ইতি নির্ভয়পুর – ১৮

১৮

“এমন ব্যবহারের মানে কী? কনকলতা তুমি ঠিক কীসের প্রতিশোধ নিচ্ছ এই বয়সে এসে?” মৃণাল হিসেবের ডায়রিটা পাশে সরিয়ে রেখে বলল।

কনকলতা সোফায় আরাম করে বসে বলল, “আমায় কড়া করে এক কাপ চা দিস তো মণিমালা। উফ, হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে সুজয়টা আমার হাঁটুর জং ছাড়িয়ে দিয়েছে। আবার বলে কি না, ‘জেঠিমা পরেরদিন আপনাকে বক্তৃতা দিতে হবে।’ বোঝো কাণ্ড! এই বয়সে এসব অভ্যাস আছে? তা বলে কি না, বয়েস নাকি একটা সংখ্যা মাত্র। প্রেম করার আর রাজনীতিতে নামার নাকি কোনও নির্দিষ্ট বয়েস হয় না।”

মণিমালা বলল, “যা-ই বলো কনকদিদি, ছেলেটার কথায় কিন্তু জোর আছে। মনে হয় বসে দু’দণ্ড শুনি।”

মৃণাল ঘোষালের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। বেশ জোরেই বলল, “কী ব্যাপার? আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি তার কোনও উত্তর নেই কেন? হঠাৎ এত ঝাঁসির রানি সাজার ইচ্ছে হল কেন?”

কনকলতা হেসে বলল, “এই বাসন্তী, তোদের বাবুকে আজ ঘোলের শরবত, লেবু চা কিছুই দিসনি নাকি? মাথাটা অকারণে গরম করছে, এরপর প্রেশার বাড়বে তো। ওহ, তুমি যেন কী বলছিলে? ঝাঁসির রানি না কী? এটা কি যেমন খুশি সাজো প্রতিযোগিতা নাকি? তুমি কলির কেষ্ট সাজবে, আমি ঝাঁসির রানি, পামেলা রাধা।”

মৃণালের রাগে টকটকে মুখটা মুহূর্তে কালো হয়ে গেল। ধপ ধপ পা ফেলে চলে গেল।

মণিমালা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি চেপে বলল, “উফ, তুমি পারো বটে দিদি।”

কনকলতা বলল, “হাসি পরে হবে। কালকে বাজার থেকে চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন সব কিনে সুজয়ের কাছে দিয়ে আসবি। আর কিনবি মাংস। কাল নির্ভরপুরে আমার জন্মদিন পালন হবে। সেই উপলক্ষে নির্ভয়পুরবাসীর নিমন্ত্রণ, বুঝলি? দেখিস ফুটবল টুর্নামেন্টে যেন একটা লোকও না যায়।”

মণিমালা বলল, “পামেলা মিত্র এবারে তোমায় চিবিয়ে খেয়ে নেবে কিন্তু।”

কনকলতা বলল, “আর জ্বালাস না বাপু, আমি কি পুরুষের মাথা নাকি যে পামেলা আমায় চিবিয়ে খাবে?”

মণিমালা হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়ল।

কনকলতা নিজের ঘরে গিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আটপৌরে শাড়িটা গায়ে জড়াতে জড়াতেই ভাবল, নির্ভয়পুরের মাটির যারা আসল দাবিদার তাদেরই উচ্ছেদের ব্যবস্থা করতে চাইছে পামেলা, এটা তো হতে দেওয়া যায় না। পলাশবনার পাশের সড়কের ধারে ওর অনেকটা জমি নাকি কেনা আছে। কার কাছ থেকে কিনেছে, সেটা অবশ্য কেউ জানে না। এখন ওখানে বসবাস করা মানুষদের তুলে ও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বানাতে চায়। ও ক্ষমতায় এলেই কিছু মানুষ আগে বে-ঘর হবে। সুজয়, শৌনক এরা বলেছে, পামেলা রাঘবের থেকেও ভয়ংকর। ওই সুন্দর মুখের আড়ালে কদাকার রূপটা এখনও অনেকেই দেখেনি। কনকলতা নিজেকে বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নায় ভালো করে দেখল। হঠাৎই ওর জুলপির পাকা চুলের আড়ালে দেখতে পেল সেই ক্লাস ইলেভেনের দুই বিনুনির মেয়েটাকে।

স্কুলের গেটের পাশেই ছিল হরেনজ্যাঠার ছোটো কুঁড়ে। হরেনজ্যাঠা সকাল দশটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত সময় একটা চকচকে অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়িতে ঘুগনি বানিয়ে কাঠের জলচৌকির ওপরে রেখে বিক্রি করত। স্কুলের সব ছাত্রী লাইন দিয়ে ওই ঘুগনি খেত। সঙ্গে আবার কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা আর পাতিলেবুর রস। সে এক স্বর্গীয় সুখস্বাদ ছিল।

হঠাৎই একদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বললেন, “স্কুলের বাইরে খাবার নিয়ে বসা যাবে না।”

বয়স্ক হরেনজ্যাঠার সংসার চলত ওইটুকু দিয়েই। সেটা বন্ধ করে দিতে বেচারা কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল। তখন কনকলতাই স্কুলের সব ছাত্রীকে নিয়ে স্কুলের গেট অবরোধ করেছিল। সবার হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘স্কুলের বাইরে হরেনজ্যাঠাদের বসতে দিতে হবে। না হলে আমরা ক্লাস বয়কট করব।’ কনকই ছিল ওই আন্দোলনের নেত্রী। ছাত্রীদের চাপে পড়ে বড়দিমণি নিমরাজি হয়েছিলেন। তারপর থেকে কনক ঘুগনি কিনতে গেলেই হরেনজ্যাঠা এক হাতা ঘুগনি বেশি দিত ওর শালপাতায়। সেসব প্রতিবাদী গুণগুলোকে মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছিল ঘোষাল বাড়ির লক্ষ্মী বউ হবার জন্যই। মৃণাল ঘোষালের যোগ্য স্ত্রী হবার জন্য। এই বয়সে এসে সুজয়ের সঙ্গে মিছিলে হেঁটে আজ মনে হচ্ছে, সেই স্কুলবেলার কনকলতাটা বহুবছর শুধু ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। এতদিনে তার ঘুম ভেঙেছে। মৃণালের চেঁচামেচিতে তাকে আর শীতঘুমে পাঠাবে না ও। কনকলতার একটাই উদ্দেশ্য, সুজয়কে জেতানো। ওদের জিনিসে ওদেরই অধিকার থাক। এত কাছ থেকে সুজয়ের সঙ্গে ও কখনও মেশেনি। দেখেছে কয়েকবার ঠিকই, কিন্তু আলাপ ছিল না সেভাবে। মেশার পরে বুঝেছে, ছেলেটার মধ্যে আগুন আছে। সত্য আছে। আর সত্য আছে বলেই সত্যের সৌন্দর্যও আছে। মাইক হাতে যেন জ্বলন্ত মশাল। আর যখন কনকলতাকে নরম গলায় এসে বলল, “জেঠিমা, হাঁটতে কষ্ট হলে আপনি বরং বাড়ি ফিরে যান। এতটা হাঁটা তো আপনার অভ্যাস নেই। একটু জল খাবেন?” কত যত্ন লুকিয়ে ছিল কথাগুলোর মধ্যে। কনকলতার দুই সন্তানও মাকে ভালোবাসে যথেষ্ট, কিন্তু ঘোষালবাড়ির ছেলে-মেয়ে বলেই হয়তো গুরুজনদের সম্মান করতে শেখেনি সেভাবে। কারণ এরা ছোটো থেকেই জানে, এদের প্রচুর টাকা। যখন যা ইচ্ছে সেটাই করতে পারবে। এদের পাশেই দশজন বয়স্ক মানুষ পরিচারিকা রূপে হুজুর হুজুর করার জন্য রেডি থাকে। তাই আক্ষরিক অর্থে বিশাল ডিগ্রিধারী হলেও মানুষকে যোগ্য সম্মান করতে শেখেনি। মা মানে ওদের কাছে এমন একটা মানুষ, যে ওদের ভালো-মন্দ দেখার জন্যই এ বাড়িতে আছে। তার ভালোমন্দের খোঁজ নেবার বিশেষ প্রয়োজন নেই। সেখানে সুজয়ের এই সম্মান আর যত্নে আপ্লুত কনকলতা। সোনা, হীরে, চুনি, পান্নার গয়নার থেকেও আজকের সম্মানটা ওকে অনেক বেশি আনন্দ দিয়েছে। এই দু’দিনেই ছেলেটার প্রতি কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে। মণিমালার মুখে শুনছিল, সুজয় কত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছে। মণিমালাকে বলতে হবে, ভালোমন্দ একটু রেঁধে ছেলেটাকে একদিন দিয়ে আসতে।

কাপড় ছাড়া শেষ হতেই আয়নায় দেখল পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে মৃণাল। দেখেও না দেখার ভান করে সোফায় বসে টিভির সুইচ অন করল কনকলতা।

মৃণাল শান্ত মেজাজে কনকের পাশে বসে বলল, “কনক, তুমি কি এখনও আমার ওপরে রেগে আছ? দেখো পামেলা মিত্রকে আমিও তেমন পছন্দ করি না, কিন্তু ব্যবসার খাতিরে রাঘবকে যেমন হাতে রাখতে হত, তেমনই পামেলাকেও হাতে রাখতে হবে। পামেলার আন্ডারেই থাকবে আমাদের অঞ্চলটা। এখানে কী হবে না হবে ও-ই ঠিক করবে এবার থেকে। এই যে তুমি সুজয়ের মিছিলে জনসমক্ষে হেঁটে এলে, এতে কি পামেলা আমাকে ছেড়ে কথা বলবে? ক্ষমতায় এলেই আমার গাড়ির রুট নিয়ে ঝামেলা বাধাবে। ওদিকে আমি কালিম্পং পর্যন্ত রুটের পারমিট পাওয়ার জন্য ছুটোছুটি করছি, আর তুমি কিনা পামেলাকে চটাচ্ছ?”

কনকলতা হেসে বলল, “তা হলে তো আমি তোমার উপকারই করছি মৃণাল। কারণ আমাদের পঞ্চায়েত ইলেকশনে সুজয়ই জিতবে, সেই বুঝেই তো আমি সুজয়ের দলে যোগ দিলাম। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, তোমরা যত চেষ্টাই করো, পামেলা মিত্র এবারে হারছেই।”

মৃণাল বলল, “সে হারলে হারুক, কিন্তু জিতলে তো আগে আমায় বাঁশ দেবে। কারণ তুমি হেঁটেছিলে সুজয়ের মিছিলে, তাই।”

কনকলতা বলল, “তুমি বরং একটা কাজ করো, পামেলার হাত নয়, গলা জড়িয়ে ধরে বলো, আমার স্ত্রী বড়ো অবাধ্য। আমার কথা শোনে না। আমরা দুজনে আলাদা ইউনিট। দিয়ে ভাবটা আর-একটু বাড়িয়ে নাও। পামেলা যেমন মহিলা তাতে আমার মনে হয়, পুরুষের মুখ থেকে স্ত্রীর নিন্দে শুনতে ও ভালোই বাসবে। তুমি এখন এসো মৃণাল। আমি এই সিরিয়ালটা দেখব। এতে একটা চরিত্র আছে জানো তো, পঞ্চান্ন বছর বয়সে স্বামীর অবৈধ সন্তানের কথা জানতে পেরে স্বামীকে ডিভোর্স দেবে বলে মনস্থির করেছে। এই চরিত্রটা আমার এত ভালো লাগে কী বলব! এই ইন্দ্রাণী চরিত্রটার জন্যই আমি সিরিয়ালটা দেখি।”

মৃণাল বেশ বুঝতে পারছে, কনকলতা বদলে গেছে। এই বদলটাকে মেনে নিতে না পারলেও মেনে নিতে হবে মৃণালকে। কারণ, কনকলতা সত্যিই মৃণালের কথা শুনছে না। মৃণালকে খুঁজে বের করতে হবে পামেলার সঙ্গে মৃণালের ওই ঘনিষ্ঠ ছবিটা কে পাঠাল ওর ফোনে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *