ইন্দ্রজিৎ
গল্পে কিছু বিশেষ প্রাচীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো পাঠকদের বোঝার সুবিধার জন্য শুরুতেই দিয়ে রাখছি।
* যবন— গ্রিক।
* অলকশেন্দ্র/সিকন্দর— মহান আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।
* গান্ধার— বর্তমানে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের একাংশ।
* পৌরব রাজ্য— বর্তমান পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের একাংশ।
* শতরপ— গভর্নর।
* হাইডাসপেস— ঝিলম নদীর গ্রিক নাম।
* আকাইমেনিদ— পারস্য সাম্রাজ্যর গ্রিক নাম।
পূর্বকথন:
—আপনি আমায় বিদেশি যবনদের সেনায় যোগ দিতে বলছেন, গুরুদেব?
—হুম।
—কিন্তু, কেন? তারা কি আমাদের শত্রু নয়? অলকশেন্দ্র কি এই দেশের শত্রু নয়? —অবশ্যই শত্রু।
—তবে? তবে কেন আমাকে তারই সৈন্যদলে যোগ দিতে বলছেন?
—কারণ, যবনদের থেকে তোমার শেখার অনেক কিছু আছে, বৎস। যে ব্যক্তি প্রায় অর্ধেক পৃথিবীকে পর্যুদস্ত করেছে, তার থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু থাকতে বাধ্য। যবনদের অস্ত্র, শস্ত্র, যুদ্ধকৌশল, রণনীতি সব পর্যবেক্ষণ করবে। তারা শস্ত্রযুদ্ধ, অসিচালনা এবং মল্লযুদ্ধে সুপটু। তুমি তাদের এই যুদ্ধকলা রপ্ত করবে। যতটা সম্ভব অলকশেন্দ্রর চালচলন, বাচনভঙ্গি সব লক্ষ করবে।
—বেশ। তাই হবে। কিন্তু, অলকশেন্দ্রর থেকে আমি কী শিখব? সে তো নিজে আমাদের মতো বিদেশি সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেবে না।
—না। তুমি তার থেকে শিখবে রাজগুণ। অলকশেন্দ্রকে তার যবন সৈনিকরা দেবতা-পুত্র মনে করে। সে একজন দুর্দান্ত সেনানায়ক এবং সুবক্তা। জনশ্রুতি আছে যে, তার বক্তৃতা শুনে হতোদ্যম, মৃতপ্রায় সৈনিকদের মধ্যেও শক্তি সঞ্চারিত হয়। তার প্রতিটা শব্দে উৎসাহিত হয়ে সৈনিকরা ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে। তোমায় এই বাচনভঙ্গি রপ্ত করতেই হবে।
—বেশ।
—যবনরা ভারতীয় যোদ্ধাদের নিজেদের সৈন্যদলে নিচ্ছে। পরাজিত বা আত্মসমর্পণ করা রাজার সৈনিকদেরও সে নিজের সেনায় যুক্ত করে নেয়। আবার অনেক ভারতীয় যুবক অর্থাভাবে তার সেনায় যোগ দিয়েছে। এরাও কয়েক মাসের মধ্যেই যবনদের দ্বারা প্রশিক্ষিত হয়ে সুদক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠবে। কিন্তু, হৃদয় থেকে তারা কোনোদিনই বিদেশিদের নিজের রাজা হিসেবে মানবে না। তোমার কাজ সেইসব ভারতীয় সৈনিকদের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করা। তাদের নায়ক হয়ে ওঠা। মনে রেখো, একজন যোদ্ধা সর্বদাই তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাকে সম্মান করে। তোমার লক্ষ্য হবে এই ভারতীয় সৈনিকদের হৃদয় জয় করে নেওয়া। তোমায় যেন তারা নিজেদের অধিনায়ক হিসেবে দেখে। উচিত সময়ে এরাই হবে তোমার সেনাবাহিনী।
—কিন্তু… কিন্তু আমাদের লক্ষ্য তো মগধ? এতে কি আমরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হব না?
—না। কারণ, নিকট ভবিষ্যতে এই সৈনিকরাই আমাদের সেনা হবে। এরা তোমায় নিজেদের অধিনায়ক হিসেবে স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করবে। এরাই হবে তোমার বিশ্বস্ত সৈনিক। যবনদের প্রশিক্ষিত যোদ্ধারা ভবিষ্যতে আমাদের সাহায্য করবে মগধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করতে। যাও, বৎস। যাও। এটাও তোমার পরীক্ষা।
—আজ্ঞা দিন, গুরুদেব।
—বিজয়ী ভবঃ।
১.
সময়- প্রায় ২৩০০ বছর পূর্বে।
স্থান- গান্ধারের রাজধানী তক্ষশিলা।
গান্ধার-রাজ অম্বিকের রাজমহলে বিশ্রাম নিচ্ছেন সম্রাট অলকশেন্দ্র। পৌরব রাজ্য তিনি জয় করেছেন। এই ভারতবর্ষে তাঁর জয়যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে। তবে, পৌরব জয় সহজে আসেনি। তাঁর অনেক সৈনিকের প্রাণ গিয়েছে যুদ্ধে।
পৌরবরাজ পুরু একজন প্রাকৃত বীর এবং কুশল সেনানায়ক। তাই তো চল্লিশ হাজার পদসৈনিক এবং পাঁচ হাজার ঘোড়সওয়ার বিশিষ্ট বিশাল সেনাবাহিনী থাকা সত্ত্বেও, পৌরবদের অল্প সৈন্যবলের কাছেও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যবনদের।
অলকশেন্দ্র বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, এই পুরু নামের রাজাটিকে শত্রুর চেয়ে মিত্ররূপে পেলে তাঁর বেশি লাভ। কিন্তু, এই মৈত্বী প্বস্তাব দিতে হবে নিজের ক্ষমতার জায়গা থেকে। যেন পুরু নিজেকে ধন্য মনে করেন স্বয়ং অলকশেন্দ্রর দয়া পেয়ে।
তাই পুরুকে যখন বন্দি করে তাঁর সামনে উপস্থিত করা হল, অলকশেন্দ্ব তাঁকে প্রশ্ন করেন, —তুমি আমার থেকে কী ব্যবহার আশা কর, হে পোরাস?
একজন রাজা, অন্য এক রাজার থেকে যা ব্যবহার আশা করে, তাই। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে হেসেছিলেন অলকশেন্দ্র। তিনি অনুমান করেইছিলেন যে, এই ভারতীয় এইরকমই কিছু একটা উত্তর দেবে। এদের চামড়া চলে গেলেও, মর্যাদা যায় না। আর, এই ভারতীয়র আত্মাভিমানকেই নিজের কার্যসিদ্ধির জন্যে ব্যবহার করতে হবে তাঁকে।
অলকশেন্দ্র তাঁর সৈনিকদের আদেশ দিয়েছিলেন,
—এই মুহূর্তে শৃঙ্খলমুক্ত করো পুরুরাজকে। হে পোরাস, তুমি বীর। আমি দেবতা জিউসপুত্র আলেকজান্ডার তোমাকে নিজের মিত্ররূপে পেতে আগ্রহী। তুমি চাইলে তোমার রাজ্য তোমায় এই মুহূর্তে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তুমি আজ থেকে আমার মিত্র হলে!
দোভাষী তাঁর প্রস্তাব পুরুকে বুঝিয়ে দিতেই, পুরুর মুখে যে বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠেছিল, সেকথা স্মরণে আসতেই অলকশেন্দ্র একবার মৃদু হেসে উঠলেন। প্রথমে ভারতীয়টা বিশ্বাসই করতে পারেনি, সে যা শুনছে সেটা সত্যি না ভুল ব্যাখ্যা করেছে দোভাষী। অলকশেন্দ্রর প্রত্যাশামতোই, পুরু বিগলিত হয়ে অলকশেন্দ্রর সঙ্গে মৈত্রী করে, তাঁর ভারত জয় অভিযানে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে।
এই নিয়ে দু-জন হল। মনে মনে ভাবলেন অলকশেন্দ্র। গান্ধারের রাজা অম্বিক তো পূর্বেই বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেছে। শুধু যে নিজের সৈন্য আর দুর্গ তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে তা-ই নয়, এমনকী নিজের অন্তঃপুরের নারীদেরও অলকশেন্দ্রর হাতে তুলে দিতে চেয়েছে।
তার কথা মনে আসতেই মুখে বিরক্তি প্রকাশ পেল মহান অলকশেন্দ্রর। ভীরুতা এবং দুর্বলতা অলকশেন্দ্রর কাছে অসহনীয়। যে লোক তার দেশের এবং অন্তঃপুরের দ্বার বিদেশির জন্যে খুলে দেয়, তাকে অন্তত আর যাই হোক সম্মান করা চলে না। এই অম্বিককে মনে মনে অত্যন্ত অপছন্দ করেন সম্রাট। কিন্তু, মুখে মধুর বাণী বলেন। কারণ, গান্ধারকে তাঁর প্রয়োজন। এটাই ভারতবর্ষের প্রবেশপথ।
অলকশেন্দ্র গত কয়েক দিন যাবৎ নারীতে রুচি হারিয়েছেন। স্বাদবদল করতে, হাইডাসপেসের যুদ্ধ থেকে ফেরার পর থেকেই সদ্য কিশোর গ্রিক নাবালকদের সাহচর্যে আছেন। এই মুহূর্তেও তাঁর গা এলিয়ে তিনজন নগ্ন গ্রিক কিশোর বসে আছে। আমোদ করে সুরাপান করছে। নেশাতুর চোখে তাদের দিকে চেয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করছেন অলকশেন্দ্র।
কক্ষে তাঁর মিত্র ও সেনাপতি সেলুকাস নিকেটর প্রবেশ করলেন।
—দেবতা-পুত্র সম্রাটের জয় হোক।
—আহ্! প্রিয় সেলুকাস! এসো। তোমায় ক্লান্ত লাগছে। এই নাও, এই পানীয় গ্রহণ করো, বন্ধু।
পানীয়ে চুমুক দিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেলেন সেলুকাস, তখন অলকশেন্দ্র কাজের কথা পাড়লেন, —যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি হিসেব করলে?
—হ্যাঁ, সম্রাট। ক্ষতি হয়েছে। অনেক সৈনিক আমরা হারিয়েছি। তবে, পুরুর সৈনিকরা আমাদের যোগ দিলে সেই ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।
—উত্তম। সে তো নিজের ইচ্ছায় এবার আমাদের সাহায্য করবে। সে ভাবছে তাকে তার রাজ্য ফেরত দিয়ে আমরা তাকে বিশাল সম্মান দিয়েছি। কিন্তু বাস্তবে, আমাদের কাছে আর উপায় নেই।
—হ্যাঁ, সম্রাট। এই দেশ বিশাল। এবং, বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি রাজাকে পরাজিত করে এক-একটি রাজ্য যদি আমরা দখলে রাখার জন্যে নিজেদের সেনা ছেড়ে যেতে থাকি, তবে আমাদের সেনা সংখ্যা কমে যাবে। তা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
—ঠিক তাই। মনে রেখো এই দেশের সবচেয়ে বড়ো সাম্রাজ্য, মগধের সঙ্গে যুদ্ধ এখনও বাকি। আর তাতে আমাদের সম্পূর্ণ সৈন্যবলের প্রয়োজন পড়বে। ছোটো ছোটো রাজ্য দখলে রাখতে গিয়ে নিজেদের সৈনিক সংখ্যা হ্রাস করাটা মূর্খামি। তার চেয়ে বরং আমাদের অধীনে, ভারতীয় রাজারা শতরপ হিসেবে শাসন করুক। আমাদের তাতেই লাভ।
—যথার্থ বলেছেন, হে মহান।
অলকশেন্দ্র কিছুক্ষণ সেলুকাসের দিকে চেয়ে থাকলেন। তারপর ইশারা করে কক্ষে উপস্থিত কিশোরদের এবং প্রহরীদের কক্ষ ত্যাগ করতে নির্দেশ দিলেন।
অন্য সবাই কক্ষ ত্যাগ করলে অলকশেন্দ্র সেলুকাস নিকেটরকে প্রশ্ন করলেন,
—হে সেলুকাস। তোমার মুখে হাসি নেই কেন? আমাদের ভারত জয় শুরু হয়ে গিয়েছে, অথচ তোমার মুখে আশঙ্কার ছায়া কেন?
—ক্ষমা করবেন, সম্রাট। তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। আমি অযথাই আশঙ্কা করি, তা তো আপনি জানেনই।
সম্রাট আরও একচুমুক পানীয় গলাধঃকরণ করে বললেন,
—তোমার আশঙ্কা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অযথা হয় না, সেলুকাস। বলো আমায়, কী তোমার দুশ্চিন্তার কারণ?
খানিক ইতস্তত করে সেলুকাস বললেন,
—ভবিষ্যদ্বক্তারা ভেড়া উৎসর্গ করেছে জিউসের নামে। সেই মৃত ভেড়ার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অধ্যয়ন করে তাঁরা তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
মুখ গম্ভীর হল অলকশেন্দ্রর। ভবিষ্যদ্বাণী, মন্ত্র-তন্ত্রাদির প্রতি তাঁর গভীর বিশ্বাস। শুধু যে তাঁর সৈনিকরাই তাঁকে দেবতা-পুত্র মনে করে তা নয়, অলকশেন্দ্ব নিজেও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, তিনি স্বয়ং দেবেন্দ্র জিউসের পুত্র। ঈশ্বর তাঁকে সংকেত দেন প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বে। তাই তিনি দেবতাদের থেকে আসা সংকেত উপেক্ষা করতে পারেন না।
—কী বলছেন তাঁরা?
উত্তর দিতে সেলুকাস দ্বিধা করছে দেখে আবার প্রশ্ন করলেন অলকশেন্দ্র।
—বলো, সেলুকাস। কী বলছেন তাঁরা?
—সম্রাট। তাঁরা বলেছেন যে, ভারতজয় আলেকজান্ডার করতে পারবে না। এখানেই তার দিগবিজয়ের রথ থেমে যাবে!
অলকশেন্দ্রর মনে হল তাঁর বুকে কেউ বিশাল একটি পাষাণ নিক্ষেপ করেছে। এ কী শুনলেন তিনি?
অলকশেন্দ্ব ছোটো থেকেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, এই গোটা পৃথিবী জয় করাটা তাঁর অধিকার। এটাই তাঁর জন্মের হেতু। দেবতারা কি এতদিন সেই ইঙ্গিতই দেননি তাঁকে? তবে, আজ কেন তাঁরা কুপিত হলেন তাঁর প্রতি?
কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল প্রায় অর্ধেক পৃথিবীর অধীশ্বর সিকন্দর মহানের। তাঁকে চিন্তিত হতে দেখে সেলুকাস বলে উঠলেন,
—আপনি চিন্তিত হবেন না, সম্রাট। আমি নিশ্চিত যে ওরাকেল1-দের কিছু ভুল হয়েছে। আমরা আবার মেষ উৎসর্গ করব। অশুভ কোনো বাধা থাকলে আমরা নিঃসন্দেহেই তা কাটিয়ে উঠব।
তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধুর কথায় হাসলেন অলকশেন্দ্র। তবুও তাঁর মন থেকে চিন্তাটা গেল না।
২.
যবন সেনাশিবিরে ভারতীয় সৈনিকদের আলাদা ছাউনি। গভীর রাতে সমস্ত সৈনিক নিদ্রায় মগ্ন। শুধু একজন বাদে।
যুবক উঠে বসল। নিজের জায়গায় বসে একবার আশেপাশে দেখে নিল। বহুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখায় এখন অন্ধকারে দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না বিশেষ। কেউ জেগে নেই নিশ্চিত হয়ে, সে উঠে দাঁড়াল। একটি বস্ত্রখণ্ড দিয়ে নিজের শরীর এবং মাথা ঢেকে নিল। মাথার কাপড় চোখের সামনে অনেকটা টেনে মুখ ঢেকে নিল।
প্রেতমূর্তির মতো নিঃশব্দে ছাউনি থেকে বেরিয়ে পড়ল। আরও একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে, শিবিরের উত্তরপ্রান্তের দিকে হাঁটা দিল।
বহুদিন ধরে নজর রেখে সে জেনেছে যে, রাত্রির এই শেষ প্রহরের শুরুর সময়টা ওদিকে প্রহরা থাকে না। উত্তরপ্রান্তে তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীর থাকায় ওদিকে এমনিতেই প্রহরা কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে শত্রু আক্রমণের সম্ভাবনা নেই। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশাল, প্রায় দুর্গের মতোই সুরক্ষিত এবং বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।
এই পথ তার চেনা, তাই চাঁদের হালকা জোছনায় পথ চিনে হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে না। তক্ষশিলার প্রাচীর দেখা যাচ্ছে এখন। প্রাচীরের সম্মুখে এসে কিছুক্ষণ থামল যুবক এবং প্রাচীর বরাবর ডান দিকে হাঁটতে শুরু করল। কিছুক্ষণ হাঁটতেই একটি বিশাল বটবৃক্ষের সম্মুখে উপস্থিত হল। তাতে চড়তে শুরু করল যুবক। বৃক্ষটি একেবারেই প্রাচীরের গা ঘেঁষে আছে বলে সহজেই বৃক্ষের ওপরের ডাল থেকে প্রাচীরের ওপর পা রাখা যায়। প্রাচীরে চড়ে ওপর দিয়ে সাবধানে হাঁটতে শুরু করল।
প্রাচীরের ভিতরদিকে, একইভাবে আরও একটি বৃক্ষ আছে কিছুটা দূরেই।
দ্বিতীয় বৃক্ষের অন্তরালে আরও একজন অপেক্ষা করছে তার জন্য। এই দু- জনই তক্ষশিলার ছাত্র ছিল, তাই এই বিশেষ অংশের দুটি বৃক্ষ তাদের অতি পরিচিত। এই ভিতরের বৃক্ষে চড়ে, প্রাচীর দিয়ে কিছুটা হেঁটে আবার বাইরের দিকের বৃক্ষ বেয়ে নেমে তারা এবং তাদের অন্যান্য গুরুভ্রাতারা বহুবার গোপনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে পড়ত বিকেলে। সেইসময় তারা ভাবত আচার্যরা এ পথের কথা জানেন না। কিন্তু, তা সত্যি নয়। আচার্যরা জেনে-শুনেই এইটুকু স্বাধীনতা তাদের দিয়েছিলেন।
ওপারের বৃক্ষের কাছে পৌঁছোতেই আড়াল থেকে দ্বিতীয় যুবক বেরিয়ে এল।
—ভ্রাতা।
—ভ্রাতা শশাঙ্ক। এনেছ?
—হ্যাঁ।
নিজের কাপড়ের ঝোলা থেকে পাটের একটি গোলাকার বাক্স বের করে আনল শশাঙ্ক। বলল,
—সাবধানে চ… শশিবর্মা।
—হ্যাঁ, জানি।
শশিবর্মা বাক্সটি হাতে নিতেই টের পেল সেটির ভেতরে জ্যান্ত কিছু একটা নড়ে উঠল।
শশাঙ্ক বলল,
—এ কাজ বড়ো ঝুঁকিপূর্ণ। ধরা পড়লে তোমায় প্রাণে মারবে যবনরা।
মৃদু হেসে শশি উত্তর দিল,
—তা বটে।
—কিন্তু, এই প্রচেষ্টা যে ফলপ্রসূ হবেই তার নিশ্চয়তা কোথায়?
—বিফল হলেও লাভ হবে মিত্র। দুইক্ষেত্রেই আমাদের পক্ষে পরিকল্পনা লাভজনক। অস্ত্র বিফল গেলেও তা ভীতি সৃষ্টি করবে। আর এই ‘ভয়’ বস্তুটি বড়োই সংক্রামক। শশাঙ্ক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,
—গুরুদেব কেন যে তোমায় এই কাজের দায়িত্ব দিলেন, তা আমি এখনও বুঝতে অক্ষম। আগামীর যুদ্ধে তুমিই আমাদের নেতৃত্ব দিতে চলেছ। এহেন অবস্থায় তোমার স্কন্ধেই এই ভার দেওয়াটা কি উচিত হল?
—নাহ্, মিত্র। তিনি ঠিকই করেছেন। গত কয়েক মাসে প্রচুর শিখেছি এদের থেকে। কঠিন প্রশিক্ষণ পদ্ধতি এদের। কিন্তু, তা আয়ত্ত করতে পারলে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শশাঙ্ক বলল,
—শুনলাম তুমি তা আয়ত্ত করে ফেলেছ ইতিমধ্যে। স্বাভাবিক। আমি আজকাল আর অবাক হই না। যুদ্ধ কৌশলে যে পারদর্শিতার পরিচয় তুমি দিয়েছ, তাতে মনে হয় যেকোনো রণকৌশলই তোমার পক্ষে শেখা সহজ। তাই নয় কি?
উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসল যুবক। শশাঙ্ক আবার বলল,
—এইবার তবে সেনাশিবির ত্যাগ করো। অকারণ সেখানে থেকে আর লাভ কী? তুমি একা এত বড়ো সেনাকে কীভাবে ঠেকাবে সেটাও আমি বুঝতে অক্ষম।
—ইন্দ্রকে পরাজিত করতে মেঘের আড়ালে থাকতেই হয়, বন্ধু। সম্মুখসমর করে অলকশেন্দ্রকে পরাজিত করা অসম্ভব। আমার সেনাশিবির ত্যাগ করার সময় আসেনি এখনও। এবং, আমি একা যবন শিবির ত্যাগ করব না।
—অর্থাৎ?
উত্তর না দিয়ে আবার রহস্যময় হাসি হাসল যুবক। বলল,
—প্রহরী ফেরার সময় হল। আমি চললাম।
—বেশ। কিন্তু, আবার বলছি, সাবধানে।
বিদায় জানিয়ে দু-জন দু-দিকের গাছ বেয়ে নেমে পড়ল।
কাপড়ের নীচে পেটিটি লুকিয়ে হাঁটছে শশিবর্মা। সেনাশিবিরের দিকে ফেরার পথ ধরল। সামান্য ভারী পেটিটা। মাঝে মাঝেই মৃদু হিসহিসানি শোনা যাচ্ছে সেটা থেকে। এবার সমস্যা হল সম্রাটের ছাউনি অবধি পৌঁছোনো। কারণ, তাঁর তাঁবু ঘিরে রাখে যবন সৈনিকরা। এদেশি সৈনিকদের কাছে ঘেঁষতে দেয় না।
একটা উপায় আছে। তার আর এক গুরুভ্রাতা অক্ষয় তাকে একটি বিশেষ গাছের মূল দিয়েছিল। এই মূল অগ্নির সহযোগে জ্বালিয়ে দিলে এর থেকে যে ধোঁয়া উদগত হয়, তা নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে নিলে, কিছুক্ষণের জন্যে তা আশেপাশের মানুষকে আচ্ছন্ন করে দিতে পারে। অর্থাৎ, গভীর নিদ্রায় ডুবে যাবে লোকজন। সেই মূল ব্যবহার করে যদি কিছু সৈনিককে নিদ্রামগ্ন করে দেওয়া যায়, তবে সেই সুযোগে তাঁবুর কাছে পৌঁছোনোটা খুব কঠিন হবে না মনে হয়। মাত্র কয়েক মুহূর্ত তো দরকার তার কাজটা সারতে। একটা তাঁবুর ফাঁক পেলেই…।
পরিকল্পনার কথা ভাবতে ভাবতে ঠোঁটে হাসি ফুটল যুবকের।
৩.
সেনাছাউনিতে সম্রাট অলকশেন্দ্রর তাঁবুটা বিশাল। যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা আছে। ভিতরে ঢুকলে বলে না দিলে বোঝাই যায় না যে, এটা একটা তাঁবু, কোনো রাজমহলের ঘর নয়। সম্রাট নিজেও মহলের চেয়ে বেশি সেখানেই থাকতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কারণ, তিনি জানেন যে, সেনাদের মধ্যে তাদের সম্রাট থাকলে, সেনাদের মনোবল বাড়ে। তাই অম্বিকের মহল ছেড়ে তিনি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সেনাছাউনিতেই আছেন।
অলকশেন্দ্রর কক্ষে ঢুকতেই জিনিসটা চোখে পড়ল সেলুকাসের। কুচকুচে কালো, আঁশদার শরীর। প্রায় দু-হাত লম্বা, বিশ্রী দেখতে প্রাণীটার প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে একপাশে। পাশেই পড়ে আছে সাপটার কাটা মাথাটা। রক্ত জমে আছে মেঝেতে। দেখেই গা ঘিনঘিন করে উঠল সেলুকাসের।
সম্রাট অলকশেন্দ্র বসে আছেন একটি কাঠের গদিযুক্ত আসনে। এক ভৃত্য তাঁর মাথা টিপে দিচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, একটু আগেই তাঁর স্নায়ুতে চাপ পড়েছে। তাঁকে দেখে সেলুকাসের ভালো লাগল না। পাশেই রাজা অম্বিক দাঁড়িয়ে।
—সম্রাট। আপনি ঠিক আছেন তো?
সেলুকাসের উদ্গ্রীব প্রশ্নে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ জানালেন অলকশেন্দ্র।
আরও একবার সাপটার দিকে দেখে সেলুকাস অম্বিকের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, এটা এখানে ঢুকল কীভাবে?
এই প্রশ্নে মনে মনে বিরক্ত হলেন রাজা অম্বিক। সেলুকাস এমন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করছেন যেন এটা অম্বিকের দোষ যে, তাঁবুতে সাপ ঢুকেছে। তবুও মনের ভাব মুখে প্রকাশ না করে অম্বিক বললেন,
—গরমে তাঁবুর জানলা খোলা রেখে শুয়ে ছিলেন সম্রাট। সেখান দিয়েই ঢুকেছে নিশ্চয়ই।
—এটি কী জাতের সাপ? বিষাক্ত?
উত্তরটা জানা থাকলেও অম্বিক বলতে চাইলেন না। কে বলতে পারে, এই মূর্খ যবনরা হয়তো তাঁকেই দোষী বলবে। তাই অম্বিক উত্তর দিলেন,
—আমার সঠিক জানা নেই…
যবনরা সাপ চেনে না। তাই সেলুকাস বললেন,
—সাপের জাত চেনে এমন কোনো ভারতীয়কে ডাকা হোক।
উত্তর স্বয়ং অলকশেন্দ্র দিলেন,
—প্রয়োজন নেই। তোমাদের আসার পূর্বেই আমি একজন ভারতীয় সৈনিককে ডেকে এই সাপ দেখিয়েছি।
প্রমাদ গনলেন অম্বিক। অলকশেন্দ্র উত্তর দিলেন,
—এটিকে কেউটে বলে এখানকার মানুষে। প্রবল বিষধর নাগ এটি। আরও বলল সে। এই নাগ নাকি এদেশে খুব একটা দেখা যায় না। উত্তর ও পূর্ব ভারতের দিকে বেশি পাওয়া যায়।
অম্বিক মনে মনে ঠিক করে রাখলেন যে, তিনি খোঁজ নেবেন যে কোন সৈনিক এই তথ্যগুলো অলকশেন্দ্রকে দিয়েছেন। সেই বাচালটি গান্ধারের সৈনিক হলে তাকে চাবকে শূলে চড়াবেন তিনি।
সেলুকাস প্রশ্ন করলেন,
—তাহলে এই নাগ এখানে এল কীভাবে?
উত্তরে অম্বিক বললেন,
—এখানে কম দেখা যায় বলে যে একেবারেই নেই তা তো নয়, সেলুকাস। তক্ষশিলার অরণ্য বেশিদূর নয় এখান থেকে। সেখান থেকে কোনোভাবে এসে পড়েছে।
উত্তর মনঃপূত হল না সেলুকাসের। তিনি সম্রাট অলকশেন্দ্রর দিকে চাইলেন তাঁর নির্দেশের আশায়।
অলকশেন্দ্র চোখ বুজে বসে আছেন এখনও। একটু আগে তিনি বাস্তবিকই ভয় পেয়েছেন। ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি নিজের পালঙ্কে। তাঁর নিদ্রা বরাবরই পাতলা, আর সেটাই পূর্বেও বহুবার তাঁর প্রাণ রক্ষা করেছে। এইবারও নিজের শরীরের ওপর কিছু একটার মৃদু চলাচলের অনুভূতি পেয়েই চোখ খোলেন অলকশেন্দ্র। আর তখনই, আলো-আঁধারিতেই চোখে পড়ে এই ভয়ংকর কালনাগটি। আর একটু হলেই তাঁকে দংশন করত।
মুহূর্তে চিৎকার করে ওঠেন অলকশেন্দ্র। নাগটিকে একঝটকায় মাটিতে ফেলেন। তাঁর চিৎকারে বাইরে প্রহরারত দুই প্রহরী আলো হাতে আসে। তাদেরই একজনের তরবারির কোপে মুণ্ডু আলাদা হয় নাগটির। মুণ্ডু কাটা অবস্থাতেও বেশ কিছুক্ষণ কিলবিল করে নড়াচড়া করছিল সেটা। সেটা ভাবলে এখনও ঘাড়ের কাছের চুল দাঁড়িয়ে যাচ্ছে অলকশেন্দ্রর।
এত কুৎসিত জিনিস ঈশ্বর কেন বানায়? সব কিছু কেন গ্রিক পুরুষদের মতো সুন্দর হয় না এই পৃথিবীতে? কীসের অশুভ ইঙ্গিত আজকের এই ঘটনা?
এইসব ভাবনার মধ্যেই তিনি সেলুকাস আর অম্বিকের কথা শুনছিলেন। শেষে অলকশেন্দ্র বললেন,
—এখনই এই নিয়ে অধিক চিন্তা করার কিছু নেই। নিছক দুর্ঘটনা হয়ে থাকতেই পারে। বরং, এই কথাটা যেন খেয়াল থাকে যে, এই ঘটনা যেন পাঁচকান না হয়। আমাদের গ্রিক সৈনিকরা এমনিতেই ভারতের সম্বন্ধে প্রচুর অলৌকিক কাহিনি শুনে শুনে শঙ্কিত। এরপর এই কাহিনি শুনলে তাদের মনে আরও বেশি অকারণ ভয় ঢুকবে। তাই এই কথা যেন আমরা তিনজন বাদে আর কেউ জানতে না পারে।
সেলুকাস প্রশ্ন করলেন,
—আপনার দুই দেহরক্ষী বিশ্বস্ত। তারা মুখ খুলবে না। কিন্তু, যে ভারতীয় সৈনিক আপনাকে এই নাগের বিষয়ে বলেছিল? সে?
অলকশেন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গিয়ে কক্ষের একধারের মখমলের পর্দা সরিয়ে দিলেন।
এতক্ষণ পর্দার আড়ালে থাকা ভারতীয় সৈনিকের মৃতদেহটা চোখে পড়ল। বুকে তরবারি বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে।
অম্বিকের বুক কেঁপে উঠল। অলকশেন্দ্র শুধুমাত্র তাঁর ভয় পাওয়ার তথ্য চাপা দিতে একজনকে অনায়াসে হত্যা করেছেন! এ দেবতাপুত্র? না, শয়তানপুত্র?
আচার্য শঙ্কুমণির পরামর্শে তিনি এই যবনদের সঙ্গে মৈত্রী করেছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি নিজে সর্বদা ভীত থাকেন সম্রাটের আশেপাশে। কিন্তু, তাঁর আচার্যর পরামর্শমতো তাঁকে সর্বদা নিকটে থাকতে হয় অলকশেন্দ্রর, বিশ্বস্ত পাত্র হয়ে ওঠার তাগিদ। যাতে ভারতজয়ের পর দেশের শাসনভার সম্রাট অম্বিকের হাতে তুলে দিয়ে যান। এই আশাতেই আছেন অম্বিক তাই পুরুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়াতে কিছুটা ক্ষুণ্নই হয়েছেন তিনি।
অম্বিক দেখলেন যবন ভৃত্যটিও ভয় পেয়েছে। এবং, তার ভয় পাওয়া যুক্তিসংগত। কারণ, পরমুহূর্তে অলকশেন্দ্র ইঙ্গিতবাহী দৃষ্টিতে সেলুকাসের দিকে চাইলেন। এবং, সঙ্গেসঙ্গেই সেলুকাস তাঁর কোমর থেকে তরবারি বের করে সেটা ভৃত্যের গলায় চালিয়ে দিলেন।
8.
পাকশালের বাইরে দুটি সারি। একটি যবন সৈনিকদের, দ্বিতীয়টি ভারতীয় সৈনিকদের। রোজই এখানে অপেক্ষমাণ সৈনিকরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে।
কিন্তু, আজকে দুই শিবিরেরই আলোচ্য বিষয় একটিই। সম্রাট অলকশেন্দ্রর কক্ষে কালনাগের আক্রমণ। হ্যাঁ। প্রচেষ্টার ত্রুটি না রাখা সত্ত্বেও ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গিয়েছে। যবনরা এটাকে অশুভ ইঙ্গিত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অপরদিকে, ভারতীয়দের কাছে সংবাদটি অন্য অর্থ বহন করে এনেছে।
কয়েক জন ভারতীয় সৈনিকের বার্তালাপ অনেকটা এইপ্রকার,
—শুনলাম নাকি সম্রাট সিকন্দর ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন?
—হ্যাঁ। তিনি নাকি চিৎকার করে উঠেছিলেন রাতে সাপ দেখে। প্রহরী শুনেছে।
—আমি তো এও শুনেছি যে, উনি নাকি ভয় পেয়ে এখনও অসুস্থ।
—হে হে। এই নাকি যবনরা বলে তাঁদের রাজা, দেবতা! তিনি নাকি আমাদের দেবরাজ ইন্দ্রর মতো দেবতাসম রাজা।
—এইসব অধর্মের কথা বুঝলে তো? আরে বাবা, মানুষ কি আর দেবতা হয়?
—আরে ভাই, আমি তো এও শুনেছি যে, অলকশেন্দ্রকে নাকি আসলে ওই সর্প দংশনও করেছে। সেইজন্যে তিনি অসুস্থ। কিন্তু, কথাটা কাউকে জানানো হয়নি।
—সেকী! তবে কি সম্রাট মরে যাবেন নাকি?
—আরে, ধীরে বলো ভাই। ধীরে বলো। ওই দেখো, সামনেই যবনরা দাঁড়িয়ে। তারা আমাদের কথা শুনতে পেলেই আমাদের মুণ্ডচ্ছেদ করবে।
এমন সময়ে, সারির প্রথম থেকে কোলাহলের শব্দ শোনা গেল।
—আরে, কী হল ভাই? কীসের ঝামেলা?
—আরে, বলছে আমাদের খাদ্য শেষ।
—সেকী! এখনও তো জনা পঞ্চাশ সৈনিক বাকি। আমরা যে অভুক্ত!
কথাটা সত্যি। পঙ্ক্তিতে এখনও পঞ্চাশজন মতো অপেক্ষায় আছে থালা হাতে। প্রত্যেকেই ক্ষুধার্ত।
কোলাহল ক্রমেই বাড়তে লেগেছে।
এদিকে ভারতীয় পাচক বাইরে এসে জানাল,
—তোমরা সবাই অপেক্ষা করো। যবনদের জানানো হয়েছে। তারা শীঘ্রই ব্যবস্থা করবে। আসলে, আজ সকালে উঠে দেখি আমাদের বরাদ্দ আটার একটি বস্তায় কোনো এক দুষ্ট জল ঢেলে দিয়েছে।
এক সৈনিক উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল,
—এ নিশ্চয়ই ওই যবনদের কাজ। ওরা তো আমাদের সহ্যই করতে পারে না।
—তাই তো! ঠিক বলেছ। ওরা আমাদের জংলি, অসভ্য জাতি মনে করে।
পাচক ভয় পাচ্ছে। ব্যাপার ভালো দিকে যাচ্ছে না। পাশের সারিতে দাঁড়ানো যবনরাও বুঝতে পারছে তাদের দিকে ইঙ্গিত করেই কোলাহল করছে ভারতীয়গুলো।
এরই মধ্যে একজন মুখ ফুটে সেই কথাটা বলেই দিল যেটা সবারই মনে চলছিল, —ওদের খাদ্য তো আছে দেখছি। আমাদের তবে ওদের অংশ থেকে কেন ভাগ দেওয়া হচ্ছে না?
ব্যস! সঙ্গেসঙ্গেই প্রবল সমর্থন এল এই প্রস্তাবে ভারতীয় সেনাদের তরফ থেকে। যারা ইতিমধ্যে খাদ্য পেয়ে গিয়েছে তারাও ফিরে এসেছে কোলাহল শুনে। তারাও এই প্রস্তাবে সমর্থন জানাল।
দুইজন সৈনিক এগিয়ে গেল যবনদের পাকশালের দিকে। ভারতীয়রা কথা বলতে চাইছে বুঝতে পেরে একজন যবন দোভাষী এগিয়ে এল।
পরবর্তী কথোপকথন অনেকটা এইপ্রকার হল,
—আমাদের খাদ্য শেষ হয়ে গিয়েছে।
—তো?
—নতুন করে খাদ্য বানাতে সময় লাগবে।
—তাতে আমরা কী করব?
—তোমাদের কাছে তো অনেক খাদ্য আছে। তার অংশ আমাদের দাও।
—কী বললে? আরও একবার বলো?
—ঠিকই বলছি আমরা। তোমাদের ভাগের খাদ্য আমাদের সঙ্গে ভাগ করো।
—ওরে জংলি! তোদের এত সাহস? তোরা আমাদের খাদ্যের ভাগ চাস?
—কেন নয়? তোমরাও সম্রাট সিকন্দরের সৈনিক, আমরাও তাই। তবে কেন এই উঁচু-নীচু ভেদ ভাব?
—চুপ কর! নীচ! আমরা যবন! দেখ, আমাদের শরীর আর তোদের শরীর! আমাদের শরীরে পবিত্র রক্ত। আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি! তোরা আর আমরা সমকক্ষ? এত সাহস?
—এ অন্যায়! আমরাও যুদ্ধে রক্ত ঝরিয়েছি সম্রাটের জন্যে! আমাদেরও অধিকার আছে।
ইতিমধ্যে যবনরাও ভিড় করতে শুরু করেছে। দুই দলে ঝামেলা শুরু হয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে একজন যবন সেনানায়ক একটা ধাক্কা দিল এক ভারতীয় সৈনিককে। সৈনিকটি মাটিতে পড়ে গেল। যবনটি মুষ্টি তুলে আঘাত করতে গেল। কিন্তু, অন্য এক বজ্রকঠিন হাত তার উদ্যত বাহু মাঝপথেই আটকে দিল।
এক তরুণ ভারতীয় সৈনিক তাকে আটকেছে। এই তরুণটিকে ইতিমধ্যেই অনেকে চিনেছে সেনাশিবিরে। কারণ, আগের হাইডাসপেসের যুদ্ধে এই তরুণ সৈনিকটি বহুবার নিজের বীরত্বের প্রমাণ দিয়েছে। বেশ কয়েক জন আহত ভারতীয় সৈনিককে সে নিজে ফিরিয়ে এনেছিল শিবিরে।
—শশিবর্মা!
গুঞ্জিত হল তার নামটা ভারতীয়দের মধ্যে। যবন সৈনিকটি তার হাত ছাড়িয়ে নিতে টান দিল। কিন্তু, শশিবর্মার বলশালী হাতের থেকে এক চুল নাড়াতে পারল না।
নিজে থেকেই হাত ছেড়ে দিয়ে, দোভাষীকে লক্ষ করে শশিবর্মা বলল,
—ওদের বলো যে, শুধু মুখে নিজেদের সেরা বললেই সেরা হওয়া যায় না। যবনরা যা যা করতে পারে, তা একজন ভারতীয়ও করতে পারে। এদেশের মাটিও বীরদের জন্ম দিয়ে এসেছে যুগ যুগ ধরে।
প্রবল সমর্থনের আওয়াজ ভেসে এল শশিবর্মার পেছনে দাঁড়ানো ভারতীয় সৈনিকদের দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শশিবর্মা হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিল পড়ে যাওয়া সৈনিকটির দিকে। তার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল সৈনিকটি।
যবনরাও এত সহজে অপমান হজম করার পাত্র নয়। একজন এগিয়ে এসে বলল, —এই মুহূর্তে তোমায় গ্রেফতার করতে পারি আমরা।
শশিবর্মা মৃদু হেসে বলল,
—তা পারো। কিন্তু, তাতে কি যবনদের বীরত্ব প্রকাশ পাবে? আরও একবার সমর্থনের ধ্বনি উঠল দেশি সৈনিকদের থেকে।
—এক-একজন যবন তোমাদের পাঁচজন ভারতীয় সৈনিকদের সমতুল্য এটা জেনে রাখো!
—তাই নাকি? তবে এও জেনে রাখো যে, আমি একা তোমাদের মতো পাঁচজন যবনের মহড়া নিতে পারি!
এইবার কিন্তু সমর্থনের শব্দ শোনা গেল না। বরং, কিছুটা আশঙ্কিত ভাব প্রকাশ পেল দেশি সৈনিকদের মধ্যে। এতটা বোধ হয় বলা উচিত হয়নি শশিবর্মার।
দোভাষী শশিবর্মার কথা তাদের বুঝিয়ে দিতেই রাগে জ্বলে উঠল যবন দলপতিটি। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
—তাই নাকি? বেশ। তবে নিজের কথার প্রমাণ দাও। অসিযুদ্ধে পরাস্ত করে দেখাও আমায়!
—না!
শশিবর্মার কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল যবনদের মুখে। দলপতি বলল,
—সেকী! সাহস শেষ? সব বীরত্ব পলকে বিদায় নিল আমার সঙ্গে যুদ্ধের কথা শুনে?
শশিবর্মা কোমর থেকে তরবারি বের করে সেটা দু-পাক একহাতে ঘুরিয়ে তাক করল যবনদের দিকে।
দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
—তোমার একার সঙ্গে আমি যুদ্ধ করব না। তোমাদের পাঁচজন যবনের সঙ্গে আমি একইসঙ্গে যুদ্ধ করব। বলো, রাজি?
আবার গুঞ্জন উঠল সৈনিকদের মধ্যে। আশ্চর্যভাবে শশিবর্মার শাস্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠ শুনে কেউই তার কথা প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিতে পারছে না।
অপমানে মুখ লাল হয়ে গিয়েছে দলপতির। সে দ্রুত চারজন নির্দিষ্ট যবনকে দল থেকে এগিয়ে আসতে বলল। এগিয়ে এল তারা।
দলপতি বলল,
—তোর দম্ভ আমি আজ দূর করব, মূর্খ বালক। শুনে রাখ, আজ যদি তুই হেরে যাস, তবে তোর প্রাণ নেব আমি।
—বেশ। কিন্তু, যদি আমি জিতে যাই, তবে আমার সঙ্গী সৈনিকদের ভরপেট আহার দিতে হবে।
—বেশ। তবে, তৈরি হ।
পাঁচজন সৈনিক নিজের কোমর থেকে তরবারি বের করে ফেলল। পাঁচজন যবন সৈনিকদের মুখোমুখি দাঁড়াল শশিবর্মা।
বাকিরা তার জেতার কোনো আশা না দেখলেও, শশিবর্মা মূর্খ নয়। সে গত কয়েক মাসে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যবনদের যুদ্ধকৌশল প্রত্যক্ষ করেছে। শশিবর্মাকে তার গুরু বাল্যকাল থেকেই সমস্ত ধরনের যুদ্ধকলায় প্রশিক্ষিত করেছেন। তিরন্দাজি, মল্লযুদ্ধ থেকে শুরু করে অসিচালনা, সবেতেই সে নিপুণ। আর, তার পক্ষে সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হচ্ছে, সে তার প্রতিপক্ষ যবনদের যুদ্ধকৌশলের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। শশিবর্মা লক্ষ করেছে যে, যবনরা নির্দেশ মেনে, বড়ো দলে যুদ্ধ করতে যতটা অভ্যস্ত, দ্বন্দ্বযুদ্ধে মোটেই ততটা নয়। তা ছাড়া, শশিবর্মার ভারতীয় যুদ্ধকলার সম্বন্ধে তারা কিছুই জানে না। সেটাকেই কাজে লাগাতে হবে।
প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে অতি দ্রুত ভাবছে শশিবর্মা। গুরুর শেখানো কথাগুলো মনে পড়ছে। একাধিক শত্রুকে পরাস্ত করার উপায় হল একে একে তাদের পরাস্ত করা। প্রথম আঘাতেই তাকে একজনকে হারাতে হবে।
আচমকা শত্রুর দিকে ছুট লাগাল শশিবর্মা। কেউই আশা করেনি যে, সে আচমকা এভাবে ধেয়ে যাবে শত্রুর দিকে। তাই তৎক্ষণাৎ চারজন যবন কিছু করতে পারল না। কিন্তু, একজন যবন সহজাত প্রতিক্রিয়ায় এগিয়ে এসে আঘাত করতে গেল শশিবর্মাকে। আর, সেখানেই ভুল করে বসল।
বাকি চারজনকে ছেড়ে এগিয়ে আসতেই শশিবর্মা তাকে একা পেয়ে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঝুঁকে পড়ে তার পেটে আঘাত করল নিজের তরবারি দিয়ে। যবনটি হাতের তরবারি ফেলে পেট ধরে বসে পড়ল। আঘাত গভীর না হলেও আর যুদ্ধ করা তার পক্ষে সম্ভব না।
আঘাতটা ইচ্ছে করেই গভীর করেনি শশিবর্মা। আঘাত করেই দ্রুত পিছিয়ে এল সে। একজন ধরাশায়ী, বাকি রইল চার।
৫.
সেলুকাস চিন্তিত ভঙ্গিতে অলকশেন্দ্রর কক্ষ থেকে শিবিরের দিকে ফিরছিলেন। সম্রাটের কক্ষে সাপের ঘটনাটা কীভাবে যেন জেনে গিয়েছে সবাই। মোটেই ভালো হয়নি এটা।
আজকে সেলুকাসের মন ভালো নেই। তাঁর মনে পড়ছে নিজের দেশের কথা। তাঁর পরিবারের কথা। কেমন আছেন তাঁরা? আরও একজনের কথা মনে পড়ছে সেলুকাসের। পারস্যের সেরা সুন্দরী আপামা। যাঁকে বিবাহ করেছেন সেলুকাস। সম্রাট পারস্য জয় অভিযানের সময়েই তিনি প্রেমে পড়েন আপামার, বিবাহ করেন পারস্য জয়ের পরেই। তাঁকে সেখানেই রেখে আবারও সম্রাটের সঙ্গে অভিযানে চলতে শুরু করেন সেলুকাস। কিন্তু, ওই সীমিত সময়েই তাদের প্রেম গভীর হয়েছে। তার কথা বড়ো মনে পড়ে সেলুকাসের।
একবার তিনি আপামাকে বলেছিলেন,
—তুমি জানো, প্রাচীন গ্রিসেও তোমার মতোই এক সুন্দরী ছিল। তার নাম ছিল “হেলেন”। তুমি গ্রিক ঘরের কন্যা হলে তোমার রূপ দেখে, আমি নিশ্চিত যে তোমার পিতাও তোমার নামকরণ করতেন “হেলেন”।
আপামা লাজুক হেসে বলেছিল,
—বেশ তো, যদি কোনোদিন আমাদের সুন্দরী কন্যাসন্তান হয়, তবে আমরা তার নাম রাখব- “হেলেনা”।
আহা! সেই দিনগুলো যেন এক সুন্দর স্বপ্ন ছিল। সেলুকাসের মন টানছে বড়ো। কতদিন দেখেননি তিনি আপামাকে। সত্যিই কি তাঁদের স্বপ্ন সত্যি হবে কোনোদিন? এক ফুটফুটে কন্যা হেলেনার পিতা হবেন সেলুকাস? ঈশ্বর, আশীর্বাদ করো!
ভাবনায় ডুবে এগোচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ চোখ আটকে গেল কিছুটা দূরে ভিড়ের দিকে। যবন ও ভারতীয় সৈনিকরা দুইই আছে ভিড়ে। সেদিকে এগিয়ে গেলেন সেলুকাস। তাঁকে কেউ খেয়াল করেনি। সবার দৃষ্টি মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় নিবদ্ধ।
সেলুকাসের চোখে পড়ল পাঁচজন যবন আর একজন ভারতীয় সৈনিক তরবারি হাতে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। বিরক্ত হলেন সেলুকাস। পাঁচজন যবন মিলে একজন ভারতীয়র সঙ্গে লড়াই করছে? ছিঃ! এ তো যবন রক্তের অপমান! এখুনি বাধা দিতে হবে। আর, এর সঙ্গেই এই ভারতীয় ও যবনদের সাজাও দেবেন তিনি।
বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এগোতে যাবেন সবে। ঠিক সেই মুহূর্তে ভারতীয় সৈনিকটি হামলা করল। এবং, মুহূর্তে সেলুকাস দেখলেন তাঁর একজন যবন ধরাশায়ী হয়েছে।
চমকে গেছেন সেলুকাস! তিনি এধরনের দৃশ্য আশা করেননি। তিনি যোদ্ধা চেনেন। এ যুবক একজন দক্ষ যোদ্ধা!
দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। তিনি দেখতে উৎসুক যে, এইবার কী হতে চলেছে।
চারজন যবন বেশ হতভম্ব হয়েছে। ভারতীয় তরুণটি পরাজিত যবনটির তরবারিটি তুলে নিয়েছে। দু-হাতে দুটি তরবারি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সৈনিকরা কাউকে আজ অবধি দু-হাতে তরবারি চালাতে দেখেনি। আদেশের আশায় দলপতির দিকে তাকাচ্ছে তিনজন যবন। দলপতি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
—ঘিরে ফেলো ওকে!
তিনজন এগিয়ে গেল তরুণের দিকে। তারা আশা করছিল যুবক তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উদ্যত হবে। কিন্তু, সে তা করল না। বরং, নিজের দু-দিকে তরবারি চক্রাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে তাদের মধ্যে দিয়ে জায়গা করে নিল। এবং, তিন সৈনিককে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দলপতিকে আক্রমণ করল।
সেলুকাস হেসে উঠলেন। সঠিক রণনীতি! তরুণ বুঝতে পেরেছে যে, দলপতির নির্দেশ ছাড়া সৈনিকরা আক্রমণ করতে পারবে না সহজে। তাই সবার আগে দলপতিকে হারাতে হবে। কিন্তু, দলপতির শরীর আকারে প্রায় তার দ্বিগুণ। গায়ের জোরও দ্বিগুণ হবে। দেখা যাক, কীভাবে তার সঙ্গে যুদ্ধ করে তরুণ।
দলপতি দু-হাতে তরবারি উঠিয়ে প্রস্তুত হল আক্রমণের জন্য। কিন্তু, সেই মুহূর্তে ভারতীয়টি একটি অদ্ভুত কাজ করল। দু-হাত থেকে তরবারি দুটি ফেলে দিল ভূমিতে।
আরও একবার হতভম্ব হয়ে পড়ল দলপতি। বুঝে উঠতে পারল না কী করছে তার প্রতিপক্ষ। আর, সেই সুযোগই নিল সেই তরুণ। দলপতির তরবারির পাশ কাটিয়ে, একলাফে তার পিঠে চেপে বসল সে। এরপর মল্লযুদ্ধের অদ্ভুত প্যাঁচে বিশালকায় যবনটিকে স্থানচ্যুত করল। দুই আঙুল চোখে ঢুকিয়ে মুহূর্তের জন্যে অন্ধ করে দিল তাকে। তাল সামলাতে পারল না ভারী দেহের যবনটি এবং মল্লযুদ্ধের আরও একটি প্যাঁচে তাকে ধরাশায়ী করল ভারতীয় যুবক।
প্রশংসাসূচক একটা শব্দ বেরিয়ে এল সেলুকাসের মুখ থেকে। দুর্দান্ত!
প্রতিপক্ষর শারীরিক শক্তিকে তারই বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে এই যুবক। কে এই যুবক?
আশেপাশের ভারতীয় সৈনিকরা চিৎকার করে উঠেছে। তারা একটি নাম বার বার বলা শুরু করেছে।
“শশিবর্মা! শশিবর্মা! শশিবর্মা!’
দলপতিকে পরাজিত হতে দেখে তিন যবন সৈনিক বজ্রাহতর মতো কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল। সেই সুযোগে ফেলে দেওয়া তরবারি দুটি আবার তুলে নিয়েছে তরুণ সৈনিক।
এরপর যা হওয়ার তাই হল। সেলুকাসের আর বিশেষ কিছু দেখার ছিল না। তিনি সহজেই বুঝতে পারছিলেন এই যুদ্ধের পরিণতি কী হবে। তিনজন যবন সৈনিক অন্ধের মতো আক্রমণ করল তরুণটিকে। এবং, একজন স্থিরমস্তিষ্ক, অসম্ভব দক্ষ যোদ্ধার পক্ষে তিন দিগ্ভ্রান্ত অসিধারিকে পরাজিত করা নেহাতই সহজ কাজ।
অতি দ্রুত ধরাশায়ী হল শেষ তিনজন। আহত পাঁচজনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে, মাথার ওপর তরবারি ধরা ডান হাত তুলে বিজয়দর্পে যুবকটি হুংকার দিয়ে উঠল,
—জয় হো!
পরমুহূর্তে প্রবল বিজয়োল্লাস ও জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়ল ভারতীয় সেনাশিবির! শশিবর্মার নামে জয়জয়কার করছে তারা। একদল এসে তাকে কাঁধে তুলে নিল।
সেলুকাস এইবার এগিয়ে এলেন। এতক্ষণে তাঁকে খেয়াল করেছে সৈনিকরা।
কোলাহল থামিয়ে দিয়েছে সবাই। কিন্তু, এখনও শশিবর্মাকে কাঁধ থেকে নামায়নি তারা। সেলুকাস তাদের কাছে যেতেই শশিবর্মা নিজেই নেমে এসে বুকের কাছে বাম মুষ্টি রেখে সামরিক ভঙ্গিতে অভিবাদন জানাল।
সেলুকাস প্রশ্ন করলেন,
—তোমার নাম কী যুবক? তোমার কুল কী?
—শশিবর্মা। আমি কুলহীন।
—কুলহীন? তবে তুমি এই যুদ্ধকলা কোথা থেকে শিখেছ?
—আমি তক্ষশিলার ছাত্র ছিলাম শতরপ। সেখানেই আমার প্রাথমিক অস্ত্র ও যুদ্ধ শিক্ষা।
তরুণের কাঁধে হাত রাখলেন সেলুকাস। বললেন,
—অসাধারণ দক্ষতা তোমার। হাইডাসপেসের যুদ্ধে ভারতীয় সৈনিকদের বীরত্বের কথা আমি শুনেছি। আজ নিজের চোখে দেখলাম।
যবন সৈনিকদের দিকে ফিরে সেলুকাস প্রশ্ন করলেন,
—কী নিয়ে বিবাদ?
দোভাষীটি এগিয়ে এসে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দিল। শুনে সেলুকাস বললেন, সেনাবাহিনীতে সমস্ত সৈনিকের একটাই পরিচয়। তারা দেবপুত্র সম্রাট অলকশেন্দ্র মহানের সৈনিক! তারা প্রত্যেকে দেবতার পক্ষে যুদ্ধ করছে! তাদের মধ্যে কোনো উঁচু-নীচু বিভেদ নেই!
পাকশালের কর্তাদের নির্দেশ দিলেন,
—অবিলম্বে নতুন খাদ্য বানানো শুরু হোক। আর, ততক্ষণে যবন শিবিরের খাদ্য ভাগ করে নেওয়া হোক ভারতীয় সৈনিকদের সঙ্গে।
আরও একবার জয়জয়কার উঠল ভারতীয়দের মধ্যে। সেলুকাস শশিবর্মাকে বললেন, —তোমার সঙ্গে ফের দেখা হবে, যোদ্ধা। আমার প্রয়োজনে তোমায় ডাকব। আরও একবার অভিবাদন জানাল শশিবর্ষা সেলুকাসকে। সেলুকাস বিদায় নিলেন।
৬.
সম্রাট অলকশেন্দ্র নিজস্ব ছাউনিতে বসে আছেন। তাঁর সম্মুখে অনেকগুলো ভূর্জপত্র জোড়া লাগিয়ে বানানো ভারতের একটি মানচিত্র। অতি দক্ষিণ প্বদেশ অজানা। কিন্তু, এই মানচিত্রে পশ্চিমে গান্ধার থেকে পূর্বে অঙ্গ, উত্তরে পৌরব থেকে অবস্তি রাজ্যের সীমানা অবধি চিহ্নিত।
অলকশেন্দ্রর আসনের পেছনেই দেওয়ালে তাঁর নিজের বিজিত সাম্রাজ্যের মানচিত্র দেখা যাচ্ছে। সুদূর ম্যাসিডোন থেকে গ্রিস হয়ে মিশর। সেখান থেকে আকাইমেনিদ ও আনাতোলিয়া দেশ হয়ে ভারতবর্ষ।
এই বিশাল সাম্রাজ্যের তুলনায় তাঁর সম্মুখে রাখা ভারতের আয়তন নেহাতই ক্ষুদ্র। অথচ, এই দেশ জয় নিয়েই চিন্তিত অর্ধ বিশ্বের সম্রাট অলকশেন্দ্ব মহান।
তাঁর মন নাড়া দিয়েছে সেরাত্রের ঘটনা। ছোটোবেলায় তিনি শুনেছেন তাঁরই মতো আরও এক গ্রিক দেবপুত্র, বাহুবলি নায়ক হেরাক্লিসের কাহিনি। তাঁকেও সর্প দ্বারা হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল তাঁর বাল্যকালে। তার ওপর আবার ভবিষ্যদ্বক্তাদের অশুভ ভবিষ্যদ্বাণী। মন বড়ো অশান্ত আজ অলকশেন্দ্রর।
তাঁর নিজের দেশের কথা মনে পড়ছে আজ। বহুদিন বাদে তাঁর আজ দেশের মাটিতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। তাঁর দেশ, ছোট্ট ম্যাসিডোনিয়া। গ্রিকরা তো এই ক্ষুদ্র দেশটিকে তাদের অংশ বলে গ্রাহ্যই করত না কোনোদিন। এথেন্স বা স্পার্টার শৌর্যবীর্যর তুলনায় ম্যাসিডোনকে কেই-বা চিনবে? কিন্তু, এই ছোট্ট দেশেরই এক বালক স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। আর, তাই তো সেদিনের তরুণ অলকশেন্দ্র আজকে দেব-পুত্র অলকশেন্দ্র মহান হয়েছে!
সম্রাটের মনে পড়ে তাঁর মায়ের মুখে বহুবার শোনা সেই কাহিনি। অলকশেন্দ্রর জন্মের পূর্বে তাঁর মা অলিম্পিয়া স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, আকাশ থেকে নেমে এসে এক ভীষণ বজ্র তাঁর গর্ভে প্রবেশ করছে। ঠিক তার কয়েক দিন পরেই তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর পেটে সন্তান এসেছে। তাই অনেকেরই বিশ্বাস, এমনকী তাঁর মা নিজেও বিশ্বাস করতেন যে, আসলে তাঁর গর্ভসঞ্চার করেছিলেন স্বয়ং বজ্রের দেবতা দেবরাজ জিউস। নাহলে ফিলিপের মতো এক ছোট্ট প্রদেশের রাজার পুত্র এরকম প্রবল পরাক্রমী বিশ্বসম্রাট হয় কীভাবে? সেরকমই ছোটোবেলা থেকে অলকশেন্দ্রকে বলে এসেছেন তাঁর মা। অলকশেন্দ্রও ক্রমে সেই কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। আর তাঁর এই ধারণার যথেষ্ট কারণও ছিল।
বরাবরই তিনি সব কিছুতে সেরা। অধ্যয়ন থেকে অস্ত্রবিদ্যা, সবেতেই তিনি অপরাজেয়। বাল্যকাল থেকেই অলকশেন্দ্রর মধ্যে প্রতিভা দেখেছিলেন তাঁর আচার্য মহা পণ্ডিত অ্যারিস্টটল। কিন্তু, তাঁর পিতা দ্বিতীয় ফিলিপের উচ্চাভিলাষ ছিল না মোটেই। পুত্র অলকশেন্দ্রর মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখে তিনি একবার বলেছিলেন,
—এই ম্যাসিডোন তোমার পক্ষে বড্ড ছোটো আলেকজান্ডার। আমার মনে হয় না তুমি এই দেশে আবদ্ধ থাকতে পারবে।
পিতার কথা যে কতটা সত্য ছিল, তা আজকে প্রমাণিত। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ম্যাসিডোনের সিংহাসন গ্রহণ করেন অলকশেন্দ্র। তারপর আর ফিরে তাকাননি। একে একে তিনি জয় করেছেন গ্রিস, মিশর ও পারস্য। অলকশেন্দ্রর কাছে হার স্বীকার করেছে প্রত্যেকে। যে গ্রিকরা ম্যাসিডোনকে অসভ্যের দেশ বলত, আজ তারাই ম্যাসিডোনিয়ান সম্রাট অলকশেন্দ্রকে দেবতা বলে।
কোন রাজ্য জয় করা সবচেয়ে কঠিন ছিল? নিঃসন্দেহে পারস্য। তৃতীয় ডারিউসের বিশাল সেনাকে পরাজিত করতে শুধুই পরাক্রম নয়, বুদ্ধিরও প্রয়োজন পড়েছিল। এত কিছুর পরেও শাস্তি পাননি অলকশেন্দ্র। কারণ, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর নেশা তাঁকে ততদিনে গ্রাস করেছে! ক্ষমতার নেশা, বিশ্বজয়ের নেশা, নতুন দেশ দেখার নেশা! সেই বাল্যকালের মতোই তাঁর চোখে এখনও স্বপ্ন খেলা করে!
কিন্তু, আজ সম্রাটের বড়ো ক্লান্ত লাগছে। বয়স বেড়েছে অনেকটা। আজ প্রথমবার অলকশেন্দ্রর হৃদয়ে দুঃখ জমাট বাঁধছে। তিনি বড্ড দূরে চলে এসেছেন তাঁর দেশ থেকে, তাঁর গৃহ থেকে। সারাবিশ্ব তাঁর হয়েছে, আর তিনি নিজে হয়েছেন গৃহহারা।
ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে তাঁর সেই ছোট্ট ম্যাসিডোনে। অথচ, তাঁর মনে বার বার কেউ বলে যাচ্ছে যে, তিনি আর কোনোদিন তাঁর দেশকে দেখতে পাবেন না। ফিরে যেতে পারবেন না আর কোনোদিন নিজের মাটিতে।
না না! এইসব কী ভাবছেন তিনি? তিনি কি তবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন? দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেবেন না অলকশেন্দ্র।
মাথা থেকে চিন্তা সরিয়ে সম্মুখে মেলে রাখা মানচিত্রে মন দিলেন তিনি।
হঠাৎই বাইরে কোলাহল শুনতে পেলেন।
এতক্ষণ তাঁরই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি সেলুকাস। তাকে বললেন, —কীসের কোলাহল হচ্ছে? দেখো তো।
বাইরে উঁকি দিয়ে ফিরে এসে সেলুকাস বললেন,
—কয়েকটি ভারতীয় সাধু ঢুকে পড়েছে শিবিরে।
বিরক্ত হয়ে অলকশেন্দ্র প্রশ্ন করলেন,
—প্রহরা ভেদ করে কীভাবে ঢুকল?
এতক্ষণ কক্ষের ভেতর চুপচাপ বসে লেখালেখি করছিলেন ওনশিসিট্রাস। ওনশিসিট্রাস তাঁর মিত্র, দার্শনিক এবং তাঁর অক্ষরজীবী লিপিকারও বটে। সম্রাটের সঙ্গেই তিনিও বিশ্বযাত্রার সঙ্গী হয়েছেন। তিনি লেখা থামিয়ে বললেন,
—ভারতীয় সৈনিকরা এই ব্রাহ্মণ আর সাধু-সন্ন্যাসীদের ঢুকতে দিয়েছে নিশ্চয়ই। তারা এদের সম্মান করে, আবার ভয়ও পায়। তাই তারা বাধা দেবে না এদের।
কৌতূহলী হলেন অলকশেন্দ্র। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
—চলো তো, একবার দেখি।
৭.
ভারতীয় সেনাশিবির।
প্রায় সমস্ত সৈনিক উপস্থিত হয়েছে। তার ফলে খুবই ভিড় জমেছে। তাদের ঠিক মাঝখানে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন ভারতীয় তরুণ সৈনিক।
আজকাল মাঝে মাঝেই ভারতীয় সৈনিকরা এভাবে ভিড় জমায় শশিবর্মার কথা শুনতে। প্রত্যেকেই এই কয়েক মাসে উপলব্ধি করেছে যে, এই তরুণ সাধারণ নয়। উচ্চশিক্ষিত, পরিমার্জিত এবং যুদ্ধকলায় অসম্ভব পারদর্শী। তার কথা, তার ভাষা হৃদয় ছুঁয়ে যায় ভারতীয়দের। যবন সেনায় ঢোকা অবধি ভারতীয়দের হেয় জ্ঞান করে এসেছে যবনরা। তাই দেশীয় সৈনিকরা কোথাও যেন হীনমন্যতায় ভুগছিল।
কিন্তু, এই তরুণ তাদের বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছে যে, তারাও গর্বিত বীর। শিবিরের অর্ধেক সৈনিক পৌরবের যুদ্ধ থেকেই এই তরুণের ভক্ত ছিল। তার বীরত্বে মুগ্ধ হয়েছে তারা৷ বহু ভারতীয় আহত সৈনিকের প্রাণ রক্ষা করেছে সে। কয়েক দিবস পূর্বের ঘটনার পর বাকি শিবিরও তার একান্ত অনুগত হয়েছে।
পাঁচজন যবনকে শশিবর্মা একা দ্বন্দ্বযুদ্ধে হারিয়েছে! ভারতীয়দের গৌরব ফিরিয়ে দিয়েছে সে। স্বয়ং শতরপ সেলুকাস তার প্রশংসা করেছেন। এখন যবনরাও সমীহ করে চলে ভারতীয় সৈনিকদের।
শশিবর্মা বলছে,
—প্রকৃত রাজা কে? সে কি দেবতা? না। কখনোই নয়। আমার গুরু বলেন, প্রকৃত রাজা আসলে জন-সেবক। সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি সে। মানুষই তার আসল শক্তি। জনতার সমর্থন ছাড়া কোনো সাম্রাজ্যই স্থায়ী হতে পারে না।
একজন বলল,
—হ্যাঁ। যবনরা আমাদের শাসক নয়! আমরা ভারতীয়। যবনের দেবতা আমাদের দেবতা নয়।
আরও এক সৈনিক প্রশ্ন করল,
—এই যবনরা আমাদের রাজা নয়। কিন্তু, মগধের নন্দরা? সে কি আমাদের রাজা? সেও তো অত্যাচারী।
শশিবর্মা উত্তর দিল,
—না। এরা কেউই আমাদের যোগ্য শাসক নয়। নিজের হৃদয় থেকে যাকে আপনি সমর্থন করতে চাইবেন। যার জন্যে আপনি মরতে ও মারতে প্রস্তুত থাকবেন, সে-ই আপনার রাজা। সে-ই আপনার অধিনায়ক!
পেছনের সারির এক সৈনিক প্রশ্ন করল,
—কিন্তু এরকম রাজা কি আমরা কোনোদিন পাব? এই যবন, এই নন্দ এদের হাত থেকে কি আমাদের মুক্তি ঘটবে?
বুকের ওপর ডান হাত রেখে শশিবর্মা বলল,
—ঘটবে। অবশ্যই তা সম্ভব। কিন্তু, স্বাধীনতার মূল্য রক্ত। স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়, বন্ধুগণ। আপনারা পূর্বে স্বৈরাচারী রাজাদের জন্যে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন, যবনদের জন্যে রক্ত ঝরিয়েছেন। আর নিজের জন্যে, নিজের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্যে কি লড়াই করতে পারবেন না? বলুন, ভারতীয় বীর যোদ্ধারা!
পারবেন না?
—হ্যাঁ! হ্যাঁ! পারব! পারব!
সমস্বরে রব তুলল ভারতীয় সৈনিকরা।
হঠাৎ একজন বয়স্ক সৈনিক উঠে দাঁড়াল। তাকে দাঁড়াতে দেখে সকলে চুপ করে গেল। এই সৈনিকটি যুদ্ধে আহত হয়েছিল পূর্বে। শশিবর্মা নিজের কাঁধে করে তাকে শিবিরে ফিরিয়ে এনেছিল। সৈনিকটি ভিড়ের মধ্যে জায়গা করে নিয়ে এগিয়ে এল শশিবর্মার দিকে। শশিবর্মার সামনে এসে নিজের কোমর থেকে তরবারি বের করে আনল।
কিন্তু, তা আক্রমণ ভঙ্গিতে না ধরে সেটা দু-হাতে নিয়ে শুইয়ে, মেলে ধরল শশিবর্মার দিকে। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল তার সামনে। নিজের অস্ত্র ও শিরস্ত্রাণ সমর্পণের ভঙ্গিতে নামিয়ে রাখল শশিবর্মার পায়ের কাছে।
বলল, —হে বীর! আজ থেকে আমার তরবারি আপনার নামে সমর্পণ করলাম। আজ থেকে আপনিই আমার অধিনায়ক! আপনার জন্যে আমি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত! এই প্রাণ আপনার জন্যে সমর্পণ করলাম।
পরক্ষণেই তার দেখাদেখি অন্য সমস্ত সৈনিক একই কাজ করল। নিজের শিরস্ত্রাণ এবং তরবারি নামিয়ে রাখল শশিবর্মার সম্মুখে। তাকে আজীবন নিজেদের অধিনায়ক মানার শপথ নিল।
এরকম কিছু হবে শশিবর্মা নিজেও আশা করেনি। তার গুরু বলে যে, শশিবর্মার মধ্যে সহজাত নেতৃত্বের গুণ আছে। কথাটা মিথ্যে নয়। বাল্যকাল থেকেই ক্রীড়ার মাঠে হোক, বা, বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে, সর্বত্রই তার পেছনে সারি বেঁধেছে অন্যে। গুরু বলেন, একজনকে শুধু সাহস করে মশাল তুলে পথ চলতে হয়। তার পিছু চলার লোক পেয়েই যাবে।
শশিবর্মা বলল,
—আমি গর্বিত! আমি আপ্লুত যে, এই দেশের শ্রেষ্ঠ বীর যোদ্ধারা আমার সঙ্গে আছেন। উঠুন আপনারা! এই মস্তক নত করবেন না! নির্ভয়ে সদা উন্নত শির থাকুন। এই দেশ আপনাদের। এই মাটি আপনাদের। আপনারা উঠুন বীরগণ! আপনাদের উত্থানেই এই দেশের উত্থান!
মাথার ওপর মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত তুলে শশিবর্মা বলল,
—জয় হো!
সঙ্গেসঙ্গে কয়েকশো ভারতীয় সৈনিক তার বিজয়ধ্বনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চিৎকার করে উঠল,
—জয় হো!
আরও কিছুক্ষণ হয়তো তাদের বিজয়ধ্বনি চলত। কিন্তু, তখনই শশিবর্মার চোখে পড়ল কয়েক জন জটাজুটধারী সাধু তাদের শিবিরের দিকে এগিয়ে আসছে।
৮.
—ছুঁবি না! হাত লাগাবি না আমাদের শরীরে! খসে পড়বে হাত তোর!
একজন সৈনিক এগিয়ে যেতেই হুংকার দিয়ে উঠল এক সাধু। ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে গেল ভারতীয় সৈনিকটি।
ভয়ানক দর্শন তিন সাধু ঢুকে এসেছে সেনাশিবিরে। মাথায় জটার ঘনঘটায় মুখ প্রায় অদৃশ্য। লাল চোখের মণি, ললাটে রক্তচন্দন ও কুমকুম লেপা। সারা অঙ্গে চিতাভস্ম ঢাকা, পরনে রক্তবর্ণ একখণ্ড বস্ত্র মাত্র। তাদের কণ্ঠে রুদ্রাক্ষের মালার সঙ্গে কিছু পশুর হাড়ের মালা। একজনের হাতে একটি হাড়, অন্যজন একটি নরকঙ্কালের খুলির চোয়ালের অংশ সরিয়ে, খুলিটি শিরস্ত্রাণের মতো মাথায় পড়েছে। দুর্গন্ধ বের হচ্ছে তাদের শরীর থেকে।
ভয়ে কেউ ধারে-কাছে যাচ্ছে না। যবনরাও দূরে দাঁড়িয়ে থাকছে। অদ্ভুতদর্শন এই সাধুদের দেখে তারা বিস্মিত। কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না।
সাধুরা বেশ অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছে। তারা চিৎকার করছে,
—সাবধান! সাবধান!
—সাবধান! সাবধান!
যবন সৈনিকদের দিকে আঙুল তুলে একজন চেঁচিয়ে উঠল,
—ধ্বংস হয়ে যাবি, পাপী! এই ভূমি তোদের জন্যে নয়! এতে পা দিলে জ্বলে যাবি! সূর্যের তাপে ভস্ম হবি!
—এই দেশের নদে তোদের সলিলসমাধি হবে!
—মৃত্যু! মৃত্যু!
—মৃত্যু! মৃত্যু!
—মৃত্যু! মৃত্যু!
শশিবর্মাও বেরিয়ে এসেছে ইতিমধ্যে। ভ্রূ কুঁচকে দেখছে এই সাধুদের। এত দূরে দাঁড়িয়েও দুর্গন্ধ নাকে আসছে তার। যবনরা দোভাষীদের উদ্দেশে গুনগুন করে প্রশ্ন করছে যে, কী বলছে এই লোকগুলো। দোভাষীদের কথা শুনে তাদের বেশিরভাগেরই দৃষ্টিতে ভয় ফুটে উঠেছে।
শশিবর্মা দেখতে পেল উলটোদিক থেকে স্বয়ং অলকশেন্দ্র বেরিয়ে এসেছেন। পাশে বরাবরের মতো সেলুকাস নিকেটর।
সাধুরা কী বলছে বোঝার জন্যে সামনে কোনো দোভাষীকে পেলেন না তিনি। হঠাৎই সেলুকাসের চোখ পড়ল শশিবর্মার ওপর। দেখেই চিনতে পারলেন তিনি। এ তো সেই যুবক যাকে কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি পাঁচজন যবনের সঙ্গে লড়তে দেখেছেন।
ইশারায় সেলুকাস কাছে ডাকলেন শশিবর্মাকে। এগিয়ে গেল শশিবর্মা। সামনে এসে প্রথমে অলকশেন্দ্র এবং তারপর সেলুকাসকে যবনদের ভঙ্গিতে অভিবাদন করল।
সেলুকাস প্রশ্ন করলেন,
—তোমার নামটা আরও একবার স্মরণ করিয়ে দাও, সৈনিক।
—আমার নাম শশিবর্মা, শতরপ।
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। শশিবর্মা। এই তোমাদের দেশের সাধুরা কী বলছে? তাদের ভাষা আমরা বুঝি না। তুমি তো খানিকটা আমাদের ভাষা বোঝো। সম্রাটকে বলো কী বলছে এরা। চুপ করে থাকল শশিবর্মা। অলকশেন্দ্র অধৈর্য হয়ে ভাঙা ভাষায় প্রশ্ন করলেন,
—চুপ করে আছ কেন সৈনিক? বলো।
শশিবর্মা পুনরায় অভিবাদনের ভঙ্গিতে বুকে হাত রেখে, মাথা নীচু করে বলল,
—সম্রাট, অভয় দিলে বলতে পারি।
—অভয় দিলাম।
—সম্রাট, এরা আপনাদের, মানে, আমাদের সাবধান করছে। বলছে, এই ভূমি যবনদের জন্যে অশুভ, অভিশপ্ত। যদি আমরা আর এগোই, তবে আমাদেরও অভিশাপ লাগবে।
অলকশেন্দ্র অভিশাপের বিষয়টা জানেন। আগেও নীলনদের দেশে তিনি এক অদ্ভুত অভিশাপের কাহিনি শুনেছিলেন বেশ কয়েক বছর আগে। সেখানে তারা বিশ্বাস করত যে, মৃত সম্রাটদের সমাধি অভিশপ্ত। কেউ সেখানে প্রবেশ করে সম্রাটদের চিরনিদ্রা ভঙ্গ করলে তার ওপর অভিশাপ নেমে আসে।
আজ আবার সেইরকমই সতর্কতা-বাণী শুনছেন।
অলকশেন্দ্র প্রশ্ন করলেন,
—আর কী কী বলছে এরা?
শশিবর্মা ভাঙা ভাঙা ভাষায় যতটা সম্ভব বুঝিয়ে দিল তাদের কথা।
শুনে অলকশেন্দ্র বললেন,
—এদের এখুনি যদি হত্যা করি?
পাশ থেকে সেলুকাস বললেন,
—না সম্রাট, না! সেটা ভুল পদক্ষেপ হয়ে যাবে। ভারতীয়রা শুনেছি এই ব্রাহ্মণ আর সাধকদের খুব সম্মান করে। এদের হত্যা করলে ভারতীয়রা ক্রুদ্ধ হবে।
—কিন্তু, এভাবে এরা সৈনিকদের ভয় দেখাতে থাকলে তো মুশকিল! শশিবর্মা বলল,
—সম্রাট যদি অভয় দেন তো একটি উপায় বলি?
—বলো, যুবক। বলো।
—এদের প্রমাণ দিতে বলুন তাদের কথার। বলুন, যে দেবতারা যদি সত্যিই ক্ষুণ্ণ হয়ে থাকে, তবে তার ইঙ্গিত দিক এই মুহূর্তে। নাহলে আমরা ধরে নেব তারা অসত্য বলেছে।
কথাটা মনঃপুত হল অলকশেন্দ্রর। তিনি সেলুকাসের দিকে চাইলেন। সেলুকাসও সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
সেলুকাস শশিবর্মাকে বললেন,
—যাও। তুমিই এগিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলো। জোরে জোরে বলবে, যাতে সকলে শুনতে পায়।
— আমি?
—হ্যাঁ। তুমিই বলো।
অনিচ্ছাভরে শশিবর্মা বলল,
—বেশ।
সাধুদের দিকে এগিয়ে গেল শশিবর্মা। যতই কাছে যাচ্ছে, ততই তার নাকে বিকট দুর্গন্ধ আসছে। তাও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গলা চড়িয়ে শশিবর্মা বলল,
—ওহে, সাধুগণ। আপনাদের সম্মুখে স্বয়ং সম্রাট অলকশেন্দ্র দাঁড়িয়ে আছেন দেখুন।
সাধুরা তার ইঙ্গিত করা দিকে চেয়ে, অলকশেন্দ্রকে দেখে আবার চেঁচিয়ে উঠল,
—পাষণ্ড! নিজেকে দেবতা ইন্দ্রর সমতুল্য বলিস?
—দেবতারা ক্ষুণ্ণ হয়েছে!
—তোর আর তোর সৈনিকদের অভিশাপ লাগবে।
—মৃত্যু!
—মৃত্যু!
—মৃত্যু!
অলকশেন্দ্র তাদের কথা বুঝতে না পারলেও ভারতীয় সৈনিকদের মুখ দেখেই অনুমান করতে পারছেন যে, অশুভ কথাই বলছে এরা। এই বিকটদর্শন তিনজনকে দেখে তাঁর বারংবার ছোটোবেলার কাহিনিতে শোনা সেই তিন ভাগ্যের দেবীর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘ফেস’, তিন অন্ধ বোন, যাদের মাত্র একটিই চোখের মণি আছে। তিন ভাগ্যদেবী যাঁরা এই জগতের প্রতিটি প্রাণীর ভাগ্যসূত্র বুনে চলেন। তাঁদের হাতেই সবার জন্ম-মৃত্যু। তাঁরা সর্বজ্ঞ।
শশিবর্মা বলে উঠল,
—কীভাবে মেনে নেব আপনাদের কথা? কীভাবে বুঝব যে, দেবতারা সত্যি অসন্তুষ্ট?
জ্বলে উঠল তিন সন্ন্যাসীর চোখের দৃষ্টি। হুংকার দিয়ে উঠল,
—অবিশ্বাস!
—আমাদের অবিশ্বাস!
—পাপী! প্রমাণ চাই?
—প্রমাণ চাই তোদের?
—বেশ! প্রমাণ পাবি!
—পাবি তোরা প্রমাণ!
—দেখ তবে প্রমাণ!
—চোখ তুলে দেখ!
—চোখ তুলে দেখ আকাশের দিকে!
—দেখ সূর্যদেবের দিকে!
—দেখ! দেখ!
—দেখ! দেখ!
—দেখ! দেখ!
তিন সাধু আঙুল তুলে আকাশের দিকে দেখাল। তারা নিজেরা দেখছে না আকাশের দিকে। তারা ভূমির দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু হাত তুলে ইঙ্গিত করছে সূর্যের দিকে। সবাই চাইল আকাশের দিকে। কয়েক মুহূর্ত কিছুই প্রত্যক্ষ করল না কেউ।
কিন্তু, এ কী! সূর্যের আলো কমে আসছে কেন? সূর্যের এককোণে কালো একটি ছোপ ফুটে উঠছে। সেটি বড়ো হচ্ছে ধীরে ধীরে! সূর্যকে গ্রাস করতে শুরু করেছে রাহু! গ্রহণ লেগেছে সূর্যে!
মুহূর্তে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ল শিবিরে। ভারতীয়রা সূর্যগ্রহণের মতো অশুভ ছায়া থেকে নিজেদের বাঁচাতে চোখ ঢাকল। সূর্যগ্রহণ চোখে দেখা যে পাপ! ভয় পেয়েছে তারা।
আর যবনরা? তারা ভূমিতে বসে পড়েছে। প্রার্থনার ভঙ্গিতে বারংবার মাথা ঠেকাচ্ছে মাটিতে। ক্ষমা চাইছে বার বার মহাতেজি সূর্যদেব অ্যাপোলোর কাছে। দেবতার ভয়ে তারা কাঁপছে।
অলকশেন্দ্র আর সেলুকাস বিশৃঙ্খলা সামলানোর চেষ্টা করছেন। চিৎকার করে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, এটা সূর্যগ্রহণ মাত্র! এর আগেও বেশ কয়েক বার তাঁরা এ জিনিস দেখেছেন। অকারণ ভয় পাওয়ার প্রয়োজন নেই!
কিন্তু, তাতে ফল হচ্ছে না। আসলে ‘ভয়’ অনুভূতিটা সম্পূর্ণ পরিস্থিতি নির্ভর। আপাত সাধারণ ঘটনাকেও পরিস্থিতি বিশেষে অসাধারণ মনে হয়।
বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে ইতিমধ্যে তিন সাধু গায়েব হয়েছে। তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। অলকশেন্দ্রর বিশেষ বিশ্বস্ত অঙ্গরক্ষক ব্যতীত সকলেই ভূমিতে বসে ক্ষমা চাইছে দেবতার কাছে।
শশিবর্মাও আকাশের দিকে না তাকিয়ে নিজের শিবিরের দিকে দৌড় দিল। গ্রহণের সময়ে বাইরে থাকা উচিত নয়।
সব কিছু গুরুদেবের পরিকল্পনামতো হয়েছে। সেলুকাস যে তাঁকেই ডাকবেন ভাষান্তর করতে সেটা অবশ্য জানা ছিল না। তবে, তাতে বিশেষ সুবিধা হয়েছে।
তিনজন সাধুকে সত্যিই চেনা যায় না এই রূপে। কিন্তু, তাদের তিনজনেরই ডান বাহুতে এক বিশেষ মণিবন্ধ দেখেছে শশিবর্মা। তার নিজের হাতেও একটি একই মণিবন্ধ আছে। এটি তাদের গুরুভ্রাতাদের চিহ্ন। তাদের গুরু নিজের বিশেষ ছয় ছাত্রকে এই বালা দিয়েছিলেন কয়েক বছর আগেই। অক্ষয়, শশাঙ্ক ও জীবসিদ্ধিকে চিনতে পেরেছে সে। তাদের এই নিখুঁত ছদ্মবেশ নিঃসন্দেহে জীবসিদ্ধির অবদান। একবার পেছন ফিরে আতঙ্কিত যবন সেনাদের দেখে মনে মনে কৌতুক অনুভব করল শশিবর্মা। আঘাত সঠিক স্থানে লেগেছে!
৯.
সম্রাট অলকশেন্দ্রর তাঁবু। চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন অলকশেন্দ্র। আজকে কক্ষে তাঁর সহঅভিযাত্রী ও মিত্রস্থানীয় অনেকেই উপস্থিত। ওনশিসিট্রাস ও সেলুকাস বাদেও তাঁর অন্যান্য সেনাধ্যক্ষ নিআরচাস এবং চারেসও উপস্থিত। আর, ভারতীয়দের মধ্যে আছেন রাজা অম্বিক এবং ঋষি কালানি।
ঋষি কালানির সঙ্গে এক বছর আগে অলকশেন্দ্রর পরিচয় এই তক্ষশিলাতেই। তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে অলকশেন্দ্র তাঁকে নিজের সঙ্গী হতে অনুরোধ করেন। অনেক অনুনয়ের পর তিনি রাজি হয়েছেন।
অলকশেন্দ্র সেনাধ্যক্ষ নিআরচাসের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন, তোমার শিবিরের কী অবস্থা?
মুখে কালো ছাপ ফুটল নিআরচাসের। বলল, —সম্রাট, সংবাদ ভালো নয়। সৈনিকরা তো এমনিতে ক্লান্ত ছিলই। এখন তার সঙ্গে অভিশাপ, অশুভর ভয় ঢুকেছে। তারা আর অভিযানে যেতে চাইছে না। এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চায় তারা।
অলকশেন্দ্র এইবার চারেসের দিকে চাইলেন, —আর, তোমার শিবির?
মাথা নীচু করে চারেস উত্তর দিল,
—একই অবস্থা, সম্রাট। তাদের পুনরায় যুদ্ধে যেতে আদেশ দিলে বিদ্রোহ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
অন্য সময় হলে এই কথা শুনে রাগে জ্বলে উঠতেন অলকশেন্দ্র। কিন্তু, এখন তিনি সেইরকম কিছুই করলেন না। তিনিও ক্লান্ত।
তিনি এইবার সেলুকাসের মুখপানে চাইলেন। কোনো প্রশ্ন করলেন না কিন্তু সেলুকাস তাঁর সম্রাটের মনের ভাব অনুমান করেই বললেন,
—সব শিবিরেই এক অবস্থা। ভারতীয়রা তো বটেই, কিন্তু গ্রিকরা আরও বেশি আতঙ্কিত। অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, পোরাসের সঙ্গে হাইডাসপেসের যুদ্ধে আমরা বিশাল ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছি। ভারতীয় সৈনিকদের বাদ দিলে আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় অভিযান চালিয়ে যাওয়া।
সম্রাট কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,
—তুমি কি বলছ আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত?
—আমি শুধু আমাদের বাস্তব পরিস্থিতি বলছি, সম্রাট। আমি জানি যে, আপনি চাইলে এই পরিস্থিতিতেও উপায় বের করতেই পারেন। আপনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। কিন্তু, এরপর ভারতজয় করতে গেলে আমাদের মুখোমুখি হতে হবে এই দেশের সবচেয়ে বড়ো সাম্রাজ্য মগধের মগধের সৈন্যবল আমাদের চেয়ে কয়েক গুণ অধিক। তাদের সঙ্গে সম্মুখসমরের জন্যে আমাদের আরও সৈন্য লাগবে। বীর সৈন্য। একদল বিদেশি এবং অশুভর ভয়ে কুঁকড়ে থাকা যবন নয়।
অম্বিক বলে উঠলেন,
— কিন্তু… কিন্তু এভাবে আপনারা ফিরে যেতে পারেন না! মগধকে ভয় করার কিছু নেই। মগধের শাসক ধনানন্দ দুর্বল এবং অপদার্থ।
অলকশেন্দ্রর ইচ্ছে করল গান্ধাররাজ অম্বিককে প্রশ্ন করতে, ‘তোমার চেয়েও অপদার্থ?’ কিন্তু মুখে কিছু বললেন না তিনি। এমনিতেই পরিস্থিতি ভালো নয়। এর মধ্যে অযাচিত শত্রুসংখ্যাবৃদ্ধি করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
তিনি সবই বোঝেন। অম্বিক কী আশা নিয়ে তাঁকে সমর্থন করেন তাও সম্রাটের অজানা নয়। এই ভীরু মূর্খর হাতে ভারতের শতরপি দিয়ে গেলে তা কয়েক বছরের মধ্যেই হাতছাড়া হবে। অম্বিকের এক গুরু আছেন যাঁর কথামতো অম্বিক চলে। তিনি এখন গান্ধারের প্রধানমন্ত্রীও বটে। কয়েক বার সাক্ষাৎ হয়েছে তাঁর সেই গুরুর সঙ্গে। এই ব্রাহ্মণ লোকটিকে দেখেই অলকশেন্দ্রর মনে হয়েছে এই ব্যক্তি অত্যন্ত ধূর্ত। কয়েক দিবস পূর্বে যে কালনাগটি তাঁর তাঁবুতে ঢুকেছিল, অম্বিকের গুরু ব্যক্তিটিকে দেখলেই তাঁর সেই কালনাগের কথা স্মরণ হয়। অম্বিককে যবনদের সঙ্গে হাত মেলানোর বুদ্ধি সেই গুরুরই দেওয়া। কারণ, গান্ধারের পক্ষে একা মগধের সঙ্গে যুদ্ধ করাটা আত্মহত্যা-সম। তাই অম্বিকের এই গুরু তাকে পরামর্শ দিয়েছেন অলকশেন্দ্রর সাহায্যে মগধ জয় করতে। এরপর যবনরা দেশ ত্যাগ করে ফিরে যাওয়ার সময়ে, যবনদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রথম ভারতীয় রাজা হিসেবে অম্বিককেই মগধের শতরূপ ঘোষণা করবে। এভাবেই আর্যাবর্তের শাসন অম্বিকের হাতে আসবে।
তাই অলকশেন্দ্রর ভারত বিজয় নিয়ে অম্বিকের উৎসাহ, স্বয়ং অলকশেন্দ্রর চেয়েও বেশি।
অলকশেন্দ্র যদিও অম্বিককে ভরসা করেন না। কাপুরুষ মিত্রর চেয়ে বীর শত্রু অনেক ভালো এবং বিশ্বাসযোগ্য হয়। তিনি ভারত ত্যাগ করলেও এই দেশের দায়িত্ব সেলুকাসকেই দিয়ে যাবেন সেটা তিনি পূর্বেই ঠিক করে রেখেছেন।
অলকশেন্দ্র তাই অম্বিকের কথার উত্তর না দিয়ে চাইলেন ঋষি কালানির দিকে। বললেন,
—হে শিক্ষক ক্যালানাস। আপনি বুদ্ধিমান, পণ্ডিত এবং একজন ভারতীয়। আপনার মতামত আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কী পরামর্শ দেন? কয়েক দিন আগে আসা সেই তিন সাধু, আমার কক্ষে কালনাগের প্রবেশ, বা, আমাদের ভবিষ্যদ্বক্তাদের ভবিষ্যদ্বাণী। এগুলো কি অশুভ ইঙ্গিত?
মৃদু হেসে কালানি উত্তর দিলেন,
— আমি সামান্য শিক্ষক, সম্রাট। ভবিষ্যৎ বলা আমার কাজ নয়।
—তবে? তবে কে আমায় বলতে পারবে আমি, অলকশেন্দ্র এই অখণ্ড ভারতবর্ষের সম্রাট হতে সক্ষম হব কি না?
কিছুক্ষণ ভেবে কালানি উত্তর দিলেন,
— আমি সেরকম একজনকে চিনি যিনি আপনার মনের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। সে ত্রিকালদ্রষ্টা। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সমস্তই তাঁর জানা। তিনি মহাপুরুষ। এবং, তিনি এই মুহূর্তে আপনার থেকে বেশি দূরে অবস্থান করছেন না।
—কে? কে এমন আশ্চর্য পুরুষ?
—মহর্ষি দণ্ডায়ন। তিনি আমার গুরু। তিনি মহাযোগী সন্ন্যাসী শ্রেষ্ঠ। উৎসাহী হলেন সম্রাট। উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
—কোথায় তাঁকে পাব আমি?
—এখান থেকে অনতিদূরেই তক্ষশিলার গভীর অরণ্য। সেখানেই তিনি একা তপস্যায় লিপ্ত।
—এ তো অতি উত্তম! তবে হে ক্যালানাস, আপনি যান তাঁর কাছে। তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আসুন। আমি তাঁকে যথাযথ পুরস্কার দেব।
অলকশেন্দ্রর দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন কালানি। বললেন,
—নাহ্। আমার পক্ষে তা সম্ভব না। কারণ, তিনি তপস্যার উদ্দেশ্যে অরণ্যে প্রবেশ করার আগে আমায় ও অন্যান্য শিষ্যদের আদেশ দিয়েছিলেন যেন তাঁর তপস্যায় আমরা বিঘ্ন না ঘটাই। অতএব, সেই আদেশ আমি লঙ্ঘন করতে পারব না। কোনো দেবপুত্রর আদেশেও নয়।
অন্য কারুর এই ধরনের কথা বলার সাহস না থাকলেও ঋষি কালানির সে-সাহস আছে। তিনি এর পূর্বেও বহুবার অলকশেন্দ্রর ধনরত্ন ও পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। এবং, সেই কারণেই স্বয়ং অলকশেন্দ্র তাঁকে সম্মান করেন। তিনি বলেন, ক্যালানাসকে দেখলে তাঁর নিজের বাল্যকালের আচার্য অ্যারিস্টটলের কথা মনে পড়ে।
অলকশেন্দ্র বললেন,
—বেশ। সেলুকাস, তুমি ব্যবস্থা করো। ছোটো ছোটো দলে লোক পাঠাও অরণ্যে খুঁজে দেখতে। মহান ড্যান্ডামিসকে খুঁজে বের করো। আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই।
অভিবাদন জানিয়ে একবার মাথা নত করে বেরিয়ে গেলেন সেলুকাস।
১০.
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে জোরে ঘোড়া ছোটানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে যবন সেনাদের দলটা।
সবার সামনে দু-ধারে, ঘোড়ায় রয়েছে অলকশেন্দ্রর দুই দেহরক্ষী। তাদের মধ্যে, কিছুটা পিছিয়ে ঘোড়ায় বসে সম্রাট অলকশেন্দ্র। তাঁর দু-ধারে দুই-দুই সারিতে কয়েক জন যবন দেহরক্ষী। পেছনে আরও একসারি এবং তাদের মাঝখানে সেলুকাস। সবার পেছনে রয়েছে পঞ্চাশজনের পায়ে হাঁটা সৈন্যদল। এই দলটা পুরোটাই ভারতীয় সৈনিকদের। এই দলটার সামনেই ঘোড়ায় বসে রাজা অম্বিক। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে সঙ্গে আসতে হয়েছে আজ।
যদিও জঙ্গলের মধ্যে এই সুরক্ষা বলয় অনুযায়ী এগোনো সম্ভব হচ্ছে না। বার বার কেউ এগিয়ে যাচ্ছে তো অন্য কেউ পিছিয়ে পড়ছে। তবুও সেলুকাস খেয়াল রাখছেন যেন অলকশেন্দ্রর সুরক্ষা বলয় না ভেঙে যায়। বার বার তিনি নির্দেশ দিচ্ছিলেন সৈনিকদের।
তাদের উদ্দেশ্য মহর্ষি দণ্ডায়নের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।
গতকালই ওয়ানক্র্যাটাসের নেতৃত্বে ছোটো দলটি জঙ্গলের মধ্যে দণ্ডায়নের সন্ধান পেয়েছে। একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে ছিলেন এক যোগী। তাঁর কাছে গিয়ে ওয়ানস্ট্র্যাটাস বলে,
—ড্যান্ডামিস, আমি বিশ্বসম্রাট, দেবরাজ জিউস-পুত্র অলকশেন্দ্র মহানের দূত হয়ে এসেছি। সম্রাট অলকশেন্দ্র তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছুক। তাই তুমি আমার সঙ্গে চলো।
দণ্ডায়ন চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন। চোখ না খুলেই বললেন,
—অন্যথায়?
—তুমি গেলে তোমায় স্বর্ণ, রত্নাদি পুরস্কার দেবেন সম্রাট। কিন্তু, যদি তুমি তাঁর আদেশ অমান্য করো, তবে তোমার শিরশ্ছেদ করা হবে।
একচোখ খুলে তিনি যবনদের দলটির দিকে দেখে কৌতুকমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন,
—তোমার দেবপুত্র সম্রাটকে গিয়ে জানিয়ে দাও যে, দণ্ডায়ন তাঁর কাছে যাবেন না। তিনি দেবপুত্র হলে, আমিও দেবপুত্র। তাই আমাকে আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। আমাকে দেওয়ার মতো তাঁর কাছে কিছুই নেই। আর, মৃত্যুর ভয় আমার নেই। অতএব, নিজের সম্রাটকে গিয়ে জানিয়ে দাও যে, দণ্ডায়ন তাঁর কাছে আসবেন না। যদি তাঁর একান্ত প্রয়োজন থাকে, তবে তিনি যেন নিজে আমাদের কাছে আসেন।
মূর্তিবৎ দাঁড়িয়ে থাকলেন ওয়ানস্ট্র্যাটাস। কী করবেন ভেবে পেলেন না। দণ্ডায়ন আবার চোখ বুজে তাদের দিকে পিঠ করে ফিরে শুলেন। বললেন,
—এবার বিদেয় হও দেখি। আমায় জ্বালিয়ো না। ভাগো এখান থেকে! ফিরেই এসেছেন যবনরা। ওয়ানস্ক্যাটাস এসে সভয়ে সব কথা জানিয়েছে অলকশেন্দ্রকে। কথাগুলো বার বার শোনার সময়ে অলকশেন্দ্রর মুখ লাল হয়ে উঠছিল।
সব শুনে তিনি ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলেন,
—বেশ। কাল স্বয়ং অলকশেন্দ্র যাবে এই উদ্ধত যোগীর কাছে।
অতএব, আজ সকালে তাঁরা চলেছেন তক্ষশিলার অরণ্যের গভীরে।
সেলুকাসেরই পরামর্শে অলকশেন্দ্র নিজের মুষ্টিমেয় দেহরক্ষী বাদে আর কোনো যবন সৈনিক সঙ্গে নেননি। কারণ, এই অসভ্য যোগী কী না কী বলবেন তার ঠিক নেই। অশুভ কিছু বললে, বা, অলৌকিক কিছু ঘটলে তাতে যবনদের মনোবল আরওই ভেঙে যাবে। তাতে হিতে বিপরীত হবে। তার চেয়ে বরং ভারতীয় সৈনিকই ভালো। তারা এইসব যোগী-ঋষিদের কাণ্ডকারখানা দেখতে অভ্যস্ত। তারা খুব বেশি চমৎকৃত হবে না। বা, কিছু শুনলেও সেটা এসে যবনদের বলতে পারবে না ভাষা না জানার ফলে।
—আমরা প্রায় পৌঁছে গিয়েছি, সম্রাট। কিন্তু, অরণ্য অতি গভীর এখানে। ঘোড়া নিয়ে আর এগোনো যাবে না। বাকিটা পথ আমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে।
ওয়ানস্ক্যাটাসের কথার উত্তর না দিয়ে ঘোড়া থামিয়ে নেমে পড়লেন অলকশেন্দ্র। তাঁর দেখাদেখি অন্য যবনরাও নেমে পড়ল ঘোড়া থেকে। ঘোড়া গাছের সঙ্গে বেঁধে তারা এগিয়ে চলল সামনের দিকে। পেছনে চলতে থাকল অম্বিকসহ ভারতীয় সৈনিকদের দল।
কিছুক্ষণ এগোতেই জলপ্রপাতের শব্দ কানে এল যবনদের। এই জলপ্রপাতের পাশেই দণ্ডায়নের দেখা পাওয়া গিয়েছে গতকাল আরও একটু এগোতেই জলপ্রপাতটি চোখে পড়ল তাদের। আর তার সঙ্গেই চোখে পড়ল তার ধারে ঠিক যেমন বর্ণনা করা হয়েছে, সেভাবেই গাছের নীচে একজন উলঙ্গ মানুষ শুয়ে আছে।
সৈনিকদের দাঁড়াতে ইশারা করে সামনে এগিয়ে গেলেন অলকশেন্দ্র। তাঁর পিছু নিলেন সেলুকাস এবং অম্বিক।
শুকনো পাতার ওপর শুয়ে আছে কঙ্কালসার, নগ্ন একজন মানুষ। চুল দাড়ি দীর্ঘ, অযত্নে জটাময়। চোখ বন্ধ করে পরম প্রশান্তিতে শুয়ে আছে লোকটি।
অলকশেন্দ্র আশা করেছিলেন আগের তিন সাধুর মতোই এরও শরীর থেকে দুর্গন্ধ পাবেন তিনি। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে অলকশেন্দ্র যতই এই লোকটির কাছাকাছি যাচ্ছেন, ততই তাঁর নাকে একটি মৃদু ফুলের সুবাস এসে লাগছে। এই নগ্ন যোগীর শরীর থেকেই এই ফুলের ঘ্রাণ নির্গত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে অলকশেন্দ্রর।
দণ্ডায়নের সামনে এসে দাঁড়ালেন অলকশেন্দ্র। কাল থেকে যে ক্রোধের ভাব অলকশেন্দ্রর মনে ছিল, আশ্চর্যজনকভাবেই সেটা তিনি এই মুহূর্তে আর অনুভব করছেন না। তাঁর সামনেই ভূমিতে শায়িত মহর্ষি দণ্ডায়ন। চোখ বন্ধ, বুকের ওঠা-নামা লক্ষ করা যাচ্ছে না। তিনি আদৌ জীবিত নাকি মৃত সেটাও বোঝার উপায় নেই।
—ড্যান্ডামিস!
—বলো, অলকশেন্দ্ব।
চোখ না খুলেই বললেন দণ্ডায়ন।
অলকশেন্দ্র বললেন,
—ক্যালানাসের পরামর্শে আমি তোমার কাছে এসেছি ড্যান্ডামিস।
—ক্যালানাস? সে আবার কে রে?
—তোমার শিষ্য। তক্ষশিলার শিক্ষক।
চোখ খুললেন দণ্ডায়ন। বললেন,
—কালানি? তা তোমরা কি সবারই নাম এরকম বিচ্ছিরিভাবে বিকৃত উচ্চারণ করো?
অলকশেন্দ্র বললেন,
—তুমি জানো আমি কে?
—তুমি কি নিজেই আদৌ জানো, তুমি কে?
—আমি দেবপুত্র আলেকজান্ডার। এই পৃথিবীর অধীশ্বর। এই ভূমি, যাতে তুমি শুয়ে আছ, সেটাও আমার।
—তুমি নিজেকে দেবপুত্র বলো? তুমি মূর্খ! এই ধরার অধিপতি বলো নিজেকে? হে অলকশেন্দ্র, শুনে রাখো এই পৃথিবী কারুর নয়। প্রত্যেকেই এই পৃথিবীর এই পৃথিবীতেই তার সৃষ্টি, এই পৃথিবীতেই তার ধ্বংস! এর পূর্বে বহুবার মানুষ পৃথিবীকে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু, কালের নিয়মে তারা ধ্বংস হবে, তুমিও হবে। কিন্তু, এই পৃথিবী থেকে যাবে।
—তুমি আমাকে এই কথা বলছ, ব্রাহ্মণ? তোমার কি ভয় নেই? এই আমার তরবারির এক আঘাতে তোমার প্রাণ আমি নিতে পারি, যোগী!
—তোমার অসি আমার দেহ খণ্ডবিখণ্ড করলেও আমার এই আত্মায় আঘাত করার ক্ষমতা তোমার নেই, অলকশেন্দ্র। আত্মা অবিনশ্বর, পরমব্রহ্মের অংশ মাত্র। তুমি আমায় হত্যা করলে আমার আত্মা গিয়ে আমার আরাধ্য পরমব্রহ্মের সঙ্গে মিশে যাবে। আমার বহু কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছা পূরণ হবে।
—আমি অলকশেন্দ্র। বিশ্বের সমস্ত ঐশ্বর্য আমার ভাণ্ডারে আছে। তোমার কি আমার কাছে কিছুই চাওয়ার নেই, ড্যান্ডামিস?
—আমার যা কিছু প্রয়োজন তা সবই এইখানে, এই মুহূর্তে আমার কাছে আছে, অলকশেন্দ্র। এই বায়ু, জল, তরুছায়া, ফল— এর বেশি কীই-বা প্বয়োজন থাকতে পারে মানুষের? আমার সব আছে, অলকশেন্দ্র। তোমার কাছে আমায় দেওয়ার মতো কিছুই নেই। যে ভূমি, যে বিশাল সাম্রাজ্যের তুমি গর্ব করো, তা নিয়ে তুমি কী করবে, অলকশেন্দ্র? মৃত্যুর পর মাত্র সমাধির মাটির সমপরিমাণ ভূমি তোমার প্রয়োজন। মাত্র সেইটুকুতেই তোমার অধিকার।
অলকশেন্দ্র চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। দণ্ডায়ন মৃদু হাসলেন। বললেন,
—তবে এই মুহূর্তে আমার একটি বস্তু প্রয়োজন। সেটি কি তুমি আমায় দেবে?
—বলো, ড্যান্ডামিস। তুমি যা বলবে আমি তাই দেব তোমায়!
—বেশ। তবে একটু সরে দাঁড়াও। আমার এখন একটু রোদের প্রয়োজন। এবং, তুমি আমার এবং সূর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে আছ।
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন অলকশেন্দ্র। কারণ, বহু বছর পূর্বে, ঠিক একই কথা তাঁকে আরও একজন বলেছিল।
নিজের জয়যাত্রার শুরুর দিকে অলকশেন্দ্র ‘সিনোপ’ শহরে পৌঁছেছিলেন। সেখানে মহা-পণ্ডিত গ্রিক দার্শনিক ডায়োজিনিসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁকেও যখন অলকশেন্দ্র পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে তাঁকে তাচ্ছিল্য করেছিলেন ডায়োজিনিস। তিনিও বলেছিলেন,
—সরে দাঁড়াও, হে যুবক। রোদ আসতে দাও। তুমি আমার রোদ আটকে দাঁড়িয়ে আছ।
একথা কেউ জানে না। অথচ, অর্ধেক পৃথিবী দূরে, ভারতবর্ষের অরণ্যে বসা এই যোগী তাঁকে ঠিক সেই কথা বলছেন যা বহু বছর আগে সুদূর গ্রিসে এক বৃদ্ধ মহাজ্ঞানী তাঁকে বলেছিলেন।
তাঁর দিকে চেয়ে মৃদু হাসছেন দণ্ডায়ন। অলকশেন্দ্রর মন থেকে সমস্ত ক্রোধ, দত্ত, যুদ্ধজয়ের অভিলাষ, বিদায় নিচ্ছে।
ভূমিতে দণ্ডায়নের পায়ের কাছে বসে পড়লেন অর্ধ পৃথিবীর অধীশ্বর অলকশেন্দ্র মহান। এইবার উঠে বসলেন দণ্ডায়ন।
অলকশেন্দ্র বললেন,
—আমায় ক্ষমা করবেন, মহান ড্যান্ডামিস। আমায় ক্ষমা করবেন।
হেসে দণ্ডায়ন বললেন,
—বলো, অলকশেন্দ্র। কী জানতে চাও?
—আপনি তো ত্রিকালজ্ঞ, ড্যান্ডামিস। বলুন আমায়, এই ভারতে কি কোনোদিন এক অখণ্ড সাম্রাজ্য স্থাপিত হবে?
—হ্যাঁ। হবে।
—একজন সম্রাট কি এই দেশ শাসন করবে?
—হ্যাঁ। করবে।
—সেই সম্রাট কি এখানে উপস্থিত?
—হ্যাঁ। সেই সম্রাটকে আমি নিজের সম্মুখে এই মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি। হর্ষিত হয়ে উঠল সেলুকাস এবং অম্বিক। তার মানে অলকশেন্দ্র সত্যিই এই দেশ জয় করবেন।
সেলুকাস এবং অম্বিকের প্রফুল্ল মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কিছুক্ষণ মহর্ষি দণ্ডায়ন। তারপর হেসে উঠলেন সশব্দে। যেন প্রচণ্ড মজার কিছু তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন।
বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে তিনি বললেন,
—মূর্খ! আমি বলেছি অখণ্ড ভারতের নির্মাণ হবে। সাম্রাজ্যের শাসন একজন সম্রাট করবে। কিন্তু, একবারও বলিনি সেই সম্রাট অলকশেন্দ্র।
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছেন সেলুকাস এবং অম্বিক দণ্ডায়ন বললেন,
—এ! এই যে! এই হবে এই দেশের প্রথম অখণ্ড সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্রাট! তর্জনী তুলে সেলুকাস ও অম্বিকের পেছনে কারুর দিকে ইঙ্গিত করছেন দণ্ডায়ন। তাঁর তর্জনী বরাবর পেছন ফিরে সেলুকাস দেখলেন দণ্ডায়ন একজন ভারতীয় সৈনিকের দিকে নির্দেশ করছেন।
—কে?
দণ্ডায়ন আবার বললেন,
—হ্যাঁ। এ! এই সে!
অলকশেন্দ্ররও ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছে। তিনিও দেখছেন সেইদিকে।
গ্রিক সৈনিকের পোশাক ও মাথায় মুখ ঢাকা শিরস্ত্রাণ থাকায় সব সৈনিককেই একইরকম লাগে। চেনা যায় না। তাই সেলুকাস আদেশ দিলেন, সৈনিক। এগিয়ে এসো।
নড়ল না সেই সৈনিক। সেলুকাস আবার বললেন,
—এগিয়ে এসো।
এইবার কয়েক পা এগিয়ে এসে সেলুকাসের সম্মুখে দাঁড়াল সৈনিকটি।
—শিরস্ত্রাণ খোলো।
দু-হাতে ধরে শিরস্ত্রাণ খুলল সৈনিকটি।
তার মুখ দেখে চমকে উঠলেন দু-জনেই। কারণ, এই ব্যক্তি তাঁদের দু-জনেরই পরিচিত।
—শশিবর্মা?
—চন্দ্রগুপ্ত?
সেলুকাস বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাইলেন অম্বিকের দিকে,
—আপনি শশিবর্মাকে চেনেন?
অম্বিক নিজেও ততোধিক বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বললেন,
—শশিবর্মা? কে শশিবর্মা? এ চন্দ্রগুপ্ত! তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয়ে আমারই সহপাঠী ছিল। এ চন্দ্রগুপ্ত!
সৈনিকদের মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে। তারা সবাই চন্দ্রগুপ্তর নাম শুনেছে। গত কয়েক বছর ধরে চলতে থাকা মগধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রধান কাণ্ডারীর নাম চন্দ্রগুপ্ত। তবে কি এ-ই সে? তাদের ‘শশি’ই আসলে ‘চন্দ্র’?
অম্বিক তরবারি বের করে চন্দ্রগুপ্তর দিকে তুলে ধরেছেন। বললেন,
—এ এবং এর গুরু চাণক্যকে বিলক্ষণ চিনি আমি! তুই এখানে যবন সৈনিকের ছদ্মবেশে কী করছিস? আবার কী চক্রান্ত করছে তোর কুটিল গুরু কৌটিল্য?
চোখের পলকে নিজের কোমর থেকে তরবারি টেনে বের করে আনল চন্দ্রগুপ্ত এবং মুহূর্তে অম্বিকের হাত থেকে তরবারি ছিটকে গিয়ে পড়ল মাটিতে।
উন্মাদের মতো হেসে চলেছেন মহর্ষি দণ্ডায়ন। যেন কোনো অত্যন্ত মজার একটি নাটকের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছেন তিনি।
সেলুকাস চিৎকার করে উঠলেন,
—ছলনা! আমার সঙ্গে ছলনা!
তিনিও মুহূর্তে তরবারি বের করে আঘাত করলেন চন্দ্রগুপ্তকে। সমরূপ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সেই আঘাত নিজের তরবারি দিয়ে প্রতিহত করল চন্দ্রগুপ্ত।
লাফিয়ে দু-পা পিছিয়ে গিয়ে যুদ্ধ-প্রস্তুত অবস্থান নিল সে।
সেলুকাস চিৎকার করে আদেশ দিলেন,
—হত্যা করো এই ছদ্মবেশীকে!
যবন সৈনিকরা তরবারি বের করতেই তাদের এবং চন্দ্রগুপ্তর মাঝখানে এসে দাঁড়াল কয়েক জন ভারতীয় সৈনিক।
সেলুকাস তাকিয়ে দেখলেন তাঁদের ঘিরে ফেলেছে তাঁরই সৈনিকরা।
—বিশ্বাসঘাতকতা!
ভারতীয় সৈনিকদের সংখ্যা অনেক বেশি যবনদের তুলনায়। এই মুহূর্তে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। কী করা যায় ভেবে পেলেন না সেলুকাস। তবে, সম্রাটকে রক্ষা করতে হবে! যেকোনো মূল্যে অলকশেন্দ্রকে রক্ষা করতেই হবে।
অলকশেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে সেলুকাস দেখলেন অলকশেন্দ্র একইভাবে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। তাঁর মধ্যে আশঙ্কা, ভয় কোনোটাই নেই।
—ভয় পাবেন না শতরপ সেলুকাস। আপনাদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে আপনাদের কোনো ক্ষতি আমরা করব না।
বক্তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন সেলুকাস।
চন্দ্রগুপ্ত এগিয়ে এসে সেলুকাসের মুখোমুখি দাঁড়াল। বলল,
—আমার নাম চন্দ্রগুপ্ত। এই মুহূর্ত হতে, আমি এবং আমার ভারতীয় সহযোদ্ধারা যবনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছি।
তরবারি মাথার ওপর তুলে চিৎকার করে উঠল চন্দ্রগুপ্ত,
—জয় মা ভারতী!
‘চন্দ্রগুপ্তর জয়! জয় মা ভারতী!’
সমস্বরে যোগ দিল ভারতীয় সৈনিকরা।
চন্দ্রগুপ্ত বলল,
—আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না এই আশ্বাস আমি দিচ্ছি। তবে, আমরা আপনাদের ঘোড়াগুলো নিয়ে যাব, যাতে আপনারা আমাদের পিছু নিতে না পারেন। সতর্ক ভঙ্গিতে পিছিয়ে গিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসল ভারতীয়রা। প্রয়োজনে এক-একটি ঘোড়ায় দু-জন করে উঠল।
অলকশেন্দ্রর ঘোড়ায় উঠে চন্দ্রগুপ্ত সেটির লাগাম টেনে ধরতেই সেটি দু-পা তুলে একবার হ্রেষাধ্বনি দিয়ে নতুন আরোহীর বশ্যতা স্বীকার করল।
চন্দ্রগুপ্ত বলল,
—বিদায়, সম্রাট অলকশেন্দ্র। বিদায়, শতরপ সেলুকাস। মনে রাখবেন, ভারত কখনোই আপনাদের বশ্যতা স্বীকার করবে না। আপনারা এর পরেও এই পথে হাঁটলে আপনার পুনরায় সাক্ষাৎ হবে আমার সঙ্গে— যুদ্ধক্ষেত্রে!
ধুলো উড়িয়ে মিলিয়ে গেল ঘোড়াগুলো জঙ্গলের গাছের মধ্যে। দূর থেকে জয়ধ্বনি শোনা গেল,
—জয় মা ভারতী!
অম্বিক এখনও হতবুদ্ধির ন্যায় দাঁড়িয়ে। সে এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না কী ঘটল।
সেলুকাস ছুটলেন অলকশেন্দ্রর দিকে।
—সম্রাট! চলুন! আমাদের ফিরতে হবে। শিবিরে গিয়ে এই বিশ্বাসঘাতকদের সাজা দেব আমরা!
অলকশেন্দ্রর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তিনি উঠলেন না, সেলুকাসের কথা শুনতে পেলেন বলেও মনে হল না। কারণ, এখন তিনি টের পাচ্ছেন তাঁর আশেপাশের পরিস্থিতি পালটে যাচ্ছে। যে ভবিষ্যৎ তিনি জানতে এসেছেন, তা তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠছে, নিজের মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছেন তিনি। পৃথিবীর অধীশ্বর সম্রাটের মৃতদেহ, কী করুণ, কী অসহায়ভাবে শুয়ে আছে। সেই মুহূর্তে যেন সব কিছু উপলব্ধি করতে পারলেন তিনি, যা এতদিন তাঁর অধরা ছিল।
অলকশেন্দ্রর চোখে শান্ত দৃষ্টি। হাত তুলে শান্ত হতে বললেন তিনি সেলুকাসকে। —আহ্ সেলুকাস! বিরক্ত কোরো না।
তিনি আবার ফিরলেন দণ্ডায়নের দিকে। বললেন,
—হে ড্যান্ডামিস। আমার যে আরও অনেক প্রশ্ন আছে। আপনি কি আমার সংশয় দূর করবেন?
অলকশেন্দ্রর কাঁধে হাত রাখলেন যোগী দণ্ডায়ন। বললেন,
—অবশ্যই, অলকশেন্দ্র। আজ তোমার মনের সমস্ত সংশয় দূর করব। আজ তুমি নিজের মিথ্যে অভিমান ত্যাগ করেছ। মনুষ্যত্বকে আলিঙ্গন করে এই প্রথমবার তুমি সঠিক অর্থে দেবপুত্র হয়ে উঠেছ!
উপসংহার:
চন্দ্রগুপ্ত জঙ্গল থেকে সোজা চলে আসে সেনাশিবিরে। ভারতীয় সৈনিকরা অনেকদিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিদ্রোহের। শশিবর্মার প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে ভারতীয় সৈনিকদের মনের যেটুকু সংশয় অবশিষ্ট ছিল, তাও দূর হল।
ভারতীয় শিবিরের অধিকাংশ সৈনিক বিদ্রোহীদলে যোগ দিয়ে চন্দ্রগুপ্তর সঙ্গে শিবির ত্যাগ করল।
তারপর?
বাকিটা ইতিহাসের পাতায় আমরা খুঁজে পাই। ভারতীয়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করায় যবন সৈনিকদের মনের প্রত্যয় ভেঙে পড়ে। যবনরা বুঝতে পারে যে, এই দুর্বল অল্পসংখ্যক সেনাবাহিনী নিয়ে ভারতজয় অসম্ভব।
৩২৬ খ্রিস্টপূর্বে হাইডাসপেসের যুদ্ধের পরেই ভারত ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন অলকশেন্দ্র। ভারত মহাদেশ ও তার আশেপাশের দেশের দায়িত্ব তিনি সেলুকাসের হাতে সমর্পণ করে ফেরার পথ ধরেন।
কিন্তু, নিজের দেশে আর কোনোদিন ফেরা হয়নি অলকশেন্দ্রর। অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বের মাঝামাঝি নাগাদ অলকশেন্দ্র মারা যান ব্যাবিলন শহরে।
শোনা যায় ভারত সফরের পর অলকশেন্দ্রর হৃদয় পরিবর্তন হয়েছিল। জনশ্রুতি আছে যে, অলকশেন্দ্র মৃত্যুর পূর্বে নিজের শেষ ইচ্ছায় বলেছিলেন,
—আমার শেষযাত্রার সময়ে পথে স্বর্ণ ও মণিমুক্তা ছড়িয়ে দিয়ো, যাতে মানুষ দেখে যে বিশ্বের সমস্ত ঐশ্বর্য একদিন ধুলোতেই মিশে যায়। আমার অন্তিম যাত্রায় আমার হাত দুটো শবাধারের বাইরে রেখো। যাতে সবাই আমার খালি হাত দুটো দেখতে পায়। তারা যেন বোঝে যে, মানুষকে এভাবেই একদিন খালি হাতে সব মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হয়। সম্রাটের এবং ভিক্ষুকের, সমস্ত মানুষের শেষ পরিণতি একই।
অলকশেন্দ্র মহানের মৃত্যুর ঠিক একবছর পরেই মগধের সিংহাসনে বসেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।
.
এই কাহিনি দুই সম্রাটের। একজন যিনি অর্ধেক পৃথিবী জয় করেও ভারতবর্ষের সিংহাসনে বসতে পারেননি। আর, দ্বিতীয়জন যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করে, ভারতের সিংহাসনে বসেছিলেন এবং এই বিশাল দেশের অধিকাংশই জয় করেছিলেন। অখণ্ড আর্যাবর্তের প্রথম সম্রাট হয়েছিলেন তিনি।
এদের দু-জনের মধ্যে কে মহান?
এ প্রশ্ন বৃথা।
***
Author’s note:
১. এই কাহিনি কাল্পনিক হলেও এর সমস্ত চরিত্র, স্থান এবং কাল ঐতিহাসিক সত্য।
২. আলেকজান্ডারের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তর কোনোদিন সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না, বা, গ্রিক সেনাদের মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত ছদ্মবেশে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন কি না, সেকথা ইতিহাসে লেখা নেই। এই ঘটনাক্রম সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
৩. মহর্ষি দণ্ডায়নের সঙ্গে আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎ বাস্তবে হয়েছিল। তাঁদের মধ্যকার কথোপকথন গ্রিকদের লিপিকার ‘Alexander — Dandamis colloquy’-তে বিশদে বর্ণনা করা আছে। তার থেকেই কিছু সংলাপ এই কাহিনির শেষ অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও দণ্ডায়নের ভবিষ্যদ্বাণী বা চন্দ্রগুপ্তর উল্লেখ তাতে নেই।
৪. আলেকজান্ডার ও গ্রিক পণ্ডিত ডায়াগোরাসের সাক্ষাতের ঘটনা সত্যি।
৫. জনশ্রুতি আছে যে, গ্রিকরা অশুভ সংকেতের ভয়েই ভারত ত্যাগ করেছিল। তা ছাড়া, গ্রিকরা যুদ্ধক্লান্ত ছিল এবং ভারতীয় সৈনিকরা বিভিন্ন শিবিরে বিদ্রোহ করছিল। অনেক conspiracy theorist-দের মতে তাদের কেউ ভয় দেখিয়ে তাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে আঘাত করেছিল। অনেকেরই মতে পুরোটাই কোনো এক নেপথ্যে থাকা ব্যক্তির মস্তিষ্কপ্রসূত ষড়যন্ত্র। সেই ব্যক্তি কি চাণক্য?
ইতিহাসের পাতায় এই অধ্যায় হারিয়ে গিয়েছে।
* * *
1. Alexander the Great– wiki
2.।ndian Campaign of Alexander– wiki
3. Diogenes– wiki
4. ‘Alexander Senki’ anime series
5. The fascinating encounter between Alexander the Great and Dandamis–
by Prakash Joshi Pax, The Lessons from History. (https://medium.com/…/the-fascinating-encounter-between…)
6. Alexander’s encounter with Dandamis at Taxila- by Paramhansa Yogananda (https://bharatabharati.in/…/alexanders-encounter-with…/)
7. Chandragupta Maurya– 2011 series.