৬০
এক মাস পর…
এই সপ্তাহে বাসার বড় মেয়ের বিয়ে। চলছে তোড়জোর প্রস্তুতি। তারচেয়েও তোড়জোড় দিয়ে ঝগড়া চলছে নীতু শফিকের। বারবার বিয়ে সংক্রান্ত কোনো না কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ঝগড়া বেঁধে যাচ্ছে দুজনের। আজ এই মুহূর্তেও ঝগড়া হচ্ছিল। ঝগড়ায় বিরতি টানলো শফিকের ছোটবোনের ফোনকল। কল রিসিভ করতেই সুরাইয়া ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, — “তুমি আমার শ্বশুরবাড়ি দাওয়াত পাঠিয়েছো কেন?”
— “কেন? সমস্যা কী?”
— “সমস্যা কী! নবনীকে নিয়ে কেমন তামাশা করলো রওনকের দাদা! ভুলে গেছ?”
— “ভাগ্যিস তামাশা করেছিল নয়তো আমার মেয়ের জীবনটা থেমে থাকতো। আর সব কথার বড় কথা অমিত একবাক্যে বলে দিয়েছে রমিজ মির্জাকে ছাড়া সে বিয়ের স্টেজে উঠবে না। কোনোভাবেই না। ছেলেটা এখন তোর শ্বশুরের ডাইহার্ড ফ্যান হয়ে গেছে, বুঝলি!”
— “মজা করছো?”
অট্টহাসি হাসলেন শফিক সাহেব। কথার প্রসঙ্গ বদলে বললেন,
— “তুই আসছিস কবে?”
আলমারী থেকে নিজের সমস্ত দামী রঙীন শাড়ীগুলো বের করছেন জামিলা বেগম। স্বামী বেঁচে থাকতে কত শত দামী শাড়ি এনে দিতেন কলকাতা, বম্বে থেকে। কোন রঙের শাড়ীটা নেই তার কাছে! সেখান থেকে বেছে বেছে পাঁচটা শাড়ী নবনীকে দিবেন তিনি। কিন্তু কোনটা যে দিবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না। ওহ্ হ্যাঁ! সঙ্গে একটা চেইন আর কানের দুলও। নীতুটা পছন্দ করে দিলে ভালো হতো মনে হয়! গলা ছেড়ে মেয়েকে ডাকছেন তিনি।
— “নীতুউউউ? নীতুরেএএএ? এদিকে আয় তো আম্মা।”
.
ঘর গোছাতে গোছাতে ঘাম ছুটে গেছে নাতাশার। সারাদিন অনির সঙ্গে মার্কেট ঘুরে এইবেলায় আর ঘর গোছাতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে নাতাশা।
— “আমি হলাম কাজের বুয়া, উইদাউট পেমেন্ট। নিত্যদিন ঘর ঝাড়ছি, গোছাচ্ছি তবুও হচ্ছে না। কেন ঘর এত এলোমেলো হয়? ঘরের ভেতর কি বাচ্চা জ্বীনেরা হামলা চালায়? বড় মেয়েটা কোথায়? সে এসে কাজ করছে না কেন? বসে বসে শুধু বিয়ে করলেই হবে? কাজ করতে হবে না?”
দূরের আত্মীয়দের কার্ড কুরিয়ার করা হয়েছে। সশরীরে যাদের দাওয়াত দেয়া হয়নি তাদের সবাইকে কল করে আবারও জানানো হচ্ছে বিয়ের তারিখ। সেই সঙ্গে অনুরোধ করা হচ্ছে অনুষ্ঠানে যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকেন। এই কাজটা শামীমাই করছেন। আর এরশাদ সাহেব ব্যস্ত আছেন কোথায় কত খরচ হচ্ছে, কোথাও আয়োজনের কোনো কমতি হচ্ছে কি না তা খুঁজতে। এইতো আর পাঁচদিন পর গায়ে হলুদ তারপর বিয়ে। সময় একদম নেই হাতে!
.
অনির ঘরের সামনে দিয়ে নবনীর ঘরে যাচ্ছিল অমিত। পথ আটকালো অনি,
— “ভাইয়া ভাইয়া!”
দরজায় দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় অমিত জিজ্ঞেস করলো,
— “কী?”
— “একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”
— “কী?”
— “আম্মু যা টাকা দিয়েছিল সব খরচ করে ফেলেছি। রিসিপশনে শাড়ীর সঙ্গে ম্যাচিং জুয়েলারী কেনা হয়নি।”
— “কিনে দিতে হবে তাই তো?”
— “হ্যাঁ।”
— “টাকা দিবো নাকি আমাকে নিয়ে যাবি?”
— “টাকা দিলেই চলবে। নাতাশারও কাজ আছে মার্কেটে। একসাথে যাবো আমরা।”
— “আমার বউয়ের চেয়ে শপিং তোরাই বেশি করছিস। রুমে আয় আমার সঙ্গে। টাকা নিয়ে যা।”
.
রাত বাড়ছে। চাঁদহীন, তারাময় খোলা আকাশে চেয়ে আছে নবনী। প্রায়ই ঐ দূর আকাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। কখনো বা গড়িয়ে পড়ে দু’চোখ বেয়ে দুই এক ফোঁটা অশ্রু। অনেকেই বলে প্রাক্তনকে মনে রাখা পাপ। বর্তমানে থাকা মানুষটার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। সত্যিই কি তাই? সব প্রাক্তনকে কি ভুলে থাকা যায়? কেউ কেউ থাকে যাদের কোনোভাবে ভুলে যাওয়া যায় না। রেখে দিতে হয় সযত্নে স্মৃতিতে। নিষ্পাপ, চাওয়া পাওয়াহীন ভালোলাগা আর শ্রদ্ধাবোধ রয়ে যায় আজীবন।
পেছনে দাঁড়িয়ে নবনীর চুলের গোড়ায় আঙুল ডুবালো অমিত। চিরুনির মতন করে পুরো মাথা জুড়ে আঁচড়ে দিচ্ছে ওর চুল। ঘাড় ফেরালো না নবনী। বাইরে তাকিয়েই বললো,
— “কাজ শেষ?”
— “হ্যাঁ। লাগেজ গুছিয়ে ফেলেছো?”
— “হুম।”
— “কালই যেতে হবে?”
— “বাসার সবাই আরো আগে যেতে বলেছিল, তোমার জন্য যেতে পারিনি।”
— “এবারও যদি যেতে না দেই? জেদ করি?”
অমিতের দিকে ফিরলো নবনী। মুচকি হেসে বললো,
— “যেতেই হবে।”
— “আমিও আসি?”
— “না।”
— “ভালো লাগবে না আমার।’ —
অমিতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নবনী। বললো,
— “কিসব যে আবদার করো না তুমি! মা-বাবারা শখ করেছে আমাদের আয়োজন করে বিয়ে দিবে। যদি তুমি আমার ওখানে চলে যাও বা আমি যদি এখানে থেকে যাই তাহলে আনন্দটা কিন্তু ওরকম হবে না। বিয়ে বিয়ে আমেজটাও ঠিক পাওয়া যাবে না। পাঁচটাদিনই তো! তারপর তো চলেই আসবো। আর যদি খুব মিস করো তাহলে কল দিও। বাইরে দেখা করবো আমরা। নবনীর কোমর জড়িয়ে ধরলো অমিত। দুষ্টু হেসে বললো,
— “একটা কথা বলবো?”
— “কী?”
— “চুমুর ক্রেভিং হচ্ছে খুব! দেই?”
এক ঝটকায় অমিতকে দূরে সরিয়ে দিলো নবনী। দুই ঠোঁটের ভাঁজে হাসি চেপে রেখে, ইশারায় মাথা নাড়িয়ে বারণ করলো। নাক কুঁচকে আহ্লাদী হলো অমিত।
— “কেন নবনী?”
— “বিয়ের পর।”
— “বিয়ে তো হয়েই গেছে!”
— “ইশ্! হসপিটাল থেকে ফেরার পর বালিশ কাঁথা নিয়ে যাইনি তোমার রুমে? থাকতে দিয়েছো আমাকে? কী বললে? অনুষ্ঠানের পর একসঙ্গে থাকবো। এখন কেন চুমু দরকার?”
— “হুট করে তোমার উপর সব অধিকার দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চাইনি। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আমার সঙ্গে অভ্যস্ত হও, নিজেকে সামলে নাও এটাই চেয়েছিলাম।” একটানে অমিতকে কাছে টেনে নিলো নবনী। অধর মিলনে রচিত হচ্ছে ভালোবাসার নতুন এক মিষ্টি স্মৃতির পাতা। কৃতজ্ঞতায়, মায়ায় নবনীর চোখে জল। গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ার আগেই চুমুতে মুছে নিলো অমিত। অসীম ভালোবাসায় নবনীকে বুকের মধ্যেখানে লুকিয়ে নিলো সে।
.
অবশেষে সম্পর্কের বসন্ত দিন।
দৃঢ় আলিঙ্গন আর প্রেয়সীর ভেজা চুম্বন।
নিঃশ্বাসের পার্থক্য মিটে গেছে
প্রেমিকের প্রতীক্ষা, অপেক্ষার হলো অবসান।
(সমাপ্ত)