ইতি নির্ভয়পুর – ২৭

২৭

মৃণাল ঘোষাল থম হয়ে বসে আছে। কনকলতা গুনগুন করে গান গাইছে আর বনসাইয়ের ডাল ছাঁটছে। কনকের এমন নিস্পৃহ ব্যবহার দেখে আর থাকতে না পেরে রাগে চিৎকার করে উঠল মৃণাল। ঘোষালবাড়ির মহিলারা কোনওদিন তাদের স্বামীর বিরোধিতা করেনি। তাদের এত সাহসই হয়নি, এ বাড়ির পুরুষের মুখের ওপরে কথা বলবে, সেখানে এত সাহস হয় কী করে কনকের? ওই আদিবাসী ছেলেটার সঙ্গে মিটিংয়ে, মিছিলে গিয়ে বসেছিল, কোনও বারণ শোনেনি মৃণালের। এটাই ছিল চূড়ান্ত অবাধ্যতা। কিন্তু এতেও থেমে থাকেনি কনক। আজকের পাওয়া খবরে চমকে গেছে মৃণাল। বুঝে উঠতে পারছে না, এতটা স্পর্ধা ও পেল কোথায়!

চিৎকার করে বলল মৃণাল, “তুমি উকিল ডেকেছিলে? শোনো কনক, তোমার নামে যা সম্পত্তি আছে সেগুলোও এই ঘোষালবাড়ির। তুমি বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসোনি। তাই এ বাড়ির সম্পত্তি তুমি যাকে খুশি দিয়ে দিতে পারো না।”

কনকলতা হেসে বলল, “ধুর মৃণাল, তুমি দেখছি আইনকানুন কিছুই জানো না। কনকলতা ঘোষালের নামে থাকা সব সম্পত্তি আমি যাকে ইচ্ছে দিতে পারি। আমার স্বামী বা সন্তান কেউ কিছুই করতে পারে না এক্ষেত্রে। আর-একটা কথা, এ সম্পত্তি আমার শাশুড়িমা আমায় দিয়ে গিয়েছিলেন। তুমি নও।”

মৃণাল রাগে গজগজ করে বলল, “তুমি জানো বড়ো রাস্তার ধারের ওই জমিটা কিনবে বলে আমায় খোকন হাজরা কত দাম দিয়েছিল? এক কোটি টাকা। তুমি ওই জমিটা সুজয়ের নামে রেজিস্ট্রি কেন করে দিয়ে এসেছ? ওই জমিতে আমরা একটা নার্সিংহোম করব ভেবেছিলাম।”

“এত দরদ কীসের?” কনক শান্ত গলায় বলল, “ওই জমিটা হাসিনীর বাবার কাছ থেকে তোমার বাবা কত টাকায় কিনেছিলেন মৃণাল। মাত্র দশ হাজার টাকায় না? শর্তটা যেন কী ছিল? ক্ষমতা থাকলে সত্যিটা বলো। ও জমি সুজয়ের দাদুর। তাকে ঠকিয়ে ওই জমি আত্মসাৎ করেছিল ঘোষালরা, তাই যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিলাম।”

মৃণাল রাগে ফুঁসে উঠে বলল, “তুমি কি ন্যায়ের প্রতিমূর্তি নাকি?”

কনক একটু বিকৃত গলায় বলল, “ন্যায়ের প্রতিমূর্তি হতে পারলাম কই? তা হলে তো হিসেব মতো সুজয়কে এ বাড়ির অধিকারও ছেড়ে দিতে হয়, তাই না মৃণাল? কারণ, এ বাড়ির বাগানটাও তো হাসিনীদের জায়গাতেই।”

মৃণাল রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “আমার বাবা ন্যায্য টাকা দিয়েই এই সম্পত্তি কিনেছিল ওদের কাছ থেকে।”

কনক আর কথা না বাড়িয়ে নিজের বেডরুমে ঢুকে গেল, মিনিট তিনেক পরে এসে হাজার পঞ্চাশেক টাকা মৃণালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নাও তোমার কাছ থেকেও আমি ওই জমিটা কিনে নিলাম।”

মৃণাল ব্যঙ্গ করে বলল, “কোটি টাকার জমি তুমি পঞ্চাশ হাজারে কিনতে চাইছ?”

কনকলতা মৃণালের সাদা-কালো চুলে হাত বুলিয়ে বলল, “তবে যে তোমার মা বলতেন ছেলের আমার অঙ্কের মাথাটা খুব সাফ ছিল? মাত্র ত্রিশ বছর আগে দশ হাজারে কেনা জমির দাম কী করে কোটি টাকা হয় মৃণাল? কোন অঙ্কের হিসেবে? আমাকে বেশি কথা বলতে বাধ্য কোরো না। তা হলে নির্ভয়পুরের আদি বাসিন্দাদের খুঁজে খুঁজে আমিও ওই ফিসফাসের রহস্য বের করে আনতে বাধ্য হব তোমার সন্তানদের সামনে।”

মৃণালের মুখটা মুহূর্তে যেন কালো হয়ে গেল। কনকলতা নিজের কাজে মন দিল। মৃণাল শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর সাধের বাগানের দিকে। কী জানে কনক? হঠাৎ কেন সুজয়কে লিখে দিল ওই জমিটা? তবে কি হাসিনী আর ওর সম্পর্কের কথা কেউ বলে দিয়েছে ওকে? কিন্তু তখনকার কথা এতদিন পরে বলবে কে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *