই—মুক্তি নিয়ে নিই!’
বাঁশি প্রথম প্রথম চুপচাপ শুনে যেত। একদিন বললে,—’যেতে হলে তুমি একাই যাও—আমি যাব না। আমার ওপরে একজন বৃদ্ধা, আর একজন বালিকার জীবন নির্ভর করে। আমার অনেক কাজ বাকি। আমি মুক্তি চাই না। আমি মুক্তই। তোমার ইচ্ছে করে তুমি একাই পালিয়ে যাও—অমন দায়িত্বহীন কাজ করার কথা আমি দু:স্বপ্নেও ভাবি না; শুনতেও রাজি নই। তোমার চিন্তাটাই মহাপাপের—নেশার যা গর্হিত অপরাধ, তার চেয়েও ঢের বেশি গর্হিত তোমার এই চিন্তা।’ বাঁশির রাগে গলা বুজে আসছিল, ওকে এত রেগে যেতে আমি খুব একটা দেখিনি।
‘শোনো ইন্দ্র, মায়ের জন্যে আর মেয়ের জন্যে আমাকে বেঁচে থাকতে হবেই, ওরা আমার ভরসায় বাঁচে। তা ছাড়া, এই কথাটাও মনে রেখো, ইন্দ্র আমার নিজের জীবনটাকেও আমি খুব ভালোবাসি, নিজের প্রাণটা আমার কাছে খুবই মুল্যবান। দয়া করে ভুলে যেও না, বহু চেষ্টায়, অনেক কষ্ট করে আমাকে এই অবস্থানে এসে পৌঁছুতে হয়েছে। জীবনকে আমি সম্মান করি।’
দেখলে মনে হবে খুব নরম, আসলে কিন্তু বাঁশি অত্যন্ত কঠিন মেয়ে। মাঝে মাঝে ওকে আমার কেমন ভয় ভয় করে।
মা খুব সমুদ্র ভালোবাসেন। কিন্তু আমাদের সমুদ্রতীরের কোনও বাড়িতে বাস করা হয়নি এখনও। মা এসে অবধি বাইরের লনে চেয়ার টেনে বসে আছেন। চোখে কালো চশমা। হাতে একটা খবরের কাগজ। মা’র কাগজে চোখ নেই। মা চেয়ে আছেন সমুদ্রের দিকে। মাকে চিন্তিত দেখচ্ছে না। আমি এখান থেকে মা’র দিকেও নজর রাখতে পারছি, ঘরের ভেতরকার মনোপলি খেলোয়াড়দের দিকেও। রঙিনও খেলছে, মায়ের বন্ধুদের সঙ্গে তার বেশ ভাব। আমার ওসব খেলা ভালো লাগে না। ধৈর্য নেই। স্ট্র্যাটেজিগেমস খেলার মতো মানসিকতাই আমার নেই। আমি বসে আছি বারান্দায়—স্কেচের খাতা নিয়ে। সমুদ্রের রংটা যে কী আশ্চর্য রকম বদলাচ্ছে! এই ছিল আলট্রামেরিন, এই হল কোবল্ট ব্লু। রোদ যত বাড়ছে ক্রমশ স্টিল গ্রে—রোদ্দুর ঝলসালে ধাতব পাতে পরিণত হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগর।
.
মেয়ে ঘরে ফিরেছে হোস্টেল থেকে।
মা ঘরে ফিরেছেন হাসপাতাল থেকে।
আমিও ঘরে ফিরেছি নেশার কবল থেকে।
ঘর মানে, বাঁশি।
আমরা সবাই ফিরেছি বাঁশির কাছে।
যে-বাঁশির একদিন নিজের কোনও ঘরই ছিল না, আজ সে আমাদের সকলের ঘর হয়ে আছে। এ-ও যদি ম্যাজিক না হয় তবে আর ম্যাজিক বলব কাকে! মধুলিকা আর আশরাফ এসেছে ছেলে জিৎ আর মেয়ে জয়াকে নিয়ে। জিৎ তার কুকুর স্যানডিকে এনেছে—তারা সমুদ্রতীরে ছুটতে গেছে। জয়া এদের সঙ্গে খেলেছে। মধুলিকা এখানে হেলথ সার্ভিসে কাজ করে। অত্যন্ত চমৎকার মেয়ে—ওর বাবা মারাঠি ব্রাহ্মণ, মা বাঙালি ছিলেন। বিয়ের পরে মধুলিকা একবারও দেশে ফেরেনি। আশরাফকে বিয়ে করার জন্যে তার মা-বাবা তাকে ত্যাগ করেছিলেন—যদিও মধুলিকা তাঁদের একটিমাত্র সন্তান। ওর বাবার ব্রাহ্মণ্য তেজ মায়ের সন্তান স্নেহকে প্রশ্রয় দেয়নি। বিয়েতে অমত না থাকলেও মধুলিকার মা তাকে আশ্রয় দিতে সক্ষম হননি। মেয়েকে চোখে না দেখেই তাঁকে শেষ নিশ্বাস ফেলতে হয়েছে। বাবাও আর বেঁচে নেই। মধুলিকা আর দেশে যায় না। বলে, ‘কলকাতায় আমার কেউ নেই—তোমারই তো আমার কলকাতা।’
আশরাফের দেশ ঢাকাতে। মধুলিকা সেখানে যায় মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েকে নিয়ে। মায়ের অসুস্থতায় মধুলিকা আমাদের অনেক সাহায্য করেছে, আমার ব্যাপারেও বাঁশির পাশে ছিল সে।
আর এসেছে সমীরণ আর নন্দিনী, ওদের ছেলে অর্ককে নিয়ে। অর্কর দাদা, নন্দিনীর প্রথম পক্ষের ছেলে অভ্র আসেনি। অর্কের সঙ্গে রঙিনের খুব ভাব, ওরা সমবয়সি—জয়াও ওদেরই কাছাকাছি—ওরা তিনজনে মহোৎসাহে যোগ দিয়েছে মনোপলি খেলায়। বাঁশি আর মধুলিকা রান্নাঘরে। নন্দিনী খেলছে ওদের সঙ্গে। প্রচণ্ড চিৎকার, হৈ হুল্লোড় শুরু করেছে ওরা। শুনতে মন্দ লাগছে না। ভাগ্যিস বাড়িটা সমুদ্রতীরে বেশ ফাঁকা জায়গায়, তাই এত চেঁচামেচিও কাউকে বিরক্ত করছে না—হাসিঠাট্টা হাততালির সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ আর্তনাদও উঠছে —মাঝে মাঝে মধুলিকা আর বাঁশিও যোগ দিচ্ছে হট্টগোলে। আশরাফ খেলছে না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেঁড়ে ওস্তাদি করছে। ওর চিমটি কাটা মন্তব্যে ক্ষেপে উঠছে বাকিরা। সমীরণ বিয়ার হাতে টিভি খুলে খেলা দেখছে।
এদেশে এরকম রিল্যাক্সড, গা-ছাড়া সময় কাটে না আমাদের বড় একটা। বিচে এসে ছেলেপুলে নিয়ে মা-বাবারা উইক এন্ড কাটাচ্ছেন মনোপলি খেলে, এ হয় না। রান্নঘরে হচ্ছে তন্দুরি চিকেন, আর নান রুটি, স্যালাড, আর ছোলার ডাল। সঙ্গে দারুণ বাকলাভা এনেছে সমীরণ ওর চেনা সেই গ্রিক মিষ্টির দোকান থেকে। এখানে তো তন্দুরি চিকেন রান্না করতে কষ্ট নেই, সময়ও লাগে না, ম্যারিনেট করো, তৈরি তন্দুরি মাশালা মিক্স মাখাও, বেক করো। আর রুটিটা কিনে এসেছে ওই বাকলাভার দোকান থেকেই। ঠিক নান নয়, তবে ওই রকমেরই। পিটা ব্রেড বিয়ার আছে সঙ্গে—কিন্তু আমার জন্যে শুধু টনিক ওয়াটার। এই স্বাদটা আমার খুব ডেলিকেট লাগে। অন্য কোলড ড্রিংকস আমি সহ্য করতে পারি না। বাঁশিও খায় না কোনও বটলড ড্রিংক। সাধে কি আর ওই ফিগারটি রেখেছে বাঁশি?
ইচ্ছে করছে মা’র কাছে গিয়ে একটু বসি। ওইখানে টেবিল ঘিরে চারখানা চেয়ার আছে। মধুলিকা আর বাঁশি মাঝে মাঝে মার কাছে গিয়ে বসছে। রঙিন, নন্দিনী, জয়া আর অর্ক এমন উত্তেজিত হয়ে খেলছে যে তার মধ্যে রঙিন ফাঁক পাচ্ছে না ঠাকুমার কাছে উঠে যাবার। আমি জানি এক চিলতে ফাঁক পেলেই রঙিন ছুটবে একবার ঠাকুমার কাছে। একবার বাবার কাছে খবরদারি করে গেছেন তিনি। ঠাকুমাকে চুমু খেয়েও গেছেন। বড্ড ভালোবাসতে পারে মেয়েটা। আমাদের সৌভাগ্যের সীমা নেই যে রঙিনকে আমাদের কোলে পেয়েছি আমরা। আমাদের রক্তমাংস থেকে এর চেয়েও চমৎকার কোনও মানুষকে আমরা সৃষ্টি করতে পারতুম বলে মনে করি না আমি। রঙিন ঈশ্বরের অকৃপন করুণার সৃষ্টি।
মা উঠে দাঁড়িয়েছেন। ভিতরে আসছেন কি? ওদিকটাতে রোদ্দুরে গিয়ে পড়ছে—মা আর বসতে পারবে না। বরং মা বারান্দায় এসে বসলে পারেন—এখান থেকেও পুরোপুরি সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ কুয়াশা এসে ঢেকে দিচ্ছে জলছবি, আস্তে আস্তে মুছে গেল প্রশান্ত মহাসাগর। হান্নার বাড়ির লনটা রেলিং দিয়ে ঘেরা, তার ঠিক নীচেই, অনেক নীচে, ঝাঁপিয়ে পড়ছে সমুদ্র। এখন কিন্তু সেখানে শুধুই শূন্যতা, উদগ্রভাবে সর্বস্ব গ্রাস করে ফেলেছে এই ক্রমশ এগিয়ে আসা সিন্ধুবাষ্পের কুয়াশা। এই শূন্যতার নীচে ঢাকা পড়ে আছে তলহীন রহস্য। কে জানে তা রত্নগর্ভ কিনা? যেভাবে বোমা ফাটানো হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরে, আর কি সমুদ্রগর্ভেও শান্তি আছে?