ইতি বিষ্ণুপ্ৰিয়া

ইতি বিষ্ণুপ্রিয়া

১.

—আচার্য ভদ্রভট্ট।

—বলুন, আচার্য সহদেব।

—আপনার আশ্রমের নতুন ছাত্রটি কতদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকতে পারবে বলে অনুমান করেন?

কথাটা সহদেব নেহাত মজার ছলে বললেও ব্যপারটা যে ভদ্রভট্টর মাথাতেও প্রথমেই আসেনি সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মহাবিদ্যালয় যতটা গরিমাময়, ততটাই নিষ্ঠুর। তক্ষশিলা বহু পণ্ডিত আচার্য ও মেধাবী ছাত্রর নিদারুণ পরিশ্রমে শ্রেষ্ঠ স্থান পেয়েছে গোটা বিশ্বে। এবং, সেই মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় বদ্ধপরিকর। তাই এখানকার নিয়মকানুন প্রচণ্ড কঠোর এবং সমস্ত বিষয়ের পাঠ্যক্রম অসম্ভব কঠিন।

প্রচলিত আছে যে, তক্ষশিলার বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দুটি মুদ্রা চলে— মেধা ও পরিশ্রম! এখানে উচ্চমেধার ছাত্রদের মধ্যে চলে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রথম কয়েক মাসে যদি কোনো আচার্য মনে করেন যে, ছাত্র তাঁর আশ্রমে, তার পাঠ্য বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে অনুপযুক্ত; তবে তাকে যেকোনো মুহূর্তে আচার্য তাঁর আশ্রম ত্যাগ করতে বলতে পারেন। সেক্ষেত্রে হয় সেই ছাত্রকে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে অন্য আশ্রমে ঢুকতে হয়, বা, বিদায় নিতে হয় বিদ্যালয় ছেড়ে। এই নিয়ম শুধুমাত্র সাধারণ ছাত্রদের ক্ষেত্রেই নয়, রাজকুমারদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অতএব, সাধারণ মেধার ছাত্রদের শুধুমাত্র টিকে থাকতেই করতে হয় অনেকটা অধিক পরিশ্রম।

আচার্য ভদ্রভট্ট আর আচার্য সহদেব এই মুহূর্তে বসে আছেন ভদ্রভট্টর আশ্রমের প্রাঙ্গণে। আজকের তাপমাত্রা বড়োই বেশি। সন্ধ্যার পরেও কুটিরের ভেতর বেশ গরম। তাই ভদ্রভট্ট কুটিরের বাইরেই বটবৃক্ষর নীচে বসে ছিলেন।

জায়গাটা পাথর দিয়ে বাঁধানো। হালকা হাওয়া আসছে দক্ষিণ থেকে, তাতে গরম অনেকটা কমছে ধীরে ধীরে। দূর থেকে তেল—প্রদীপ হাতে সহদেবকে আসতে দেখে হাত তুলে তাঁকে ডাক দিতে তিনি এসে যোগ দিয়েছেন ভদ্রভট্টর সঙ্গে। কথার মধ্যে ভদ্রভট্টর আশ্রমে সদ্য যোগ দেওয়া নতুন ছাত্রটির প্রসঙ্গ উঠল।

সহদেবের কথায় খানিকটা চিন্তিত হলেন ভদ্রভট্ট। আশঙ্কা তাঁর মনেও এসেছে। নতুন ছাত্রটি আর পাঁচটা ছাত্রর মতো নয়। শরীর দুর্বল, কৃষ্ণবর্ণ ও মিতভাষী। ভদ্রভট্ট বললেন,

—বিষ্ণুর কথা বলছেন?

—তার নাম বুঝি বিষ্ণু? বিষ্ণুদত্ত?

—বিষ্ণুগুপ্ত। ব্রাহ্মণসন্তান। জন্ম মগধে। বহুদূর থেকে, অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসেছে এখানে। শুধুমাত্র শিক্ষালাভের আশায়।

ইতিমধ্যে ভদ্রভট্টর সদ্য কিশোরী ভগিনীটি তাঁদের জন্যে ঘরে বানানো সামান্য চালভাজা আর জল এনে দিয়ে গেল। ভদ্রভট্টর পরিবার বলতে শুধুই এই কিশোরী ভগিনী আর তিনি। আশ্রমেই তাঁদের পাকাপাকি ঠিকানা। তাঁদের সামনে চালভাজা রেখে মেয়েটি অদূরেই একটা পুতুল নিয়ে খেলতে মশগুল হয়ে গেল।

—সে তো সবই বুঝলাম, কিন্তু ছেলেটা একটু কেমন যেন। অন্য ছাত্রদের সঙ্গে মিশে চলতে পারবে বলে মনে হয় না। তার ওপর ছাত্ররাও তো খুব একটা সুবিধার নয় এখানকার। নতুনদের উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করবেই। আর এই নতুন ছাত্রটির চেহারাটাও …

কথাটা শেষ করলেন না ইচ্ছে করেই। তিনি জানেন ভদ্রভট্টর মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হবে না। কিন্তু, তাঁর কথা শেষ হতেই কিশোরীকণ্ঠে সহদেবের বাক্যর শেষটুকু বলে উঠল দূরেই বসে পুতুল খেলতে থাকা ভদ্রভট্টর কিশোরী বোন,

—কুরূপ! ছেলেটাকে দেখতে কী বাজে! দাঁতগুলো সব বাঁকা!

তার কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে হাসি চাপলেন সহদেব। কিন্তু, ভদ্রভট্টর মুখ গম্ভীর হল। খুব নরম অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন,

—সুভাষিণী! তোমায় কতদিন বলেছি না যে, মানুষের রূপ ঈশ্বরপ্রদত্ত। তাই কোনো মানুষের শারীরিক ত্রুটি বা রূপ নিয়ে কাউকে অপমান করার অর্থ স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে অপমান করা।

সুভাষিণী মাথা নত করে পুতুলের কাপড়ে আঙুল বোলাতে বোলাতে নীচুস্বরে বলল,

—ক্ষমা করে দাও। আর ভুল হবে না।

বেশ। আর কখনো এমন করবে না, সুভাষ। মনে রেখো, মানুষের বাহ্যিক রূপ দেখে যারা মানুষের বিচার করে, তারা মহা মূর্খশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। যাও, ওদিকে গিয়ে খেলা করো।

সুভাষিণী উঠে চলে যেতে সহদেব বললেন,

—তোমার বোনটি নাহয় কিশোরী, তাকে চুপ করালে। কিন্তু, অন্য ছাত্ররা এই নতুন ছেলেটির প্রতি এতটা উদারমনস্ক হবে বলে মনে হয় না। দুর্বল ছাত্রটিকে ওরা ছিঁড়ে খাবে হে! না হে না, এই ছেলে তক্ষশিলায় বেশিদিন টিকতে পারবে না।

—দুর্বল…?

কিছুটা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতেই স্বগতোক্তি করলেন ভদ্রভট্ট। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

—আচ্ছা আচার্য সহদেব, আপনি এই নতুন ছাত্রটির চোখ দুটি দেখেছেন?

খানিকটা অবাক হয়েই সহদেব বললেন,

—চোখ? না… সেভাবে তো খেয়াল করিনি।

—ওর চোখ দুটো দেখলে কিন্তু আমার মনে হয়, এত সহজে আপনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পারতেন না। আমি ওই ছাত্রটির চোখ দুটো দেখেছি।

—কেন? কী দেখেছেন ওই চোখে, আচার্য ভদ্রভট্ট?

আকাশের দিকে তাকিয়ে ভদ্রভট্ট উত্তর দিলেন, —অগ্নি!

২.

আজকে বাইরে প্রখর রোদ। তাই পাঠ চলছে আশ্রমের কুটিরের অন্দরেই। আচার্য ভদ্রভট্ট একটি শ্লোক পাঠশেষে প্রশ্ন করলেন,

—একজন উত্তম রাজার মধ্যে কী কী গুণ থাকা উচিত? বলো দেখি তোমরা ছাত্ররা। পাঠ থেকে আমরা কী শিখলাম?

এক এক করে কিছু ছাত্রর উত্তর এল,

—বংশ পরিচয়!

—সাহস!

—বীরত্ব!

আরও বেশ কিছু এরকম উত্তর এল ছাত্রদের মধ্যে থেকে। আচার্য লক্ষ করলেন একদম শেষ সারির কোণে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে এক ছাত্র। ছেলেটি শ্লোক পাঠের সময়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।

কিন্তু, এখন হঠাৎ তাকে অমনোযোগী দেখে খানিকটা ক্ষুণ্ণ হলেন ভদ্রভট্ট। তিনি সেই ছাত্রকেই উদ্দেশ করে প্রশ্ন করলেন,

—তোমার কী মনে হয়, বিষ্ণুগুপ্ত? একজন রাজার মধ্যে কী গুণ থাকা উচিত? বিষ্ণুগুপ্ত আচার্যর দিকে ফিরে, প্রণাম জানিয়ে উঠে দাঁড়াল। নির্দ্বিধায় উত্তর দিল,

—ভয়! রাজার মনে ভয় থাকা উচিত।

সবাই হেসে উঠল তার কথায়। ভদ্রভট্ট আর যাই হোক এই উত্তর আশা করেননি। কিন্তু, তিনি বুঝতে পারলেন যে, বিষ্ণুগুপ্ত আরও কিছু বলতে চায়, তার উত্তর শেষ হয়নি। তাই তিনি হাত তুলে অন্য ছাত্রদের শান্ত হতে বললেন। প্রত্যেকে চুপ করতে বিষ্ণুগুপ্ত উত্তর দিল,

—রাজার মনে তাঁর প্রজাদের নিয়ে ভয় থাকা উচিত! একজন রাজা তখনই জনহিতে সিদ্ধান্ত নেবেন যখন তাঁর মনে ভয় থাকবে যে, তাঁর নেওয়া ভুল সিদ্ধান্তে তাঁর প্রজারা ক্ষুণ্ন হতে পারে। আর, প্রজারা ক্ষুণ্ন হলে রাজার রাজ্যহারা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ভদ্রভট্টর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। তিনি প্রশ্ন করলেন,

—কিন্তু রাজা সবসময় রাজ্য হারানোর ভয় মনে রেখে সিদ্ধান্ত নিলেই কি তা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে?

—না, তা নয়। কিন্তু, একজন রাজা যদি মনে করেন তাঁর কোনো আদেশ বা সিদ্ধান্তর ফলে প্রজাদের মধ্যে সাময়িক অসন্তোষ সৃষ্টি হলেও, সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে তা আগামীতে প্রজাদের জন্যে লাভজনক; সেক্ষেত্রে যতই কঠিন হোক না কেন সেই সিদ্ধান্তেই রাজাকে অটল থাকতে হবে।

—অর্থাৎ, রাজার উচিত সর্বদা রাজ্যের হিতের কথা ভাবা? কিন্তু, তা করতে গিয়ে সে প্রজাদের মধ্যে জনপ্রিয়তা হারালে?

বিষ্ণুগুপ্ত কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। কারণটা সম্ভবত আচার্য অনুমান করতে পারছেন। কিছু অপ্রিয় সত্য বলার অপরাধে বিষ্ণুগুপ্তর পিতা চণক পণ্ডিতের ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করেছেন মগধ নরেশ।

ভদ্রভট্ট তাকে আশ্বস্ত করে বললেন,

—নির্ভয়ে বলো। এখানে আমরা সবাই সমান। আমরা প্রত্যেকেই মা সরস্বতীর সম্মুখে ভিক্ষুক মাত্র।

বিষ্ণুগুপ্ত বলল, —ক্ষমা করবেন, আচার্য। কিন্তু, জনপ্রিয় হওয়া রাজার কাজ নয়। নগরের নটী, গায়িকা, গণিকারা অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। তার মানে এটা নয় যে, তাদের হাতে আমরা রাজ্যের শাসন তুলে দেব। রাজা ও তাঁর অমাত্য, এদের ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে গোটা রাজ্য। প্রয়োজনে বহু অ—জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত তাঁদের নিতে হবে, কিন্তু তা যেন প্রজাদের হিতেই হয়।

কুটিরে উপস্থিত প্রতিটা ছাত্র রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে এই বুঝি আচার্য ফেটে পড়বেন ক্রোধে এবং দণ্ডিত করবেন এই ছাত্রকে। কিন্তু, ঘটল ঠিক বিপরীত। আচার্য হেসে উঠে বললেন,

—বিষ্ণুগুপ্ত, মনে হচ্ছে তোমার উত্তর এখনও শেষ হয়নি। এক কাজ করো, আজ সন্ধ্যার পর আশ্রমে এসো। আমি তোমার মতামত শুনতে ইচ্ছুক। আপাতত এই প্রসঙ্গে আলোচনা দীর্ঘায়িত হলে আজকের পাঠে বিঘ্ন ঘটবে।

রোজকার পাঠ আবার শুরু করলেন আচার্য ভদ্রভট্ট।

সেদিন সন্ধ্যার দিকে ভদ্রভট্টর গৃহের সামনে এসে দাঁড়াল বিষ্ণুগুপ্ত। তাকে আচার্য আসতে বলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা আন্তরিক ইচ্ছায়, নাকি, শুধুমাত্র পাঠে সময় নষ্ট করা থেকে তাকে বিরত করতে, সে—বিষয়ে বিষ্ণু এখনও নিশ্চিত নয়।

তাই কুটিরের দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে দোলাচলে ভুগতে শুরু করল চাণক্য। এই অবসর সময়ে আচার্যকে বিরক্ত করা ঠিক হবে কি না সে—বিষয়ে নিশ্চিত নয় বিষ্ণু। নাহ্, তার ভুল হয়েছে আজ পাঠশালে অত্যধিক কথা বলা। মনের কথা সবসময়ে মুখে আনা উচিত নয়, এটা সে বুঝেছে নিজের পিতার পরিণতি দেখে।

কিন্তু, এতদূর এসে ফিরেও যাওয়া যায় না। আচার্য বলার পরেও সে আসেনি জানলে হয়তো—বা তার ওপর উলটে কুপিত হবেন ভদ্রভট্ট। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিষ্ণু দ্বারে কড়া নাড়ল। ভেতর থেকে কেউ দরজা খুলল না। আরও একবার কড়া নাড়া উচিত হবে, নাকি, সে বিদায় নেবে এই চিন্তায় যখন সে ডুবে আছে, তখনই দরজা খুলে গেল। বিষ্ণুগুপ্ত দেখল দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি কিশোরী। পরনে সাধারণ একবস্ত্র পোশাক, খোলা চুল কোমর ছাড়িয়েছে। কেমন একটা জুঁই ফুলের সুগন্ধ এসে বিষ্ণুগুপ্তর নাকে লাগল। কিশোরী মুখের কাছে একটি প্রজ্বলিত প্রদীপ ধরে আছে। সেই আলোয় মেয়েটির অদ্ভুত সুন্দর মুখটা দেখে কিছুটা থমকে গেল বিষ্ণুগুপ্ত। কয়েক মুহূর্তমাত্র মেয়েটির চোখে চোখ রেখেছিল বিষ্ণু, তারপরেই চোখ নামিয়ে নিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,

—আমি… আমি… মানে, আচার্য আসতে বলেছিলেন। কিশোরী নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,

—জ্যেষ্ঠ তো গৃহে নেই। তুমি তো এই বিদ্যালয়ের ছাত্র। জানো না এই সময়ে রাজকুমারদের অতিরিক্ত পাঠশালা চলে?

বিষ্ণুগুপ্ত জানত, কিন্তু ভুলে গিয়েছে। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,

—ক্ষমা করবেন। আ… আমি তবে আসি।

দ্রুত পেছন ঘুরে হাঁটা দিতে যাচ্ছিল বিষ্ণুগুপ্ত, কিন্তু পেছন থেকে কিশোরী কণ্ঠে আদেশের সুর ভেসে এল,

—দাঁড়াও! যাচ্ছ কোথায়? আমি কি যেতে বলেছি তোমায়?

দাঁড়িয়ে গেল বিষ্ণুগুপ্ত। কী বলা উচিত বুঝতে না পেরে নিজের জায়গায় চুপচাপ মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল সে। মেয়েটি দরজা ছেড়ে ভেতরে ঢুকে গিয়ে ডাকল,

—ভেতরে এসে অপেক্ষা করো এখানে বসে। জ্যেষ্ঠ আসার সময় হয়েছে। তিনি এসে পড়বেন এখুনি।

পেতে দেওয়া আসনে বিষ্ণুগুপ্ত কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বসল। মেয়েটি কিন্তু গেল না। কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক তাকে দেখছিল। তার দৃষ্টির সামনে বিষ্ণু আরওই কুণ্ঠাবোধ করতে লাগল।

—তোমার নাম কী?

উত্তরটা জেনেও প্রশ্ন করল সুভাষিণী।

—বিষ্ণুগুপ্ত।

—শুধু বিষ্ণুগুপ্ত?

—বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য।

—চাণক্য? বড়ো অদ্ভুত নাম।

—পণ্ডিত চণক পুত্ৰ চাণক্য।

নামটা শুনে কিছুটা চমকাল কিশোরী। প্রশ্ন করল,

—তুমি চণক পণ্ডিতের ছেলে? তাঁকে তো শুনেছি…

কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল সুভাষিণী। বিষ্ণুগুপ্ত অন্যদিকে তাকাল।

—নিজের নামের সঙ্গে সর্বদা নিজের পিতৃপরিচয় দেবে, বিষ্ণু। মনে রেখো, তিনি একজন মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর নাম সর্বদা উচ্চারণ করবে গর্বের সঙ্গে। কথাটা ভেসে এল দরজার দিক থেকে। গৃহে প্রবেশ করলেন আচার্য ভদ্রভট্ট।

উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে প্রণাম জানাল বিষ্ণুগুপ্ত। হাসিমুখে ভদ্রভট্ট বললেন,

—আমার ভগিনীটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে দেখছি তোমার।

—হ্যাঁ, আচার্য।

প্রতিবাদ করে উঠল কিশোরী,

—মোটেই নয়। আমাদের পরিচয় হয়নি। বিষ্ণুগুপ্ত আমার নামই জানতে চায়নি। হেসে ভদ্রভট্ট বললেন,

—এ তো ভারি অন্যায়, বিষ্ণুগুপ্ত। তুমি এক্ষুনি ওর থেকে নাম জিজ্ঞেস করো। বিষ্ণুগুপ্ত মেয়েটির দিকে ফিরে প্রশ্ন করল,

—তোমার নাম কী?

মুখ ফিরিয়ে ভেতর দিকে যেতে যেতে কিশোরী উত্তর দিল,

—সুভাষিণী।

ভদ্রভট্ট তাঁর ছাত্রটিকে বসতে ইঙ্গিত করে নিজেও তার সম্মুখে বসলেন। প্রশ্ন করলেন,

—জনপদ ও সংযুক্ত রাষ্ট্রর বিষয়ে তোমার মতামত কী, বিষ্ণুগুপ্ত?

গৃহের ভেতর থেকে সুভাষিণী শঙ্খ বাজাল। রাত্রির প্রথম প্রহরের সূচনার সঙ্গেসঙ্গেই সেই ধ্বনি যেন ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনার ঘোষণা করে দিচ্ছিল।

৪.

সময়কে নদী বলা হয় কারণ তা প্রতিক্ষণে শুধু বয়ে চলে। কিন্তু, মাঝে মাঝে নদীতে যেমন জোয়ার এসে জল ফুলে উঠে ভাসিয়ে নিয়ে যায় শহর, গ্রাম। সৃষ্টি হয় সব কিছু নতুনভাবে। ঠিক সেভাবেই কিছু মানুষ, কিছু ঘটনা এই সময়নদীতে সৃষ্টি করে উত্তাল জোয়ার—ভাটা।

নিজের গতিতেই সময় বয়ে যেতে লাগল তক্ষশিলায়। বিষ্ণুগুপ্ত নিয়মিত আসে আচার্য ভদ্রভট্টর গৃহে। মাঝে মাঝেই তাদের আলোচনা রাত গড়িয়ে শেষ হয় ভোরের আলো ফোটার আগে। তাদের সম্পর্ক এখন আচার্য—ছাত্র অতিক্রম করে গুরু—শিষ্য পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে মাত্র কয়েক বছরে। রাষ্ট্র, রাজনীতি, যুদ্ধনীতি, অর্থনীতি, অপরাধবিজ্ঞান, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রহরের পর প্রহর আলোচনা হয় আচার্য আর ছাত্রর মধ্যে। অনেকেই চেষ্টা করেছে এই আলোচনায় যোগ দেওয়ার, কিন্তু তারা এই দু—জনের কথাবার্তায় হয় হীনমন্যতা নিয়ে আলোচনা ত্যাগ করেছে অথবা ভয় নিয়ে। কারণ, তাদের আলোচনা পাঠ্যপুস্তকের গণ্ডি অতিক্রম করে মাঝে মাঝেই যে পর্যায়ে পৌঁছে যেত তা শুধুমাত্র আলোচনা করাটাও রাষ্ট্রদ্রোহ হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে।

তবে, সেই প্রথম দিন থেকে তাদের এই আলোচনার একজন নীরব শ্রোতা ছিল— কুমারী সুভাষিণী। ভেতরের কক্ষের দ্বারের গায়ে হেলান দিয়ে নিবিষ্ট মনে শুনে যেত সে এই দু—জনের আলোচনা।

এভাবেই তার কানে এসেছিল বিষ্ণুগুপ্তর অতীতের কিছু কথা।

যেমন, বিষ্ণুগুপ্তর পিতা চণক ছিলেন মগধের তৎকালীন শাসক উগ্রসেনের সভাপণ্ডিত। উগ্রসেন ও তাঁর পুত্রদের একই দিনে হত্যা করে সিংহাসন দখল করে তাঁর অবৈধ সন্তান, ক্ষৌরকার মহাপদ্মানন্দ। এবং, সেই সঙ্গেই রাহু গ্রাস করল মগধকে।

বিদ্রোহ দমন করতে, যুদ্ধ লড়ে ছোটো জনপদের রাজাদের নিজের বশ্যতা স্বীকার করাতে টান পড়ল রাজকোষে। এবং, সেই কারণেই আরও স্বর্ণ ও ধন রাজকোষে আনতে শুরু হল প্রজাদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া। এবং, তা দিতে না পারলে রাজার সৈনিকদের হাতে তাদের উৎপীড়ন। এই অবধি তাও চলছিল। এরপর নন্দ একটি কাজ করলেন যার ফলে গর্জে উঠল দেশের শিক্ষিত মানুষদের একাংশ। নন্দ চড়া কর বসালেন মৃতদেহের দাহকাজে ব্যবহার হওয়া কাঠের ওপর। অর্থাৎ, উপযুক্ত দাম রাজকোষে না দিলে পরিবারের মৃত মানুষটার সৎকার পর্যন্ত করা যাবে না। শ্মশানে নিজের সন্তানের মৃতদেহকে চিল, শকুনের খাদ্য হতে দেখল বহু গরিব। বহু স্ত্রী তার সদ্যমৃত স্বামীর চিতার কাঠ ক্রয় করার ধন একত্রিত করতে বাধ্য হল কোনো ধনী ভিনদেশি বণিকের শয্যাসঙ্গী হতে।

এই অনাচার দেখে যে কয়েক জন শিক্ষিত মানুষ প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিষ্ণুগুপ্তর পিতা চণক। আর তার ফল হয়েছিল ভয়াবহ!

একদিন রাত্রে হঠাৎ রাজসৈনিকরা এসে বিষ্ণুগুপ্ত ও তার মায়ের চোখের সামনে তুলে নিয়ে যায় তার পিতাকে। পরেরদিন পাটলিপুত্রর প্রধান সড়কের ধারে একটি বৃক্ষ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয় চণকের মৃতদেহ। সারাশরীরে অকথ্য অত্যাচারের চিহ্ন স্পষ্ট। জায়গায় জায়গায় তার চামড়া তুলে সেখানে লবণ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে দুর্মূল্য লবণ সাধারণের খাদ্যের তালিকায় ওঠে না, তা অত্যাচারের কাজে ব্যবহার করতে নন্দরাজ কার্পণ্য করেননি।

রাজার আদেশে অতি উচ্চ করেরও প্রায় তিনগুণ দামে চণকের পরিবারের কাছে দাহকার্যের কাঠ ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করা হয়, যা জোগাড় করতে কপর্দকশূন্য হল বিষ্ণুগুপ্ত ও তার মাতা। স্বামীর সেই ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহর দৃশ্য তিনি সহ্য করতে পারেননি। এর কয়েক বছরের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর।

তবে তার আগে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে প্রায় উন্মাদিনী হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

৫.

ক্রমেই গোটা বিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যর নাম। এ ছাড়াও অসাধারণ মেধাবী হিসাবে যে কয়েক জন ছাত্রর নাম সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চারিত হত তাদের মধ্যে শঙ্কুমণি ও কাত্যায়নের নাম ছিল অগ্রগণ্য। এই দু—জনও ছিল আচার্য ভদ্রভট্টর শিষ্য। কারণ, যেভাবে ফুলের মধু ভ্রমরদের আকর্ষণ করে, সেভাবেই মেধাবীকে আকৃষ্ট করে জ্ঞানী। ইতোমধ্যে ভদ্রভট্টর জ্ঞানের কথাও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যেতে শুরু করেছিল। বিভিন্ন জ্ঞানসভায় তাঁকে আমন্ত্রণ করা হতে লাগল নিয়মিত। বড়ো বড়ো পণ্ডিতরা তাঁর বক্তৃতা ও তর্ক শুনে সাধুবাদ জানাতে লাগলেন। তাই সেই দশকের সেরা ছাত্ররা যে, আচার্য ভদ্রভট্টর ছত্রছায়ায় আসবে, এতে কেউই অবাক হয়নি। প্রত্যেক মেধাবী ছাত্ৰই তাঁর সান্নিধ্যে আসতে চাইত। বিশেষ করে বিষ্ণুগুপ্ত ও শঙ্কুমণি।

তবে, বিষ্ণুগুপ্তর ক্ষেত্রে তার মেধার চেয়েও যেটা ছাত্রদের মুখে মুখে বেশি ছড়িয়েছিল তা হল, বিষ্ণুগুপ্তর অদ্ভুত স্বভাবের কথা। সে যেন সব কিছুতে থেকেও নেই। তাকে অনেকেই ভয় করত এবং সমীহ করে চলত।

কিন্তু, এ কাহিনি বিষ্ণুগুপ্তর নয়। এ কাহিনি যাকে নিয়ে সেই সুভাষিণী ও কালের নিয়মেই কিশোরী থেকে সদ্যযৌবনা হল। তাকে দেখলে মনে হবে দেবতারা অনেকটা সময় নিয়ে, কোনোরকম কার্পণ্য না করে তাকে সাজিয়ে তুলেছে। তার রূপের তুলনা করা চলে স্বয়ং দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে।

তবে, সেও কোনো সাধারণ মেয়েটি নয়। সে নিজেকে ভদ্রভট্টর সুযোগ্য ভগিনী হিসেবে প্রমাণ দিয়েছে। তার প্রজ্ঞার সামনে নত হয়েছে অনেক পণ্ডিত ও মেধাবী ছাত্র। এই বছরের বিদ্যালয়ের জ্ঞানসভায় তাকে বক্তব্য রাখতে বলা হয়েছে। তার কণ্ঠে যেন বসবাস করেন স্বয়ং দেবী সরস্বতী। বীণা বাজিয়ে যখন সে সন্ধ্যায় কল্যাণ রাগে সুর তোলে তখন আশেপাশের সবাই কাজ ফেলে মুগ্ধ হয়ে বসে শুনতে বাধ্য হয়।

আরও একজন তার রাগ নিত্যদিন শোনে। কিন্তু, এত বছরে কোনোদিন একটি প্রশংসাবাক্য সে ব্যবহার করেনি। যখন সুভাষিণী বীণা সহযোগে গান ধরে তখন তার কুটিরের অদূরে একটি বৃক্ষের নীচে বসে শোনে যুবক বিষ্ণুগুপ্ত। সেই কয়েকটা মুহূর্তের জন্যে সে যেন ভুলে যায় তার জীবনের যাবতীয় অন্ধকার অধ্যায়। সেই কারণে নিজেকে বার বার দোষ দেয় সে। কারণ সে ভুলতে চায় না, সে মনে রাখতে চায়!

এই কয়েক বছরে খুব অল্প কথা হয়েছে বিষ্ণুগুপ্ত ও সুভাষিণীর। বিষ্ণুগুপ্ত ভয় পায়। হ্যাঁ, সে ভয় পায় এই মেয়েটির চোখের দিকে তাকাতে। ওই দৃষ্টিতে এমন কিছু যেন আজকাল সে দেখে যা তার কাছে অপরিচিত। সে তার দিকে ওঠা চোখে তার প্রতি সাধারণ মানুষের ভয় দেখেছে, সহপাঠীদের চোখে ঈর্ষা দেখেছে, শিক্ষকদের চোখে প্রশংসা দেখেছে, ভদ্রভট্টর চোখে স্নেহ দেখেছে। কিন্তু, সুভাষিণীর চোখের ভাষা সে পড়তে পারে না। বা, হয়তো পড়তে চায় না।

আর, সুভাষিণী? সে কি জানে তার নিজের অন্তরের কথা?

হ্যাঁ, সে জানে। কারণ, নিবিষ্ট চিত্তে রাগ চন্দ্রকৌশ সাধনার সময়ে তার মনে একজন যুবকের মুখ বারংবার ফুটে ওঠে। প্রকৃতি প্রতিটা নারীকে এই সহজাত ক্ষমতা দিয়েছে তার ভালোবাসার পুরুষের মনের কথা বুঝে ফেলার জন্য। সুভাষিণী জানে বিষ্ণুগুপ্তর মনের অন্তরের কথা। কিন্তু, বিষ্ণু যে বরাবরই নিজেকে তার থেকে সচেতনভাবে দূরে রাখে। তা কি শুধুই এই কারণে যে, সে তার গুরুর ভগিনী? বোধ হয় না।

সুভাষিণী ও ভদ্রভট্ট বিষ্ণুগুপ্তর অতীতের অনেক কথা জানে যা অন্য কেউ জানে না। তার মনের গভীরের অন্ধকারের কথা সে জানে।

যেমন কয়েক বছর আগে এক সন্ধ্যায় বিষ্ণুগুপ্ত তার গুরুর কাছে বলেছিল তার জীবনের একটি অতি ভয়ংকর ঘটনার কথা। সে বলছিল,

—আমি সম্পূর্ণ দাঁতের সারি নিয়েই জন্মেছিলাম। অর্থাৎ, আমার মুখে জন্ম থেকেই বত্রিশটা দাঁত ছিল। কোনো এক সাধু সেই দেখে আমার জন্মের পর বলেছিলেন এ নাকি রাজলক্ষণ। আমি নাকি রাজা হব ভবিষ্যতে।

ঘটনাটা আমার মাতার মৃত্যুর কয়েক দিন পূর্বের। আপনাকে তো আগেই বলেছি যে, আমার পিতার মৃত্যুর… (একটু থেমে)… হত্যার পর মা প্রায় উন্মাদিনী হয়ে গিয়েছিল। এমনিতে সুস্থ থাকলেও মাঝে মাঝে হঠাৎ তার মধ্যে বিকার দেখা দিত। একরাত্রে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম মায়েরই সঙ্গে। হঠাৎ মুখের মধ্যে একটা তীব্র যন্ত্রণায় ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে যে দৃশ্য দেখি তা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়ের দৃশ্য। আমার মা আমার সামনে বসে আছে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে। তার হাতে তুলে ধরা আছে মশলা পেশার ভারী পাথরটা। কিছু বোঝার আগেই সেটা নেমে আসে আমার খোলা মুখ লক্ষ করে! বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই আরও একবার মা আমার মুখের ওপর আঘাত করে। আমার মুখ তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমার সমস্ত দাঁত ভেঙে গিয়েছে! মুখ চেপে আতঙ্কে আমি সরে গেলাম একদিকে। শুনতে পেলাম আমার মা বলছে,

—বিষ্ণু! তুই রাজা হোস না, বাবা! রাজারা খুব খারাপ হয়! খুব, খুব খারাপ! রাজা তোর বাবাকে মেরেছে! তুইও কি শেষে তাই হবি? না, না, আয় তোর ওই দাঁত আমি ভেঙে দিই, বাবা! ওগুলো যে রাজলক্ষণ নয়, ও অভিশাপ!

পরক্ষণেই মা আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে এবং নিজের হাতের ভারী পাথরটা দেখে, সে একটু আগে কী করেছে তা উপলব্ধি করতে পেরে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছিল। সেই দাঁত পড়ে গিয়ে আবার দাঁত উঠেছিল বটে। কিন্তু, সেগুলো সব আঘাতের কারণে বক্র ওঠে।

অদ্ভুত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে গেল বিষ্ণুগুপ্ত। প্রতিদিনের মতোই তার এই কথাগুলো দরজার পেছন থেকে শুনছিল সুভাষিণী। নিজের মুখে দুই হাত দিয়ে চেপে চিৎকার করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিল সে! হে ঈশ্বর! একটু আগে যে ভয়ংকর ঘটনার বিবরণ সে শুনল তা কি সত্যি? সুভাষিণী টের পেল বিষয়টা কল্পনা করতেই তার সারাশরীর থরথর করে কাঁপছে।

সুভাষিণী জানে যে, বিষ্ণুগুপ্তর অতীতে এরকম অনেক ভয়ংকর ঘটনা আছে। এই অল্প আয়ুতেই তাকে এমন বহু অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে যা তার সমবয়সি কারুর কাছে দুঃস্বপ্নেরও অতীত। সুভাষিণী চায় তাকে এই সব কিছুর অন্ধকার থেকে টেনে আলোয় আনতে। কিন্তু, বিষ্ণুগুপ্ত যেন চায় না সেই আলোয় পদার্পণ করতে। সে যেন সচেতনভাবে তার মনের এই অন্ধকারকে পালন করছে। বার বার আঘাত করে যেভাবে অসি নির্মিত হয়, সেভাবেই যেন নিজের মনকে সে এই আঘাতগুলো দিয়ে অসির মতো ধারালো বানাতে চায়। কিন্তু, কেন? কেন? কেন কেন?

তাই রোজ সন্ধ্যায় বিরহের করুণ সুর তোলে সুভাষিণীর বীণা। দূরে অন্ধকার গাছের এককোণে তা শোনে বিষ্ণুগুপ্ত।

৬.

যে সমস্ত পুরুষ গোটা পৃথিবীর কাছে প্রস্তরসম কঠিন বলে পরিচিত, তাদের ভেঙে পড়তে, তাদের দুর্বলতার মুহূর্তের সাক্ষী থেকে গিয়েছে শুধুই তাদের প্রিয় নারীরা। সময় অনেকটাই ব্যয় হয়েছে। সুভাষিণী বিবাহযোগ্যা হয়েছে। তার পাণিপ্রার্থীর অভাব নেই। কিন্তু, সে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বিবাহ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। ইতিমধ্যে বিবাহ করেছেন ভদ্রভট্ট। তাঁকে কাজের সূত্রে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য তাদের সবচেয়ে যোগ্য শিক্ষকদের এভাবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে শিক্ষার আরও প্রসার ঘটানো। কে বলতে পারে, হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আর্যাবর্তর রাজধানীতেই গড়ে উঠবে তক্ষশিলার মতোই কোনো বিহার।

ভদ্রভট্টর বিবাহ হয়েছে কয়েক বছর পূর্বে, চেতি মহাজনপদের এক ব্রাহ্মণকন্যার সঙ্গে। তার নাম চিত্রা। ইতিমধ্যে তাঁদের একটি কন্যাসন্তানও হয়েছে। সুশীলা ও বুদ্ধিমান স্ত্রী চিত্রা। তক্ষশিলায় থাকাকালীন তার ননদিনীর মনের কথা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। সে ভেবেই রেখেছিল যে, এইবার বসন্ত উৎসবের অবসরে তার স্বামীর সঙ্গে সুভাষ আর বিষ্ণুর বিবাহের কথা তুলবে।

কিন্তু, নিয়তি যে তার ভাগ্যের খাতায় কী নিষ্ঠুর পরিণতি লিখে রেখেছিল, তা কেইবা জানত। মাত্র কয়েক বছরে যেন ঝড়ের দাপটে সব তছনছ হয়ে গেল এরপরেই।

হঠাৎ তাঁর শ্বশুরের স্বাস্থ্যের অবনতির খবর আসায় স্ত্রী, কন্যাকে নিয়ে চেতি দেশে যেতে হয় আচার্য ভদ্রভট্টকে।

কন্যার সেবায় সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর শ্বশুর। হঠাৎই জরুরি একটি কাজে শীঘ্রই অবস্তি যেতে অনুরোধ করা হয় ভদ্রভট্টকে। স্ত্রী, কন্যা সঙ্গে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু, তিনিই স্ত্রীকে বললেন,

—তুমি এখানেই থেকে আরও কয়েক দিন তোমার পিতার সেবা করো। আমি নাহয় অবস্তি ঘুরে আবার এখানেই ফিরে এসে, তারপর একসঙ্গে তক্ষশিলার উদ্দেশে রওনা দেব।

তাঁর ছোটোকন্যাটি তার প্রিয় পুতুল নিয়ে খেলছিল। তার মাথায় হাত রেখে ভদ্রভট্ট বললেন,

—পুতুল তোর বড়ো প্রিয়, না রে মা? দাঁড়া, অবন্তি থেকে তোর জন্যে একটা নতুন পুতুল নিয়ে আসব।

ভদ্রভট্ট অনুমান করতে পারেননি যে, তাঁর শ্বশুরের এই ক্ষণিকের সুস্থ হওয়াটা আসলে প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগের শেষবার দপ করে জ্বলে ওঠা ছিল। অবস্তি পৌঁছোনোর পূর্বেই বৃদ্ধর মৃত্যুসংবাদ তিনি পান এবং তৎক্ষণাৎ যাত্ৰা স্থগিত রেখে স্ত্রী—কন্যার কাছে ফেরার পথ ধরেন। দুইদিনের পথ অতিক্রম করলেই তিনি পৌঁছে যাবেন শ্বশুরগৃহে। কিন্তু, অদৃষ্টর মনে অন্য কিছু ছিল।

স্থানীয় লোকেরা সঠিক সময়ে মৃতদেহ সৎকার করে দিয়েছে। বৃদ্ধর মৃত্যুর পরের পরেরদিন চিত্রা পিতৃশোকে কাতর হয়ে স্বামীর অপেক্ষায় বসে ছিল কুটিরে। শিশুকন্যা আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন কান্নাকাটির পর ক্লান্ত, অবসন্ন চোখে ঘুম নেমে এসেছিল। জ্বলন্ত প্রদীপের পাশেই বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। খেয়াল করেনি, কখন জানি তার থেকে তার অঙ্গবস্ত্রের আঁচলে আগুন লেগে গিয়েছিল। ঘুম যখন ভাঙে ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রথমে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে গৃহে আগুন ধরে গেল। কন্যাকে বাঁচাতে গিয়ে বুঝতে পারল অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এই জতুগৃহ থেকে বেরোনোর একমাত্র পথ গ্রাস করেছে লেলিহান শিখা।

রাত্রির শেষপ্রহরে যখন ভদ্রভট্ট এসে পৌঁছোলেন, ততক্ষণে গ্রামবাসীরা আগুন নিভিয়ে ফেলেছে। আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া কুটিরের মধ্যে একটি স্ত্রীলোকের কোলে জড়িয়ে রাখা শিশুকন্যার ঝলসে যাওয়া মৃতদেহর সামনে এসে দাঁড়ালেন ভদ্রভট্ট। সেই বীভৎস, বিকৃত মৃতদেহর, নরমাংস, চুল ও চামড়া পোড়া গন্ধ সহ্য করতে পারলেন না তিনি। অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন নিজের মৃতা স্ত্রী ও কন্যাসন্তানের মৃতদেহর পাশেই।

তক্ষশিলায় যখন ভদ্রভট্ট ফিরলেন তখন তিনি একজন ভগ্ন, বিধ্বস্ত মানুষ। সুভাষিণী চিনতেই পারছিল না তার বলিষ্ঠ, সদাহাস্য জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে। ভগিনীকে দেখে ভেঙে পড়লেন আচার্য ভদ্রভট্ট। রাত্রে ঘুম আসত না ভদ্রভট্টর। চোখ বন্ধ করলেই তিনি আগুনের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রী—কন্যাকে দেখতেন। তাদের দগ্ধ মৃতদেহ দেখতে পেতেন। নাকে এসে লাগত সেই চামড়া পোড়া দহনঘ্রাণ!

রাতের পর রাত সুভাষিণীর কোলে মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদতেন ভদ্রভট্ট। ভগিনী নয়, মাতার মতো করেই এই সময়টা তাঁকে আগলে রেখেছিল সুভাষিণী। সব হারিয়ে নিজের একমাত্র সম্বল হিসেবে আরও বেশি করে অসহায়ের মতো সুভাষিণীকে আঁকড়ে ধরেছিলেন ভদ্রভট্ট।

আবার স্বাভাবিক হতে তাঁর কয়েক মাস লেগেছিল। নিরন্তর সে—চেষ্টা করে গিয়েছিল সুভাষিণী ও বিষ্ণুগুপ্ত।

কয়েক মাস পর আচার্য ভদ্রভট্ট খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর মধ্যে বৈরাগ্য দেখা দিল। তিনি ক্রমেই সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়লেন সংসারের প্রতি। নিজেকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে ও অধ্যয়নে। সম্ভবত নিদারুণ শোক ভুলে থাকার এই একটাই উপায় ছিল তাঁর কাছে।

বছর ঘুরতে—না—ঘুরতেই প্রধানাচার্য পদের জন্যে মনোনীত হলেন আচার্য ভদ্রভট্ট। এর আগেও বহুবার তাঁকে এই পদ গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু, এতদিন সংসারে সময় দেওয়ার জন্যে তিনি বারংবার আচার্য প্রমুখর পদ নিতে চাননি। কিন্তু, এইবার আর তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন না। এর কয়েক মাসের মধ্যেই তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানাচার্য হলেন আচার্য ভদ্রভট্ট।

৭.

ইতিমধ্যে অধ্যয়ন শেষ করে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছে বিষ্ণুগুপ্ত। একবছর হল তক্ষশিলাতেই শিক্ষক হয়ে যোগ দিয়েছে। আশানুরূপভাবেই কাত্যায়ন মগধ সভায় যোগ দিয়েছে। কিন্তু, সবাইকে চমৎকৃত করে বিষ্ণুগুপ্তর মতোই শিক্ষক পদে যোগ দিয়েছে শঙ্কুমণি।

বিষ্ণুগুপ্ত আচার্য হিসেবে যোগ দেওয়ার দেড় বছরের মধ্যেই প্রধানাচার্য হলেন তার গুরু ভদ্রভট্ট। বিষ্ণুগুপ্ত অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিল যে, সুভাষিণীর মূর্তি তার হৃদয়মন্দিরে অধিষ্ঠিত হয়েছে। সম্ভবত, সেই যে প্রথম যেদিন কুটিরের দরজা খুলেছিল কিশোরী সুভাষ, সেই প্রথম দেখাতেই বিষ্ণুগুপ্ত নিজের হৃদয় হারিয়েছিল। সুভাষিণীও তার প্রতি অনুরক্ত, তাও সে দেরিতে হলেও বুঝেছে।

বিষ্ণুগুপ্তর মনে কাঁটার মতো বিদ্ধ হয় একটা নাম ‘নন্দ!” তার পিতার মৃত্যু ও মাতার পরিণতির জন্যে যে দায়ী, সেই ব্যক্তি যে এখনও জীবিত আছে! এত বছর ধরে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত প্রতিশোধের অগ্নিতে দগ্ধে চলেছে বিষ্ণুগুপ্ত! সেই কারণেই নিজের ও সুভাষিণীর মধ্যে এক অদৃশ্য দেওয়াল তুলেছে সে!

কারণ, তার উদ্দেশ্য যে অন্য। তার একমাত্র উদ্দেশ্য প্রতিশোধ! বিষ্ণুগুপ্ত কখনো চায়নি তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ুক সুভাষিণী। কারণ, সে জানে তার পরিণতি কী হতে পারে। আচার্য ভদ্রভট্ট তার মনের কথা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি একদিন কথায় কথায় বিষ্ণুগুপ্তকে বলেছিলেন,

—প্রতিশোধের পথে যাত্রা শুরুর পূর্বে দুটি চিতা সাজিয়ে রাখতে হয়, বিষ্ণু। প্রথমটা শত্রুর জন্যে, দ্বিতীয়টা নিজের জন্যে।

তার অন্তরের এই জ্বালা উপলব্ধি করতে পেরেছিল সুভাষিণীও। তাই তো হাজার বাসনা থাকলেও কোনোদিন বিষ্ণুগুপ্তর চারপাশে গড়ে তোলা অদৃশ্য সেই প্রাচীর ভেদ করার চেষ্টা করেনি সে।

বিষ্ণুগুপ্ত বহু বছর ধরে ভেবে রেখেছিল কোন পথে মগধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে সে। সেই উদ্দেশ্যেই প্রথম পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বিষ্ণুগুপ্ত, ঠিক সেসময়েই মগধ থেকে সংবাদ এল— মগধ সম্রাট মহাপদ্মানন্দ মৃত্যু হয়েছে! না, যুদ্ধে নয়, বিদ্রোহীদের হাতে নয়, গুপ্তঘাতকের হাতে নয়। তাঁর মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক শারীরিক অসুস্থতা থেকে। অত্যধিক তামসিক খাদ্যগ্রহণ, মদ্যপানসহ শরীরের প্রতি অত্যাচার তো তিনি কম করেননি। অতএব, বার্ধক্যের সীমানা ছোঁয়ার পূর্বেই মৃত্যু হল তাঁর। সিংহাসনে বসেছে তাঁরই পুত্র ধনানন্দ।

এই সংবাদ শুনে বিষ্ণুগুপ্তর মনে হল ঈশ্বর তার সঙ্গে এ কেমন ছলনা করল? তার গোটা জীবন যে ব্যক্তির সর্বনাশ করার অভিপ্রায় নিয়ে কেটেছে, সে কিনা তার কিছু করার আগেই মারা গেল? এবার কী করবে তবে বিষ্ণুগুপ্ত?

সেইদিনটা ছিল বসন্তোৎসব, যেদিন মগধ সম্রাটের মৃত্যুর খবর আসে সুদূর গান্ধারের এই তক্ষশিলায়। সেদিন বিকেলে প্রথমবার বিষ্ণুগুপ্তর আশ্রমগৃহে আসে সুভাষিণী। মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় বিষ্ণুগুপ্তর। বিষ্ণুগুপ্তর পাশে অপরূপ সুভাষিণীকে দেখতে লাগছিল বড়োই বেমানান। কিন্তু, প্রজ্ঞা যে রূপ দেখে আকৃষ্ট হয় না! প্রজ্ঞা নারীরা আকৃষ্ট হয় এক ও একমাত্র পুরুষের জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বে।

শেষ বিকেলের অস্তগামী সূর্যের আলোয় সুভাষিণীকে দেখে বিষ্ণুগুপ্তর মনে হচ্ছিল যেন কোনো দেবী প্রতিমা থেকে বেরিয়ে এসে তার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে। দু—হাতে বিষ্ণুগুপ্তর দু—পায়ের পাতায় আবির দেয় সুভাষিণী। নিজের হাতের তালুতে কিছুটা আবির তুলে নিয়ে এগিয়ে ধরে বিষ্ণুগুপ্তর দিকে। শুধু মৃদু, আবেগজড়িত কণ্ঠে বলতে পেরেছিল,

—এবার কি সব ভুলে তুমি নতুন করে সব শুরু করতে পারো না? এবারও কি আমায় ফিরিয়ে দেবে তুমি বরাবরের মতো?

সেদিন সুভাষিণীর চোখে এমন কিছু ছিল যা মুহূর্তে তার এত বছর ধরে গড়ে তোলা প্রতিরোধের দেওয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। বিষ্ণুগুপ্ত সেই মুহূর্তে উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে, সে আসলে কতটা দুর্বল। এই অসাধারণ নারীটি চাইলে যেকোনোদিন তার এই প্রতিরোধ ভেঙে দিতে পারত এত বছরে। আজকে এই নারীকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা বিষ্ণুগুপ্তর নেই। সে—ক্ষমতা কোনো পুরুষকে ঈশ্বর দেননি।

হাতে আবির তুলে সুভাষিণীর গালে লাগায় বিষ্ণুগুপ্ত। এইবার আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে নেয় সুভাষিণী। পরমুহূর্তে তাকে নিজের বাহুডোরে আকর্ষণ করে তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় বিষ্ণুগুপ্ত। তার সব প্রতিরোধের দেওয়াল ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে…। সে হেরে যাচ্ছে এই নারীর কাছে…। তার বড়ো ভালো লাগছে আজকে হেরে যেতে…।

৮.

সুভাষিণী আজ খুব খুশি। কারণ, তার প্রাণের পুরুষটি এতগুলো বছর পর তার হতে চলেছে। গত কয়েক মাসে তাদের মধ্যের দূরত্ব ক্রমশই কমে এসেছে। সম্ভবত জীবনে প্রথমবার বিষ্ণুগুপ্ত নিজের মনের যাবতীয় অন্ধকার দূরে সরিয়ে আলোর পথে এসে দাঁড়াতে চেয়েছে।

সবার চোখের আড়ালে তারা আজকাল নিয়মিত সাক্ষাৎ করে নির্জন কোনো স্থানে। দু—জনই বিরহে ভাবে কত কথা বলার আছে একে অপরকে, কিন্তু সাক্ষাতে কথা কেউই কিছু বলে উঠতে পারে না। একে অন্যের সান্নিধ্যে কেমন যেন তারা হারিয়ে যায়। সুভাষ বিষ্ণুর বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে শুধু। তার একটা হাত নিজের দুই হাতের মধ্যে ধরে।

সুভাষিণীর মনে পড়ে, দাদার গৃহে বেশিরভাগ দিনই আলোচনা করতে করতে অনেক দেরি হয়ে যেত বিষ্ণুগুপ্তর। তাই গুরুর গৃহেই ভদ্রভট্টর সঙ্গেই তারও ভোজনের ব্যবস্থা হত। নিজের দুইজন প্রিয় মানুষকে অন্নব্যঞ্জন সাজিয়ে খেতে দিতে বড়ো ভালো লাগত তার। সুভাষিণী জানে যে, বিষ্ণুগুপ্তর মিষ্টি খাদ্য বড়ো পছন্দের। তাই কখনো ক্ষীর বা গুড়—মধুর মিষ্টান্ন হলে তার থালায় একটু বেশিই দিত সুভাষিণী। এই খাদ্য পরিবেশনের অছিলাতেই মাঝে মাঝে বিষ্ণুগুপ্তর হাত স্পর্শ করত তাকে।। চমকে গিয়ে দ্রুত হাত সরিয়ে নিত বিষ্ণুগুপ্ত। প্ৰথম প্ৰথম বিষয়টায় কৌতুক লাগলেও, পরবর্তীতে মনে বড়ো দুঃখ পেত সুভাষিণী। কেন এরকম করে বিষ্ণুগুপ্ত? সে কি অস্পৃশ্য?

আজকে সেই হাত নিজের হাতের মধ্যে রেখে বসে থাকতে বড়ো ভালো লাগে সুভাষিণীর। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, যেন এই মুহূর্ত চিরস্থায়ী হয়।

গতকালও নদীর পাড়ে এভাবেই তারা দু—জন বসে সূর্যাস্ত দেখছিল। সুভাষিণী বুঝতে পারছিল বিষ্ণু কিছু একটা বলতে চাইছে। তাকে উৎসাহ দিতেই তার হাতটা আরও একটু বেশি জোরে চেপে ধরল সুভাষিণী।

—সুভাষ?

সুভাষিণী মুখ তুলে দেখল বিষ্ণু অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। মুখ তার দিকে না ফিরিয়েই বলল,

—যদি তোমার অনুমতি থাকে, তবে আমি কালকে আচার্যর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

সুভাষিণীর হৃদয়ের গতি বাড়ছে! কোনো কথা বলল না সে। অপেক্ষা করল বিষ্ণুগুপ্তর কথা শেষ করার। বিষ্ণুগুপ্ত বলল,

—আমি গুরুদেবের কাছে তোমাকে বিবাহ করার প্রস্তাব রাখতে চাই। মানে… যদি তোমার মত থাকে তবেই…।

সুভাষিণী কি ঠিক শুনছে? এ কি সত্যি, না, স্বপ্ন? তার ভয় হল, হয়তো এখুনি তার নিদ্রাভঙ্গ হবে এবং এই মধুর মুহূর্ত স্বপ্নের সঙ্গেই উবে যাবে।

—কী হল, সুভাষ? চুপ করে আছ কেন? তোমার কি তবে মত নেই?

সুভাষিণী তবুও কিছু বলছে না দেখে এইবার তার দিকে তাকাল বিষ্ণুগুপ্ত। দেখতে পেল সুভাষিণীর দুটি মায়াময় গভীর চোখ অশ্রুসিক্ত। তার চোখ থেকে গাল বেয়ে জল ঝরে পড়ছে। তার দু—চোখের ভাষাই বিষ্ণুগুপ্তর জন্যে যথেষ্ট ছিল। তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছে বিষ্ণুগুপ্ত তার ওই দু—চোখে। আর কোনো কথা না বলে সুভাষিণীর কপালে চুম্বন এঁকে দিয়েছিল বিষ্ণুগুপ্ত।

কুটিরের বাগানের ফুলগাছে জল দিচ্ছে সুভাষিণী। তার মনে এখন যা চলছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। উৎফুল্লতা—উৎকণ্ঠা মেশানো এক অদ্ভুত অনুভূতি। তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে আজকে প্রধানাচার্যর কার্যালয়ে গিয়েছে বিষ্ণুগুপ্ত ভদ্রভট্টর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। বিভিন্ন ধরনের চিন্তা আসছিল সুভাষিণীর মনে।

“আচ্ছা, জ্যেষ্ঠ কী বলবেন শুনে? নিশ্চয়ই তিনি আপত্তি করবেন না। কারণ, বিষ্ণু তাঁর প্রিয়তম শিষ্য। কিন্তু, তিনি কি অবাক হবেন? নিশ্চয়ই হবেন। কারণ, স্ত্রী, কন্যার মৃত্যুর পর থেকেই তিনি বিদ্যালয় ব্যতীত সব কিছুর প্রতি উদাসীন। তিনি জানতেও পারেননি কখন তাঁর শিষ্য ও ভগিনীর মধ্যে প্রণয় গড়ে উঠেছে। তিনি অবাক হবেন, কিন্তু খুশি হবেন। আচ্ছা, বিষ্ণু কোথায়? তার এত দেরি হচ্ছে কেন আসতে?”

কিছুক্ষণ বাদেই বিষ্ণুগুপ্ত এল। তাকে দেখেই তার দিকে ছুটে গেল সুভাষিণী। —কী হল? কী বললেন জ্যেষ্ঠ?

বিষ্ণুগুপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—বলার সুযোগই পেলাম না, সুভাষ। গুরুদেবের কাছে গিয়ে দেখলাম তাঁর ওখানে অনেক প্রবীণ শিক্ষককে নিয়ে আলোচনা সভা চলছে। স্বয়ং গান্ধারনরেশ সেখানে উপস্থিত। গম্ভীর বিষয়ে আলোচনা চলছে। একান্তে পেলাম না অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও।

—কী নিয়ে এত গভীর আলোচনা? অনুমান করতে পারি, নিশ্চয়ই সেই বিদেশি সম্রাটের সেনাদলের বিষয়ে?

হেসে বিষ্ণুগুপ্ত বলল,

—হুমম। তুমি সত্যিই বুদ্ধিমান, সুভাষিণী। ঠিকই অনুমান করেছ। তুমি তো জানোই সুদূর যবন দেশে এক মহাপ্রতাপ সম্রাট অলকশেন্দ্র সুবিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বিশ্বজয় করতে বেরিয়েছে। সর্বশেষ পাওয়া সংবাদ যদি সত্যি হয়, তবে সে ইতিমধ্যে পারস্যদেশ আক্রমণ করেছে। এবং, পারস্য তার দখলে এলেই সে পূর্বের দিকে যাত্রা শুরু করবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই তার সেনা আমাদের দেশের সীমান্তে এসে পৌঁছোবে।

সুভাষিণীকেও চিন্তিত মনে হল। বলল,

—শুনেছি পারস্য বিশাল শক্তিশালী এক সাম্রাজ্য। যদি এই উন্মাদ রাজা তাদের হারাতে সক্ষম হয়, তবে গান্ধারের পক্ষে কখনোই তাকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়!

সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল বিষ্ণুগুপ্ত। বলল,

—হুমম। সেই কারণেই সভায় আলোচনা চলছিল যে, কী করণীয় আমাদের। যদিও আমি সভায় কনিষ্ঠ, তবুও আমিই প্রস্তাব দিলাম যে, যদি আর্যাবর্তর ষোলো মহাজনপদ একত্র হয়, তবে কিন্তু বিদেশিদের অনুপ্রবেশ আটকানো সম্ভব। গুরুদেবসহ অনেকেই আমার কথার সমর্থন করলেন এবং সেই অনুযায়ী ঠিক করা হয়েছে যে, এই প্রস্তাব নিয়ে আচার্য প্রদ্যুম্ন যাবেন মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রে। কারণ, এই মুহূর্তে গোটা জম্বুদ্বীপে সবচেয়ে বড়ো ও শক্তিশালী সেনা আছে মগধের। তারাই সবচেয়ে বড়ো রাজ্য এই দেশের। অতএব, শুরুটা মগধের সম্রাটকেই করতে হবে। তাঁকেই উদ্যোগ নিতে হবে অন্য ছোটো ছোটো জনপদকে এক করতে। আশা করা যায়, নবীন সম্রাট ধনানন্দ তাঁর পিতার মতো নন। তিনি নিশ্চয়ই আসন্ন বিপদের কথা বুঝে আমাদের প্রস্তাবে সাড়া দেবেন।

—দিলেই ভালো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুভাষিণী। বিষ্ণুগুপ্ত হেসে তার মাথায় হাত রেখে বলল, —চিন্তা কোরো না হে, বিষ্ণুপ্রিয়ে। কয়েক দিন যাক, এই উত্তেজনার আবহাওয়া কিছুটা স্তিমিত হলেই আমি আমাদের কথা গুরুদেবকে জানাব। সব ঠিক থাকবে। এই কথায় কেন জানি সুভাষিণীর মনে অজানা কিছুর আশঙ্কা দেখা দিল।

৯.

নিয়তি বড়ো রহস্যময় পথে চলে। নিয়তি অমোঘ, নির্বিকল্প ও অভূতপূর্ব। সে—ই ভাগ্যবিধাতা ও সর্বশক্তিমান। মানুষ তার হাতের পুতুল মাত্র। কালের পুস্তকের পৃষ্ঠায় তার জন্যে নিয়তি কী লিখে রেখেছে, সে—বিষয়ে অজ্ঞানী মানুষ নিজের মতো আগামীর পরিকল্পনা বানায়। নিয়তি নিভৃতে পরিহাস করে। আসলে, নিয়তি বড়োই নিষ্ঠুর।

বিষ্ণুগুপ্ত প্রধানাচার্যর কার্যালয়ে প্রবেশ করতে আচার্য ভদ্রভট্ট মাথা তুলে তার দিকে তাকালেন। বিষ্ণুগুপ্ত বলল,

—প্রণাম, আচার্য। আমায় ডেকেছিলেন, গুরুদেব?

—হ্যাঁ, বিষ্ণুগুপ্ত। তুমি কি দুঃসংবাদটা শুনেছ?

—না, কী ঘটেছে?

—আচার্য প্রদ্যুম্ন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন গতকাল রাত থেকেই। তাঁর ধুম জ্বর এসেছে। এদিকে আগামীকালই তাঁর মগধ যাত্রার তিথি।

—হুমম। তাই তো। এটা তো সত্যিই খারাপ খবর। তাঁর যাত্রা তবে কয়েক সপ্তাহ পিছিয়ে দিন।

—আমি সেটাই চাইছি না। সব ব্যবস্থা যখন হয়েই গিয়েছে, তখন তাঁর পরিবর্তে অন্য কেউ যাক।

—হুমম। সেই ভালো। কিন্তু, আচার্য প্রদ্যুম্ন আগেও রাজপ্রতিনিধি হিসেবে বহু দেশে গিয়েছেন। তাঁর মতো কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা তো আর কারুর নেই। তাঁর বদলে কে যাবে? আপনি? হ্যাঁ, আপনি অবশ্যই যেতে পারেন। আপনার নিজের এই বিষয়ে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি।

ঘাড় নেড়ে ভদ্রভট্ট বললেন,

—সে এখন আর সম্ভব নয়, বিষ্ণু। একসময়ে তো কম দেশভ্রমণ করিনি এইসব কাজে। কিন্তু, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে একবেলাও যাওয়া সম্ভব নয়। প্রধানাচার্য পদের সঙ্গেই যে সুবিশাল দায়িত্ব আমার ওপর এসে পড়েছে, তাতে গত কয়েক মাস আমি রাত্রিটুকু ব্যতীত অবসর সময় পাচ্ছি না। গতকালই তো সুভাষ খুব রাগারাগি করছিল আমার ওপর, যে, আমি এবার অসুস্থ হয়ে পড়ব এই অত্যধিক কাজের ফলে।

—কথাটা তো ঠিকই বলেছে, গুরুদেব।

—সেকথা বাদ দাও। অতএব, আমার পক্ষে এখন মগধযাত্রা সম্ভব না, বুঝতেই পারছ। দেড় থেকে দু—মাসের জন্যে প্রধানাচার্যর অনুপস্থিতি সম্ভব নয়। —হুমম।

ভদ্রভট্ট কিছুক্ষণ বিষ্ণুগুপ্তর দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বললেন,

—আচার্য প্রদ্যুম্নর পরিবর্তে আমি একটা নাম প্রস্তাব করেছি। আমার মনে হয়েছে সেই ব্যক্তি গোটা বিষয়টার গভীরতা বোঝে এবং তার অভিজ্ঞতা না থাকলেও তার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জ্ঞান যথেষ্ট আছে। এবং, গান্ধাররাজসহ সমস্ত বরিষ্ঠ আচার্যই আমার প্রস্তাবের সমর্থন করেছে।

—কে? কার নাম প্রস্তাব করেছেন আপনি?

—তোমার! আমি বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যর নাম প্রস্তাব করেছিলাম।

বিষ্ণুগুপ্ত ভীষণরকম চমকে গিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত তার মুখে কথা জোগাল না। তারপর সে বলল,

—না, না, আচার্য! এ হয় না। আমি যেতে পারব না।

— পারবে না, নাকি, যেতে চাও না?

—যেতে চাই না! পাটলিপুত্র মানেই হল আমার অতীতের বহু বেদনার স্মৃতি। আমি ওইসব ভুলে যেতে চাই, গুরুদেব। আপনি তো সবই জানেন। আপনার কাছে আমি কোনোদিনই কোনো কথা গোপন করিনি আর ভবিষ্যতেও করব না। আমি আজকে যা—কিছু, যেটুকু শিখেছি সবটুকুই আপনার দান। অতএব, আমি মগধে যেতে চাই না। আর, তা ছাড়া আমার অভিজ্ঞতাও কম এইসব বিষয়ে।

আচার্য ভদ্রভট্ট তাঁর পিঠ টান করে বসলেন। কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,

—তোমার যদি নিতান্তই আপত্তি থাকে, তবে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমায় আমি জোর করব না। কিন্তু বিষ্ণুগুপ্ত, আমার তোমার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা আছে। আমি কিন্তু অনেক ভেবেই তোমার নাম প্রস্তাব করেছি। এই গুরুদায়িত্ব তো আমি যাকে খুশি দিতে পারি না। সেদিন আলোচনা সভাতেও তুমি আচমকাই উপস্থিত হয়েছিলে এবং ঐক্যবদ্ধ আর্যাবর্তর এই ভাবনাও তোমারই মস্তিষ্কপ্রসূত। যবন সেনাদের ভারত আক্রমণের বিপদের যথাযথ মূল্যায়ন তুমি করতে সক্ষম এবং বিষয়টার গুরুত্ব তুমি বোঝো। যেখানে গোটা দেশের ভাগ্য নির্ভর করে আছে এই বিষয়ের ওপর, সেক্ষেত্রে আমি বলব নিজের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে সরে দাঁড়িয়ে আর একবার বিচার করো।

বিষ্ণুগুপ্তর কপালে ভ্রূকুটি দেখা দিয়েছে। সে চিন্তিত। নিজের সঙ্গেই যুদ্ধ করছে সে নিজের অন্তরে। একদিকে গোটা দেশের ওপর আসন্ন বিপদ। অন্যদিকে তার মনে ভেসে উঠছে সুভাষিণীর মুখশ্রী।

ভদ্রভট্ট আবার বললেন,

——অতীত আঁকড়ে থেকো না, বৎস। তোমার মনে তোমার নিজের জন্মস্থান মগধকে নিয়ে যে তিক্ততা আছে, তা তুমি একমাত্র আবার সেই নগরে গিয়ে দাঁড়াতে পারলে তবেই হয়তো কাটবে। নিজের মনের শাস্তির জন্যেও তোমার অন্তত একবার যাওয়া উচিত সেখানে। অতীত থেকে পালিয়ে বেড়িয়ো না, বিষ্ণুগুপ্ত। তাকে নিজেরই অংশ হিসেবে স্বীকার করো। তার মুখোমুখি দাঁড়াও।

বিষ্ণুগুপ্তর মুখের ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে। তার মধুদ্রব্য খেতে ইচ্ছে করছে। সে লক্ষ করে দেখেছে গভীর সমস্যা বা চিন্তায় পড়লে তার এরকম হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষ্ণুগুপ্ত বলল,

বেশ, গুরুদেব। আপনি যখন বলছেন তখন আমি যাব মগধ। কিন্তু, একাজে আমি রাজি হলাম শুধুমাত্র আমার দেশের কথা ভেবে। দেশের ও দশের হিতে নিজের প্রয়োজনকে তুচ্ছ করার শিক্ষা আপনার থেকেই আমি পেয়েছি। রাজধানীতে গিয়ে রাজা ধনানন্দর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব এবং তাঁকে আসন্ন বিপদের কথা বোঝানোর চেষ্টা করব। তাঁকে অখণ্ড আর্যাবর্তর প্রয়োজন ও গুরুত্ব বোঝাতে, আশা রাখি আমি সক্ষম হব।

হাসি ফুটল ভদ্রভট্টর মুখে। বললেন,

—নিশ্চয়ই হবে। তোমার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কেই—বা আছে? আমি জানতাম তোমার দেশপ্রেম তোমায় চুপ থাকতে দেবে না, বিষ্ণু। তবে আর বিলম্ব কোরো না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নাও। আগামীকাল প্রভাতেই বেরিয়ে পড়ো।

উঠে দাঁড়িয়ে আচার্য ভদ্রভট্টকে প্রণাম জানাল বিষ্ণুগুপ্ত। বেরিয়ে যাওয়ার আগে তাকে ডাকলেন ভদ্রভট্ট,

—বিষ্ণু! আগেরদিন কী প্রয়োজনে আমার কাছে এসেছিলে, সেটাই তো শোনা হল না। কিছু বলবে বলে এসেছিলে নিশ্চয়ই? খুব প্রয়োজনীয় কিছু কথা কি? বিষ্ণুগুপ্ত আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—নাহ্, থাক। এখন নয়। মগধ থেকে ফিরে এসে বলব।

—বেশ, বেশ। আর শোনো…

—বলুন, আচার্য?

—তোমার শিক্ষক ও শুরু হতে পেরে আমি গর্বিত, বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য! আমি জানি তুমিই পারবে এই দেশকে নবনির্মিত করতে। তোমার এই মগধযাত্রাই হয়তো পালটে দেবে ইতিহাস! তোমার যাত্রা শুভ হোক। তোমার উদ্দেশ্য সফল হোক!

১০.

—তোমায় মগধ যেতে হবে?

—হুম।

—আগামীকালই?

—হুমম।

—যেয়ো না! দোহাই তোমায়, যেয়ো না।

সুভাষিণীর প্রশ্নের অন্যমনস্কভাবে জবাব দিচ্ছিল বিষ্ণুগুপ্ত। কিন্তু, হঠাৎ সুভাষিণীর কাতর মিনতি শুনে চমকাল বিষ্ণুগুপ্ত। সে কোনোদিন সুভাষিণীকে এই ভঙ্গিতে কথা বলতে শোনেনি। সুভাষিণী বরাবরই তার কাছে একজন দৃঢ়চেতা নারী। সুভাষিণীর দিকে তাকিয়ে অবাক হল বিষ্ণুগুপ্ত। সুভাষিণীর চোখে জল জমেছে। বিষ্ণুগুপ্ত তার মাথায় হাত রেখে বলল,

—তুমি এমন করছ কেন, সুভাষ? মাত্র তো এক—দেড় মাসের ব্যাপার বড়োজোর। ফিরে এসেই আমরা বরাবরের মতো মিলিত হব।

সুভাষিণী বিষ্ণুগুপ্তর হাত চেপে ধরে বলল,,

—না, না! তুমি যেয়ো না।

বিষ্ণুগুপ্ত নরম স্বরে বলল,

—আবেগকে সংযত করো, সুভাষ। যাওয়ার ইচ্ছে আমারও নেই। বিশ্বাস করো, বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। কিন্তু, যে দায়িত্ব আমি নিয়েছি, তার ওপর যে আগামী দিনে গোটা দেশের ভাগ্য নির্ভর করে আছে। তাই আমায় যেতেই হবে। কিন্তু, তোমার হঠাৎ কী হল বলো তো? তোমায় কখনো সামান্য বিষয় নিয়ে এইরূপ আবেগপ্রবণ হতে তো আগে দেখিনি।

সুভাষিণী অনুভব করল যে, বিষ্ণুগুপ্ত সত্যি কথাই বলছে। সে অকারণেই বেশি ভেবে ফেলছে কেন? কিছুটা সামলে নিয়ে সুভাষিণী বলল,

—ঠিক জানি না, বিষ্ণু। কিন্তু, আমার মন বড়ো উতলা হচ্ছে তোমার মগধযাত্রার কথা শুনে। জানি, এর কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যে, তুমি মগধ গেলে আমার থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে।

বিষ্ণুগুপ্ত হেসে সুভাষিণীর গালে হাত রেখে বলল,

—এরূপ কিছুই ঘটবে না।

সুভাষিণী চোখ বন্ধ করে বিষ্ণুগুপ্তর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে নিজের গালে চেপে ধরল। বলল,

—আমার জন্মের পরেই মাতার মৃত্যু হয়। পিতা তো জন্মের আগেই মারা গিয়েছিল। জ্যেষ্ঠ আমায় পিতার মতোই বড়ো করেছে। আমরা দু—জন অনেক ঝড়ের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠেছি। যখন ভাবলাম সে সুখী হবে, সেও সংসারের স্বপ্ন দেখল। কিন্তু দেখো, তার সেই সুখও ক্ষণস্থায়ী হল। এখন যখন আমি সুখের স্বপ্ন দেখছি, তখন বার বার মনে হচ্ছে যে, আমারও কপালে হয়তো নিয়তি সুখ লেখেনি। আমার বড়ো ভয় করছে বিষ্ণুগুপ্ত!

চোখ খুলে বিষ্ণুগুপ্তর চোখের দিকে তাকিয়ে সুভাষিণী বলল,

—জানো বিষ্ণু, এক জ্যোতিষ বলেছিলেন যে, আমাদের বংশ অভিশপ্ত। আমরা কেউ কখনো সুখী হব না। সংসার করা আমাদের ভাগ্যে লেখা নেই। কোনোদিন এই কথায় বিশ্বাস করিনি। কিন্তু, জ্যেষ্ঠর সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পর থেকেই আমি বড়ো দুর্বল হয়ে পড়েছি। যদি সেই জ্যোতিষের কথাই সত্যি হয়?

বিষ্ণুগুপ্ত আবারও মৃদু হেসে বলল,

—তুমি আমার দেখা শ্রেষ্ঠ নারী। তাই একথা তোমার মুখে শোভা পায় না, সুভাষ মানুষ নিজের ভাগ্য নিজে নির্ণয় করে, সুভাষ। আমার জন্মের পর এক জ্যোতিষ বলেছিল আমি সম্রাট হব। আমার কথায় নাকি গোটা দেশ চালিত হবে। এখন আমায় দেখো। এই হলাম আমি, বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য, তক্ষশিলার এক সাধারণ শিক্ষক মাত্র। আমি কোনোদিনই সম্রাট হব না। কারণ, সে—বাসনা আমার কোনোদিনই ছিল না। আমি আমার মাতাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, আমি কোনোদিন রাজা হব না। তাই মন থেকে দুর্বলতা ও কুসংস্কারকে বহিষ্কার করো। খুব তাড়াতাড়িই বিষ্ণু তার বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হবে। এখন আসি, বিদায় সুভাষিণী।

—কথা দাও, তুমি ফিরে আসবে!

—আমি ফিরে আসব, সুভাষিণী। কথা দিলাম।

১১.

দেড় মাস পর এক বিকেলে সুভাষিণী নিজের কুটিরে বীণায় ‘মধুবন্তী’ রাগ বাজাচ্ছিল। তখনই কেউ একজন এসে সংবাদ দিল যে বিষ্ণুগুপ্ত ফিরে এসেছে। প্রধানাচার্যর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছে সে।

আনন্দে হৃদয় নেচে উঠল সুভাষিণীর। সে ফিরেছে! তার বিষ্ণু ফিরেছে। সুভাষিণী মনে মনে আশা করেছিল, বিষ্ণুগুপ্ত নিশ্চয়ই ফিরে এসে তার সঙ্গেই সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ করবে। কিন্তু, সে প্রথমেই গিয়েছে জ্যেষ্ঠর কাছে। কিছু কি ঘটেছে? না না, সে অহেতুক চিন্তা করছে। নিশ্চয়ই জরুরি কোনো কথা বলার আছে বিষ্ণুর তার গুরুদেবকে। তাই…।

তার উচিত অপেক্ষা করা। কিন্তু, সুভাষিণীর মন যে এই দীর্ঘ বিরহে বড়োই ক্লিষ্ট। হৃদয় তার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করছে। তার বড্ড ইচ্ছে করছে এখুনি একবার বিষ্ণুগুপ্তকে দেখতে! একবার কি জ্যেষ্ঠর সঙ্গে সাক্ষাতের অজুহাতে যাওয়া যায় না?

নিজের এই কিশোরীসুলভ আচরণে নিজেই লজ্জা পেল সুভাষিণী। ইসস! এ তার কী হয়েছে? কিন্তু, মন যে বারণ মানে না!

এইসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে সুভাষিণী পায়ে পায়ে প্রধানাচার্যর ভবনের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তা নিজেই খেয়াল করেনি। সকলেই জানে সুভাষিণী প্রধানাচার্যর ভগিনী। তাই তাকে প্রবেশ করতে কেউ বাধা দিল না। কক্ষে প্রবেশ করে বিষ্ণুগুপ্তর দিকে চোখ যেতেই ভীষণ বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল সুভাষিণী।

এ কোন বিষ্ণুগুপ্তকে দেখছে সে? ব্রাহ্মণের প্রজ্ঞার পরিচয় ও গৌরব যে শিখা, সেই শিখার কেশ বাঁধেনি বিষ্ণুগুপ্ত। খোলা শিখার দীর্ঘ কেশ এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে তার পিঠ জুড়ে। তার পরিধানের বস্ত্র অপরিচ্ছন্ন! তার স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছে। যেন পরিমাণমতো খাদ্য ও পানীয় সে বহুদিন গ্রহণ করেনি।

সুভাষিণী প্রবেশ করতে তার দিকে ফিরে তাকাল বিষ্ণুগুপ্ত। তার চোখের দিকে দৃষ্টি যেতেই শিউরে উঠল সুভাষিণী! ওই চোখ! উফ, কী ভয়ংকর তার দুই চোখ! তাতে যেন বিদ্যুৎ খেলা করছে! ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে তার দু—চোখে! যে আগুন ছারখার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তাদের জীবন, ভবিষ্যৎ, সাম্রাজ্য!

সেই মুহূর্তে সুভাষিণী উপলব্ধি করতে পারে যে, বিষ্ণুগুপ্ত ফিরে এসেছে বটে। কিন্তু, সে তার পরিচিত বিষ্ণুগুপ্ত নয়! মগধযাত্রায় তার সঙ্গে এমন কিছু ঘটেছে যা বিষ্ণুগুপ্তর অন্তরের প্রশমিত আগুনকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। যে ফিরেছে সে বিষ্ণুগুপ্ত নয়, সে চাণক্য!

বিষ্ণুগুপ্তর চোখ কি একটুও শান্ত হয়েছিল সুভাষিণীকে দেখে? এর উত্তর জানা নেই। কারণ, পরমুহূর্তেই তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল চাণক্য। কারণ, সে জানত যে, এই নারী সাধারণ নয়। এই নারী তাকে দুর্বল করে দেবে। নিজের দুর্বলতা যাতে প্রকাশ না পেয়ে যায় তাই সুভাষিণীর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল চাণক্য। সে চায়নি সুভাষিণী তার চোখের দিকে তাকিয়ে তার অন্তরের দুর্বল বিষ্ণুগুপ্তকে খুঁজে পাক।

ভদ্রভট্ট ও চাণক্যর মধ্যের আলোচনা থেকে কী ঘটছে তার আঁচ পেল সুভাষিণী। মগধের নতুন রাজা ধনানন্দ তাঁর পিতা মহাপদ্মানন্দর চেয়েও লম্পট, অত্যাচারী ও লোভী। তিনি সম্পূর্ণভাবে মদিরা ও নারীশরীরে আসক্ত। ভদ্রভট্টর লেখা পত্রর অনুরোধে, রাজার সঙ্গে বিষ্ণুগুপ্তর সাক্ষাতের ব্যবস্থা অমাত্য কাত্যায়ন করেছিল। কিন্তু, নেশাতুর রাজা বিষ্ণুগুপ্তর কথার গুরুত্ব বোঝার অবস্থায় ছিল না। বিরক্ত হয়ে বিষ্ণুগুপ্ত রাজাকে বলে যে, এইরূপ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা রাজার শোভা পায় না। তার দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করাতে চায়। তাতে কুপিত হয়ে রাজা তৎক্ষণাৎ বিষ্ণুগুপ্তর শিরশ্ছেদের আদেশ দেন!

পরিস্থিতি সামলাতে প্রধানামাত্য কাত্যায়ন রাজাকে অনুরোধ করে এই আদেশ প্রত্যাহার করতে, অন্যথায় ব্রহ্ম—হত্যার পাপ হবে তাঁর। তাতে প্রাণদণ্ড প্রত্যাহার করলেও ধনানন্দ আদেশ দেন,

—মূর্খ, আচার্য! তোর এত সাহস আর দত্ত যে আমাকে, মগধ সম্রাটকে, তুই জ্ঞান দিতে আসিস! তোদের মতো পণ্ডিত ব্রাহ্মণদের খুব গর্ব না তোদের ওই কেশশিখা? সৈনিক, এই কুরূপ, নোংরা ব্রাহ্মণকে এখুনি ওর শিখা ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে মহলের বাইরে ছুড়ে ফেলে দাও!

একদল সৈনিক বিষ্ণুগুপ্তর কেশশিখা ধরে তাকে মাটির ওপর টেনে—হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে সভা থেকে! রাজার আদেশে তাকে তারা মহলের বাইরে মাটিতে ছুড়ে ফেলে দেয়! সেই টানা—হ্যাঁচড়ায় শিখার গিঁট খুলে যায়।

অপমানিত, লাঞ্ছিত বিষ্ণুগুপ্ত সেইখানেই দাঁড়িয়ে নিজের শিখা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, নন্দ সাম্রাজ্য সে ধ্বংস করবে! আজ, এই মুহূর্ত থেকে তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হবে নন্দ সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করা। আর, যতদিন না সে নন্দ সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে, ধনানন্দকে সিংহাসনচ্যুত করতে পারছে, ততদিন সে নিজের কেশশিখা বাঁধবে না!

তার এই প্রতিজ্ঞার কথা রাজার কানে যেতে রাজা পুনরায় বিষ্ণুগুপ্তকে ধরে এনে বন্দি করার নির্দেশ দেন। বহু কষ্টে পালিয়ে মগধের সীমানা পেরিয়ে, গোপনে এতটা পথ অতিক্রম করে সে গান্ধার আসতে পেরেছে।

সব শুনে কোনো কথা না বলে নিজের কুটিরে ফিরে আসে সুভাষিণী। তার কুটিরে প্রতিষ্ঠিত বিষ্ণুমূর্তির সামনে বসে ভেঙে পড়ে সে। এতক্ষণ বুকের মধ্যে চেপে রাখা কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসে।

বিষ্ণুগুপ্তর তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া থেকেই তার যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গিয়েছে। সে বিষ্ণুগুপ্তকে খুব ভালোভাবে চেনে। তাই সুভাষিণী উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, বিষ্ণুপ্রিয়া তার বিষ্ণুকে চিরতরে হারিয়েছে! তার সমস্ত স্বপ্ন আজীবন অধরাই থেকে যাবে!

১২.

কয়েক বছর অতিক্রান্ত হল। বিষ্ণুগুপ্ত এখন ‘চাণক্য’ নামেই বেশি পরিচিত। চাণক্য টানা কয়েক মাসের বেশি কখনো আজকাল তক্ষশিলায় থাকে না। মাঝে মাঝেই কোথাও চলে যায়। তার পরিকল্পনার সমস্ত কথা সে শুধু বলে তার আচার্য ভদ্রভট্টকে। কীসের বা কারুর যেন খোঁজ করে বেড়ায় সে হন্যে হয়ে।

আর, সুভাষিণী? সে আচার্য ভদ্রভট্টর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছে। বিষ্ণুগুপ্তর সঙ্গে সেদিনের পর থেকে তার আর কোনোদিন একান্তে কথা হয়নি। সুভাষিণীও চেষ্টা করেনি। কারণ, সে জানে যে, এই পীড়া তার একার নয়। যেভাবে এই বিরহে তার হৃদয় দগ্ধ হয়, সেভাবেই অপরপ্রান্তের মানুষটার হৃদয়ও পীড়িত। সে সুভাষিণীর কাছে আসে না কারণ, সে ভয় পায় তার কাছে আসতে। সে ভয় পায় যে, তার চোখে চোখ রাখলে সে বিচ্যুত হবে নিজের প্রতিজ্ঞা থেকে।

সুভাষিণী নিজের ভবিতব্য মেনে নিয়েছে। তার কণ্ঠে শুধুই আজকাল বিরহের গান আসে, তার বীণায় বাজে বিরহের সুর। কিন্তু, বিষ্ণুগুপ্ত তক্ষশিলায় থাকলে সুভাষিণী কখনো তার বীণা বাজায় না। কারণ, সে জানে যে, এই সুর শুনতে পেলে বিষ্ণু দুর্বল হবে। সে থাকতে পারবে না এবং চলে আসবে তার কাছে সুভাষিণী চায় না নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্যে বিষ্ণুগুপ্তর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হোক। তাই যেসব রাত্রে চাণক্য বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে না, সেইসব রাত্রে নিভৃতে তার বীণায় বাজে বিষাদের সুর।

কয়েক বছর পর একদিন বিষ্ণুগুপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরলেন সঙ্গে এক কিশোরকে নিয়ে। সবাইকে বললেন যে, মগধের পথে তিনি এই ছেলেটিকে পেয়েছেন। নিজের শিষ্য হিসেবে তাকে তক্ষশিলায় ভরতি করিয়ে দেন। গভীর রাত অবধি তাঁকে পাঠ দিতেন বিষ্ণুগুপ্ত। ধীরে ধীরে আরও কয়েক জন ছাত্র এল বিষ্ণুগুপ্তর ছত্রছায়ায়। সেই ছাত্রদের একান্তে প্রশিক্ষিত করতে শুরু করেন বিষ্ণুগুপ্ত। সুভাষিণী তার জ্যেষ্ঠর সূত্রে জানতে পেরেছিল যে, বিষ্ণুগুপ্ত তাঁর এই ছয় শিষ্যকে গোপনে অস্ত্রশিক্ষা দিচ্ছেন। এ ছাড়াও, যেসব বিশেষ পাঠ্যক্ৰম শুধুমাত্র রাজকুমারদের জন্যে বরাদ্দ, সেইসমস্ত বিষয়ে নিজের শিষ্যদের শিক্ষিত করছেন বিষ্ণুগুপ্ত।

সুভাষিণী বুদ্ধিমতী। বিষ্ণুগুপ্তর অভীষ্ট বুঝতে অসুবিধা হয় না তার। বিষ্ণুগুপ্ত মগধের আগামী সম্রাট হিসেবে প্রশিক্ষিত করছেন এই ছাত্রদের।

আচার্য চাণক্য যখন দিনের বেলা নিজের আশ্রম প্রাঙ্গণে পাঠশালে পাঠ পড়াতেন, সেসময়ে সুভাষিণী মাঝে মাঝে অদূরে দাঁড়িয়ে তাঁর পাঠ শুনত। বার বার মুগ্ধ হত তার প্রিয় মানুষটির জ্ঞান ও প্রজ্ঞায়। নিজের নিয়তি তো সে মেনেই নিয়েছে, তার প্রিয় মানুষকে মাঝে মাঝে চোখের দেখা দেখে, তাঁর কণ্ঠ শুনেই নাহয় বাকি জীবন কাটিয়ে দেবে সে। এটুকু থেকে অন্তত তাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না।

এদিকে চাণক্যর গতিবিধি থেকে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জেগেছে। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ে আচার্য চাণক্যর নাম ছাত্রদের মুখে মুখে ফেরে। তিনি নিঃসন্দেহেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। তাই তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস কেউ করে না সাধারণত।

শুধু একজন বাদে। বিদ্যালয়ের আরও এক বিখ্যাত ও পণ্ডিত শিক্ষক আচার্য শঙ্কমণি। ইনি সেই ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে, বর্তমানে কর্মক্ষেত্রেও আচার্য চাণক্যর প্রতিদ্বন্দ্বী। ঠিক যেমনভাবে অনেক ছাত্র চাণক্যর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে ইচ্ছুক থাকে, সেভাবেই আচার্য শঙ্কুমণির আশ্রমের সম্মুখেও প্রতি বছর তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে ইচ্ছুক ছাত্রদের ভিড় জমে। কিন্তু, আচার্য শঙ্কুমণি বুদ্ধিমান। তিনি বেছে বেছে শুধুমাত্র রাজকুমারদেরই স্থান দেন নিজের আশ্রমে। তিনি জানেন যে, রাজাদের থেকে আনুকূল্য পাওয়ার ও নিজের উন্নতির সবচেয়ে সহজ মার্গ এইটাই। তাঁর বক্র নাসার কারণে তাঁর নামের অপভ্রংশ হয়ে ছাত্রমুখে তাঁর পরিচিত নাম— আচার্য শকুনি। অনেকেই মজা করে বলে গান্ধারে এক ছিল মহাভারতের শকুনি আর এখন আছে আচার্য শকুনি!

একদিন প্রধানাচার্যর কক্ষে প্রবেশ করতেই সুভাষিণীর কানে এল আচার্য শঙ্কুমণির কথা। তিনি প্রধানাচার্যর সঙ্গে কথা বলছেন,

—আচার্য চাণক্যও তো এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক। তবে, তাঁর বেলা বিদ্যালয়ের নিয়ম কেন শিথিল, আচার্য? তিনি মাসের পর মাস বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকেন না। কাউকে কিছু না বলে চলে যান। ছাত্রদের তো এতে পাঠের ক্ষতি হয়, প্রধানাচার্য! ক্ষমা করবেন, কিন্তু আপনি নিজের প্রিয় ছাত্রকে বড্ড বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছেন, আচার্য! এবং, সে আপনার প্রশ্রয়ের অযাচিত লাভ ওঠাচ্ছে। প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট মৃদু হেসে বললেন,

—বিনা অনুমতিতে তো সে যায় না। সে আমার অনুমতি নিয়েই যায়। আর, ছাত্রদের কিন্তু এই নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। উল্লেখ্য যে, বরাবরই তার আশ্রমের ছাত্ররাই সবচেয়ে ভালো ফলাফল করে পরীক্ষায়। আর, যদি প্রশ্রয়ের প্রসঙ্গেই বলতে হয়, তবে তুমিও তো আমার অন্যতম প্রিয় ছাত্র, শঙ্কু। আমি কিন্তু তোমাকেও যথেষ্ট প্রশ্রয় দিই। অনেকেই অভিযোগ করে যে, তোমার পাঠশালায় রাজকুমারদের পক্ষপাতিত্ব করো। আমি তো সেই অভিযোগ তোমার হয়ে প্রতিহত করি।

প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টর সঙ্গে যুক্তিতে কুলিয়ে উঠতে পারা কঠিন বুঝতে পেরে এবার সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে অভিযোগ করার চেষ্টা করল আচার্য শঙ্কুমণি,

—বেশ, মেনে নিচ্ছি যে, তাকে নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে কোনো অসন্তোষ নেই। কিন্তু, তার গতিবিধি বড়োই সন্দেহজনক। তার কাজকর্ম নিয়ে অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগছে, আচার্য। চাণক্য একাধিক রাজকুমারসহ বহু ছাত্রকে নিজের শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। কিছু ক্ষেত্রে তো কয়েক জন রাজার অনুরোধও সে প্রত্যাখ্যান করেছে। তার ছয় শিষ্যদের নিয়ে সে সারাদিন রাত এত কী শলাপরামর্শে মেতে থাকে সর্বদা? এত কীসের গোপনীয়তা তাদের মধ্যে? আমি শুনেছি তাদের গোপনে অস্ত্র ও অশ্বারোহণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এইসবের কারণ কী?

ভদ্রভট্ট উত্তর দিলেন,

—তুমি তো জানোই যে কোন আচার্য, কোন ছাত্রকে নিজের শিষ্য বানাবে বা কাকে প্রত্যাখ্যান করবে সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই ক্ষেত্রে বিদ্যালয় হস্তক্ষেপ করে না। ঠিক যেমন তোমার শিষ্য বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও আমি হস্তক্ষেপ করি না। সেই শিষ্যদের কী কী প্রকার শিক্ষা দেওয়া হবে সেটাও সম্পূর্ণভাবেই ছাত্র ও তার গুরুর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। এইক্ষেত্রেও কোনো নিয়মের উল্লঙ্ঘন তো হচ্ছে না। অন্য ছাত্রদের পাঠক্রম অবহেলা না করে কেউ যদি বিশেষ কোনো ছাত্রকে কিছু বেশি শিক্ষা প্রদান করে, তবে এতে আপত্তির কী থাকতে পারে? আচার্য শঙ্কুমণি কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার শেষ অস্ত্রটা প্রয়োগ করল,

—বেশ, কিন্তু আপনি কি জানেন যে, আচার্য চাণক্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার বাইরে একটা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছে? এবং, সেখানে সে বেশ কিছু কিশোরী ও বালিকাকে এনে জড়ো করেছে। তাদেরও সে যুদ্ধকলার প্রশিক্ষণ দেওয়াচ্ছে বলে সংবাদ আমার কানে এসেছে।

কক্ষের দ্বারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সুভাষিণী কথাটা শুনে চমকাল। এ সংবাদ তারও জানা ছিল না, অথচ, আচার্য শকুনি জেনেছে। এই লোকটি বিপজ্জনক! বিষ্ণুগুপ্তর উচিত এর থেকে সাবধানে থাকা।

প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট কিন্তু বিন্দুমাত্র বিস্মিত না হয়ে উত্তর দিলেন,

—শঙ্কুমণি, শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা গান্ধার দেশে খুব কম ঘটনা ঘটে যা আমার অজানা। বিষ্ণুগুপ্তর এই আশ্রমের কথা আমি বিলক্ষণ জানি। সেখানে যে মেয়েদের আনা হয়েছে তারা বড়োই অভাগিনী। তাদের প্রত্যেকের জন্মসময়ে গ্রহদোষ থাকায় তাদের বিবাহ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এই মেয়েরা সমাজ ও তাদের নিজেদের পরিবারের কাছেই অবাঞ্ছিত। সমাজে তাদের ন্যূনতম অধিকার নেই এবং তাদের ‘বিষকন্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিষ্ণুগুপ্ত গোটা দেশ থেকে এই ধরনের মেয়েদের খুঁজে এনে তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে সেই আশ্রমে। এই কিশোরীরা নিজেদের পরিবারের হাতে এতটাই লাঞ্ছিত যে, এদের আত্মপ্রত্যয় ফিরিয়ে আনতে তাদের যুদ্ধকলাসহ বিভিন্ন ধরনের যোগক্রিয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিষ্ণুগুপ্তর এই উদ্যোগে সন্দেহজনক কিছুই নেই, বরং আমাদের প্রত্যেকের উচিত তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানানো।

আচার্য শঙ্কুমণির বুঝতে অসুবিধা হল না যে, চাণক্যর প্রতিটি গতিবিধির খবর আচার্য ভদ্রভট্টর কাছে আছে। এবং, সব জেনেও তিনি চাণক্যর মূল উদ্দেশ্য গোপন করছেন।

শঙ্কুমণি চুপ করে আছে দেখে ভদ্রভট্ট প্রশ্ন করলেন,

—তোমার কি আর কোনো অভিযোগ আছে বিষ্ণুকে নিয়ে?

উঠে দাঁড়িয়ে প্রধানাচার্যকে প্রণাম জানিয়ে শঙ্কুমণি বলল,

—না, আচার্যপ্রমুখ। আপনি যে সবই জানেন তা বিলক্ষণ উপলব্ধি করতে পারছি। তবে, আমি নিশ্চিত এইসবের পশ্চাতে চাণক্যর কোনো বিশেষ অভিপ্ৰায় আছে। কী সেই উদ্দেশ্য তা আমি একদিন ঠিকই জানতে পারব, গুরুদেব! আজ আসি। প্রণাম নেবেন।

বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে আড়ালে দাঁড়ানো সুভাষিণীকে লক্ষ করল না আচার্য শঙ্কুমণি। সে বেরিয়ে যেতে কক্ষে প্রবেশ করল সুভাষিণী। তাকে সন্ন্যাসিনীর বেশে যতবারই ভদ্রভট্ট দেখেন, তাঁর হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। তিনি নিজেকে দোষারোপ করেন যে, তাঁর সংসারের প্রতি বিমুখতার কারণেই হয়তো তাঁর আদরের ভগিনীটি একটা স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হল। নিজের শোক ভুলতে গিয়ে তিনি এই ভগিনীটি যে তাঁকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছিল, তাকেই অবহেলা করেছেন। এই পাপবোধ তাঁকে আজকাল কুরে কুরে খায়। তবুও ঠোঁটে শুষ্ক হাসি ফুটিয়ে তিনি সুভাষিণীকে জিজ্ঞেস করলেন,

—বলো, সুভাষ। কিছু বলবে?

—না, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতেই এসেছিলাম। তোমাদের কথা শুনছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। বিষ্ণুগুপ্তকে সচেতন করে দিয়ো শঙ্কুমণি সম্পর্কে।

—হ্যাঁ, সে জানে। শঙ্কু কয়েক দিন আগেই বিষ্ণুর শিষ্য চন্দ্রগুপ্তর থেকে কথা বের করার চেষ্টা করেছে।

—তাই নাকি? চন্দ্র কি কিছু বলেছে?

মৃদু হেসে ভদ্রভট্ট উত্তর দিলেন,

—চন্দ্রগুপ্ত নামের কিশোরটিকে তো তুমি ভালোই চেনো। সে কী পরিমাণ বুদ্ধিমান ও চতুর তা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না। অতএব, সুকৌশলে ও শঙ্কুর প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছে।

—যাক, তাও ভালো। কিন্তু জ্যেষ্ঠ, বিষ্ণুগুপ্ত এইসব করে ঠিক কোন উদ্দেশ্য সাধন করতে চাইছে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রভট্ট উত্তর দিলেন,

—সে ইতিহাস লিখতে চলেছে, সুভাষিণী। এবং, আমি তাকে চিনি, তাই জানি যে, এই অসম্ভব কাজে সে আজ নয়তো কাল ঠিকই সফল হবে।

১৩.

চাণক্য তাঁর ষড়যন্ত্রের জাল নিঃশব্দে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। ধনানন্দ তাকে প্রথম প্রথম গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু তাঁর সভায় একজন ছিলেন যিনি, বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যকে চিনতেন— প্রধানামাত্য কাত্যায়ন। তিনি জানতেন যে, চাণক্য কোনো সাধারণ ব্রাহ্মণ নয়। তাঁর অপমানের জল অনেকদূর গড়াবে। তাই অমাত্য কাত্যায়ন সতর্ক ছিলেন। চাণক্যর কীর্তিকলাপের দিকে তিনি নজর রেখেছিলেন গুপ্তচর মাধ্যমে।

সুভাষিণী জানত যে, বেশিদিন চাণক্যর গতিবিধি গোপন থাকবে না। তার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে একদিন মগধের তরফ থেকে বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যকে রাজদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর নামে দণ্ডাদেশ জারি করা হল। রাজদ্রোহের একটাই শাস্তি মৃত্যু! অতএব, যে বা যারা চাণক্যকে ধরিয়ে দিতে পারবে, তাদের জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করল মগধ। সুতরাং, বিষ্ণুগুপ্তকে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আত্মগোপন করতে হল।

কিন্তু, সুভাষিণী জানত যে, বিষ্ণুগুপ্ত যেখানেই থাকুক, তক্ষশিলার সঙ্গে সে বরাবরই যোগাযোগ রেখে চলেছিল। তাঁর বৃত্তের ছয় শিষ্যর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। এ কাজে প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট তাঁকে সাহায্য করতেন আড়াল থেকে। তাঁর কাছে কোনোদিন কোনোকিছুই গোপন করেননি বিষ্ণুগুপ্ত। শুধু তাঁর আর সুভাষিণীর কথাটাই বোধ হয় একমাত্র বিষয় যা কোনোদিন বলে উঠতে পারেননি বিষ্ণুগুপ্ত।

চাণক্যকে ধরিয়ে দেওয়ার পুরষ্কারের মূল্য ক্রমেই বাড়তে থাকল। গোটা মগধে যেখানেই বিদ্রোহ হয়, বা, যখনই কোনো ছোটো জনপদের রাজা পাটলিপুত্র আক্রমণ করে, তার নেপথ্যে একজনেরই নাম উঠে আসে— চাণক্য! কিন্তু, তাঁর সমস্ত ষড়যন্ত্র ও আঘাত প্রতিহত করে, চাণক্যর পথে এক প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ধনানন্দর প্রধানমন্ত্রী অমাত্য কাত্যায়ন! যিনি ইতিমধ্যে লোকমুখে পরিচিত হয়েছেন অমাত্য ‘রাক্ষস’ নামে।

বিষ্ণুগুপ্তর শত্রু কিন্তু শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেই ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরেও একজন ছিলেন যিনি তাকে ধরিয়ে দিতে কোমর বেঁধে লেগেছিলেন— আচার্য শকুনি! তিনি বহুবার চেষ্টা করেছেন চাণক্যর শিষ্যদের মাধ্যমে চাণক্য অবধি পৌঁছোতে।

সুভাষিণী জানে শঙ্কুমণি অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং ধূর্ত। সে বুঝতে পারছিল যে, এভাবে বেশিদিন চললে আজ নয়তো কাল ঠিকই বিষ্ণুগুপ্তর নাগাল পেয়ে যাবেন আচার্য শকুনি। কে বলতে পারে, হয়তো তিনি ইতিমধ্যে পেয়েও গিয়েছেন। তিনি অপেক্ষা করছেন পুরস্কারের স্বর্ণমুদ্রার পরিমাণ আরও বাড়ার। সঠিক সময়ে তিনি বিষ্ণুগুপ্তর সন্ধান পৌঁছে দেবেন অমাত্য রাক্ষসের কাছে।

একদিন সুভাষিণীর কাছে চাণক্যর শিষ্য চন্দ্রগুপ্ত এসে যা বলল তাতে সুভাষিণীর মনের দুশ্চিন্তা আরও বাড়ল।

চন্দ্রগুপ্ত জানাল আগের দিন আচার্য শকুনি তাদের সরাসরি বলেছেন,

—তোমাদের গুরু নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করে, তাই না, চন্দ্রগুপ্ত? তোমরা মনে করো, আমি জানি না যে, তোমাদের কাছে নিয়মিত পত্র আসে জনৈক ‘কৌটিল্য’ নামের এক ব্যক্তির থেকে? এই কৌটিল্যই যে আসলে চাণক্য, তা আমি জানি! তোমাদের গুরুকে বলে দিয়ো যে আমার চোখে ধুলো দেওয়া সহজ নয়!

চন্দ্রগুপ্তর মুখে একথা শুনে বুক কেঁপে উঠল সুভাষিণীর। সে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেল প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টর নিকটে। সব শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন ভদ্রভট্ট। কিছুক্ষণ ভেবে তিনি সুভাষিণীকে বললেন,

—বিষ্ণু ও তার ছাত্রদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গেলে সর্বপ্রথমে শঙ্কুমণিকে তক্ষশিলা থেকে সরাতে হবে।

—কিন্তু, তা আপনি কীভাবে করবেন, জ্যেষ্ঠ? তাকে কি বিতাড়িত করবেন? সুভাষিণীর উত্তরে হাত তুলে ‘না” সূচক ইঙ্গিত করে ভদ্রভট্ট বললেন,

—তা আমি কখনোই করতে পারি না, সুভাষ। বিষ্ণু ও শঙ্কু দু—জনই আমার শিষ্য। আমি তাদের গুরু হিসেবে কখনোই একজনের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে অন্যের ক্ষতি করব না। তা ছাড়া, শঙ্কুমণি শিক্ষক হিসেবে বিষ্ণুগুপ্তর প্রায় সমতুল্য। তাকে বিতাড়িত করার প্রশ্নই আসে না। যদি না সে নিজের ইচ্ছায় বিদ্যালয় ত্যাগ করে।

—জ্যেষ্ঠ, আপনি কোনো উপায় করুন। আমি আপনাকে চিনি এবং জানি যে, বিষ্ণুগুপ্ত হোক বা শঙ্কুমণি, বুদ্ধিতে আপনি বাস্তবে এদের গুরুদেব। আপনার মস্তিষ্কে এই সমস্যার কোনো সমাধান ইতিমধ্যে এসেছে বলেই আমার বিশ্বাস।

ভদ্রভট্ট চোখ বুজে কিছু ভাবছিলেন। ভগিনীর কথা শুনে তাঁর ঠোঁটে হাসি ফুটল। বললেন,

—একটা উপায় আছে। গতকালই গান্ধারের রাজা অম্বিরাজের থেকে পত্র এসেছে। তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রী পদের জন্যে যোগ্যব্যক্তির সন্ধান করছেন এবং আমার কাছে মনোনয়ন চেয়েছেন। আমি ভেবেছি আমি শঙ্কুমণির নাম সুপারিশ করে পত্র লিখব। শঙ্কু নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান এবং দক্ষ কূটনীতিবিদ। তা ছাড়া, সে গান্ধারের ভবিষ্যৎ রাজা, অর্থাৎ, অম্বিরাজের পুত্র অম্বিককুমারের গুরু ছিল এই বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাকালে। অতএব, আমার মনে হয় সে এই পদের জন্যে যোগ্যব্যক্তি। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিষ্ণুগুপ্ত যেখানে একজন পলাতক আচাৰ্য মাত্র, সেখানে সে রাজপদ পেতে চলেছে। আমার ধারণা শঙ্কুমণিও এহেন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করবে না।

সুভাষিণী তার জ্যেষ্ঠকে প্রণাম জানিয়ে বলল,

—ধন্য আপনার মস্তিষ্ককে, জ্যেষ্ঠ!

ভদ্রভট্টর পরিকল্পনা বিফল হয়নি। আচার্য শকুনি পরম উৎসাহের সঙ্গে গান্ধারের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন পরের মাসেই। কিন্তু, এর ফল খুব দ্রুত ভুগতে হয়েছিল গোটা ভারতবর্ষকে।

১৪.

ক্রমে সেইদিন এল, যেদিন চাণক্য আর ভদ্রভট্টর আশঙ্কা সত্য হল। অলকশেন্দ্ৰ তার বিশাল সেনাসহ ভারতের চৌকাঠে এসে পৌঁছোল। সুদূর ম্যাসিডন থেকে শুরু করে প্রায় অর্ধেক পৃথিবীজুড়ে নিজের বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করে গ্রিক বাহিনী পৌঁছোল গান্ধারের সীমানায়। আগামীর আশঙ্কায় প্রমাদ গনল আর্যাবর্তর রাজা ও প্রজারা।

অর্ধেক বিশ্বকে পদদলিত করা এই সুবিশাল সেনার মুখোমুখি ভারতের যে একমাত্র মহাশক্তি দাঁড়াতে পারে, দুর্ভাগ্য যে সেই মগধের শাসক ডুবে রয়েছে বিলাসিতা ও মদিরায়।

জরুরি ভিত্তিতে পঞ্চনদের রাজাসহ অন্যান্য অমাত্যদের সভা আয়োজন করা হল গান্ধারে। নিরপেক্ষ স্থল হিসেবে বেছে নেওয়া হল তক্ষশিলা। নিজেদের বহু বছরের শত্রুতা সত্ত্বেও গান্ধাররাজ ও পর্বতেশ্বর পুরু সেই সভায় যোগ দিলেন ভদ্রভট্টর আহ্বানে। উপস্থিত ছিলেন চাণক্যও। সভার নেতৃত্ব দিলেন আচার্য ভদ্রভট্ট।

সেখানে পুরু চাণক্যকে প্রশ্ন করলেন,

—আচার্য, ক্ষমা করবেন, কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে জাগছে। আপনি নন্দ সাম্রাজ্য শেষ করে নিজের প্রতিশোধ সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। সেক্ষেত্রে তো যবন সেনার ভারত আক্রমণ আপনার জন্যে সুবর্ণ সুযোগ হতে পারত, আচার্য। আমি শুনেছি যবন সম্রাট অলকশেন্দ্র বিদেশি পণ্ডিতদের বড়ো সম্মান করে। আপনি তো ইচ্ছে করলেই অলকশেন্দ্রর সঙ্গে যোগ দিয়ে, তার সাহায্যে মগধকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারেন। কিন্তু আপনি তা না করে, যবনদের বিরুদ্ধে সবাইকে এক করতে চাইছেন। এর কারণ কী?

চাণক্য হেসে উত্তর দিয়েছিলেন,

—আমার উদ্দেশ্য বুঝতে আপনার ভুল হয়েছে, রাজন। নন্দ সাম্রাজ্যের পতন আমার অভিপ্রায়ের একটা অংশ মাত্র। মগধে সুশাসন স্থাপনা ও গোটা আর্যাবর্তকে একত্র করে এক শক্তিশালী রাষ্ট্র নির্মাণ করাও আমার উদ্দেশ্য, মহারাজ। বিদেশি শক্তির হাতে দেশকে তুলে দিলে আমরা কোনোদিনই শক্তিশালী রাষ্ট্র হতে পারব না। আমরা দাস হয়েই থেকে যাব। তাই নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্যে দেশমাতৃকার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে করব, পুরুরাজ?

সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, অভ্যন্তরীণ দ্বেষ ভুলে, বিদেশি মহাশক্তির মোকাবিলা সবাই একসঙ্গে করবে। গান্ধারের সীমানাতেই আটকে দেওয়া হবে যবন সেনাবাহিনীকে। এবং, এ কাজে গান্ধারকে সাহায্য করবে পুরুর সেনাবাহিনী।

এর কয়েক সপ্তাহ বাদে এক বিকেলে কুটিরের দ্বারে কড়া নাড়ার শব্দ পেল সুভাষিণী। কড়া নাড়ার শব্দ থেকেই তার অভ্যস্ত কান বুঝতে পারল যে ভদ্রভট্ট এসেছে। কাজের ভারে কার্যালয়েই দিন—রাত্রি যাপন করেন আজকাল ভদ্রভট্ট। তাই অনেকদিন পর জ্যেষ্ঠ বাড়ি এসেছে দেখে প্রফুল্ল চিত্তে দ্বার খুলে দিল সুভাষিণী।

কিন্তু, দ্বার খুলে ভদ্রভট্টর গম্ভীর মুখ দেখেই সে বুঝল কিছু একটা ঘটেছে। কোনো কথা না বলে ভেতরে প্রবেশ করে ক্লান্ত চিত্তে মেঝেতে পাতা আসনে বসে পড়লেন ভদ্রভট্ট।

—কী হয়েছে, জ্যেষ্ঠ?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রভট্ট উত্তর দিলেন,

—খুব খারাপ খবর, সুভাষ। গান্ধারনরেশ অম্বিরাজ অকস্মাৎ গতকাল দেহত্যাগ করেছেন। সিংহাসনে বসেছে তাঁর পুত্র অম্বিক। সে সিংহাসনে বসেই পুরুরাজের সঙ্গে তার পিতার স্থাপন করা মৈত্রী চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছে।

—সেকী? কিন্তু, কেন? যবন সেনাকে গান্ধার একা কখনোই প্রতিরোধ করতে পারবে না! পুরুরাজের সাহায্য তাদের নিতান্তই প্রয়োজন। অম্বিকুমারের শিক্ষক ও প্রধানমন্ত্রী তো আচার্য শঙ্কুমণি। তিনি কী করছেন?

দু—হাতের আঙুল জড়ো করে তার ওপর মাথা রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসলেন ভদ্রভট্ট। বললেন,

—আমার ধারণা গোটাটাই ঘটছে শঙ্কুর অঙ্গুলিহেলনে। মহত্ত্বের আকাঙ্ক্ষা তার সুবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করছে এবং সে এক ভয়ংকর পথে অগ্রসর হয়েছে। আমার তো সন্দেহ… না, সন্দেহ বলা ভুল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস অম্বিরাজের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। অম্বিককে আমি যতদূর দেখেছি, সে ভীরু প্রকৃতির। তার একার এই কাজ করার ক্ষমতা নেই। নিজের পিতাকে সে হত্যা করেছে নিশ্চিতভাবেই তার আচার্য শঙ্কুমণির পরামর্শে।

—কিন্তু, কেন? আচার্য শঙ্কুমণি তো গান্ধারের প্রধানমন্ত্রী এমনিতেই ছিলেন। হঠাৎ অম্বিককে সিংহাসনে বসানোর প্রয়োজন কী ছিল তাঁর?

—রাজা অম্বি—কে ও নিজের অঙ্গুলিহেলনে চালিত করতে পারত না। কিন্তু, অম্বিককুমারকে সে নিজের ইচ্ছামতো পরিচালনা করতে সক্ষম। নিজের মহত্ত্বের আকাঙ্ক্ষা সে অম্বিকের মধ্যে দিয়ে পূর্ণ করবে। আমি নিশ্চিত এটা তার পরিকল্পনার একটা অংশ মাত্র।

—আপনি কি অনুমান করতে পারছেন কী তাঁর সেই পরিকল্পনা?

মাথা না তুলেই ‘হ্যাঁ’ সূচক ইঙ্গিত করলেন ভদ্রভট্ট। বললেন,

—শঙ্কুমণি বরাবরই ক্ষমতাকামী। অম্বিকুমার ও যবনদের সে নিজের স্বার্থসিদ্ধির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়।

—আমি ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা, জ্যেষ্ঠ।

আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভদ্রভট্ট বললেন,

—আমার আশঙ্কা যবনদের অনুপ্রবেশ আমরা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছি, সুভাষ! তারা আর্যাবর্তে প্রবেশের মুক্তদ্বার পেতে চলেছে। কারণ, শঙ্কুমণি যবনদের ব্যবহার করে গোটা দেশ নিজের অধীনে আনতে চায়। যে পথে বিষ্ণুগুপ্ত যেতে অস্বীকার করেছে দেশের স্বার্থে, শঙ্কুমণি ঠিক সেই পথেই অগ্রসর হয়েছে স্বস্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে! ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করো যেন আমার এই আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়!

আচার্য ভদ্রভট্টর আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়নি। অম্বিক সিংহাসনে বসার কয়েক দিনের মধ্যেই অলকশেন্দ্রর কাছে তার সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় গান্ধারের দূত। তাতে জানানো হয় যে, আর্যাবর্ত আক্রমণে সম্রাট অলকশেন্দ্রকে সব রকমের সাহায্য করতে প্রস্তুত গান্ধার। পরিবর্তে অলকশেন্দ্র দেশ ত্যাগ করলে যেন গান্ধাররাজ অম্বিককে গোটা দেশের শাসনভার দেওয়া হয়।

ইতিহাস সাক্ষী আছে, গান্ধারের খুলে দেওয়া পথ ধরেই ভারতে প্রথমবার প্রবেশ করে যবন সেনা। অম্বিককুমারের নাম আজও ইতিহাস মনে রেখেছে দেশের প্রথম বিশ্বাসঘাতক হিসেবে!

১৫.

অলকশেন্দ্রর ভারত জয়ের স্বপ্ন কিন্তু অধরাই রয়ে গিয়েছিল। কয়েক বছরের অভিযানে ভারতের কিছু রাজ্য তিনি জয় করেছিলেন বটে, কিন্তু সেনাবাহিনী ততদিনে দীর্ঘযাত্রায় ক্লান্ত। সুদীর্ঘ সময় ধরে দেশের থেকে দূরে থেকে তাদের মন অবসন্ন। অনেকে বলে অলকশেন্দ্র অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, কেউ বলে হঠাৎই তার হৃদয় পরিবর্তিত হয়েছিল। তাই বিশ্ববিজয় অসমাপ্ত রেখেই, ভারত থেকে ফিরতে হয়েছিল অলকশেন্দ্র ও তার যবন সেনাকে। অতএব, অধরা থেকে যায় অম্বিক, বা, বলা ভালো আচার্য শকুনির গোটা আর্যাবর্ত দখল করার ইচ্ছা।

যবনরা বিদায় নিতেই নিজের সম্পূর্ণ ধ্যান চাণক্য কেন্দ্রীভূত করেন মগধের দিকে। সাম—দাম—দণ্ড—ভেদ সমস্ত অস্ত্র ব্যবহার করে চাণক্য একের পর এক আঘাত করতে থাকেন মগধের ওপর। ততদিনে তাঁর সুযোগ্য শিষ্য চন্দ্রগুপ্ত ও হয়ে উঠেছে এক বীর যোদ্ধা ও সেনানায়ক।

চাণক্যর অন্য পাঁচ শিষ্যও ছড়িয়ে গিয়েছে গোটা দেশে। প্রত্যেকের কাঁধে রয়েছে কিছু—না—কিছু গুরুদায়িত্ব। কেউ গোপনে সেনা একত্রিত করছে, কেউ অস্ত্ৰ জোগাড় করছে, কেউ মগধের বুকে বসেই চাণক্যর গুপ্তচর হয়ে রয়েছে। আর, এইসবের কেন্দ্রে থেকে সব কিছু পরিচালনা করছেন বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য।

মগধও কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই। ধনানন্দ দেরিতে হলেও উপলব্ধি করেছেন যে, সেই ব্রাহ্মণ শিক্ষককে ক্ষমতাহীন ভেবে গুরুত্ব না দেওয়া ঠিক হয়নি। তিনি—ই এখন রাহু হয়ে দেখা দিয়েছেন মগধের জন্যে। চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তর মাথার দাম ধার্য করে গোটা দেশে তাঁদের বিরুদ্ধে মৃত্যুর পরোয়ানা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নিজের সমস্ত বুদ্ধি ও মগধের সেনাবল ব্যবহার করে চাণক্য ও চন্দ্রগুপ্তর বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে যুদ্ধ করে চলেছেন অমাত্য ‘রাক্ষস’ কাত্যায়ন!

কাত্যায়ন বুদ্ধিমান, তিনি জানতেন যে, একবার বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্যকে হত্যা করতে পারলেই বিদ্রোহীরা ধ্বংস হবে। চাণক্যই বিদ্রোহের মস্তিষ্ক এবং চন্দ্রগুপ্ত তাঁর ডান হাত। অতএব, শরীরটাকে শেষ করতে গেলে মাথাটা কাটতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে তিনি মগধের সম্পূর্ণ সেনাবল ছড়িয়ে দিলেন দেশের প্রতিটা কোণে কোণে। যেকোনো মূল্যে তিনি চাণক্যকে চান, জীবিত কিংবা মৃত!

চাণক্য বুঝতে পারলেন যে, তাঁর চারিদিকে জাল ঘনিয়ে আসছে। অমাত্য রাক্ষস যে এরকম মরিয়া হয়ে উঠবেন তাঁকে কোণঠাসা করতে তা তিনি অনুমান করতে পারেননি। এবং, তাতেই মারাত্মক ভুল হয়ে গিয়েছে! বাঁচার কোনো উপায় নজরে আসছিল না চাণক্যর।

অমাত্য রাক্ষস গুপ্তচর মাধ্যমে সংবাদ পেলেন যে ভোজ রাজ্যে, গোদাবরী নদীর তীরে অবস্থিত অরণ্যের এক গুহায়, আত্মগোপন করে আছেন চাণক্য। তৎক্ষণাৎ তার আদেশে জনা পঞ্চাশ সৈনিকের একটি দল প্রবেশ করলো সেই অরণ্যে। আক্রমণ করলো তারা সেই নির্দিষ্ট গুহায়। তাঁদের আক্রমণে নিহত হলেন চাণক্য! ধর থেকে মাথা আলাদা করে পাঠানো হল পাটলীপুত্রে। গোটা দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল চাণক্যের মৃত্যুসংবাদ!

বহুদূর তক্ষশিলায় নিজের কুটিরে বসে থাকা সুভাষিণীর কাছেও সেই সংবাদ পৌঁছোল যথাক্রমে।

১৬.

প্রধানাচার্যর কক্ষের দরজা সজোরে খুলে ভেতরে ঝোড়ো হাওয়ার মতো প্রবেশ করল সুভাষিণী।

—এ আমি কী শুনলাম, জ্যেষ্ঠ? এ খবর কি সত্যি?

তার দিকে এক পলক তাকিয়ে, কয়েক মুহূর্তের জন্যে বিস্মিত হলেন ভদ্রভট্ট। গম্ভীর স্বরে বললেন,

—জানি না। প্রার্থনা করি যেন এই সংবাদ ভুল হয়।

—আপনার সঙ্গে কি বিষ্ণুগুপ্তর যোগাযোগ নেই?

—না। গত কয়েক মাস হল নেই। কারণ, যোগাযোগের উপায়ও নেই। মগধ সেনা ও গুপ্তচর গোটা দেশ জুড়ে ছেয়ে গিয়েছে। এহেন অবস্থায় যোগাযোগ রাখা সম্ভব নয়।

—কিন্তু… কিন্তু এ যে অসম্ভব! এ হতে পারে না! আপনি যে করেই হোক যোগাযোগ করুন, জ্যেষ্ঠ।

—আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু, সুভাষ…

কিছু বলতে পারলেন না আচার্য ভদ্রভট্ট। সুভাষিণী কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। তার গমনপথের দিকে কিছুক্ষণ অপলক চেয়ে থাকলেন ভদ্রভট্ট। একটা উপলব্ধি ধীরে ধীরে তাঁর মনের গভীরে অঙ্কুরিত হচ্ছিল। নিজের মনেই ভদ্রভট্ট বলে উঠলেন,

—আমি এত অন্ধ কীভাবে হলাম? কীভাবে এতদিন আমি সত্যটা দেখতে পাইনি যা আমার চোখের সামনেই ছিল? হায় ঈশ্বর! আমার স্বজনহারানোর শোক কি আমাকে এতটাই অনুভূতিহীন করে দিয়েছে যে আমি আমার নিজের ভগিনীর মনও বুঝতে পারিনি?

মাথায় হাত দিয়ে বসলেন ভদ্রভট্ট। বড়ো ভুল হয়েছে তাঁর। তিনি যদি আগে এই সত্য উপলব্ধি করতেন, তবে তিনি কখনোই বিষ্ণুগুপ্তকে এই পথে অগ্রসর হতে দিতেন না। তিনি তাকে ফিরিয়ে আনতেন আবারও নিজের ছত্রছায়ায়। তাকে আটকে দিতেন অনেক আগেই সুভাষিণীর মুখের দিকে তাকিয়ে! কিন্তু, এখন যে কোনো উপায় নেই! অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে! অনেক দেরি!

.

সুভাষিণীর নিজেকে প্রচণ্ড নিরুপায় লাগছে। যদিও সে মনে—প্রাণে বিশ্বাস করে যে, এই সংবাদ মিথ্যা। তার বিষ্ণুগুপ্ত জীবিত আছে! আছেই! জ্যেষ্ঠ বাদে, তার মতো বুদ্ধিমান ও চতুর মানুষ এই ভূমিতে কেউ নেই। তাকে এত সহজে খুঁজে পেতেই পারে না অমাত্য কাত্যায়ন। এ নিঃসন্দেহেই বিষ্ণুগুপ্তর কোনো কৌশল। সে অপেক্ষা করবে! হ্যাঁ, হ্যাঁ, ততদিন সে অপেক্ষা করবে।

কিন্তু, এরপর কয়েক মাস অতিক্রান্ত হল, অথচ বিষ্ণুগুপ্তর কোনো সংবাদ এল না। শুধু শোনা গেল যে, গুরুর মৃত্যুতে প্রায় উন্মাদ চন্দ্রগুপ্ত বেশ কয়েক বার তার দুর্বল সেনাদল নিয়ে পাটলিপুত্র আক্রমণের বৃথা চেষ্টা করেছে। প্রতিবারই সে পরাজিত হয়ে ফিরে গিয়েছে।

সবাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, চাণক্যর মৃত্যু হয়েছে। শুধু দু—জন বাদে। একজন অবশ্যই সুভাষিণী, যে এখনও আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় ছিল তার বিষ্ণুর ফিরে আসার। আর দ্বিতীয়জন, অমাত্য রাক্ষস!

যদিও চারদিক থেকে যা সংবাদ আসছে, তাতে মনে হচ্ছে চন্দ্রগুপ্তর সেনা ছত্রভঙ্গ হয়েছে। সে যেরূপ নিতান্ত মূর্খর মতো বার কয়েক আক্রমণ করেছে মগধে, তার থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, সে মতিভ্রষ্ট হয়েছে। সবদিক থেকেই ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, চাণক্য মৃত। কিন্তু, তবুও নিশ্চিত হতে পারছেন না অমাত্য রাক্ষস। তাই এখনও মগধের গুপ্তচর ও সেনাদের ছড়িয়ে রেখেছেন তিনি দেশ জুড়ে। গোটা আর্যাবর্তর বেশিরভাগ নগরের প্রবেশদ্বারে, প্রতিটি মানুষের পরিচয়পত্র দেখে তল্লাশি নিয়ে তবেই ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। এমনকী আকাশে যদি কোনো অচেনা পত্রবাহক পাখি উড়তে দেখা যায় তবে সেটাকেও তির বিদ্ধ করে অথবা দানা ছড়িয়ে নামানো হচ্ছে। গোটা দেশ জুড়ে অজস্র সন্দেহভাজন মানুষকে বন্দি করা হয়েছে।

.

এভাবেই আরও কয়েক মাস কাটল। আচার্য ভদ্রভট্ট গোপনে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে বিফল হয়েছেন। শুধু বিষ্ণুগুপ্ত নয়, তাঁর ছয় শিষ্যদের মধ্যে কারুর সঙ্গেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তাঁর আশঙ্কা হচ্ছে যে, হয়তো তারাও ইতিমধ্যে মগধের সৈনিকদের হাতে বন্দি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁর পক্ষে সরাসরি তাদের খোঁজ নেওয়াও সম্ভব নয়। সুভাষের মুখের দিকে তাকালে তাঁর কষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের বাইরের বাকি সময়টুকু ভদ্রভট্ট শুধু চাণক্যকে নিয়েই দুশ্চিন্তা করে কাটান।

এদিকে সুভাষিণী এতদিন শুধুই অপেক্ষা করে চলেছে। রোজই একবার করে তার জ্যেষ্ঠর কাছে যায় বিষ্ণুগুপ্তর কোনো সংবাদ আছে কি না জানতে। প্রতিবারই তাকে নিরাশ হয়ে ফিরতে হয়। চারিদিক থেকে শুধুই দুঃসংবাদ আসছে।

একদিন সুভাষিণীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। সে ভদ্রভট্টর কাছে গিয়ে বলল,

—জ্যেষ্ঠ, আপনার দুটি পায়ে পড়ি! কিন্তু, আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। আজ দশ মাস, বাইশ দিন হল বিষ্ণুগুপ্তর কোনো সংবাদ নেই। অন্তত, সে বেঁচে আছে এইটুকু জানতে পারলেই আমি শান্তি পাব। দয়া করুন আমার ওপর! আপনি যেকোনো মূল্যে আমায় তার সংবাদ এনে দিন!

আদরের ভগিনীর কথা ফেলতে পারলেন না, আচার্য ভদ্রভট্ট। ভদ্রভট্ট জানেন যে, সমস্ত গোপন সংবাদ আদানপ্রদান ও চাণক্যর গুপ্তচরদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকে তার শিষ্য জীবসিদ্ধি। তাই অনেকটা ঝুঁকি আছে জেনেও তিনি কোনো নাম উল্লেখ না করে একটি পত্র প্রেরণ করলেন চাণক্যর শিষ্য জীবসিদ্ধির উদ্দেশে।

১৭.

—আর্য। অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী।

নিজের কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন অমাত্য রাক্ষস। বাইরে থেকে সৈনিকের গলার স্বর পেয়ে তিনি উঠে বসতে বসতে বললেন,

—ভেতরে এসো, সৈনিক। বলো, কী সংবাদ এনেছ?

এক সৈনিক কক্ষে প্রবেশ করে প্রধানামাত্যকে অভিবাদন জানিয়ে একটি পত্র বাড়িয়ে দিল তাঁর দিকে।

সূত্রটি হাতে নিয়ে পড়লেন কাত্যায়ন। তাঁর মুখে কোনো অভিব্যক্তি ফুটল না। কিন্তু, তাঁর মনের ভেতর সেই মুহূর্তে ঝড় উঠল। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি। কারণ, পত্রে প্রেরক বা কাকে পত্র লেখা হয়েছে ইত্যাদি কোনো নাম না থাকলেও তাঁর বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, এটা শত্রুপক্ষের চিঠি। আপাতদৃষ্টিতে এই অতি সাধারণ একটি পত্র তাঁর অভিজ্ঞ চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। কারণ, তিনি বেশ কিছু পরিচিত শব্দসমষ্টির ব্যবহার এখানে দেখতে পাচ্ছেন যা গত কয়েক বছরে তিনি বহুবার দেখেছেন চাণক্য বা চন্দ্ৰগুপ্ত বিষয়ক পত্রে। এগুলো সংকেত শব্দ। যেগুলোর কিছু কিছু তিনি নিজেও চিনে গিয়েছেন গত কয়েক বছর ধরে বিদ্রোহীদের থেকে বাজেয়াপ্ত করা অসংখ্য পত্র দেখে দেখে।

অমাত্য রাক্ষস প্রশ্ন করলেন,

—এই পত্র কোনো ব্যক্তির থেকে বাজেয়াপ্ত হয়েছে, নাকি, পক্ষীর থেকে? — পক্ষী।

অতএব, পত্রের মাধ্যমে কাউকে ধরা সম্ভব নয় ঠিকই, কিন্তু এটা যে আসলে চাণক্যর মৃত্যুসংবাদের সত্যতা যাচাই করতে লেখা হয়েছে, তা তিনি নিশ্চিত। এই তার সুবর্ণ সুযোগ! এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই তো তিনি এতদিন ফাঁদ পেতে বসে ছিলেন!

পত্র সৈনিকের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি নির্দেশের সুরে বললেন,

—পক্ষীটি জীবিত আছে?

—হ্যাঁ, প্রভু। আজ প্রভাতেই সৈনিকরা পক্ষীর দানা ছড়িয়ে জাল পেতে বসে ছিল। হঠাৎ তারা লক্ষ করে অনেকগুলো পক্ষীর মধ্যে একটি এসে বসেছে যার গলায় সুতো দিয়ে পত্র বাঁধা রয়েছে। সেই দেখেই পক্ষীটাকে জালে বন্দি করে তারা।

—সাধু! ওই পক্ষীর যেন কোনো ক্ষতি না হয়। এই পত্র ঠিক যেমন ছিল সেভাবেই পক্ষীর গলায় বেঁধে ওটাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু, লক্ষ করো সেটা কোনদিকে উড়ে যায়। আমার নির্দেশ বুঝতে পারছ, সৈনিক?

—হ্যাঁ, মহামাত্য।

—বেশ। এরপর শুরু হবে আসল কাজ। পক্ষী যে অভিমুখে উড়ে যাবে, আগামী কয়েক সপ্তাহ সেইদিক থেকে উড়ে আসা প্রতিটা পক্ষীকে আটক করতে হবে ফাঁদ ফেলে! মনে থাকে যেন, ওই দিশা থেকে উড়ে আসা একটাও পত্রবাহক পক্ষী যেন আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে না পারে! এই পত্রের উত্তরপত্রটা আমার চাইই চাই! ঘোষণা করে দাও যে, এই পত্রের উত্তরপত্রটা আমায় এনে দিতে পারলে আমি সেই সৈনিকদের পুরস্কার দেব। যতদিন না এই উত্তরপত্র পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন আমার এই নির্দেশ কার্যকর থাকবে। যেকোনো মূল্যে আমার ওই পত্রটা চাই!

—যথা আজ্ঞা, আর্য। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমার সৈনিকদের দৃষ্টি এড়িয়ে কোনো পত্রবাহক পক্ষী ফিরবে না।

সৈনিক বিদায় নিয়ে চলে যেতে অমাত্য রাক্ষস কক্ষের মধ্যে উত্তেজিত ভঙ্গিতে পায়চারি করতে শুরু করলেন। ইতিমধ্যে তিনি সন্দেহ করছেন যে গোদাবরী তটে নিহত ব্যক্তি চাণক্য নন। অতএব এই পত্রের উত্তরের সূত্রে, হয়তো তিনি চাণক্যের বর্তমান অবস্থান জানতে পারবেন। এটার উপরেই নির্ভর করছে তার পরবর্তী পদক্ষেপ!

১৮.

প্রথমে দুটো টোকা, কিছুটা পরে আরও দু—বার টোকা। দরজায় এই বিশেষ ভঙ্গিতে টোকা দেওয়ার সাংকেতিক শব্দটা শুনে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য।

তাঁর কুটিরে প্রবেশ করলেন একখণ্ড করে বস্ত্রে আপাদমস্তক ঢাকা দু—জন ব্যক্তি। তবুও দুই শিষ্যকে চিনতে অসুবিধা হল না তাঁর।

চন্দ্রগুপ্ত ও জীবসিদ্ধি চাণক্যর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। চাণক্য তাদের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন।

যাঁকে মগধের সেনা গোটা দেশে সন্ধান করে চলেছে এবং যাঁর মৃত্যু হয়েছে বলেই সবাই বিশ্বাস করে, সেই বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য এই মুহূর্তে আত্মগোপন করে আছেন এক গোপন স্থানে। প্রায় একবছর হতে চলল তিনি এভাবেই থেকেছেন। তাঁর সন্ধান শুধুমাত্র তাঁর ছয় শিষ্য ব্যতীত কেউ জানে না। চন্দ্রগুপ্ত তাঁরই নির্দেশে বার কয়েক মগধে আক্রমণের চেষ্টা করেছে। যাতে সবার মনেই এই ধারণা হয় যে, গুরুর মৃত্যুতে দিশাহারা হয়ে চন্দ্রগুপ্ত এই কাজ করেছে। চন্দ্রগুপ্তর সেনাবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু, সৈনিকরা ঠিকই রয়ে গিয়েছে। নাগরিকের বেশে তারা অপেক্ষা করছে চন্দ্রগুপ্তর পরবর্তী নির্দেশের। তলে তলে তার বাহিনীতে আরও সেনা নিযুক্ত করা হয়েছে গত এগারো মাসে, অতি গোপনে।

এই সময়ে সবচেয়ে সক্রিয় থেকেছে জীবসিদ্ধির নেতৃত্বে চন্দ্রগুপ্তর গুপ্তচর বাহিনী। আর, চাণক্যর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে শুধুমাত্র দুইজন— চন্দ্রগুপ্ত ও জীবসিদ্ধি।

—কী সংবাদ, জীবসিদ্ধি?

প্রশ্ন করলেন চাণক্য। জীবসিদ্ধি আজকে এসেছে এক মদিরা বিক্রেতার ছদ্মবেশে। গত কয়েক মাসে যতবার জীবসিদ্ধি তাঁর এখানে এসেছে, প্রতিবার তার ছদ্মবেশ ভিন্ন ভিন্ন ছিল। জীবসিদ্ধিকে প্রকৃত রূপে চাণক্য শেষ দেখেছেন সম্ভবত বেশ কয়েক বছর আগে। গুপ্তচরবৃত্তি থেকে ছদ্মবেশ ধারণ, আশ্চর্যরকমের পটু সে।

গুরুদেবের প্রশ্নের উত্তরে জীবসিদ্ধি বলল,

—অমাত্য রাক্ষস এখনও আপনার সন্ধানে একইরকমের তৎপর। তাঁর বাহিনীর মধ্যে অবশ্য অসন্তোষ আছে। কারণ, অধিকাংশ সৈনিক বিশ্বাস করে যে, চাণক্য মৃত, মহামাত্য অকারণেই তাদেরকে দিয়ে মৃতব্যক্তির সন্ধান করাচ্ছেন। কিন্তু, সেকথা অবশ্যই রাক্ষসের সম্মুখে বলার সাহস কারো নেই।

চাণক্য ঠোঁটের এককোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

—হুমম। সৈনিকদের মনে সন্দেহ আর অসন্তোষ জাগাই স্বাভাবিক। অমাত্য রাক্ষস বেশিদিন আর তবে এভাবে চালাতে পারবেন না। তাঁকে খুব শীঘ্রই সেনা ফিরিয়ে নিতে হবে রাজধানীতে।

চন্দ্রগুপ্ত বলল,

—আর একটা সংবাদ আছে, আচার্য।

চন্দ্রগুপ্ত জীবসিদ্ধিকে ইঙ্গিত করতে জীবসিদ্ধি একটা ভাঁজ করা ভূজপত্র এগিয়ে দিল চাণক্যর দিকে। বলল,

—প্রধানাচার্য পত্র লিখেছেন আমাকে। আপনার মৃত্যুর সংবাদের সত্যতা যাচাই করার উদ্দেশ্যে।

চন্দ্রগুপ্ত প্রশ্ন করল,

—এই পত্রের লেখক যে প্রধানাচার্যই, সেটা নিশ্চিত?

জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,

—হ্যাঁ, সংকেত শব্দের ব্যবহার ঠিকভাবেই করা হয়েছে এতে। এটা নিশ্চিতরূপেই প্রধানাচার্য ভদ্রভট্টর লেখা।

চন্দ্রগুপ্ত চাণক্যর উদ্দেশে বলল,

—আপনি তো তাঁকে বলেছিলেন যে, আমাদের তরফ থেকে কোনো সংবাদ না পাওয়া অবধি তিনি যেন কোনো পত্র প্রেরণ না করেন। তার পরেও তিনি হঠাৎ উতলা হয়ে এইরূপ ভুল করলেন কীভাবে?

চন্দ্রগুপ্তর কণ্ঠে উষ্মা প্রকাশ পেল। চাণক্য কিছু বললেন না। তিনি জানেন যে, এই পত্র আচার্য ভদ্রভট্ট কার অনুরোধে লিখেছেন। সুভাষিণীর পীড়াপীড়িতেই যে আচার্যপ্রমুখ এই কাজ করেছেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। পত্র পাঠ করে সুভাষিণীর মুখ স্মরণে এল চাণক্যর।

কতদিন তাকে দেখেননি বিষ্ণুগুপ্ত। তার চোখ দুটোর কথা স্মরণ করলেই বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেন তিনি। মুহূর্তের জন্যে দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি আজও। তুমি কি এখনও সন্ধ্যা নামলে বীণায় রাগরাগিণী বাজাও? বিরহের গান ধরো তুমি এখনও, সুভাষ? হায় রে অভাগি মেয়ে! কেন নিজের ভাগ্য জড়ালে তুমি আমার সঙ্গে? কেন ভুলে যেতে পারো না আমায়?

সুভাষিণীর চিন্তায় ডুবে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন চাণক্য। চিন্তার জাল ছিন্ন হল জীবসিদ্ধির ডাকে

—আচার্য, শুনছেন?

—হুমম?

—এই পত্র মাঝপথে শত্রুদের হাতে পড়েছিল, আচার্য।

চমকে উঠে জীবসিদ্ধির দিকে তাকালেন, চাণক্য। বিস্মিতভাবে জানতে চাইলেন,

—তুমি কীভাবে এত নিশ্চিত হচ্ছ, জীবসিদ্ধি?

জীবসিদ্ধি মৃদু হেসে বলল,

—আমি নিশ্চিত, আচার্য। আমরা কিছু বিশেষ কৌশল অবলম্বন করি যার ফলে আমাদের পত্র মাঝপথে অন্য কোনো ব্যক্তি পাঠ করলে তার চিহ্ন পত্রে থেকে যায়। তা ছাড়া, এই দেখুন। এর মধ্যেই এই পত্র এসেছে।

একটা ছোট্ট তামার মাদুলি চাণক্যর দিকে বাড়িয়ে দিল জীবসিদ্ধি। এই ধরনের ফাঁপা মাদুলির মধ্যে গুপ্ত পত্র ভরে, মাদুলির মুখ মোম দিয়ে আটকে দেওয়া হয়। এরপর এই মাদুলি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত পত্রবাহক পক্ষীর গলায় বা পায়ে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

একদিক খোলা মাদুলিটা চোখের সামনে তুলে ধরে পরীক্ষা করতেই চাণক্য বুঝতে পারলেন জীবসিদ্ধি কী ইঙ্গিত করতে চাইছে। মাদুলির মুখে লেগে থাকে মোমের প্রলেপের অবশিষ্ট। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যায় যে, দুই ধরনের মোমের দাগ রয়েছে। অর্থাৎ, একবার মোম ভেঙে, পুনরায় সেটা মোম ফেলে আটকানো হয়েছে। চাণক্য বললেন,

—ঠিকই বলেছ হে, জীবসিদ্ধি। এই পত্র নিশ্চিতভাবেই অমাত্য রাক্ষসের হাতে পড়েছিল।

চন্দ্রগুপ্ত প্রশ্ন করল,

—আপনি এত নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছেন যে, রাক্ষসের হাতেই এই পত্র পড়েছিল? হতে পারে মগধের অন্য কোনো সৈনিক এটা পাঠ করেছে। চাণক্য উত্তর দিলেন,

—কারণ অন্য কেউ হলে এই পত্র আবার যথাযথভাবে মাদুলির মধ্যে ভরে পক্ষীর গলায় বেঁধে উড়িয়ে দিত না। সাধারণ কোনো মন্দ—বুদ্ধি সৈনিক হলে হয় এটা ফেলে দিত বা নিজের কাছেই রেখে দিত। কিন্তু, কেউ একজন এটা পাঠ করে, এই পত্রের গুরুত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে। এবং, আমাদেরই কৌশল ব্যবহার করে, আমাদের জন্যে ফাঁদ পেতেছে! এই চতুর পরিকল্পনা করার মতো মস্তিষ্ক আমাদের শত্রুপক্ষে মাত্র একজনেরই আছে— অমাত্য রাক্ষস!

—তাহলে আমাদের কী করণীয়?

চন্দ্রগুপ্তর প্রশ্নে জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,

—এ তো খুব সহজ, ভ্রাতা! এই সুবর্ণ সুযোগ আমরা সদ্ব্যবহার করব। পত্রের উত্তরে জানানো হবে যে, আচার্যর মৃত্যুর সংবাদ সত্য। আমি নিশ্চিত আগামী কয়েক দিন ধরে এ পথ থেকে উড়ে যাওয়া প্রতিটি পক্ষীকে জাল ফেলে ধরা হবে মগধে। আমার এই উত্তর অমাত্য রাক্ষসের হাতে পৌঁছোবে।

—ঠিক বলেছ, ভ্রাতা। আচার্য চাণক্যর মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হলেই রাক্ষস তার এই গত এগারো মাস ধরে চলতে থাকা দেশব্যাপী অভিযান শেষ করবে। এবং, তাদের সতর্কতা যে মুহূর্তে শিথিল হবে, ঠিক তখনই আমরা আঘাত করব! আচার্যর সঙ্গে আলোচনা করে এখুনি এই পত্রের উত্তর লিখে ফেলো, ভ্রাতা জীবসিদ্ধি। আপনার কী অভিমত, আচার্য?

বিষ্ণুগুপ্ত উত্তর দিচ্ছেন না দেখে অবাক হল তাঁর দুই শিষ্য। আচার্যর মুখ দেখে মনে হল তিনি কিছু ভাবছেন। চন্দ্রগুপ্ত আবার প্রশ্ন করল,

—আচার্য? কী ভাবছেন, আচার্য?

চাণক্য খুব ধীরে উত্তর দিলেন,

—জীবসিদ্ধির থেকে আমার মৃত্যুসংবাদ পেলে আচার্য ভদ্রভট্টও কিন্তু বিশ্বাস করবেন যে, ‘আমি মৃত’।

জীবসিদ্ধি বলল,

—তা হবে, আচার্য। কিন্তু, সে তো সাময়িক। মগধের সুরক্ষা ব্যবস্থা শিথিল হলেই আমরা পুনরায় তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করব। এ ছাড়া তো উপায় নেই। যদি পত্রের উত্তর না লেখা হয় তাহলেও কিন্তু অমাত্য রাক্ষসের সন্দেহ হবে। উত্তর আমাকে দিতেই হবে!

চাণক্যর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল কোনো একটা যন্ত্রণা তিনি গিলে নিতে চাইছেন। তাঁর অন্তরের দ্বন্দ্ব কাউকে বোঝাতে পারবেন না। বিষ্ণুগুপ্ত জানেন যে, সুভাষিণীর কাছে তাঁর মৃত্যুসংবাদ পৌঁছোলে সে অভাগিনী সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে। কিন্তু, এই মিথ্যা পত্র না লিখলে যে, তাঁদের অভিযান কোনোদিন সফল হবে না! নন্দকে সরিয়ে কোনোদিনই অবিভক্ত ভারত নির্মিত হবে না।

হে নিয়তি! এ তোমার কেমন নিষ্ঠুর পরীক্ষা? আমায় আজকে বেছে নিতে হবে দেশ ও প্রেমের মধ্যে যেকোনো একজনকে? আমায় নির্ণয় নিতে হবে আমি আসলে কে? বিষ্ণুগুপ্ত নাকি ‘কৌটিল্য’ চাণক্য! বেছে নিতে হবে নিজের প্রতিজ্ঞা ও ভালোবাসার মধ্যে যেকোনো একজনকে!

চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে শক্ত করলেন বিষ্ণুগুপ্ত। তাঁর উত্তরের অপেক্ষায় থাকা শিষ্যদের বললেন,

—উত্তর লেখো, জীবসিদ্ধি। লেখো যে, চাণক্য মারা গিয়েছেন। বিদ্রোহীরা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিচ্ছে।

আবারও চোখ বুজে ফেললেন চাণক্য। নিজের মনেই ভাবলেন,

ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা এই পত্র পাঠের পর রাক্ষস সেটা পুনরায় যেন পক্ষীর কণ্ঠে বেঁধে প্রেরণ না করে! তাহলে পত্র পৌঁছোবে না তক্ষশিলায়। এটাই শেষ আশা। অন্যথায় …

হে সুভাষিণী, হে আমার ভালোবাসা। পারলে তোমার বিষ্ণুকে তুমি ক্ষমা কোরো বিষ্ণুপ্রিয়া। জেনো, সেই প্রথম দেখা থেকে আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি। আমার পথে চলতে গিয়ে আমি হীন থেকে হীনতর কৌশল অবলম্বন করেছি। তার জন্যে আমি পরলোকে জবাবদিহি করব, কিন্তু আমার সেই কার্যে যদি দেশের ভালো হয়, তবে তার জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী নই। বিষ্ণুগুপ্ত থেকে আমি কুটিল ‘কৌটিল্য’ হব সানন্দে! কিন্তু, তুমি… সুভাষিণী… তোমার কাছে আমি দোষী হয়ে রইলাম! একমাত্র তোমার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থনা করছি, সুভাষ! আমায় ক্ষমা করো! আমায় ক্ষমা করো!

***

পত্র পাঠ করতে করতে মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল অমাত্য রাক্ষসের। চাণক্য মৃত। এ সুখবরে তার যতটা উল্লাস হবে বলে তিনি অনুমান করেছিলেন, তা তো তাঁর হচ্ছে না? বরং, কেমন যেন হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর মনে।

তিনি মনের কোণে কি তবে আশা করেছিলেন যে, তাঁর সহপাঠী এই ব্রাহ্মণ নিশ্চয়ই জীবিত থাকবেন? মনের গভীর কোণে কি তবে স্বয়ং অমাত্য রাক্ষসও চেয়েছিলেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী যেন জীবিত থাকেন! তিনি কখনোই চাননি সব কিছু এভাবে শেষ হয়ে যাক। তবে যতদিন না চাণক্যের ছিন্ন মস্তকটি আসছে, ততদিন তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারছেন না। কিন্তু সেনা আর বেশিদিন এভাবে ছড়িয়ে রাখাও সম্ভব না। এইবার তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে রাজধানীতে।

হতাশ ভঙ্গিতে পত্র ভাঁজ করে রাখলেন তিনি। সামনে অপেক্ষায় থাকা সেনাপ্রধান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চাইল। অর্থাৎ, সে পরবর্তী নির্দেশ চাইছে প্রধানামাত্যর থেকে। নির্লিপ্ত কণ্ঠে তিনি উত্তর দিলেন,

—সেনাদের ফিরে আসার আদেশ জারি করো।

—যথা আজ্ঞা, আর্য।

সেনাপ্রধান চলে যাচ্ছিল। তাকে পিছু ডাকলেন অমাত্য,

—আর, শোনো।

—বলুন, আর্য।

তার হাতে পত্রটা দিয়ে অমাত্য বললেন,

—এই পত্র পুনরায় পক্ষীর কণ্ঠে বেঁধে আকাশে উড়িয়ে দাও। আমি চাই এই পত্র তার গন্তব্যে পৌঁছোক।

পত্র হাতে বিস্মিত দৃষ্টিতে অমাত্যর দিকে চেয়ে রইল সেনাপ্রধান। এই আদেশের মর্ম সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু, অমাত্য রাক্ষসের আদেশকে প্রশ্ন করার সাহস তার নেই। অতএব, সে পুনরায় অভিবাদন জানিয়ে বেরিয়ে গেল।

খোলা জানলার সামনে এসে দাঁড়ালেন মগধের মহামাত্য। তাঁর হৃদয় শত্রুর মৃত্যুতে ভারাক্রান্ত। এই অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা তাঁর কাছে নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তাঁর মুখ থেকে। তিনি অনুমান করতে পারেন যে, উত্তর—পশ্চিম থেকে উড়ে আসা পক্ষীর গলায় থাকা পত্রের প্রেরক কে হতে পারেন। তিনি তাঁরও আচার্য, গুরু ছিলেন একসময়ে। চাণক্যর মৃত্যুসংবাদ জানার অধিকার তাঁর আছে এবং তা থেকে অমাত্য তাঁকে বঞ্চিত করতে চান না।

এতগুলো বছর অতিক্রম করেও, কোথাও গিয়ে কাত্যায়ন ‘রাক্ষস’ হয়ে উঠতে পারেননি…।

১৯.

—প্রণাম, প্রধানাচার্য।

—এসো, ভাগদত্ত। উত্তর এসেছে কোনো?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, মহামতি।

লোকটি তার হাতের ভূর্জপত্রটা বাড়িয়ে দিল ভদ্রভট্টর দিকে। পত্রটা তার হাত থেকে নিয়ে দ্রুত পাঠ করলেন ভদ্রভট্ট। না না, নিশ্চয়ই সাংকেতিক ভাষা বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে তাঁর! আবারও ধীরে ধীরে পাঠ করলেন তিনি। তারপর আরও একবার।

তাঁর হাত থেকে পত্রটা খসে পড়ে গেল। মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন ভদ্রভট্ট। তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে, বিষ্ণুগুপ্ত আর নেই!

ভাগদত্তর অক্ষরজ্ঞান নেই। পত্রে কী আছে তা সে পড়তে পারেনি। কিন্তু, প্রধানাচার্যকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে অনুমান করতে পারল যে, এই পত্ৰ কোনো দুঃসংবাদ বহন করে এনেছে। সে বলল,

—কী লেখা আছে এতে, আচার্য? দুঃসংবাদ?

কিছুটা স্বগতোক্তির ভঙ্গিতেই ভদ্রভট্ট বললেন,

—সব শেষ! হে ভারতমাতা! তুমি তোমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুত্রকে হারিয়েছ! ঈশ্বর জানেন আগামীতে ইতিহাস কোন পথে চলবে!

ভাগদত্ত সরল মানুষ। দেশ, ইতিহাস, এইসব শব্দ তার কাছে অলীক কিছু সে বলল,

—কই? দেবী সুভাষিণী তো কিছু বললেন না পত্র পাঠ করে।

বিদ্যুৎস্পৃষ্টর মতো তার কথায় চমকে উঠলেন আচার্য ভদ্রভট্ট।

—কী বললে? সুভাষ এই পত্র পাঠ করেছে? কখন?

—এই তো কিছুক্ষণ পূর্বেই। তিনি তো রোজ একবার করে পক্ষীশালে আসেন পত্রের কোনো উত্তর এসেছে কি না জানতে। আজও এসেছিলেন, আমি তখনই পত্র নিয়ে আপনার কাছে আসতে উদ্যত হচ্ছিলাম। তখনই তিনি এলেন। আমি পত্র দিলাম, তিনি পাঠ করে বিদায় নিলেন।

—কিছু বলেছে সে?

—না তো। কেন মহামতি? আমার কি অজান্তে কোনো ভুল হয়েছে দেবী সুভাষিণীকে পত্র পাঠ করতে দিয়ে?

কী উত্তর দেবেন বুঝতে পারলেন না ভদ্রভট্ট। কিন্তু, তাঁর মনে একটা আশঙ্কার কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। এখুনি তাঁকে যেতে হবে সুভাষিণীর কাছে!

দ্রুত উঠতে গিয়ে তাঁর সম্মুখে রাখা চারপায়া উলটে গেল। সব কাগজ, নথি ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। কালি, দোয়াত উলটে কাগজে মাখামাখি হয়ে গেল। সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করেই আচার্য ভদ্রভট্ট ছুটলেন তাঁর কুটিরের দিকে।

মনে মনে বার বার তিনি বলছিলেন যেন এতক্ষণে অনেক দেরি হয়ে না যায়! সুভাষিণী! প্ৰিয় ভগিনী আমার! দয়া করে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলো না! হে ঈশ্বর, রক্ষা করো! সুভাষিণী! সুভাষ! তার কাছে পৌঁছোতেই হবে! এক্ষুনি যেতে হবে তার কাছে!

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চললেন ভদ্রভট্ট!

***

নিজের কুটিরে বসে একটা ভূর্জপত্রে বেশ অনেকক্ষণ ধরে একটা পত্র লিখছিল সুভাষিণী। গোটাটা শেষ করে পড়তে অসুবিধা হচ্ছিল কিছুটা। তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বার বার। পত্রের মধ্যে দু—এক জায়গায় অশ্রুবিন্দু পড়ে কালি উঠে অক্ষর কিছুটা অপাঠ্য হয়ে গিয়েছে।

প্ৰিয় জ্যেষ্ঠ,

আমাকে ক্ষমা করো। তোমার অনুমতি না নিয়ে আমি এ জীবনে মাত্র দুটি কাজ করেছি। এক, আমি একজনকে ভালোবেসেছি। তার কথা তোমায় কোনোদিন বলা হয়নি। সে নিজেও তোমায় বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বলে উঠতে পারেনি। নিয়তি প্রতিবার তাকে বাধা দিয়েছে। আসলে কী জানো? তা কোনোদিন হওয়ার ছিলই না, নিয়তিও তাই বিরূপ আমাদের প্রতি। আমার ভালোবাসার মানুষটা কে তা আশা করি এই পত্র পেলে তুমি নিজেই অনুধাবন করতে পারবে। আমি জানি তুমি পারবে, কারণ তুমি আমার দেখা সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ।

আমার ভালোবাসার দু—জন মানুষেরই চোখে এই বিশ্ববিদ্যালয়, এই দেশ নিয়ে প্রচুর স্বপ্ন আমি দেখেছি। একজন পারেনি। অতএব সেই দায়িত্ব তোমার ওপরেই রইল, জ্যেষ্ঠ। তক্ষশিলাকে আগলে রেখো। এই বিদ্যালয়ই যে ‘আগামী’—র নির্মাণের আঁতুড়ঘর।

দ্বিতীয় যে কাজটা আমি তোমার অনুমতি ছাড়াই করতে চলেছি, সেটা আমি জানি তোমায় আগে জানালে তুমি আমায় কোনোদিন করতে দিতে না। কিন্তু জ্যেষ্ঠ, বিশ্বাস করো আমার এই জীবনের আর কোনো অর্থ বা বাসনা অবশিষ্ট নেই। ভগবান বুদ্ধ বলেন মানুষ বহুবার জন্ম নেয়। এ জীবনে তো আমার কপালে ভাগ্যদেবী সুখ লেখেননি। এ জন্মে তো নিজের একমাত্র ভালোবাসাকে পেলাম না। আশা রাখি, পরজন্মে আমরা মিলিত হব। সে—জন্মেও প্রার্থনা করি যেন তোমাকেই জ্যেষ্ঠরূপে পাই। এইবারের মতো আমায় বিদায় দাও। আমার অস্তিম প্রণাম নিয়ো। আশা রাখি, তুমি আমায় ক্ষমা করবে।

ইতি,

বিষ্ণুপ্রিয়া সুভাষিণী

দোয়াতের নীচে পত্রটা চাপা দিয়ে রাখল সুভাষিণী। পাশেই তৈরি করে রাখা বিষের পানপাত্রটা হাতে তুলে নিল।

.

Author’s note:

চাণক্য সম্পর্কিত বিভিন্ন কাহিনিতে এক নারীর নাম বার বার উঠে আসে— সুভাষিনী। কিন্তু কী তার প্রকৃত পরিচয় অথবা সে আদৌ বাস্তব চারিত্র নাকি কাল্পনিক, তা জানা নেই। কারণ ইতিহাসে সুভাষিনীর কোনো উল্লেখ নেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *