৩৫
সপ্তাহখানেক ধরে মুনিয়ার ফোনকল আসছে ঘন ঘন। রিসিভ করে না অমিত। মোবাইল সাইলেন্ট করে ফেলে রাখে। মুনিয়া মাথার ভেতর খুব একটা দখল নিতে পারছে না আজকাল। পুরোটা আপাতত নবনীর দখলে। সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান বেশ কিছুদিন ধরে ওকে ঘিরেই আটকে আছে। “নবনী মানসিকভাবে অসুস্থ” এই ব্যাপারটা অমিত মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে নবনী যখন প্রাণখুলে হাসে তখন যেন একটুখানি বেশীই পীড়া দেয়। সুস্থ নবনীকে দেখার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠে। কিভাবে মেয়েটা সুস্থ হবে সেই নিয়ে ভেবে ভেবেই ব্যস্ত সে। নবনীর রোগটা নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার, গুগল রিসার্চও চলছে প্রতিদিন কয়েকবার করে। রোগের ইতিবৃত্তান্ত ইতোমধ্যে মুখস্থ হয়ে গেছে তবুও রিসার্চ বন্ধ হয়নি তার। পড়ে ফেলা আর্টিকেলগুলো আবারও পড়ে সে। নবনীকে নিয়ে শহরের বেস্ট সাইকিয়াট্রিস্টদের মাঝে একজন, ডক্টর রায়হানের সঙ্গে কথা হয়েছিল তার। সাইকিয়াট্রিস্ট বললো নবনীকে কাল চেম্বারে নিয়ে যেতে। নবনীকে ডক্টরের চেম্বারেই বা কী করে নিয়ে যাবে ভেবে পাচ্ছে না অমিত। ও কখনোই যেতে রাজি হবে না। জোর করে নিয়ে যাবে কি না এই নিয়ে ভীষণ দ্বিধায় আছে। আসলে নবনী রিএ্যাক্ট করবে কিভাবে সেটাই জানা নেই অমিতের।
.
— “দেখি হাতটা দাও।”
নবনীর ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো অমিতের। ওর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো অমিত। অমিতের হাতটা নিজের হাতের উপর রেখে অন্যহাতে ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজ খুলছে নবনী।
— “সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বলেছিলাম বিকেলে ড্রেসিং করিয়ে নিও। অথচ করোনি। লোহা দিয়ে হাত কেটেছো, বললাম টিটেনাস দিয়ে নাও, দাওনি 1 ইঞ্জেকশন দিবে না আবার ড্রেসিংও করবে না, তুমি চাও কী বলো তো আমাকে? আঙুলে ইনফেকশন হয়ে পঁচে টচে যাক?”
নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলো অমিত। ভীষণ যত্নে কাটা জায়গাটাতে ড্রেসিং করে দিচ্ছে নবনী। মনে হচ্ছে যেন সে তার কতজনমের আপন, বহুবছরের মায়ার সম্পর্ক তাদের! নবনী খুব খেয়াল রাখে তার সমস্ত কিছুর। শুধু তার না, অনিরও। নাতাশা বলছিল, নবনী ভীষণ কেয়ারিং। ও সবার কেয়ার করে। তবুও কোন এক অধিকারবোধ থেকে নবনীর কাছে একটু স্পেশাল কেয়ার পেতে ইচ্ছে করে অমিতের। বেশি কিছু না। শুধু একটুখানি! সবার চেয়ে একটুখানি বেশি যত্ন, একটুবেশি ইমপরট্যান্স।
নবনীর মুখের উপর বারবার চুল এসে বিরক্ত করছে খুব। ভ্রু কুঁচকানো মুখটা মিষ্টি দেখাচ্ছে ভীষণ। মুচকি হাসলো অমিত। কানের পাশে চুলগুলো গুঁজে দিয়ে সে বললো,
— “ইনফেকশন কেন হবে? তুমি আছো না? দেখে দেখে রাখছো, কেয়ার করছো। ওসব আমাকে ধরবে না।”
কপট রাগে অমিতের চোখে তাকালো নবনী। নবনীর চোখে চোখ পড়তেই মায়ের সেদিন রাতে বলা কথাটা মনে পড়ে গেল, “নবনী শুধুই তোর বান্ধবী না, ও তোর বিয়ে করা বউ।”
বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো অমিতের। ভীষণ সংকোচে মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নিলো সে। নবনী কী যেন বলছে তাকে। ওসব কিছু কানে যাচ্ছে না তার। “ও তোর বউ” কথাটা কানে ঘন্টার মতন বাজছে অনবরত।
৩৬
— “কোথায় যাচ্ছি আমরা বলো না!”
— “১৩ বার।”
— “১৩ বার কেন? আমাকে যতক্ষণ না বলবে ততক্ষণ জিজ্ঞেস করতেই থাকবো। “ নবনীর কথার জবাবে কিছু বললো না অমিত। মাথা দুলিয়ে হাসলো শুধু। অফিস থেকে আজ জলদি ছুটি নিয়ে নবনীর কারখানায় চলে গিয়েছিল অমিত। সেখান থেকে নবনীকে ধরে বেঁধে এনে তুলে নিলো গাড়িতে। এখনও নবনীকে বলা হয়নি কোথায় যাচ্ছে ওরা। ভেতরে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও চেহারা যথাসাধ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে অমিত।
— “আমি একদম সাসপেন্স নিতে পারি না অমিত!”
— “নিতে কে বললো?”
— “কারখানা থেকে হুট করে জরুরি কাজ আছে বলে নিয়ে এলে। কী কাজ, কার সঙ্গে কাজ, কোথায় কাজ কিছুই বলছো না। গাড়ি এসে থামলো ধানমন্ডিতে, সাইকিয়াট্রিস্ট ইফতেখার রায়হানের বাসার সামনে। নিজের বাড়িতেই তার চেম্বার। বাড়ির বাইরের নেইমপ্লেটে নাম দেখতেই চেহারার রঙ উড়ে গেল নবনীর। সে চেনে ডক্টর রায়হানকে। বহুবার নাম শুনেছে তার। টিভি চ্যানেলগুলোতে মাঝেসাঝে দেখা যায় তাকে। কিন্তু অমিত এখানে কেন গাড়ি থামালো?
— “নবনী? তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো? আমি তোমার ভালো চাই এই বিশ্বাসটুকু আছে আমার প্রতি তাই না?”
— “আমরা এখানে কেন এসেছি অমিত?”
— “আজ উনার সঙ্গে এপোয়েন্টমেন্ট ফিক্স করেছি।”
— “কার জন্য?”
নবনীর দিকে ভীষণ সংকোচে তাকিয়ে রইলো অমিত। তাহলে কি অমিত তাকে নিয়ে এসেছে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে? বুঝতে বাকি রইলো না নবনীর। তবে কি অমিত বিশ্বাস করে না সামি আছে? সত্যিই আছে? চোখ ভিজে যাচ্ছে নবনীর। কাঁপাস্বরে সে বললো,
— “তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি অমিত!”
— “নবনী প্লিজ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। আমি গুছিয়ে কোনো উত্তর দিতে পারবো না। তুমি একটাবার ভেতরে চলো আমার সঙ্গে?”
— “আমি তোমাকে ভীষণ বিশ্বাস করি। ভেবেছিলাম তুমিও করো। সামিকে নিয়ে
আমি কারো সঙ্গে গল্প করি না। তোমার সঙ্গে করতাম। তোমাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল তাই! ভেবেছিলাম আর কেউ না হোক তুমি অন্তত আমার কথাগুলো বুঝবে, সত্যি বলে মেনে নেবে। ভালো তো তুমিও বাসো মুনিয়াকে। পাগলের মতই বাসো। তুমি জানো না ভালোবেসে শুধু জীবন দেয়া যায় না, ফিরে আসাও যায়?”
— “তুমি কাঁদছো কেন নবনী? তুমি কষ্ট পাবে এমন কিছু আমি করবো কখনো? এতটুকু বিশ্বাস রাখো আমি তোমার ভালো চাই। তুমি কষ্ট পাবে এমন কিছু আমি কখনো করবো না।
— “করছো তো অমিত!”
— “নবনী কেউ থাকে না তোমার আশপাশে। তুমি একাই কথা বলো। তুমি যাকে দেখতো পাও সে জাস্ট তোমার হ্যালুসিনেশন।”
— “সামি আমার হ্যালুসিনেশন না।”
— “আমি তোমাকে কী বলবো, কিভাবে বুঝিয়ে বলবো ভেবে পাচ্ছি না সত্যি। শুধু বলবো ভেতরে চলো প্লিজ। ডক্টর তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবে।”
— “ভুল ছিলাম আমি। তোমাকে সামির কথা বলা একদম উচিত হয়নি আমার। আমাদের ভালোবাসা বোঝার সাধ্য তোমার নেই। সাধ্যের বাইরে কে কবে কী করতে পেরেছে! বন্ধুত্ব বেঁচে থাকে বিশ্বাসে। ভেবেছিলাম তুমিও আমার অসম্ভব গল্পটা বিশ্বাস করবে, কিন্তু তুমি করোনি। উল্টো নিয়ে এলে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। তার কাছে গিয়ে কী হবে শুনি? মেডিসিন দিবে যেন সামিকে আর কখনো আমি না দেখি? কাউন্সেলিং সেশনে আমাকে বুঝাবে সামি মরে গেছে? হ্যাঁ গেছেই তো, তোমাদের জন্য ও মরে গেছে। আমার জন্য মরেনি, বেঁচে আছে ও। ফিরে এসেছে আমার জন্য, শুধুমাত্র আমার জন্য। যে ভালোবাসা কখনো তোমাদের ছোঁয়নি সে ভালোবাসা বোঝার সাধ্য আছে তোমাদের? কেন আমার কাছে মৃত প্রমাণ করতে চাইছো ওকে? ডক্টরের দেয়া হাবিজাবি মেডিসিন কেন খাওয়াতে চাইছো আমাকে? ওসবে কোনো কাজ হবে না কখনো। সামি ফিরে এসেছে এটাই সত্য। তোমাদের কথায় আমার কিছুই আসবে যাবে না। একটা সহজ হিসেব শুনবে? এইযে আমি বসে আছি তোমার সামনে, শুধুমাত্র সামি ফিরে এসেছে বলেই এখানে বসে তোমার সঙ্গে কথা বলছি। নয়তো আমার আজ এখানে বসে তোমার সঙ্গে কথা বলা হতো না, পরিচয়ও হতো না। মরে যেতাম সেই কবেই।”
সন্ধ্যে নেমেছে। আবাসিক এলাকার এই রাস্তাটায় এতক্ষণ বাচ্চাদের ছুটোছুটি, বয়স্কদের হাঁটাহাঁটি চলছিল। মাগরিবের আজান হতেই সবাই ফিরে গেছে যার যার বাসায়। হঠাৎ কেমন নির্জনতা নেমে এসেছে এই গলিতে। অন্ধকার, নির্জন এই পথের ধারে গাড়ির ভেতর পাশাপাশি বসে আছে অমিত, নবনী। বাচ্চাদের মতন ঠোঁট উল্টে নবনী কাঁদছে। কখনো ওকে এমন করে কাঁদতে দেখেনি অমিত। নিজেকে বড্ড দিশেহারা লাগছে। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হয়নি সে। নবনীকে কিভাবে সামলাবে তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। নবনীর চোখে তাকাতেও ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। বড্ড অপরাধী লাগছে নিজেকে। মেয়েটা সত্যিই কষ্ট পাচ্ছে খুব। নয়তো এভাবে কেউ কাঁদে বুঝি! অসহায় চোখে নবনীর দিকে তাকালো অমিত। ভীষন জড়তায় নবনীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
— “কেঁদো না প্লিজ!”
— “তুমি আজ বাড়াবাড়ি একটু বেশিই করে ফেললে অমিত। এতগুলো বছরে আমার কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি। সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি যদি কখনো কোনোভাবে ওরা সামির ব্যাপারে জেনে যায়! ওরা কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না আমি জানতাম। তোমার বেলায় এসে কী হলো আমার কে জানে! খুব ভুল হলো আমার। তুমি যা খুশি করতে পারতে অমিত। কিন্তু সামি আমার ভ্রম এতটাও বলার অধিকার কখনোই তোমাকে আমি দেইনি।”
অমিতের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে, গাড়ি থেকে নেমে পড়লো নবনী। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল অমিতও। বড় বড় পা ফেলে নবনী মেইন রোডের দিকে যাচ্ছে। অমিত দৌড়ে গিয়ে নবনীর পথ আটকালো।
— “একা কোথায় যাচ্ছো?”
— “আমি আর তোমার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাই না।”
— “বলতে হবে না। ডক্টরের চেম্বারেও যেতে হবে না। তুমি গাড়িতে বসো, আমরা এখনই বাসায় ফিরবো।
— “কোন বাসা অমিত? তোমার? এই ঘটনার পরও তুমি ভাবছো আমি তোমার বাসায় যাবো? তাও তোমার সঙ্গে?”
— “কেন নবনী? আমার বাসায় কেন যাবে না?”
— “সিরিয়াসলি অমিত! এরপরও তুমি আমাকে উল্টো জিজ্ঞেস করছো আমি কেন যাবো না? খুব হালকাভাবে নিয়েছো পুরো ব্যাপারটা, তাই না? আমার জন্য মোটেও ওরকম কিছু ছিল না। যেহেতু আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না তাই তোমার সঙ্গে বন্ধুত্বটাও আর আমি রাখছি না। বন্ধুত্ব যেহেতু থাকছে না, তোমার বাসায় আমি কেন যাব বলো? কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে যাবো?”
নবনীর দু’হাত শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করলো অমিত। মুখ ফুটে কিছু বলছে না সে। অসহায় চোখে শুধু তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে। কয়েকবার অমিতের মুঠো থেকে হাত ছাড়াতে গিয়েও পারলো না নবনী। প্রচন্ড রাগে চিৎকার করে উঠলো সে,
— “হাত ছাড়ো আমার!”
নামাজ শেষে বাসায় ফিরছে এই এলাকার মানুষেরা। নবনীর চিৎকার শুনে থেমে গেল কয়েকজন। এগিয়ে এসে ওদের দু’জনকে ঘিরে ধরলো সবাই। নানারকম প্রশ্নে জর্জরিত করতে লাগলো অমিতকে, এই মেয়ে কে? আপনি তার কী হন? নির্জন এলাকায় মেয়েকে হয়রানি কেন করছেন? আপনার নাম কী? বাসা কোথায়? কিচ্ছু বলছে না অমিত। নবনীর হাতও ছাড়ছে না। এখনও চেয়ে আছে নবনীর দিকে। অমিতের চোখ স্পষ্ট পড়তে পারছে নবনী। এই হাতজোড়া আজ সে সহজে ছাড়বে না। তার সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসা অব্দি ঠায় দাঁড়িয়েই থাকবে এভাবে। পরিস্থিতি বেগতিক হওয়ার আগেই নবনী সামলে নিলো,
— “উনি আমার পরিচিত। এমনিতেই একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে। তেমন কিছু না।”
নবনীর কথা শুনে নিজেদের মাঝে বিভিন্ন মন্তব্য করতে করতে চলে গেল লোকজন। সবশেষে ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি চলে যাবার আগে বলে গেল,
— “ঝগড়াঝাটি এভাবে রাস্তাঘাটে করতে হয় না মামনি। মানুষ মন্দ বলবে। আরেকটু হলেই ছেলেটার সঙ্গে বাজে কিছু ঘটে যেত। বাসায় ফিরে যাও তোমরা। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকো না।”
লোকটা চলে যেতেই নবনী স্বর নিচু করে বললো,
— “গাড়িতে বসছি আমি। এবার হাত ছাড়ো।”
নবনীর হাত ছেড়ে দিলো অমিত। গাড়িতে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে নবনী বললো,
— “আমি আমার বাসায় যাবো। ওখানে ড্রপ করে দাও।”
নবনীর সঙ্গে কথা বাড়ায় না অমিত। তার কন্ঠের গম্ভীরতা আর কিছু বলতে দেয় না অমিতকে। সমস্ত কথাগুলো কোনঠাসা করে দেয় মনের ভেতরই। কী বিশ্রী কান্ড ঘটে গেল! নবনীর সঙ্গে এই দ্বন্দ্বটুকু ভেতরে ভেতরে বেশ ভোগাচ্ছে তাকে। নবনীকে সামলানোর আগে নিজেকে সামলানো জরুরি। মনের কথাগুলো একদম গুছিয়ে উঠতে পারছে না সে। যাক নাহয় নবনী বাবার বাসায়। কথা গুছানো হয়ে গেলে, নিজেকে সামলে নেয়া হয়ে গেলে তখন নাহয় যাওয়া যাবে নবনীর বাসায় ওকে ফিরিয়ে আনতে।
৩৭
বিষন্ন মনে ঘরে ফিরে এল অমিত। অনি দরজা খুলেই অমিতের মুখ দেখে বুঝে নিলো তার ভীষণ মন খারাপ। পকেটে মোবাইল বাজছে তার। বাজতে বাজতে কেটে যাচ্ছে, আবার ফোন বাজছে। সেই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। হাত দিয়ে কপাল ঢেকে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে অমিত। বারবার ফোনের শব্দে বিরক্ত লাগছে অনির। অমিতকে ডেকে সে বললো,
— “ভাইয়া? কে কল করছে? রিসিভ করছো না কেন?”
— “নবনীর বাসা থেকে কল করছে।”
অবাক হলো অনি। নবনীর বাসা থেকে কল আসবে আর অমিত সেটা রিসিভ না করে বসে থাকবে এমন কখনো হয়েছে! আবার মনটাও খারাপ দেখা যাচ্ছে। কোনো ঝামেলা হলো না তো! কৌতুহলী হলো অনি।
— “কী হয়েছে তোমার? কল কেন রিসিভ করছো না?
— “রিসিভ করে কী বলবো?”
— “কী বলবে আবার? যা জিজ্ঞেস করবে তাই বলবে। আর এতবার কল করছে যেহেতু জরুরি কিছুই হবে হয়তো!”
— “উনারা যা জিজ্ঞেস করবে তার উত্তর আপাতত আমি দিতে পারবো না।”
— “কথা প্যাঁচাচ্ছো কেন বলো তো? সহজ করে বলো না কী হয়েছে?”
— “একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছি।”
— “কী?”
— “নবনীকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
অমিতের দিকে চোখ বড় করে তাকালো অনি।
— “সর্বনাশ!”
— “সত্যিই সর্বনাশ করেছি। নবনী প্রচন্ড রেগে আছে আমার উপর।”
— “ওখানে নিয়ে গেলে কেমন করে? আপু তো রাজি হবার কথা না! “বলিইনি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবো।”
— “কেন ভাইয়া! এই ঝামেলাটা বাঁধানোর খুব প্রয়োজন ছিল?”
— “ওর ভালোর জন্যই তো…”
— “ভালোমন্দ কি আপুকে বোঝানো যাবে? সম্ভব? সামি ভাইয়ার ব্যাপারটা প্রচন্ড সেনসেটিভ ইস্যু। এভাবে হুটহাট কিছু না করে একটুখানি বুদ্ধি খাটিয়ে স্টেপ নিলে ভালো হতো না?”
— “এতকিছু ভাবিনি আমি। শুধু চেয়েছি নবনীর সুস্থ হওয়া দরকার। জানতাম, ও যেতে চাইবে না, রাগারাগি করবে। তবে এতটা রিএ্যাক্ট করবে ভাবিনি।”
— “কোথায় আছে ও?”
— “ওদের বাসায়।”
— “রাগ করে চলে গেল?”
— “হ্যাঁ। খুব কাঁদছিল ও। মনটাই খারাপ হয়ে গেল আমার! ভালো করতে গিয়ে একটা দ্বন্দ্ব হয়ে গেল আমাদের। মুখের উপর বলে দিলো, আমার এখানে আর কখনো আসবে না। আমাদের বন্ধুত্বও শেষ — “স্যরি বলোনি?”
— “বলেছি। কাজ হয়নি কোনো। ও খুব কষ্ট পেয়েছে অনি। কাজটা আমি করেছি তাই হয়তো কষ্ট একটু বেশিই পেলো।”
— “কলটা রিসিভ করো। শুনো উনারা কী বলতে চান?”
— “বলবে আবার কী! উনারাও আমাকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। আমি কেন ওকে নিয়ে গেছি সেসব কিছুই কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। তারচেয়ে বরং চুপ থাকি।”
— “নিজের মতো করে সবটা ভেবে নিচ্ছো কেন? কথা বলোই না একবার! নবনী আপু বাসায় গিয়ে কী বলেছে তা তো আর তুমি জানো না। চাচ্চু নাহয় দু’টো ধমকই দিবে তোমাকে, এরচেয়ে বেশি কিছু তো আর না! তুমি উনাদের কল রিসিভ করছো না এটাও খারাপ দেখাচ্ছে।”
অনির পীড়াপীড়িতে কল রিসিভ করলো অমিত।
— “চাচ্চু…”
— “কখন থেকে তোমাকে কল করছি!”
— “একটু ব্যস্ত ছিলাম।”
— “এখন আমাকে একটু বলো তো বাবা তুমি কেন নবনীকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলে?”
— “স্যরি!”
— “বুঝলাম তুমি স্যরি। নবনী তো তোমার স্যরি শুনে শান্ত হবে না। ঝগড়া হলো তোমার সঙ্গে জিনিস ভাঙচুর করছে আমার ঘরের এটা কেমন অবিচার? কেঁদেই যাচ্ছে, কেঁদেই যাচ্ছে। মেয়েটা না আমার অসুস্থ হয়ে যায় বাবা!
মুখ চুপসে এল অমিতের। কানে ফোন চেপে চুপ করে বসে রইলো সে। কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে শফিক সাহেব বললেন,
— “চুপ করে বসে আছো যে! ঝামেলা বাঁধিয়েছো, ঝামেলার একটা সমাধান করবে না?”
— “সমাধান থাকলে তখনই ওকে সামলে নিতাম। নবনী আমার উপর রেগেও থাকতো না, রাগ করে আপনার ওখানে চলে যেত না।”
— “তুমি জানতে নবনী রিএ্যাক্ট করবে, তবুও কেন নিয়ে গেলে ওকে?”
— “জানতাম। এতটা করবে তা তো জানতাম না! আর কেন ওকে নিয়ে গেছি সে কথা আপনাকে এক্সপ্লেইন করা পসিবল না। শুধু এতটুকু বলবো, ওর জন্য মায়া হয়, আমি কষ্ট পাই তাই ওকে নিয়ে গেছি। সাত পাঁচ ভাবিনি। এতকিছু আমার ভাবতে ইচ্ছে হয়নি। আমি শুধু সুস্থ, স্বাভাবিক নবনীকে দেখতে চেয়েছি, ব্যস!”
— “একটাবার আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া উচিত ছিল না?”
— “হ্যাঁ নবনী আপনাদের মেয়ে, অবশ্যই আমার চেয়ে ওর উপর আপনাদের
অধিকার বেশি। কিন্তু আমিও ওর কিছু হই সম্পর্কে। ওকে খুব কাছের একজন ভাবি। ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার অধিকারটা নবনীই আমাকে দিয়েছে। সেই অধিকার থেকে ওকে নিয়ে গেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে নবনীর জন্য বেস্ট ডিসিশন আমি নিতে পারবো, ওর ভালো মন্দ আমি বুঝবো, তাই গেছি। যদি আমাকে নবনী অধিকার না দিতো, ওকে আমি আমার কাছের একজন না ভাবতাম কিংবা ওর ভালো মন্দ আমি বুঝতে পারবো এই নিয়ে দোটানায় থাকতাম তাহলে কখনোই ওর ব্যাপারে একাই কোনো সিদ্ধান্ত নিতাম না। আমি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করতাম।”
অমিতের কথায় কপাল থেকে দুশ্চিন্তার ভাঁজ সরে গেল শফিক সাহেবের। অধিকারবোধ আসে ভালোবাসা থেকে। অমিতও নবনীকে ভালোবাসে। ভালোবেসে ভালো মন্দ বুঝতে চায়। এই ভালোবাসার নাম কী সে কথা শফিক সাহেবের অজানা। তবে এই অধিকার বোধ, ভালো মন্দ বুঝতে চাওয়ার অনুভব করার ব্যাপারটা বেশ লাগছে তার। মনটা বেশ হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে যেন এই ছেলেটা মাত্র কয়েকটা কথায় তার দুশ্চিন্তা অর্ধেক কমিয়ে ফেলেছে। মুচকি হেসে অমিতকে তিনি বললেন,
— “ভালো মন্দ যেহেতু বুঝোই তাহলে নবনীকে একা রেখে পালালে কেন? বাসায় এসে আমার মেয়েকে সামলাও।”
— “আমাকে দেখলে নবনী আরো রেগে যাবে।”
— “তো রাগ ভাঙাও! নবনীর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে পারো, ওকে না জানিয়ে ওর ব্যাপারে ফট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারো অথচ ওর রাগ ভাঙাতে পারো না! ওর কান্নাকাটি আর ভালো লাগছে না আমার। এক্ষুনি বাসায় এসে আমার মেয়েকে শান্ত করো বলছি! দশ মিনিটের ভেতর আমি তোমাকে আমার বাসায় দেখতে চাই।”
কল কেটে বেশ শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে বসলেন শফিক সাহেব। ঠোঁটের কোণে তার এখনও মুচকি হাসি। ঘরের তিন নারী সদস্য অবাক হয়ে দেখছে তাকে। এমন মুহূর্তে শফিক সাহেবের হাসি দেখে বেশ মেজাজ খারাপও হচ্ছে নীতুর। স্বামীর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে কঠিন স্বরে বললেন,
— “তোমার হাসি পাচ্ছে নবনীর বাবা!”
ঘাড় কাত করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন শফিক সাহেব। মাথা উপর নিচ করতে করতে বললেন,
— “রিল্যাক্স লাগছে বেশ। এক কাপ চা দেবে নীতু?”
— “নবনী ভেতরে কাঁদছে।”
— “ওসব আর আমাদের ভেবে কাজ নেই। অমিত আছে, ও সামলাবে নবনীকে।”
— “আব্বু, উনি একটা তার ছেঁড়া। আমি সেদিন বললাম পর্যন্ত আপু সাইকিয়াট্রিস্টের নামই সহ্য করতে পারে না। তবুও নিয়ে গেল। আর তুমি ভাবছো উনি এসে আপুকে সামলাবে? উল্টো পরিস্থিতি আরো বিগড়ে দেবে।
— “এতটুকু বিশ্বাস করিস তো ও আমার মেয়ের ভালোটাই চাইবে?”
— “হ্যাঁ ভালো চায়। কিন্তু ভালো চাইতে গিয়ে গোলমাল করে ফেললো তো!”
— “একবারই গোলমাল করলো। এরপর থেকে আর করবে না দেখিস। নতুন তো! শুরুতে একটু আধটু ভুল হয়েই যায়। ব্যাপার না, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ও আমার মেয়ের দায়িত্ব নিতে চায়। ও ভুল করবে, গোলমাল বাঁধাবে ভেবে যদি নবনীর দায়িত্বগুলো ওকে না দেই, নবনীর ভালো মন্দ সামলাতে না দেই তাহলে চলবে? সারাজীবন আমি আর তোর মা থাকবো? নবনীকে কারো দায়িত্বে রেখে যেতে হবে না?”
মেয়ে জামাইর কথার অর্থ বুঝতে বাকি রইলো না জামিলা বেগমের। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে পান মুখে পুরলেন তিনি। চিবুতে চিবুতে শফিক সাহেবকে বললেন,
— “শান্তি শান্তি লাগতাছে শফিক?”
— “অনেক আম্মা!”
— “নবনীর আব্বু! অমিত তোমাকে কী বলেছে, বলো তো? কল করার আগে চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলে। এখন কেন এত শান্ত তুমি?”
— “অমিত যা বললো নীতু, আমার মন ভরে গেছে আজ। যেদিন শুনলাম মেয়ের সঙ্গে এতবড় কান্ড হয়ে গেছে আমার মনে হচ্ছিল আমি মরেই যাবো! আম্মা সেদিন আমাকে বুদ্ধি না দিলে সত্যিই মামলা টামলা করে মেয়ের ডিভোর্স করাতাম। ভাগ্যিস করাইনি! এতগুলো বছর যে দুশ্চিন্তায় আমরা সবাই ভুগছিলাম, ফাইনালি একটা অন্ত বুঝি হলো। অমিত কী বলছিল, জানো?”
— “কী?”
— “নবনীকে ও খুব কাছের একজন ভাবে। নবনীই ওকে অধিকার দিয়েছে ওর ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার। সেই অধিকার থেকেই নিয়ে গেছে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। নবনীর এই অবস্থা ও মেনে নিতে পারে না। ওর কষ্ট হয়। ও সুস্থ নবনীকে দেখতে চায়। আমাদের মেয়ের ভালো মন্দ ও বুঝে, ওর ব্যাপারে বেস্ট ডিসিশনটাও ও নিতে পারবে। বুঝতে পারছো কথাগুলো? জানো, ও কথাগুলো খুব জোর গলায় বলছিল! কোনো দ্বিধা কিংবা জড়তা ছিল না একদম। কথাগুলো একদম ওর মনের। লৌকিকতা ছিল না কোনো। এমনটাই তো তুমি আমি চাইছিলাম নীতু! সব জেনেও কেউ আমার মেয়েকে আগলে রাখুক, নবনীকে সুস্থ করে তুলুক। আমরা বোধ হয় পেয়েছি নীতু! অমিতকে পেয়েছি আমরা।”
— “অমিত ভাইয়া আপুকে ভীষণ পছন্দ করে জানি। কিন্তু তুমি যেভাবে ভাবছো ব্যাপারটা তেমন নাও হতে পারে, তাই না বাবা? শুধু বন্ধুত্ব থেকেই হয়ত আপুকে নিয়ে এত ভাবে ভাইয়া!”
— “ভালো চিন্তা কর নাতাশা। শুরুতে বন্ধুত্ব, দাবি খাটানো কোনোটাই ছিল না। অমিত আমার নাতিনরে আগে দেখলে মুখ কুঁচকায়া রাখতো। তারপর নবনী আর অমিতের ভালো একটা সম্পর্ক হইলো। তারপর বন্ধুত্ব। তুই নিজেই একবার ভাব, দিনদিন ওগো বন্ধুত্ব গভীর হইতাছে কি না? ওরা দুইজন যখন একসঙ্গে থাকে হাসিখুশি সময় কাটাইতাছে কি না? একটু আগে তোর বাপ যে কইলো অমিত নবনীর উপর অধিকার বোধ থেইকা এই কাম করছে, এই অধিকারবোধ আইলো কেমনে? সম্পর্ক গভীরে যাইতাছে তাই অধিকারবোধ জন্মাইছে। যাক না আরো সময়, ধীরে ধীরে মহব্বত-ভালোবাসাও হইবো।”
— “আমিও আজকের পর থেকে সবকিছু পজিটিভলি ভাববো। অমিত এখন থেকে শুধু আমার ভাতিজা না, আমার মেয়ের জামাইও। ছেলে হিসেবেও অসাধারণ। ঐ অসভ্য মূর্খ রমিজ অঘটনের মাঝে একটা কাজের কাজ করেছে নবনীকে অমিতের হাতে তুলে দিয়ে। এবার ভালো ভালোয় সব মিটে গেলে হয়! নীতু, জামাই আসবে বাসায়। শান্তাকে নিয়ে রাতের খাবার আয়োজন করো গিয়ে। আর নাতাশা, ঘরটা একটু গোছগাছ কর। ওর আসতে বেশি সময় লাগবে না কিন্তু।”
.
— “নবনী, দরজাটা খুলবে প্লিজ!”
আধঘন্টা ধরে নবনীর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অমিত। ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা বোধহয় পণ করেছে, আর কখনো অমিতের সঙ্গে কথা বলবো না। হতাশ চোখে বারবার নাতাশার দিকে তাকাচ্ছে অমিত। চোখের ইশারায় অমিতকে স্বান্তনা দিচ্ছে সে। ফিসফিসিয়ে অমিত বললো,
— “দরজা ভেঙে ফেলি?”
— “ইশ্! ঝগড়া করেছেন আপনারা, দরজা কেন আমাদের বাসার ভাঙবেন? অলরেডি আপনার বান্ধবী আমাদের বাসার কিছু জিনিস ভেঙে ফেলেছে। বান্ধবীকে বাসায় নিয়ে যাবার সময় অবশ্যই আমাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাবেন।”
— “দরজা ভাঙি, তারপর ওটার ক্ষতিপূরণও দিয়ে যাবো। নয়তো সারারাত এভাবে কেটে যাবে নবনী দরজা আর খুলবে না।”
— “মিষ্টি করে ডাকুন না আরেকবার! এবার দরজা খুলে যাবে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবারও নবনীকে ডাকতে লাগলো অমিত,
— “নবনী আমার কিন্তু ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে! আমি এতবার ডাকছি তোমাকে অথচ তুমি দরজা খুলছো না। একটা ভুল নাহয় করেই ফেলেছি তাই বলে এভাবে বন্ধুত্বটাই শেষ করে দেবে!”
- …………………
— “ঝগড়া করো, প্রয়োজনে দুই চারটা চড়-থাপ্পর দাও। রাগ টাগ ঝেড়ে ফেলো না নবনী! এভাবে চুপ করে থাকলে রাগ কখনো মিটবে?”
- …………………
— “আমরা কি আর কখনো কথা বলবো না? তুমি আমাকে আর দেখতে চাও না?”
— “ঠিক আছে চলেই যাচ্ছি আমি! আর কখনো আসবো না তোমার সামনে।”
নাতাশা হাত চেপে ধরলো অমিতের। দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে বললো,
— “আশ্চর্য! রাগ ভাঙাতে এসে নিজেই রাগ করে চলে যাচ্ছেন কেন?”
— “ধুর! যাচ্ছি কে বললো? আমি এখান থেকে না গেলে নবনী দরজা খুলবে না। চাচী চা-নাস্তার আয়োজন করেছে আমার জন্য। বান্ধবীকে ডাকতে ডাকতে ক্ষুধা লেগে গেছে আমার। যাই, কিছু খেয়ে আসি এই ফাঁকে।”
— “নবনী, দরজা খোল বইন। তোর আলমারিতে টাকা রাখছিলাম। ঐটা নিমু।” নানীর ডাকে বিরক্ত হলো নবনী। নাক টানতে টানতে বললো,
— “তুমি আমার আলমারিতে কেন টাকা রেখেছো নানী?”
— “ক্যান? আলমারির গায়ে লেখা আছে তোর আলমারিতে আমি কিছু রাখতে পারুম না?”
— “দরজা খুলবো না আমি!”
— “আরেহ্ খুলবি না ক্যান? অমিত চইলা গেছে।”
— “সত্যিই গেছে?”
— “হ সেই কখনই তো! এত কইরা ডাকলো তুই শুনোস নাই। তোর জন্য কি সারাদিন দাঁড়ায়া থাকবো নি!”
দরজা খোলার আগে কিছুক্ষণ বসে ভাবলো নবনী। নানী নাটক করছে না তো! নিজের আলমারি ছেড়ে ওর আলমারিতে টাকা কেন রাখবে? অমিত সত্যিই চলে গেছে? হ্যাঁ গেছে হয়তো! অনেকক্ষণ ধরে কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি ওর। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দাঁড়ালো নবনী। নানীর পেছন পেছন নাতাশা আর মা এসেছে। তিনজনে মিলে কেন দরজা খুলিসনি, ছেলেটার মন খারাপ হয়েছে, কিছু মুখে না দিয়েই বাসা থেকে চলে গেল, মেহমানের সঙ্গে এমন আচরণ করে কেউ এসবই বলছিল। অস্পষ্ট হয়ে নবনীর কানে সেসব পৌঁছাচ্ছে। তখনও তার মাথা জুড়ে ছুটোছুটি করছে, অমিত কেন ওকে বুঝলো না?
হঠাৎ ঝড়ের গতিতে কে যেন এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো পায়ের কাছে। ছলছল চোখে নবনী চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে, অমিত তার সামনে বসে!
একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলো,
— “তোমরা সবাই মিথ্যে বলেছো আমাকে!”
— “মিথ্যে না বললে দরজা খুলতি তুই?”
— “কেন খুলবো আমি? অমিত ডাকলেই দরজা খুলতে হবে?”
— “তুমি আমাকে ডাকলে পাহাড় ডিঙিয়ে তোমার কাছে ছুটে আসবো। আর তুমি আমার ডাকে দরজা খুলতে পারবে না!”
৩৮
অমিত নবনীর সংসারের চারমাস চলছে। দিব্যি কেটে যাচ্ছে ওদের মিছেমিছি সংসারের দিনগুলো। ভোরের দিকে উঠে অনি আর নবনী হেল্পিং হ্যান্ডকে নিয়ে হাতে হাতে তৈরী করে নেয় সকালের নাস্তা আর দুপুর রাতে খাবার তরকারী। নাস্তা সেরে অমিত, নবনী বেরিয়ে পড়ে গাড়িতে করে আর অনি চলে যায় স্কুটি চালিয়ে নিজের ভার্সিটিতে। নবনীকে কারখানায় ড্রপ করে অমিত যায় অফিসে কিংবা কখনো সখনো ইভেন্ট ভেন্যুতে। কাজের ফাঁকে নিয়ম করে খোঁজ নেয়া চলছে দুজনের, অবসর সময়ে চলছে মেসেঞ্জার টেক্সটিং। ছুটির দিনে একসঙ্গে কাঁচাবাজার, মাছবাজার ঘুরে পুরো সপ্তাহের বাজার করা, প্রতি বৃহস্পতিবার রাত জেগে অমিতের হাতের চওমিন কিংবা নবনীর হাতের ফ্রেঞ্চফ্রাই খেতে খেতে চারজনে মিলে মুভি দেখা। কোনো ঝামেলা হলেই নবনীকে কল করে ফটাফট সমাধান পাওয়া, জোৎস্নারাতে কফি হাতে সুখ দুঃখের গল্প করা, কাজের চাপ যেদিন কম থাকে সেদিন দুজনে মিলে হুটহাট প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়া আরো কত কী! সব মিলিয়ে জীবনের অসাধারণ এক সময় কেটে যাচ্ছে অমিতের। অনেক অনেক লম্বা সময় বাদে হাসি আনন্দে ঘেরা জীবন কাটছে তার। নবনী এই বাসায় থাকার সুবাদে নাতাশাও প্রায়ই চলে আসে এখানে। অনির আনন্দে দিন কেটে যায়। একা একা সবকিছু সামলাতে হয় না, সময় কাটাতে হয় না। যে মেয়েটার গলার আওয়াজ খুব একটা শোনা যেত না, সেই মেয়ের ঘর থেকে গভীর রাতে হাসির শব্দ, হৈ হুল্লোড়ের শব্দ শোনা যায়। কখনো কখনো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের তিনজনের আনন্দ দেখে অমিত। বেশ লাগে তার! একই ঘরে থেকেও অনির সঙ্গে বসে গল্প করা হয়নি এতগুলো দিনে। মা-বাবাও আসতো না খুব একটা। টিভির আওয়াজ, ফ্যানের শব্দ, রান্নাঘরে-ডাইনিংরুমে টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোনো সাড়াশব্দ খুব একটা পাওয়া যেত না এই ঘরে। নবনী এসেছে পর থেকে এই ফ্ল্যাট সদা সরগরম। গল্প হচ্ছে, হাসি ঠাট্টা হচ্ছে, কখনো কখনো তার সঙ্গে গলা ফাটিয়ে ঝগড়াও হচ্ছে। অনির সঙ্গে পুরোনো সেই সম্পর্কটা আবার তাজা হয়েছে, মা বাবা প্রতিমাসে নিয়ম করে আসছে। বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব মিটেছে। মাসে একবার দুইবার তাদের নিয়ে এই বাসায় চা-নাস্তার আসর জমছে। বাবা-মা বাসায় এলে নবনীর বাসার সবাইকে নিয়ে আসা হয় এই বাসায়। ধরে বেঁধে এখানে রেখে দেয়া হয় তাদের দুইদিনের জন্য। দুই পরিবারের এই মিলনমেলা অসাধারণ লাগে অমিতের। সকালে আর রাতে পুরো পরিবার ড্রইং রুমের ফ্লোরে বসে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, ছুটির দিনের বিকেলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, নানীর কাছে পুরোনো দিনের গল্প শোনা, বসার ঘরে সবাই মিলে সাদাকালো দিনের ছবি দেখা, মা আর চাচীর হাতের চমৎকার সব রান্না, আর রাতের বেলায় বড়দের বিছানা ছেড়ে দিয়ে অনি নাতাশা আর নবনীকে নিয়ে ড্রইংরুমে বিছানা পেতে ঘুমানো। অবশ্য ঘুমানো বললে ভুল হবে, রাত জেগে গল্পই তো করা হয়! পুরো রাত গল্প করে ভোরে এসে একটুখানি ঘুমানো তারপর সকাল সাড়ে আটটায় উঠে নাস্তা করে রেডি হয়ে ঘুমে টলতে টলতে সাড়ে নয়টা নাগাদ যার যার কাজে বেরিয়ে পড়া। পুরো মাস জুড়ে অমিত অপেক্ষা করে এই সময়টার জন্য। মাস ফুরোলেই মা-বাবাকে বারবার কল করে বলতে থাকে, আসো না কেন তোমরা? এত কী কাজ ওখানে তোমাদের? সব ফেলে চলে আসো তো! জীবন নিরামিষ লাগছে আমার। এখানে এসে আমার বাসার আবহাওয়া চাঙ্গা করো।
জীবন সুন্দর! বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর। যে জীবন পেলে বারবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসার সাধ জাগে, সময়গুলো বাক্সবন্দি করে রাখতে ইচ্ছে হয়! এইসব কিছুর কৃতিত্ব সামনে গুনগুন করে গান গাওয়া, চোখের ইশারায় দুষ্টুমি করতে থাকা মেয়েটার। ছোটবেলায় কার্টুনে দেখতো ম্যাজিশিয়ানরা তুড়ি বাজিয়ে খালি প্লেটে চিকেন ফ্রাই/বার্গার হাজির করে, সাদামাটা বেডরুমকে খেলনায় ভরপুর করে ফেলে, কুঁড়েঘর থেকে আকাশে কিংবা সমুদ্রে নিয়ে যায়। নবনীকেও অমিতের ম্যাজিশিয়ান মনে হয়। এক তুড়িতে সবকিছু বদলে দেয়া ম্যাজিশিয়ান। কিংবা বলা যেতে পারে মিরাকেল! দুইবছর সে অপেক্ষায় ছিল একটা মিরাকেলের। অসহ্য একাকিত্বের রাতগুলোতে বারবার মনে হতো, ইশ্! একটা মিরাকেল, জাস্ট একটা মিরাকেল হতো জীবনে! সকালে ঘুম থেকে জেগেই শুনতে পেতো আজ তার বিয়ে! গোটা দুইবছর অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। জীবনে মিরাকেল হয়েছে। একদিন ঘুম থেকে জেগে সত্যি সত্যি শুনতে পেয়েছে আজ তার বিয়ে! শুধু মানুষটা অদল বদল হয়ে গেছে। মুনিয়ার বদলে নবনী। আর একচুয়াল মিরাকেলটা ছিল ঠিক এখানেই! ভাগ্যিস ও এসেছিল জীবনে! নয়তো এমন করে অগোছালো জীবনটা, অশান্ত মনটা, ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কের সুতোগুলো কে গুছিয়ে দিতো, শান্ত করতো, জোড়া লাগাতো? সৃষ্টিকর্তার দরবারে রোজ কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল হয় না তার, নবনীর হাতে এ জীবন তুলে দেবার কৃতজ্ঞতা!
— “অমিত তুমি হাসছো? দেখি দেখি? হাসছো তুমি!”
ইশ্! নবনীকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঠোঁটের কোনো হাসি ফুটলো কে জানে! সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রু কুঁচকে কঠিন গলায় অমিত বললো,
— “হাসবো কেন! হাসির কিছু হয়েছে?”
— “তুমি আমার নাচ দেখে হাসছিলে। জানি তো আমি!”
টিভিতে গান বাজছে। হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দোপাট্টা মাল মাল কা। নবনী গানের তালে ওড়না দুলিয়ে তখনও নেচে চলছে। প্রচন্ড হাসি পাওয়া সত্ত্বেও চেপে রইলো অমিত। ধমকে উঠলো নবনীকে।
— “কখনো চোখের ইশারায় কিসব করছো, এখন আবার ওড়না দুলিয়ে নাচছো! স্টপ দিস। ইরিটেট হচ্ছি আমি!”
মাথায় ঘোমটা টেনে ঝড়ের গতিতে অমিতের পায়ে এসে পড়লো নবনী। সুর করে বলতে লাগলো,
— “ও আমার স্বামী, স্বামী গোওওও! ও স্বামী, কইরাছি কী ভুউউউল আমিইই? ও আমার স্বামী, স্বামীইগোওও…”
জোর করে হাসি চেপে রাখা ভীষণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বারবার না চাইতেও চোখে মুখে প্রকাশ পেয়েই যাচ্ছে। অমিতের পায়ে জোরে চিমটি কাটলো নবনী,
— “জোর করে হাসি চেপে রাখো তুমি! শয়তান ব্যাটা! একঘন্টা ধরে পেছন পেছন ঘুরছি তোমার রাগ ভাঙাবো বলে। সার্কাসের জোকার হয়ে গেছি আমি। তবুও তুমি হাসছো না!”
— “আমার রাগ নিয়ে আমি বসে থাকবো, তাতে তোমার কী?”
— “আমার তো কতকিছুই! কথা বলছো না আমার সঙ্গে। আমাকে দেখলেই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছো। ধুমধাম শব্দ করে দরজা বন্ধ করছো। গাল ফুলিয়ে বসে থাকছো। দেখতে ভালো লাগে আমার?”
— “আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য মরে যাচ্ছো তুমি?”
— “হ্যাঁ মরছিই তো।”
নবনীর কান টেনে ধরলো অমিত। বললো,
— “গতকাল ঝগড়া কে করেছিল?”
— “আমি।”
— “ফোন সুইচড অফ কে করেছিল?”
— “আমি।”
— “কেন করেছিলে?”
— “তুমি বারবার কল করে বিরক্ত করছিলে, তাই।”
— “আমি কল দিলে তুমি বিরক্ত হও। আমার কথা তোমার বিরক্ত লাগে। তাহলে এখন কেন কথা বলতে চাইছো আমার সঙ্গে?”
— “আচ্ছা বলছি তো! কান ছাড়ো আমার।”
নবনীর কান ছেড়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো অমিত। একলাফে ফ্লোর ছেড়ে অমিতের পাশে বসে পড়লো নবনী। তার গাল চেপে নিজের দিকে ফিরিয়ে নবনী বললো,
— “আর্জেন্ট ডেলিভারী ছিল। আজ এগারোটার আগে পৌঁছাতে হবে। পুরো রাত কাজ না করলে শেষ করতে পারতাম না। সব ওয়ার্কার এতরাতে কাজ করতে চায় না। হাফ ওয়ার্কার চলে গেছে এশার আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। বাকিরা গেছে নয়টায়। কারখানায় ছিল শুধু চারজন আর সঙ্গে আমি। পাঁচজনে মিলে আর কতটুক কাজ আগাবো বলো? সবাই মিলে কাজ করলে বারোটা নাগাদ শেষ হয়ে যেত।”
— “আমি তোমার কারখানার বাইরে দাঁড়িয়ে কতবার কল করলাম! দরজা খুলোনি তুমি। কলও রিসিভ করোনি। উল্টো ফোনের সুইচ অফ করে দিলে।”
— “দরজা খুললেই বিপদ! তুমি আমাকে রেখে আসতে ওখানে? ধরে বেঁধে বাসায় নিয়ে আসতে না?”
— “তুমি ঝগড়াও করেছো আমার সঙ্গে।”
— “কাজের প্রেশার ছিল খুব। তার উপর তুমি রাগারাগি করছো, একের পর এক কল করছো। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল!”
— “রাগ করবো না আমি! কতবার বলেছি এতরাত জেগে কাজ করবে না। কাজের এত স্ট্রেস নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আয়নায় নিজেকে দেখেছো একবার? অসুস্থ দেখাচ্ছে তোমাকে। একবার শুধু বলে দেখো তোমার মাথা ঘুরাচ্ছে, ট্রাস্ট মি নবনী! আজ তোমাকে আমি ছাদের উপর থেকে নিচে ফেলে দিবো।”
— “দিও। এবার রাগ ছাড়ো অমিত। ভালো লাগছে না তোমার গাল ফোলানো দেখতে।”
— “তোমার ভালোর জন্যই তো বলি। কেন শোনো না আমার কথা?”
— “শুনি তো!”
— “কিচ্ছু শোনো না। মাঝেমাঝে এমনভাবে ইগনোর করো যেন আমি তোমার কেউ না।”
— “এত কঠিন করে কেন বলছো? কোন কথাটা শুনিনি বলো তো?”
— “বারবার বলি যতকিছু হয়ে যাক রাতে তুমি বাসায় থাকবে। তুমি বাইরে থাকলে টেনশন হয় না আমার?”
— “তুমিও আমার সঙ্গে কারখানায় চলে এসো। তাহলেই আর টেনশন করতে হবে না।”
চেহারা কুঁচকে নবনীর দিকে তাকালো অমিত। ঠোঁট চেপে হাসলো নবনী। অমিতের হাত টিপে দিতে দিতে বললো,
— “বাদ দাও না ভাই! ভুল হয়ে গেছে আমার।”
— “তোমার কারখানায় একদিন আমি আগুন ধরাবো।”
— “আচ্ছা যা খুশি করো। এবার রাগ টাগ ছাড়ো প্লিজ। অনেক হলো তো! শোনো, চলো আমরা চারজন মিলে বাইরে ডিনার করে আসি। তোমার ফেভারিট পেরি পেরি চিকেন খাওয়াবো, উইথ গারলিক মাশরুম রাইস।”
— “বিল তুমি দিবে। সঙ্গে অবশ্যই আমার গাড়ির তেল খরচও।”
— “রাগ ভাঙানোর ঘুষ?”
— “হ্যাঁ।”
— “খাবার বিল, তেলের খরচ আর এমন কী! তোমার জন্য আমার আস্ত কলিজাটাই হাজির।”
— “শুধু কলিজা দিয়ে কী করবো? সঙ্গে মনটাও দাও।”
— “মনটা যে সামিকে দিয়ে দিয়েছি বহু আগেই।
— “ভালোই ব্যালেন্স করতে শিখেছো। মন বয়ফ্রেন্ডের জন্য আর কলিজা হাজবেন্ডের জন্য।”
— “শিখতে হয় অমিত। একজীবনে দুই পুরুষ থাকলে এভাবেই ব্যালেন্স করতে হয়।”
— “নষ্ট মহিলা! তোমার ঐ বয়ফ্রেন্ডকে দেখতে পারি না আমি। শালা একটা সতীন!”
৩৯
রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে বসে আড্ডায় মেতে উঠেছে ওরা। খাবারের ফাঁকে চলছে হাসি আর গল্প। গল্প করতে করতে হঠাৎ অমিতকে চোখে পড়লো নবনীর। ও হাসছে, গল্প করছে অথচ মনের ভেতর চলছে অন্যকিছু। অস্থির হয়ে উঠেছে কেমন! কিন্তু কেন? অমিতকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো নবনী। মুচকি হেসে সেই প্রশ্ন হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো সে। অমিতের নাম্বারে টেক্সট এল। স্ক্রিন অন করতেই সেদিকে চোখ গেল নবনীর।
‘বাইরে আসবে ৫ মিনিটের জন্য?’
অমিত কোনো রিপ্লাই না দিয়ে স্ক্রিনলক করে রেখে দিলো টেবিলের উপর।
কৌতুহলী হলো নবনী। বাইরে কে ডাকছে তাকে? সেও নিশ্চয়ই এখানে উপস্থিত! আশপাশে চোখ ঘুরাতেই দেখতে পেলো অমিতের বরাবর সামনের সারিতে মুনিয়া বসে আছে! নড়েচড়ে বসলো নবনী। এই তবে অমিতের অস্বস্তির কারণ!
মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে অমিতের। অমিত মোবাইল হাতে নেবার আগেই নবনী নিয়ে নিলো। স্ক্রিনে একটু আগে ম্যাসেজ আসা সেই নাম্বার। মুনিয়া কল করছে। নিজের পার্সে মোবাইল রেখে নবনী মুচকি হাসলো। অমিতের আরেকটুখানি কাছে এসে বললো,
— “খুব বেশি অস্বস্তি হচ্ছে?”
— “নো, আ’ম ফাইন।”
— “তুমি চাইলে এখনি বের হয়ে যাবো।”
— “একই শহরে আছি আমরা। দেখা হতেই পারে। মুখ লুকিয়ে আর কতদিন থাকা যাবে? অনেকদিন বাদে এভাবে দেখা হলো তো! তাই একটু কেমন কেমন লাগছে আর কী। বসি কিছুক্ষন, ঠিক হয়ে যাবে।
— “এক্সাক্টলি! প্রবলেম ফেইস না করে চিরতরে মেটানো সম্ভব না। আছি তো আমি। খুব বেশি রেস্টলেস ফিল হলে বলো আমাকে। শক্ত করে আমার মুঠোয় হাত ধরে বসে থাকবো। দেখবে মুহূর্তেই সব অদ্ভুত অনুভূতি হাওয়া! নাও, এবার হা করো তো?”
অমিতের মুখের সামনে খাবার ধরলো নবনী। চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালো অমিত। অমিতের গাল চিপে মুখের ভেতর খাবার ঢুকিয়ে দিতে দিতে নবনী বললো,
— “এভাবে তাকানোর কী আছে?”
— “খাইয়ে দাওনি তো কখনো! আজ এত প্যাম্পার করছো তাই একটু অবাক হলাম।”
— “তোমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখিয়ে দিচ্ছি, সে চলে গেলেও তোমাকে দেখে রাখার মানুষের অভাব নেই। তুমি ভালো আছো, যত্নে আছো।”
— “আচ্ছা! তাহলে তুমি আমাকে প্যাম্পার করছো না। জাস্ট শো অফ করছো!”
— “হ্যাঁ শো অফ করছি। এবার হা করো।”
— “যাক বাবা! বিয়ের চারমাস পর শো অফ হোক আর যাই হোক মুখে তুলে খাইয়ে তো দিচ্ছো। ভাগ্যিস মুন এসেছিল, নয়তো বউয়ের হাতে এই খাবারটুকু জুটতো না।”
মিষ্টি খুনসুটিতে মেতে উঠেছে ওরা দু’জন। সেলফি তোলার বাহানায় লুকিয়ে ওদের ভিডিও করছে নাতাশা। মা, নানী আর চাচী দেখলে খুশিতে আটখানা হবে একদম! অনি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো একবার। মুনিয়া এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অমিত-নবনীর দিকে। তার চোখেমুখে লেপ্টে আছে মন খারাপের ছায়া। মুখ আড়াল করে হাসলো অনি, স্বস্তির হাসি। ইচ্ছে হচ্ছে তাকে ডেকে বলতে, যা হারালে তা আর এজনমে মিলবে না মেয়ে। খুঁজে এসো গোটা পৃথিবী। অমিতের মতন ভালো আর কে বাসবে তোমাকে?
.
এরশাদ সাহেব ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকক্ষন হলো। ঘুম আসছে না শামীমার। হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া ভিডিওটা বারবার দেখছেন তিনি। ছেলে, ছেলের বউকে কী দারুণ দেখাচ্ছে! নবনী মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে, মিষ্টি করে ওরা দু’জন হাসছে। সারাদিনের যত ক্লান্তি ছিল সব উধাও হয়ে গেছে এই ভিডিওটা দেখে। তবে সমস্যার কথা হলো এতরাতেও ঘুমটা যে আসছে না! গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এরশাদ সাহেবকে ডাকলেন তিনি।
— “অমিতের আব্বু? এই অমিতের আব্বু?”
কোনোরকম এক চোখ মেলে তাকালেন এরশাদ সাহেব।
— “কী চাও?”
— “একটা কথার উত্তর দাও তো?”
— “বলো?”
— “ছেলের বউ ছেলেকে মুখে তুলে খাইয়ে দিবে ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। আমার আনন্দ হবে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আনন্দে আমার ঘুম আসবে না এটা তো অস্বাভাবিক, বলো? আমার ঘুম কেন আসছে না অমিতের আব্বু?”
— “শামীমা! রাত বিরাতে ডেকে তুলে অদ্ভুত প্রশ্ন করা কবে বন্ধ হবে তোমার?”
*****
রাতে খুব একটা ঘুম হয় না জামিলা বেগমের। পান খেয়ে, পুরোনো স্মৃতিচারণ করে, তাহাজ্জুদ আর জিকির করেই রাতের বেশিরভাগ অংশ কাটে তার। আজ তার সময় কাটছে পুরোনো ছবির অ্যালবাম ঘেটে। এই ছোট্ট অ্যালবামটা জুড়ে আছে সামি। এটা কিনেও দিয়েছিল সামি। মারা যাবার ঠিক দেড়মাস আগে এই অ্যালবামটা এনে বলেছিল, এখানে শুধু তোমার আর আমার ছবি থাকবে। দীর্ঘ আটবছরে প্রতি পহেলা বৈশাখে, ঈদে নিয়ম করে ছবি তোলা হয়েছিল ছেলেটার সঙ্গে। সেই ছবিগুলোই এই ছোট অ্যালবামটাতে নিজেই সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল ছেলেটা। এখনো ঠিক সেভাবেই আছে। একটা ছবিরও জায়গা পরিবর্তন হয়নি, জামিলা বেগম হতে দেননি। রাতে খাবারের পর তার মেয়ে এসেছিল এই ঘরে, ফোনে নবনী অমিতের ভিডিও দেখাতে। খুশি লাগছিল খুব। নবনীর জীবনটা বুঝি গুছিয়ে এল এবার! সেইসঙ্গে বুকের মধ্যে কোথায় যেন চিনচিনে এক ব্যথা! দীর্ঘসময় যাকে নাতিন জামাই ভেবে এসেছেন, আপন করে কাছে কাছে আগলে রেখেছেন সেই মানুষটা চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবার ব্যথা। আজ ভীষন কান্না পাচ্ছে তার। অঝোরে কাঁদছেন তিনি। ছবির উপর আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জামিলা বেগম বলছেন, — “যার লগে খোদা নবনীরে বাইন্ধা দিলো ঐ মানুষটা খুব ভালো। হীরার টুকরা
কইতে পারো। ওর কাছে ভালো আছে নবনী, ও আমার নাতিনরে সুখেই রাখবো। একটা সময় বাদে হয়তো নবনী সুস্থ হইবো, সংসারী হইবো। সবই ঠিকঠাক চলবো। থাকবা না খালি তুমি। নবনীর সংসার, সুখ সব তো হওয়ার কথা ছিল তোমার লগে। আজকে ঐ জায়গায় অন্য কেউ দাঁড়ায় আছে। নসীবের জোরে সব বদলায় গেল! আমার মানতে একটু কষ্টই হয়! নবনীর সুখ চাই আবার তোমারেও ভুলতে পারি না। ভাইগো! তোমারে আমার খুব মনে পড়ে। তোমার লাইগা ভেতরটা আমার পুইড়া ছারখার হয়। তবুও মনরে শক্ত কইরা আমি নবনীর ঘর সংসারের সিদ্ধান্ত নেই। তুমি কি আমারে কবর থেইকা দেখতে পাও ভাই? শুনতে পাও আমারে? আমারে কি তুমি স্বার্থপর ভাবো?”
*****
— “তোমার কী মনে হয়, হি স্টিল লাভস হার? অর এ্যনি সফট ফিলিংস?” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো নবনী। সামির প্রশ্নে থমকে গেল সে।
— “কী ভাবছো?”
— “তোমার কাছে কী মনে হয়? ও এখনও ঐ মেয়েটাকে ভালোবাসে?”
— “নট সিওর। বাট, একেবারে ভুলেও যায়নি। কিংবা থাকে না এমন, থাকা কিংবা না থাকাতে আমার বয়েই গেল, ওরকমটা না। মুনিয়ার থাকা না থাকা এখনও অমিতের উপর প্রভাব ফেলে।’
— “তাহলে ভালোবাসা আছে এমনটা ভেবে নেয়া ভুল কিছু হবে না?”
— “উঁহু।”
— “বিপদ তো!”
— “হ্যাঁ বিপদই। এই টক্সিক মেয়েটাকে চিরতরে মুছে ফেললেই ভালো হতো। কখন আবার ওর লাইফে ব্যাক করে কে জানে!”
— “অমিত আবারও ওর পেছন পেছন যদি যায় এবার নির্ঘাৎ আমি ওর গালে কষে চড় লাগাবো।”
— “যাক সেসব। এসব মারামারি পরে দেখা যাবে। এবার বলো ওর জন্মদিনে কী প্ল্যান করছো?”
— “ভালো কিছু।”
— “কী?”
— “বুঝতে পারছি না।”
— “শার্ট, পারফিউম ওসব সবাই দেয়। তুমি নাহয় ভিন্ন কিছু দাও। সামথিং প্রাইসলেস! যেটা অমিতের জন্য স্পেশাল মেমোরি হয়ে থাকবে।”
— “কেমন?”
— “ওর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে এমন কিছু।”
— “তুমি একদম আমার মনের কথাটাই বলে দিলে সামি। আমিও চাইছিলাম এমন কিছু। কিন্তু কিভাবে উনার সামনে দাঁড়াবো, উনাকে ম্যানেজ করবো বুঝে পাচ্ছি না।”
— “সাব্বির?”
— “হ্যাঁ।”
— “উনার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াও। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। মাথার নাটবল্টু একটু নাড়াচাড়া করতে হবে, কিন্তু তুমি পারবে।”
.
পাশে বসে থাকা মেয়েটা কে ছিল জানা নেই মুনিয়ার, তবে এতটা কাছাকাছি বসে মুখে তুলে খাইয়ে দেবার অনুমতি অমিত তো কখনো কাউকে দেয়নি! এই অনুমতি ছিল একমাত্র তার। আজ কাকে অনুমতি দিয়ে দিলো এতখানি কাছে আসার? মেয়েটার পরিচয় জানার কৌতুহল বড্ড পীড়া দিচ্ছে ওকে। বারবার কল করা সত্ত্বেও অমিত রিসিভ করছে না। একের পর এক ম্যাসেজ দেবার পরও অপরপ্রান্ত থেকে রিপ্লাই আসছে না। এতখানি অবহেলা কখনো কি অমিত করেছিল? তার ডাক কখনো এভাবে উপেক্ষা করেছিল? করেনি তো! খুব কেঁদে কেঁদে বলতো, তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা ইম্পসিবল। আর এখন! ঝাপসা চোখে মোবাইল স্ক্রিনে “কলিং অমিত” লেখাটায় তাকিয়ে রইলো মুনিয়া। প্রচন্ড অভিমানে কাঁদছে সে।