ইতি নির্ভয়পুর – ৭

“এতে এত বিস্মিত হবার মতো কী হল মল্লিকবাবু? সেই স্কুল লাইফ থেকেই তো পেটরোগা মানুষ ছিলে। কয়েতবেলের আচার খেয়ে মনে নেই তিনদিন বমি করে স্কুলে আসোনি? একটু দৌড়ালেও হাঁপিয়ে একশা হতে। বয়েস বেড়েছে তাই হৃদয় দুর্বল হয়েছে। এত চিন্তার কিছু নেই। নিয়মে থাকো, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

অরুণাংশু একটু করুণ হেসে বলল, “তোমার সব মনে আছে তাই না অতসী?

সব মনে থাকা সত্ত্বেও আমায় ক্ষমা করে দিলে কী করে, এটা ভেবেই আজও অবাক হই। জানো হসপিটালের বেডে একা শুয়ে শুয়ে অনেকদিন পরে এমন নিশ্ছিদ্র অবসরযাপন করছি। মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ঘুরে এলাম তো তাই আরও যেন জীবনটাকে অনুভব করলাম।”

অতসী বলল, “আমি রাতে থাকতে চেয়েছিলাম তো, সাহেব বলল, একজনকে রেখেছে।”

অরুণাংশু যেন অন্য মানুষ এখন। সেই সদা ব্যবসা চিন্তায় মগ্ন, বাড়ির নিয়মে একটু এদিক-ওদিক হলে চলবে না সেই মানুষটাই যেন নয়। এ যেন জাগতিক জগৎ থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন একটা মানুষ। কথায় সেই ঝাঁজটুকু অবধি নেই। অতসীর হাতের ওপরে হাত রেখে বলল, “ভাবছি, বাড়ি ফিরে সম্পত্তির ভাগ করে দেব। তিনটি ভাগে সমান ভাগ করব।”

অতসী হেসে বলল, “সে তো হচ্ছে না মল্লিকমশাই, আমার ভাগে বেশি চাই। তারপর তোমার দুই ছেলেমেয়েদের দিয়ো। আমি যেটা চাইব সেটা দেবে তারপর ও ভাগ আমি মানব।”

অতসীকে অরুণাংশু মল্লিক ঠিক কত বছর ধরে চেনে সেটা হিসেব করতেও সময় লাগবে। সহজ হিসেবে বলা যায়, নিজেকে যতদিন চেনে ততদিনই চেনে। কখনও কোনও জিনিস নিজের জন্য দাবি করেনি অতসী। আবদারও করেনি কোনওদিন। অদ্ভুত সংযমী মেয়ে ছিল, এখন কঠিন মহিলা যতদূর মনে পড়ছে ক্লাস সেভেনে একবার ওর কাছে ঘুড়ি কেনার বায়না করেছিল অতসী। অরুণাংশু বলেছিল, “মেয়েদের অমন ঘুড়ি ওড়াতে নেই।” তারপর আর কোনওদিন কোনও বায়না করেনি অতসী। অতসীর অভিমান বড়ো ভয়ঙ্কর। পাথর গলে গেলেও সে অভিমান গলবে না। অরুণাংশু বড্ড ভয় করে সেই জেদি অভিমানকে।

মল্লিক হেসে বলল, “যা চাইবে এই বেলা চেয়ে নাও। সব মঞ্জুর হবে।”

অতসী উদাস গলায় বলল, “কথার খেলাপ আমি পছন্দ করি না। তাই ভেবেচিন্তে কথা দাও। পরে আর কথা ঘোরানো চলবে না।”

মল্লিক নিজের একটা হাত তুলে বলল, “তথাস্তু।”

অতসী শান্ত হয়েই বলল, “একবার কথা দিয়েও রাখোনি, ক্ষমা করে দিয়েছি। বারবার দেব না কিন্তু। তোমার সম্পত্তি তুমি দুই ভাগে ভাগ করবে, তোমার ছেলে আর মেয়ের নামে। আর আমার ভাগে রাখবে তুমি নিজেকে আর তোমার দুই সন্তানকে। উঁহু, এখন আর কথা বদলাতে পারবে না।”

মল্লিক বলল, “এটা ভুল হবে গো। আমি চোখ বুজলে, যদি এরা তোমায় না দেখে তখন?”

অতসী হেসে বলল, “তা হলে বুঝব আমি কিছু পাওয়ার যোগ্যই নই। সন্তান মানুষেই অক্ষম হয়েছি। আর-একটা কথা মল্লিকমশাই, একবার আমায় ছেড়ে চলে এসেছিলে, আবার আমায় ছেড়ে যাব বললে কিন্তু রক্ষে রাখব না। আমার মুখ গৌরীপুরের সবাই জানে, আশা করি তোমার অজানা নয়। যা-ই হোক, এসব বোঝাপড়া করার সময় অনেক পাব। আমরা কলকাতা যাব।”

মল্লিক অবাক হয়ে বলল, “হঠাৎ কলকাতা কেন অতসী?”

অতসী গর্বিত গলায় বলল, “আমার সাহেব তার বাবাকে আরও বড়ো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চায়। সঙ্গে আমারও কী সব টেস্ট করাবে বলে বায়না জুড়েছে।”

মল্লিক বুঝল, সাহেব আর অতসীর দূরত্ব ঘুচেছে, মনে মনে এ দিনের অপেক্ষায় থাকত অতসী। অপেক্ষায় কি শুধু অতসী থাকত? অরুণাংশুও ভাবত, সাহেব কবে বুঝবে, অতসী কোন ধাতুতে গড়া। এসব সম্পত্তি, টাকা-পয়সার অনেক ঊর্ধ্বে ওর ভাবনা। সাহেবের অবশ্য দোষ নেই। ছোটো থেকেই ওকে অতসীর বিরুদ্ধে বোঝানো হয়েছে। সাহেবের মামাবাড়ি লোকজন থেকে অরুণাংশুর বোন অবধি ওকে বুঝিয়েছিল, অতসী ওর ক্ষতি করতে চায়।

অতসী বলল, “অত আকাশকুসুম ভাবার কী আছে? মা-ছেলের ভাবে কি মন্নিকদের হিংসা হচ্ছে নাকি? যা-ই হোক, সাহেব গেছে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে। আর তোমার মেয়েও আজ ফিরছে। না, দোষ দেবে না। আমরা কেউ তাকে বলিনি। সে তার দাদাভাইয়ের গলা শুনে বুঝে গেছে, বাড়িতে কিছু একটা হয়েছে। তাই বিতানকে কল করে সব জেনেছে। এবার তোমার হোটেলের ম্যানেজারকে তো আর বারণ করা হয়নি। নূপুর কারওর কথাই শুনবে না, সে আসছে।”

অরুণাংশু চোখটা বন্ধ করল, ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। বলল, “মাঝে মাঝে অসুস্থ হওয়া তা হলে ভালো, কী বলো?”

অতসী আর সাহেব চলে গেছে। অরুণাংশ একাই শুয়ে আছে। আকাশ-পাতাল ভাবছে। আজ বড়ো গ্রামের বাড়ির স্মৃতি ঘাঁটতে মন চাইছে। চূড়ান্ত ব্যস্ততার কাটে ওর প্রতিটা মুহূর্ত। স্মৃতির পাতাগুলো তাই ক্রমশ হলদে হচ্ছে। না ওল্টানোর কারণে গুঁড়ো গুঁড়ো ধুলোও বুঝি জমছে পাতায় পাতায়। চোখ বন্ধ করে অরুণাংশু আজ ডুব দিল সেই স্কুলবেলায়।

তখন ও দশম শ্রেণির ছাত্র। গৌরীপুরের জমিদার বংশ ওদের। জমিদারি প্রথা তো কবেই শেষ হয়েছে, তবুও গ্রামের মানুষরা ওদের বড়োবাবু, ছোটোবাবু বলেই সম্বোধন করত। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলের দিকে বাড়ির উঠোনে ইজি চেয়ারে বসে শরৎ সাহিত্য পড়ছিল অরুণাংশু।

হঠাৎই বাবা এসে বলল, “তারকনাথের মেয়েটা আজ থেকে আমাদের বাড়িতেই থাকবে। তারকের স্ত্রী গত হয়েছে, তারক তো আমাদের বাড়িতেই দিনের অধিকাংশ সময় কাটায়, ছোটো মেয়ে, দেখার তো কেউ নেই। নিচেরতলার একটা ঘরে ওদের বাপ-মেয়ের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ো।”

মল্লিক-বাড়িতে অয়নাংশু মল্লিকের কথার বিরুদ্ধাচরণ করবে এমন সাহস কারওর ছিল না। কিন্তু পিসিমণি, কাকুদের যে বিষয়টা পছন্দ হয়নি সেটা ওদের আড়ালের আলোচনা শুনেই বোঝা গিয়েছিল। আড়ালে বলেছিল, “ম্যানেজারকে বেতন দেবে এটাই তো যথেষ্ট, বাড়িতে নিয়ে এসে কে তোলে? দাদার সবেতে বাড়াবাড়ি।” দাদু মারা যাবার পরে এই বিশাল বাড়ি, জমি জায়গা সবই বাবা সামলেছে একা হাতে। তাই ভাই-বোনেরা কেউই মুখের ওপরে কিছু বলতে পারত না। তবে তারকনাথকাকা ওদের বাড়িতে সব সময় থাকবে জেনে অরুণাংশুর খুব আনন্দ হয়েছিল। আসলে তারকনাথকাকা অরুণকে খুব ভালোবাসত। গৌরী নদীতে নৌকা চড়তে ইচ্ছে হলেও ও তারকনাথকাকার কাছেই আবদার করত। এমন কত ছোটো ছোটো ইচ্ছে পূরণ করত কাকা। কখনও মনে হয়নি সে ওদের জমি-জায়গা-পুকুরের লাভ-ক্ষতির হিসেব রাখা মাস মাইনের কর্মচারী। অতসী তখন ছোটো হলেও নিজেদের পজিশনটা ঠিক বুঝত। তাই অরুণ খেলতে ডাকলেও সে কখনও দোতলায় উঠতে চাইত না। অরুণের পিসি, পিসেমশাই, কাকা যে ওদের তেমন পছন্দ করত না সেটা তখন থেকেই জানত। তবে অরুণের মায়ের খুব পছন্দের মেয়ে ছিল অতসী। রোজ সকালে উঠে মায়ের পুজোর ফুল তুলে রাখত ও। মা যখন যা বলত হাসিমুখে করে দিত। মা ওকে না দিয়ে কোনও খাবার নিজে খেত না। সেটাও বাড়ির অনেকেরই পছন্দ ছিল না। বাবা তখন কলকাতায় ব্যবসা ফাঁদতে ব্যস্ত। কলকাতায় নাকি বিশাল হোটেল বানাচ্ছে বাবা। গৌরীপুরের জমি-জায়গা অনেকটাই বিক্রি করে দিচ্ছিল বাবা নিজের ভাগের থেকে। কাকা পরিষ্কার জানিয়েছিল, গৌরীপুর ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। পিসিমণিও শ্বশুরবাড়িতে পোষায়নি বলেই পিসেমশাইকে নিয়ে এখানেই থাকত। পিসেমশাই ছিল নাম করা উকিল। পসার মন্দ ছিল না। শ্বশুরবাড়ি থেকে রোজ খাওয়া-দাওয়া করে একটা গাড়ি হাঁকিয়ে কোর্টে যেত। আর কাকা ওদের গৌরীপুরের পুকুরে মাছ চাষ করার তোড়জোড় শুরু করেছিল। মোট কথা বাবা বলত, কুবেরের সম্পত্তিও বসে খেলে ফুরিয়ে যায়, তাই সেটা বাড়াতে হয়। ব্যবসা করতে হয়, সেই ব্যবসা যেটায় লাভ বেশি। কলকাতায় সারা বছর প্রচুর ট্যুরিস্ট আসে। ওখানে হোটেলের ব্যবসা ভালো চলবে। সেই শুরু মল্লিকদের হোটেলের ব্যবসার। ফুডিং অ্যান্ড লজিং দিয়েই শুরু করেছিল বাবা।

অরুণাংশুর অবশ্য ব্যবসায় তত ইন্টারেস্ট ছিল না। ওর ইচ্ছে ছিল চাকরি করার। সাহেবের মতো কোট-টাই এঁটে অফিস যাবে। ঠিক সিনেমার উত্তম কুমারের মতো। অতসীই ছিল একমাত্র বিশ্বস্ত সঙ্গী এসব মনের গোপন কথা বলার। স্কুলে বা খেলার মাঠে বললে বন্ধুরা লেগপুল করত। তাই মুখচোরা অরুণাংশু বন্ধুদের সামনে কখনও উত্তম কুমারের মতো হেঁটে দেখায়নি। মল্লিক-বাড়ির উঠোনের দক্ষিণ কোণে ঝাঁকড়া আম গাছটার নিচে একমাত্র দর্শক অতসীর সামনে উত্তম কুমার সাজত প্ৰায়ই।

অতসী অবাক হয়ে বলত, “তুমি পুরো নায়কের মতো কথা বলছ!”

বাধ্য দর্শক পেয়ে অরুণাংশু খুবই খুশি হয়েছিল। তাছাড়া ওর ছোটোখাট ফাইফরমায়েশও খেটে দিত। রান্নাঘর থেকে মুড়ির বাটিটা এনে দেওয়া, ওর বইপত্রগুলো সব গুছিয়ে রাখা এসব ধীরে ধীরে অতসীর কাঁধে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়েছিল ও। মেয়েটা পড়াশোনায় মন্দ ছিল না। এক চান্সে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল। অরুণাংশু কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছিল তখন। বাড়ি যেত ছুটিতে। গিয়ে দেখত অতসীর মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন ঘটেছে। সেই ছোটোবেলার মতো আর যখন তখন ওর ঘরে আসে না। ওর সঙ্গে হুটোপুটি করে না। ওর জন্য খেলার মাঠে গিয়ে বেপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে গলার শিরা ফুলিয়ে ঝগড়াও করে না। কেমন যেন আচমকা বড়ো হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। দেখতেও ভারি মিষ্টি হয়েছিল। নিজের যত্ন নিতে শিখেছিল। তারকনাথকাকা বলেছিল, ভালো পাত্র পেলেই বিয়ে দিয়ে দেব। অতসীর বিয়ে হয়ে যাবে অন্যত্র ভেবেই প্রথম ওর বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। অতসী ওর একান্ত নিজের। ওকে অতসীর মতো করে কেউ চেনে না। ওর আনন্দ, দুঃখ, রাগ সবটুকুর প্রকাশ জানে অতসী, সে কেন অন্যের হবে? সেই প্রথম অরুণাংশু বুঝেছিল, ও অতসীকে ভালোবাসে।

সেদিনই বিকেলে অতসীকে একটা পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। তারা অতসীকে পছন্দও করে গিয়েছিল। কিন্তু অরুণাংশু বুঝেছিল, ছেলেকে অতসীর পছন্দ নয়। ও জিজ্ঞাসা করেছিল, “ছেলে পছন্দ হয়নি বুঝি?”

অতসী ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “না, তোমার মতো নয়।”

অরুণাংশু বলেছিল, “আমি তোমায় বিয়ে করব, কিন্তু এখনও একটা বছর সময় দিতে হবে আমায়।”

অতসী কোনও কথা বলেনি সেদিন। ওর প্রচার শুধু জলে ভরে গিয়েছিল।

তারপর তারকনাথকাকা যত সম্বন্ধই এনেছিল, সব ভেঙে গিয়েছিল। অতসী অপেক্ষায় ছিল কবে অরুণ সকলকে বলবে ওদের সম্পর্কের কথা। না কাউকে বলার সুযোগই দেওয়া হয়নি অরুণকে। ও গ্র্যাজুয়েশন করার পরেই বাবা আচমকা তার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল অরুণাংশুর। মাকে অরুণ বলেছিল অতসীর কথা, মা বোধহয় বলেছিল বাবাকে। এসব শুনে রাতারাতি তারকনাথকাকার কাজটা চলে গিয়েছিল। অতসীরাও আশ্রয়হারা হয়ে ফিরে গিয়েছিল ওদের নিজেদের ভাঙা বাড়িতে। তারকনাথকাকা নিজের জমানো টাকায় বাড়িতেই একটা ছোটো দোকান দিয়েছিল। বাবা আর মেয়ে মিলে সেই দোকান চালাচ্ছিল। ওদিকে কলকাতার বাড়িতেই মহা ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল অরুণাংশুর। গৌরীপুর থেকে আত্মীয়রা এসেছিল কলকাতায়। নিরুপমাও উচ্চবিত্ত বাড়ির মেয়ে। অহংকারী আর মেজাজি হওয়া সত্ত্বেও বাবার তাকে পছন্দের কারণ বোধহয় নিরুপমার বংশ পরিচয়। লজ্জা আর অপরাধবোধের কারণেই অরুণাংশু আর কখনও যায়নি অতসীদের বাড়ির সামনে দিয়ে। ইনফ্যাক্ট গৌরীপুরেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল ও। ততদিনে বাবাও ওখানের দায়িত্ব কাকা আর পিসির ওপরে দিয়ে মাকে নিয়ে কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছিল। তারপর বাবা-ই কোথা থেকে খবর নিয়ে এসে বলেছিল, নির্ভয়পুরে হোটেল বানাতে হবে। পাহাড়ি এলাকা, এখনও জায়গার দাম কম। বাকিটা যদিও অরুণাংশুই করেছিল। বাবা মারা যাবার এক বছরের মাথায় সাহেব পেটে এসেছিল নিরুপমার। বাবার মতোই ধবধবে ফরসা হয়েছিল সাহেব। সকলের রীতিমতো বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, অয়নাংশু মল্লিক ব্যবসা সামলাতে আবার চলে এসেছে।

নিরুপমার উদ্ধত আচরণে মা প্রায়ই লুকিয়ে আফসোস করত, আর বলত, “সে কত যত্ন করত আমার, কত বুঝদার ছিল। আমার কপালে ছিল না তাই।”

অরুণাংশু অদ্ভুত একটা অপরাধবোধে ভুগত। লুকিয়ে দেখতে গিয়েছিল অতসীকে একদিন, কিন্তু চোখাচোখি হয়ে যেতেই অতসীই এগিয়ে এসে বলেছিল, “বাবা চলে গেল অরুণদা। যাবার আগে তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চেয়েছিল। আমিই খবর দিইনি। যদি আবার আকাশ-কুসুম কিছু আবদার করে বসে তোমার কাছে, লজ্জার শেষ থাকবে না। তাই আর দেখা করানো হল না। তোমার ছেলেকে নিয়ে তোমার পিসি সারা পাড়া ঘোরাতে এনেছিল, তখনই দেখলাম। জেঠুর মতো দেখতে হয়েছে। তোমার হাতের আংটিটা বহুদিন আগে থেকে গচ্ছিত ছিল আমার কাছে। সাহেবের মুখ দেখে ওটাই ফেরত দিলাম। তোমার পিসি দেখে বলল, ‘অরুণের আংটি চুরি করেছিলি হতচ্ছাড়ি?’ তুমি আমায় চোর বদনামটুকুও দিয়ে দিলে অরুণদা। তোমার পিসিকে বলা হল না, মল্লিকবাড়ির ছেলেই এটা হতচ্ছাড়ির আঙুলে পরিয়ে দিয়েছিল একদিন। থাক গে, চুরির বদনাম মন্দ কী? দুশ্চরিত্রার বদনাম তো আগেই পেয়েছিলাম, এবারে পেলাম চোর।”

অরুণাংশু বলেছিল, “বিয়ে করলে না কেন?”

অতসী হেসে বলেছিল, “সারা পাড়া জানে, আমি আশ্রিতা হয়ে মল্লিক বাড়ির ছেলের দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম। আমি লোভী, দুশ্চরিত্রা, তারপর আর কে বিয়ে করবে আমায় বলো দেখি?”

অরুণাংশু বলেছিল, “বাজে কথা। অনেক ছেলেরই তোমায় পছন্দ হয়েছিল আমি জানি। বিয়েটা তুমিই ভেঙেছিলে।”

অতসী হাতের কাজ সারতে সারতে বলেছিল, “ভালোবাসায় বিশ্বাস হারিয়েছি, তাই করিনি। তুমি এখন এসো অরুণদা, না হলে আবার আমি বদনাম কুড়াব। দোকানটুকু চালিয়ে চলে যাচ্ছে, বন্ধ হলে মুশকিলে পড়ব।” অরুণাংশু ভয়ে ভয়েই বলেছিল, “তোমায় কিছু টাকা দিতে পারি আমি? নেবে?”

অতসী হেসে বলেছিল, “হঠাৎ টাকা কেন? মুখ বন্ধ রাখার জন্য? কই মুখ তো আমি খুলিনি কোনওদিন। তোমার পিসি চোর বলল, তখনও খুলিনি। তা হলে আবার অকারণ অপচয় কেন?” আর দাঁড়ায়নি অতসী।

অরুণাংশু ওকে যতটুকু চিনেছিল তাতে বেশ জানত, আর কোনওদিনই কিছু হাত পেতে নেবে না ও। একদিন ও অরুণের কাছে ঘুড়ি কেনার বায়না ধরেছিল, অরুণ বলেছিল, মেয়েরা ঘুড়ি ওড়ায় না। সেই অভিমানে আর কোনওদিন কোনওকিছুর বায়না করেনি অতসী। আর এখন তো অতসীকে প্রবঞ্চিত করেছে ও, তাই যত অভাবেই কাটুক, ওর কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নেবে না। ফিরে এসেছিল অরুণাংশু।

কাকা মারা যাবার পরে গৌরীপুরের সঙ্গে সম্পর্কেও ছেদ পড়েছিল। সাহেব যখন মাত্র বছর দুই তখন মা-ও চলে গেল। নিরুপমার অহংকারে অরুণাংশুর জীবন প্রায় ওষ্ঠাগত। মা থাকতে তাও নিজের কথা বলার একটা মানুষ ছিল। নিরুপমার তো শুধুই অভিযোগ ওকে ঘিরে। হাজার চেষ্টা করেও নিরুপমার মন পেল না অরুণাংশু। নির্ভয়পুরের ব্যবসাটা তখন সবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল, তাই বেশিরভাগ সময় নির্ভয়পুরেই কাটাচ্ছিল। কলকাতার ব্যবসা দেখার জন্য বাবার আমল থেকেই দুজন বিশ্বস্ত লোক ছিলই, তাই অরুণাংশু বেশিরভাগ সময়ই নির্ভয়পুরের চা-পাতা দিয়ে ঘেরা জনপদে কাটাতে পারছিল। কলকাতার বাড়ির সদাসর্বদা কোলাহল থেকে বেরিয়ে একমুঠো শান্তি। নিরুপমার রোজকার অসন্তোষের তাপ থেকে পালিয়ে এসে একটু শীতলতা পাওয়া। নিরুপমার দিদি, জামাইবাবুও ওদের কলকাতার বাড়িতে প্রায়ই আসত। বোনের অভিযোগ শুনে অরুণাংশুকে শাসন করতে আসত। কখনও নিরুপমার বড়দা এসে বলে যেত, “বোনকে আমরা বড়ো আদরে মানুষ করেছি অরুণ, অবহেলা করার জন্য নয়।” অরুণাংশুর বলা হয়ে ওঠেনি, নিরুপমাকে সে কোনওদিনই অবহেলা করেনি, বরং অবহেলিত হয়েছে বিয়ের পর থেকেই। ভেবেছিল সাহেব হবার পরে নিরুপমার স্বভাবে পরিবর্তন হবে, কিন্তু সেটা তো হলই না, বরং তার মেজাজ আরও তীব্র হল। অরুণাংশু চেষ্টা করত, কাজের অতিরিক্ত সময়ে নিরুপমার মন জুগিয়ে চলতে, কিন্তু কীসে যে মানুষটা খুশি হবে বুঝতেই পারল না গোটা বিবাহিত জীবনে।

কলকাতা থেকে তারপর ছোটো সাহেবকে নিয়ে ওরা গিয়েছিল নির্ভয়পুরের নতুন বাংলোতে। নতুন পরিবেশে এসে নিরুপমার বিরক্তি তিনগুণ বেড়ে গেল। এমন পাহাড়ি পরিবেশও তাকে শাস্তি দিতে পারল না। লোকজন জেনে গেল, অরুণাংশু মল্লিক তার স্ত্রীর কাছে রোজ অপমানিত হন। ছোটো জনপদে কথা হওয়ায় ভাসে। বাধ্য হয়েই কলকাতা ফিরে গিয়েছিল অরুণাংশু। সাহেবকে স্কুলে ভর্তি করা হল, এদিকে নিরুপমা প্রায়ই অসুস্থ হতে লাগল। কলকাতার বড়ো ডাক্তার দেখিয়ে ধরা পড়ল লিভার ক্যানসার। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল সেদিন অরুণাংশুর। ছোটো সাহেবকে নিয়ে কী করবে ও! নিরুপমার বাড়ির লোকজন প্রায় জোর করেই মেয়েকে নিয়ে চলে গেল। হাজার ট্রিটমেন্ট করিয়েও বাঁচিয়ে রাখা গেল না নিরুপমাকে। হাজার অভিযোগ নিয়েই সে চলে গেল। অরুণাংশুর সুযোগ হল না সেসব অভিযোগ খণ্ডন করার। তাই স্ত্রীর চোখে দোষী হয়েই রয়ে গেল। আত্মীয়-স্বজন সকলেই বলতে শুরু করল, “এই বয়সে স্ত্রী বিয়োগ হল, ছেলেটাকে দেখবে কে?” সাহেবের তখন বছর দশেক।

বিয়ে করে সংসার করার ইচ্ছেটুকু ততদিনে চলে গিয়েছিল ওর। নিরুপমাকে খুশি করতে পারেনি, অতসীর চোখে অপরাধী হয়েছিল আগেই। প্রেমিক হিসেবে চূড়ান্ত ব্যর্থ, স্বামী হিসেবেও ব্যর্থ মানুষ অরুণাংশু, এটাই মেনে নিয়েছিল মনে মনে। আবারও আর-একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোনও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু অরুণাংশুর দুই পিসতুতো বোন উঠে-পড়ে লেগে গেল। পিসি আর কাকা মারা যাবার পরে গৌরীপুরের বাড়িতে ওরাই আসা-যাওয়া করত। অরুণাংশু কখনও ওদের পিসতুতো বোন ভাবেওনি। নিজের বোনের মতোই সম্পর্ক ছিল ছোটো থেকে। প্রতি ভাইফোঁটায় ওরাই ফোঁটা দিয়েছে ওকে। দুই বোনই পিসির জেরক্স কপি যেন।

প্রায়ই পাত্রীর ছবি নিয়ে হাজির হচ্ছিল। সে এক বিড়ম্বনা।

আচমকাই অরুণাংশ অতসীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। হাত জোড় করে বলেছিল, “তুমি তো জানো আমি চিরকালের স্বার্থপর। নিজের ছাড়া কিছু‍ই বুঝি না। নিরুপমা চলে যাবার পর থেকে বড়দি রোজই পাত্রীর ছবি নিয়ে হাজির হচ্ছে। তুমি তো জানো, আমায় কেউ বুঝতেই পারে না তুমি ছাড়া। নিরুপমার মতো আর-একটা মেয়ের অভিযোগের দায় কাঁধে নিতে পাচ্ছি না। আর-একবার ভেবে দেখবে অতসী?”

অতসী হেসে বলেছিল, “সেদিনও বাড়ির বাধ্য ছেলে ছিলে, আজও তাই থাকো। কেন অকারণ এই বয়সে এসে আমায় নিয়ে টানাটানি করছ মল্লিকবাবু?”

হঠাৎই অরুণদা বদলে গিয়ে মল্লিকবাবু হয়েছিল ওর ঠোঁটে। অনেক সাধ্য-সাধনা করে দুই বছরের চেষ্টায় অতসীকে রাজি করানো গিয়েছিল। তাও অরুণাংশু অসুস্থ ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল অরুণাংশু। প্রায় যায় যায় অবস্থা। কলকাতার এক নামী নার্সিংহোমে ভর্তি ছিল দীর্ঘদিন। কার কাছ থেকে যেন খবর পেয়ে অতসী এসে হাজির হয়েছিল। সেরে ওঠার পরে অরুণাংশু আর অতসী রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করেছিল। তখনও বড়দি খুবই রাগ করেছিল। নিরুপমার বাপের বাড়ির লোকজন বলেছিল, সাহেবকে তারা এই পরিবেশে রাখবে না। বাধ্য হয়েই হস্টেলে ভর্তি করেছিল ছেলেকে।

অতসী মাঝে মাঝেই বলত, “মল্লিক-বাড়ির সম্পত্তির লোভেই এই বিয়ে করেছি এমন কথাই রটিয়েছে তোমার বড়দি আর বোন। না, সে সব রটনা নিয়ে এই বয়সে আর ভাবি না, কিন্তু সাহেবকে বোঝানো হয়েছে, তাকে আমি মেরে ফেলব, দিয়ে তোমার সম্পত্তি দখল করব। ছেলেটা কেমন আতঙ্কের চোখে তাকায় আমার দিকে। সাহেবের ওই চাউনিটাই আমার বুকে ক্ষতর কারণ।”

অরুণাংশু বুঝেছিল, সাহেব অতসীকে কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না, আর অতসীও সাহেবের উপস্থিতিতে কেমন একটা আড়ষ্ট হয়ে থাকছে। সাহেব যখন হস্টেল থেকে ফিরত তখন অতসীকে কয়েকদিনের জন্য নির্ভয়পুরে রেখে যেত অরুণাংশু। এভাবেই চলছিল। জীবন কোনওদিনই অরুণাংশুকে একচ্ছত্র সুখ দেয়নি।

অতসী প্রায়ই বলত, “মল্লিকবাবু, জীবনে মানুষ বোধহয় একবারই ভালোবাসে, দ্বিতীয়বার যেটা আসে সে সমঝোতা।”

অরুণাংশু বুঝত, অতসী কোনওদিনই ওকে ক্ষমা করেনি। নূপুর হবার পরে অতসী বলেছিল, “দেখো মল্লিকমশাই, মেয়ের কপাল যেন মায়ের মতো না হয়। কেউ যেন তাকে না বলে সম্পত্তির ভাগিদার হবে বলে এ পৃথিবীতে এসেছে।”

অরুণাংশু বুঝত, অতসী তাকে যতু করত, সমস্ত কর্তব্যও করত কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন একরাশ ক্ষোভ পুষে রেখেছিল।

বাড়িতে কেউ এলেই তার কাছে গল্প করত, “আসলে আমি তো মল্লিক-বাড়ির আশ্রিত ছিলাম, আপনাদের মল্লিকমশাই আমায় দয়া করে উদ্ধার করেছেন। ওঁর বড়ো মন, তাই এ বাড়ির কর্ত্রী হতে পেরেছি।”

অরুণাংশু পুরুষ, সফল ব্যবসাদার তাই তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে নেই। বলতে নেই, এ জীবনে শান্তি সে খুব কমই পেয়েছে। অতসী হয়তো পারত সব ভুলে ওকে আপন করে নিতে। কিন্তু অতীতে বাস করা অতসী সেটা পারেনি। কিছুতেই ভুলতে পারেনি, ওদের একদিন তাড়িয়ে দিয়েছিল মল্লিকবাড়ি। কিছুতেই ভুলতে পারেনি, তার একান্ত কাছের মানুষটাই অন্যের সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছিল। ভুলতে পারেনি, তাকে ওই বাড়ির সবাই দুশ্চরিত্র, চোর বলেছিল। তার বাবাকে বলেছিল, মেয়েকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে তারকনাথ। এত, এত কথার ভিড়ে অরুণাংশুর নিষ্পাপ ভালোবাসাটা কবেই যেন পদপিষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই অতসী নুপুরের মা হয়েছে, অরুণাংশুর স্ত্রী হয়েছে, সাহেবের আন্টিও হয়েছে কিন্তু অরুণদার সেই অতসী হয়ে উঠতে চায়নি আর। চেষ্টা করার সাহসও ছিল না ওর। অতসীর শীতল অভিমানকে আজও ভয় পায় অরুণাংশু। কোথা থেকে যে এত সাহস পায় মেয়েটা কে জানে! পকেটে দশ টাকা নিয়েও রাস্তায় বেরিয়ে যেতে পারে এক কাপড়ে, খেতে না পেলেও কারওর কাছে মুখ ফুটে না বলে কাটিয়ে দেবে, এসব কারণেই স্ত্রীকে নয়, অতসী মল্লিককে বেশ সমঝে চলেও। বলা যায় না কখন আবার অভিমানের ঠান্ডা পর্দায় নিজেকে ঢেকে ফেলবে অতসী, সেই পর্দা ছেঁড়ার ক্ষমতা অরুণের নেই। অতসীর ঠোঁটের হাসিটা বড়ো মূল্যবান ওর কাছে। কদাচ সেই প্রাণখোলা হাসি দেখতে পেয়েছে অরুণ ওর ঠোঁটে বিয়ের পর থেকে। আজও তেমনই একটা মূল্যবান দিন ওর কাছে, আজ অতসীর ঠোঁটে হাসি, চোখের পাতায় তৃপ্তির ছোঁয়া। আনমনেই সিলিং-এর দিকে তাকিয়েছিল অরুণাংশু, খেয়াল করেনি, কখন শৌনক এসে পাশে দাঁড়িয়েছে।

“কী ব্যাপার মল্লিকবাবু? আজ বেশ ফুরফুরে লাগছে দেখছি আপনাকে শরীরে এই মুহূর্তে কোনও সমস্যা নেই, তবে সাহেব চাইছে একজন বেস্ট কার্ডিওলজিস্ট দেখিয়ে নিতে কলকাতা গিয়ে। আমি আগামিকাল রিলিজ করে দেব। ঘুরে আসুন তিলোত্তমা থেকে।”

অরুণাংশু একটু কুণ্ঠিত হয়েই বলল, “আসলে শৌনক, সাহেব বোধহয় একটু ভয় পেয়েছে। তাই হঠাৎ কলকাতা নিয়ে যেতে চাইছে। আমি কিন্তু বেশ আছি। মানে তোমাদের ট্রিটমেন্টে সেরে উঠেছি।”

শৌনক বিনীতভাবে বলল, “ভুল করছেন মল্লিকবাবু, চিকিৎসা এখন অনেক উন্নত হয়ে গেছে। কলকাতার হসপিটালে বা নার্সিংহোমে যে সব ইনস্ট্রুমেন্ট ইউজ করেন ডাক্তাররা, সে সব আমরা পাব কোথায়? তাই ইচ্ছে থাকলেও আমরা ওই ট্রিটমেন্ট রোগীকে দিতে পারব না। বিশেষত হার্টের ব্যাপারে অবশ্যই দেখিয়ে নেওয়া উচিত।”

অরুণাংশু বুঝল, শৌনক পরিমার্জিত শিক্ষায় মানুষ। তাই সাহেবের মতো ব্যবহার সে করবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *