ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৩০

৩০

ঘড়িতে দুপুর তিনটা বাজে। এরশাদ সাহেব বাসস্ট্যান্ডে গিয়েছেন নবনীদের আনতে। বারান্দায় আধঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে আছেন শামীমা। নবনী কখন আসবে তর সইছে না তার। আজ সকালে কত আগ্রহ নিয়ে অমিতকে বলেছিল নবনী আসছে। ছেলেটা কিছুই বললো না। কাজের দোহাই দিয়ে ফোন রেখে দিলো। আজব কান্ড! নবনী এই প্রথম তার বাবার বাসায় আসছে অথচ তার এক্সাইটমেন্টই নেই! ছেলের কান্ডে পুরো মুডটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল শামীমার। ইচ্ছে হয়েছিল কল করে খুব করে বকে দিতে। এই ছেলেটার সঙ্গে কিভাবে যে নবনীর ভাব ভালোবাসা হবে কে জানে! 

পেছন থেকে এই বাসার সহযোগী শামীমাকে ডেকে বললো,

— “খালা? কতক্ষণ দাঁড়ায়া থাকবেন? ভিতরে আইসা বসেন।’ 

— “নাহ্! ভিতরে মন বসবে না আমার।”

— “পোলার বউর লাইগা কত টান! কী লক্ষ্মী শাশুড়ি আপনে! এমন কইরা কে অপেক্ষা করে বউর লাইগা?” 

— “আমার বউটাও খুব লক্ষ্মী। কতবছর পর আমার ছেলেটার সঙ্গে সব সমস্যা মিটমাট হলো! নবনীই তো করলো সব। এমন বউকে মাথায় রাখবো না তো কোথায় রাখবো? কী ইচ্ছে ছিল ওকে ধুমধাম করে আমার ঘরে বরণ করে নেয়ার! বাইরে ব্যান্ড পার্টি বাজবে, এই বাড়িটা লাইটিং করা হবে, একঘর আত্মীয়স্বজন থাকবে, আমি ওকে দুই হাতে বালা পরিয়ে দিবো, আমার দাদী শাশুড়ির বিয়ের ওড়না পরাবো, আমার ছেলে আর ও মিষ্টিমুখ করবে, অমিত ওকে কোলে করে ঘরে ঢুকবে। ওসব কিছুই হচ্ছে না! এজন্য মনটা একটু খারাপ বটে। কিন্তু তোর খালু বলেছে আর কয়েকমাস বাদে সবকিছুর একটা সমাধান হয়ে যাওয়ার পর আমরা বড় করে আয়োজন করবো। আমার একটামাত্র ছেলে না বল? ওর বিয়ে উপলক্ষে একটু আনন্দ ফূর্তি হবে না তা কি করে হয়?” 

— “ঐ তো খালা, চইলা আইছে।” 

বারান্দার বাইরে একবার শামীমা উঁকি দিয়ে, ঝড়ের গতিতে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালো। আজ একটু পরই তার অমিতের বউ এই দরজার সীমানায় পা রাখবে। এত আনন্দ সে রাখবে কোথায়! 

.

রুক্ষ শুষ্ক চেহারা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে অমিত। কাজে ভুলগুলো যথাসাধ্য এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। তবুও সামলে উঠতে পারছে না ঠিক। ছোটখাটো ভুল হচ্ছেই। মনের অবস্থা যতটুকুই ছিল, গতরাতে মুনিয়ার সঙ্গে কথা বলার পর আরো বেশি এলোমেলো লাগছে নিজেকে। মাঝরাতে, নির্জন হোটেল কামড়ায় একাকিত্ব জেঁকে ধরেছিল ঠিক তখনই মুনিয়ার কল এল। নিজেকে আর কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারলো না। রিসিভ করেই ফেললো। খুব আহামরি কথা হয়নি। সামান্য কুশলাদি বিনিময়েই কথোপকথন শেষ হয়েছে তাদের। তবে গতকালের মুনিয়া ভিন্ন কেউ ছিল। এতটা সফট টোনে মুনিয়া কথা বলতো সেই বছর তিনেক আগে। সেই পুরোনো মুনিয়া বারবার চোখে ভাসছে। পুরোনো দিনগুলো মনে পড়ছে। ফেলে আসা স্মৃতিগুলো মনের কোণে এক্কাদোক্কা খেলছে। পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো কেউ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো কলিগ রুমানা দাঁড়িয়ে। — “এখনো কিছু খাননি কেন ভাইয়া?” 

— “খাবো।” 

— “আর কখন? সকালেও খাননি, সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখনও না খেয়েই আছেন। না খেয়ে এত কাজ করলে গায়ে সইবে?” 

— “সমস্যা নেই। অভ্যাস আছে আমার।” 

— “অসুস্থ দেখাচ্ছে আপনাকে। আপনি নাহয় হোটেল থেকে রেস্ট করে আসুন। আমরা এদিকটা সামলে নিবো।”

— “হবে না। কখন কোন কাজ পড়ে যায়! তারচেয়ে বরং থাকি এখানে।” 

মোবাইল বেজে উঠলো অমিতের, অনি কল করছে। রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। কল ডিক্লাইন করে পকেটে রাখতেই আবারও কল এল। ইমার্জেন্সি ভেবে কল রিসিভ করলো অমিত 

— “বল…” 

— “আমরা ঈশা খাঁ বেইজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি বাইরে এসো।”

— “তোরা কারা?” 

— “আমি, নাতাশা আর নবনী আপু।” 

— “তোরা কেন এসেছিস?” 

— “তোমাকে দেখতে।” 

— “আমাকে দেখার কী আছে অনি? আমি এখন দেখা করতে পারবো না। ব্যস্ত আছি। ফিরে যা তোরা।” 

— “আশ্চর্য! নবনী আপু এতদূর থেকে চলে এল তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে অথচ তুমি বলছো সময় নেই!” 

অনির হাত থেকে মোবাইল ছোঁ মেরে নিলো নবনী। গলা চড়িয়ে বলতে লাগলো,

— “দেখো অমিত, খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু! একের পর কল করেই যাচ্ছি রিসিভ করছো না, তোমার হয়েছেটা কী সেই কথা জানতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে এলাম তবুও তোমার সময় হচ্ছে না পাঁচ মিনিট দেখা করার? ফাজলামি করো? তুমি বাইরে আসবে নাকি আমি ভেতরে যাবো?” 

— “এটা বি এন এস এর বেইজ। তোমাকে এখানে কখনোই এলাউ করবে না। সো, তুমি এখন বাসায় যাও।” 

— “তুমি কি ভেবেছো ভেতরে যাওয়া আমার এলাউড না সে কথা আমি জানি না? অবশ্যই জানি এবং বন্দোবস্ত করেও এসেছি। ভেতরে ঢুকে তোমার ঠ্যাং ভেঙে যাবো, দেখতে চাও তুমি?” 

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অমিত। নিচুস্বরে বললো, 

— “আসছি আমি।” 

.

ভিডিও কলে নীতুর সঙ্গে কথা বলছেন শামীমা। হাসি যেন আজ তার থামছেই না। দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে নীতুর। চুপ করে শামীমার গরগর করে বলতে থাকা সমস্ত কথা শুনছে সে। বলুক, তার মেয়েকে ঘিরে কেউ এত আনন্দে আছে মা হিসেবে এই প্রাপ্তিটুকু অনেক সুখের। 

— “আমি তো ভেবেছিলাম নবনীর বুঝি ইচ্ছে হয়েছে সমুদ্র টমুদ্র দেখার, তাই আমার এখানে বেড়াতে এসেছে। ওমা! আমাকে অবাক করে দিয়ে দুপুরে খেতে খেতে কী বললো, জানো ভাবী?” 

— “কী?” 

— “অমিত নাকি ওর সঙ্গে কথা বলছে না। রাগ করেছে বোধহয়! অমিতের রাগ ভাঙাতে এসেছে।”

— “নবনী এমনই পাগলাটে। আমরা কেউ ওর উপর রেগে থাকলে কতক্ষণে রাগ ভাঙাবে তা নিয়ে উঠেপড়ে লাগে।” 

— “তোমরা কেউ বলতে কারা? সবাই? ও যাদের চেনে তারা সবাই?” 

— “সবাই না ঠিক। ঝগড়া বিবাদে ও নেই। কেউ ওর সঙ্গে রেগে থাকলে তা মিটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে তবে আমরা ওর কাছের যে ক’জন আছি আমাদের হিসেবটা আবার আলাদা। দিনভর পিছু পিছু ঘুরতেই থাকবে।” 

— “এই তো কথা! আমার অমিতকেও নবনী কাছের কেউ ভাবে। নয়তো এতদূর থেকে ওর জন্য আসতো? তুমিই বলো?” 

.

ল্যাম্পপোস্টের নিচে মুখোমুখি অমিত নবনী। মাথানিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অমিত। সোডিয়াম বাতির আলোয় অমিতের শুকনো মুখটায় নিষ্পলক তাকিয়ে আছে নবনী। বিষণ্ণ কন্ঠে সে বললো, 

— “চুপ করেই থাকবে? কিচ্ছু বলবে না?”

— “জিজ্ঞেস করেছো কিছু?” 

— “আমি জিজ্ঞেস করলেই শুধু উত্তর দেবে, এর বাইরে কিছু বলবে না?” 

  • …………….

— “এত শুকনা লাগছে কেন? খাওনি সারাদিন তাই না?” 

— “সময় পাইনি।” 

— “চলো, আমার সঙ্গে খাবে।” 

— “খাবো না কিছু। কাজে ফিরতে হবে।” 

— “আমি খাবো। খিদে পেয়েছে খুব। চলো, খাওয়াবে আমাকে।”

মানিব্যাগ থেকে দুই হাজার টাকার নোট বের করে বললো, 

— “দশ মিনিট পরই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানে শহরের বেস্ট শর্মা পাওয়া যায়। অনি চিনবে। খেয়ে এসো তিনজন মিলে। — “আমরা তো যাবোই, তুমিও যাবে।” 

— “না।”

— “দেখো, খুব আদর করে কথা বলছি। আমার কথা না মানলে কিন্তু! 

— “নবনী, দেখা করতে চেয়েছো, করেছি। সিন ক্রিয়েট করো না।” 

— “আমি সিন ক্রিয়েট করছি অমিত? কী নিয়ে রাগ করলে সেটা তো বলবে? হুট করে আমার বার্থডে ফেলে চলে এলে। রাগ আমার করা উচিত। অথচ রাগ তুমি করে বসে আছো! আমি এত করে সবকিছু মিটিয়ে নিতে চাইছি, তুমি কথাই বলতে চাইছো না! এতবড় কী অন্যায়টা করে ফেললাম আমি?” 

— “জানো না?” 

— “জানলে অবশ্যই তোমার পেছন পেছন ঘুরতাম না। সোজা ঝামেলাটাই শেষ করে ফেলতাম।”

— “তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। এবার বাসায় যাও।” 

অমিতের হাত নিজের মুঠোবন্দি করে নিলো নবনী। আরো একটুখানি কাছাকাছি এসে বললো, 

— “হাত কিন্তু আমি ছাড়বো না। কঠিন সিন ক্রিয়েট করে ফেলবো। বাইরের মানুষদের সামনে এমনটা করলে তোমার ভালো লাগবে না নিশ্চয়ই?” 

হতাশ চোখে নবনীর দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো অমিত। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। এগিয়ে যেতে যেতে বললো, 

— “এবার হাত ছাড়ো?” 

— “এত অবহেলা? হাত ছাড়ানোর জন্য কী তাড়া! আমার হাত ধরার জন্য কেঁদে কেঁদে মরবে বলে দিলাম।” 

মুখ টিপে হাসতে লাগলো নবনী। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো অমিত। 

— “সবকিছু তোমার কাছে ফাজলামি মনে হয়?” 

— “যাহ্! তোমার সঙ্গে একটু মজাও করা যাবে না? রেগে যাবে এভাবে?” 

.

রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খাচ্ছে ওরা চারজন। নাতাশা অনি খুব সেলফি তুলছে গল্প করছে। অমিত ডানে-বামে না তাকিয়ে চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। আর নবনী সমস্ত মনোযোগ ঢেলে রেখেছে অমিতের দিকে। প্লেটে খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে অমিতকে বললো,

— “শীতের সময় চলছে অমিত। একটু তো স্কিনে ময়েশ্চারাইজার, ঠোঁটে ভ্যাজলিন লাগাতে পারো, তাই না? একে তো না খেয়ে মুখ শুকিয়ে রেখেছো, তার উপর ময়েশ্চারাইজারের অভাবে চামড়াও শুকিয়ে আছে। কেমন দেখাচ্ছে বলো? টিমের অপারেশন ম্যানেজার তুমি। তোমাকে থাকতে হবে ফিটফাট।” 

— “কপালই ভালো না। চামড়া আর ঝকঝকে তকতকে রেখে করবোটা কী?” 

— “রাগ কি কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে? মিটিয়ে নাও না ভাই! ভালো লাগছে না এসব।” 

টেবিলের উপর অমিতের ফোন বাজছে। স্ক্রিনে মুনিয়ার নাম দেখে ভ্রু কুঁচকালো নবনী। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে কল রিসিভ করলো অমিত। চেয়ার ছেড়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে পা বাড়ালো সে। নবনী চোখ বড় করে চেয়ে রইলো অমিতের চলে যাওয়ার পথে। 

.

— “চট্টগ্রাম এসেছি কাজে। দেখা হয় না অনেকদিন। চলো মিট করি।” 

— “না, আমি এখানে ব্যস্ত অনেক।” 

— “জানি ব্যস্ত। আধঘন্টা সময় আহামরী কিছু তো না। তোমার ডিনার বা লাঞ্চ আওয়ারে মিট করা যায়। কিংবা তুমি রাতে হোটেলে ফেরার পর!” 

— “দেখো এখানে আমার কলিগরা আছে। হোটেল রুমে নিশ্চয়ই তোমাকে আসতে বলবো না। আর রইলো কথা দেখা করার, সেটা ঢাকা ফিরেও করা যাবে। এই দুই চারদিন আমি মিট করতে পারবো না। তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে। রাখছি।” অমিত কল কেটে পেছন ফিরতেই নবনীর মুখোমুখি হলো। হকচকিয়ে গেল অমিত। প্রচন্ড রেগে আছে মেয়েটা। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল। তার হাত টেনে ধরলো নবনী। 

— “ঘটনা তাহলে এটা?” 

— “কোন ঘটনা?” 

— “তোমার টক্সিক গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আবারও তোমার প্যাঁচ আপ হয়েছে। গার্লফ্রেন্ডের ভয়ে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছো না, আমাকে ইগনোর করছো তাই তো?” 

— “ওহ্ গড!” 

কপাল চেপে হাসলো অমিত। অমিতকে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালে সেটিয়ে নবনী বলতে লাগলো, 

— “ইট ওয়াজ আনএক্সপেক্টেড অমিত! তুমি ওর সঙ্গে কিভাবে! মেয়েটা তোমাকে এত টর্চার করলো তবুও তুমি আবারও ওর সঙ্গে রিলেশনে! মানে কিভাবে সম্ভব! এমন মানুষকে ভালোবাসো কী করে? ওর জন্য তুমি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছো আর আমি গাধা অনবরত কল করেই যাচ্ছি। ভুলেই গিয়েছিলাম অমিত, মুনিয়ার পারমিশন ছাড়া কিছু করবে না। 

— “নিজে নিজে কত কী বানিয়ে ফেলছো নবনী!”

— “ওহ্ তুমি বলতে চাইছো আমি ভুল বুঝেছি? তাহলে আমাকে কেন ইগনোর করছো? মুনিয়ার কল কেন রিসিভ করছো? মুনিয়া তোমার সঙ্গে মিট করতে চাইতো না সেই মেয়ে এখন তোমার সঙ্গে মিট করতে চায় কেন? তোমার হোটেল রুমে এসে মিট করতে চায়! হোটেল রুমে কেন আসতে চায়, কী হতে পারে রুম জানি না ভাবছো? প্যাঁচআপ না হলে এসব কথা আসবে কেন?” 

— “তুমি আমার কী হও? 

— “মানে?” 

— “জানতে চাইলাম, এই যে এতকিছু জিজ্ঞেস করছো কেন করছো? কী সম্পর্ক তোমার সঙ্গে আমার? হাজবেন্ড ওয়াইফ? না! তোমার খবর আমি জানি না কিন্তু তোমাকে আমি ওয়াইফ ভাবি না। আমরা কি বন্ধু? হ্যাঁ আমি তোমাকে বন্ধু ভাবি কিন্তু তুমি আমাকে বন্ধু ভাবো না। সো, আমরা কেউ কারো পারসোনাল ম্যাটারে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।” 

অমিতের দিকে আহত চোখে নিষ্পলক চেয়ে রইলো নবনী। ওর চোখে চোখ রাখতে পারছে না অমিত। মনের কোথায় যেন অনুতাপ খচখচ করছে। ভেতর থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলছে, একটু বেশিই বলে ফেললি না? চলে যেতে যেতে অমিত বললো, 

— “আমার খাওয়া হয়ে গেছে। বিল পে করে যাচ্ছি। তোমরা খাবার শেষ করে যেও।” 

৩১

প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরলো নবনী। মাথাব্যথার অযুহাতে রাত এগারোটায়ই লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। শামীমার একটু আধটু খটকা লাগলেও অনি, নাতাশা সামলে নিয়েছে পুরোটা। রাতে খাবার টেবিলে বসে অমিতকে ফোন করলেন এরশাদ সাহেব। 

— “হ্যাঁ বাবা?” 

— “নবনীরা এসেছে বাসায়, এবার তো অন্তত বাসায় আয়।” 

— “হোটেলেই ঠিক আছি বাবা। কলিগরা আছে, ওদের সঙ্গে কাজ নিয়ে ডিসকাস করতে সুবিধা হয়। এখান থেকে বেইজ কাছাকাছি। প্রয়োজন হলে যখন তখন ছুটে যাওয়া যায়। 

— “বাসা কি আহামরি দূরে? গাড়ি তো আছেই। যখন তখন এখান থেকেও যাওয়া যায়। রইলো কথা কলিগদের, ওদেরসহ বাসায় নিয়ে আয়।” 

— “এত মানুষ নিয়ে বাসায় চলে আসবো এটা কেমন কথা?” 

— “তুই চট্টগ্রাম এসেও বাসায় একবারও উঁকি দিলি না, এটা কেমন কথা? রাতে বাসায় ফিরে ঘুমালেও পারিস। তোর মা আজ কত কী রান্না করলো, তুই এত কাছে অথচ তোকে রেখে খেতে হচ্ছে। ভালো লাগে এসব?”

— “আসবো বাবা। প্রোগ্রাম শেষ করে বাসায় থাকবো দুইদিন। পরশু কাজ শেষ হয়ে যাবে।” 

— “রাতে খেয়েছিস?” 

— “হ্যাঁ। নবনীরা এল, তখন একসঙ্গে খেলাম।

— “বাইরে কিন্তু বেশ ঠান্ডা। হুডি ছাড়া কোত্থাও যাবি না।” 

— “আচ্ছা। বাবা আমি খুব ব্যস্ত। রাখছি তাহলে।”

কল কেটে চেয়ারে পা এলিয়ে বসলো অমিত। ঠোঁট জ্বলছে তার। শুষ্ক হাওয়ায় ফেটেছে বোধহয়! ভ্যাজলিনের একটা ছোট কৌটা সঙ্গে রাখা উচিত ছিল। ভ্যাজলিন নিয়ে ভাবতেই নবনীর কথা মনে পড়ে গেল অমিতের। ও তখন বলছিল নিজের যত্ন নিতে। এত খেয়াল করে সবকিছু মেয়েটা! মুখ দেখে বলে দিলো সারাদিন না খেয়ে আছে। জোর করে ধরে বেঁধে নিয়ে খাওয়ালো। রেস্টুরেন্টে ছিল দেখে রক্ষা! বাসায় থাকলে এতক্ষনে হয়তো নিজেই তার হাতে ময়েশ্চারাইজার ধরিয়ে দিয়ে বলতো, নাও হাতে পায়ে ঘষো। সেদিন রাতের পর থেকে সবকিছুতেই আগলে আগলে রাখে মেয়েটা। আপন ভাবে তাই আগলে রাখে। দূরের কারো জন্য নিশ্চয়ই এতটা কেয়ার করবে না। তখন বলছিল, তুমি রাগ করে আছো তাই চলে এসেছি মিটিয়ে নিতে। কেন করে এসব? বন্ধু ভাবে? যদি ভেবে থাকে তবে মিথ্যা কেন বললো? নাতাশাই বা কেন নবনীর সামনে বলতে চাইলো না? নবনী কি বাসায় কঠিন বারণ করেছে এই সত্যটা অমিতের সামনে প্রকাশ করতে? কারণটা কী? কত কত ব্লু ছিল সামনে অথচ একবারও ধরতে পারলো না নবনীর মিথ্যা! কোন প্রেমিকটা নিজের প্রেমিকাকে অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে করতে বলবে? কোন প্রেমিকটা রাত বিরাতে অন্য ছেলের সঙ্গে বাড়ি ফেরা, অন্য ছেলের প্রতি এতটা কেয়ারিং হওয়া, তার সঙ্গে রাত জেগে মুভি দেখা, বাইরে খেতে যাওয়া সয়ে যাবে? এত সহজ সবকিছু! তবে কি নবনী তাকে আলাদা করে ভাবে? মুখে শুধু বন্ধু বললেও মনে মনে মেয়েটা তাকে স্বামী হিসেবেই চায়? কী ভেবেছিল নবনী? বিবাহিতা স্ত্রী প্রেমিকের গল্প স্বামীকে শোনালে স্বামী হিংসার বশবর্তী হয়ে স্ত্রীকে কাছে পেতে মরিয়া হয়ে যাবে? অথবা এমনও হতে পারে প্রেমিক আছে জানলে সে নবনীর সঙ্গে নির্দ্বিধায় কথা বলবে, স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারটা মাথায় আর আসবে না সেই ভাবনা থেকেই মৃত প্রেমিককে সে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওর মাথায় কি একবারও এল না সত্যিটা জেনে গেলে অমিতের প্রচন্ড মন খারাপ হবে? এত কঠিন মিথ্যা কেউ কি করে পারে এত সাবলীলভাবে শোনাতে? নবনীকে ঠিক ধরতে পারছে না অমিত। শত দ্বিধা আর প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে প্রতি মুহূর্তে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছে সে। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। একটা সুরাহা এবার করা দরকার। নাহিয়ান আর জুনিয়রদের কাজ বুঝিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলো অমিত। নাতাশার কাছে আজই সবটা জানবে সে। 

.

বাইরে থেকে একটু পর পর রিকশার শব্দ ভেসে আসছে। রাত অনেক গড়ালেও, এলাকার পথঘাট এখনো জেগে। গায়ে চাদর পেঁচিয়ে বারান্দায় বসে আছে নবনী। দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে রেখেছে। সামি পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অনেকটা সময় ধরে নবনী চুপ। সামিও কিছু জানতে চায়নি। প্রচন্ড মন খারাপের সময়টাতে নবনী চুপ থাকে। সামি জানে সেই কথা। তার চোখের সামনেই তো নবনীর বেড়ে উঠা। নবনীর সবটা জানে সে। নবনী খুশি হলে কী করে, রেগে গেলে কী করে, মন খারাপ হলে কী করে। এতগুলো বছর এভাবেই কাটছে দুজনের। পরস্পরের আবদারগুলো, ভালো লাগা মন্দ লাগাগুলোকে পূরণ করে, সম্মান করে, আগলে রেখে। মাথার উপর থেকে সামির হাত টেনে এনে নিজের গালের সঙ্গে মেশালো নবনী। হাতের তালুতে আলতো চুমু খেয়ে বললো, 

— “আমার এখানে আর ভালো লাগছে না।” 

— “কী হয়েছে? মনটা এত খারাপ কেন? “অমিতকে আমি দেখতে পারি না।”

— “ঝগড়া হয়েছে ওর সঙ্গে?” 

— “ও আমাকে খুব আজেবাজে বকেছে। আমি ওকে আমার বন্ধু ভাবতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ও আমাকে বন্ধু ভাবে না। ওর রাগ ভাঙাতে চলে এলাম এতদূরে অথচ এসে দেখি ওর গার্লফ্রেন্ডের ভয়ে ও আমার কল রিসিভ করছে না। তার উপর ব্লেইম আমাকে করছে আমি ওকে বন্ধু ভাবি না, আমি যেন ওর পারসোনাল লাইফ নিয়ে কিছু না বলি। বোঝো অবস্থা! মুনিয়া মেয়েটা কত হার্ট করলো ওকে, বিট্রে করলো। কিভাবে ভেঙে পড়েছিল ও! তখন কত কী বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে স্ট্যাবল করলাম। আর এখন বলছে আমি যেন ওর পারসোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার না করি! খুব ইনসাল্ট ফিল করছি। কত কত কল করলাম ওকে! একটা মানুষ এত রুড কী করে হয় বুঝি না। তুমিই বলো এসবের পরও কি আমার এই বাসায় থাকা উচিত? ঢাকায় ফিরে অমিতের বাসায় যাওয়া উচিত? একদম মন বসছে না আমার এখানে।” 

— “অমিতের মনে কী চলছে সেই খবর তুমি আমি কি জানি? হতে পারে কিছু একটা নিয়ে ও প্রচন্ড ডিপ্রেসড।” 

— “কী নিয়ে আর হবে? আছে না একজন! ঐ মেয়েটার মতো টক্সিক একটা গার্লফ্রেন্ড থাকলে ডিপ্রেসড হবার জন্য আর কিছু লাগে নাকি?” 

— “অমিত কিন্তু ছেলে মন্দ না। তুমি নিজেও চেনো ওকে। সবসময় তুমিই না বলতে অমিত খুব ভালো একটা ছেলে। তাহলে আজ এত মন খারাপ কেন করছো? জানোই তো ওর গার্লফ্রেন্ড খুব পাজি। হয়তো তোমার সঙ্গে মেলামেশা মুনিয়ার পছন্দ না।” 

— “ওকে যেতে বলেছে কে ঐ মেয়ের কাছে?” 

— “শত হোক, অমিতের প্রথম প্রেম তো! কতটা ভালোবাসে তা তুমিও জানো। এত ভালোবাসা মন থেকে মুছে ফেলা কি সহজ? ওর জীবনে অন্য কেউ নেই। সো, ও মুনিয়ার কাছে ফিরে যাবে এটা খুব স্বাভাবিক।” 

— “তাই বলে গার্লফ্রেন্ডের কথায় আমার সঙ্গে মিসবিহেভ করবে, যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে?”

— “আহ্হা! তুমি আমি দু’জনেই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছি। তেমন কিছু নাও হতে পারে। অন্য কারণ হতে পারে।

— “আমি আন্দাজে বলছি না। আজ দেখেছি আমি ও মুনিয়ার সঙ্গে কথা বলছিল। মেয়েটা হোটেলে এসে মিট করতে চায়। তার মানে প্রেম চলছে।”

— “আর তাতেই ধরে নিলে তোমার সঙ্গে মুনিয়া যোগাযোগ করতে বারণ করেছে। এত আগ বাড়িয়ে ভাবছো কেন? পরে যদি জানতে পারো তুমি ভুল ধারণা করে ছিলে, অমিত সত্যিই অন্যকোনো ব্যাপারে খুব স্ট্রেসড ছিল তখন তো ঠিকই মন খারাপ করে বলবে, সামি আমার খুব গিল্ট ফিল হচ্ছে। অমিত না তোমার বন্ধু? বন্ধুকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত।” 

— “আমি তো বুঝতে চাইলাম কতবার। ও না বললে আমি কী করবো?”

— “অমিতের সময় প্রয়োজন। ওকে ওর মতো কয়েকটাদিন থাকতে দাও। কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরুক। তারপর নাহয় পরিস্থিতি বুঝে জিজ্ঞেস করো।” 

.

অমিত বাসায় ফিরলো পৌনে একটায়। ড্রইংরুমে বসে নাতাশা আর অনি টিভি দেখছিল। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে অনি দরজা খুললো। অমিত পায়ের জুতোগুলো খুলেই নিজের ঘরে যেতে যেতে নাতাশাকে বললো, 

— “আমার ঘরে এসো তো? কথা আছে।” 

— “এখনি?” 

— “হ্যাঁ, এখনি।” 

অনির দিকে তাকালো নাতাশা। এতরাতে আলাদা ডেকে কী বলবে কে জানে! 

তার উপর খুব টেনশনে আছে কিছু একটা নিয়ে সে কথা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনি নিচুগলায় বললো,

— “ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন?” 

— “কী বলবে আমাকে? 

— “যাই বলুক, খেয়ে তো আর ফেলবে না। চলো আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।” সোয়েটার খুলে নিজের বিছানায় অমিত লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। দরজায় দাঁড়িয়ে অনি জিজ্ঞেস করলো, 

— “ভাইয়া, আমি কি তোমাদের কথার মাঝে বসতে পারি?” 

— “আয়। জিজ্ঞেস করার কী আছে!” 

নাতাশা খাটে বসেই জানতে চাইলো, 

— “কী হয়েছে ভাইয়া? জরুরি কিছু?”

— “হ্যাঁ জরুরিই তো! নবনী কোথায়?” 

— “আপুর মাথাব্যথা। ফিরেই ঘরে চলে গেল। ঘুমিয়ে গেছে হয়তো এতক্ষণে।”

— “রাতে খেয়েছে কিছু?” 

— “না।” 

— “তুমি হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বাসায় চলে এলে যে? বাবা খেতে বসেও তোমাকে আসতে বললো। তখনও কিছু বলোনি।

— “আসলাম, নাতাশার কাছে কিছু জানার ছিল তাই।” 

— “কী জানার ছিল?” 

— “তোমার বোনের জন্মদিনে সামির ছবি দেখেছিলাম। তুমি বললে ছেলেটা মারা গেছে। আসলেই কি মারা গেছে?” 

— “হ্যাঁ।” 

— “তাহলে নবনী আমাকে কার গল্প শোনায়?” 

— “সামি ভাইয়ার।”

— “কিন্তু ওর গল্পে সামি এখনো বেঁচে আছে। ও আমার সঙ্গে এমনভাবে সামিকে নিয়ে গল্প করে যেন সামির সঙ্গে ওর প্রতিদিন কথা হচ্ছে, নিয়মিত দেখা হচ্ছে। নবনী মিথ্যা কেন বললো আমাকে?” 

— “আপু মিথ্যা বলেনি ভাইয়া। আপুর কাছে উনি এখনো বেঁচে আছে।” – “মানে? বুঝিয়ে বলো — “ভাইয়া মারা যাওয়ার পরে একবছর আপু স্বাভাবিক ছিল না। কত ডক্টর দেখালাম তবুও আপু সুস্থ হয়নি। তারপর একদিন সামি ভাইয়ার বোন এসে আপুকে খুব বোঝালো। তার ঠিক সপ্তাহ…” 

— “নাতাশা…” 

— “জি?” 

— “জানি আজ জার্নি করে এসেছো। খুব টায়ার্ড তুমি। তবুও একটা অন্যায় আবদার করি?” 

— “বলুন না!” 

— “আমাকে শুরু থেকে বলো। নবনী কত কি-ই বলেছে আমাকে। কোনটা সঠিক কোনটা মিথ্যা আমি জানি না। সবটা ঘোলাটে লাগছে। তুমি আমাকে নতুন করে শোনাও। 

— “আপনি এত অস্থির হয়ে যাচ্ছেন কেন?” 

— “বুঝবে না নাতাশা। আমি রাজ্যের কাজ ফেলে এসেছি। কোনো প্রশ্ন করো না প্লিজ! আমাকে বলো ওদের গল্পটা। 

— “ওদের গল্পটা যখন শুরু হয় আপু বেশ ছোট। সবেমাত্র গায়ে তখন ওড়না নেয়া শুরু করেছে। এইটের গন্ডি পেরিয়ে নাইনে উঠবে। ডিসেম্বর মাস চলছে। পরীক্ষা শেষে অপেক্ষা করছে রেজাল্টের। আর ভাইয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী। চারমাস বাদে পরীক্ষা দিবে। ভাইয়ারা মাস ছয়েক আগেই আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে এসেছে ভাড়াটিয়া হয়ে। উনাদের পুরোনা বাড়িটা ভেঙে নতুন করে করা হবে তাই পাশের বাড়িতে ভাড়া নেয়া। আর আমাদের তিনতলায় ছিল ভাইয়ার কলেজ বন্ধু নাবিল ভাইয়াদের বাসা। আমাদের খুব পুরোনো ভাড়াটিয়া ছিল উনারা। সে হিসেবে আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি ছিল। বাসায় আসা যাওয়া ছিল। নাবিল ভাইয়ার সঙ্গে ছাদে কত খেলেছি আমরা! তখনকার সময়ে বিকেল হলেই ছাদে মানুষের আনাগোনা থাকতো। এক বাড়ির মানুষদের সঙ্গে অন্য বাড়ির মানুষদের ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প চলতো। একবার হলো কি, ছাদে নাবিল ভাইয়ার সঙ্গে আমরা দুই বোন ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম, সামি ভাইয়া উনার বোনকে নিয়ে ছাদে উঠলো। নাবিল ভাইয়াকে খেলতে দেখে আমাদের ছাদে চলে এল বোন নিয়ে। একটু কাঁচা ছিলাম তাই আমি খেলা থেকে বাদ। পুরো বিকেল জুড়ে ওরা চারজন খেললো। সামি ভাইয়া আর আপু ছিল একই টিমে। সেদিন ওদের প্রথম আলাপ, মোটামুটি একটা সখ্যতা গড়ে উঠা।” 

— “সেদিনই কি নবনী আপু আর ঐ ভাইয়াটার মধ্যে ভালোলাগার ব্যাপারটা শুরু?”

— “আরে নাহ্! সবে তো পরিচয় হলো সেদিন। তারপর থেকে নিয়ম করে ওরা দুই ভাইবোন আসতো আমাদের এখানে। আমরা খেলতাম, গল্প করতাম। মাঝেমধ্যে সুমনা আপু নাস্তা বানিয়ে আনতো।” 

— “সুমনা কে? সামি ভাইয়ার বোন?” 

— “হ্যাঁ। এরমাঝে আম্মু, নানু দুইদিন ছাদে এল। দেখলো ওদের দুই ভাইবোনকে। পরিচিত হলো। সামি ভাইয়ার আম্মুর সঙ্গেও আমাদের পরিচয় হলো। আমরা দুইবোন বাসায় ওদের গল্প করতাম, সুমনা আপুর নুডলস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্রশংসা করতাম। দেখতে দেখতে আমাদের মাঝে বিশাল খাতির জমে গেল। বিকেলে ওদের সঙ্গে খেলতে যাবো এই নিয়ে সারাদিন এক্সাইটেড থাকতাম। ঐ মুহূর্তগুলো এতবেশি সুন্দর ছিল! আমি যেন এখনো সব দেখতে পাই। ছাদের রেলিং ঘেষে কত কত ফুল গাছ, শীতের বিকেল, আমরা সবাই সোয়াটার গায়ে ব্যাডমিন্টন খেলছি, দুই টিমের মাঝে একটা লম্বা নেট টাঙানো, খেলতে খেলতে আমরা ঘেমে গেছি, সোয়েটার খুলে তারে ঝুলিয়ে রাখছি, সামি ভাইয়া আর নাবিল ভাইয়া খেলার ফাঁকে কী যেন বলে উঠে আর আমরা হেসে কুটিকুটি হই, সূর্যটা একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। এতগুলো বছর বাদেও ঐ সময়টা আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। তবে আমাদের সবার আন্তরিকতার মাঝে নবনী আপু আর সামি ভাইয়ার আন্তরিকতা বোধহয় একটু বেশিই ছিল। মানে চোখে পড়ার মতো। ছোট ছিলাম তবে ইঁচড়ে পাকাও ছিলাম। ঐ বয়সে কে কার সঙ্গে লাইন মারতে চাচ্ছে অতটুকু বুঝতাম। নবনী আপুর তরফ থেকে শুরুতে তেমন কিছু ছিল না। তবে সামি ভাইয়াকে খুব কাছের একজন ভাবতে লাগলো। খুব কাছের বন্ধু বলা যেতে পারে। কিন্তু সামি ভাইয়ার হাবভাব ছিল অন্যরকম। বুঝতাম আমি, আপুকে বলেছিলামও। আপু সেই কথা শুনে খুব জোরে আমার কান মলে দিয়েছিল। তারপর আপুর রেজাল্ট হলো, নাইনের ক্লাস শুরু হলো। স্কুলে যাবার সময় প্রায়ই সামি ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হতো। সেই থেকে ভাইয়ার সাথে আব্বুরও পরিচয় হলো। সেই বছর জানুয়ারিতে আপুর বার্থডে এল। প্রতিবার খুব ধুমধাম করে আমাদের দুইবোনের বার্থডে সেলিব্রেট করা হতো। সেইবার জন্মদিনে সামি ভাইয়াদের ফ্যামিলিকে আব্বু আম্মু দাওয়াত করলো। উনারা সবাই এসেছিল পার্টিতে। প্রথমবারের মতো সামি ভাইয়ার আমাদের বাসায় আসা। সেদিনের পর থেকে দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বাড়লো, বাসায় নিয়মিত আম্মু আর আন্টির যাতায়াত শুরু হলো। এভাবেই চলছিলো সময়গুলো। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আমরা হঠাৎ গ্রামে যাই। আম্মুর ছোট চাচা মারা গিয়েছিলেন। খবর আসা মাত্র ব্যাগ গুছিয়ে আমরা সব নানুবাড়িতে চলে গেলাম। ফিরলাম চারদিন পর। সেদিনই নাবিল ভাইয়া এসে বলে গেল সাড়ে তিনটায় যেন আপু ছাদে চলে আসে। জরুরি কথা আছে। ঠিক সাড়ে তিনটায় আপু আর আমি চলে গেলাম ছাদে। গিয়ে দেখি নাবিল ভাইয়া আর সামি ভাইয়া বাসার ছাদে। আপুকে দেখামাত্রই নাবিল ভাইয়া ছাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। সামি ভাইয়াকে তাড়া দিতে লাগলো, জলদি কর। কে কখন দেখে ফেলে ঠিক নেই! সামি ভাইয়াও ঝট করে আপুর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো। একটা বাটি তার উপর সাদা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললো, তোমাকে আমি খুব মিস করেছি। একবার বলে গেলে পারতে। যাই হোক, এটা রাখো। নুডলস আছে, খেয়ে নিও। চিঠিটা চাইলে বাসায় গিয়ে পড়তে পারো। এখনও পড়লে হয়। তোমার খুশি। আর হ্যাঁ, আই লাভ ইউ।” 

— “বাহ্! প্রপোজালটা কিউট ছিল তো।”

মুখ কুঁচকালো অমিত। 

— “এখনই কিউট কিউট করিস না অনি। আমারও তেমনই মনে হয়েছিল। সেই কিউটনেস এখন বিষের মতো লাগছে।’ 

— “এভাবে বলছেন কেন ভাইয়া?” 

— “বলছি, আগে তুমি শেষ করো।”

— “আপু তখনও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। একছুটে বক্স আর চিঠি নিয়ে বাসায় চলে এল। দরজা আটকে চিঠিটা আমিই খুললাম। চমৎকার হ্যান্ডরাইটিং ছিল ভাইয়ার। টানা টানা অক্ষরে লেখা ছিল, 

সবাই ফুল দিয়ে প্রপোজ করে। আমি করলাম নুডলস দিয়ে। তুমি পছন্দ কর যে! তাই। আমি রান্না বান্না কিচ্ছু পারি না। ভাতও ঠিকঠাক রাঁধতে জানি না। তবে আজ রেস্টুরেন্ট স্টাইলে নুডলস রান্না করেছি শুধুমাত্র তোমার জন্য। তুমি আমার ভীষণ প্রিয় নবনী। মাঝে চারদিন আমাদের দেখা হয়নি, কথা হয়নি আমি কিন্তু খুব কষ্ট পেয়েছি। তুমি চলে যাওয়ার পর বুঝেছি তোমার সঙ্গে রোজ কথা না হলে আমার একদম চলবে না। ছোটবেলায় একবার নাটকে দেখেছিলাম নায়ক নায়িকাকে রোদ্দুর বলে ডাকছে। সেই থেকে আমার মাথায়ও গেঁথে গেল আমিও যাকে ভালোবাসবো তাকে রোদ্দুর ডাকবো। তোমাকে আমার রোদ্দুর ডাকতে ইচ্ছে হয় নবনী। তার মানে দাঁড়ালো তুমি শুধু আমার প্রিয় না, এরচেয়ে বেশি কিছু। তুমি আমার প্রিয় থেকে প্রেমিকা হয়ে যাও প্লিজ! তারপর শুধু নুডলস কেন তোমার সব প্রিয় খাবারগুলো আমি শিখে নেবো। তোমাকে রেঁধে খাওয়াবো। তোমার পারসোনাল বাবুর্চি হয়ে যাবো আমি। না করো না নবনী। রাজি হয়ে যাও প্লিজ! সে ইয়েস!”

— “তারপর? আপু হ্যাঁ বলেনি?” 

— “বলেছিল। আপু তখন আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রথম প্রপোজাল পেলে সবার যা হয় আরকি! একে তো আগে থেকেই সামি ভাইয়ার বিশাল ফ্যান ছিল আপু। তার উপর এত মিষ্টি করে প্রপোজ করলো। আপু সত্যিই ভেবে নিলো ভাইয়া ওর জন্য শেফ হয়ে যাবে। ঐ বয়সে আকাশ কুসুম ভাবনা যেমনটা হয়! প্রেমিক যা বলবে তাই-ই হলো কিশোরী প্রেমিকার কাছে ধ্রুব সত্য। আপু তখন গলে শেষ! শুধু যে মুগ্ধতা কাজ করছিল কিংবা প্রেম প্রেম পাচ্ছিলো তা না। লজ্জা আর ভয়ও ছিল। লোকে জানলে কী হবে? আব্বু-আম্মু জানলে কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে? নাবিল ভাইয়া সব জানে। ওর সামনে এখন থেকে কী করে দাঁড়াবে? আর সামি ভাইয়া, ওর সঙ্গে সম্পর্কটা আজ থেকে বদলে যাবে না? প্রিয় মানুষের সামনে দাঁড়ানো খুব সহজ। কিন্তু প্রেমের শুরুর দিনগুলোতে প্রেমিকের সামনে দাঁড়ানো লজ্জাই বটে!”

অবাক হলো অমিত। 

— “তাই? কই আমার তো কখনো লজ্জা লাগেনি, মুনিয়ারও না। প্রথমদিন থেকে ও নিজ থেকেই আমার হাত ধরতো, চোখে চোখ রেখে কথা বলতো।

— “বয়সের একটা ব্যাপার আছে না? আপু তখন বেশ ছোট। আর সময়ের ব্যবধানও আছে। আপুর গল্পটা ১৫-১৬ বছর আগের আর আপনার চারবছর। পুরো একযুগ ব্যবধান। এই একযুগে পৃথিবী আর মানুষজন কত বদলে গেল! শুনলাম আপনার নাকি আবার প্যাঁচআপ হয়েছে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে?” 

— “কে বললো? নবনী?” 

— “হুম।” 

— “নাহ্ তেমন কিছু না। তুমি নবনীর কথা বলো।

— “আপু লজ্জায় সামি ভাইয়ার সামনেই দুইদিন যায়নি। ভাইয়ারও তখন কলেজ বন্ধ। একমাস পর পরীক্ষা। সকাল বেলায় দেখা হতো না। সারাদিন বাসায় বসে পড়তো। বিকেলে বের হতো আপুর সঙ্গে দেখা করতে। পরপর দুইদিন আপুকে দেখতে না পেয়ে সামি ভাইয়া ধরেই নিলো আপু উনাকে ফিরিয়ে দিবে। পরীক্ষার আগ মুহূর্তে এসে কান্নাকাটি, মন খারাপ করে পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া সব ছেড়ে দিলো। আংকেল আন্টি ভেবেছিল তাদের ছেলে পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় এমন করছে। কিন্তু সুমনা আপু সন্দেহ করছিল। আপু আর সামি ভাইয়ার ব্যাপারটা ওর চোখ এড়ায়নি। তবে মুখোমুখি কখনো কিছু জানতেও চায়নি। সামনে পরীক্ষা, এমন সময় ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললো নবনী আপুকে নিয়ে কোনো সমস্যা নাকি। ভাইয়াও কিছু লুকায়নি। গড়গড় করে বলে দিলো সব। আপু পরদিন দুপুরেই কেক নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির। ঘরে ঢুকেই মায়ের হাতে বক্স দিয়ে বললো, আন্টি কেক বানিয়েছি। ওদের কখনো আমার হাতের কেক খাওয়াইনি, তাই নিয়ে এলাম ওদের জন্য। আমাদের দুই বোনকে সুমনা আপু এত প্যাম্পার করে এই নিয়ে মা বেজায় খুশি। বন্ডিংটাও একদম আপন খালা ভাগনির মতই ছিল। মা আর নানুর সঙ্গে টুকটাক গল্প করে চলে এল আমাদের রুমে। খুব নিচু গলায় আপুকে বললো, সামি তিনদিন আগে কিছু বলেছিল। তুমি এখনো ওকে কিছু জানাওনি কেন? আপু লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাচ্ছিল। যেই সুমনা আপুর সঙ্গে ও রাজ্যের গল্প করতো সেই আপুর দিকে ও চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছিল না। সুমনা আপু ওকে কাছে টেনে বসালো নিজের পাশে। বললো, ভয় কিংবা লজ্জার কিছু নেই। আমি তোমার বন্ধুর মতই। নির্দ্বিধায় বলে ফেলো তো তুমি কী চাও?” 

চোখ বড় করে নাতাশার দিকে চেয়ে রইলো অনি। মুখে হাত চেপে বললো, 

— “ও মা! বড় বোন চলে এল ভাইয়ের পুঁচকে প্রেমিকার সম্মতি আছে কি না জানতে! অন্যসব বোন হলে কানের নিচে টাস করে লাগিয়ে দিতো। আমি এতবড় হয়েছি অথচ এখনো ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলার সাহস হবে না আমার কোনো ছেলেকে ভালো লেগেছে। কী জোস বোন পেয়েছে সামি ভাইয়া!”

— “ভাইয়ার ফুল ফ্যামিলিটাই জোস। খুব লিবারেল মাইন্ডেড।” 

— “তারপর? নবনী আপু বলেছিল উনাকে?” 

— “আপু আমতা আমতা করেই যাচ্ছে। আমার বিরক্ত লাগছিল। আমিই সুমনা আপকে বলে দিলাম, আপু ভাইয়ার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করেছে। কিন্তু লজ্জায় তোমাকে কিছু বলতেও পারছে না, ছাদেও যাচ্ছে না। সুমনা আপু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আপুকে পারে না সে কোলেই তুলে ফেলে। গাল টেনে, মাথায় আদর করে খুব রিকুয়েষ্ট করলো, আমাকে বলার দরকার নেই। কিন্তু তুমি এই কথাটা আমার ভাইকে বলবে, আজ বিকেলেই বলবে। ওর সামনে পরীক্ষা। তোমার টেনশনে ও সব ছেড়ে দিয়ে সারাদিন বাপ্পারাজ হয়ে ঘুরে। এমন করলে পরীক্ষায় ডাব্বা মারবে না বলো? তুমি চাও আমার ভাইটা ডাব্বা মারুক? জবাবে আপু বলল, না আপু। সুমনা আপু বলল, তাহলে চলে এসো ছাদে। আমি ওকে নিয়ে আসবো বিকেলে, কেমন? সেদিন বিকেলে আপুকে আমি বলে টলে পিংক কালার সালোয়ার কামিজ পরালাম, চোখে একটু কাজল দিতে বললাম।” 

নাতাশার কথার মাঝে জোরে হেসে উঠলো অমিত আর অনি। ওদের হাসির কারণ বুঝতে বাকি রইলো না নাতাশার। সেও তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো। নাতাশার মাথায় চাটি মেরে অমিত বললো, 

— “হাফপ্যান্ট পরে গাছে ঝোলার বয়সে বোনকে শেখাচ্ছো কিভাবে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। কপাল!” 

— “আমরা দুইজন কঠিনরকমে ইঁচড়ে পাকা ছিলাম। সব নানু আর মায়ের দোষ। আমাদের সামনে বসে প্রেমের সিনেমা দেখতো। তখন প্রেম ব্যাপারটা কী যে ইন্টারেস্টিং লাগতো! আমি আর আপু প্রেমের প্রতিটা ধাপ প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। বিশেষ করে আমি একটু বেশিই পেঁকে গিয়েছিলাম। আমাদেরই বা কী দোষ বলুন? যা দেখবো তাই তো শিখবো।” 

— “চাচী আর নানুকে ফাঁসাতে হবে না। এবার আপনি গল্পে ফিরে যান।” 

— “তারপর আরকি! আপু সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস হয়ে ছাদে গেল। সামি ভাইয়া বিরহে প্রায় দেবদাস। আপু ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে বললো, তুমি গতকাল যেটা জিজ্ঞেস করলে সেটার জবাব হলো “হুম”। সামি ভাইয়া বলল, হুম? হুম কী? আপু বলল, ধুর ভাইয়া! বোঝেন না কেন? ভাইয়া হেসে বলল, কী বললে? হ্যাঁ? আপু লাজুক স্বরে বলল, ঐ তো সেটাই। ভাইয়া বলল, তো স্পষ্ট করে বলো? আমি পেছন থেকে অনবরত আপুকে চিমটি কাটছিলাম, আপু আই লাভ ইউ বল, আপু আই লাভ ইউ বল। ওদিক থেকে সুমনা আপুও বারবার বলছিল, সুন্দর করে বলো নবনী। আমাদের পীড়াপীড়িতে আপু আই লাভ ইউ বলেই দৌড়।” 

— “আর সেই থেকে নবনী আপুর লাভ স্টোরি শুরু?” 

— “হ্যাঁ। দীর্ঘ আট বছরের অসাধারণ একটা গল্পের শুরু হয়েছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আমাদের বাসার ছাদ থেকে। নবনী আপুর ১৪ বছরের কিশোরী থেকে ২২ বছরের যুবতী হয়ে উঠা, এইচএসসি ক্যান্ডিডেট সামি ভাইয়ার এম বি এ শেষ করে ব্যবসায়ী হয়ে উঠা, দুই পরিবারের অসাধারণ একটা বন্ডিং তৈরী হওয়া, পুত্র সন্তানহীন শফিক-নীতু দম্পতির সামিকে ছেলে হিসেবে পাওয়া, আমাদের হাসি আনন্দ, মায়া, দু’জনের মিষ্টি একটা প্রেম, ওদের দু’জনকে নিয়ে আমাদের কত কত স্বপ্ন দেখা, আরো কত কী! কী না ছিল এই আটবছরে! প্রাপ্তির ঝুলি বিশাল ছিল। সবচেয়ে বেশি ছিল সুখ, পূর্ণতা।

— “দুই পরিবার কবে জানলো ওদের কথা?” 

— “একবছর পর। ঐ একবছরে ছাদে, রাস্তায় কিংবা দুই পরিবারের যে কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াতে আপু আর ভাইয়ার দেখা হতো। নানুর ফোনে লুকিয়ে প্রতিদিন পাঁচ সাত মিনিট কথা চলতো। আর প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে সারারাত জেগে চলতো ওদের ফোনালাপ। কোনো পার্টিতে কিংবা বেড়াতে গেলে আপুর কাছে ভাইয়া সবসময় জিজ্ঞেস করতো, কোন শার্টটা পরবো? রিলেশনের পর থেকে ভাইয়া কখনো আপুকে না জিজ্ঞেস করে কিছু পরেনি। ভাইয়া তার কথা রেখেছিল। এইচএসসি পরীক্ষার পর সত্যিই রান্নায় মন দিলো। আপুর সমস্ত প্রিয় খাবারগুলো শিখে নিলো। প্রায়ই আপুর জন্য এটা সেটা রান্না করে ছাদে নিয়ে আসতো। কখনো বাসায়ও চলে আসতো সুমনা আপু বা আন্টিকে নিয়ে। আমার বাসার লোকজন ধীরে ধীরে উনার ফ্যান হয়ে গেল। পরিস্থিতি গড়ালো এমন, আমার মা কোথাও বেড়াতে গেলেও সামি ভাইয়ার গল্প জুড়ে বসতো। বলতো, কী লক্ষ্মী ছেলেটা! এমন একটা বাচ্চা আমার সংসারে কেন এল না? বাবাও একই কথা বলতো। নানী তো মাঝেমধ্যে উনাকে ডেকেও পাঠাতো গল্প করবে বলে। খুব গল্প করতে জানতো ভাইয়া। বড় ছোট যে কারো সঙ্গে মিশে যেতে পারতো মুহূর্তেই। সামি ভাইয়া আপনার সঙ্গে বসে আছে আর আপনি বোর হবেন কিংবা মন খারাপ করে থাকবেন এটা হতেই পারে না। বয়স হলে মানুষ গল্প করতে চায়। নানীও ব্যতিক্রম ছিল না। সেই সুবাদে সামি ভাইয়ার সঙ্গে নানীর অন্তরঙ্গতা ছিল অন্যরকম। প্রতিটা মানুষের নাকি ত্রুটি থাকে। সামি ভাইয়ার কোনো ত্রুটি ছিল না। সুইট একটা চেহারা ছিল, স্টুডেন্ট ভালো ছিল, আর মানুষ হিসেবে আর কী বলবো? উনার আসলে কোনো তুলনা হয় না। কেউ মন খারাপ করে বসে আছে? নিজের সময় নষ্ট করে তার মন ভালো করে দিবে। কেউ টাকার কষ্টে আছে? নিজের সেভিংস থেকে টাকা দিয়ে দিবে। কেউ বিপদে পড়েছে? সবার আগে আগে উনি ছুটে যাবে। সদা সর্বদা হাসিখুশি একটা মানুষ যার কাছে তার পরিবারই সব। পরিবার বলতে শুধু নিজের মা বাবা তা কিন্তু না! পরিবার হলো আত্নীয়স্বজন সবাই মিলে যা হয়। নিজের পরিবার, প্রেমিকার পরিবারে উনি ছিলেন সবচেয়ে আলোচিত, বিখ্যাত এবং বুড়ো কচি নির্বিশেষে সবার প্রিয় একটা মানুষ।” 

— “আচ্ছা আপু? তোমাদের রিলেটিভরাও জানতো?” 

— “হ্যাঁ জানতো। সর্বপ্রথম আপু আর ভাইয়ার ব্যাপারটা টের পেল নানী। প্ৰায় বছরখানেক পর হঠাৎ একদিন সামি ভাইয়াকে নানু জিজ্ঞেস করে বসলো, তোমার লগে আমার বড় নাতিনের কিছু চলতাছে তাই না? দুইমাস ধইরা খুব চোখে পড়তাছে আমার। ভাইয়া অস্বীকার করেনি। উনি জানতেন নানী কখনোই আপত্তি করবে না। নানী করেওনি। হাসিমুখে শুধু বলেছিল, আমার মাইয়্যার মনে মনে খুব ইচ্ছা ছিল তোমারে নবনীর জামাই বানাইবো। কিন্তু মনে মনে একটা ভয়ও আছিলো। তোমার অন্যকারো লগে প্রেম থাকতে পারে নয়তো অন্য কাউরে মন দিয়া বসতে পারে। যাক বাবা! মাইয়্যার ইচ্ছা খোদায় কবুল করছে। আমার মাইয়্যা খুব খুশি হইবো জানলে।” 

— “তারপর দুই পরিবার জেনে গেল?” 

— “পরিবার বলতে শুধু দুই বাসার লোকজন। তার বাইরে কেউ না। নানী জানালো আম্মু আব্বুকে। আম্মু জানালো সামি ভাইয়ার বাসায়।” 

— “রিএ্যাক্ট কেমন ছিল উনাদের?” 

— “খুশি! তুমি যা চাইছো তা পেয়ে গেলে খুশি হবে না? আর সামি ভাইয়ার মতো একটা ছেলের সঙ্গে কোন মা বিয়ে দিতে না চাইবে?” 

— “আর ভাইয়ার মা বাবা? উনারা পছন্দ করতেন আপুকে?” 

— “এখন যেই নবনীকে দেখছো তার সম্পূর্ণ উল্টো ছিল তখন। পড়া, খাওয়া আর প্রেম ছাড়া কিছুই জানতো না সে। মোটু গোলগাল ছিল। কোনো কাজ করতে চাইতো না, শিখতেও চাইতো না। বিছানাটা পর্যন্ত গুছিয়ে রাখতো না। বিছানা, ওর পড়ার টেবিল, ওয়্যারড্রব সব আমি গোছগাছ করতাম। তবুও আন্টি আর আংকেল কেন যেন ওকে খুব আহ্লাদ করতো। ওর ফোলা গাল দু’টো আন্টি সুযোগ পেলেই টেনে দিতো আর বলতো একেবারে বাসায় চলে আসো। সারাদিন তোমার গাল টানবো।” 

— “তার মানে উনাদের তরফ থেকেও কোনো আপত্তি ছিল না?” 

— “একদম না! দুই পরিবারের সম্পর্ক আরো সুন্দর হলো। অঘোষিতভাবে ওদের বিয়ের সময়টা ঠিক হয়ে রইলো। তবে একটা ব্যাপার কি জানেন ভাইয়া?

পরিবারের আস্কারা পেয়েও ওরা কখনো ওদের লিমিট ক্রস করেনি। আগে যেভাবে প্রেম করতো সেভাবেই লুকিয়ে চলতে থাকলো। আপু ইন্টারের গন্ডি পেরোবার পর শুরু হলো দুই পরিবারের নড়েচড়ে বসা। ওদের বিয়ে, সংসারের প্রিপারেশন তখন থেকেই শুরু। ভাইয়া তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। আংকেল একটু একটু করে ভাইয়াকে বিজনেসে ইনভলভ করতে থাকলো। আপুকে আম্মু আর নানু মিলে রান্না, সেলাই, মেহমান আপ্যায়ন শেখাতে লাগলো। সংসারে কিভাবে মানিয়ে চলতে হয় দুই মা তাদের ছেলেমেয়েকে দিনরাত শেখাতো। ঐ বাড়ির যেকোনো অনুষ্ঠানে আমার মা বাবার পরামর্শ নেয়া হতো। আমাদের বাসার অনুষ্ঠানের বেলায়ও তাই হতো। সুমনা আপুর বিয়ের সময় ভাইয়ার রিলেটিভদের চোখে পড়লো ব্যাপারটা। নিজের রক্তের আত্নীয়স্বজন রেখে বাইরের অপরিচিত দুইজনের মতামতকে খুব প্রায়োরিটি দেয়া হচ্ছে সেই ব্যাপারটা চোখ এড়ালো না কারো। কানাঘুষা শুরু হলো আর তখনই আংকেল আন্টি সবাইকে জানিয়ে দিলো আমার ছেলের হবু শ্বশুর-শাশুড়ি উনারা। তখন থেকে ঐ বাড়ির প্রত্যেকে আপু ভাইয়ার ব্যাপারটা জানে। তারপর আমার বাবাও কিছু লুকায়নি। কথার ছলে আমার চাচা, মামাদের জানালো। উনাদের কাছে শুনে শুনে পুরো পরিবার জেনে গেল। আর সেই থেকে সামি ভাইয়ার সঙ্গে আমাদের আত্মীয়স্বজনদের খুব ভাব জমে গেল। শুরুতে যারা ছেলে কালো বলে নাক সিটকে ছিল, সেই মানুষগুলোই সামি ভাইয়ার অন্ধভক্ত হয়ে গেল। আর কাজিনদের মাঝে সামি ভাইয়ার ক্রেইজ ছিল অন্যরকম। প্রতি ঈদে সামি ভাইয়ার সঙ্গে সবার একটা আড্ডা হওয়া চাই-ই চাই। কাজিনদের মধ্যে যেই ছেলেটা কথা সবচেয়ে কম বলতো সেই ছেলেটাও ঐ আড্ডা মিস করতো না। ঈদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় দিন দলবেঁধে সবাই চলে যেতাম কোথাও বেড়াতে কিংবা সামি ভাইয়ার বাসায়। যার যত সিক্রেট কথা ছিল সব ভাইয়া জানতো। আমরা ভুল হলে সঠিক পথটা দেখাতো, সঠিক হলে এগিয়ে যেতে ইন্সপায়ার করতো। তবে আমার মামার বাড়ির লোকজন একটু বেশিই ভক্ত ছিল উনার। বড় মামা এক কথার মানুষ। উনার ছোট মেয়েটার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর জানা গেল তার এ্যাফেয়ার আছে। সেই নিয়ে বাড়িতে বাপ বেটির মাঝে তুমুল দ্বন্দ্ব। মামা পাত্রপক্ষকে কথা দিয়েছে, উনি আর পিছু হটবে না। ওদিকে আপুও নাছোরবান্দা, প্রেমিককে ছাড়বে না। আপু আর মামাকে সামলাতে গিয়ে আমার মা খালারা পুরো নাজেহাল তখন সামি ভাইয়া কিভাবে যেন মামাকে ম্যানেজ করে ফেললো। দরজা আটকে বাপ বেটিকে কী বললো কে জানে! মামা শান্ত হলো, আপু মামার কাছে ক্ষমা চাইলো। পাত্রপক্ষের বাড়িতে মামা সামি ভাইয়াকে নিয়েই গেল কথা বলতে। মুরুব্বি আর কাউকে নিয়ে যায়নি সঙ্গে। একটা আস্থা তৈরী হয়ে গিয়েছিল ভাইয়ার উপর। মামা প্রায়ই বলতো, ওর মাঝে আমি আমার আব্বার ছায়া দেখতে পাই। তারপর তো সব ঝামেলা মিটে গিয়ে আপুর প্রেমিকের সঙ্গেই বিয়ে হলো। কাজিনরাও সেই থেকে ভাইয়ার নাম দিলো “প্রেম নৌকার মাঝি”। বলতো, মাঝি ভাই আমাদের যখন সময় হবে তখন আপনাকেই কিন্তু আমাদের নৌকা আব্বু আম্মুর ঘাটে পৌঁছাতে হবে।”

— “দুই পরিবারের কথা তো বললে। এবার যাদের নিয়ে গল্প, তাদের কেমিস্ট্রি নিয়ে কিছু বলো।” 

— “আপু আর ভাইয়ার সম্পর্কের গভীরতা কখনো মুখে বলে এক্সপ্লেইন করা পসিবল না। তুমি নিজ চোখে দেখলে হয়তো ফিল করতে পারতে।” 

— “তুমি তো দেখেছো?” 

— “হ্যাঁ। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই আমার নিজ চোখে দেখা। যতটা কাছ থেকে আমি ওদের দেখেছি ততটা কাছ থেকে কেউ দেখেনি।” 

— “যা দেখেছো তা থেকেই একটু আধটু বলো না!” 

— “সবার থেকে ওদের সম্পর্কটা আলাদা ছিল জানো? সবাই বলে পিওর লাভ নাকি আজকাল এক্সিস্ট করে না। কথাটা ভুল। পিওর লাভ এক্সিস্ট করে। ওদের দু’জনের মাঝে ছিল সেই ভালোবাসা। আপুকে একটুখানি চোখের দেখার জন্য যতটা ছটফট আমি ভাইয়াকে করতে দেখেছি ততটা অস্থিরতা কখনো আপুকে স্পর্শ করার জন্য দেখিনি। রিলেশনের মাস ছয়েকের মধ্যে কিস আর বছর দেড় দুয়েকের মাঝে ফিজিক্যাল রিলেশনে যাওয়া খুবই কমন। কিন্তু ভাইয়া কিংবা আপুকে কখনো দেখিনি ওসবে জড়াতে। আটবছর লম্বা সময় ছিল। এতবছরে লোকজন প্রেম করে, সময় সুযোগ পেলেই ইন্টিমেট হয়, আবার ব্রেকআপও হয়ে যায়। ভাইয়ার সঙ্গে বাইরে মিট করতে গেলে সবচেয়ে বেশি থাকতাম আমি। আপুর হাত ধরা, কাঁধ জড়িয়ে হাঁটা ছাড়া আর কিছু কখনো দেখিনি ওদের মাঝে। তবে হ্যাঁ, প্রতি জন্মদিনে আপুর কপালে একটা চুমু ভাইয়া অবশ্যই দিতো। আর ভাইয়ার জন্মদিনে আপু চুমু দিতো উনার গালে। সবাই যখন একটু নিরিবিলিতে, রেস্টুরেন্টের কর্নার টেবিলে বসে কিংবা পার্কের সবচেয়ে নির্জন জায়গাটা খুঁজে বের করতো প্রেম করার জন্য, ওরা দু’জন প্রেম করতো হুড খোলা রিকশায়, শিশু পার্কে, শাহাবাগের রাস্তায়, পুরান ঢাকার রেস্তোরাঁয়।”

— “নবনীও বলেছিল আমাকে কথাটা। তখন শুনে মনে হয়েছিল মানুষ তো না, যেন সাধু সন্ন্যাসী! আট বছরের রিলেশনে এত কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সামলে নিলো কিভাবে? পরে আবার মনে হলো, হতেই পারে এমন। সবার ভালোবাসার ধরণটা কিন্তু সমান হয় না।” 

— “বললাম না! ওদের গল্পটা একদম ভিন্ন ছিল। তখন রিয়েলাইজ করেছিলাম মনের অনুভূতি, মায়া যখন শরীরের অনুভূতি, কামনা বাসনা ছাপিয়ে যায় তখনই ভালোবাসায় হেভেনলি ব্লিস ফিল করতে পারবেন। সেই ভালোবাসাটাকে মনে হবে গড গিফটেড। বলছি না পার্টনারের প্রতি ফিজিক্যাল এ্যাট্র্যাকশান থাকার অর্থ সেই কাপলের মাঝে ভালোবাসা নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু আপু আর ভাইয়ার মাঝে যা ছিল তা খুব রেয়ার। পৃথিবীটা ঘুরে হয়তো গুটি কয়েকজনের মাঝে এমনটা পাবেন। আপু ছোটবেলা থেকেই গোলগাল ছিল। ইন্টারের পর হঠাৎ ওজন আরো বেড়ে গেল। ৮৪-৮৫ এর মধ্যে আপডাউন করতো সবসময়। সামি ভাইয়া কখনো বলেনি নবনী তুমি মোটা হয়ে যাচ্ছো কিংবা নবনী স্লিম হও। আপু অসুস্থ হয়ে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও ভাইয়া ডাকতো এ্যাই সুন্দরী, আবার বাসায় পুরোনো কাপড়, তেল দেয়া চুল, ঘামে ভেজা মুখ দেখেও বলতো এ্যাই সুন্দরী। কখনো ভাইয়ার চোখে আপুর জন্য তিল পরিমান বিরক্তি দেখিনি, রাগ দেখিনি। যতবার আপুকে উনি দেখতো আমি উনার চোখে শুধু মুগ্ধতাই দেখতাম। এতগুলো বছরে ওরা কখনো মুখোমুখি বসে ঝগড়া করেনি, কেউ কখনো গলা উঁচিয়ে কথা বলেনি, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি। ঝগড়া যা হতো সব ঐ ফোনে ফোনেই। ঘন্টা দুয়েক পরই শুনতাম আবার কল করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। বাইরে লাঞ্চ করতে চলে যাচ্ছে। যেদিন ঝগড়া হতো সেদিন দু’জনের বাইরে ঘুরে বেড়ানো হতো লম্বা সময় ধরে। আপুর ছোট ছোট প্রত্যেকটা ব্যাপার ভাইয়া বুঝতো। মুখ দেখে বলে দিতে পারতো নবনী এই মুহূর্তে এটা চাইছে। আপু যখন রেগে যায় তখন আমরা ওকে জড়িয়ে ধরি। আপু আর রাগ ধরে রাখতে পারে না। একবার কী নিয়ে যেন আপু খুব রেগে গেল। ভাইয়া আপুকে জড়িয়ে ধরতেই আপু ঠান্ডা। ভাইয়ার দেখাদেখি আমরা ওকে জড়িয়ে ধরি। আগলে আগলে রাখতো সবসময়। তাই বলে অন্যসব প্রেমিকদের মতো বলতো না, নবনী বৃষ্টিতে ভিজো না, নবনী আইসক্রিম খেও না, এটা করো না, ওটা করো না। আপুর সবকিছুতে ভাইয়ার হ্যাঁ ছিল। সেই সঙ্গে ঝামেলা এড়াতে সলিউশনও ছিল। যেমন ধরুন, বৃষ্টিতে ভেজার পর ভাইয়া বলতো রসুন সরিষার তেল মালিশ করে ফেলো। আইসক্রিম খাওয়ার পর বলতো এককাপ আদা চা খেয়ে নিও। কখনো কখনো ওর চুল বেঁধে দিতো। টিপ বাঁকা পরা আপুর আজনমের বদঅভ্যেস। ওর বাঁকা টিপটা সবসময় ঠিক করে দিতো ভাইয়া। কখনো যদি মা কিংবা আমি ঠিক করতে চাইতাম খুব রেগে যেত। বলতো, সামি ঠিক করে দিবে। সাধারণত ছেলেরা মার্কেটে ঘুরাঘুরি পছন্দ করে না। কিন্তু এই একটা মানুষের মাঝে আমি কখনো বিরক্তি দেখিনি। বরং আপুর জিনিস কেনার বেলায় সবচেয়ে বেশি খোঁজাখুঁজি করতো ভাইয়া। আপু ইন্টারে উঠার পর থেকে ঈদ, পহেলা বৈশাখ, ফাল্গুনের শপিং ভাইয়াকে সঙ্গে নিয়েই করতো। আমাদের দুইবোনের যত ড্রেস আর কানের দুল ছিল সব ভাইয়ার পছন্দে কেনা। দুই চারটা মার্কেট খুঁজে সবচাইতে সুন্দর জিনিসটা বের করতো আমাদের দুই বোনের জন্য। ভাইয়ার উপর আপু খুব ডিপেন্ডেড ছিল। সবকিছুতেই শুধু ভাইয়াকে খুঁজতো। দুজন ছিল দুজনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দুইজন মানুষকে আমরা কখনো স্বপ্নেও আলাদা ভাবতে পারিনি। অথচ মাত্র আট বছরেই ওদের জার্নিটা শেষ হয়ে গেল। চিরতরে আমার বোনটা ভাইয়ার কাছ থেকে আলাদা হলো।” 

— “এতদিন শুধু শুনেই এসেছি নবনী আপুর একটা প্রেমিক ছিল। সে মারা গেছে। কখনো ওভাবে ফিল করিনি ব্যাপারটা। এখন খুব মন খারাপ হচ্ছে জানো? বিশ্বাস হচ্ছে না উনি নেই। মনে হচ্ছে উনি আছে, আমার পাশেই বসে আছে। এত ভালো মানুষটা মারা গেল কিভাবে আপু?” 

— “আপুর থার্ড ইয়ার ফাইনালের পর আব্বু আর আংকেল ডিসিশন নিলো ওদের এনগেজমেন্ট সেরে ফেলবে। মাস্টার্স শেষ হলেই বিয়ে। ভাইয়াও ততদিনে আংকেলের বিজনেসের হাল ধরে ফেলেছে। সেই বছর মার্চের ৩ তারিখে আপু ভাইয়ার এনগেজমেন্ট হলো। বেশ বিয়ের আয়োজনই বলা যায়। দুই পক্ষ মিলিয়ে ২৫০ গেস্ট ইনভাইট করা হলো। ভাইয়ার পছন্দে আপু সাজলো, আপুর পছন্দে ভাইয়া। উনার খুশি ছিলো আকাশছোঁয়া। আমি, ভাইয়া আর সুমনা আপু খুব নেচেছিলাম এনগেজমেন্টের আগেরদিন রাতে। নাচতে নাচতে ভাইয়া আমাকে বলছিল, তোর বোন প্রেমিকা থেকে বউ হয়ে যাচ্ছে। এবার থেকে রাস্তাঘাটে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো, ও নবনী, আমার ওয়াইফ। আমার ভাবতেই কী চমৎকার লাগছে! সবকিছু খুব পার্ফেক্ট ছিল, অসম্ভব রকমের সুন্দর ছিল। আমরা সুখ আর স্বপ্নের মাঝে ডুবে ছিলাম। ভাবতেই পারিনি সামনে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। এনগেজমেন্টের সপ্তাহখানেক পর ভাইয়া একদিন রাত আড়াইটায় বাসায় এল। চুল এলোমেলো, চোখে মুখে আতংক। আমরা সবাই মোটামুটি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম উনাকে এতরাতে এভাবে দেখে। ঘরে ঢুকেই বললো, নবনীকে দেখতে এসেছি। একটু কথা বলবো ওর সঙ্গে। আমরা সবাই ভাবছিলাম ঝগড়া টগড়া হলো নাকি দুজনের? হঠাৎ শুনি ভেতর থেকে ভাইয়া কাঁদতে কাঁদতে আপুকে বলছে নবনী তোমাকে ছাড়া আমি শেষ হয়ে যাবো। আমি বেঁচে থাকতে তুমি অন্য কারো হও কী করে? ভাইয়ার আওয়াজ পেয়ে আমরা সবাই রুমে গেলাম। যেই মানুষটাকে কখনো হাসিমুখ ছাড়া দেখিনি সেই মানুষটা আপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে! এমন কী হয়ে গেল! আম্মু কী বুঝলো কে জানে! আপুকে কত কী বলে বকতে লাগলো। আপু বোকার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আব্বু এসে ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে টুলিয়ে বিছানায় বসালো। নানী ভাইয়ার বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো, কী হইছে গো ভাই? আমার বইন তোমার লগে ঝগড়া করছে? আমাদের সবাইকে স্পিচলেস করে দিয়ে ভাইয়া বললো, স্বপ্নে দেখেছি নবনীর সাজানো ঘর সংসার, একটা বাচ্চা। কিন্তু ওর সংসার আমার সঙ্গে না। অন্য কারো সঙ্গে। খুব আনন্দ করছে ওরা। আর আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দরজা খোলা অথচ শত চেষ্টা করেও আমি ভেতরে যেতে পারছি না। আমি এত করে নবনীকে ডাকছি ও শুনতে পাচ্ছে না। আমরা হাসবো নাকি ভাইয়াকে স্বান্তনা দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সামান্য একটা স্বপ্ন দেখে কেউ এভাবে কাঁদে! পরে আমরা সবাই বুঝিয়ে শুনিয়ে ভাইয়াকে বাসায় পাঠালাম। স্বপ্নের কথা ভুলে গেলাম। কিন্তু ভাইয়া ভুলতেও পারেনি, স্বাভাবিকও হতে পারেনি। সবাইকে দেখাতো খুব চিল মুডে আছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কী যেন ভাইয়াকে সবসময় অস্থির করে রাখতো। আপুকে মাঝেমধ্যে বলতো, নবনী খারাপ কিছু হবে মনে হয়। ভাবতাম খুব ভালোবাসে তাই হয়তো ঐ স্বপ্নের ধাক্কা নিতে পারছে না। ঠিক দুই সপ্তাহ পর ভাইয়া আবার স্বপ্নে দেখলো, আপু চিরতরে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। ভাইয়া খুব দৌড়াচ্ছে আপুর পেছনে কিন্তু কোনোভাবেই আপুর কাছে পৌঁছাতে পারছে না। বেচারা আরো ঘাবড়ে গেল। তার দুইদিন পর আপুর খুব জ্বর হলো। প্যারাসিটামল নেয়ার পর ঘন্টা দু’য়েক ভালো থাকে। তারপর আবার সেই ১০৩-১০৪ জ্বর। ভাইয়া আর আব্বু সেদিনই আপুকে হসপিটালে নিলো। ডক্টর টেস্ট করালো। পরদিন রিপোর্ট হাতে আসতে আসতে আপুর অবস্থা আরো খারাপ। রিপোর্টে এল ডেঙ্গু পজিটিভ। ভাইয়া ভয়ে কেমন আধমরা হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেন আপুর আশপাশে সে আজরাইল দেখতে পাচ্ছে। বারবার শুধু বলছিল আমি দেখেছি নবনী চলে যাচ্ছে। কান্নাকাটি করে কী একটা অবস্থা! উনি ধরেই নিলো আপু মারা যাবে তাই ওসব দেখেছে। সেদিনই আপুকে হসপিটালে এডমিট করা হলো। প্লাটিলেট যতই কমছে ভাইয়ার ভয় তত বাড়ছে। আপুর টেনশনে উনি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। দিনরাত আপুর পাশে বসে থাকতো। বারবার আপুর হাত ধরে বলতো, আমি মরে গেলে যেখানে খুশি যাও, যা খুশি করো। আমি বেঁচে থাকতে কোত্থাও যাওয়া যাবে না। তুমি নেই, এই যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারবো না। উন্মাদের মতো আচরণ করছিলো উনি। আমরা আপুকে দেখবো নাকি ভাইয়াকে সামলাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এমনকি আপু নিজেও শুয়ে শুয়ে ভাইয়াকে স্বান্তনা দিতো আমি সুস্থ হয়ে যাচ্ছি। এইতো আর দুইটাদিন। আপুকে বাসায় আনার এক সপ্তাহ পরই ভাইয়া জেদ ধরলো নবনীকে বিয়ে করবো, এক মাসের মধ্যে করবো। দুই পরিবার খুব একটা আপত্তি করেনি। ভাইয়ার মানসিক অবস্থা দেখছিল সবাই। বিয়ের দিন ঠিক করা হলো পহেলা মে। তারিখ ঠিকঠাক হবার পর ভাইয়া অনেকটাই শান্ত হলো। বাসায় তোড়জোড় বিয়ের আয়োজন চলছে। শপিং, ওয়েডিং ভেন্যু, ফটোগ্রাফার, বাবুর্চি গেস্ট এইসব করে বিয়ের তারিখ চলে এল। হাতে আছে মাত্র একসপ্তাহ। ভাইয়া একদিন দুপুরে আপুকে বাসায় ডাকলো। আমি আর আপু গেলাম উনার বাসায়। গিয়ে দেখি কেউ নেই। আংকেল আন্টি রিলেটিভদের দাওয়াত দিতে গেছে। সুমনা আপু তখনও দেশে ফেরেনি। ভাইয়া বাসায় একা। কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে বসে গল্প করলো। তারপর আপুকে ডেকে নিলো নিজের রুমে। প্রথমবার ভাইয়াকে দেখলাম আপুর সঙ্গে আলাদা বসে কথা বলতে চাইছে। কখনো এমন হয়নি। আমার সামনে বসেই ওরা গল্প করতো। একটু অবাক হয়েছিলাম বটে কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুও মনে হয়নি। সপ্তাহ বাদে বিয়ে। একটুখানি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতেই পারে। আধঘন্টা পর আপু বেরিয়ে এল। ওর মনটা খারাপ দেখছিলাম। আমরা ঘর থেকে বেরোতে যাবো তখন দরজায় আপুর হাত টেনে খুব শক্ত করে ভাইয়া বুকে জড়িয়ে রাখলো অনেকটা সময়। আপু কত কী বললেও ভাইয়া কিচ্ছু বলেনি। উনার চোখে পানি ছলছল করছিল। আমার কী মন খারাপ হলো ভাইয়াকে দেখে! এই মানুষটা কিছু একটা নিয়ে কষ্টে আছে কিন্তু আমাদের বোঝাতে পারছে না বা আমরা বুঝতে পারছি না।” 

— “উনি কি কোনো কারণে ডিপ্রেসড ছিলেন? ডিপ্রেশন থেকে কি সুইসাইড?” 

— “সুইসাইড না, বলছি। পরদিন সকাল সকাল আমরা দুই বোন ভাইয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম লাস্ট শপিংগুলো সেরে নিতে। শপিং শেষ হতে হতে দুপুর গড়ালো। বাইরে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলাম। রোড ক্রস করে অন্যপাশে গেলাম ট্যাক্সি নিতে। ট্যাক্সি ঠিকঠাক করার পর আপু বললো ব্যাগ রেস্টুরেন্টে রেখে এসেছি।” 

বলতে বলতেই নাতাশা হঠাৎ থেমে গেল। চোখ ভিজে আসছে তার। লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে সে কাঁপা গলায় বলতে লাগলো, 

— “ভাইয়া গিয়েছিল ব্যাগ আনতে। কী নিয়ে যেন অন্যমনস্ক ছিল উনি। বাস ছুটে আসছিল অথচ উনি খেয়ালই করেনি। আমরাও বুঝিনি ভাইয়া এখনি রাস্তায় পা রাখবে। রোড ডিভাইডার থেকে রাস্তায় নামামাত্র ভাইয়াকে বাসটা পিষে দিলো। মুহূর্তেই রক্তে ভেসে গেল পিচঢালাই রাস্তাটা। আমার বোন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ার দিকে। লোকজন ধরাধরি করে ভাইয়াকে ট্যাক্সিতে তুললো। তখনও উনি বেঁচে ছিল। আমার কোলে উনার মাথা। পা দুটো আপুর কোলে। উনার গায়ের শার্ট, আমার জামা, হাত ভিজে গিয়েছিল রক্তে। এমনভাবে ব্লিডিং হচ্ছিল কোথায় কেটেছে, কোথায় ভেঙেছে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভাইয়া দুইবার হাত বাড়িয়েছিল আপুর দিকে। আপুর তখনও ঘোর কাটেনি। মূর্তির মতো নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল ভাইয়ার দিকে। তারপর আমার হাতটা ধরে বললো, নবনী যেন সুখে থাকে। ওকে আঁকড়ে রাখিস, যত্নে রাখিস। হারিয়ে যেতে দিস না। তারপর দুই মিনিটের মধ্যে ভাইয়া আর নেই। আমার হাতটা শেষবারের মতো শক্ত করে একবার চেপে ধরলো। লম্বা নিঃশ্বাস নিলো। তারপর সব শেষ!” 

দুই ঠোঁট চেপে কাঁদছে নাতাশা। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অনিও। নাতাশার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো অমিত। চোখজুড়ে তার বিষাদের ছায়া। কয়েক মুহূর্ত পর নাতাশার দিকে টিস্যুবক্স এগিয়ে দিলো অমিত। চোখ মুছে নাক টানতে টানতে নাতাশা বললো, 

— “নানী বলে কিছু মানুষ থাকে যারা মারা যাওয়ার আগে টের পায় তার জীবনে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, ভাইয়ারও বোধহয় তেমন কিছুই হয়েছিল। 

— “ও মারা যাওয়ার পর নবনী কিভাবে সামলে নিলো নিজেকে?”

— “কোথায় আর নিলো! এখনও বেঁচে আছে ভাইয়াকে আঁকড়ে ধরেই। ভাইয়া মারা গেছে এই খবরটা আমাকেই কল করে বাসায় জানাতে হয়েছে। আব্বু, ছোট মামা আর আংকেল গিয়ে হসপিটাল থেকে লাশ নিয়ে এল। তারপরের সময়টা না অমিত ভাইয়া কেমন ছিল সেসব মনে পড়লেও আমার নিঃশ্বাস আটকে আসে। মানুষটা শুধু মরেনি, দু’টো পরিবারকে নিঃস্ব করে রেখে গেছে। সুমনা আপুর ফ্লাইট ছিল সেদিন রাতে। উনার ভাই আর নেই এই কথাটা শোনামাত্র উনি প্ল্যান ক্যান্সেল করলো। সাফ জানিয়ে দিলো ভাইয়ের হাসিমুখের স্মৃতিই উনি নিজের কাছে রাখতে চান। তার মরা মুখ দেখার সাহস কিংবা সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াবার মতো সহ্য ক্ষমতা তার নেই। ভাইয়ার লাশ দেখে আন্টি সেন্সলেস হলো। দুইদিন পর্যন্ত জ্ঞান হারাচ্ছে, ফিরছে এই করে কাটালো। আমার নানী বারবার চাদর সরিয়ে ভাইয়ার মুখটা দেখছিল আর বলছিল, চইলা গেলা ভাই তুমি! আমার নাতিনটারে এহন আমি কী করুম কও তো? আম্মু ভাইয়ার লাশের খাটিয়ায় মাথা রেখে বসেছিল। নানীকে কিছুক্ষণ পরপর বলছিল, ওর মুখটা বারবার ঢাকছো কেন আম্মা? খোলা রাখো। আমাকে দেখতে দাও। আর তো কখনো ওকে দেখতে পাবো না। বাবা তখন লাশ কোথায় দাফন হবে, গাড়ি ভাড়া করা, কোথায় কোথায় জানাজা হবে সেসব নিয়ে ব্যস্ত। একটুখানি ভাইয়ার পাশে বসে দুঃখ করবে সেই ফুরসতটুকুও নেই। আর আমার বোন! ভাইয়ার লাশের পাশেই বসে ছিল। আংকেলের কাঁধে মাথা রেখে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল ভাইয়ার লাশটার দিকে। ও কাঁদেনি, একটুও না। কিছু বলেনি। কে কী বলছে তাও হয়তো শোনেনি। যদি জীবন বিনিময় করা যেত, আমি অবশ্যই করতাম। সামি ভাইয়া নেই এই কঠিন কথা মেনে নেবার শক্তি কিংবা দু’টো পরিবারের এভাবে ভেঙে পড়ার দৃশ্য সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। পৃথিবীটা কতখানি অসহ্য হতে পারে, জীবন কতটা নির্মম কষ্টের হতে পারে আমি সেদিনই প্রথমবারের টের পেয়েছিলাম। খুব করে চাইছিলাম ভাইয়ার আত্মাটা কোথাও থেকে খুঁজে এনে শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দেই, নয়তো খোদাকে বলি আমার জীবন তাকে দাও। সশরীরে মানুষটা তখনও আমার সামনে অথচ রূহ নামের অদৃশ্য একটা অংশের অভাবে এই দৃশ্যমান শরীরটাকে আমি জাগাতে পারছি না, তাকে মৃত বলতে হচ্ছে, তাকে কবরে নামানোর প্রস্তুতি চলছে এটা মেনে নেয়ার মতো না। একটু আগেও তো সে ছিল। কিছুক্ষণের ভেতর সে নেই! এই যন্ত্রণা অসীম অমিত ভাইয়া।” 

— “নবনী সামিকে নিয়ে গল্প করে। শুনলে যে কেউ ভাববে সামি জীবিত কোনো মানুষ। ওর দেখা হয়, কথা হয় ওর সঙ্গে।”

— “আপনি এই ব্যাপারটা জানার জন্য কখন থেকে বসে আছেন তা আমি জানি।” 

— “হ্যাঁ, খুব দ্বিধায় আছি।” 

— “ভাইয়ার লাশ জানাজার জন্য নেয়ার আগ মুহূর্তে কে যেন উনার গায়ের শার্ট প্যান্ট আংকেলের কাছে দিলো। আপু সেই শার্ট নিয়ে সোজা চলে গেল উপরে সামি ভাইয়ার বাসায়। আর আসেনি। ভাইয়া চলে যাবার সময়ও না। ঢাকায় জানাজা শেষে গ্রামে লাশ নিয়ে গেল দাফন করবে বলে। আপু সেখানেও যায়নি। রাতে আপুকে নিয়ে আমি আর ছোটমামী বাসায় ফিরলাম। সেই যে আপু নিজের রুমে খাটের এক কোনায় গিয়ে বসলো আর বের হয়নি ঐ ঘর থেকে। কথা বলা একেবারে বন্ধ, খাওয়া দাওয়া বন্ধ, ঘুম নেই। সারাক্ষণ শুধু ভাইয়ার শার্টটা বুকে জড়িয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতো। আপুকে সামলানো কিংবা ওর দিকে খেয়াল দেয়ার মতো অবস্থায় আমরা কেউই ছিলাম না। আম্মু আর আমার বড় মামী থাকতো সামি ভাইয়ার আম্মার সঙ্গে। আমি, আব্বু, ছোট মামী আর নানী থাকতাম আমাদের বাসায়। কেউই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। বাবাও ভাইয়াকে মাটি দিয়ে এসে চুপ হয়ে গেল। কথা বলতো না, সারাক্ষণ নিজের ঘরে শুয়ে বসে থাকতো। রান্না নেই, খাওয়া নেই কারো। দিনরাত শুধু কান্না আর সামি ভাইয়াকে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসা। ভাইয়ার চারদিনের মিলাদে বাসার সবাই গেল। রয়ে গেলাম শুধু আমি আর আপু। সেদিন ওয়াশরুম থেকে বের হবার সময় আপু সেন্সলেস হয়ে গেল। বাসার দারোয়ানের হেল্প নিয়ে ওকে হসপিটালে নিলাম। মানসিক চাপ, পুরো চারদিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে দুর্বল হয়ে গেল খুব। ওকে স্যালাইন পুশ করিয়ে বাসায় নিয়ে এলাম। তারপর থেকে নিজেকে কোনোভাবে সামলে আপুর দিকে খেয়াল রাখা শুরু করলাম। দিনে একবার না দুইবার জোর করে হয়তো মুখে কিছু একটা তুলে দিতাম। ওর সঙ্গে কথা বলতাম। বাইরে নিতে চাইতাম। রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে চাইতাম। ও কোনোকিছুতেই রেসপন্স করতো না। সপ্তাহখানেক পর বাবা গেল অসুস্থ হয়ে। আমার বাবার প্রেশার সবসময় নরমাল ছিল। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর থেকেই বাবার হাই প্রেশারের ঝামেলাটা হলো। নানীরও ডায়বেটিস, প্রেশার সব বাড়তি। কাকে রেখে কাকে দেখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কে কাকে স্বান্তনা দিবো তাও জানতাম না। ছোট মামা-মামী নিজের বাসা বাড়ি ফেলে পড়ে রইলো এখানে আমাদের দেখাশুনা করবে বলে। আম্মু আর আমি পাথর হয়ে ওদের তিনজনকে আগলে রাখতে চাইলাম, পারলাম না। দুনিয়া এলোমেলো লাগে, ভেতর ফেটে কান্না পায়। আমরা চোখে পানি নিয়ে বাবা, আপু, নানীকে বুঝাতাম কেঁদো না। ভাইয়া কষ্ট পাবে। আর আংকেল আন্টির কথা কী বলবো! যেই বাবা-মা নিজের সুস্থ ছেলেটাকে এভাবে হারালো সেই বাবা মায়ের মনের অবস্থা বোঝার মতো ক্ষমতা না আমাদের আছে, না মুখে বলে বোঝানোর মতো ভাষা। আম্মু, বাবা নিয়ম করে ঐ বাসায় যেত। ছোট মামা তিনবেলা খাবার দিয়ে আসতো। কখনো উনাদের জোর করে খাওয়ানো যেত, কখনো না। আমি যেতাম না ঐ বাসায়। আমার সাহস হতো না। ভাইয়া ছাড়া ঐ বাসাটাতে গিয়ে আমি সুস্থভাবে ফিরে আসতে পারবো না এমনটাই মনে হতো। আমাদের মেয়েদের একটা ভালো দিক কি জানেন? আমরা মনের কথা প্রকাশ করতে জানি, মন খুলে কাঁদতে জানি, ভালোবাসা রাগ কষ্ট সব ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করতে জানি। কিন্তু পুরুষ মানুষ যতটা সহজে নিজের রাগ প্রকাশ করতে পারে, কষ্টগুলো অতটা সহজে প্রকাশ করতে জানে না। আমার বাবাও পারেনি নিজের কষ্টগুলো প্রকাশ করতে। ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। বাবার কলিজার টুকরা হলো আমার বোন। ভাইয়া মারা যাবার পর সেই কলিজার টুকরোর সামনে বাবা দাঁড়ায়নি ১৭ দিন। আপুর কথা শুধু জানতে চাইতো আমাদের কাছে। আপুর ঐ অবস্থা নিজ চোখে দেখার সাহস কিংবা আপুকে স্বান্তনা দেবার মতো ভাষা আমার বাবার কাছে ছিল না। থাকার কথাও না। এমন অবস্থায় একটা মেয়েকে কী বলে স্বান্তনা দিবেন আপনি?”

— “নবনী কি একেবারেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল? কিছুই বলতো না?” 

— “না।” 

— “ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওনি?” 

— “আমরাই কথা বলতাম না তেমন। ভেবেছিলাম আপুর জন্য তো এই ট্র্যাজেডি মেনে নেয়া আরো কঠিন। তাই হয়তো কথা বলছে না। চোখের সামনে আপুর এতবড় সমস্যা হয়ে যাচ্ছে কিংবা আপুকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে হবে সেসব মাথাতেই আসেনি তখন। শুধু মাথায় ছিল আপুকে কোনোরকমে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তারপর নাহয় এসব সমস্যা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। 

— “বোকামি হলো খুব।” 

— “হ্যাঁ হলোই তো। সিচুয়েশনটাই তেমন ছিল। ব্রেইন ইউজ করে কোনো স্টেপ নেয়ার মতো অবস্থা কারোই ছিল না।”

— “তারপর নবনী স্বাভাবিক হলো কতদিন পর?” 

— “আটবছর হয়ে গেছে ঐ ঘটনার, আপু আজও সুস্থ হয়নি।” 

— “নবনীর সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম আছে?” 

— “হ্যাঁ। ও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার পেশেন্ট।” 

— “শিট! তারমানে ওর ধারণা সামি বেঁচে আছে?” 

— “বেঁচে আছে ধারণার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। ও জানে পৃথিবীর সবার কাছে ভাইয়া নেই কিন্তু ওর কাছে, ওর জন্যই শুধু ভাইয়া বেঁচে আছে। ফিরে এসেছে ওর কাছে অন্য পৃথিবী থেকে।”

— “বুঝলাম না ঠিক। কবে কিভাবে ফাইন্ড আউট করলে নবনীর সমস্যাটা? একটু ডিটেইল বলো তো আমাকে!” 

— “এক সপ্তাহ যাওয়ার পরও আপু ঘুমাচ্ছিল না। সারারাত বসে থাকতো। তখন মামা বললো ওকে লো পাওয়ার সিডেটিভ দিতে। না ঘুমিয়ে আর কতদিন টিকে থাকবে ও! একদিন পর পর ওকে সিডেটিভ দিতাম। তা খেয়ে তিন চারঘন্টা ঘুমাতো। এভাবে ১৭ দিন চলে যাবার পর একদিন রাতে ঘুমের ঘোরে ওর সিজার অ্যাটাক হলো। আমি আপুর পাশেই ছিলাম। হঠাৎ দেখি ওর খিঁচুনি হচ্ছে। ভাইয়ার ট্রমা তখনো সামলে নিতে পারিনি। সর্বক্ষণ চোখের সামনে দেখতাম ভাইয়ার রক্তমাখা মুখ, একটুখানি নিঃশ্বাস নেবার শেষ প্রাণপণ চেষ্টা। ঠিক সেই সময়ে আপুর এই অবস্থা মনে হচ্ছিল আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। ধরেই নিয়েছিলাম এবার আমার বোনের যাওয়ার সময় চলে এসেছে। ভাইয়াকে ছাড়া ও আর কতদিন টিকবে? আমার চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এল। ছোট মামা আপুর মাথার বালিশ সরিয়ে কাত করে শুইয়ে দিলো। মাথার কাছে বসে ডাকছিল বারবার। কিছুক্ষণ পরই আপু নরমাল হলো। তবুও ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। চোখে মুখে আতংক। বুঝাই যাচ্ছিল খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। আপুকে রাতেই হসপিটালে নেয়া হলো। ইমার্জেন্সি থেকে বলে দিলো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। বাসায় ফিরে বাবা খুব কেঁদেছিল। এতগুলো দিনে বাবাকে সেই প্রথম দেখেছিলাম হাউমাউ করে কাঁদতে। নানীর পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ছেলেটা মরে গেল কেন আম্মা? উপরওয়ালা ওকে আমাদের কাছে রেখে গেল না কেন? নিজের ছেলে ভেবে আদর করেছি ওকে। ও নেই আম্মা। নিজেকে এখন পঙ্গু লাগে। আমার নবনীকে নিয়ে আমি খুব বিপদে আছি। কী করবো এখন? আমার সমস্যা সমাধান করতো যে, সে তো চলেই গেল। আমার নবনীটার কী হবে? খোদা নিলোই যেহেতু নবনীকেও ওর সঙ্গে নিয়ে যেত। সন্তানকে জীবিত লাশ হয়ে দেখার চেয়ে মরা লাশ কবরে রেখে আসা অনেক সহজ। বয়স হয়েছে আমার, বুকের উপর এত ভারী বোঝা সয়ে যেতে পারছি না।” 

— “নবনীকে তারপর সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওনি?” 

— “হ্যাঁ, পরদিনই। ডক্টর কথা বলার চেষ্টা করেছিল। আপু বলেনি। ডক্টর তখনই বলেছিল ওর সিম্পটম পিটিএসডি-র সঙ্গে ম্যাচ হচ্ছে। পরদিন থেকে আপুর কাউন্সেলিং শুরু হলো, মেডিসিন নেয়া শুরু হলো। পুরো ২১ দিন পর দ্বিতীয় সেশনে আপু কথা বললো ডক্টরের সঙ্গে। তাও খুব বেশি না। হুম, হ্যাঁ, না এতটুকুই। তখন আমাদের জন্য এইটুকুই অনেক বেশি ছিল।” 

— “চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষের এত নির্মম মৃত্যু কে সহ্য করবে? মেন্টাল ডিসঅর্ডার হওয়া খুব স্বাভাবিক।” 

— “চোখের সামনে মৃত্যু হওয়া আর বাসের নিচে পিষে মৃত্যু হতে নিজ চোখে দেখার মাঝে বিস্তর তফাৎ। আপু তো তখনই মরে গিয়েছিল।” 

— “ট্রিটমেন্টের পরও নবনী ঠিক হলো না কেন? প্রোপার ট্রিটমেন্ট কি ওকে দেয়া হয়নি? নাকি ঐ ১৭ দিনের দেরীটুকুই ঝামেলা বাঁধালো?” 

— “ট্রিটমেন্টের পর ঠিক বলতে কয়েকটা সেশনের পর আপু কথা বলতো টুকটাক। স্লিপিং পিল খেয়ে লম্বা সময় ঘুমাতো। ব্যস এতটুকুই। কিন্তু দিন দিন ওর সিম্পটমগুলো আরো বাড়ছিল।” 

— “যেমন?” 

— “মাথাব্যথা, বমি ভাব। নিজেকে একঘরে করে রাখতো। ওর সামনে সামি ভাইয়াকে নিয়ে কথা বললেই দৌড়ে পালাতো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল। মানুষ দেখলে বিরক্ত হতো। ঘরে ভাঙচুর করতো। দুঃস্বপ্ন যেন ওর নিত্যদিনের সঙ্গী হলো। প্রায় রাতেই ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠতো। সিজার এ্যাটাক হয়েছিল আরো পাঁচবার। পড়ালেখা ছেড়ে দিলো, নিজের যত শখ আহ্লাদ ছিল সব বেমালুম ভুলে গেল। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রতি মিনিমাম ইন্টারেস্ট ওর আর রইলো না।” 

— “ডক্টর চেইঞ্জ করোনি?” 

— “দশ মাসে ডক্টর দেখিয়েছি তিনজন। দিন দিন আপুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন মেনে নেয়ার মতো ছিল না। এমন কিছু বাদ নেই আপুর জন্য আমরা করিনি। সামি ভাইয়া মারা যাওয়ার আগে বলেছিল নবনীকে হারিয়ে যেতে দিস না। চোখের সামনে আপু হারিয়ে গিয়েছিল অথচ আমরা ওকে আঁকড়ে রাখতে পারিনি। নিজেকে অসহায় তো লাগতোই, সন্তানকে সুস্থ করার আব্বু আম্মুর লাগাতার ব্যর্থ চেষ্টা আর হাহাকার আমাকে আরো শেষ করে দিচ্ছিল। আমি নিজেও ছয়মাস সাইকিয়াট্রিস্টের আন্ডারে ছিলাম। আপু সারাটাদিন রুমের ভেতর পর্দা আটকে এই কোণায়, ঐ কোণায় বসে থাকতো। আমরা কোনো প্রয়োজন ছাড়া গেলে ও খুব রেগে যেত। প্রয়োজনের বাইরে কিছু বলতে গেলে হয় আমাদের ঘর থেকে বের করে দিত নয়তো ও নিজেই বেরিয়ে যেত। খাওয়াদাওয়া করতো না। প্রতিদিন ওর পছন্দের সব খাবার আম্মু রান্না করতো। সারাদিন মিলিয়ে একবেলা মুখে খাবার নিতো। তাও কোনোরকমে। হাসতো না, কাঁদতোও না। নবনীকে সুস্থ করতে হবে সেই ভাবনা থেকে মামা, খালারা, কাজিনরা কয়দিন পরপরই চলে আসতো ওর সঙ্গে কথা বলতে। ও দরজাই খুলতো না। ৮৫ কেজির নবনী শুকিয়ে ৫০ কেজিতে নেমে এল। এরমাঝে হসপিটালাইজড হয়েছে তিনবার। অসুখে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল ও। ভিটামিন ডেফিসিয়েন্সি, লো বিপি, লো হিমোগ্লোবিন, ডিহাইড্রেশন থেকে ইউরিন ইনফেকশন, জ্বর এগুলো ওর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলো। কতদিন হাঁটতে হাঁটতে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেছে ফ্লোরে!” 

— “ডক্টর বদলানোর পরও কাজ হলো না?” 

— “নাহ্! কোনো মেডিসিন, কাউন্সেলিং, থেরাপী কিছুই আপুর কাজে আসছিল না। চরম হতাশার মাঝে দিন পার করছিলাম। আমার মনে আছে, শেষ যেইবার আপুকে হসপিটালে এডমিট করা হলো সামি ভাইয়ার আম্মু এসেছিল আপুকে দেখতে। আম্মু তখন আন্টিকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল আমার মেয়ে তো মরে গেছে সামির সঙ্গেই। শরীরটা শুধু পড়ে আছে এখানে। সেটাও চলে যাবে। সময় ঘনিয়ে আসছে বোধহয়। চোখের সামনে মেয়েটা এভাবে শেষ হয়ে গেল আমি সহ্য করতে পারি না আপা। তারচেয়ে বরং ও চলে যাক, এসব থেকে মুক্তি পাক। আমাকেও মুক্তি দিক। মানুষের এত দোয়া, চেষ্টা উপরওয়ালা ফিরিয়ে কেন দিচ্ছে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যে যা করতে বলেছে আমরা তাই করেছি শুধু এই আশায় আমার বোনটা ফিরে আসুক। সব চেষ্টার পরও যখন আপু ঠিক হচ্ছিল না আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। আপু এভাবেই অসুখে বিসুখে একদিন মরে যাবে সেই দিন গুনছিলাম। আপু শেষবার রিলিজ নিয়ে বাসায় ফেরার একসপ্তাহ পর সুমনা আপু এক বিকেলে হাজবেন্ড, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আমাদের বাসায় এসে হাজির। নবনী আপু খুব একটা কথা বলতে চায়নি। কুশলাদি জিজ্ঞেস করেই নিজের ঘরে চলে গেল। সুমনা আপু সবসময় একটু নাছোড়বান্দা স্বভাবের। নিজের কাজ উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকবে। সেদিনও তাই করলো। আপুর পেছন পেছন গিয়ে দরজা আটকে দিলো। কয়েক মিনিট পরই নবনী আপুর চিৎকার শুনেছিলাম, তুমি এক্ষুনি ঘর থেকে বের হও। আমি ঐ ব্যাপারে একটা কথাও শুনতে চাই না, এসব আরকি! কিছুক্ষণ পর আপু থেমে গেল। আর কোনো শব্দ আমরা পাই না। ঘন্টা দেড়েক পর শব্দ পেলাম আপু চিৎকার করে কাঁদছে, তুমি আমাকে মাঝরাস্তায় ফেলে চলে কেন গেলে সামি? ফিরে এসো প্লিজ! ভাইয়া মারা যাওয়ার পুরো ১০ মাস পর আপু কেঁদেছিল। আব্বু আম্মু সবাই রুমে যেতে চেয়েছিল। সবাইকে রেখে সুমনা আপু শুধু আমাকে রুমে যেতে দিলো। আমি অবাক হয়ে সুমনা আপুকে দেখছিলাম। কী এমন বললো উনি যে আপু স্বাভাবিক মানুষের মতো কাঁদছে। এতগুলো মাসে কতভাবে চেষ্টা করলাম আপু একটু কাঁদুক অথচ ও কখনোই কাঁদেনি। আপুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী এমন বললে তুমি? ও আমাকে কিছুই বলেনি। শুধু বললো, এত জেনে কী হবে! বাদ দাও সেসব। যতক্ষন খুশি কাঁদুক। একদিন, একসপ্তাহ, একমাস যতদিন খুশি। ওকে বাঁধা দিও না। এবার যদি একটুখানি স্বাভাবিক হয় মেয়েটা!” 

— “উনি সাইকিয়াট্রিস্ট?” 

— “নাহ্।

— “স্ট্রেঞ্জ! তারপর?” 

— “টানা ১২ দিন আপু কান্নাকাটি করে কাটালো। কখনো চিৎকার করে, কখনো ফুঁপিয়ে। ঐ কয়েকদিনে আপুর মেজাজ খিটখিটে হতে দেখিনি। আমরা সবাই যখন খুশি ওর পাশে বসেছি ও রিএ্যাক্ট করেনি। এমনকি ও আম্মু আর নানীকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, সামি কি ফিরে আসবে না? ও আসবে না কেন? আমার ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র অভাব ছিল? তুমিই বলো? এতগুলো মাস পর আপু ওদের গা ঘেঁষে বসেছে, জড়িয়ে ধরেছে। আমরা সবাই খুশিতে আত্মহারা। ১২ দিন পর ১৩ দিনের সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আপু ভাইয়ার শার্ট পরে ঘুমাচ্ছে। ১০ টার দিকে ডাকলাম নাস্তা খাওয়ার জন্য। আপু ঘুম থেকে উঠলো, ফ্রেশ হলো, নাস্তার টেবিলে এল। ও কাঁদছে না, মন খারাপ করে নেই, হাসিমুখে কথা বলছে, নাস্তা করছে। একরাতের মধ্যে আপু অস্বাভাবিক রকমে স্বাভাবিক হয়ে গেল। বিশ্বাস হচ্ছিল না কারো। আপু সুস্থ হয়ে গেল কেমন করে? ধরেই নিলাম এতদিন আমরা যেই মিরাকেলের আশায় বসে ছিলাম সেই মিরাকেল হয়ে গেছে। আপু সুস্থ হয়ে গেছে। খুশিতে আমরা কী রেখে কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আম্মু সুমনা আপুকে কল করে সে কী কান্না! আপুর জন্য আমার বোন সুস্থ হয়েছে এই কৃতজ্ঞতা আমরা কিভাবে প্রকাশ করবো!” 

— “আমি কিছু একটা গেস করছি। ও চাচী আর নানীকে বলছিল সামি ফিরবে কবে? ও অপেক্ষায় ছিল সামি ফেরার। সেদিন রাতে ও প্রথম দেখেছে সামি ওর সামনে দাঁড়িয়ে? আই মিন হার ফার্স্ট হ্যালুসিনেশন?” 

— “ইয়েস! আমরা একদম বুঝিনি মিরাকেলটা আসলে কী ছিল। প্রথম দুইদিন খুব ভালো কাটলো। খুব মানে খুব। মৃত সন্তান জীবিত হয়ে ফিরে আসা যেমন অসম্ভব, আপুকে সুস্থ ভাবে ফিরে পাওয়া আমার আম্মু আব্বুর কাছেও ঠিক তেমনই ছিল। আপু নরমাল বিহেভ করছে তাতেই আমরা খুশি। কেন হলো কিভাবে হলো সেসব কিছুই ঘাটাঘাটি করিনি। কতটা দিন পর আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি! একঘুমে আমার সকাল হয়েছে।” 

— “কবে জানলে নবনীর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে?” 

— “তিনদিন পরই। ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম জরুরি কাজে। ফিরতে ফিরতে দুপুর তিনটা বাজলো। ততক্ষণে সবাই খেয়ে দেয়ে যার যার রুমে। দরজা খুলেছিল কাজের মেয়ে। ভেবেছিলাম আপুও হয়তো ঘুমাচ্ছে। সেজন্য কোনো শব্দ না করে পা টিপে টিপে রুমে গেলাম জামা ছেড়ে ফ্রেশ হতে। রুমে ঢুকতেই দেখি আপু জানালার দিকে মুখ করে হেসে হেসে একাই কথা বলছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। আপু তো সুস্থ হয়ে যাচ্ছে তাহলে আবার একা একা কথা কেন? এই সমস্যা তো ছিল না। এটা হলো কেন? আমি দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম আপু কী বলছে। ঠিকঠাক শুনতে পাইনি। খুবই নিচুগলায় কথা বলছিল। আপুকে আমি ডাকিনি, কিছু বলিওনি। আপু এতটাই কথা বলায় ডুবে ছিল যে আমি ওর পেছনে হাঁটছি, ড্রেস চেইঞ্জ করছি ও একদম টের পায়নি। রাতে আমি আব্বু আম্মুকে বললাম। পরদিন আমরা ডক্টরকে জানালাম। উনি সবটা শুনে একটু রাগ করলো। বললো, নবনী সুস্থ হয়েছে কি না সেটা ডিসাইড করবো আমি। আমার সঙ্গে কনসাল্ট না করে আপনারা কিভাবে বলছেন ও সুস্থ হয়ে গেছে? এডুকেটেড পারসনের কাছে এমনটা আশা করা যায় না। আপনাদের উচিত ছিল আমাকে ইমিডিয়েটলি জানানো। কালই নবনীকে আমার চেম্বারে নিয়ে আসবেন। রাতে আমার ঘুম ভাঙলো। ওয়াশরুমে যাবো। ঘরে ডিম লাইট জ্বলছিল। মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল সব। চোখ মেলে দেখি আপু এমনভাবে হাত উঁচু করে রেখেছে, দেখে মনে হচ্ছিল কেউ ওর হাত ধরে রেখেছে। ও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে। মাথা দুলিয়ে কথা বলছিল, কথার ফাঁকে হাসছিল। ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম আমি। দুপুরে ভেবেছিলাম আপু একাই কথা বলছে। রাতের বেলা মনে হলো আপু একা না। ওর সঙ্গে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভূতের ভয় কখনো ওভাবে লাগেনি। কিন্তু সেদিন রাতে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এল। কোনোরকমে ছুটে গিয়ে নানীর ঘরে গেলাম। উনাকে ডেকে সব বলতেই উঠে এল আপুকে দেখতে। আপু তখনও কথা বলছেই। নানী ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে, তুমি কার লগে কথা কইতাছো বইন? আপু খুব মিষ্টি করে হেসে বললো, কে আবার! সামি এসেছে। নানী আর আমি নিজেকে কিভাবে যে সামলেছি তা আপনি আন্দাজও করতে পারবেন না। যেই মানুষটা নেই প্রায় এক বছর হয়ে গেছে তার সঙ্গে কি না আমার বোন গল্প করছে! আমরা আর একটা কথাও বাড়াইনি। দুজনেই চলে গেলাম বসার ঘরে। কী হচ্ছে, আপু কী বলছে সেগুলো বুঝার জন্য নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া দরকার ছিল। ওরকম একটা সিচুয়েশনে সর্বপ্রথম মাথায় যেটা এল তা হলো ভূতের খেয়াল। দুজনই সামি ভাইয়ার আত্মা এসেছে ওসব আওড়াচ্ছিলাম। পাঁচ মিনিট পর নানী এক গ্লাস পানি খেয়ে এসে আমাকে ধমক দিলো, ঐ আমি নাহয় বুড়া মানুষ, এতকিছু মাথায় ধরে না। আবোল তাবোল কই। তাই বইলা তুইও কইবি? তখন আমারও বোধহয় জ্ঞান বুদ্ধি একটুখানি ফিরে এল। আপু অসুস্থ ছিল এটা আমরা কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম এটাও আপুর অসুস্থতারই একটা অংশ। ওর হয়তো হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। আর দুই তিনদিন ধরে আপুর মাঝে যা পরিবর্তন তা হচ্ছে শুধুমাত্র হ্যালুসিনেশনের কারণে। আপনি যাকে হারিয়ে অসুস্থ হয়েছেন, অস্বাভাবিক আচরণ করছেন সেই মানুষ আপনার কাছে ফিরে এলে আপনি কি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন না?” 

— “হ্যাঁ।” 

— “আপুর বেলায়ও তেমনটাই হলো। আপুর নতুন এক রোগ পুরোনো রোগ থেকে মুক্তি দিলো।” 

— “স্ট্রেঞ্জ!” 

— “পরদিন ওকে আমরা ডক্টরের কাছে নিয়ে যাই। আমি ডক্টরকে জানাই আগের রাতের কথা। তারপর উনি ট্রাই করেছেন এই ব্যাপারে কথা বলতে, আপু বলেনি ডক্টর আমাদের বললো, ওর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে আর এটা ওর রোগেরই একটা অংশ। কল্পনায় সামি ভাইয়ার যে কথাগুলো আপু শুনতে পায়, যেভাবে উনাকে দেখতে পায় সেগুলো আপুরই নিজস্ব ভাবনা। আপু যা শুনতে চায় বা সামি ভাইয়া এই পরিস্থিতিতে কী বলতে পারে সেই ধারণা থেকেই আপু কথাগুলো ভাইয়ার কাছ থেকে শোনে। আপু ঐ কথা শুনে আর এক সেকেন্ডও ওখানে বসেনি। উঠে চলে এল। চেম্বার থেকে বেরোনোর আগে ডক্টরকে খুব শান্তভাবে বলে এল, আপনাকে চাইলে আমি সবটা বলতে পারতাম। বলিনি কেন জানেন? আপনি শুধু ডাক্তারি বিদ্যায় বিশ্বাসী, মিরাকেলে না। আমার কোনো হ্যালুসিনেশন হয়নি। যাকে দেখছি, কথা বলছি, সে সত্যি। কাউকে ভালোবেসেছেন কখনো? কেউ কখনো বেসেছে আপনাকে? যারা ভালোবাসে তাদের মাঝে কখনো বিচ্ছেদ আসে না। ওকে ফিরে আসতেই হতো। আমাকে না দেখে, কথা না বলে কখনো থেকেছে ও? না আমি থেকেছি? আমি ওর ভীষণ প্রিয়। আমাকে ফেলে কিভাবে থাকবে ও?”

— “ওহ! ও ভাবতো সামি ফিরে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো মেনেই নেয়নি সামি মারা গেছে।

— “এই ধারণার শুরুটা কী করে হলো, জানেন?” 

— “কিভাবে?” 

— “সুমনা আপু ওকে কী কী বলেছিল সব কথা আমরা আজও জানি না। তবে কিছু কথা জানি। সুমনা আপুই ওকে বলেছিল, সামি সশরীরে নেই তাই বলে ভেবে নিবি সম্পর্ক শেষ, ভালোবাসা শেষ? ভালোবাসা আজও বাকি আছে। যারা শুধু চোখের দেখায় ভালোবাসে তাদের ভালোবাসা হারিয়ে যায়। তোরা তো মন থেকে একজন অন্যজনকে ভালোবেসেছিলি। সামি তোর সামনে আর নেই, আর কখনো ওকে দেখতে পাবি না বলে ভেবে নিলি তোদের ভালোবাসা মরে গেছে? যারা ভালোবাসে ওদের বিচ্ছেদ বলতে কিছু নেই। ও তোর মাঝে, তোর জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। চোখটা বুজে একবার ওকে ভালো করে খুঁজে দেখ না! তোর সবকিছুতেই ওকে খুঁজে পাবি। সবার জন্য ও মরে গেছে, তুই নাহয় ওকে বাঁচিয়ে রাখ তোর মাঝে। আগে যেমনটা ভালোবাসতিস ঠিক তেমনি আজও ভালোবাসবি। আমার ভাই এখানে নেই তাতে কী? আছে তো কোথাও না কোথাও। সেখানে বসে দেখছে তোকে। ভালোবাসছে তোকে। ধরে নে সাময়িক একটা বিচ্ছেদ হয়েছে তোদের। এই জীবনটা কেটে গেলে আবার দেখা হবে তোদের।”

— “আপুর কথাগুলো ও ভুলভাবে নিলো?” 

— “হ্যাঁ। সুমনা আপু কল করেছিল নবনী আপুর খোঁজ নিতে, তখন মা বলছিল আপুর অবস্থা। আপু শুনে থ! তখনই আপু বললো ঐ কথাগুলো। আপু নিজেও বুঝতে পারেনি নবনী আপু কথাগুলো এভাবে বুঝবে। উনি বুঝাতে চাইছিল ভালোবাসা কখনো মরে যায় না। মানুষটা নেই তাতে কী? তুই না হয় ওকে ভালোবেসে বাঁচিয়ে রাখ মনের ভেতর, নিজের মাঝে অনুভব কর। আর আমার বোন ধরে নিলো, ভালোবাসায় বিচ্ছেদ নেই তার মানে ভাইয়ার সঙ্গে ওর আবার দেখা হবে, উনি ফিরে আসবে। ঐ কয়টাদিন ধ্যান-জ্ঞান করলো এই নিয়ে। গোটা একজীবন অপেক্ষা করার সহ্য ক্ষমতা আপুর ছিল না। আপু চাইছিল ভাইয়া যেখানেই আছে ওর কাছে চলে আসুক। এক্ষুনি আসুক। দিনরাত অপেক্ষা আর ধ্যান জ্ঞান করার ফল হলো আপুর হ্যালুসিনেশন।”

— “ঐ ঘটনার এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল! এতদিনের ট্রিটমেন্টের পরও নবনী সুস্থ হলো না!”

— “আপু ট্রিটমেন্টই করেনি।” 

— “কেন?” 

— “কেন করবে? ও কি অসুস্থ? ওকে ট্রিটমেন্টের কথা বললেই বাসায় খুব ঝামেলা করতো, অসুস্থ হয়ে যেত। বলতো, আমি অসুস্থ না। সামি সত্যি এসেছিল। বিশ্বাস কেন করছো না? নবনী তোমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে এই কথাটা ওর সামনে উচ্চারণ করলেই ঘরের ভেতর কেয়ামত নেমে আসতো। ও বাসা থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে চাইতো। বাবা আপুর প্রতি একটু বেশিই উইক। ওকে যখন কোনোভাবেই রাজি করাতে পারছিলাম না, উল্টো ও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরী হচ্ছিল তখন বাবা বললো আপু যা চায় তাই হবে। ও হাসছে, কথা বলছে, ঘুমাচ্ছে এটাই বাবার জন্য অনেক। আর কিছু চাই না তার। আপু যদি কল্পনায় সামি ভাইয়াকে নিয়ে ভালো থাকে, সুখে থাকে তো থাকুক। এমন সুখের অসুখ থাকা মন্দ কিছু না।” 

— “এটা কেমন ডিসিশন! পরিস্থিতি তো আরো খারাপ হতে পারতো।” 

— “প্রথমে আমি আর নানী আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম আপুর সবকিছু আগের মতো নরমাল হয়ে গেছে, পড়ায় মন দিয়েছে, নতুন ব্যবসায় হাত দিয়েছে তখন আমাদেরও মনে হলো ও মরে যাওয়ার চেয়ে এই-ই বরং ভালো। বদ্ধ উন্মাদ তো আর হয়ে যায়নি। নিজের একা সময়টাতে বসে কথা বলে, কল্পনায় ভাসে। ভাসুক।” 

অনি মাথা দুলিয়ে বললো, , 

— “হ্যাঁ আমিও নোটিস করেছি আপু একা সময়টাতেই কথা বলে। সঙ্গে কেউ থাকলে কখনো বলে না। ভেবেছিলাম একাই হয়তো কথা বলছে। বলে না অনেকে! কিন্তু কাউকে ইমাজিন করে কথা বলে এতটাও বুঝিনি।” 

— “এর পেছনেও কথা আছে। আপু ভাবে, ভাইয়া শুধু ওর জন্যই ফিরে এসেছে। আর কাউকে উনি দেখা দেবে না। আপুর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। এই নিয়ে তর্ক হবে, দ্বন্দ্ব হবে। আপুকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর পরামর্শ দিবে। আপু এই প্রবলেমগুলো ফেইস করতে চায়নি। তাই ব্যাপারটা ও নিজেই হাইড রাখার চেষ্টা করে।” 

— “এটা একদিকে ভালো। নয়তো বাইরের মানুষদের সামনে কথা বললে ব্যাপারটা আরো বাড়াবাড়ি হতো। কিন্তু তোমাদের ডিসিশনটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না নাতাশা। ও আবদার করলো আর তোমরাও মেনে নিলে! একবারও ভাবলে না ওর ভবিষ্যৎ আছে, সামনে হয়তো ওর সমস্যাটা আরো বাড়তে পারে। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল নবনী আজও একটা মিথ্যা আঁকড়ে বেঁচে আছে। আর কতদিন? ওকে সত্যিটা জানানো উচিত না? ওকে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা উচিত না?”

— “সত্যি কথা বলতে তখন আমরা আপুর বর্তমান নিয়ে এতটাই বিপাকে পড়েছিলাম যে ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবিনি। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। আপুকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয়। অনিকে নিয়েই একবার ভাবুন না! চোখের সামনে আপনাদের মেয়ে জীবিত লাশ হয়ে পড়ে থাকবে, মানতে পারবেন আপনারা? সামি ভাইয়া আমাদের এতটা ঘিরে ছিল যে আমরাই ওভারকাম করতে পারছিলাম না। আপুকে আর আমরা কী বলতাম? বিশেষ করে আব্বু। আপুর সঙ্গে আব্বুও এক প্রকার জেদই করলো নবনীকে আর ডাক্তার দেখাতে হবে না। কিছুদিন পর আব্বুর জেদটাই আমাদের কাছে ঠিক মনে হলো। আপু তো বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়নি, সবকিছু একদম পার্ফেক্ট। ও শুধু একটা মানুষকে কল্পনায় আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে, তো বাঁচুক না। ট্রিটমেন্টের পর হয়তো আপু সুস্থ হয়ে যেত, ভাইয়াকে আর কখনো দেখতে পেতো না। কিন্তু সত্যটা কি মেনে নিতে পারতো? সারাটা জীবন অসহনীয় এক যন্ত্রণা আপুকে একটু একটু করে মেরে ফেলতো। হয়তো আমাদের সঙ্গে কথা বলতো, পড়াশোনায় আবার মন দিতো, খাওয়া দাওয়া করতো কিন্তু আগের নবনী কি বেঁচে থাকতো? ঐ দশমাসের কথা মনে পড়লে আমাদের গায়ে এখনো কাঁটা দেয়। আব্বু আজও ঐ সময়গুলো স্বপ্নে দেখে ঘুমের মাঝে চিৎকার করে উঠে। ঐ নরকে আমরা কেউ আর ফিরে যেতে চাইনি ভাইয়া।” 

মাথা নিচু করে বসে রইলো অমিত। বুক ভারী হয়ে আসছে তার। সামি ছেলেটাকে এক নজর দেখার লোভ বড্ড বেড়ে গেছে। এত ভাগ্য কারো হয়! কোনো প্রেমিকের ভাগ্যে এত ভালোবাসা এরআগে জুটেছিল কখনো? কই, তার চেনা দেখায় তো কেউ নেই! আর নবনী? একজনকে ভালোবেসে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল! ছোট্ট একটা জীবনে কত কী ঘটে গেল ওর। কিসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে ওকে। অসুস্থ মেয়েটা তো শুধু ওর কল্পনায় বেঁচে থাকা মানুষটার গল্প শুনিয়েছিল তাকে, আর সে কিনা সেই গল্পকে কেন্দ্র করে মনে মনে কত কী নোংরা ভাবনা ভেবে ফেললো ওকে নিয়ে! কঠিন সময়টাতে এই মেয়েটাই তো একদম কাছের বন্ধুর মতো আগলে রাখলো, মায়ের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কটা আবার ফিরিয়ে দিলো। ওকে নিয়ে মনে কেন এল এত এত মন্দ খেয়াল? একদিকে নবনীর কুৎসিত অধ্যায়ের গল্প অন্যদিকে ওকে ভুল বুঝার অনুতাপের দায় বাড়াবাড়ি রকমে মন খারাপ করে দিলো। গলায় কান্না আটকে আছে। ঠিক গলার মাঝখান বরাবর ব্যথা হচ্ছে। 

— “ভাইয়া?” 

— “হুম?” 

— “আপুর উপর রাগ আপনি?” 

— “ঐ কথা আর মনে করিও না প্লিজ!” 

— “কী নিয়ে রাগ করেছেন বলবেন আমাকে?” 

  • ………………..

— “আপু আপনাকে খুব পছন্দ করে। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর নতুন করে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি আপুর। এতগুলো বছর পর দেখছি আপুর কারো সঙ্গে খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছে। আপুকে এভাবে ইগনোর করবেন না প্লিজ! কী নিয়ে রাগ করেছেন মুখোমুখি কথা বলে মিটিয়ে ফেলুন না! ও খুব কষ্ট পাচ্ছে আপনার আচরণে। আপনার রাগ ভাঙাতে ঢাকা থেকে এখানে চলে এল। অথচ আপনার রাগ ।এখনো ভাঙাতে পারলো না। রেস্টুরেন্টে আপুর সঙ্গে আপনার কথা কাটাকাটি হয়েছিলো তাই না?” 

— “কথা কাটাকাটি না ঠিক। আমিই একতরফা ওকে শুনিয়েছি। ও আমাকে কিছু বলেনি।” 

— “ও খুব মন খারাপ করেছে। রেস্টুরেন্ট থেকে সি বিচে গিয়েছিলাম। পুরোটা সময় ও চুপ ছিল। বাসায় ফেরার পথে বলছিল আমাদের বোধহয় বাসায় ফিরে যাওয়া উচিত। কী এমন হলো ভাইয়া, বলুন তো? একটা মানুষ জানেই না আপনি কী নিয়ে রেগে আছেন অথচ এতদূর চলে এল স্যরি বলতে। কেন করছে এসব বলুন তো? ফ্রেন্ডশিপটা যেন নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্যই তো, তাই না? আপনি ছোট বাচ্চা? এই বয়সে এভাবে রাগ করে বন্ধুত্ব নষ্ট করা মানায়?”

— “আমাকে ঝাডুপেটা করা উচিত। একমাত্র মুনিয়া ছাড়া আমি কখনোই কোনো সম্পর্ক আগলে রাখিনি, রাখতে জানি না। ওর সঙ্গে যা করলাম এই তিন চারদিন, একদম অকারণে করেছি। কিছু প্রশ্ন ছিল, দ্বিধা ছিল সেসব তোমাকে জিজ্ঞেস করলেই মিটে যেত। অথচ আমি নিজে নিজেই কিসব ভাবছিলাম। নিজের উপর রাগ হচ্ছে খুব।” 

— “সামি ভাইয়া রিলেটেড কোনো ব্যাপার ছিল?” 

— “বাদ দাও নাতাশা। আমি আর কখনো মনে করতে চাই না। ও রাতে কিছু খায়নি তাই না?”  

— “না।” 

— “অনি, খাবার গরম করে টেবিলে দে। আমি ওকে নিয়ে আসছি।” 

— “তিনটা বাজে ভাইয়া। এতরাতে ও খাবে? এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।” 

— “বাজুক। ঘুম থেকে ডেকে খাওয়াবো। এ্যাই অনি, উঠ না!”

নাক টানতে টানতে অনি বললো, 

— “টিস্যু দাও।” 

টিস্যু বক্স অনির হাতে ধরিয়ে অমিত বললো, 

— “এই যে শুরু হলো, আগামী তিনদিন এই কান্নাকাটি চলবেই।” 

— “আমাকে বলছো! তুমি কষ্ট পাওনি? ভাইয়াটা এভাবে মরে গেল, নবনী আপুর জন্য তোমার খারাপ লাগছে না?” 

অনির প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না অমিত। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। 

.

দরজা ঠেলে ভেতরে এল অমিত। নবনীর ঘরে বাতি নেভানো। ডাইনিং রুমের আলো এই ঘরে আবছা হয়ে ছড়িয়ে গেছে। কাঁথা মুড়িয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমুচ্ছে নবনী। ওকে দেখে বুকের ভেতর মোচড় কেটে ব্যথা হচ্ছে অমিতের। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওকে একবার জড়িয়ে ধরে স্যরি বলতে। খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে জড়িয়ে ধরলে? নবনী খারাপভাবে নিবে? দোটানায় ভুগতে ভুগতে নবনীর মাথায় হাত রাখলো অমিত। মৃদুস্বরে ডাকলো, 

— “নবনী, উঠো!” 

চোখ মেলে হুরমুর করে শোয়া থেকে উঠলো নবনী। 

— “তুমি এখানে! কয়টা বাজে?” 

— “তিনটা।” 

— “এতরাতে এখানে কী করছো?” 

— “এই রাতে নক না করে তোমার ঘরে চলে এলাম, বিরক্ত হলে?” 

— “তুমি কখনোই আমার কথা পজিটিভলি নিবে না অমিত? আমি কখন বিরক্ত হলাম? তোমার আজ বাসায় ফেরার কথা ছিল না তাই জিজ্ঞেস করলাম।” 

— “আমি গাধা, তাই তোমাকে বুঝি না। বন্ধুত্ব যেহেতু হয়েই গেছো, এই গাধাটাকে মেনে নাও।” 

ভ্রু কুঁচকে অমিতের দিকে তাকালো নবনী। মুচকি হেসে অমিত বললো, 

— “রাতে কিছু খাওনি কেন?” 

— “আমার খুশি।” 

— “ঝগড়া হয়েছে আমার সঙ্গে, তাই বলে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে! খাবে চলো। 

— “এতরাতে তুমি আমাকে খেতে বলছো?” 

— “হ্যাঁ। সমস্যা কী?” 

— “খাবো না। যাও তুমি।” 

— “আমি কাজ ফেলে বাসায় এলাম তোমার সঙ্গে খাবো বলে। আর তুমি বলছো খাবে না?”

— “অমিত খুব আদিখ্যেতা হচ্ছে। সন্ধ্যায় কী রুড বিহেভ করলে আমার সঙ্গে। আর এখন বলছো তুমি আমার সঙ্গে বসে খাবে বলে কাজ ফেলে চলে এসেছো?”

— “নবনী আমরা অবশ্যই এই ব্যাপারে কথা বলবো। না মানে, তুমি বলবে আমি শুনবো। যা খুশি বলো আমাকে। কিন্তু প্লিজ, আমরা আগে কিছু খেয়ে নেই? সেই সন্ধ্যায় তোমাদের সঙ্গে বসে খেয়েছি। তারপর শুধু কাজ আর কাজ। ক্ষুধা পেয়েছে ভীষণ। তারউপর আম্মু চিংড়ি ভুনা করেছে। প্লিজ নবনী, এসো আমার সঙ্গে।”

— “ঢঙ করবে না একদম। আমি তোমার সঙ্গে খাবো না, কথাও বলবো না। তুমি তোমার মুনকে নিয়ে ডিনার করো। আমি তোমার কেউ না।”

— “এ্যাই, তুমি জেলাস?” 

— “জেলাস কেন হবো?” 

— “হ্যাঁ জেলাসই তো! বউ কখনো হাজবেন্ডের প্রেমিকাকে সহ্য করতে পারে? মুন আমাকে কল করেছে সেটা তোমার সহ্য হচ্ছে না।” 

— “অমিত! একদম বাজে কথা বলবে না। আমি কখনোই নিজেকে তোমার বউ ভাবি না। বন্ধু ভাবতাম তোমাকে। তুমি যা বিহেভ করলে তখন! আপাতত তোমাকে বন্ধুও ভাবতে পারছি না আমি।” 

— “নবনী…” 

  • ………………..

নবনীর দুইগাল চেপে নিজের দিকে ফেরালো অমিত। মিষ্টি হেসে বললো, 

— “স্যরি।” 

— “তোমার কী হয়েছে অমিত বলো তো? হাসিটাও ঠিকঠাক ঠোঁটের ভাঁজে আসছে না। জোর করে হাসতে চাইছো তুমি। মনের ভেতর কিসের ঝড় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো বলো আমাকে।’ 

— “অনেক কিছু একসঙ্গে চলছে মনের ভেতর। আপাতত আমার স্যরি এক্সেপ্ট করে অন্তত একটা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করো প্লিজ! তোমার সঙ্গে কিসব আচরণ করলাম আমি। গিল্ট ফিল হচ্ছে খুব। আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি নবনী। আর কখনো এমন হবে না, প্রমিজ 

মুচকি হাসলো নবনী। চুলগুলো পাঞ্চক্লিপে আটকে নিতে নিতে বললো,

— “এবারই শেষ। আর কখনো যদি এমন করো, সত্যি বলছি তোমার সঙ্গে সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ করে দিবো। খুউব কষ্ট পেয়েছি আমি। কিন্তু তুমি রাগ হলে কেন সেটাই তো এখনো বললে না।”

— “বাদ দাও না! আর ওসব কথা না বলি প্লিজ!” 

— “দিলাম বাদ। কিন্তু একটা ব্যাপারে ক্ষমা পাবে না 

— “কোন ব্যাপার?”

— “তুমি বলেছিলে, আমার বার্থডে তুমি আমার সঙ্গে সেলিব্রেট করবে। অথচ তুমি রাগ করে চলে এলে অনুষ্ঠান শুরু না হতেই। এমন কেউ করে অমিত? রাগ হয়েছো ভালো কথা। আমাকে কারণটা বললেই মিটিয়ে নিতাম। তুমি কি ভেবেছো কাজের অযুহাত দিলেই কেউ কিছু টের পাবে না? সবাই সব বুঝেছে। আমার বাসার সবাই ভেবে নিলো আমিই হয়তো অন্যায় করেছি তাই তুমি রাগ করে চলে গেলে। খুব লজ্জায় ফেলে দিলে না আমাকে? আমার জন্মদিনটাই এবার তুমি মাটি করে দিলে। 

নবনীর দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো অমিত। বিষণ্ন স্বরে বললো,

— “জন্মদিন ফিরিয়ে দিতে পারবো না। তোমার আমার মাঝে যে তিক্ত স্মৃতি তৈরী হলো সেটাও মেটাতে পারবো না। কিন্তু আমরা আবার সেলিব্রেট করতে পারি। সুন্দর কিছু স্মৃতি আমি তোমাকে দিতে পারি।” 

— “আর তোমার মুন? ওকে কী বলবে? জানলে রাগ করবে না?” 

— “আমরা আপাতত ওর ব্যাপারে কিছু না বলি। এখানে তুমি আমি আছি, কথা আমাদের দুজনের হচ্ছে। আলাপটা নাহয় আমাদের পর্যন্তই থাকুক।” 

— “তুমি সবসময় এত সিরিয়াস মুডে কেন থাকো? চিল থাকতে পারো না?”

— “তোমার সামির মতো?” 

— “হ্যাঁ। যত যাই হোক না কেন সামি সবসময় খুব চিল মুডে থাকে।” 

— “সামির মতো অসাম একটা প্রেমিকা থাকলে আমিও সারাক্ষণ চিল মুডে থাকতাম। প্রেম করেছি একটা ইচ্ছাধারী নাগিনের সঙ্গে। আড়াই বছর ধরে ওর বিষাক্ত ছোবল খেতে খেতে জীবন থেকে সব ফূর্তি উড়ে গেছে।” 

— “ছোবল খেতে তোমার ভালোই লাগে। নয়তো ওর সঙ্গে আবারও প্যাঁচআপ করতে নাকি!” 

— “উফ! নবনী চলো না! খাবো চলো। খিদে পেয়েছে খুব। আমাকে আবার কাজে ফিরতে হবে।” 

ভেংচি কেটে খাট থেকে নেমে এল নবনী। টেবিলে নাতাশা আর অনি মিলে খাবার সাজাচ্ছে। নবনীকে অমিতের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে দেখে অনি মুচকি হেসে বললো, 

— “ঝগড়া মিটে গেছে তোমাদের?” 

— “তা মিটেছে। কিন্তু তোমার চোখ মুখ ফুলে আছে কেন? কেঁদেছো তুমি? কোনো সমস্যা?” 

নবনীর প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল অনি। নাতাশা তৎক্ষনাৎ পরিস্থিতি সামলে নিলো। 

— “আরে আপু! অনি স্যাড সিন দেখে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেছে।” 

— “ওমা তাই! অনেক টাচি সিন ছিল? কী মুভি? দেখতে হবে তো!” 

— “ওসব মুভি টুভি রেখে আমাকে দেখো। আমার জীবনটাও একটা সিনেমা। দুঃখে, যন্ত্রণায় ভরপুর। বউ, প্রেমিকা সব আছে অথচ কেউ আমার না।

— “তুমি আসলেই একটা সিনেমা অমিত! তোমার মতিগতি কিছুই বুঝি না আমি। এখনই মেঘ, এখনই রোদ।” 

— “তোমাকে মেঘ রোদ দেখানো শেষ। এবার দ্বীপ, সমুদ্র দেখানোর পালা।” 

— “সত্যিই দেখাবে?” 

— “বললাম না ভালো কিছু স্মৃতি তোমাকে দেবো। 

— “তোমাকে বিশ্বাস করি না।”

— “আপাতত না করলেও চলবে। ওখানে যাবার পর নাহয় বিশ্বাস করো। 

— “কিন্তু যাচ্ছি কোথায়?” 

— “মহেশখালী।”

৩২

আজ খুশিতে শায়লার পা মাটিতে পড়ছে না। অনি ঘুম থেকে জেগে বললো অমিত নাকি এসেছিল গতরাতে নবনীর রাগ ভাঙাতে। আফসোসও হচ্ছে খুব। একটা সুন্দর মুহূর্ত নিজ চোখে দেখতে না পারার আফসোস। কাজের সময়গুলোতে অমিত বাসায় আসে না। হাতে পায়ে ধরেও তাকে আনা যায় না। কাজ শেষে বাসায় একটুখানি উঁকি দিয়ে ফিরে যায় ঢাকায়। গত চারবছরে তো কাজ শেষে উঁকিও দিতে আসেনি। বছরে একবার ঈদে ইচ্ছে হলে আসতো নয়তো কোনো বিশেষ প্রয়োজনে। এবার হাওয়া বদলেছে। নবনী পেরেছে হাওয়া বদলাতে। এই মেয়েটাকে ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি গালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে রাখতে। 

.

চায়ের মগ হাতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো নবনী। ওকে চোখে পড়তেই ভেতর থেকে ডাকলেন শামীমা, 

— “এ্যাই নবনী, শুনে যাও তো?” 

— “জি চাচী?” 

— “তুমি কী খেতে পছন্দ করো?” 

— “প্লিজ চাচী আপনি আর বাড়তি কোনো ঝামেলা করবেন না। দুইদিনে এত কিছু রান্না করলেন। কত খাবো আমি!” 

— “তোমাকে দিনরাত খাওয়ালেও আমার মন ভরবে না।” 

— “হ্যাঁ সেই কথা আমিও ভাবছি। এটা সেটা তৈরী করেই যাচ্ছেন। আর পারছি না চাচী। আমি আর সহজে এখানে আসবো না।” 

— “ইশ্! আসবে না বললেই হলো। এটা তোমারই বাড়ি। নিজের বাড়িতে আসবে না? থাকবে না?” 

শায়লার প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না নবনী। ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ধরে চাচীর দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজের বাড়ি বলে কিসের ইঙ্গিত করলেন তিনি? শায়লার কথার অর্থ নবনী ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। নবনীর চোখে মুখে প্রশ্ন খুঁজে পায় শায়লা। মুখ ফস্কে বলা কথাটা মুহূর্তেই সামলে নিলেন তিনি। 

— “বাবার ঘর আর চাচার ঘরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আমার ছোটবেলায় সকালে খেতাম নিজের ঘরে আর বাকি দুইবেলা খেতাম চাচাদের ঘরে। কখনো মনেই হয়নি ওগুলো আমার নিজের ঘর না। নিজের হাতে যখন যা ইচ্ছে হয়েছে খেয়েছি, যা ইচ্ছে হয় কাজিনদের কাছ থেকে নিয়ে পরেছি।”

এবারে দ্বিধার অবসান হলো নবনীর। ঠোঁটজুড়ে বিস্তৃত হাসির রেখা টেনে বললো,

— “আপনি আমার বায়না করার রাস্তা সহজ করে দিলেন। আপনার একটা শাড়ী আমার ভীষণ পছন্দ। দেখার পরই মনে হয়েছিল এটা পরে সমুদ্রপাড়ে ছবি তুললে দারুণ হবে। কিন্তু আপনাকে বলবো বলবো করে বলতে পারছিলাম না। কেমন কেমন লাগছিল আমার।” 

— “হ্যাঁ, হ্যাঁ! কেমন কেমন লাগবেই। আপন তো ভাবো না আমাকে।” মিথ্যে অভিমানে গাল ফোলালো শামীমা। তার কথায় হেসে ফেললো নবনী। বললো, “এবার কিন্তু যতগুলো শাড়ী ভালো লাগবে সব নিয়ে নিবো। “ বালিশের নিচ থেকে চাবিটা নিয়ে আলমারী খুলে শামীমা বললেন, 

— “তোমার মা আর আমার মাঝে কোনো পার্থক্য করো না কখনো। যতটা অধিকার মায়ের উপর খাটাও ঠিক ততটা অধিকার তুমি আমার উপরও নির্দ্বিধায় খাটাতে পারো। এবার দেখো তো এখানে। যে কয়টা ভালো লাগে সব নিয়ে নাও।” 

***** 

অনুষ্ঠান চলছে। আর ঘন্টাখানেক পরই আয়োজন শেষ হবে। এই কয়দিনের কাজের চাপ আর মানসিক চাপে ভীষণ ক্লান্ত অমিত। শরীর আজ চলছেই না। অনুষ্ঠান শুরু হবার পর থেকে শরীরে প্রচন্ড ক্লান্তি ভর করেছে। এত মানুষের আনাগোনা ভালোও লাগছে না। ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট গুঁজে বেইজ থেকে মিনিট দশেকের জন্য অমিত বেরিয়ে এল। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে মাথায় ঘুরতে লাগলো নানান কথা, নানান খেয়াল। মাথার ভেতর সবচেয়ে বেশি খোঁচাচ্ছে নবনী আর তার প্রাক্তন। নাহিয়ান বলেছিল কথা বলে দ্বিধা মিটিয়ে নিতে। দ্বিধা মেটাতে গিয়ে যে মাথার উপর পাহাড়সমান বিষন্নতা চড়ে বসবে কে জানতো! বাবা বলে, সবসময় সবকিছু জানতে নেই। কিছু কথা আড়ালে রয়ে গেলেই মঙ্গল। সত্যিই তো! ওর মিষ্টি গল্পগুলো শুনে কী সুন্দর কেটে যেত কিছু মুহূর্ত। কতটা সময় জুড়ে মন ভালো রয়ে যেত। মুনিয়াটা, নিজের বিশ্রী সময়টা মনে পড়তো না অনেকক্ষণ। অজানাই থাকতো নবনীর গল্পটা, সামির মৃত্যুটা! অন্তত নিত্যদিনের মন খারাপে, একাকিত্বে বিরতি হতো। এখন থেকে নবনী গল্প বলবে। সামির সঙ্গে ওর কাল্পনিক কথোপকথনগুলো শোনাবে। সে শুনবেও। কিন্তু আগের মতো আনন্দ কিংবা মন ভালো কোনোটাই যে আর হবে না! বরং প্রচন্ড শোকে মৃত প্রেমিকের মাঝে নিজেকে খুইয়ে ফেলা এক প্রেমিকার কাল্পনিক প্রেম ভীষণ কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে তাকে। মোবাইলে রিং বাজছে। স্ক্রিনে মুনিয়ার নাম। এই মুহূর্তে ওর সঙ্গে একদম কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না অমিতের। সে কল কেটে দিতেই আবারও কল দিলো মুনিয়া। প্রচন্ড বিরক্তিতে মোবাইলের সুইচাটাই অফ করে দিলো অমিত। ওর কল এলেই মনটা বড্ড অশান্ত লাগে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও মন ভালো হয় না। কী এক ঝড় ভেতরটা এলোমেলো করতেই থাকে। মুনিয়া আপাতত মনের ঠিক কোন জায়গাটাতে আছে ভেবে পায় না সে। আগের মতো ওর জন্য অপেক্ষা নেই, বলার মতো কথা নেই, ওকে একান্ত নিজের করে পাবার আকাঙ্খা নেই, অনুভূতি নেই। তবুও ওর ফোন এলে, কন্ঠ শুনলে ভেতরটা এত অস্থির কেন হয়ে উঠে? কেন ছুটে পালাতে ইচ্ছে হয় সব ছেড়ে? কেন গলার ঠিক মাঝ বরাবর ভীষণ ভারী কি যেন আটকে থেকে তাকে দিনভর কষ্ট দেয়? 

.

অনুষ্ঠান শেষ করে অমিত বাসায় ফিরেছে একঘন্টা আগে। ঘরে ঢুকতেই দেখলো ড্রইংরুমে বসে বাসার মহিলা সদস্যরা লুডু খেলছে। বাবা বসে খেলা দেখছে। কারো সঙ্গে কথা না বলে, শুধু একটুখানি মুচকি হেসে নিজের ঘরে গেইট লক করে দিলো সে। মাঝে বাবা একবার বাইরে থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল রাতে খাবে কি না। দরজা না খুলেই ভেতর থেকে অমিত না করলো। আর কেউ ডাকেনি তাকে। এত খাটাখাটুনির পর ভীষণ ক্লান্ত সে। নিজের ঘরে হয়তো নিরিবিলিতে আরাম করতে চাইছে। লুডো খেলার পর্ব চুকিয়ে দশ মিনিট আগেই নিজেদের ঘরে গিয়েছেন এরশাদ-শামীমা। অনি, নাতাশা আর নবনী সোফায় ফ্লোরে এলোপাতাড়ি শুয়ে গল্প করছে। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এল অমিত। মুখ আড়াল করে মা বাবার ঘরে যাচ্ছে সে। পাশ থেকে তাকে ডাকলো নবনী, 

— “এ্যাই দাঁড়াও!” 

অমিত দাঁড়ালো না। মায়ের ঘরে যেতে যেতে বললো, 

— “এখন না প্লিজ!” 

নবনীও আর ডাকলো না। অনির দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো। শুকনো হাসি হেসে অনি বললো, 

— “ওর বোধহয় মন খারাপ। মন খারাপ হলে এমন মুখ লুকিয়ে বেড়ায়।” 

— “ওর কি বারো মাসই মন খারাপ থাকে?” 

— “ও খুব হাসিখুশি ছিল জানো! স্কুল কলেজের সবচাইতে বখাটে স্টুডেন্ট ছিল ভাইয়া। পড়াশোনায় যেমন তুখোড় ছিল, বাঁদরামিতেও ছিল তেমন। প্রিন্সিপাল প্রায়ই মা-বাবাকে ডাকতো, ওর কান্ড কারখানা বলতো। চলে আসার সময় এটাও বলতো, আপনাদের ছেলের রেজাল্ট অবিশ্বাস্য! তাইতো এখনো রেখে দিয়েছি। নয়ত কবেই টি সি দিয়ে বের করে দিতাম। পুরো ঘর মাতিয়ে রাখতো ও। আত্মীয়দের কোনো অনুষ্ঠান কখনো মিস করতো না। নিয়ম করে সবাইকে ফোন করতো। আমাদের নানু-দাদুর সবচাইতে প্রিয় নাতিটা ছিল ও। মন খারাপ কী জিনিস এটাই তো কখনো ও জানেনি। আমি জন্মাবার পর থেকে ভাইয়াকে কখনো দেখিনি মন খারাপ করতে। ভার্সিটিতে উঠে ভাইয়ার বাঁদরামি আরো বাড়লো। যখনই কেউ প্রেম করে বাসায় ধরা খেয়েছে, চলে আসতো ভাইয়ার কাছে। ও নিজ দায়িত্বে বিয়ে করাতো। এসব কিছুর পেছনে অবশ্য বাবার বিশাল হাত ছিল। মায়ের আদরের বাচ্চা তো ভাইয়া ছিলই। কিন্তু জগতের যত অঘটন আছে সেগুলোতে প্রশ্রয় দিতো বাবা। বলতো, করুক না! আমার ছেলে তো আর কারো ক্ষতি করছে না। একটু আধটু দুষ্টুমিতে কিচ্ছু হয় না। অমন আমিও একসময় করেছি। ভালোবাসলে মানুষ অসহায় হয়, বদলে যায় তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ হলো ভাইয়া। যেই বয়সে উথাল পাথাল প্রেম হওয়ার কথা ছিল সেই বয়সে হয়নি। যখন কিনা বিয়ে করে সংসার গড়ার বয়স হলো তখন এসে নিজেকে খুইয়ে প্রেমে মজে গেল। একটা নতুন মানুষ, আর ওর সবকিছু এলোমেলো! পরিবারের সবচাইতে মিশুক ছেলেটা নিজেকে আড়াল করে ফেললো। আমরা সবাই খুব মন খারাপ করতাম জানো! হঠাৎ করে কেন যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিলো ছেলেটা! ওকে কত জিজ্ঞেস করেছি, উত্তর না পেয়ো নিজেরা আলোচনা করে একটা হিসেব মিলাতে চেয়েছি, পারিনি। তবে আমার মা, খালারা আন্দাজ করেছিল ওর হয়তো কারো সঙ্গে প্রেম চলছে। কিন্তু প্রমাণ তো ছিল না কোনো। তারপর আট নয়মাস বাদে জানলাম ওর সত্যিই প্রেম চলছে। প্রেমিকার জন্য ও আমাদের সবাইকে এভাবে ভুলে যাবে এটা মেনে নেয়া যেন আরো কঠিন ছিল।’ 

— “অমিতের এই হিসেবটা না আমি মিলিয়ে পাই না জানো! প্রেম হতেই পারে। জীবনে নতুন মানুষ আসতেই পারে। তাই বলে আমার জীবনে বাকি যারা আছে তাদের সবাইকে ভুলে যেতে হবে?” 

— “জানি না আপু। মুনিয়ার ভালোবাসা কেমন ছিল, কিভাবে প্যাম্পার করতো তা তো আর আমরা জানি না। ভাইয়া ওসব শেয়ার করে না কখনো। তবুও মাঝেমধ্যে যখন ড্রিংক করে তখন একটু আধটু বলে আমাকে। আমি শুনি কিন্তু খুব একটা ফিল করতে পারি না। এমন প্যাম্পারিং সব সম্পর্কেই চলে। তাই বলে ও এভাবে ডুবে মরবে? গত আড়াইবছরে ভাইয়াকে আমি ঠিকমত হাসতে দেখিনি। যেই ছেলেটার কখনো মন খারাপ হয়নি সেই ছেলেটা মদ খেয়ে এসে বাসায় চিৎকার করে কাঁদে, মাসে অন্তত তিন চারদিন ওর চোখ ভেজা থাকে। কতদিন ও খেতে বসেও খেতে পারেনি। খাবার ফেলে উঠে গেছে। সারারাত না ঘুমিয়ে এঘর ওঘর করে কাটিয়েছে। চোখের সামনে একটা মানুষের মানসিক যন্ত্রণা কতক্ষণ আর মেনে নেয়া যায় বলো? ওকে বোঝাতে বোঝাতে আমরা ক্লান্ত। এতকিছুর পরও ও কেন মুনিয়াকে ভুলতে পারে না আমি ভেবে পাই না। কতদিন হয়ে গেল সেই আগের অমিতকে আমরা দেখি না। হাসিখুশি ছেলেটা একজনকে ভালোবেসে চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল।” 

দরজার হাতল চেপে কেউ ঘরে এল। মাথা তুলে তাকালেন দুজনেই। মায়ের পায়ের কাছে এসে অমিত বললো,

— “আমি তোমাদের মাঝে একটুখানি শুই?” 

তাড়াহুড়ো করে এরশাদ, শামীমা দুপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলেন। অমিত তাদের মাঝে এসে শুতেই শামীমা তার বুকে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। 

— “কী হয়েছে বাবা? শরীর খারাপ লাগছে?” 

— “না, এমনিই এলাম। ঘরে ভালো লাগছিল না।” 

ছেলেকে জড়িয়ে ধরে এরশাদ সাহেব বললেন, 

— “বল, তোর মন খারাপ। মায়ের কাছে এসেছিস মন খারাপের গল্প করতে।”

মায়ের হাত বুকে চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অমিত। বুকের ভেতর মোচড় কেটে উঠলো শামীমার। 

— “কী হয়েছে তোর?” 

— “আমার নিঃশ্বাস আটকে আসে আম্মু। সবকিছু এত এলোমেলো কেন? কোথাও কেউ ভালো নেই কেন? আমরা যাকে ভালোবাসি সে আমাদের হয় না কেন?”

— “শুধু একজনের ভালোবাসাতেই কী আসে যায় বল তো? তুই যাকে পেতে চাইছিস সেই মানুষটাও তোকে ভালোবাসতে হবে, তোকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পাবার ইচ্ছে থাকতে হবে।

— “নবনী যাকে ভালোবাসতো সেও নবনীকে ভীষণ ভালোবাসতো। তবুও কেন ওদের একটা সুন্দর সমাপ্তি হলো না?”

— “তুই আসলে কাকে নিয়ে ডিস্টার্বড বল তো আমাকে?” 

— “আমার রিলেশনটা নিয়ে ডিস্টার্বড তো ছিলামই, নতুন করে যোগ হয়েছে নবনী।”

— “শুনলাম তুই ওর সঙ্গে রাগ করেছিলি। কী নিয়ে বলতো?” 

— “একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। ওটা কিছু না, মিটে গেছে। কিন্তু মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্লিয়ার হওয়ার পর থেকে আমি খুব ডিপ্রেসড ফিল করছি। এত লক্ষ্মী একটা মেয়ের জীবনটা এমন এলোমেলো কেন হবে আম্মু? ছেলেটাকে হারিয়ে ও নিজেকে হারিয়ে ফেললো। একটা কল্পনার জগতে ও বেঁচে আছে। উপরওয়ালা কি জানতো না এই ছেলেটাকে নিয়ে গেলে নবনী শেষ হয়ে যাবে? অবশ্যই জানতো। তবুও কেন নিয়ে গেল ওকে?” 

— “উপরওয়ালার সিদ্ধান্তে আমরা আপত্তি করার কে, বল তো?” 

— “নবনী মেয়েটা খুব ভালো, স্নিগ্ধ, সরল। আমার ভীষণ পছন্দ ওকে। সবার আড়ালে ও যেই রোগটা পেলে পুষে রেখেছে, ও একটা অস্বাভাবিক জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে এই ব্যাপারটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না আম্মু। ওকে ট্রিটমেন্ট করালে হয়তো সমস্যাটা আর থাকবে না। কিন্তু এখন যেই হাসিখুশি ফড়িং স্বভাবের নবনীকে দেখতে পাচ্ছি সেই নবনীকে আর কখনো দেখতে পাবো না। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুটা তখন ওর কাছে পৃথিবীর সবচাইতে কুৎসিত সত্য হয়ে প্রকাশ পাবে। তখন ওর নিঃশ্বাসটা হয়তো চলবে, ভেতরটা ঠিক মরে যাবে। ঐ নবনীকেও আমি দেখতে চাই না আম্মু। একজনকে ভালোবেসে নিজে শেষ হয়ে গেল অথচ এই মেয়েটাই আমার সবচেয়ে খারাপ সময়টাতে আমাকে ঠিক সামলে নিলো। ঐ মুহূর্তে নবনী আমার সঙ্গে না থাকলে হয়তো আমি ঠিক কিছু একটা করে ফেলতাম। মুনিয়া অন্য ছেলের সঙ্গে এত ক্লোজ… আমি নিজ চোখে এসব দেখে বাঁচতে পারতাম না আম্মু। ধুর! আমিও কী বোকা! নবনীর সমস্যাটাই তো বললাম না তোমাকে।”

— “জানি আমরা।”

— “তোমরা জানো আব্বু! তাই? আমি যেই সমস্যার কথা বলছি সেটার কথাই কি তোমরা বলছো?” 

— “নবনীর হ্যালুসিনেশনের কথা বলছিস তো?” 

— “হ্যাঁ!” 

— “জানি আমরা। কথা গুলো নবনীকে বাসায় আনার আগেই ভাবী আমাদের বলতে চেয়েছিল। আমরাই শুনতে চাইনি। ভাবী আড়াল করতে চাননি ব্যাপারটা। নবনী এই বাসায় আসার পর ভাবী একদিন আমাদের উনার বাসায় ডেকেছিল, তখনই জেনেছি।” 

— “কই আমাকে বলোনি তো?” 

— “ইচ্ছে করেই আমরা বলিনি। ভেবেছিলাম যাক আরো কিছুদিন, তারপর নাহয় বলবো।” 

— “ওর জন্য আমার কিছু করতে ইচ্ছে হয় আব্বু। কী করবো আমি? নিজেকেই বা কী করবো? মুনিয়াকে আগের মত মনে পড়ে না, ওভাবে ফিল করি না। কিন্তু মাঝেমধ্যে খুব মন খারাপ হয় নিজের জন্য। ওকে আমি এত ভালোবাসলাম অথচ ও আমার হয়ে রইলো না। সবাইকে ছেড়ে দিয়েছি শুধু ওকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে তবুও ধরে রাখতে পারিনি। নিজেকে খুব হেরে যাওয়া মানুষ মনে হয়। ওর কল এলেই মাথায় যন্ত্রণা হয়। মনে হয় কেউ বুঝি আমার গলাটা চেপে ধরেছে। ভেতরে ভেতরে আমি মরে যাচ্ছি। আমি এসব থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।” 

— “ঐ মেয়েটা তোকে কল করে?” 

— “হ্যাঁ তিনদিন যাবৎ প্রতিদিন কল করছে।” 

— “কী চায় ও?” 

— “দেখা করতে চায়।” 

— “ও তোকে ছাড়বেও না, ধরেও রাখবে না।” 

ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শামীমা বললেন, 

— “অমিত, তোকে কিছু কথা বলি বাবু?” 

— “বলো না! কথা বলতেই তো এলাম।”

— “তোর পছন্দ হবে না হয়তো। আবার এই মুহূর্তে এই ব্যাপারে কথা বলাও উচিত না। কিন্তু বলতে চাইছি কথাগুলো, সময়ের প্রয়োজনেই বলছি।” 

— “হুম?” 

— “নবনীর জন্য কিছু করতে চাইছিস, নিজেকেও সামলে নিতে চাইছিস। খুব সহজ একটা সলিউশন দেই তোকে। নবনীকে খুব কাছের একজন ভাবিস তো, তাই না?”

— “হুম খুব। বলতে পারো ও আমার কমফোর্ট জোন।” 

— “মুনিয়াকে নিয়ে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে মনের ভেতর সেটা ওর সঙ্গে কেন শেয়ার করছিস না?” 

— “নবনীর সঙ্গে আর কী শেয়ার করবো আম্মু? ওর অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ।”

— “হ্যাঁ খারাপ। কিন্তু এর আগে ও কি কখনো তোকে সামলে নেয়নি? আমরা যা পারিনি সেটা কিন্তু ও পেরেছে। এবারও তোকে ও সামলে নেবে। আর তুই নাহয় ওকে সামলে নিস।

— “আমি! কিভাবে?” 

— “তোর বান্ধবীকে তুই কিভাবে সামলে নিবি সেটা তুই ভালো জানিস। আমি জানবো কেমন করে?” 

— “যদি না পারি? হীতে বিপরীত হয়?” 

— “হলে হবে। সেটাও সামলে নিবি। বন্ধুর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হবে, মতের অমিল হবে আবার দ্বন্দ্ব মিটেও যাবে। বন্ধুত্ব এমনই তো হয়, তাই না?”

— “হুম।”

— “এবার আসল কথায় আসি?” 

— “বলো।” 

— “নবনী শুধুই তোর বান্ধবী না, ও তোর বিয়ে করা বউ। তোর…” 

— “আম্মু!” 

— “জানতাম চিল্লাপাল্লা শুরু করবি।” 

— “করবো না! ওকে আমি ভাবি নাকি তেমন কিছু?” 

— “ভাবিস না কেন? এখন কী বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তোদের মাঝে? না সামি বেঁচে আছে, না মুনিয়ার সঙ্গে তোর সম্পর্কটা আছে।” 

— “না থাকুক। তাই বলে নবনীকে নিয়ে সংসারের কথা ভাববো! ও শুনলে আমাকে কী ভাববে বলো তো?” 

— “ও কী ভাববে সেটা নিয়ে আপাতত জানতে চাই না। তুই কী ভাবছিস কিংবা কেন ভাবছিস না আমি সেটা জানতে চাই।” 

— “ধুর! ওর সঙ্গে কিভাবে কী? আমার মাথায় ওসব একদমই আসে না আম্মু! নবনীকে আমার খুব ভালো একজন বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। আমার খেয়ালে আসেইনি কখনো সে কথা।” 

— “খেয়ালে না আসুক তাতে কী? সত্যিটা বদলে যাবে? পরিস্থিতি যেমনই হোক, বিয়েটা তো হয়েছিল। তুই ওকে বিয়ে করেছিস এই সত্যিটা কখনো বদলে যাবে না। নবনী তোর বউ এটাও কখনো অস্বীকার করতে পারবি না।” 

শামীমা উত্তর দেবার আগেই এরশাদ বললেন, 

— “তুমি কী চাইছো বলো তো আমাকে?” 

— “কী আবার চাইবে? তুই নিজের মুখেই বললি নবনী তোর কমফোর্ট জোন। ভীষণ পছন্দ ওকে। ওকে তোর মা আর আমারও ভীষণ পছন্দ তোর বিয়ের আগে থেকেই। খুব করে চেয়েছিলাম এই মেয়েটা তোর বউ হয়ে আসুক। সবদিকেই মেয়েটা পার্ফেক্ট। যদিও বিয়েটা খুব খারাপভাবে হয়েছে তবুও আমরা খুশি। পছন্দের মেয়ে বউ হয়ে এলে কে না খুশি হয় বল তো! বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে এবার তোদের একটা সংসার হলে কিন্তু মন্দ হয় না।”

— “তার মানে আম্মু আর তুমি এটাই চাইছো?” 

— “হ্যাঁ।”

— “আব্বু অলরেডি মাথায় শ’খানেক ঝামেলা লেগে আছে। মাঝে এসব বলে আমার মাথাটা আর খারাপ করে দিও না।

— “তোর মা সলিউশন তো দিলোই! মুনিয়া আর তোর সম্পর্কটা নিয়ে যা কিছু মনের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছিস তা নবনীকে দিয়ে দে। ও তুড়ি বাজিয়ে তোর মাথা থেকে ভূত নামিয়ে দেবে। আর নবনীকে নিয়ে যে কষ্টটা পাচ্ছিস সেটা নিজের কাছে রেখে দে। এটা তুই সামলাবি। ওকে তুই ভালো না বাসতে পারিস, সংসার করার ইচ্ছে না-ই হতে পারে। কিন্তু যতদিন ও তোর বউ হয়ে আছে ততদিন ওর ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তোর। নিজের দায়িত্বগুলো অন্তত ভালোভাবে পালন কর।” 

.

মা-বাবাকে আর কিছুই বলছে না অমিত। নাক মুখ কুঁচকে চুপচাপ শুয়ে রইলো সে। তাদের মুখে “নবনী তোর বউ” কথাটা শুনতে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে অমিতের। নবনী এসব শুনলে কী একটা কেলেংকারী ঘটে যাবে! মুখ দেখাবে কেমন করে ওকে? ছিঃ।

৩৩

গতকাল বিকেলে কক্সবাজার এসেছে ওরা চারজন। উদ্দেশ্য, আজ সকাল সকাল মহেশখালির দিকে রওয়ানা হওয়া। আটটার দিকে কক্সবাজার থেকে নাস্তা সেড়ে স্পিডবোটে মহেশখালী এসে পৌঁছেছে ওরা। সূর্য ঠিক মাথার উপর চড়তে চড়তে মহেশখালী জেটি থেকে শ্যুটিং ব্রিজ হয়ে আদিনাথ মন্দির ঘুরা হয়ে গেছে। মন্দির থেকে বেরিয়ে পাশ দিয়েই বেয়ে উঠেছে পাহাড় চূড়ায় উঠার সিঁড়ি। আশপাশটা বেশ নির্জন। মানুষের আনাগোনা তেমন দেখা যাচ্ছে না। একটুখানি গা ছমছম করলেও ভীষণ ভালো লাগছে নবনীর। এ পর্যন্ত কয়েকবার কক্সবাজার এলেও এদিকটাতে কখনো আসা হয়নি। সমুদ্রের গভীরে কখনো আসা হয়নি। হাঁটু পর্যন্ত পানিতে নামলেই মায়ের চেঁচামেচিতে আবার ফিরে আসতে হয়েছে। নাতাশা কতবার বায়না করেছিল সমুদ্রে বোট নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াবে। বাবা-মা কেউই রাজি হলো না! আদিনাথ জেটির ওপাশটা অনেকটা সুন্দরবনের মতই। নদীর ধারে, কাঁদা পানির উপর ম্যানগ্রোভ জাতির গাছ, জঙ্গল দেখে নাতাশা বলছিল, অমিত ভাইয়া মহেশালী দেখাতে নিয়ে এসেছে নাকি সুন্দরবন! দুই চারটা বাঘ হাতিরই যা কমতি। ওগুলো হলেই ষোলোকলা পূর্ণ হতো। 

অনিও কখনো আসেনি এর আগে। বাচ্চাদের মতন ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে ঘুরছে, অসীম কৌতুহলে এদিক ওদিক দেখছে, ছবি তুলছে, খিলখিল করে হাসছে, গল্প করছে। এই নিরিবিলি পাহাড়ি পথ, পাহাড় জুড়ে ছোট বড় গাছ, ঝলমলে রোদের দিন, শরৎ এর মতন ঝকঝকে আকাশ আর কিশোরী মেয়ের মতন আনন্দে মেতে উঠা কুড়ির ঘর পেরোনো দু’টো মেয়ে সব মিলিয়ে আজকের সময়টা ভীষণ সুন্দর! অমিত আর নবনী ধীর পায়ে একটু আধটু গল্প করতে করতে উপরে উঠছিল। হঠাৎ নাতাশা অনি উপর থেকে “অমিত ভাইয়াআআআআ” বলে চিৎকার করে নেমে এসে দুপাশ থেকে অমিতকে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ চিৎকারে ঘাবড়ে গেল অমিত-নবনী দুজনই। ওদের ভয় পাওয়া চেহারা দেখে সজোরে হেসে উঠলো নাতাশা, অনি। নবনী কিঞ্চিৎ বিরক্তি হয়ে বললো, 

— “হাসছিস কেন? কী হয়েছে তোদের?” 

অনি বললো,

— “আমরা তো ভাইয়াকে থ্যাংকিউ বলতে এসেছিলাম। কতদিন পর পাহাড়ে এসেছি জানো!” 

অনি নাতাশা একসঙ্গে অমিতকে, থ্যাংকিউ ভাইয়া বলেই আবারও হাত ধরাধরি করে উপরে ছুটতে লাগলো। দুজনের কান্ডে হাসলো নবনী। অমিতকে বললো,

— “ওরা দুজন খুব খুশি হয়েছে।” 

— “তুমি হওনি?” 

— “উমমমম… হ্যাঁ খুশি আমিও হতাম কিন্তু হতে পারছি না।”

— “কেন?”

— “যে আমাকে নিয়ে এল আমার রাগ ভাঙাতে তার মনটাই যে ভালো নেই!” 

নবনী তাকিয়ে আছে অমিতের চোখে। ওর চোখে চোখ মেলাতে পারছে না অমিত। মাথা নিচু করে বিষন্ন হাসলো সে। 

— “মন খারাপ কেন বলবে না আমাকে?”

— “মুনিয়া কল করছে তিনদিন যাবৎ।” 

— “হ্যাঁ করছে। তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমাকে কল করবে না?” 

— “নবনী! আমি ওর সঙ্গে রিলেশনটা আর কন্টিনিউ করছি না তুমি জানো না?”

— “সেদিন না কথা বললে?” 

— “কথা বলেছি বলেই কি ভেবে নিবে ওর সঙ্গে আমার সুন্দর সম্পর্ক যাচ্ছে?” 

— “হোটেলে মিট করতে চাইলো তাই ভাবলাম সম্পর্কের মধুমাস চলছে। তার উপর তুমিও তো বললে ঢাকা ফিরে দেখা করবে।”

— “হ্যাঁ বলেছি। কেন বলেছি জানি না।” 

— “দেখা করতে ইচ্ছে হয় ওর সঙ্গে?” 

— “ইচ্ছে হলে ওকে হোটেলেই আসতে বলতাম।” 

— “কী ইচ্ছে হয় তাহলে?”

— “শান্তিতে বাঁচতে ইচ্ছে হয়। সুখী হতে ইচ্ছে হয়। মন খারাপের বোঝা টানতে টানতে আমি ক্লান্ত।”

— “মুনিয়াকে নিয়ে?” 

— “একদম না। আপাতত কাউকে আমার জীবনে আমি চাইছি না। একা নিজের মতন করে আনন্দে বাঁচতে চাই।” 

— “মুভ অন করতে চাও কিন্তু ওকে ভুলতে পারছো না তাই তো?” 

— “ভালোবেসে ওকে মনে করছি ব্যাপারাটা কিন্তু তেমন না। আমাদের সুন্দর সময়গুলো এখন আমার মনে পড়ে না। মনে পড়ে ওর সঙ্গে আমার তিক্ত স্মৃতিগুলো। আমার জীবনের সবচাইতে বাজে আড়াই বছর। মুনিয়াকে আমি ঘৃণা করি না। আবার ভালোবাসাও নেই। মানে, ওকে নিয়ে কিছুই ফিল করি না। আফসোস যা হওয়ার নিজের জন্য হয়। এমনিতে নিজেকে সামলে নিতে পারি, কাজে মন বসাতে পারি। কিন্তু যেই মুহূর্তে ও আমাকে কল করে আমি জাস্ট এলোমেলো হয়ে যাই। নিজেকে উন্মাদ মনে হয়। কোনোকিছুই আমি করতে পারি না। কাজে বারবার ভুল হয়। নিজের ভুলগুলো এক এক করে মাথার ভেতর ছুটতে থাকে। মুনিয়ার জন্য সব ভুলে গিয়েছিলাম। সব ছেড়ে শুধু ওকে ভালোবেসেছি। আমার মতন করে এত ভালো ওকে কে বাসতো নবনী? তবুও ও আমাকে ভালো কেন বাসলো না? এত ভালোবাসা ও ফিরিয়ে দিলো কেমন করে? আমার হিসেব মেলে না নবনী! কিছুতেই মেলে না।”

— “শুনেছি ভীষণ হাসিখুশি মানুষ ছিলে তুমি। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু নিয়ে মেতে থাকা প্রাণবন্ত একটা ছেলে। অথচ তোমাকে আমি ঠিকঠাক হাসতেই দেখি না। বন্ধুদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ করতে দেখি না। আত্মীয়দের সঙ্গেও না। এমন কী করে হয়ে গেলে অমিত?” 

— “ভালোবেসে নবনী। বহুবছর আগে এক বন্ধুর পাগলামি দেখে বলেছিলাম, ভালোবেসেছিস ভালো কথা। তাই বলে নিজেকে শেষ করে ফেলতে হবে? ও বলেছিল, যে ভালোবাসে সে তো ভালোবাসার মানুষটার মাঝেই শেষই হয়ে যায়। বেঁচে থাকে নাকি? বুঝিনি তখন ওর কথাগুলো। আর আজ এত বছর পর সেই জায়গাটাতে আমি দাঁড়িয়ে।” 

— “তোমার বন্ধুর পাগলামি কেমন ছিল আমি জানি না। তবে তোমার ব্যাপারটা ভিন্ন। এত ভালোবাসতে যেই পরিবারকে, বন্ধুদের তাদেরকে শুধু একটা মেয়ের কারণে ভুলে যাবে এই ব্যাপারটা আমি ঠিক মানতে পারি না। মুনিয়া তোমাকে আর ভালোবাসে না এই সত্যিটা তোমার চোখের সামনে ছিল, ওর অবহেলা তোমাকে একটু একটু মেরে ফেলছে তাও তুমি বুঝতে পারছিলে তবুও কেন তুমি ওর কাছ থেকে সরে আসোনি অমিত? এত অপমান মাথায় নিয়ে ভালোবাসাহীন একটা সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর মানে কী? নিজের উপর এতটা অবিচার না করলেই কি হতো না?” 

কথা বলতে বলতে পাহাড়চূড়ায় এসে থামলো দু’জন। অমিতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে নিলো নবনী। 

— “তোমার মন খারাপের গল্প তুমি নিজে এসে আমাকে কেন বলো না অমিত? সবসময় আমাকেই কেন জিজ্ঞেস করতে হবে? বলেছি না একবার, যে কথা তোমাকে কষ্ট দেয় সেটা কখনো পেটে চেপে বসে থেকো না। আমাকে বলবে। যখন খুশি তখন আমাকে ডেকে বলবে। আমি আছি তো কথা শোনার জন্য।” 

— ……………………

— “কেমন বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে দেখো! শোনো ছেলে, জীবনটা অনেক লম্বা। এই লম্বা জীবনে আমরা একটা দুইটা ভুল করবো না, দুঃখ পাবো না, আমাদের সঙ্গে প্রতারণা হবে না সেটা কী করে হয়? সবকিছুর একটা এক্সপেরিয়েন্স থাকার দরকার আছে না, বলো? শুধু সুখ, ভালোবাসা, সাকসেস নিয়েই এক জীবন কাটিয়ে দিবে কিন্তু দুঃখ, অবহেলা, অপ্রেমের মতন ইম্পর্ট্যান্ট ফিলিংসগুলোর সঙ্গে কখনো তোমার আলাপ পরিচয় হলো না; এই জীবনটাকে কিন্তু ঠিক জীবন বলা চলে না। এমনটা হলে আক্ষরিক অর্থে একটা মানব জীবন তুমি পেলেই না। যা পেলে তা শুধু ভ্রম কিংবা সুখের একটা স্বপ্ন। বলবো না মুনিয়াকে তুমি ভুলে যাও। কাউকে কখনো চিরতরে ভুলে থাকা যায় না। বরং মুনিয়া তোমার স্মৃতিতে থাকুক। ওর সঙ্গে কাটানো সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো, মন্দ সময়গুলো সবটাই থাকুক তোমার স্মৃতিতে। নিজের জীবনের মূল্যবান সাড়ে চারবছর ওকে তুমি দিয়েছো। ভুলে গেলে চলবে নাকি? আমি বলবো ওকে স্মৃতিতে রেখেই আনন্দে বাঁচো, সুখে থাকো। সেইবার মুনিয়াকে আগলে রাখতে গিয়ে পরিবার, বন্ধু হারিয়েছিলে। এবার নাহয় নিজেকে ফিরে পেতে ওদেরকে কাছে টেনে নাও। ভুল কী হলো, ভালোবাসা কেন পেলে না এসব ভাবনায় বসে থেকে এখন যে সময়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে তা নিয়ে ভেবেছো একবার? যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার এসব চিন্তা থেকে বেরিয়ে নতুন করে জীবন নিয়ে ভাবো। নিজেকে সময় দাও, কাছের মানুষের পাশে বসে কথা বলে সময় কাটাও। বেড়াতে যাও, বন্ধুদের সঙ্গে গেট টুগেদারে যাও। নিজের সুখের সবটা খুঁজে নাও, তাতেই বাঁচো।”

— “যদি ওরা আর আমাকে কাছে না টেনে নেয়?” 

— “নেবে। যেই অমিতের গল্প চাচী অনি আমাকে শোনায় সেই অমিত কারো অভিমান ভাঙাতে পারবে না এমনটা হতেই পারে না। মাথার উপর সূর্য তার আপন তেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। উঁচু গাছগুলোর পাতা বাতাসে দুলে সুর তুলছে। সেই একই বাতাসে উড়ছে নবনীর চুল। মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে অমিতের চোখে। ঠোঁটের কোণে তার মিষ্টি হাসি। নবনীর চোখে আশ্রয় খুঁজে পায় অমিত, হাসির মাঝে স্বস্তি। 

৩৪

— “ভালোই কাটলো তোমার এই তিন চারদিন। কাল থেকে আবার কারখানায় ছুটোছুটি।”

— “ছুটোছুটিই ভালো। তিন চারদিন আরাম করে গায়ে আলসেমি ধরে গেল।”

“এত ছুটোছুটিও কিন্তু ভালো না রোদ্দুর। ত্রিশে পা রেখেছো। এবার শরীরটাও দেখতে হবে। অতিরিক্ত স্ট্রেস নিলে ডায়বেটিস, ব্লাড প্রেশার সব একসঙ্গে গায়ে বাসা বাঁধবে।” 

— “এখন জমিয়ে কাজ করছি। পনের বছর পর আর করবো না।”

— “তারপর বসে বসে খাবে?”

— “হ্যাঁ। এই বাসায়, এই শহরে আমি আর থাকবো না। চলে যাবো দূরে। দূরে কোনো মফস্বলে অনেকখানি জায়গা কিনবো। চার-পাঁচটা রুমের বাড়ি করবো। বাড়ির একপাশে থাকবে ফলের বাগান, অন্যপাশে করবো ফুলের বাগান। শিউলি, কাঠগোলাপ, কামিনি, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া। বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন থাকবে। বৃষ্টি হলে উঠোনে দাঁড়িয়ে ভিজবো, জোৎস্না নামলে মোড়া পেতে বসবো। পুকুর থাকবে একটা। ঘরে ফার্নিচার খুব একটা রাখবো না তবে মনের মতন করে সাজাবো। দেয়ালের রঙ হবে তোমার পছন্দে। ঘরে কোথায় কোন ফার্নিচারটা বসবে সেটা ঠিক করবো আমি। আমাদের আলাদা একটা পৃথিবী হবে সামি। আমরা সারাদিন গল্প করবো, বাগানে পুকুরে ঘুরে বেড়াবো। তখন আর কাজ টাজ করবো না। করবো শুধু সারাদিন তোমার সঙ্গে প্রেম। এতকিছু করতে, শেষ বয়সটা একা কাটাতে টাকার দরকার আছে না বলো? এমনিতে এই কয়বছরে ব্যাংকে ভালোই জমিয়েছি। কিন্তু এতটুকুতে হবে না। আরো অনেক প্রয়োজন।” 

— “তুমি এতকিছু প্ল্যান করে রেখেছো? কই আমাকে বলোনি তো কিছু!”

— “বলিনি, আজ বললাম।” 

— “তবুও প্লিজ নিজের খেয়াল রেখো।” 

— “খেয়াল রাখার জন্য আছে তো তুমি! এবার শোনো…” 

মধ্যরাতে বাস ছুটছে নোয়াখালীর পথ ধরে ঢাকার দিকে। স্লিপিং কোচ সার্ভিসের বাসটায় অনেকেই ঘুমিয়ে গেছে। কেউ কেউ জেগে ফেসবুক স্ক্রলিং-এ ব্যস্ত। নবনীর চোখেও ঘুম নেই। সে ব্যস্ত সামির সঙ্গে গল্প করতে। ঘুমায়নি অমিতও। নবনীর ঠিক পেছনের সিটটাতেই বসে আছে সে। মেয়েটা নিচু স্বরে কথা বলছে সামির সঙ্গে। খুব মনোযোগে সেই গল্প শুনছে সে। এর আগে কখনো সে শোনেনি সামির সঙ্গে নবনীর কথোপকথন। আজই প্রথম! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে অমিতের। 

.

সবকিছু গোছগাছ করে নিজের ঘরে এলেন শামীমা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা ঠিকঠাক করে, বাতি নিভিয়ে বিছানায় এলেন। এরশাদ সাহেব ডাকলেন তাকে, 

— “অমিতের আম্মু…” 

— “হ্যাঁ?” 

— “একটা কথা কবে থেকেই জিজ্ঞেস করবো করবো করে করা হচ্ছে না।” 

— “কী কথা? বলো না! 

— “সব মায়েরাই ছেলের জন্য নিখুঁত মেয়ে খোঁজে। যদিও নিখুঁত মানুষ পৃথিবীতে নেই তবুও খোঁজে। তোমার ছেলের বউটা নিখুঁত না, বিশাল এক খুঁত তার মাঝে আছে তা জেনেও ওকে মেনে নিতে তোমার কষ্ট হয়নি বা কোনো দ্বিধা জাগেনি মনে?” 

— “কষ্ট হলে তোমাকে বলতাম না?” 

— “হ্যাঁ তা বলতে। জানি আমি, নবনীকে তুমি ভীষণ পছন্দ করো। বরং প্রথমদিনের চেয়ে এখন আরো অনেক বেশি পছন্দ ওকে। কিন্তু তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছে। নবনী ঐ ছেলের মাঝেই বেঁচে আছে, কখনো সুস্থ হবে কি না আমরা জানি না। যদি ও কখনো সামির মাঝ থেকে বেরিয়ে না আসতে পারে? যদি কখনোই আমাদের ছেলের সঙ্গে ওর সংসার না হয়? অমিতের জীবনটা অপূর্ণই রয়ে যাবে, ওর জীবনে ডিভোর্সের দাগ রয়ে যাবে সেসব ভাবনা কখনো এসেছে মনে?” 

— “একদম আসেনি তা না। ভাবী প্রথম যেদিন বললো নবনীর কথা আমি রীতিমতো অথৈ সাগরে পড়ে গিয়েছিলাম। ও আমার ছেলের বউ সে কারণে না। অমিতের সঙ্গে ওর বিয়ে না হলেও আমি নবনীকে নিয়ে ভাবতাম। ওকে দেখে বুঝার উপায় আছে ও এমন একটা রোগ পেলেপুষে রেখেছে ভেতরে?” 

— “আমার প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি। ভাবীকে খুব সন্দেহ হচ্ছিল আমার। ভেবেছিলাম অমিতের সঙ্গে এই বিয়েতে উনার মত নেই তাই এসব বলছে বিয়েটা ভাঙার জন্য।”

— “কিসব যে সন্দেহ করো না অমিতের আব্বু! তেমন কিছুই না। ভাবী আমার ছেলেকে খুব পছন্দ করে। তুমি খেয়াল করেছিলে কিনা আমি জানি না। নবনীর ব্যাপারটা জানার পর সেদিন সারারাত আমি জেগে ছিলাম। ঘুম হয়নি আমার। ওকে নিয়ে ভেবেছি, আমাদের ছেলেকে নিয়ে ভেবেছি। এতদিন আমরা সবাই আশায় ছিলাম নবনীর জীবনে আপাতত কেউ নেই। সুতরাং একসঙ্গে থাকতে থাকতে স্বামী সংসারের প্রতি মায়া মমতা হয়েই যাবে ওর। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই উল্টে গেল। এই সংসারে নবনীর মন বসবে কি না সেটা নিয়ে একটা ভয় ঢুকে গেল মনে। যতই ভাবি ততই শুধু বাজে খেয়াল আসে। ওর অসুখটা বাদে আর কোনো খুঁত আমি দেখি না অমিতের আব্বু। ও যা করলো আমার জন্য, অমিতের জন্য এইসব আমি ভুলবো কী করে? মেয়েটা অমিতের জীবনে এসেও চলে যাবে, আজীবন আমার ছেলের হাত ও ধরে রাখবে না এটা আমি মেনে নিবো কেমন করে? আবার ওদিকে অমিতেরও কোনো ঠিকঠাকানা নেই। এক মুনিয়া নিয়ে ডুবেছে তো ডুবেছেই। নিজের একটা জীবন আছে সেদিকে খেয়াল নেই। কী যে দিশেহারা একটা রাত পার করেছি আমি। আমার শুধু কান্না পাচ্ছিলো সেদিন।”

— “আমাকে ডাকলে না কেন?” 

— “ডাকবো ডাকবো করেও ডাকিনি। ডেকে কি বলতাম তোমাকে? মনের ভেতর কী চলছে কিচ্ছু বুঝিয়ে বলতে পারতাম না। অশান্ত মন নিয়ে কিছু বলা যায় নাকি?” 

— “তারপর? মন শান্ত হলো কেমন করে?” 

— “ভাবতে ভাবতেই একটা ব্যাপার মাথায় এল। অমিত নবনীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না। একদম অসম্ভব ছিল। অমিত মুনিয়াকে ফেলে কাউকে বিয়ে করবে এটা কল্পনাও করা যায় না। কিংবা নবনী? ও অন্য কাউকে বিয়ে করবে সেটা সম্ভব না। তবুও তো হলো! আমাদের চাওয়াটাই সবকিছু না। ভাগ্যে থাকাও জরুরি। ওদের জোড়া বাঁধা ছিল ভাগ্যে। তাই বিয়েটা হলো। সংসারটাও ভাগ্যের জোরে হয়ে যাবে দেখে নিও।” 

— “আচ্ছা তাহলে তুমি কনফিডেন্ট ওদের সংসার টিকে যাবে?” 

— “হ্যাঁ। নয়তো ওদের বিয়েটাই হতো না। আচ্ছা একটা কথা বলো তো?”

— “কী?” 

— “এতরাতে হঠাৎ এসব কেন জিজ্ঞেস করছো?”

— “এমনিই। সব জেনেও নবনীকে খুব সহজে মেনে নিলে তাই। সেদিন সব জানার পর বাসায় যখন ফিরছিলাম বেশ দ্বিধায় ছিলাম তোমাকে নিয়ে। কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে বুঝতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম নবনীর সঙ্গে তুমি হয়তো আর কখনো সহজ হতে পারবে না।” 

— “তোমার ঘর করছি এতবছর হয়ে গেল অথচ আজও আমাকে চিনলে না অমিতের আব্বু! অনি আর নবনীকে আমি আলাদা ভাবি না। ওর জায়গায় আমার অনি যদি এসব সাফার করতো, আমার মেয়ের জন্য তখন আমি যতটা কষ্ট পেতাম নবনীর জন্য আমি ঠিক ততটাই কষ্ট পাই।” 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *