ইতি নির্ভয়পুর – ১৩

১৩

ডাক্তার শোভন বসু ড্রয়িং রুমে এসে বসেই একটু তিরিক্ষি মেজাজে বলল, “কল্পনা, এক কাপ কড়া করে কফি করে দে।”

কল্পনা এ বাড়ির সব সময়ের পরিচারিকা। শোভনের গলার স্বর শুনেই নিবেদিতা আন্দাজ করল, কিছু একটা হয়েছে চেম্বারে। সাধারণত রোগীদের হ্যান্ডেল করার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে শোভন। কিছুতেই তেমন বিরক্ত হয় না ও। শোভন বলে, “কার্ডিওলজিস্টদের বিরক্ত হলে চলবে? আমি বিরক্ত হলে আমার পেশেন্টের হৃদয় আরও বিচলিত হবে যে। তাই যা-ই প্রশ্ন করুক, মাথা ঠান্ডা রাখতেই হবে।”

শোভনের চেম্বারে আসা রোগীদের প্রশ্নের বহর শুনলে নিবেদিতার মনে হয় ওরই বোধহয় হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। দিন কয়েক আগে এল ভদ্রমহিলা এসে শোভনকে বলেছেন, “ডাক্তারবাবু, আমার বর্তমান বয়েস পঞ্চান্ন আর স্বামী সাতান্ন। আমরা দুজনেই মর্নিং ওয়াকে যাই, খুব কম তেলে রান্না খাই। তারপরেও ইদানীং আমার হার্টটা দুর্বল হয়ে পড়ছে।”

শোভন নাকি ইসিজি করার আগেই জিজ্ঞাসা করেছে, “কখনও হাঁপ ধরছে সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে?”

ভদ্রমহিলা বলেছেন, “না ডাক্তারবাবু, হাঁপ তো ধরে না। শুধু টাইগার শ্রফের হটনেস দেখলে আমার বুকের হৃৎপিণ্ডটা কেমন যেন লাফিয়ে ওঠে।”

শোভন এদিকে টাইগার শ্রফ কে সেটাই চেনে না। অমিতাভ বচ্চনের পরে আর কোনও নায়ক জন্মেছে বলেই না মনে করা শোভন বলে বসেছিল, “রিসেন্ট ঘটেছে? কোথায় দেখেছিলেন? সুন্দরবন না থাইল্যান্ডে? সুন্দরবনেরগুলো একটু ভয়ের কারণ বই-কি, তবে থাইল্যান্ডে ওদের ইনজেক্ট করা থাকে, চমকানোর কিছু নেই।”

ভদ্রমহিলা নাকি পাক্কা পঞ্চাশ সেকেন্ড চোখের পলক না ফেলে শোভনের দিকে তাকিয়েছিলেন। ঠিক যেন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ডাইনোসোর দেখতে পেয়েছেন। তারপর চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, যে ডক্টর টাইগার শ্রফকে চেনে না তার কাছে নাকি চিকিৎসা করাবে না।

শোভন বাড়ি ফিরে শানুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “হ্যাঁ রে, টাইগার নামের কোনও প্লেয়ারকে চিনিস? যার হটনেস দেখে পঞ্চান্নর মহিলার হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে?”

শৌনক বেচারা তখন সদ্য কোল্ডড্রিঙ্কের বোতল খুলে মুখে ঢেলেছিল। সে ড্রিঙ্ক তো মুখ থেকে মেঝেতে ফেলে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটেছিল। তারপর হাসতে হাসতে বলেছিল, “বাবা, টাইগার শ্রফ কোনও প্লেয়ার নয়, ফিল্ম আর্টিস্ট। জ্যাকি শ্রফের ছেলে, নতুন উঠছে।”

তখনও টাইগার শ্রফের ঝুলিতে বোধহয় দুটো মাত্র সিনেমা ছিল।

শোভন ভ্যবাচ্যাকা খেয়ে বলেছিল, “জানিস, ভদ্রমহিলা আমায় রীতিমতো অপমান করে গেছে ওই টাইগার শ্রফের জন্য। বলে গেছে, যে ওকে চেনে না তার কাছে নাকি হার্টের চিকিৎসাই করা যায় না।”

নিবেদিতা আর শৌনক সেদিন হাসতে হাসতে সোফাতেই শুয়ে পড়েছিল।

শৌনক বলেছিল, “এই জন্যই তো বলি, শোলে আর সিলসিলা বত্রিশ বার করে না দেখে এখনকার কিছু মুভিও দেখো।”

শোভন টাইগার শ্রফকে চিনে ভদ্রমহিলাকে ফোন করে বলেছিল, “সত্যিই ম্যাডাম ছেলেটার হটনেস দেখে আপনার হৃদয় যে বিচলিত হচ্ছে, এটা কোয়াইট ন্যাচারাল। আপনার সব রিপোর্ট পারফেক্ট আছে। তাই আপনি নিশ্চিন্তে টাইগার শ্রফের মুভি দেখুন। হার্টের ওই চমকানি এনজয় করুন।”

ভদ্রমহিলা এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে নিজে হাতে পায়েস আর মাংস রান্না করে শোভনকে খাইয়ে গিয়েছিলেন।

এমন ধরনের পেশেন্টকেও হ্যান্ডেল করেছে শোভন, তাই নিবেদিতা বেশ বুঝতে পারছে এসব নয়, অন্য কিছু ঘটেছে। যেটার কারণে ও স্থির হয়ে বসতেই পারছে না। নিবেদিতার আজ চেম্বার থাকে না। আগের থেকে প্র্যাকটিস অনেক কমিয়ে দিয়েছে। এখন সপ্তাহে দু’দিন মাত্র চেম্বার রেখেছে। কিন্তু শোভন রিটায়ার করব রিটায়ার করব বলে বলে এখনও সপ্তাহে চারদিন চেম্বার করে।

ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা জল বের করে নিবেদিতা শোভনের হাতে দিয়ে বলল, “এই গরমে হঠাৎ কড়া কফি কেন? কী হয়েছে?”

শোভন টিভিটা রিমোট দিয়ে অন করে বলল, “কেন? এ বাড়িতে কি আমার ইচ্ছে মতো কিছু খাওয়াও যাবে না? সেটাও কি আজকাল সবার পারমিশন নিয়ে করতে হবে?”

কথা বলতে বলতেই নিবেদিতার হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে নিমেষে খেয়ে ফেলল। নিবেদিতার আন্দাজ যে নির্ভুল সেটা আরও বুঝল, শোভনের মেজাজ হারানো দেখে। কিন্তু এই মুহূর্তে জিজ্ঞাসা করলে ও আরও রেগে যাবে তাই নিবেদিতা ধৈর্য ধরেই বলল, “কল্পনা শুধু কফি আনবি না, সঙ্গে বিস্কিট আনবি।”

শোভন যেন চাইছে নিবেদিতা কথা বলুক, তা হলে ও আক্রমণ করতে পারবে। আবারও তিরিক্ষি মেজাজে বলল, “কেন আমি বিস্কিট চেয়েছি? আমার মনমর্জির তো কোনও মূল্য নেই এ বাড়িতে। ওদিকে তোমার পুত্র তো যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াচ্ছে। এতটা অসম্মান করে কী করে ছেলেটা আমাকে, সেটাই তো বুঝতে পারি না আমি!”

নিবেদিতা শান্ত গলায় বলল, “ফোন করেছিল শানু? কিছু বলেছে তোমায়?”

শোভন বলল, “না না, ফোন সে কেন করবে? আমরা তো পাপী, মিথ্যাবাদী মানুষ। আমাদের ফোন করলে তো তার ইগো হার্ট হবে। আজ কলকাতা থেকে এক পেশেন্ট এসেছিল। সঙ্গে পেশেন্টের ছেলে আর স্ত্রী। অরুণাংশু মল্লিক। নির্ভয়পুরে থাকেন। ভদ্রলোকের রিসর্ট, হোটেলের বিজনেস। ওঁর হার্টের প্রবলেম ধরা পড়েছে। স্টেন্ট বসবে গোটা তিনেক। অরুণাংশু মল্লিকের ছেলে বলল, আসলে নির্ভয়পুরে ভালো কার্ডিওলজিস্ট নেই, সরকারি হাসপাতালের হাতুড়ে ডাক্তার এনজিওগ্রাফি করে বলেছে স্টেন্ট বসাতে হবে। আমরা রিস্ক নিইনি ওই হাতুড়ে ডাক্তারের কথায়। সোজা কলকাতার বেস্ট হার্ট স্পেশালিস্টের কাছে নিয়ে চলে এসেছি। আপনি যা বলবেন, যেভাবে বলবেন, সেটাই করব।”

নিবেদিতা বলল, “তারপর? মানে, এতে তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন?”

শোভন বলল, “বুঝতে পারছ না তাই তো? নির্ভয়পুর সরকারি হাসপাতালের ওই হাতুড়ে ডাক্তার হলেন তোমার গুণধর পুত্র। তার হাতের প্রেসক্রিপশন দেখলাম। দুর্দান্ত ডায়গনসিস করেছেও সে। কলকাতা মেডিকেল কলেজ ছেড়ে যে নির্ভয়পুরে যায়, তাকে লোকে হাতুড়েই বলে। তোমার ছেলে মনে করছে বিশাল সমাজসেবী হয়ে গেছে সে, জানেও না তার আড়ালে লোকজন তাকে নিয়ে কী ভাবে। আমার অমন ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করা ছেলেটাকে ওখানের ওই অর্ধশিক্ষিত লোকজন হাতুড়ে ডাক্তার বলছে নিবেদিতা, আর আমায় সেটা সহ্য করতে হচ্ছে। ভদ্রলোককে জাস্ট বাঁচিয়ে দিয়েছে শৌনক তৎক্ষণাৎ রাইট মেডিসিন দিয়ে। আর ছেলেটা বলে কি না হাতুড়ে ডাক্তার? কোনও কৃতজ্ঞতাবোধ নেই গো। ওরা জানে শৌনকের রেজাল্ট? জানে ওর মেডিকেল কলেজের চাকরি ছেড়ে নির্ভয়পুর যাওয়ার ইতিহাস? নিবেদিতা, আমার আজ ইচ্ছে করছিল এক থাপ্পড়ে ছেলেটার দাঁতগুলো ফেলে দিই। শৌনকের লেখা প্রেসক্রিপশন দেখলাম নিবেদিতা। দেখবে? আমি প্রিন্ট আউট বের করে নিয়েছি।”

নিবেদিতার দু’চোখে জল। ঠোঁট কাঁপছে। ব্যাগ থেকে বের করে নিবেদিতার হাতে দিয়ে বলল, “দেখো হাতের লেখাটা পুরো তোমার মতো হয়েছে। মনে আছে আমি বলতাম, এমন সুন্দর কবিতা লেখা হাতের লেখার ডাক্তার জীবনে দেখিনি। শানুর হাতের লেখাও তোমার মতো স্পষ্ট, তাই না? টানটা একইরকম, তাই না? আগে এতটা খেয়াল করিনি কখনও। আজ যেন বেশি করে বোঝা যাচ্ছে।”

নিবেদিতা শৌনকের লেখা প্রেসক্রিপশনে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আর কিছু জানতে পারলে?”

শোভন বলল, অরুণাংশু মল্লিক খুবই ভদ্রলোক। তিনি তো শৌনকের নামে ঢোক গিলছেন। ওঁর স্ত্রী ভদ্রমহিলাও বারবার স্বীকার করলেন, ডাক্তারবাবুর জন্যই এ যাত্রা বেঁচে গেছেন। নির্ভয়পুরের লোকজন নাকি এ ডাক্তারকে ভগবানের মতো বিশ্বাস করে। আমি বললাম, ‘যতদূর শুনেছি আপনাদের ওই হসপিটালে তো কোনও ডাক্তারই এক বা দুই বছর টেকে না। ইনি ক’বছর আছেন?’ তো অরুণাংশুবাবু বললেন, ‘তা প্রায় চার-পাঁচ বছর আছেন’।”

নিবেদিতা বলল, “পাঁচ বছর সাতাশ দিন শানু ওখানে আছে।”

শোভন একটু বিরতি নিয়ে বলল, “উনি বলছিলেন, ওঁর মেয়েও নাকি শৌনককে দেখে ইন্সপায়ার্ড হয়ে নির্ভয়পুর হসপিটালেই চাকরি নিয়েছে। বলেছে, শৌনক ওর আদর্শ। কিন্তু এ সবই বলছিলেন ওই ভদ্রলোক। আর ছেলেটা বলে যাচ্ছিল, ‘আসলে ডাক্তারবাবু আদার গাঁয়ে শেয়াল রাজা বুঝলেন কি না। কলকাতায় সুযোগ পায়নি, তাই জনসেবায় মন দিয়েছে আমাদের হাতুড়ে ডাক্তার। বাবা-মায়ের বয়েস হয়েছে তাই এত কিছু বোঝে না। আমি আমার বোনকে এইভাবে কেরিয়ার শেষ করতে দেব না।’ আমি বললাম, শহরে চান্স পায়নি এ কথা আপনার কেন মনে হল? এমনও তো হতে পারে শহরের জীবন ছেড়ে সে পাহাড়ি পরিবেশে থাকতে চাইছে, ওখানের অসহায় মানুষগুলোর পাশে থাকতে চাইছে।’ সে ছেলে বলল, ‘আমরা ব্যবসাদার ফ্যামিলি, মানুষ চরিয়ে খাই। তাই বেশ বুঝতে পারি কলকাতায় তল খুঁজে না পেয়ে, ল্যাং খেয়ে নির্ভয়পুরে গেছে। আপনার মতো ডাক্তার যাবে ওখানে? ক’টা টাকা মাইনে পায়? থাকে তো ওই সরকারি কোয়ার্টারে। যা-ই হোক মন্দের ভালো আছে একটা, অন্য ডাক্তারগুলো তো পাশ করা কি না সেটা নিয়েও সন্দেহ হয়। আপনি দেখুন ডাক্তারবাবু, আমার বাবাকে কী করতে হবে।’ আমি আর কথা না বাড়িয়ে শৌনকের প্রেসক্রাইব করা ওষুধগুলোই রিপিট লিখে দিলাম। আর বললাম, ‘স্টেন্ট বসবে, ভর্তি করুন।’ তাতে ছেলের আবার গোসা হল, বলে কি না ‘আপনি ওই মেডিসিনগুলোই রিপিট কেন করছেন ডাক্তারবাবু? পালটে দেবেন না?’ আমি বললাম, ‘ডাক্তার আমি না আপনি? কখনও নির্ভয়পুর গেলে আপনার রিসর্ট ভাড়া করব, তখন না হয় গাইড করবেন। আপাতত আমায় কাজ করতে দিন।’ সেই তখন থেকেই আমার শরীরটা খারাপ লাগছে নিবেদিতা। ছেলেটা কাদের জন্য ওখানে পড়ে আছে? যারা একটু অবস্থাপন্ন তারা শিলিগুড়ি না হয় জলপাইগুড়ি ছুটছে। যারা বেশ ধনী তারা কলকাতা অথবা চেন্নাই আসছে। ও কি শুধু আদিবাসী মানুষগুলোর জ্বর-জ্বালা কমানোর জন্য ওখানে বসে আছে? এফআরসিএস করার কথা চলছিল শৌনকের, সে এখন নির্ভয়পুরের হাতুড়ে ডাক্তার পরিচয়ে বসে আছে। এটা মানা কোনও বাবার পক্ষে সম্ভব?

নিবেদিতা বলল, “শান্ত হও। ওকেই বুঝতে হবে। যাদের ও উপকার করছে একদিন এরাই ওর সবচেয়ে বড়ো শত্রু হবে দেখো। কারণ কী জানো? ওখানের মানুষ অত্যন্ত সরল, বোকা। তারা চলে এই শিল্পপতিদের বুদ্ধিতে। এরা যেভাবে পরিচালনা করে, ওখানের ওই সহজ-সরল মানুষগুলো সেদিকেই চলে। শৌনক যেদিন বুঝবে এভাবে ক্রিম টাইমে নিজের কেরিয়ারের সর্বনাশ করছে, তখন অবশ্য কিছুই করার থাকবে না ওর। কিন্তু বুঝবে তো বটেই। আমরাও মেডিকেল ক্যাম্পে গিয়েছিলাম নির্ভয়পুর। সুন্দর, ছিমছাম, পাহাড়ি পরিবেশে থাকতে মন্দ লাগছিল না। তারপরেই ওখানের নোংরা রাজনীতিটা চোখে পড়েছিল। শিউরে উঠেছিলাম আমরা। কিন্তু এই ব্যবসাদারদের দাপটে কেউ মুখ খোলেনি সেদিন। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে আসতে হয়েছিল শোভন। তখন আমরাও জুনিয়র ছিলাম। মনে জেদ ছিল, বুকে সাহস ছিল। জগৎ পালটে দেবার স্বপ্ন দেখতাম।”

শোভন বলল, “এমন সব জায়গায় মেডিকেল ক্যাম্প করতে গিয়ে দেখেছি, ইঞ্জেকশনের কারণে রাতে হাতে যন্ত্রণা হচ্ছে বলে লাঠি, বাঁশ নিয়ে ডাক্তার পেটাতে এসেছে রোগীর বাড়ির লোকজন। তাদের বোঝাতে পারিনি, ওষুধের অ্যাকশনে হচ্ছে, সকালে ঠিক হয়ে যাবে। আসলে কী জানো, অশিক্ষা আমাদের দেশে সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ। ওদের দোষ তো নেই। ওরা তো জানেই না কিছু। ভিটামিন ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছিলাম এই নির্ভয়পুরেই। তুমি ঠিকই বলছ নিবেদিতা, ও যখন বুঝবে তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে। বুকের ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে। কী হতে পারত আর কী হয়ে গেল নিবেদিতা! সাহেব বলে ছেলেটির কথা শুনে মনে হল, শৌনককে একেবারেই পছন্দ করে না। এভাবে ওখানে শত্রু তৈরি হলে বিপদে পড়তে দেরি হবে না শানুর। কারণ নির্ভয়পুর চলে এদের টাকায়। ওই অসহায় গরিব মানুষগুলো, যাদের পেটের ভাত নেই, তারা কীভাবে রক্ষা করবে শৌনককে?”

নিবেদিতা বলল, “ওরা আবার কবে আসবে গো? আমি সেদিন যাব তোমার চেম্বারে?”

শোভন ঘাড় নেড়ে বলল, “উঁহু, বেশি ইন্টারেস্ট দেখালে সন্দেহ করবে। আর তাছাড়া ভুলে গেলে সেদিন ঋতব্রত আর শর্মিলা ফোন করে কী বলল?”

নিবেদিতা বলল, “ভুলব কেন গো? শর্মিলাকে তো পরিষ্কার বলেছে শানু শোভন বসু আর নিবেদিতা বসু নামে কাউকে ও চেনেই না। ঋতমের নাম করায় শানু নাকি অস্বীকার করেছে ওদের বন্ধুত্বের কথাও। শর্মিলা তো মারাত্মক কনফিউজ হয়ে কল করে বলল, ‘শৌনক কি এখন নির্ভয়পুর বলে কোনও জায়গায় আছে?’ আমি বললাম, ‘কেন বলো তো?’ শর্মিলা বলল, শৌনক নাকি কাউকেই চিনতে পারেনি। আমি অপমানটা হজম করে নিয়ে বললাম, ‘তুমি হয়তো ভুল দেখেছ। ও উত্তরবঙ্গে আছে ঠিকই, কিন্তু নির্ভয়পুরে নয়।’ তবুও ওর গলা থেকে সন্দেহ গেল না। না যাওয়ারই কথা।”

শোভন আলতো করে নিবেদিতার হাতটা ধরে বলল, “তোমার নজরেও কি আমিই অপরাধী নিবেদিতা? শানুকে কি সত্যিগুলো বলা অনুচিত হল?”

নিবেদিতা কথা না বলে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “এখন এসব ভেবে লাভ কী শোভন? প্রতিজ্ঞাটা আমরা দুজনে মিলে করেছিলাম সেদিন। তাই একজন কারও ভাঙার অধিকার ছিল না। তুমি ভেঙে ফেললে, আমাকে না জানিয়েই। ভেবে দেখো, সেটা যদি অপরাধ বলে গণ্য হয় তোমার নিজস্ব আদালতে, তা হলে তুমি অপরাধী। আর যদি মনে করে থাকো, সে প্রতিজ্ঞা ভাঙার অধিকার তোমার ছিল, তা হলে তুমি নিরপরাধ। প্লিজ শোভন, আমি গত পাঁচ বছরে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর এই একই প্রশ্ন কোরো না। চিরকাল তুমি নিজের মনের কথা শুনে চলা মানুষ, এখন এসব পুনরাবৃত্তি করে লাভ কী আছে! শানুর চোখে তো আমি মিথ্যাবাদী, চূড়ান্ত ফ্রড হয়েই গেছি। তাই থাক এসব কথা। চেম্বার থেকে ফিরেছ, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও কিছু।”

শোভন ভাঙা গলায় বলল, “জানি জানি, বুঝি সবই। আমি যে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জীবন কাটাচ্ছি সেটা আমি নিজেও ফিল করি, তুমি মুখে না বললেও চলবে নিবেদিতা। এই কারণেই তো ইদানীং বেঁচে থাকাটা অর্থহীন লাগে। যাবে নির্ভয়পুর একবার?”

নিবেদিতা ব্যঙ্গাত্মক ঢঙেই বলল, “না, তোমায় ছোটো করতে তোমার স্ত্রী হিসেবে ওখানে যাব না। শানু বাড়ি ছেড়ে যাবার পরেই আমি তোমাকে বলেছিলাম নির্ভয়পুর যেতে। সেদিন তুমি ঠিক এই বাক্যটাই বলেছিলে, তাই না? বলেছিলে ঘুম না হলে সিডেটিভ নাও, কিন্তু ওই ছেলের কাছে যাওয়া চলবে না। মনে আছে? নাকি স্মৃতিও প্রতারণা করছে তোমায়?”

শোভন আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। কিছু অপরাধী বোধহয় আইনের চোখে ছাড়া পেয়ে গেলেও সারাজীবন শাস্তি পায় আপনজনদের ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে বিদ্ধ হয়ে।

শোভন ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। নিবেদিতা নিজের ল্যাপটপ খুলে বসল। শানুর ছোটোবেলা থেকে বড়ো হওয়ার সব ছবি আপলোড করা আছে একটা ফোল্ডারে। সেদিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবছিল নিবেদিতা, শৌনক যে কোনওদিন আলাদা হবে ওর কাছ থেকে, এ যেন কল্পনার বাইরে ছিল। পাঁচবছর ও আর স্পর্শ পায় না ছেলেটার, মা ডাকটাও শুনতে পায় না। ভিতরে ভিতরে গুমরে ওঠে। শোভন চিরটাকাল নিজের জেদ নিয়ে রয়ে গেল। শৌনক যখন ওদের ভুল বুঝে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, তখনই নিবেদিতা ছোটো ট্রলিতে নিজের আর শোভনের দু’সেট করে জামাকাপড় গুছিয়ে রেডি হয়ে বলেছিল, “ফ্লাইটের টিকিট বুক করে দিয়েছি শোভন, চলো নির্ভয়পুরে গিয়ে ছেলেকে নিয়ে আসি। এই বয়সের ছেলে মাথা গরম করে দু’-চারটে কথা না হয় বলেই ফেলেছে, আমরা বাবা-মা হয়ে অভিমান করলে চলবে কেন? ওর বয়েস আর আমাদের?”

শোভন জেদ ধরে বলেছিল, “কিছুতেই না। ও আমাদের যেভাবে অপমান করেছে তারপর আমি কোনওভাবেই ওর সামনে নত হব না। আর তোমাকেও হতে দেব না।”

নিবেদিতা সেদিন অনেকভাবে বুঝিয়েছিল, কোনওভাবেই টলানো যায়নি শোভনকে। শোক-দুঃখ-রাগের প্রকোপ একবার যদি কমে যায়, মানুষ যদি সামলে নেয় প্রাথমিক কষ্টের ধাক্কাটা, তা হলে সে ভীষণ কঠিন হয়ে যায়। সেই বরফ শীতল কাঠিন্য ভাঙা সহজ হয় না। এটাই ঘটেছিল শৌনকের সঙ্গে ওদের। শৌনককে ফিরিয়ে আনতে যায়নি ওরা, ভয়ঙ্কর অভিমান করে বসেছিল শৌনকও। তারপর ধীরে ধীরে নিজের ক্ষততে নিজেই প্ৰলেপ লাগিয়ে কঠিন হয়েছিল শৌনক। নিবেদিতার ফোনে বলেছিল, “মনে করো কোনও ভয়ংকর অ্যাক্সিডেন্টে ছেলেকে হারিয়েছ তুমি। তা হলেই দেখো বিষয়টা সহজ হয়ে যাবে। আর-একটা কথা, যোগাযোগ করার চেষ্টা কোরো না, তা হলে চিরতরে হারিয়ে যাব।”

শৌনকের গলা শুনে সেদিন চমকে উঠেছিল নিবেদিতা। কথায় কথায় মা মা বলে জড়িয়ে ধরে আবদার করা সেই ছেলেটার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না ফোনের অন্য প্রান্তের ছেলেটাকে। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। শান্ত গলায় শুধু বলেছিল, “মাকে মনে পড়বে না তোর?”

শৌনক কঠিন গলায় বলেছিল, “যাতে মনে না পড়ে সে চেষ্টা করব। আর তুমি তো জানো জেতাটা আমার চিরকালের অভ্যাস।”

ফোনটা কেটে দিয়েছিল শৌনক।

অভিমান নিবেদিতাও করেছিল। হাজার কষ্ট হলেও যোগাযোগ করেনি শৌনকের সঙ্গে। ভেবেছিল, মা ফোন করছে না দেখে নিশ্চয়ই নিজে খবর নিতে ফোন করবে। কিন্তু সে ভাবনাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল শৌনক। একটাও ফোন আসেনি ওদিক থেকে। নিবেদিতার প্রতীক্ষারাও ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। তারপর শুধু জন্মদিনের দিনে ফোন করে। শৌনকের রিসিভ করতে ইচ্ছে হলে ধরে, না হলে নয়।

নিবেদিতা খেয়াল করেনি কখন শোভন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। আলতো করে বলল, “চোখের জলটা মোছো। এতটা কষ্ট পেয়ো না, আবার প্রেশার ফ্লাকচুয়েট করবে।”

নিবেদিতা বলল, “না দুঃখ আর কী, বরং আজ তো তাও ছেলেটার খবর পেলাম। ভালো আছে, মানুষের চিকিৎসা করছে। ওখানের মানুষজন নিশ্চয়ই ওকে ভালোবাসে, তাই রয়ে গেল। ভালোবাসা, আদর ছাড়া যে আমার শানু থাকতেই পারত না।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *