ইহজন্ম – ১

| ১ | বাঁশরি

 আজ আমার বান্ধবী হান্না অরেনস্টাইনের উপনয়ন হচ্ছে—সেপুলভেডা আর মন্টানার মোড়ে ওই ছোট লুথারাম চার্চটাতে। ওটাকে ওরা ইহুদি মন্দির হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়—ইহুদিদের প্রার্থনা সভা বসে শনিবারে শনিবারে। শনিবার দিনে অবশ্য ওখানে আরও একটা সভা বসে—অন্য এক প্রার্থনার সভা—সেটাতে অনেকদিন যোগ দিয়েছি আমরা। ইন্দ্রর জন্য। অ্যালকোহলিক অ্যাননিমাস সভ্যদের প্রার্থনা সভা—নেশা থেকে মুক্তির উপায় প্রার্থনা। এই প্রার্থনাতে যে হাতে হাতে ফল মেলে, ইন্দ্র তার প্রমাণ। ওর নতুন করে ড্রাইভিং লাইসেন্স মিলেছে—গতবার ওটা কেড়ে নেবার পরে তিন বছর গাড়ি স্পর্শ করেনি। আমিই ছিলুম একমাত্র চালক। এখন ইন্দ্র একদম অন্য মানুষ। গাড়ি চালাচ্ছে, ছবিও আঁকছে। ছবির ধরনটা অবশ্য একেবারেই পালটে গিয়েছে—আগের মতো প্রচণ্ড জীবনীশক্তি এখনকার এই রং ব্যবহারে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু শিল্পীদের তো স্টাইল হামেশাই পালটে যায়। ইন্দ্ররই তো কতবার আঁকার ধরন বদল হল এদেশে আসার পরে।

.

নেশা ছাড়বার পরে ইন্দ্র প্রথম প্রথম একটু ভগ্নহৃদয়, ভগ্নদশাগ্রস্ত হয়েছিল, তুলি ধরত না। বইও পড়তে চাইত না। কেবলই টিভি দেখত বসে বসে। আর সিগারেটটা বেড়ে গিয়েছিল খুব।

এখন বলতে নেই, বেশ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে ইন্দ্র। ছবি আঁকছে, সিগারেট খাওয়া অনেক কমেছে—আঁকার সময়ে তো কক্ষনো সিগারেট খেত না ও। এখন আবার সেই অভ্যেসটা ফিরে এসেছে। যখন কাজ করে তখন সিগারেট ছোঁয় না। ইন্দ্র আবার তুলি ধরেছে এবং স্টিয়ারিংও—এতে আমার যে কত আনন্দ হচ্ছে, আমি বলে বোঝাতে পারব না কাউকে। যেমন, ও যখন মদে ডুবে গিয়েছিল, তখন কত কষ্ট হত আমার, সেটাও অন্য কোনও মানুষের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব ছিল না। ইন্দ্রর মা-ই শুধু বুঝতেন। কিন্তু তিনি নিজে তো সে-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেন না। চলে গেলেন সব কিছুর বাইরে।

আমার ধারণা ওদের পরিবারে এই মানসিক ভারসাম্যের অভাব ব্যাপারটা খানিকটা জন্মগত, রক্তে চারিয়ে-যাওয়া রোগ। মায়ের যেটা হল আটাত্তর পেরিয়ে, ইন্দ্রেরও সেটাই দেখা দিয়েছিল, মত্ততার বেশে। এবং আমার ননদকে ওঁরা যে বলতেন প্রসূতি-পাগল, আমি এখন মনে করি সেটাও এই পুরুষানুক্রমিক একটা অসুখেরই লক্ষণ। সে বেচারি তো সুস্থ হলই না, সুস্থ করে তোলার সুযোগও দিল না কাউকে। তা মৃত্যুটা সবাই মানসিক বিষাদ-জনিত আত্মহত্যা বলে ধরে নিলেও, আমার বিশ্বাস সময়মতো বিষাদের চিকিৎসা করলেই ওকে বাঁচানো যেত। ওর বিষাদ আসলে অসুখ ছিল। কখনও চিকিৎসা হয়নি। যে চিকিৎসা ইন্দ্রর মা উনসত্তর বছর বয়েসে পেলেন, কেন না আমি তখন মতামত দেবার অধিকারী হয়েছি। মা বলেন, ললিতা সেটা পেল না—কেন না কেউ ছিল না ওর জন্যে করবার।

*

ইন্দ্রকে নিয়ে ওই চার্চে এ. এ-র মিটিঙে গিয়েছি নিয়মিত। খুবই সাফল্য পেয়েছি সত্যি, নবজীবন লাভ করেছি দুজনেই। ইন্দ্র নেশামুক্ত ইন্দ্র, নতুন করে আমার প্রেমে পড়েছে বলেও একটু একটু মনে হচ্ছে। কেবল আমারই ছবি আঁকছে এখন। নানান মিডিয়ামে—সবরকমেই হাত লাগাচ্ছে নতুন করে—চারকোল স্কেচও করছে, অয়েলও করছে, সেদিন কয়েকটা ছোট ছোট ওয়াটার কালারও করল হঠাৎ বাগানে বসে। ওয়াটার কালার ও করত না তেমন, আগে আগে। এখন ওর রং ব্যবহারে দু:সাহসটা যেন অনেক কমে গেছে, একটু বেশিই কনভেনশনল রং মনে হচ্ছে যেন—কিন্তু আমি ওসব কিছু ওকে বলছি না। উৎসাহ দেওয়া ছাড়া আর কিচ্ছু না। এখন উলটোপালটা কথা বলে ফেলাটা বিপজ্জনক হতে পারে। একবার সদ্য ফিরে পাওয়া আত্মবিশ্বাসে ঘা লাগলেই হয়তো আমাদের এই সাজানো বাগান আবার শুকিয়ে যাবে। আর ও একবার খোলসে ঢুকে পড়লেই সর্বনাশ!

.

হান্নার ইহুদি উপনয়ন (Bat Mitz Va) হচ্ছে শুনে ইন্দ্র হেসে বাঁচে না। বলল—’কালে কালে কতই হল, পুলিপিঠের ল্যাজ গজাল।’ কী ব্যাপার? না এক মাতাল নাকি মাতাল অবস্থায় রাত্তিরে বাড়ি ফিরে পিঠে-পায়েস খেতে গেছে। পায়েসের বাটিতে মরা ইঁদুর পড়েছিল, সেটাকেই পিঠে ভেবে, খেতে খেতে, মাতালের ওই প্রসিদ্ধ উক্তি! একেই তো মেয়েদের উপনয়ন হচ্ছে, তাও আবার আটান্ন বছর বয়সে! পুরুষের চোখে এটা পুলিপিঠের ল্যাজ গজানো ছাড়া আর কী?

হান্নার একদঙ্গল শিল্পী বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে ইন্দ্ররও। হান্নার এই নতুন করে ইহুদি ধর্মে জাতে ওঠার দীক্ষা উৎসবে তারা সকলেই স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে মহা উৎসাহিত।

আমাদের হিন্দুধর্মের মতোই, ইহুদি ধর্মেও বয়:সন্ধিকালে একটি উপনয়নের মতোই ব্রতপালনের চল আছে। কিছু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করে, মন্ত্র পড়ে ইহুদি ছেলেদের দ্বিতীয় জন্ম দেওয়া হয়। এতদিনে তারা জাতে উঠল, শুচি হয়ে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘টোরা’ স্পর্শের অধিকারী হল। অর্থাৎ, তারা ‘দ্বিজ’ হল। এই ‘বার মিৎসভা’ ব্রতটি শুধুই বালকদের। বালিকাদের নবজন্মের উৎসব হত না। ইহুদি মেয়েরা কোনওকালেই পবিত্র ‘টোরা’ গ্রন্থ স্পর্শ করতে পেত না। এমনকি ইহুদি মন্দির সিনাগগের প্রধান প্রার্থনাঘরে নীচের তলাতে বসতেও পেত না মেয়েরা তাদের বসতে দেওয়া হত দোতলায়, চিকের আড়ালে। পাছে মেয়েদের মুখ দেখলে পুরুষদের মনে অপবিত্র চিন্তা আসে। ধ্যানভঙ্গ হয়।

.

মুক্তির দশক সত্তরের দশকে প্রবলভাবে জেগে উঠেছিল পশ্চিমের নারী জগৎ, ইহুদি নারীরাও তখন বিদ্রোহ ঘোষণা করল। তারাও পবিত্র ‘টোরা’ স্পর্শ করার অধিকার চাইল। আস্তে আস্তে ভেঙে যেতে লাগল ইহুদি ধর্মযাজকদের কড়া আইনের প্রাচীর। মেয়েদেরও নবজন্মের উৎসব প্রচলিত হল এবার, তাদের বয়:সন্ধিকালে। মেয়েদের ব্রতটির নাম ‘বাত মিৎসভা।’

.

কিন্তু হান্নার তো আটান্ন। তার সঙ্গে ওই একই দিনে ইহুদি ব্রাহ্মণ হবেন আরও পাঁচজন মহিলা, সকলেই পঞ্চাশোর্ধ্ব। আর যে পুরোহিত তাঁদের এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন, তিনি এক ইজরায়েলি মহিলা, মধ্যবয়সি। র‌্যাবাই মিরিয়ম তাঁর নাম।

আমি তো মহা উৎসাহী হয়ে আছি, অনুষ্ঠানটি দেখতে যেতে ইন্দ্ররও আগ্রহ কম নয়। ইন্দ্রর বাবা তখন কমিউনিস্ট হয়েছিলেন বলে ইন্দ্রর পৈতে দেননি তাই ইন্দ্রর মনে কিঞ্চিৎ শোক জমে ছিল। কেন না অনেক কলম, আর প্রচুর পাব্বুনীর টাকা পেত তার স্কুলের বন্ধুরা, পৈতের সময়ে। ইন্দ্র বেচারি গাঙ্গুলি হয়েও পাওনা থেকে বঞ্চিত হল—বাবার ভুলভাল রাজনীতির কারণে। এই দু:খেই সে প্রথম প্রথম অ্যান্টি-কমিউনিস্ট ভোট দিত কলেজে এসে। তারপরে আস্তে-আস্তে বড় হয়ে উঠল, বুঝল, দেশে নান্য: পন্থা বিদ্যতে অয়নায়। ইন্দ্রর বাবার চেয়ে ইন্দ্ররা আরও এককাঠি এগোল, বাবা জেল খাটেননি, ইন্দ্র কিন্তু কিছুদিন জেলে ছিল। জেল থেকেই ওর ছবি আঁকার শুরু। খুব চমৎকার একজন তরুণ জেলর ছিলেন ওদের, সাহিত্যে, শিল্পে, পড়াশুনো করায় উৎসাহ দিতেন। রাজনৈতিক বন্দিদেরই শুধু নয়, অন্যান্য অপরাধীদেরও পরিপূর্ণ মানুষ করে গড়ে তোলার প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর।

 সেই জেলরটিই আমার ছোড়দা বাদল। সরকারি নাম, অভিমন্যু রায়। সরকারি চাকরিটাকে ছোড়দা মনে করত তার জীবনের ব্রত। আমাদের আলাপও ওই ছোড়দার মাধ্যমেই। কেউ কি এমন কোনও অভিভাবককে চেনেন, যিনি জেলের বন্দিদের মধ্যে নিজের বোনের জন্যে পাত্র ঠিক করেন? ছোড়দা অবশ্য ঠিক সেটা করেনি, তবে আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছিল সে-ই। ছোড়দার খুবই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, ইন্দ্রর যখন ওই রকম নেশা কাহিল অবস্থা হল। খবরটা শুনে ছোড়দা মনে মনে ওর পতনের জন্যে দায়ী করেছিল ইন্দ্রর ওই জেলে থাকার দিনগুলোকেই। আমি ঠিক টের পেয়েছিলুম। এত দূর থেকেও বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ছোড়দাকে তো চিনি।

ছোড়দাকে ইন্দ্রও ভালোবাসে খুব, ভগবানের মতো না হোক বড় দাদার মতো তো বটেই। ছোড়দার কথাতেই রাজি হল শেষটায় অ্যালকোহলিক অ্যাননিমাসের কাছে যেতে। আমার কথা, মায়ের কথা, কোনও কিছুই কানে ঢুকছিল না তখন ওর, নেশার শেষ না দেখে ছাড়বে না—টাকাপয়সা চুরিও করছিল শেষটা। পাগলামিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল ওর নেশা—আর পাগলামি তো ওদের বংশের ধারা বলে আমি এখন টের পেয়েছি। শুনেছি নাকি ও দুটো একসঙ্গেই থাকে। জিনিয়াস আর পাগলামি। ওদের ব্রিলিয়ান্সও ওখান থেকেই। বড় মামা অত বড় বৈজ্ঞানিক ছিলেন আর মাসি অমন ডাকসাইটে গাইয়ে, ও কি অমনি অমনি হয়? ইন্দ্রর মা নিজেও খুব অন্যরকম। ঝকঝকে মনের মানুষ, অসাধারণ। কিন্তু জীবনে তেমন কিছু করলেন না। অসাধারণ না হলে কেউ এটা পারে? এই বয়েসে বিদেশের মেন্টাল হোমে গিয়ে যেভাবে নিজেকে মানিয়েই নিয়েছেন শুধু নয়, সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এখন তো হাফওয়ে হোমে আছেন। শিগগিরই আমরা ওঁকে বাড়িতে নিয়ে আসব। ইন্দ্র সুস্থ হয়ে উঠেছে, ছবি আঁকছে, ড্রাইভ করছে, এই সংবাদেই হয়তো উনি এতটা সুস্থ সবল হয়ে উঠেছেন। ইন্দ্রর ভেঙে পড়াটা উনি মেনে নিতে পারেননি—নিজেও ভেঙে পড়েছিলেন। অনেক যত্নের, অনেক স্বপ্নের সন্তান ওঁর ইন্দ্র। স্বামীর মনোযোগ তো সেভাবে পাননি কখনও. ইন্দ্রর বাবাকে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি কোনওদিন। এখনও ভেবে পাই না, উনি জীবনে ঠিক কি চেয়েছিলেন। এত অস্থিরমতি ছিলেন কেন?

.

অস্থিরমতিত্বের প্রসঙ্গে আবার হান্নাকে মনে পড়ল। হান্না প্রথমে ছিল ধর্মনিরপেক্ষ সোশ্যাল অ্যাকটিভিস্ট। সাদাকালোর সমান অধিকার নিয়েই ব্যস্ত ছিল, ধর্ম নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সেইসঙ্গে ওরা ছিল যুদ্ধ-বিরোধী এবং পারমাণবিক অস্ত্র-বিরোধী। শান্তির জন্য লড়াই ছিল ওদের—তারই মধ্যে উঠে এল ফেমিনিজমের স্লোগান, স্ত্রীপুরুষের সমানাধিকারের জন্যে আরেকপ্রস্থ লড়াই।

হান্নাকে দেখলে খুব একটা লড়াকু বলে মনে হবে না। হাসিখুশি, ছোট্টোখাট্টো, মিষ্টি, মুখটি লালচে কোঁকড়া চুলে ঘেরা, রোগা পাতলা মেয়ে। দেখলে বয়েস বোঝা যায় না।

হান্না কবিতা লেখে, পিয়ানো বাজায়, আর সঙ্গীত শিক্ষকের চাকরি করে। হান্নার দুবার বিয়ে হয়েছিল। প্রথমে একটি পরম রূপবান, কালো গাইয়ে ছেলের সঙ্গে। সে বিয়ে বেশিদিন টিকল না, ছেলেটার মাদক আসক্তি ছিল। যদিও ব্লুজ গাইত সে খুবই ভালো। নামও করেছিল যথেষ্ট। দ্বিতীয় স্বামীটি ল’ইয়ার। ধনী, আইরিশ, ইস্ট কোস্টের মানুষ—হান্নার চেয়ে বয়েসে অনেকটা বড়। হান্নাই তার সঙ্গে থাকতে পারল না। আমরা বুঝিনি হান্না ওকে বিয়ে কেন করেছিল। বিয়ে ভেঙে যেতে কেউ অবাক হইনি। লাভের মধ্যে হান্নার একটি বড় সুন্দরী মেয়ে আছে। রেচেল।

রেচেল এখন বড় হয়েছে, কলেজ শেষ করে চাকরি করছে ইনটেল কোম্পানিতে। ওর খুব মজার চাকরি। রেচেল অ্যারিজোনাতে থাকে, কোলে ছোট বাচ্চা আছে বলে ঘরে বসেই চাকরি করে রেচেল। এ-দেশে এটা সম্ভব। ওর বয়ফ্রেন্ডটিও ওখানে কাজ করত, সে দক্ষিণ ভারতীয় ছিল। দেশে চলে গিয়েছে। বাচ্চার ভার নেয়নি। রেচেল তার বাচ্চাটির নাম রেখেছে মোনা। বয়ফ্রেন্ডের নাম মোহন ছিল। শুনেছি রেচেল আরেকটি ছেলেকে এই বছরেই বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছে। মার্কিনি ছেলে। হান্স। ওরা তিনজনই এখন লস এঞ্জেলেসে এসেছে হান্নার নবজন্মের উৎসবে যোগ দেবে বলে।

হান্নার আহ্লাদের শেষ নেই। ওর মাসিও এসেছেন নিউইয়র্ক থেকে দীর্ঘ ছ’ঘণ্টার ফ্লাইটে, এই ঐতিহাসিক উৎসবে উপস্থিত থাকতে। তাঁর বয়েস বিরাশি পেরিয়েছে, কিন্তু বোনঝির এই গৌরবমন্ডিত মুহূর্তের সাক্ষী হতে উদগ্রীব তিনি। বেঁচেছিলেন বলেই তো দেখতে পেলেন তাঁরই নিজের রক্তের মেয়ের আজ বাত মিৎসভা অনুষ্ঠান হচ্ছে—সে এখন মন্দিরে গিয়ে পবিত্র ‘টোরা’ চুম্বন করবার যোগ্যতা অর্জন করবে। এ কি সোজা কথা? ওর মা আজ বেঁচে থাকলে কত সুখী হতেন।

হান্না খুব ওদের পরিবারের গল্প করে। ওরা কীভাবে এদেশে পালিয়ে এসেছিল, কীভাবে কষ্টেসৃষ্টে বড় হয়েছিল, কীভাবে ওর বাবা ভিখিরি থেকে ধনী হলেন। হ্যাঁ, হান্নাদের দু:খী পরিবারে পরে আর অর্থাভাব ছিল না। ওর বাবা ওকে প্রচুর ধনসম্পত্তি দান করে গেছেন। হান্নার গলায় যে একটা মস্ত বড় পাথরের লকেট আছে, সেটা নাকি গোলাপি হিরে। ওর বাবার ছিল হিরে-জহরত-এরই ব্যাবসা। বাবাতে-মাতে ভালোবাসার সম্পর্কটি বজায় ছিল জীবনের শেষ দিন অবধি। অনেক দু:খকষ্ট ভাগ করে নিয়েছেন দুজনে অল্প বয়সে, সেই অশ্রুর বন্ধন শিথিল হয়নি কোনওদিন। হান্নার ব্যবসায়ী বাবা নাকি বেহালা বাজাতেন, মা পিয়ানো। মায়ের কাছেই তার পিয়ানোয় হাতেখড়ি। এসব গল্পের সত্যি-মিথ্যে জানি না, রূপকথার মতো শোনায়। নাৎসি অত্যাচারে ওঁদের গ্রাম যখন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তখন যেভাবে ওঁরা ইয়োরোপ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন নিউইয়র্কে, সে এক পরম রোমহর্ষক কাহিনি। হান্নার জন্ম নিউইয়র্কে।

হান্নার এই আকস্মিক ধর্মভাবের জাগরণ আমার ভালো লাগছে না, যদিও আমি বুঝি ‘ব্যাকল্যাশ’ বলে একটা ব্যাপার আছে।

তবে আমার মনে হয় হান্নার এই ধর্মভাবের পিছনে আছে ওর মানবী বিদ্যাচর্চা। এটা ওদের নারীবাদের, পুরুষের সমান অধিকার দাবি করারই একটা দিক।

আমাদের দেশেও তো একই ব্যাপার। ব্রাহ্মণত্বের দাবি তো কেবল পুরুষের পক্ষেই সম্ভব। গায়ত্রীমন্ত্র উচ্চারণের অধিকার পেতে হলে উপনয়ন হওয়া চাই, এবং উপনয়নে কোনও নারীর অধিকার নেই। ‘বার মিৎসভা’ উপনয়নের মতোই—সে-ও দ্বিতীয় জন্ম। উপনয়নের অধিকার নারীর নেই, কেন না নারী অশুচি। নারী রজস্বলা হয়। আমাদের দেশেও নারীকে অনেক মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। নারায়ণ পুজোর অধিকার দেওয়া হয় না। কেন না সে রজোমতী হয়। সে অশুচি। জগতের সবচেয়ে প্রাচীন দুটি সনাতন ধর্মে—নারীর অধিকার নেই ধর্মের পবিত্রতম, উচ্চতম মার্গে বিচারণের। সে শুধুই পুরুষের। কেন? যেহেতু পুরুষের রজপাত হয় না, তাই সে পবিত্র। নারী অপবিত্র, কেন না তার জননী হবার শক্তি আছে। কুমারীকে দেবী সাজিয়ে পুজো করা যায়, সে তো অসম্পূর্ণা নারী। তাই সে ভয় দেখায় না পুরুষ জাতিকে। পুরষের সেখানে স্বস্তি। কিন্তু যে নারী রজস্বলা হয়? সেই নারীর সৃষ্টিশক্তিকে পুরুষ ভয় পায়, সেই নারী ঈশ্বরীর সমগোত্রা, নতুন মানুষের জন্ম দিতে পারে সে। পুরুষ তাই তাকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছে যাবতীয় সামাজিক ক্ষমতার জায়গা থেকে। স্বয়ং প্রকৃতি যে-ক্ষমতা তাকে দিয়েছেন তাতেই যে সে পরমা। ইহুদি মেয়েরা যদি নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই নিয়মের বিরোধিতা করে, তারা যদি ধর্মেও পুরুষের সমান আচরণের অধিকার চায়, তাতে আধুনিক মানুষের তো অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা তো যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ।

ইন্দ্র বলল, ‘এবারে তবে আমাদের দেশের বামুন ঘরের মেয়েরাও পৈতে নিতে চাইবে, তারাই বা কেন অত কলম আর পাব্বুনী পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে? মেয়েরাই তারপর এবাড়ি-ওবাড়ি পুজো করে দিয়ে কলাটা মুলোটা উপার্জন করবে। আহা, কত সুবিধে হয়ে যাবে! সত্যনারায়ণের জন্যে পুরুত ধরতে যেতে হবে না। সম্বৎসরের যাবতীয় পুজো-আচ্চা মেয়ে বামনিদের ধরে এনেই করে নিতে পারবেন ঘরে ঘরে মা-মাসির দল। আর মেয়ে পুরুতেরা পুরুষ পুরুতদের চেয়ে সম্মানে আরেকটু উঁচুই হবেন, আচার্যানী হবেন। কেন না, আপনা-আপনি পাওয়া ক্ষমতার চেয়ে অর্জন-করে নেওয়া ক্ষমতা সব সময়ে বেশি জোরালো হয়—’

ইন্দ্রকে থামিয়ে দিতে আমি বলি, ‘কিন্তু আমার তো উলটোটাই মনে হয়। হিন্দু মেয়েরা কখনওই পৈতে পরতে চাইবে না। পুরুষের সমান অধিকার চাওয়া মানে এই নয় যে, শ্রাদ্ধে বসলে ছেলেদের যেমন মাথা কামাতে হয়, আমরা মেয়েরাও তেমনি মাথা ন্যাড়া করতে চাইব—না মশাই, ওরকম নয়। নিজেরা পৈতে না নিয়ে মেয়েরা বরং চেষ্টা করবে পুরুষের পৈতে নেওয়াটা বন্ধ করতে। এই পৈতের মধ্যে যে অনৈক্য লুকিয়ে রয়েছে, সেটা নারী-পুরুষের মধ্যেই সীমিত নয়—সেটা তো সব মানুষের মধ্যে অসাম্য সৃষ্টি করে। কিছু মানুষ হঠাৎ অধিকাংশ মানুষের চেয়ে উচ্চশ্রেণির হয়ে যাবে দুটো মন্ত্র পড়ে, এটা কোনও সমাজেই চলতে পারে না। মন্ত্রের গুণে তারা নিজেদের অন্যদের চেয়ে উন্নততর, পবিত্রতর মনে করতে শুরু করবে, সেটা তো ঠিক নয়? পৈতে পরলেই তো ব্রাহ্মণ হয় না। আমরা বলব না ”আমরাও পৈতে পরব”, আমরা বলব ”কেউই পৈতে পরবে না—বর্ণভেদ আমরা মানব না—সব মানুষ সমান”।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *